নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইবনে শামস

রায়হানা তনয় দা ফাইটার

আমি। কেউ না। তবে মাঝে মাঝে আমার দুষ্ট মনটা কানে কানে এসে বলে, তুমি মহাকালের উচ্ছল সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো এক কচুরিপনা । কালের ঊর্মিমালার সাথে সাথে নাচা ছাড়া তোমার আর কোন কাজই নেই.....

রায়হানা তনয় দা ফাইটার › বিস্তারিত পোস্টঃ

অবেলার অবসরে...

০৬ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ১০:৩২



এক

“স্বপ্ন সবাই দেখে। স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করেনা এমন মানুষ পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।..........” দিদি আরও কত কিছুই না বলে চলেছেন অশ্রুভেজা কন্ঠে। কিন্তু আমি আছি আমার চিন্তাই বিভোর। কিভাবে স্কুল থেকে শিক্ষা সফরে যাওয়ার টাকা জোগাড় করা যায়? আমি ভয়ে ভয়ে বল্লাম। মেঝদি, এসব পরে শুনব। তুমি আমাকে পাঁচশ টাকা দিতে পারবে? শিক্ষাসফরে যাব। দিদি মুখ কালো করে বল্লেন- আমি তোর কাছে কারণ জানতে চেয়েছি? যা, ওখান থেকে আমার হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে আয়। দিদি আমার হাতে চকচকে একটা পাঁচশ টাকার নোট গুজে দিলেন। আমি টাকা পেয়ে ভুঁ দৌড়ে বেরিয়ে আসতে আসতে কানে বাঁজছে। দিদি বলছেন, “নিজের খেয়াল রাখিস। সাবধানে চলিস। বাজে খরচ করিস না। ..... ” এসব বড়তোতো কথা। এগুলো বড়দের একান্ত সম্পত্তি তাই বড়তোতো বল্লাম।

আমার এই একটাই দিদি, যে আমার সকল আবদার বিনা বাক্যব্যয়ে পূরণ করে। কখনও বলেনি কেন? এরকম করলি কেন? এসব কর্তৃত্বমূলক প্রশ্ন। সবসময় শুধু একটা কথা বলতো। ভাল থাকিস। মায়ের আশাটা পূরণ করবিতো? আমি হ্যাঁ বলে চলে আসতাম। আজ তার চিরচেনা বাক্যটা আমাকে কেন বলেনি বুঝলাম না? এই দুইটা কথাতে হয়তো আমার জীবন পরিচালনার নির্দেশিকা নিহিত। তাঁকে আমি শ্রদ্ধা ও আদর করে ‘মেঝদি’ বলি। সেও আমাকে আদর করে ছোট বলে। মাঝে মাঝে খোকাবাবু। সে সবসময় মাকে বলে, তোমার ছেলেদের মধ্যে দেখিও ছোটই তোমার সব দুঃখ র্দূদশা ভাগিয়ে দিবে। এনে দিবে সুখের প্রহর। মাও সাহস করে মাথা নাড়ে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, হয়তোবা?

দিদি এখন অনার্স করছে। ৩য় বর্ষে। অত্যন্ত মেধাবী। পাশ করার পর বাবা ছাড়া সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর কথা ভাবছিলো। বাবা নারাজ থাকাতে দিদিও আর ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি ভাল করে নেয়নি। তাই ভর্তিও হওয়া হলো না। পরে সবাই দিদিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কলেজে অনার্স শেষ করতে বললো। দিদিও মেনে নিল। শহরে এসে ভাল কলেজে ভর্তি হল ঠিক কিন্তু থাকার কোন ব্যবস্থা হয়নি। কারণ মা-বাবা গ্রামে। আমরা ভাইরা বড় আপুর বাসায় থেকে পড়া-লেখা করি। একজনের উপর আর কত ভার চাপানো যায়। তাই মেঝদির ওখানে থাকা চলবে না। এমনটাই বলেছে বাবা। বড় আপু আমাদের জন্য যার পর নায় কষ্ট করেন। মা সবসময় কলতেন, যদি তোমরা শরীরের চামড়া দিয়ে শিশিরের জুতা বানিয়ে দাও, তবু তাঁর ঋণ শুধ হবে না। আমরাও একথা খাড়া পায়ে মেনে নিই। শিশির আমাদের বড় দিদি। আপুর স্কুলে কোন অনুষ্টানে কোন নাস্তা দিলে তা তিনি না খেয়ে আমাদের জন্য নিয়ে আসতেন। তাঁর মেয়েদের পর্যন্ত আমাদের সাথে ভাগ করে দিতেন। একা কখনও তাঁর ছেলেদের নিয়ে খেতেন না। অনেকবার এ ঘটনা ঘটেছে।

অনেক কষ্টে মা-বাবা মেঝদির জন্য একটা স্কুলে চাকরি ঠিক করেছেন। দিদি স্কুলের হোস্টেলে থাকবে। হোস্টেলে যাওয়ার সময় দিদি আমাকে বার বার করে বলে গেলেন, বড় আপু যা বলে তা শুনবি। ঠিকমতো পড়াশুনা করবি। যে কোন প্রয়োজনে আমাকে ফোন করবি। নিজের খেয়াল রাখিস। এই প্রথমবার শুধু দিদি আমাকে কর্ততৃত্বমূলক কথাগুলো বলেছিলেন। আমি অন্য দিকে ফিরে নিরবে কাঁদছিলাম। দিদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আরে বোকা কাঁদছিস কেন? আমি কি তোদের ছেড়ে ভিন গ্রহে পাড়ি জমাচ্ছি? বরং তোর নিঃশ্বাস দূরত্বেইতো যাচ্ছি। আমি কিছুই বল্লাম না।

স্কুলে টাকা জমা দিয়ে পথে নামতেই এতসব ভাবনা মাথায় এসে জট পাখিয়েছে। আজ প্রথম আমি হাঁটতে হাঁটতে এতো ভাবলাম। খুব ভাল লাগছে। আপন মনে হাঁটছি। দূর থেকে সাকিবের আওয়াজ শুনে এগুলাম। হাত মিলিয়ে একসাথে মাঠে বসেছি। সাকিব বল্ল- তোর জন্যে একটা চিরকুট আছে।

-কে দিল?

-খুল্লে দেখতে পাবি।

- নাম বল্লে কী অসুবিধেটা হবে শুনি?

আমার কথার উত্তর না দিয়ে ছোট একটা কাগজ হাতে দিয়ে বল্ল, নে খুলে দেখ। আমি যাচ্ছি।

হাতে নিয়ে আর খুলতে ইচ্ছে করছে না । ভাবছি। এখানে না। বাসায় গিয়েই বরং খুলি। পকেটে পুরে বাসায় চলে আসলাম। বিভিন্ন সিনেমা কিম্বা উপন্যাসের নায়কেরা এরকম অকস্মাৎ চিঠি টাইপ কিছু পেলে আয়েশ করে ঢং করে পড়ে। আমার কেন জানি ওভাবে পড়তে ইচ্ছে করছে। রাত যখন একটু ঘন হবে। ভরা পূর্ণিমা হওয়ার কথা আজ। তখনই পড়বো।

নিস্তব্ধ রজনী। চারপাশে পিন পতন নীরবতা। জানালা খুলে দিলাম। এক ঝাপটা মুক্ত হিমেল হাওয়া এসে আমার মুখে ঝাপিয়ে পড়ল। মনের গহীনে শির শির করে উঠল। দরাজ আকাশের বুকে প্রকৃতির চিরায়ত নিয়ম মেনে উঠেছে চাঁদ। চাদের মৃদু আলোতে ‘চিরকুট’ খুললাম। দেখতে সুন্দর লাগছে জো¯œার রুপালী আলোতে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা...

হিমেল,

তুমি শিক্ষা-সফরে অবশ্যি যাবে। কারণ তুমি না গেলে আমিও যাব না। আমাকে অন্তত এই সুন্দর একটা আনন্দ- ভেলাতে উঠতে দাও। তোমার যাওয়া হলেই শুধু সম্ভব। আমি তোমার জন্যে কাল সকালে স্কুলের সামনে কৃষ্ণচূড়ার নীচে অপেক্ষা করব। ভালবাসা রইলো।

ইতি

মিশু

মিশু নামটা পড়ার সাথে সাথে মন অতি সুন্দর একটা মেয়ের ছবি এনে দিয়েছে সামনে। দেখতে দেখতে ওর সাথে খুব ঘনিষ্ট হয়ে গেছি। বোঝতেই পারিনি ব্যাপারটা। ওর পূরা নাম মিশারা। আমি একবার দুষ্টুমি করে মিশু বলেছিলাম। তখন থেকে সবাই ওকে এই নামে ডাকে। স্যার-ম্যাডাম সবাই। মিশুর তো আনন্দের সীমা নেই। আমার দেওয়া নাম পেয়ে সে মহা খুশী। ক্ষুধার্ত ফকির কিছু খেতে পেলে যেমনটা খুশি হয়। ওর কথা মনে পড়তেই ভাবনার ডানায় ভর করে কিছু পুরানো স্মৃতি মনের আকাশে হাসি-খুশি মনোভাব নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। বুকসেল্পের তলানি থেকে ঘেটে ঘেটে একটা ডাইরি বের করলাম। আমার রোজনামচা। ধুলো মুছে আবার জানালার পাশে বসলাম। একটা একটা করে পাতা উল্টালাম। এই এক একটা পাতা আমার পূরনো দিনের আনন্দ-বেদনার সাক্ষী। মিশুর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হওয়ার কথাটা খুঁজে বের করলাম। এখানে প্রতিকী নামে নোট করেছি (তাসপি)। অনেকেই আমার ডাইরি পড়ে। যাতে কেউ সন্দেহ না করে। গরগর করে আমি পড়ে গেলাম....

হয়তো আমারো ট্রাম দূর্ঘটনায় মৃত্যু হবে....

আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছি একবৎসর পূর্ণ হয়েছে কয়েকদিন হচ্ছে। আজ আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল বিবরণী অনুষ্টান। খুব টেনশন। আমার না; আমার সব বন্ধুদের। ওদের কপালে এ চিন্তার চাপ খুব সুচারুরূপে ফুটে উঠেছে। কারণ আর মিনিট কয়েক পরে ঘোষিত হবে স্কুল সেরা আর প্রতি ক্লাসের ক্যপ্টেনদের নাম। কার ললাট চুম্বন করবে এমনতর সৌভাগ্য? কে হবে শিক্ষকদের চোখের মনি? সবার মাথায় ছুটছে এসব চিন্তা। ভাগ্যের জোরে তার নামও যদি উঠে আসে এ তালিকায়...! সবচেয়ে বেশি চিন্তিত মনে হচ্ছে তাসপিকে। অষ্টম শ্রেণীর ক্যপ্টেন ছিল। সেভেনের বার্ষিকে স্কুল সেরা আর ক্যপ্টেন নির্বাচিত হয়েছিল। কোন দূর্ভাগ্য ছুঁয়ে দিবেনাতো ওকে? দূর আকাশে চোখ তোলে বার বার এই জিজ্ঞাসাই হয়তো করছে প্রভুর কাছে। ওর সব ভাবনার মূলে হয়তো আমি। আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছে তাতে এরকমই মনে হচ্ছে। মনে মনে হয়তো বলছে, বেটা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। পুরো বছরটাই সবাই তাকে মাথায় তুলে নেচেছে। এখনও সবাই আামার কথায় বলাবলি করছে। সবার ধারনা আমি এবার এ মেয়েকে মাটিতে নামিয়ে দেব। এটাও তাকে কম কষ্ট দিচ্ছেনা। এই বছরের সংস্কৃতি - অঙ্গনে আমার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারেনি। যতটা ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছি সবটাতে প্রথম। অপ্রতিদন্ধি এক নায়ক। তাই বলে লেখা পড়ায়ও কি খুব ভালো হবে ? বুঝতে পারিনা নিজেকে কি মনে করে ও। কোন মেয়ের সাথেই কথা বলে না। জোর করে বলালে ভাল আছি বলে ইতি টেনে দেয়। এসব হাবিজাবিও হয়তো ভাবছে। মেয়েদের স্বভাবই এরকম। সব বেকাজের কাজী। কেপটেন হবে কি হবে না এই দ্বিধার চাপটা তার মুখে খুব সুচারুপে পড়েছে। সূর্য মাতার উপর দিব্যি উত্তপ্ত কিরণ ছড়াচ্ছে। এরকম গরমে মানুষ কি আর হেলায় দাড়িয়ে আছে? কারো মাতার উপর ছাতা, কারো মাতার উপর শোভা পাচ্ছে কিছু বই। এক আমি খালি মাতায় খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে আছি। গরম লাগছে ঠিক কিন্তু গরম থেকে রেহাই পাবার কোন চেষ্টায় করছি না। একটাই চিন্তা মাথায় ভোঁ ভোঁ করছে। রেজাল্টটা হচ্ছে কেমন ? আচমকা পেছন থেকে একজন এসে বলল, ক্যান আই হেলফ ইউ ? পেছনে ফিরে দেখি তাসপি মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে। ওকে সহ্য করার মতো পরিস্থিতি এটা নয়। নো থ্যাংকস বলে ঘাড় ফিরিয়ে নিলাম। ততক্ষনে প্রধান শিক্ষক এসে রেজাল্টের সামারি উপস্থাপন করছিল।

“ক্লাস টেন দেয়ার নো চেইনজ, বাট ক্লাস নাইন হেভ এ চেইনজ। দ্যা চেইনজ ইজ দ্যাট মোঃ হিমেল বিকেইম ফাস্ট।” রিপোর্টটা আমাকে আনন্দের অতিশয্যে পৌঁছে দেয়। আনন্দে কান্না চলে আসে। একটু দূরে লক্ষ্য করছি তাসপি ওড়নার আচল দিয়ে অশ্রুজল মুচছে। ইচ্ছা থাকলেও ওকে শান্তনা দিতে যায়নি। বন্ধুদের সাথে কথা বলে বাড়ির দিকে ফিরছিলাম। পথি মধ্যে ও এসে কংগ্রেজুলেশন জানাল। হাসি মুখে ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসছি। চলে আসার সময়ে ও অনুরোধ করলো যাতে কাল খুব তাড়াতাড়ি স্কুলে আসি। কারণ জানতে চাইলে বলল আগামিকাল জানাবে। রবিবার খুব ভোরে স্কুলের পথে রওনা দিই। স্কুলে পৌছতে খুব বেশি সময় লাগেনি। চারপাশে নিরবতা ভর করে আছে। মাঝে মাঝে হিমেল বাতাস হৃদয়ে শান্তির পয়গাম দিয়ে যাচ্ছে। স্কুল মাঠে সবুজের সমারোহ। এই পরিবেশ আমার খুবি ভালো লাগে। মাথার উপর কৃষ্ণচূড়ায় থরে থরে ফোটে থাকা লাল টুকটুকে ফুল গুলোও মনে এক সুতীক্ষœ সুখের সুড়সুড়ি দেয়। হঠাৎ মনে হলো ফুল গুলো ছিড়ে যদি সবুজের উপর বৃত্তাকারে সাজিয়ে দিই তাহলে খুব সুন্দর একটা লাল সবুজের পতাকা তৈরী হবে। কিন্তু সমস্যা হলো আমি গাছে উঠতে পারি না। একবার উঠতে গিয়ে পা ভেঙ্গে দু’মাস মেডিকেলে ছিলাম। স্কুলের ভেতর একটা ছেলেকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে ওকে ডাকলাম। গাছ বাইতে জানে কিনা জানতে চাইলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। পাঁচ টাকার লোভ দেখিয়ে গাছ থেকে সব কৃষ্ণচূড়া ফুল পাড়িয়ে নিলাম। ফুল গুলো নিয়ে মনের মতো করে পতাকা বানাতে ব্যস্ত। পেছন থেকে এসে তাসপি ঝাকুনি দিয়ে বলল, হাই, হাওয়ার ইউ ? উঠতে উঠতে বললাম এতক্ষণ ভালই ছিলাম। মনের মতো করে একটা পতাকা বানাতে চেয়েছিলাম সেটাই বানচাল করে দিলে। তোমরা মেয়েরা সব ভালো কাজের পেছনে লাগো কেন ? এসেছি তোমার সাথে কথা বলার জন্য। তুমি কি বলছ কথা না বলে তোমার ক্যালেগ্রাফি দেখে দেখে ক্লাস টাইম নিয়ে আসবো? যাক একটা কথা মানতে হবে তুমি খুব ভালোই আর্টও করো। আমি মূখ নিচু করে বললাম, সরি জীবনে প্রথম কিছু একটা আকঁতে নিলাম আর তাতে ভালো হয়ে গেলাম! আসলে মা বলে কি আমার আকুঁনি দেখলে কোনো মানুষই আর জীবনে কিছু আকঁতে চাইবে না। কারণ আমার ক্যালেগ্রাফি দেখে সবার আকাঁর প্রতি অরুচি জন্মাবে। ও বলল রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, কাউকে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে, সে যদি ঐ বিষয়ে জানার পরও অজ্ঞতা প্রকাশ করে তাহলে সে নিশ্চিত জাহান্নামে যাবে। বুঝতে পারছি ও আমাকে হাদিস দিয়ে হেনস্তা করতে চেষ্টা করছে। এসব বিষয়ে আমিও চেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। দেখ, হাদিস শুধু পড়লে হয় না; এর মর্মার্থও জানতে হয়, যা উদঘাটন করা খুবি দূরুহ। তুমি যে হাদিসটার কথা বলেছ বাস্তবে রাসূল(সা:) ওখানে বুঝাতে চেয়েছেন, যদি কেউ তোমার কাছ থেকে তার অজানা বিষয়ে জানতে চায় যাতে সে পরবর্তী সময়ে সে অনুসারে চলতে পারে। আর ঐ ব্যাপারে তুমি জান অথচ তুমি তার কাছ থেকে তা গোপন করেছো যাতে সে পরবর্তীতে উপকৃত হতে না পারে বা ও তোমার কাছ থেকে বেশি যাতে না জানে। তাহলে তুমি জাহান্নামি হবে। তুমি চিন্তা করে দেখ তোমার করা প্রশ্নের সাথে এর কোন সম্পৃক্ততা আছে কিনা। তুমি আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেছো। আর রাসূল বলেছেন যোগ্যতা নিয়ে যাতে কখনো বড়াই না করি। আমার উত্তর শুনে তাসপি কিছুটা ভটকে গেছে। আচ্ছা তুমি কি যেন বলবে? একটু তাড়াতাড়ি বললে ভালো হয়। আচ্ছা হিমেল তুমি কি সত্যিই আমার সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলে ? এখানে মিথ্যা হবার কি আছে। আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম। আচ্ছা তুমি কি আমাকে বন্ধু ভাব? অনিচ্ছা সত্যেও আমি ওর এরুপ উদ্ভট প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলে দিলাম। ও বলল, চল কোথাও বসে গল্প করি। বলেছি সময় নেই। কোন ইমপর্টেন্ট কথা থাকলে বল। তাসপি আবার বেহুদা কথা বলা শুরু করেছে। হিমেল, আমি বরাবরি খেয়াল করেছি তুমি অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় অনেকটা ভিন্ন। একেবারে বেরসিক। কোন মেয়েকেই সহ্য করতে পারনা। এর পিছনে বাংলা সিনেমার মতো কোন বিরহ প্রেমিকের বিষাক্ত ট্রাজেডি আছে কি? অত্যন্ত সুচারুভাবে আমার মনের কথা বের করতে চেষ্টা করছে মেয়েটা। সাত পাঁঁচ ভেবে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। ভেবেছিলাম এই উত্তর পেয়ে ও আমার সাথে কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে বসবে। আর আমিও বিরাট এক ঝামেলা থেকে বেঁচে যাব। কিন্তু আমার আশায় গুড়ে বালি ছিটিয়ে ও দ্ধিগুণ উৎসাহে জানতে চাইল। প্লিজ ট্রাজেডিটা বল। সত্যি আমি তোমার জন্য দুঃখিত। ঘটনাটা তোমাকে বলতে পারছিনা। ওটার কথা মনে পড়লে আমার লেখা পড়ার ছন্দ পতন ঘটবে। আশা করি আমার এই ক্ষতিটা তুমি করবে না।

-ঠিক আছে; তুমি কি এখন কাউকে পছন্দ কর? ও সুধালো।

ওর আরেকটি অদ্ভুদ প্রশ্নের অবতারণায় আমি আরেকটু হতচকিয়ে উঠলাম। অদ্ভুদ মেয়েতো! লজ্জা শরমের বলাই নেই। আমি জানতে চাইলাম তুমি কি বুঝাতে চায়ছ ? ও বলল, ক্লাসের এত ভালো ছেলে জলের মত স্বচ্ছ কথা না বুঝার কোনো মানে হয় ? সত্যি আমি কিছু বুঝতে পারিনি। একটু খুলে বলবে ? আমার অনুরোধের ঢেকি গিলে বলল, আমি বলতে চাইছি যে, তুমি এখন এই স্কুলের কাউকে ভালো তালো বাস কিনা ? দেখ, আমি অন্যকে এসব থেকে বিরত থাকতে বলি। নিজেও এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। -আচ্ছা বলতো, তুমি কি কখনো ট্রাকের ডিজেল বক্স থেকে একশত হাত দূরে থাকার কথা ভাব ? - নাতো ভুলেও কখনো ভাবিনি।

-কি আশ্চর্য! ট্রাকের ডিজেল বক্সে লিখা থাকে “একশ হাত দূরে থাকুন”। ওটা থেকে দূরে থাকার কথা ভাবই না। অথচ দেখ আমাদের কপালে আর পিঠে কোথাও লিখা নাই একহাত দূরে থাক। আর সেই আমাদের কাছ থেকে তুমি হাজার মাইল দূরে থাক ?

-আমার মনে হয় বর্তমান যুগের মেয়ে গুলো ট্রাকের ডিজেল বক্স থেকে হাজার গুণ বেশি ভয়ঙ্কর এবং ধংসাত্মক।

-কেন ? ও গলায় প্রতিবাদের সূর বেঁধেছে ।

-বর্তমান যুগের মেয়েরা ছেলেদের সাথে ভালবাসার নামে ছলনা করে। ওরা ভালবাসতে জানেনা জানে শুধু প্রতারণা করতে। এখন নারিদের বালক বন্ধুর অভাব নেই। যার হাতে টাকা আছে তার সাথেই প্রণয়ত্ব গড়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভালবাসা যে দু’টি মনের মিলন এই সুভোধটা তাদের কাছ থেকে একেবারে হারিয়ে গেছে। আজ একজনের সাথেতো কাল অন্য জনের হাত ধরে পুরাতন বন্ধুকে পৃষ্ট প্রদর্শন করে ঢুকে পড়ে কোন দামী রেস্তোরায়। তাদের লজ্জা শরম বলতে কিছুই আর বাকি নাই। এটাই হাল যামানার প্রেমের মহাত্ম। তবুও আমি নারি জাতিকে সম্মান করি। কারণ এটা আমার মায়ের জাতি; আমার বোনেরাও নারি জাতির অন্যতম সদস্যা। তাই আমি এ ব্যাপারে আলোচনায় বসতে চায় না। বসলে নিশ্চিত আমার মুখ ফসকে অপ্রিয় সত্য গুলো বেরিয়ে পড়বে। যা শুনলে আমার মায়ের, বোনের খারাপ লাগবে। শুধু শুধু তুমি কেন আমার মস্তিস্ক ঘেটে এসব মন্তব্য বের করে আনলে? তাসপি আমার কাছে অপমানিত হয়ে কাল নাগিনীর মত ফুসতে ফুসতে বলল, সব মেয়েতো আর খারাপ নয়; যেভাবে সব ছেলেরা ভালো নয়। তাহলে কেন তুমি পুরো নারি জাতির উপর দোষটা ছাপিয়ে দিচ্ছ ?

-একটা বুক সেল্পে সাধারণত সবগুলো বই থাকে না। কম বেশি খাতা ও থাকে। কেন ওটাকে আমরা বুক সেল্প বলি ?

-সাধারণত ওখানে বই বেশি থাকে। তাই বুক সেল্প বলে। ওর সাদা মাটা উত্তর। ও হয়তো বুঝতে পারেনি ওর দেওয়া উত্তরেই লুকিয়ে আছে তার করা প্রশ্নের উত্তর। তবু আমি বিশ্লেষণ করলাম, বর্তমান যুগে বেশিরভাগ মেয়ে খারাপ। তাই দোষটা সবার উপর চাপিয়েছে।

ও আমতা আমতা করে বলল, দেখো হিমেল জীবনানন্দ দাশ। যিনি তোমার সবচেয়ে প্রিয় কবি। তিনি নারীকে লক্ষী ভেবেছিলেন। তিনি নিশ্চয় তোমার চেয়ে কম বুঝতেন না।

-তুমি সে কালের কথা বলছ কেন ? আমি এ কালের কথা বলছি। এ যুগটা তোমাদের মনের পরিবর্তন করে দিয়েছে। তবুও আরেকটা কথা মনে রেখ, জীবনানন্দ নারীদের লক্ষী ভেবে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছিলেন। তুমি হয়তো জান তিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা গেছিলেন। অকাল মৃত্যু ছিল। বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে ঝড়ে পড়েছিলো জ্বলজ্বলে এক তারকা। প্রত্যক্ষভাবে যদিও আমরা ট্রাম দুর্ঘটনাকে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্ণিত করি। অবশ্য এর পরোক্ষ একটা কারণ আছে। বনলতা সেনের কথা কি মনে আছে ? জীবনানন্দের বিখ্যাত কবিতা। সেই বনলতা সেন ছিল তার মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ। তিনি বনলতা সেন নামের একটা মেয়েকে খুবি ভালোবাসতেন। তার সাথে বনলতা সেনের দেখা হয়েছিল মুটে দুই কি তিনবার। অথচ তিনি মূহুর্তের জন্যেও তাকে ভূলতে পারেননি। তার সার্বক্ষণিক কল্পনা জুড়ে বিচরণ করতো বনলতা সেন। তিনি রাস্তায় হাটা চলার সময়ও ভাবতেন বনলতা সেনের রুপ মাধুর্য্য। এই উদাসীনতায় ট্রাম দুর্ঘটনার মূল কারণ। আমাদের মজলিস থেকে ঝলসিত এই নক্ষত্র হারিয়ে যাবার অন্তরালে আছে একটি নারীকে না পাবার বিষাক্ত যন্ত্রনা। তাঁর জীবন থেকে আমি এই মহা সত্যটা অর্জন করেছি বলে তিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি।

-কেন তুমি উদোর পিন্ডি বূধোর ঘাড়ে চাপাচ্ছো ?

-তুমি ভুল বুঝছ। আমি কিন্তু গাধার বোঝা গাধাকে আর উটের বোঝা উটকে বইতে দিয়েছি। হেসে হেসে বললাম, আরেকটা ছোট্ট কাজ করেছি। কারণ বন্টনে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সুপ্রচেষ্টা করেছি। আমি উঠে চলে আসছিলাম। তাসপি হাত ধরে বলল, আমি তোমাকে ... । আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আবারো তোমার জন্যে দুঃখিত। এর ফলে হয়তো আমাকেও ট্রাম দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে পড়তে হবে ...

ডায়রিটা আস্তে আস্তে বন্ধ করলাম। কিছুক্ষণ চোখ বোজে কিছু একটা ভাবতে চাইলাম। কোন ফায়দা হচ্ছে না। চোখ মেলে দেখি সব কিছু জাপসা দেখাচ্ছে। চাদেঁর চারপাশ থেকে নিউরনের মতো অনেক প্রবৃদ্ধি বেরিয়েছে। এক চিরচেনা আকর্ষণে চোখের পাতারা পরস্পরকে কাছে টানছে। আমিও হারিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে ...





দুই

ঘুম থেকে উঠছি ১০টা বাজে। ওদিকে ৮টা থেকে মিশু আমার জন্যে স্কুলে অপেক্ষা করছে। কিছুই করার নেই। আমি একটু অন্যরকম। আজ মিশুর জন্মদিন। ওকে উইশও করা হলো না। যাক, আগেতো স্কুলে যাই। দ্রুত প্রস্তুতি সেরে ভুঁ দৌড় দিলাম। স্কুলের সামনে এসে থমকে গেলাম। ভেবে লাভ নেই। এটাই হওয়ার ছিল। বেচারি এখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওদিকে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ওর কাছে এসে বললাম, দুঃখিত আসলে বড় আপু একটা কাজে...

কেঁদে কেঁদে বলল, তোমার আর মিথ্যে বলতে হবে না। । মেয়েটি অভিমানে কাঁদছে। ভালই হলো ওকে কাঁদিয়ে। না হলে একটা মেয়ে কাঁদলে যে তার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায় এই চরম সত্যটা অজানা থেকে যেত। বাহ মিশু, তোমাকে কাঁদলেতো মোনালিসার চেয়েও দারুন লাগে।

-ইয়ার্কি করিও না। জন্মদিনে উইশতো করলে না। একটা উপহার অন্তত দাও।

-শুভ জন্মদিন। উইশতো করলাম। উপহারতো পেয়েই গেছো।

-মানে ?

-তোমাকে একটু কষ্ট দিলাম। সবাই বন্ধুর জন্মদিনে বন্ধুকে আনন্দ দেয়। আমি সবার চেয়ে ব্যাতিক্রম তাই তোমাকে দেরীতে এসে একমুটো কষ্ট দিলাম। ও নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ক্লাসে চল। আমিও বললাম, চলা যাক। সাগর ছুটতে ছুটতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর বলছে, হিমেল নে। তুই একটা হুমায়ুন আহমেদের বই কিনতে টাকা দিয়েছিলিস না। আমি সাগরের মুখ চেপে ধরে একপাশে নিয়ে এলাম।

চুপ শালা, তোকে কি বলেছিলাম ? মিশুর সামনে আমাকে এটা দিতে না করেছিলাম তো? ও তাড়াতাড়ি কানে ধরে বলল, সরি। যাক, কি আর করা যায়?

সাগর। এ আমার সবচেয়ে হাবলা বন্ধু। কিন্তু প্রচুর বই পড়ে। অনেক অনেক বই পড়েও যে হাবলাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় সেটা ওকে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না। খুব সরল মনের মানুষ। তুমি ওর চৌদ্দ গুষ্টিকে কবর থেকে তুলে এনে গালি দিলেও ও টু শব্দটি পযন্ত করবে না। একবার স্কুলের বাইরে একটা গাছের পাতা সে লাফিয়ে ছিড়ছিলো। এলাকার একজন নেতাগুছের ছেলে ওকে ডেকে থাপ্পড় দিল। ও রিঅ্যাক্ট হিসাবে সরি বলে আসে। পরে আমরা কয়েকজন বন্ধু নেতা নামে কেতাটাকে স্কুলে ফন্দি এঁেট আনি। আমাদের স্কুলের বাথরুমে ঢুকিয়ে এমন কেলান কেলিয়েছি যে বাথরুমের জড় পদার্থ গুলোও ভয়ে কেঁপে উঠছিলো থর থর করে। এই সাগরকে আমি গতকাল ফোনে বলেছিলাম হুমায়ুন আহমেদের “আজ হিমুর বিয়ে” ও নজরুলের “ব্যাথার দান” বই দুটি আনতে। মিশুর ব্যাগে ঢুকিয়ে দেবো ওর অজান্তে। শালা সব মাটি করে দিলো। ইচ্ছে করছে ওকেও কেতাটার মতো পেঁটাতে। কিন্তু কি করি হাজার হলেও বন্ধুতো।

বন্ধুরা মিলে একটা র্পাটি দিলো। র্পাটিতে সবাই অনেক মজা করেছি। মাইক্রোফোনে অনেকই অনেক কথা বলেছে। কোন কথা বলার মতো যোগ্যতা আমার ছিলনা। তাই আরেকবার মেঝদির কাছে হাত পাতলাম। টাকা নিতে গেলে দিদি স্বপ্ন নিয়ে যে কথাগুলো আমাকে বলেছিলো তাই বললাম। সবার চোখে পানি চিফ চিফ করতে দেখে নিজের চোখেও জল এসে যায়। ছাগলে তিন নাম্বার বাচ্ছার মতো। এখন খুব ইচ্ছে করছে দিদির বাকি কথাগুলোও শুনতে। ইচ্ছে হলেও কী করব ? দিদি একবার খেই হারালো দ্বিতীয় বার আর কোন কথা বলে না। নিজের উপর খুব রাগ হলো। মন খারাপ হয়ে গেলো। আর ক্লাস করতে মন চাইছেনা। বন্ধুরা মিলে কোথাও ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছে। সবাইকে বললাম। বলতেই বন্ধুরা রাজি হয়ে গেলো। সবাই মিলে ষোলশহর রেলষ্টেশনের পাশে মাতা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ে গেলাম। পাহাড়টাকে “মুক্তিযোদ্ধা পাহাড়” বলে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তি সেনাদের পদভারে প্রকম্পিত হত এই পাহাড়। পাহাড়ের চৌড়ায় উঠলে পুরো শহরটা চোখের সামনে ধরা দেয়। এখানে ওখানে আগাছার মতো বেড়ে উঠেছে বস্তি, দালানকোটা। কঠিন পদার্থের অণুগুলোর অবস্থান যেমন এই শহরের জনবসতীর চিত্রটাও ঠিক তেমনি। ভেবেছিলাম এখানে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো ভাবতে চেষ্টা করব। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিময় চিহৃগুলোই ছিঁড়ে কুটি কুটি হয়ে গেছে। মিশু গুটি গুটি পায়ে কাছে এসে কাঁধে হাত রাখল হৃদয়ের গহীনে আনন্দ-অনুভুতি বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে তাকাতেই মন ভালো হয়ে যায়। তার জাদুমাখা হাসি কী আর উপেক্ষা করা যায় ? ও মৃদুকন্ঠে জানতে চায়ল- মন খারাপ ? মুখে উত্তর না দিয়ে মাথা নেড়ে জানালাম!

- একটা গান শুনবে? মন ভালো হয়ে যাবে।

- তোমাকে দেখেই মন ভাল হয়ে গেছে। তবুও যদি তোমার মর্জি হয় একটা গান করো।

-শুনো, বেদনা মধুর হয়, যদি তুমি দাও। / মুখের কথা হয় যে গান, তুমি যদি গাও।...

তার সুরেলা কন্ঠ আমার মন ছুঁয়েছে আলতো করে। গভীর অনুভুতি সাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে ওর সুরেলা গানের আহবানে। অসম্ভব সুন্দর কন্ঠ বাতাস বয়ে নিয়ে গেছে পৃথিবীর রন্দ্রে রন্দ্রে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো নিঃসীম আকাশের বুকে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে মিশুকে নিয়ে...



তিন

বাসায় ফিরতে না ফিরতেই শুরু হলো বকাবকি। বড়দের এই একটা বৈশিষ্ট থাকবেই। অন্য বৈশিষ্ট্যের ধার তারা ধারেনা। অথচ ছোটদের কারণে অকারণে বকাবকী করার ব্যাপারে তারা সিদ্ধ হস্ত বা বলা যায় এটা তাদের বাঁ হাতের ব্যাপার। স্কুল জীবনে প্রথম স্কুল পালালাম। জানতাম হেডস্যার বাসায় ফোন করবে। সেই বদৌলতে বাসায় সবাই জানতে পারবে। স্কুল পালানোর মজাটা বোধহয় এখানেই। আমি ওদের যাবতীয় মন্তব্য এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিই। না হলে এমনি এমনিতো এতসব শব্দের ভীড় ঠেলে মোবাইল ফোনের আওয়াজ আমার কানের পর্দা কাঁপাচ্ছে না ? বড় ভাইয়ের বকা উপেক্ষা করে ফোন রিসিভ করলাম। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মেঝদি বলছেন, কী খবর ছোট ?

-খুব একটা ভাল নয়। আমার উপর শব্দ দুষণের ব্যবহারিক করা হচেছ।

-কেন ? কি করলি আবার ?

-আজ স্কুল পালিয়েছিলাম। তারই আক্কেল সেলামি দিতে হচ্ছে। তুমি ফোন করে বাঁচিয়েছ।

-আমি তোদের ওখানে আজ আসছি।

-সত্যি !

-এক সত্যি, দু সত্যি... তিন সত্যিটা নাই বলি। কারণ দূর্ঘঠনার খবরতো আর আমি জানিনা। ওটা বেচারার জন্যে তুলা থাক।

-ঠিক। তবে তাড়াতাড়ি চলে আসো।

নিরাসক্তভাবে ফোনে কথা বলছি দেখে বড়ভাই অপদার্থ, গোঁয়ার, বিয়াদব ইত্যাদি কমন গালি দিতে দিতে চলে গেলেন। আবারও মেঝদির বদৌলতে বেঁচে গেলাম। তাঁর প্রতি ঋনের হিসেব বেড়েই চলছে।

চারদিকে মেকি আলো ছড়িয়ে সূর্য ডুবে গেল। অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আমি বই নিয়ে পড়তে বসলাম। মেঝদির আওয়াজ শুনে টেবিলের উপর বই রেখেই দৌড়ে মেঝদির কাছে চলে এলাম। মেঝদি আমার থুতনি ধরে আদুরে গলায় বল্লেন -

কীরে পড়ছিস তো ? নাকি বাড়ি মাথায় তুলে নিজেও নাচছিস আর অন্যদেরও নাচিয়ে চলছিস ?

-দিদি শেষ পর্যন্ত তুমিও ওই বড়দের দলে।

-না না, আমিতো তোর টীমে।

-থ্যাংক ইউ দিদি।

-কিছু খেতে দিবি নাকি সারাক্ষন বলিয়েই যাবি ?

-আমি ফ্রিজ থেকে নাস্তা বের করে খেতে দিয়ে বললাম। বড়দি তোমার জন্য বানিয়ে রেখেছে।

আমার ও মেঝদির মাঝে খুব ভাব ছিল। সময় পেলেই নিজেরা আড্ডায় মেতে উঠতাম। দিন-রাতের কোন হিসেব আমরা কষতাম না। একবার রাতে দু’টায় মেঝদি আমাকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন ছাঁদে। কত কী যে গল্প করেছিলাম। দিদি সবসময় গল্প করার সময় ফ্লাক্সে করে চা বানিয়ে রাখবেনই। মিশুর ব্যাপারে মনে অনেক কথা জমে আছে। দিদিকে আজ বলতে ইচ্ছে করছে। কিছু সাজেশন্সও দরকার। সময় দেখলাম। রাত একটা বেজে ৪৫ মিনিট। দরজা খুলে বেরুতেই দেখলাম দিদি ডাইনিং টেবিলে বসে কী যেন লিখছে। ল্যাম্পের আলোয় দিদিকে খুব খুব সুন্দর লাগছে। তাঁর সাদা মুখের উপর ল্যাম্পের লালচে আলোর নাচানাচি তাঁর সৌন্দর্য্য আরও অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে মিশু হলে তাকেও কী এমনই সুন্দর দেখাত ? হয়তো বা দেখাত। আমাকে দেখে দিদি ইতস্তত ভাঙ্গিতে কলম রেখে ডাইরিটা বন্ধ করে দিল।

-কী লিখছিলে ?

-কিছুই না , এমনে আঁকিবুকি করছি।

-আমি আসাতে লুকালে কেন ?

-কই লুকালাম ? তোর সামনেইতো পড়ে আছে ...

ডাইরিটার দিকে তাকিয়ে খুবই অবাক হলাম। এর মলাট দিদি নিজের মতো করে বানিয়েছেন বুঝাই যাচ্ছে। একটা মেয়ে বসে আছে। তার ছায়াই ডাইরির মলাটে আছে বাস্তব চিত্র নাই।

সে তার একহাতের উপর অন্য হাত দিয়ে কী যেন করছে ? মনে হয় কাটছে। কারণ হাত দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত বিন্দু দিয়েই নিচের দিকে লেখা আছে “অসমাপ্ত কবিতা”।

-দিদি, আমি একটু দেখি ?

-এখন না, আমি যখন চাঁদের বুড়ী হব তখন পুরোটাই দেখিস।

-দিদির না মানে না। এতে নড়চড় হবে না। তাই আর জোরও করলাম না। তবে বাইনা ধরে বললাম।

-দিদি, আমাকে একটা ওরকম ডাইরি বানিয়ে দে না।

-এখন না, পরে একদিন এসে বানিয়ে দেব। কেমন ?

-ওকে।

-দিদি তোর সাথে কিছু কথা ছিল।

-বলে ফেল।

মিশু নামের একটা মেয়ে আমার সাথে সম্পর্ক করতে চাইছে। আমি কী করব বুঝতে পারছিনা ? মিশুর সাথে ঘঠে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বললাম। আমার বক্তব্য শুনে দিদি মুখ টিপে টিপে হাসছেন। দিদির হাসি দেখে প্রথমবা আমার এত লজ্জ লাগছে। মুখ লাল হয়ে উঠছে। আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছিলাম যাতে লজ্জাটা ফিকে হয়ে যায়। তখন দিদি আলতো হেঁসে বললেন- প্রেমের মরা জলে ডুবো না। আমি সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলাম। আজ নীল জোছনা হওয়ার কথা। পত্রিকায় পড়েছি। কখনও দেখা হয়নি। আজ দেখতে হবে। জানালা খুলে দিলাম। হৃদয়ের গহীন থেকে একটি তৃপ্তির নিঃশ্বাস বেরুলো। দিদির মতো কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। স্কুলের রাফ খাতাটা বের করলাম। জানালার পাশে বসলাম। ভাবনারা কি পদ্যাকারে না গদ্যাকারে মালা গাঁথছে বুঝতে পারছিনা। ইচ্ছে হলো তাই পদ্যাকারেই সাজালাম। জানি এ পদ্যের মরিচ মসলাও হবে না। তবুও কী আর করা ইচ্ছের জোর যে প্রবল থেকেও প্রবলতর। মনে হলো তাই নতুবা/ইচ্ছের প্রবল বকুনিতে/হেয়ালিপনার পশ্রয়ে কিম্বা/ ভাবনাদের অসম্ভব ঝাকুনিতে/ আজ পত্রিকা কিনলাম।/পত্রিকার এপিট ওপিট/ কলামও রিপোর্টের একুল/ওকুল সব পড়া হলো সঠিক/তবে আজ অতি নতুন/এক খবর পড়লাম।

আকাশের বুকে আজ/চাঁদ সাজিয়ে দিবে/নীল জোছনার পসরা/দেখবো তাহা কিসে/নগ্ন চোখে না দূরবীনে।/দেখছি আমি অবাক হয়ে / অতি সুন্দর এক পরী/নাচে তাহার করেছে/পাগল আখি আমার...



চার

আজ একদম ভাল লাগছেনা। আমার ভাল লাগা-না লাগা, সুখ-দুঃখ শেয়ার করার মতো কোন মানুষ বাসায় নেই। যারা আছে সবাই হিটলার আর আমি তাদের জন্যে ইহুদী। কখনও হাসিমুখে গল্প করেনি। রুমে ডুকে টেবিল গুছাতে গিয়ে মেঝদির ডেস্কের চাবি পেলাম। আমার রুমে মেঝদির একটি ডেস্ক আছে। ইচ্ছে হলো তার ডেস্ক খুলে কী আছে দেখবো। ভেতরে দেখি তার সেই ডাইরি। হাতে নিলাম পৃষ্টা খুলতেই চোখে পড়ল।

মন ভাল নেই। দুশ্চিন্তা,নৈরাশ্য চারপাশে ঘিরে ধরেছে। এদের ফাঁকি দিয়ে বেরুবার জোঁ নেই। হৃদয়ের গহীনে কে যেন ছুরিকাঘাত হানছে বারংবার। বিন্দু বিন্দু করে গড়িয়ে পড়ছে রুধির। একেকটি রক্ত কণিকা যেন বের করে আনছে বুকের জমানো ব্যাথার অগনিত নুড়ি। আগে যে কোন ব্যাথায় অঝোরে কাঁদতাম। এখন জঘন্য ব্যাথায়ও চোখের কোণে অশ্রু বিন্দুর দেখা মেলেনা। অযুত আঘাতে জর্জরিত নয়নে শুধু নিরব বেদনা। মাঝে মাঝে বিষন্ন মনে মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে আত্মহননের প্রবল ইচ্ছা। কিন্তু মায়াপুরীর মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ি প্রতিনিয়ত। ভাগ্যের উপর জীবনের ঘানি টানার ভার দিতে গিয়েও দিতে অপারগ। শুধু দুর্বলরাই ভাগ্যের উপর সব কিছু ছেড়ে দেয়। আমি দুর্বল নই, নই অসহায়। প্রভু আমাকে অন্যসবার মতো সব কিছু দিয়েছে। সাহসিকতার জ্বলন্ত অঙ্গারের স্তুপ আমার মন। তাই ভাগ্যটা নিজেই গড়ে নিই নিজের আদলে...

পড়লাম কিন্তু বুঝলাম না। আরো পৃষ্টা উল্টালাম। তার ডাইরিতে লেখা সবকিছুর শিরোনাম লাল রঙের। “বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা” নামের একটা লেখা পড়া শুরু করলাম।

মায়ের কোলে যখর ছিলাম তখন দুঃখ, কষ্ট বলতে কিছুই ছিলনা। অথচ মায়ের সামান্য বকুনি, দুষ্টুমির জন্য কয়েকটা চড় এগুলোকে চরম দুঃখ মনে করতাম। বাস্তবে বায়ুর অথৈ সাগরে ডুবে থেকেও যেমন আমরা বায়ুর মর্যাদা উপলদ্ধি করতে পারিনা, তেমনি মায়ের ¯েœহের ডোরে থেকেও সেই ¯েœহকে আঁচ করতে পারতাম না। এখন তা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি।

এক রাতের ঘটনা। নৈ:শব্দের রাজত্ব চলছিলো পৃথিবীময়। আমি বেঘোর ঘুম। হঠাৎ লাফিয়ে উঠি। সামনে দাঁড়িয়ে মেঝদা রাগে দাঁড়সাপের মতো ফুঁসছে। আর মাকে বলছে-ওর মতো বোন আমার লাগবেনা। এরকম বোনদের কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দিলে কারও কোন ক্ষতি হবেনা। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। একক্ষনে সম্বিত ফিরে পেলাম। আমাকে টেনে চকি থেকে মাটিতে নামানে হয়েছে তা বুঝলাম। নামিয়েছে তপন তথা মেঝদা। আমার এক কি দেড় বছরের বড়। হাঁক ছেড়ে বলল

-আজ রাতে তুই কোন ছেলের সাথে দেখা করেছিস ?

-মানে ?

-মানে আবার কী? বলেই আমার গালে খুব জোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। আমি ব্যাথায় ককিয়ে উঠলাম। চোখ দিয়ে পানি এসে গেছে।

- আমি তো রুমে বসে পড়ছিলাম।

-মিথ্যে বলিস না। সত্যি করে বল।

-মিথ্যে বলছিনা। আপনি আমার ক্ল্যাসমিটদের জিজ্ঞেস করেন।

“আমি তুর চাকর নাকি?” বলে আমার তলপেটে প্রচন্ড বেগে লাথি মারল। আমি ছিটকে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলাম। আমি হা করে মেঝদার দিকে তাকিয়ে আছি। তাঁকে দেখতে হায়েনার মতো লাগছে। আমি অঝোরে কেঁেদ উঠলাম। মা দৌড়ে এসে আমাকে নিয়ে অন্য রুমে ঢুকে ভেতর থেকে নক করে দিলেন। মা আমাকে খাঁটে বাসিয়ে দিতেই ব্যাথায় শরীর শিরশির করে উঠল। বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছি।

যখন আমাকে মেরেছিল তখন আমার বয়স ১৮ ছুইঁ ছুঁই। বিয়ের বয়স। ঐ. ঝ. ঈ পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। আজও আমি আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া অপরাধের সত্যতা পাইনি। কী আর করি ? যখর মা বলেন বড় ভাই শাসন তো করবেই! তখন এসব অনায়াসেই মেনে নিতে হয়।

লেখাটি পড়তে পড়তে আমার মনের ভেতর বেদনারা হাহাকার করে উঠল। কিছুক্ষন পর অশ্রু ঝরলো অঝোরে। বিষন্ন মনে ডাইরিটা বন্ধ করলাম। কভারটার উপর চুমু খেতে গিয়ে তার উপর অশ্রুর ফোটা কয়েক পড়ল। আর চোখে ঘুম নামছেনা। সেও আমার সাথে সাষে বিষন্ন, অতি বিষন্ন...









পাঁচ

বাসায় গণিত স্যার এসেছেন। গত রাতে ঘুম হয়নি। তাই গণিত করতে বসে মাছ ধরছি। মাছ ধরছি কথাটা কেমন জানি বেখাপ্পা লাগছে। সামান্য ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। একবার রাতে আমি পড়ছিলাম। পরীক্ষার প্রস্তুতি বলা যায়। আমি ঝিমাচ্ছিলাম। বাবা চেক করতে এসে আমার এই অবস্থা দেখে হয়তো মনঃক্ষুন হলেন। খুব জোরে মুখে চড় দিয়ে বল্লেন- পড়তে বসে মাছ ধরছ কেন ? না পড়লে ঘুমিয়ে যাও। বাবা চলে গেলে নিজের দেহটাকে আয়নার সামনে দাঁড় করালাম। মুখ দেখে আঁতকে উঠলাম বাবার হাতের কার্বন কপিই ছাপা হয়ে গেলো আমার মুখে। গনক আমার চেহারা থেকেই বাবার হাত দেখতে পারবেন। বাজে কথা ছাড়ি, আসল কথায় আসি। মাছ ধরা রুপক অর্থে ঝিমানোকে বুঝায়। কারণ যখন আমরা ঝিমুয় তখন আমাদের দশা মাছ ধরতে ব্যস্ত বকের ন্যয় হয়ে পড়ে। মর্হুমুহু নীচের দিকে মাথা ঝুঁকে পড়ে।

এই স্যারের কাছে পড়ছি তিন বছর। আমার যেদিন ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে সেদিন স্যারেরও ঝিমুনি আসেই। আমি গণিত বইয়ের শেষের সাদা পৃষ্টায় নোট করে রেখেছি। উল্টে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এতই অলস হয়ে পড়েছি যে তাও পারছি না। অবাক হলাম। কারণ, স্যার আজ ঝিমুচ্ছে না। তাই আমিও ভালো মতো তৃপ্তির সাথে মাছ ধরতে পারছিনা। তাই শেষ পৃষ্টার নোটটা দেখে নিলাম।

আমি মাছ ধরেছি = ২১০ দিন

স্যার মাছ ধরেছে = ২১০ দিন

মোট = ৪২০ দিন

কী অদ্ভুদ ! দু’জনে ভাগাভাগি করে ৪২০ হয়ে গেলাম। যাক অসুবিধে নেই। ক’জনেইবা এমন কীর্তি গড়তে পারে ? আমার এক বন্ধু প্রকৃত সাহসী চিহিৃত করতে গিয়ে বলতো- ইচ্ছে করে পরীক্ষায় ফেল করা সহজ কথা নয়। যে পারবে ইচ্ছে করে ফেল করতে সেই প্রকৃত সাহসী। সেদিনই বাগধারাটা প্রথম শিখলাম। মুঠামুঠি একটা ব্যাখ্যাও দাঁড় করালাম।

“হিমু” নিয়ে লেখা হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস গুলো পড়তে পড়তে সেও “মহাপুরুষ” হওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে তরীকাগুলো নিজের মতো করে বানিয়ে নেয়। যেমন প্রকৃত সাহসীর সংজ্ঞাটা সেই মহাপুরুষ হওয়ার একটি সূত্র। তাঁর মহিমান্বিত নামটা এখন মনে পড়ছেনা।

অংক করতে ইচ্ছে করছেনা। কী করা যায়? স্যারকে রাগিয়ে দিতে পারলেই পগার পার। রেগে গেলে স্যার আর পড়াতে পারেন না। কিছু না বলে চলে যান। ওনাকে রাগানোর একটাই পন্থা উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করা। কিন্তু গোলাটে মাথায় প্রশ্নও আসছে না। তবুও চেষ্টা করছি। জীব বিজ্ঞান বই নিয়ে বললাম

-স্যার, এটা কী ?

-কেন ? চিংড়ি মাছ।

-মাছ কিভাবে ?

-আমরা খাই বলে।

-কলমি লতাওতো আমরা খাই।

-পানিতে সাতার কাটে তাই।

-স্যার, সাপকি আকাশে উড়ে ?

স্যারের. নাক-মুখ লাল হয়ে আসছে। বুঝতে পারছি কাজ হচ্ছে। চালিয়ে যেতে হবে।

-তুমি মেথ করবা না ফালতু বকবা?

-আসলে এটা জানার খুব সাধ ছিলতো তাই।

-তোমার সাধের গুলি মার। কাল বাড়ীর কাজ করে আনবা। আমি যাচ্ছি, একটা কাজ আছে।

-জী স্যার।

-আচ্ছা স্যার একটা কথা বলি ?

-বলো

-আসলে আমার মনে হয়েছিলো, চিংড়ি মাছ বল্লে মাছ-জাতি খুবই অপমান বোধ করবে। তাই জিজ্ঞেস করলাম। আমি কি ওদের চিংড়ি পোকা বলতে পারবো ?

-স্যা অং ুড়ঁ রিংয, গু ফববৎ অংং বলে দ্রুত পায়ে চলে গেলেন । এই একটা ইংরেজী বাক্য স্যারের কাছ থেকে কমপক্ষে হাজার বারের উপর শুনেছি।

স্যার চলে গেলেন। সাধারণ সম্মান বোধটুকুও দেখানো হলোনা স্যারকে। টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষন পর বড়দি এসে ঘুমের রাজ্যে হানা দিয়ে গেলেন। উঠে গোসল করে স্কুলের ইউনিফর্ম পড়ছিলাম। বুক সেল্পে চোখ গেল। দিদির সুন্দর ডাইরিটা পড়ে আছে। গিয়ে দিদির ডাইরিটা ছু’লাম। খুলে পড়তে মন চাইল। কিন্তু সাইসে কুললো না। যদি আবার মন খারাপ হয়ে যায়। স্কুলে আর যাওয়া হবে না। না গেলে আমার ক্ষতিটায় বেশী। মিশুর কাছ থেকে একটা শীট পাওয়ার কথা। বিনা পয়সায়। ওর প্রাইভেট টিউটর দিবে। সেটা ফটো কপি করে আনার কথা। স্কুলে যাওয়ার জন্যে বেরুবো। তখন বড়দি এসে বল্লেন, একটু ব্যাংকে যেতে হবে। স্কুলে যাস না। মাথা খারপ হয়ে গেল। ইচ্ছে করছিল মুখের উপর বলে দিই, পারব না। কিন্তু মায়ের দেওয়া সবসময় সর্বাবস্থায় পালনীয় ৫টা কর্তব্যের মধ্যে এটি একটি। আমি ঐ কর্তব্যগুলো একটা কাগজে মায়ের হাতে লিখিয়ে মানিবেগে রেখে দিয়েছে। যখনই ইচ্ছা করে দেখে নিই। খুব ইচ্ছে করছে মায়ের লেখাটা একবার দেখি...

মানিবেগ নিয়ে কাগজটা বের করলাম। ওঠা কেমন মুচড়ে গেছে। আজ লেমেনেটিং করে স্কুল ওউ- কার্ডের মতো গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে। কাগজটা ভেজা ভেজা। কারণ যখনই এটা পড়তে যাই কান্না আসে। আর ক’ফুটা অশ্রু ওটাতে পড়ে আজ শেষবারের মতো ভিজিয়ে নিই। লেমেনেটিং করলেতো আর ভিজবে না।

হিমেল

নিচের পাঁচটি কথা সদা-সর্বদা স্মরন রাখিবে। কখনও অমান্য করিবে না।

১। সময় মতো নামায পড়িবে।

২। শিক্ষককে সম্মান করিবে।

৩। বড়দের বিশেষ করে বড়দির কথা অক্ষরে অক্ষরে মান্য করিবে।

ধ্যাৎ, বাকি দু’টো এখন পড়তে ইচ্ছে করেছে না। খারাপ লাগছে। হয়তো আজ কাঁদা হবে না। যে লাইনটা পড়লে কান্না আসে সেটা আর পড়া হচ্ছে না....

১০টা বাজার কিছুক্ষন আগে আপু এসে বল্লেন,

-তোর যেতে হবে না, বাদল যাবে।

-তাইলেতো আমি স্কুলে যেতে পারি ?

-হ্যা

ভাবলাম, বড়দের সম্মানের ফযিলত বুঝি এটাই। বাদল, আমার বোনের স্বামী। উনার মার্জিত আচরনের ব্যাখ্যা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। আমাকে খুব খুব দেখতে পারে। আমার গোসল করার সব সরঞ্জাম আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখেন তিনি। শীতকালে গরম পানি পর্যন্ত করে রাখতো। একটা মজান ঘটনা মনে পড়ছে।

একবার কুরবানের ঈদে বড়দির শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যাই। রাতে খুব জোরে বাথরুম ধরেছিল। কাউকে ডাকার আগে ছুটে গেল। কাপড়-চুপড় একাকার হয়ে গেছে। বাদল ভাই ১নাম্বার সারতে উঠেছিল। উনি দেখে প্রথমে হাসলেন। তখন অঘোর শীত। উনি রাত পোহাবার আগেই গরম পানি করে আমাকে গোসল করালেন। কাপড়-চোপড় সব ধুয়ে শুকাতে দিয়ে তবে ঘুমালেন। বর্তমানের মা-বাবারা তাদের প্রিয় ছেলেদেরও এমন খেদমত করেনা। সেখানে আমি উনার বউয়ের ছোট ভাই। বহুত দূর কী বাদ। অথচ উনি কাছের চেয়েও কাছের মনে করে কাজ করলেন আমার মনে হয় না কখনও উনার ঋন শোধ করা যাবে।



ছয়

বাসা থেকে বেরুয়েই ঈঘএ নিলাম। তবু চ.ঞ অর্ধেক খেয়ে ফেললাম। বর্তমান বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাটের জ্যামটা পান্তাভাতে পানি থাকার চেয়েও ঢের স্বাভাবিক। এই একটা কারনে আজ স্যারের মার খেতে হবে। মার খাওয়ার অভিজ্ঞতাটা আমার খুবই কম। .০০০৩% এরকমই নতুবা তারচেয়ে কম। ইচ্ছে করছে প্রশাসনের চৌদ্দ গুষ্ঠিকে কবর থেকে তুলে এনে গালি দিই। কিন্তু দিতে পারলাম না মায়ের ওউ -কার্ডটার জন্যে। ওখানে ৪ নাম্বারে ছিল-

৪. মিথ্যে এবং গালি কোনটাই যেন তোমার স্বভাবে না আসে।

যাক, ভয়ে ভয়ে স্কুলে ঢুকলাম। মধ্যমাঠে হ্যাড স্যারের আধিপত্য চলছে। যারা ড্রেস, চ.ঞ শো নিয়ে আসেনি এবং যারা অর্ধেকে এসেছে সবাইকে মাঝমাঠে কান ধরিয়ে উঠবস করাচ্ছে। আমাকে দেখেই হ্যাড স্যার ডাক দিলেন- হিমেল, এদিকে আয়। নিশ্চিত আজ লজ্জায় লেজ কাটা যাবে। আস্তে আস্তে হেটে গেলাম।

-জ্বী স্যার ?

-আমার অফিসে যাও, আমি আসছি।

স্যার রাজকার্য সম্পাদন করে রুমে ঢুকলেন। চেয়ারে বসে আমার দিকে তাকালেন। চিত্রটা এমনই লাগছে যে, উনি রাজা আমি সাত-খুনের দায়ে একজন অপরাধী। স্যার গম্ভীর গলায় বললেন-

-এতো দেরী করলে কেন ?

-স্যার সত্যি বলব না মিথ্যে ?

-মিথ্যেটা বল, শুনি।

-স্যার আমি কিন্তু সত্যি নয় মিথ্যে যে কোন একটাই বলব। পরে সত্যিটা জানতে চাইলেও বলা মুশকিল হয়ে পড়বে।

স্যার সাথে সাথে হেসে ফেল্লেন। স্যার আমাকে খুবই পছন্দ করেন। দু’জনে খুব মজা করি। মাঝে-মাঝে এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, আমাদের সম্পর্কটা কী তাও মনে থাকেনা। অবশ্যই তার একটা কারন আছে।

আমি ও স্যার একটা অনুষ্ঠানে এটেন্ড করেছিলাম। শহরের সব নামীদামী স্কুলের মেধাবীতে ঠাসা ছিল অনুষ্ঠান। অনুষ্টানের ভলান্টিয়ার যখন আমার নাম ও স্কুলের নাম লিখছিল তখন বিশ্রী একটা এক্সপ্রেসোন দেখাল। আমারতো খারাপ লাগলো। স্যারেরও খুব বাজে লাগল।

ওটা বিতর্ক অনুষ্ঠান ছিলো। আমাদের টীমটাই জিতেছিল। এবং আমি সেরা বক্তা। অনুষ্টানের পর যখন সবাই আমাকে কনগ্রেচ্যুলেশন জানাতে আসছিল তখন স্যার দূর থেকে দেখে অশ্রুসিক্ত চোখে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল।

স্যারের মুখোমুখি হলেই তিনি ঐ চিত্রটার কথা একবার হলেও বলবেন আমাকে। কিন্তু আজ বলছেন না। স্যার হেসে হেসে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে মিথ্যাটাই শুনব।

-স্যার, ইচ্ছে করেই দেরী করেছিলাম।

তিনি জোরে জোরে হেঁসে উঠলেন। আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছি। তিনি আবার বললেন -

-তোমাকে আজ সবার সামনে শাস্তি না দিয়ে এখানে আনিয়ে মজা করছি কেন ? ঐ দিকে তোমার ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে।

- হয়তো তখন আপনার ঐদিনটার কথা মনে পড়ে গেছিলো ?

স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন -একটা ভাল কাজ এতোদিন মনে রাখতে নেই। কারণ তাহলে অন্য কোন ভাল কাজ করা হয়ে উঠে না।

-বক্তব্যটা একটা কাগজে লিখে দিবেন ?

-কেন ?

-আসলে আমার বন্ধু রাহাত “মহামানব প্রকল্প - ২ ” হাতে নিয়েছে। ওর কাজে লাগতে পারে।

-মানে ?

-স্যার, হিমু যে মহামানব প্রকল্প ছিল সেঠা- ছিল ১ম পর্ব। হিমুর এই প্রকল্প প্রকৃতির আঘাতে থমকে যাওয়ায় ও চাইছ মহামানব প্রকল্পটা জীবন্ত রাখতে। আমি ওর এই প্রকল্পকে মহামানব প্রকল্পের পুন রুত্থান পর্ব নাম দিয়েছি।

-তোর এই বাদরামি গুলো ছাড়বি কবে ?

- যবে থাকবো না এই ভবে ...

-আমার সাথে একটা কাজে যেতে হবে ?

-ঠিক আছে,স্যার।

-তাহলে চল।

-এখনই স্যার।

-হ্যা

-একটু ক্লাস রুম থেকে আসি।

-যা, তবে তাড়াতাড়ি আসবি। হাতে একদম সময় নাই।

-ওকে স্যার , যাব আর আসব। ক্লাস রুমের দিকে দৌড় দিলাম। টিচার্স বিল্ডিং থেকে বাঁক নিতেই সামনে পড়লো মিশু। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। তোমাকে পেয়ে ভালই হলো। তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম। শিটটা এনেছ। আনলে তাড়াতাড়ি দাও। তাড়া আছে।

-হ্যা এনেছি। তবে এখন দিবোনা। আমার সাথে কিছুক্ষন থাকো তার পর দিবো।

- দিবা কিনা বল? আমি যাচ্ছি।

আমার দিকে শিটটা দিয়ে বলল -কীসের তাড়া ?

আমি শীট নিয়ে মুখে ফিরিয়ে বললাম, হ্যাড স্যারের সাথে জরুরী কাজে যাচ্ছি।

-একটু দাড়াও, তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে।

পরে বলেই আমি দৌড়ে চলে এলাম। ওর দিকে ফিরেও তাকানো হলো না।

-আমাকে দেখে স্যার হাসি মুখে বললেন

-এসেছিস? চল বেরুই।

-চলুন স্যার।

স্কুলের কিছু দূরেই মূল রাস্তা। আমিও স্যার কথা না বলেই এগুচ্ছি। আমি প্রথমে মুখ খুললাম।

স্যার, আপনি আজ কেন আমাকে শাস্তি দেননি ?

-এত তাড়া করছিস কেন ? জানার সময় হলে নিশ্চয় জানতে পারবি।

আমি মুখে কুলুপ এঁটে দিয়ে হাটা শুরু করেছি। কিছুদুর গিয়ে বড় ইতস্ত হয়ে পড়লাম। দোকান থেকে একটা মানুষ বের হয়ে আমাকে সালাম দিলেন। আমি হাসি মুখে সালাম নিয়ে হাঁটা দিতে চাইলাম। তিনি আমার পথ আগলে দাঁড়ালেন।

-হিমেল ভাই, এক কাপ চা খেয়ে যান।

-না, না কি বলেন এসব? এখন একটা কাজে যাচ্ছি। পরে একদিন হবে। স্যার না থাকলে সত্যি সত্যি চা খেতে ঢুকে পড়তাম।

-এরকম বল্লেতো হবে না। আপনাকে খেতেই হবে।

আমি আবার বললাম, স্যারের সাথে একটা কাজে যাচ্ছি। তাই আজ হবে না

উনি স্যারকে নিয়ে দোকানে ঢুকে পড়লেন। অগত্যা আমাকেউ যেতে হলো। আমার খুব বাজে লাগছে। মানুষটা স্যারের সামনে আমাকে এভাবে ...

স্যারকে এতই নার্বাস লাগছিল যে, মনে হলো, তিনি এই প্রথম স্কুলের বাইরে কোন দুকানে চা খাচ্ছেন। তাও আবার তাঁর ছাত্রের ভক্তের টাকায়। চা খেয়ে বেরুলাম। স্টেশনে এসে কিছুক্ষন দাড়াতেই বাস আসল। বাসে উঠে স্যার এবং আমি পাশাপাশি সিটে বসলাম। স্যার আমার দিকে আঁড় চোখে তাকালেন। তিনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

-কি ব্যাপার হিমেল ? আমার এলাকার মানুষ তোমাকে আমার চেয়ে বেশী ভালবাসে

-তেমন কিছু না স্যার , ছোট খাঠো ব্যাপার।

-ছোট ব্যাপারে এই এলাকার মানুষ এতো আন্তরিক হয় না। ব্যাপারটা খোলে বলো।

আমি গিট খুলে দিলাম এভাবে...

কিছু দিন আগের ঘটনা। স্কুল থেকে ফিরছিলাম। দেখছি ওনি রাবিনকে মারছে। রাবিন চিৎকার করছে। আর বিচ্চিরি ধরনের গালি দিচ্ছে। আরও বলছে, পড়া-লেখা করব না। কী করবে তুমি ? আমি রিকশা থামিয়ে বিষয়টা পর্যবেক্ষন করলাম। ও নাকি ১১টা পরীক্ষার ১০টাতেই ফেল করছে। বাবা রিকশা চালিয়ে আর মা গ্যার্মেন্টসে চাকরি করে রাবিনের লেখা-পড়ার খরচ চালান। ছেলে এমন করলেতো মা-বাবার রাগ হবেই। স্যার এদ্দুর শুনে রেগে মেগে বললেন, এরকম ছেলেকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া উচিৎ।

আমি স্যারকে বললাম। এই অবস্থায় অভিবাবকরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। এটায় সমস্যা। পরের ঘঠনা গুলো শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন যে ওর বাবা কত বড় ভূল করেছিল।

স্যার পরের ঘটনা জানতে চাইলো। আমি খুলে বললাম।

আমি রবিনের বাবার কাছে গিয়ে বললাম। চাচা একটু শুনবেন। ওনি আমার স্কুলের ড্রেস দেখে গর্জে উঠলেন তুমি কী বলবে ? ওর হয়ে সাফাই গাইবে নিশ্চয়।

না না, আসলে আপনাকে দেখে মনে হলো খুব টায়ার্ড। তাই একটা কুল ড্রিংস নিয়ে আসলাম বলে নিজের জন্যে কেনা কুল ড্রিংসটা এগিয়ে দিলাম। তিনি ইতস্তত ভঙ্গিতে হাতে নিলেন। বাপ-ছেলে উভয়ই হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। চারপাশের লোকদের ক্যাল ক্যাল করে তাকানো দেখে নিজেকে চোর চোর লাগছিল। আমি রবিনের বাবার কানে কানে গিয়ে বললাম। ভাবুনতো, এত লোকের মাঝে আপনার ছেলে আপনাকে গালি দিচ্ছে। এতে কী আপনার নূন্যতম সম্মান বাড়ছে? আমারতো মনে হয় না। দেখুন, আপনি যেভাবে ওকে মারছেন এতে রবিন আরো বিগড়ে যাবে। এই বয়সের ছেলেরা একটু আদর, একটু ¯েœহ চায়। আচমকা তিনি সিংহের মতো গর্জে উঠে বললেন, এসব কথা বলা সহজ করা কঠিন। রিক্সা চালিয়ে ছেলের পড়া-লেখা করানো কত কষ্টের তাতো আর তোমরা বুঝবে না। আর সেই ছেলে যদি ৯’টা বিষয়ে পেল করে সেই ছেলে সামলানোও এতো ইজি কাজ নয়। ওনার শেষের কথাশুনে আমি হেসে ফেলি। ওনি আমার দিকে চোখ লাল করে থাকিয়ে আছে। আমি এখন ছেড়ে দে মা পালিয়ে বাঁচি অবস্থা। চলে আসার আগে রবিনকে বললাম। প্রতিদিন ক্লাস শেষে আমার সাথে একঘন্টা বসতে। প্রথম কয়েকদিন বসতে বিরক্তবোধ করত। আমি এই কয়দিন ওর সাথে পড়া-লেখার প্রতি ভালবাসাবোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছিলাম। পাঠ্য বই ছাড়া হুমায়ুন আহমেদের কিছু মজার মজার বই পড়তে দিয়েছি। এরপর দেখি একদিনও মিস করেনা। নতুন নতুন বই পড়ার নেশা তাকে পেয়ে বসে। আমি এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। সুযোগ পেয়ে পরের দিন বললাম, তোমাকে নতুন নতুন বই দিব। তবে সপ্তাহে একটা। তবে এই একটা বই পেতে তোমাকে সামান্য কষ্ট করতে হবে। রবিনতো একপায়ে খাড়া। নিজে নিজে খুব তৃপ্ত হলাম ওর আগ্রহ দেখে। ওকে বল্লাম তোমাকে স্কুলের বইগুলো একটু পড়তে হবে। না বুঝলে স্যারদের কাছে থেকে বুঝিয়ে নিবে। স্যারদের ভয় লাগলে আমার কাছে চলে আসবে। এরপরের খবরতো স্যার আপনি জানেনই। রবিন ২য় সাময়িকে থার্ড এবং বার্ষিকে ফাস্ট হয়ে সেভেনে উঠেছে।

কথাগুলো শুনে স্যার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন দৃষ্টিতে। এতক্ষণ স্যারের সাথে কথা বলছি বলে খেয়ালই করিনি। আমার সামনে একজন বৃদ্ধলোক অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দ্রুত সিট হতে উঠে উনাকে বসতে দিলাম। উনি বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তুমি কী পড়? আমি উত্তর করার আগেই স্যার বলে উঠলেন, ক্লাস টেন। বৃদ্ধ স্যারের দিকে তাকিয়ে এবার স্কুলের নাম জানতে চাইলেন। স্যার দ্বিগুণ আগ্রহে স্কুলের নাম বললেন। স্কুলের নাম শুনে তিন আমাকে বারকয়েক দেখে নিলেন। উনার তাকানোতে কেমন যেন অবিশ্বাস, অবিশ্বাস ভাব ছিল। বৃদ্ধ বিশ্বাসই করতে পারছেনা আমি ঐ স্কুলের ছাত্র। এ জায়গায় আমার খুব মজা লাগে। স্কুলের নাম শুনে ওদের মুখের অবস্থা দেখতে বাংলার পাঁচ না হলেও নয়ের মতো অবশ্যি হয়। কারণ এরকম স্কুলেও যে ভালছেলে পড়তে পারে বা স্কুল যে ভাল ছাত্রের মাপকাটি নয় এই ব্যাপার তাঁদের মস্তিস্কে কোন মতেই ঢুকে না। বরং নীতিবাক্যটা ওদের মস্তিস্কের বাইরের শক্ত আবরনে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। অবশেষে দু’ঘন্টার পথ পেরিয়ে আমরা গন্তব্যে পৌছলাম। এই মূহুর্তে গন্তব্য সম্পর্কে জানলাম। স্যার এখানে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান বিচারক হিসেবে দাওয়াত পেয়েছেন। আমাকে দেশের বরেন্য র্তাকিকদের সাথে দেখা করাতে এনেছেন। স্যার সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার প্রতি স্যারের এই নিঃস্বার্থ ভালবাসা আমাকে খুব খুব আনন্দ দিয়েছে। স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞবোধ বাড়ছে বুঝতে পারছি চোখের কোনার চিক চিক করা নোনা জলের কারণে...



সাত

অনুষ্টান শেষে বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। খুব ক্লান্তি লাগছে। হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ঘুমানোর চেষ্টা করছি। সব ক্লান্তি ভাবনা ঠেলে মিশুর ছবিখানা ভেসে উঠছে হৃদয়ে। আজ ওকে এভাবে অবজ্ঞা করে চলে আসা ঠিক হয়নি। ওকি আমাকে ভুল বুঝবে ? তখন ওকে খুব বিষন্ন, বিপর্যস্ত দেখেছি। এসব ভেবে মন আরো খারাপ হয়ে গেল। আমার একটা স্যার বলতেন। যখন তোমার ভালো লাগবে না তখন রবীন্দ্র সংগীত বা অন্যকোন ক্লাসিক গান শুনবে। দেখবে মন ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু বাসার কেউ গান শুনেনা। আমি গান শুনলেও কেউ মেনে নিবে না। তাই মোবাইল নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছি। ঝরনা ছেড়ে দিয়ে পানিদের স্বাধীনভাবে আমার শরীরে বিচরনের অধিকার দিলাম। আর গান ছেড়ে দিয়েছি। রবীন্দ্র সংগীত। সংগীতের মূর্ছনা বাথরুমের পরিবেশটায় হয়ে উঠেছে অসম্ভব রকমের মাধুর্য্য মন্ডিত। আমিও গুনগুনিয়ে গেয়ে চলছি...

আমারও পরানও যাহা চায়,

তুমি তায়, ওগো তুমি তায়।...

বুঝতে পারছিনা স্যার ঠিক বলতেন কিনা? কিন্তু আমার ক্ষেত্রে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখছি কেন ? মনের সুতীক্ষè অনুভূতি আমার হৃদয়ের গহীনে গিয়ে খোঁচা দিয়ে মিশু নামক সত্ত্বাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। মনও ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। বাথরুমে একঘন্টা হয়ে গেলে। বাইরে থেকে সবাই বাথরুমের দরজাকে এত বেশী মারছিল তার জন্য মায়া হল। অনিচ্ছা সত্তেও বেরিয়ে আসি। গোসল সেরে পড়তে বসি। সাথে এলাচি ও লেবু দেওয়া রং চা। পড়তে বসে কী পড়ব বুঝতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত জীবজ্ঞিান বইটা তুলে নিলাম। কোষ বিভাজন সম্পর্কে পড়তে গিয়ে মজার একটা বিষয় পেলাম। অনেকবার আমি অধ্যায়টা পড়েছি, কিন্তু আজ যে ভাবনাগুলো আসছে আগে কখনও আসেনি। আমার বন্ধু রাহেল। ছেলে-মেয়ে সবাই ওকে ক্লীব লিঙ্গ বলে ইনসাল্ট করে। বেচারা একদিন আমার কাছে এসে বলে, দোস্ত আমার একটা উপকার করতে পারবি ?

-চেষ্টা করে দেখব। কী ব্যাপারে বল।

-আমি জানি তুই পারবি।

-আচ্ছা, এতো কাহিনি না জুড়িয়ে মূল কথা বল।

-ভাই, আমার জন্য একটা নতুন নাম বের কর। যার অর্থ শুধু ছেলেরা জানবে। মেয়েরা জানতে পারবে না। তোরা ইনসাল্ট কর কিন্তু মেয়েরা তোর বন্ধুর ইজ্জত পানসার করুক এটা তুই নিশ্চয় চাস না। আমি নিশ্চয় এতো বাজে বন্ধু নয়।

আজ বায়োলজি পড়তে গিয়ে ওর যে নাম খুজেঁ পেয়েছি। ওর সমস্ত কনডিশন এটা দিয়ে মানা যাবে। কারণ নামটার মর্মার্থ বের করার মতো এতো বুদ্ধি মেয়েদের মেকআপ সরঞ্জামের চিন্তায় ঠাসা মাথায় নেই। এটা আমার জানা। অটোসোম নামেই তাকে ডাকতে হবে। মানব দেহে লিঙ্গ নির্ধারনী কোষ ছাড়াও আরো ২২ জোড়া কোষ থাকে। এদের অটোসোম বলে। যাদের লিঙ্গনির্ধারনী কোষ নেই শুধু অন্যান্য কোষ গুলো আছে তারাই অটোসোম তথা হিজরা। সবার মুখে মুখে নাম ছড়িয়ে দিয়েছি। ছেলে-মেয়ে সকলে তাকে “অটোসোম” বলে অথচ কেউ জানেনা এর মতলবটা কী ? পড়তে বসে আমি কখনও কাজের কাজ একটাও করতে পারিনি। কেন জানি পৃথিবীর হাবিজাবি সব চিন্তা মাথায় এসে ভিড় জমায়। একটুও পড়তে পারিনা। ইদানিং এ সমস্যা প্রবল। আগে, অনেক আগে এরকম হতো না। খুব মন দিয়ে পড়তে পারতাম। ঘুমের সময় চলে এলো দোর ঘোড়ায়। পড়তে পড়তে ঘুমাতে খুব ভালো লাগে। দিদির ডাইরিটা অনেকদিন ধরা হয় না। ধরে দেখলে ভালো হয়। সেল্প খুলে ডাইরিটা হাতে নিতেই মন আঁতকে উঠলো অজানা সুক্ষœ ব্যাথায়। এক এক করে পৃষ্টা উল্টালাম। একেক করে হেডলাইন গুলো পড়ছিলাম। শেষের দিকে নতুন একটা লেখা পেলাম। দেখে তাজা মনে হলো। হয়তো আজই লিখেছে। ডাইরি রেখে দৌড়ে বেরুলাম। শিশির আপুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মেঝদি এসেছে না কি ? তিনি অন্য দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে জানালো। দিদি এরকম কখনও করেনি। বাসায় এসেছে অথচ আমাকে বলেনি। আজতো আমার সাথে দেখাও করেনি। আবার জিজ্ঞেস করলাম। দিদি কী চলে গেছে ?

-না, ঘুমিয় পড়েছে হয়তো।

-কী বলছ ? কিছু না খেয়েই এত তাড়াতাড়ি তিনি তো ঘুমায়না।

-আমি কি জানি? আজ কেন এমন করল ? আমার দিকে বিরক্তিভরে থাকাল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে গেষ্টরুমে নক করলাম। কিন্তু খুললনা। অনেক্ষন চেষ্টা করলাম কোন ফায়দা হলো না। অগত্যা ঘুমুতে চলে আসলাম। ডাইরিটা বিছানায় পড়ে আছে। হাতে নিয়ে শুয়ে শুয়ে পড়তে শুরু করলাম।

জীবন সায়াহ্ণের গল্প...

আজ মনে হচ্ছে আমার জীবনের শেষ দিন। মন চায়ছে যত রকমের আনন্দ আছে সব একসাথে করে ফেলি। কিন্তু কিছু ঘটনা আমার আনন্দগুলো গলা টিপে মেরে ফেলেছে। আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। জীবনটা বিষিয়ে উঠেছে। গতকাল আমার এক ছাত্রীর বোনের বিয়ে ছিল। আমাকে ওর মা-বাবা এসে দাওয়াত করে গেছে। ছাত্রীও অনেক অনেকবার করে দাওয়াত করেছে। আমার ছাত্রীর নাম ছিল মেহের। ওতো আমায় সাফ জানিয়ে দিল, ম্যাম, আপনি যদি না আসেন তাহলে আমি কখনও আপনার সাথে কথা বলব না। এমনও হতে পারে আপনার ক্লাসই করব না। আমি নানা অজুহাত দেখালেও সে মানতে নারাজ। কোন উপায় খোঁজে না পেয়ে মাকে ফোন করি। সব খোলাসা করে মাকে জানায়। অনেক কষ্টে মাকে রাজি করালাম। বিয়েটা ছিল রাতের।

মেহেরের সাথে আসতে দেখে ওর মা-বাবা খুব খুশি হলো। নিজের মেয়ের মতো কাছে টেনে আদর করলেন। আমিও কিছুক্ষনের জন্য বাইরের পৃথিবী বেমালুম ভুলে গেলাম। ওদের সবার সাথে পরিচিতি হলাম। খুব খুব আনন্দ করলাম। মনে হলো পৃথিবীর মানুষগুলো কতো ভালো। এরকম মানুষদের ছেড়ে কীভাবে যে মরতে চায় মানুষ ? হৈ-হুল্লোড করতে করতে কখন যে সাড়ে বারোটা বাজল বুঝতেই পারিনি। মেহেরকে বললাম, আমি উঠি। মেহের বলল আপু আমি তো কিছু জানি না। মাকে বলেন। আমি ওর মাকে খুঁজে বের করে চলে যাওয়ার কথা বলি। ওনি রেগে বল্লেন আমরা গরীব বলে কী আমাদের বাসায় থাকা যাবে না। কাল সকালে যাবে। আমি আর কোন কথা শুনতে চায় না। আমি বলি, মা রেগে যাবেন। আমাকে চলে যেতে হবে। ওর আম্মু আমার মায়ের ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করলেন। মার সাথে কিছুক্ষন কথা বলে ফোন রেখে আমাকে বললেন, তোমার মাকে বলেছি আর কোন অসুবিধে হবে না। আমিও প্রবোধ মেনে আনন্দ-যজ্ঞে যোগ দিলাম। পুরোরাত আনন্দ করেছি। অনেক দিন পর বিশেষ করে বড় আপুর বিয়ের পর কোন বিয়েতে এরকম আনন্দ করলাম। ওদের বাড়িতে সবচেয়ে মজা পেয়েছি অদ্ভুদ একটা খেলাতে। মেহের কোথেকে দৌড়ে এসে আমার কাছে জানতে চাইল, আপু “কিলার” খেলবেন। আমি জানতে চাইলাম। এটা আবার কী ? মেহের আমাকে বুঝিয়ে বলল, এখানে যত জন ইচ্ছা খেলতে পারবে। বর্গাকার কাগজ ছিড়তে হবে খেলোয়াড় যতজন ততটা। কাগজের টুকরোর যে কোন একটাতে কিলার লেখে অন্যগুলোতে টিলার, মিলার, ঢিলার, মিরার ও ফ্রিলার যা ইচ্ছা লেখা যাবে। সবাই বৃত্তাকারে বসবে। পালা করে কাগজগুলো “পুলিশ কাম কে” খেলার মতো ঝেড়ে মাঝখানে ফেলবে। সবাই ওখান থেকে একটা করে কাগজ নিবে। যে “কিলার” লেখা কাগজের টুকরাটা পাবে সে বসে থাকা যে কোন একজনকে চোখ মারবে। যে চোখ-মারাটা প্রথমে দেখবে সে বলে উঠবে ও ধস রহ খড়াব । তারপর সে একজন একজন করে জিজ্ঞেস করবে কে চোখ-মেরেছে। যে বলতে পারবেনা সে গোল্লা- আর পারলে ১ পয়েন্ট।

তার বিবরন শুনে খেলতে ইচ্ছে করছিল। বুঝতেই পাছি দারুন মজার একটা খেলা। তবুও খেলবনা বিছানায় উঠে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। মেহের ওর সব খেলোয়াড়কে নিয়ে আমার এখানেই চলে আসলো। ওরা সবাই এতো চিল্লাচিল্লি করছিল যে, আমার ওখানে ঘুমানো তো দূরের কথা বসে থাকাও অসম্ভব। আমি বের হতে গেলে মেহের বলে। আপনি খেল্লে আমরা কিন্তু আর চিল্লাবো না। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। অসম্ভব মজার একটা খেলা। জল আরো কদ্দুর গড়ানোর পর বুঝতে পারলাম, একটা ছেলে যতবারই “কিলার” পাচ্ছে ততবারই চোখ মারছে আমাকে। আমি তেমন একটা গুরুত্ব দিলামনা। খেলার অংশ হিসেবে ছেড়ে দিলাম। ব্যাপারটা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি। কোন কাজ হচ্ছে না। আমি যতই ওর দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা করছি তারচেয়ে দ্বিগুণ চেষ্টা করছে আমার দৃষ্টি আকর্ষনের। আমি মেহেরকে বললাম , আর খেলব না, বিরক্ত লাগছে। অন্য কিছু খেলি।

মেহের বলল, আমারও বিরক্ত লাগছে। চলেন গান গান খেলি।

না, না আমি খেলব না। তোমরা খেল।

না আপু, আমাদের সাথেতো খেলতে হবে।

ঠিক আছে খেলব। তবে ধাঁধা খেলব। সবাই রাজি হয়ে গেল।

সবার মুখ থেকে নতুন পুরাতন ধাঁধা বেরুচ্ছে। মানুষের মাথায় মাথায় যে এতসব ধাঁধার বিচরন চলছে আগে জানা ছিলো না। কিন্তু অদ্ভুদ ব্যপার হলো আমার মাথায় একটা ধাঁধা ভুলেও আসছেনা। আমি না ধাধা বলতে পারছি না কোন ধাধার উত্তর দিতে পারছি। এই মূহুর্তে আমার মনে হচ্ছে আমার মাথায় গিলু নামের কিছুই নেই সব গোবর। অনেক কষ্টে মাথায় একটা প্রশ্ন আনলাম। আচ্ছা বলতো মেহের, একজনের কাছে একটা কেতলিতে ৮কেজি দুধ আছে। দু’জন খরিদদার এসেছে। একজনের ৫লিটার কেতলি এবং অন্য জনের ৩লিটার। সমস্যা হলো, দু’জনই চার লিটার করে দুধ নিয়ে যাবে। কিভাবে ঐ তিনটা কেতলি দিয়ে চার লিটার করে ওদের ভাগ করে দিবে ?

সবাই ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। অনেক্ষন হয়ে যাওয়ার পরও কেউ সমস্যার গিট খুলতে পারলো না। এখন সবাই আমার কাছে সলোশন খুঁজছে। কিন্তু আমার মাথায় উত্তরটা এখন নেই। কোন এক বিজন বনে মুক্ত হাওয়া গায়ে মাখতে গেছে। ওরা যেভাবে জেদ ধরেছে উত্তর না দিয়ে রেহায় নেই। কোন একটা গুপ্তপথ বেরতো করতে হয়। পেয়েছি। আমি ধাঁধা বলি, কিন্তু উত্তর বলি না। কারণ আমার সৃষ্টকর্ম পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ার ভয় আছে। আর আমার সেলিব্রিটি হওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। সবাই হু হু করে হেসে উঠল। আমি ওদের থামানোর জন্যে বললাম, আরেকটা প্রশ্ন আছে। মেহের বলল, কী বলেন ?

আচ্ছা, এমন একটা ছড়া বলো যার প্রতিটি শব্দের প্রথম অক্ষর হকে “ক”।

বলা শেষ করার আগেই দেবদাসটা বলা শুরু করে দিল।

কপিলা কাকাকে কহিল

কাকা কহো, কেন কাক ?

করে কাকা ?

কহিলো কাকা, কাকের

কাজই কাকা করা

কাজেই কাক কা

কা করে।

এতক্ষন সবাই ওর দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো থাকিয়ে ছিলো। আমি মোটেও অবাক হলাম না। কারণ আমি জানতাম কেউ একজন এটা বলবে। এটা খুব কমন হয়ে গেছে। আমি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম। দেখো, দেখো ও কতো সহজেই উত্তরটা বলে ফেলল। এটাও আমার বোকামীর ফল। সবাই বলে উঠল, কেমন ?

আরে এটাও আমার একটা সৃষ্টি। আমি প্রথম যাকে বলেছিলাম তাকে উত্তরটা সহ বলেছিলাম। আর তাতেই এটা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে। অতি সহজে সকলে উত্তর দিচ্ছে। ধাঁধায় মজাটাই আর থাকছে না। আচ্ছা তোমরাই বলো গাধা ঘোড়া যদি একদর হয়, তাহলে কী হবে ? সবাই ছেলেটার দিকে তাঁকিয়ে হেসে উঠলো। এভাবে মজা করতে করতে প্রায় রাত শেষ হয়ে এসেছে। সবাই আড্ডা ছেড়ে ঘুমুতে যাচ্ছে। ছেলেটা আমার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, আমি মৃন্ময়। আমি বললাম, তো আমি কি করতে পারি ? আসলে আপনি আমাকে এভাবে অপমান না করলেও পারতেন ? সরি, আপনার অপমান বোধ আছে জানতাম না ? ছেলেটার চোখের দিকে থাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। মনে হচ্ছে, এখনই রক্ত ঝরে পড়বে।

মেহেরকে বললাম, ওকে যেতে বলতো। দশটার দিকে ঘুম থেকে উঠে হোস্টেলে চলে আসলাম। আমার রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই মেঝদার ফোন আসল। মেঝদা ওপাশ থেকে গমগমে গলায় বলল, এখনই বাসায় চলে আয়। কেন ? কোন প্রয়োজন আছে ?

আসতে বললাম আসবি। এতো প্রশ্ন কেন ? আমি ওই অবস্থাতেই বাসায় চলে আসি। বাসার কেউ ছিলনা। সামনের বাড়াটের কাছ থেকে চাবি পাওয়া গেল। বাসায় ঢুকে ¯œান-টœান সেরে ফ্রেশ হলাম। চা বসালাম। চা খেয়ে ঘুম দিলাম। দুপুর দু’টায় মেঝ ভাই ও বড় ভাই এসেছে। দরজা খুলে দিয়ে আমি আবার ঘুমুতে গেলাম। ভাইয়ারা আমার কাছে এসেই জিজ্ঞেস করলো

-গতকাল রাতে কোথায় ছিলি ?

-কেন ? মেহেরের ওখানে। মেহেরের বড় বোনের বিয়েতে গিয়েছিলাম।

-কাার অনুমতি নিয়ে?

-মাকে বলেছিলাম।

-রাতে থাকার কথা ?

- মাকে ফোন করে বলেছিল।

-কে বলেছিল ?

-মেহেরের মা বলেছিল।

ওদের এতসব প্রশ্ন শুনে আমার মাথা ধরে যাচ্ছে। আমিতো সাত-খুনের আসামী নই যে এতো জেরা করতে হবে। তেমন কোন অপরাধও করিনি যে এতসব প্রশ্নের মুখোমুখী হতে হবে। আমি বললাম, এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। যা জানার মাকে ফোন করে জেনে নাও।

মেজদা সাথে সাথে মুখে তাপ্পড় মেরে বলল, আমাদের বলে গেছিলি ?

আমি কেঁদে কেঁদে বললাম, মাকে বল্লে আর তোমাদের বলতে হচ্ছে কেন ?

গতকাল রাতে মৃন্ময় নামের একটা ছেলে তোর ছবি দিয়ে ওর স্যাটাস আপডেট দিয়েছে। এটা শুনে আমি হা হয়ে গেলাম। মেঝদা কম্পিউটারে কিলার খেলার সময় আমাদের গোল করা বসা ছবিটা আপলোড করেছে। ছবিটা এডিট করা। আমার দিকে ইঙ্গিত করে একটা নোট লিখেছে। “ভালবাসার উচ্ছল প্রবাহে আমি একা। বলো ওকে কিভাবে সঙ্গে আনি।”এটা দেখে আমার মাথা ধরেছে প্রচন্ড। মেঝদা বলছে, এখন বল এই কুকুরটা কে ? এবার বড়দা হাত তুল্ল। আমি প্রচন্ড ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলাম। সাবার সামনে ওরা দু’জন আমাকে পালা বদল করে বেদড়ক মারলো। আমি ছোট বলে ওদের কিছু করতে পারলাম না। ইচ্ছে করছিলো ওদের নামে নারী নির্যাতন মামলা করি। কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে করা হল না। সবচেয়ে রাগ হলো মায়ের উপর। মা নাকি ভাইদের বলেছেন, ওনি আমাকে রাত্রে থাকার অনুমতি দেননি। এই ঘৃণিত জীবনের ভার আমার আর বইতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে, নিজেকে শেষ করে দিই ...

দিদির ডাইরিটা বন্ধ করে আমার বুকের উপর রাখি। চোখ ছল ছল করছিল। বালিশ চাপিয়ে অনেক্ষণ ধরে কান্না করি। শেষ রাতে চোখে ঘুম আচঁড়ে পড়ল ।



আট

সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গল। আলো জ্বালানোর পরও সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। মুখ ধুয়ে খুব আরামবোধ করছি। চোখের ঝাপসা নেশাটা কেটে গেছে। বেসিনের উপর একটি আংটি পড়ে আছে। অদ্ভুদতো, আমার এখানে মেয়ে কখন এলো ! ঘুমানোর আগে যখন এসেছিলাম তখনও দেখিনি। ধ্যাৎ এখন কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। ঠিক মিসির আলীও হতে চাইছে না মন। টেবিলের উপর একটা গিফ্ট পেপারে মোড়ানো বাক্স চোখে পড়ল। দৌড়ে গেলাম। অত্যন্ত সুন্দর একটা গিপট পেপার। সবচেয়ে মনোহরী পেপারের গ্রাফিক্সটা। রক্তাক্ত পানকৌড়ি। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্তের কণাগুলোই জানান দিচ্ছে। আহত পানকৌড়ি বাচাঁর জন্য কম চেষ্টা করেনি। অনেক্ষন ডানা ঝাপটানোর পরেই প্রাণের মায়া ছেড়েছে। বুঝতে পারছি না কে দিয়ে গেল। উপরের কোথাও কিছুই লেখা নেই। আস্তে আস্তে খুলি যাতে গিপট পেপারটা না ছিড়ে। এটি আমার রুমে ওয়ালমেট হিসেবে দারুন মানাবে। অবাক কান্ডতো ! খুবি সুন্দর একটা ডাইরি। এপিট ওপিট দেখলাম। খুবি চমৎকার অলংকরণ। কাবারের উপর কিছু ঢেলে দেওয়া রক্ত। সেই রক্তের উপর আঙ্গুল দিয়ে লেখা “অপরাহেৃর গল্প”। নিশ্চয় দিদির কাজ। হুমায়ুন আহমেদের প্রচুর লেখার মধ্যে দিদির সবচেয়ে পছন্দের একটি লেখা। কাবার উল্টাতেই চোখে পড়ল

খোকাবাবু,

ইদানিং বড় দুষ্ট হয়েছিস না বলে আমার ডাইরি পড়ছিস। আমি খুব রাগ করেছি। মন আমার দারুন ব্যাথা পেয়েছে। এই আমার ব্যাথার দান। তোর প্রতি আমার শেষ উপহার। ভালো থাকিস।

তোর হতভাগ্য দিদি

উপহারের আগে শেষ অভিধায়টা কেন ব্যবহার করল ? এমন কি অপরাধ করেছি যে আমাকে আর উপহারই দিবে না। আমারও দিদির উপর খুব রাগ হলো। আরেকটা পৃষ্টা উলটালাম। এটা ছড়া লেখা আছে। আস্তে আস্তে পড়লাম।

খোকা-খুকু

জানিস কি/ওগো খোকা?/তুই যে/বড়ই বোকা।/আনবি কবে/দুষ্টু খুকু?/মুচবি কবে/সব দুঃখ।

একটু করে হাসলাম। হেসে হেসে আরেকবার ছড়াটা পড়লাম। খুব মজা লাগছে। ডাইরির আরেক পাতাতে গদ্যাকারে কিছু লেখা পেলাম। দিদি হয়তো অনেক রাত পর্যন্ত আমার রুমে ছিল। বেসিনে পাওয়া আংটিটাও হয়তো তার। লেখাটা এখন পড়তে ইচ্ছে করছে না। ডাইরিটা বন্ধ করে আরেকবার দিদির ক্যালেগ্রাফিটা দেখে মুগ্ধ হলাম। মুখ দিয়ে একটা শব্দই শুধু বেরিয়ে এল। লা জবাব দিদি।

বের হয়ে দিদির রুমে নক করলাম। অনেক্ষন নক করার পরও দরজা খুলেনি। ওদিকে বড়দা ঘুম থেকে উঠে রেগে মেগে বলছে সাঝ সকালে তোর হয়েছেটা কি ? আমি আমতা আমতা করে কিছু হয়নি বলে চলে আসি। বিছানা আর আমার শরীরের আকর্ষণ জোরদার হওয়াতে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে হলো। ডাইরিটা হাতে নিয়ে গদ্য আকারের লেখাটা পড়লাম।

“জানিস খোকা ? আজ আমি দারুন এক স্বপ্ন দেখেছি। সেটাও জীবনে যাকে সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করি তাকে নিয়ে। তোর একটা বন্ধু মহাপুরুষ হওয়ার দান্ধায় নেমেছে বলেছিস না। ছেলেটার একটা বাণী তুই আমায় সবসময় বলতিস। আজ মনে হয় সেই বাণী বাস্তবে ঘটছে। তুর বন্ধুটা কী সত্যিই মহাপুরুষ ? - তুমি যাহাকে দু’চোখ ভরে ঘৃণা করিবে, দেখিবে তাহাই কো’থেকে চার চোখ জোগাড় করিয়া তোমার পেছনে ছায়ার চেয়েও আপনতর হয়ে চলিয়াছে। এই বাণীটা এখনও আমার শিরা উপশীরায় ময়ুরের মত পেখম তুলে নাচঁছে। আচ্ছা স্বপ্নটার কথা শুন,

আমি কলেজের বাগানে বসে আছি। মৃন্ময় গোলাপ হাতে নিয়ে মৃদু পায়ে আমার দিকে আসছে। ওকে খুব সুন্দর লাগছে। কাছাকাছি এসে বলল, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। হাতে সময় হবে ? আমি মুখ বাকিয়ে বললাম সরি। আর হে, তুমি নিশ্চয় আধুনিকতার মহান ভক্ত। ও মাথা নেড়ে বলল হ্যাঁ। বলি তাহলে ভাষার ক্ষেত্রে এখনও আদিম যুগে কেন হাবলা ? এখন থেকে আর হাতে সময় আছে কিনা কারো কাছে জানতে চাইবে না। ও বলে ওঠল কেন ? এটাও খুলে বলতে হবে ? তখনকার যুগে মানুষ হাতে ঘড়ি পড়তো। তাই ঘড়ি ও ঘড়ির সময়ের সাথে হাতের দহরম মহরম গড়ে উঠেছিল। এযুগে তো আর মানুষ হাতে ঘড়ি পড়ে বসে থাকে না। পকেটে পকেটে মুবাইল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সময়ের কথা জানতে চায়লেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে তারপর বলে সময় নেই। তাই ঘড়ির স্থানটা এখন মোবাইলের। ঘড়ির সময়ও এখন হাতকে ছ্যাঁকা দিয়ে পকেটের সাথে পরম প্রণয়ত্ব তৈরী করেছে। তাই এখন থেকে সকলের কাছে জানতে চাইবে পকেটে সময় হবে কিনা। বেচারা এতক্ষণ যন্ত্রের মত দাড়িয়ে আমার কথা গুলো গিলছিল। শেষে জিজ্ঞেস করলো । তাইলে নিশ্চয় তোমার পকেটে সময় আছে ? আমি তাও সরি। কারণ যে সময় পকেটে ছিল তা তোমাকে লেকচার দিয়ে শেষ করেছি। পঁিচশটা টাকা দাওতো। হাবলার মতো তাকিয়ে আছে কেন ? মৃন্ময় সম্বিত ফিরে পেয়ে পঞ্চাশ টাকা বের করে দিল। আমি চোখ রাঙ্গিয়ে বললাম পঁিচশ টাকা চেয়েছি। বেচরা মুখ কালো করে বলল ভাংতি নেই। আমি টাকাটা হাতে নিয়ে পাশে দাঁিড়য়ে থাকা অন্ধ ফকিরকে দিয়ে দিলাম। আর শোন, যে টাকাটা নিলাম ওটা আমার লেকচারের বিনিময় মূল্য। তোমাকে ফকিরের মত লাগছে তাই কম নিলাম। নয়তো পাঁচশোর নিচে আমি লেকচারই দিই না। হাতের ফুল গুলো কার জন্য ? ও নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার জন্য এনেছিলাম। ওগুলোও ফকিরটাকে দিয়ে দাও। যুবকের আধুনিক যুগের যুবক ফকির। গার্লফ্রেন্ড থাকলেও থাকতে পারে। তোমাদের গার্লফ্রেন্ডকে উপহার দিতে ইচ্ছে করে। উদের কি দিতে ইচ্ছে করে না। আমি গম গম করে হেঁেট চলে এলাম। বেচারা লাখ টাকা হারানো বিপর্যস্ত লোকের মতো নিরাশ চোখে অপলক তাকিয়ে আছে। পরেরদিন সকালে একগাধা গোলাফ নিয়ে মৃন্ময়ের বাসায় যেতে খুব ইচ্ছে করল। ইচ্ছেটাকে দমালাম। শেষে কলেজের পথে পা বাড়ালাম। কলেজে পৌছে দেখি হাদারামটা গেইটে দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে ওর সতেজতা ফিরে এসেছে। আমার হাতে গোলাপ দেখে আরো চমকে গেছে। ছেলেটা দেখতে বাজে না। হাসিটাও চরম। আমিও হেসে আলতো পায়ে এগিয়ে গেলাম। আমার ইচ্ছের পরিবর্তন খুবি দ্রুত ঘটে। যেমন এখন ওকে ফুল গুলো দিতে আর ইচ্ছে করছে না। কি আর করা ? ওর পাশে এক জোড়া কুকুরকে প্রেমমত্ত্ব দেখা গেল। মজনু ঠিক জায়গায় বেছে নিয়েছে। ফুল গুলো কুকুর দু’টোর মাঝে রাখলাম। ওরা গন্ধ নিয়ে মৃদু স্বরে ঘেউ ঘেউ করে আমাকে ধন্যবাদ জানালো। বেচারার মুখে মেঘের উপস্থিতি ঠের পেলাম। ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, এর নাম লায়লা আর ওর নাম মজনু। অনেক কষ্টে গত বছরের এই দিনে ওদের বিয়ে দিয়েছিলাম। আজ ওদের বিবাহ বার্ষিকী। আমি ওদের শুভ বিবাহ বার্ষিকী বলে কলেজে ঢুকে পড়লাম। ঠিক তখনি ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠে মুখ হাত ধুয়ে তোর কাছে যায়। জীবনে শেষবারের মত তোর সাথে বসে পুরো রাত চা খেয়ে খেয়ে গল্প করতে মন চাইল। কিন্তু তোর বুকের উপর আমার ডাইরিটা দেখে আর ডাকতে পারলাম না। লেখাটা লিখার পর আর দ্বিতীয়বার পড়েও দেখা হয়নি। তোর পাশে বসে পড়ি। যে সামান্য সুখটুকু ছিল বুকের ভেতরকার অসহনীয় ব্যাথার তান্ডবে তাও হারিয়ে পেললাম। শেষ ইচ্ছেটাও পুরন হলো না। ভালো থাকিস।

ইতি

নিজের হিনতা ও দৈন্যতায়

নূয়ে পড়া তোর মেঝদি।

লেখাটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল। বুঝলাম না দিদির বারবার শেষ শব্দটা ব্যবহার করার রহস্য। আমার মনটা হঠাৎ অজানা ভয়ে ক্ষেপে উঠে। দৌড়ে বেরিয়ে দিদির দরজায় নক করলাম। অনেক্ষন। খুলছে না। বাসার কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। কারো ঘুম না ভাঙ্গার মতো করে ডাকলে দিদি দরজা খুলছে না। একটা ছুরি এনে দরজার খিল বরাবর কেটে দরজা দাক্কা দিলাম। অর্ধেকটা খুলে কপাট আটকে গেল। প্রচন্ড বেগে পাখা ঘুরছে। পোড়া কতগুলি কাগজ উড়ে এসে আমার মুখে এসে পড়ল মুখ পরিস্কার করে ভেতরে ঢুকলাম। দিদি বলে চিৎকার দিয়ে নিচে পড়ে গেলাম। ওর হাতের পায়ের এবং গলার প্রত্যেকটা রগ কাটা। এখনও রক্ত ঝরছে। কিছু ঝমাট বাধা রক্তের উপর লেখা মৃন্ময় ...। দিদিকে ঝড়িয়ে ধরতে গিয়ে লেখাটা নষ্ট হয়ে গেল। আধপোড়া অবস্থায় দিদির ডাইরির কয়েকটা পাতা পেলাম। এগুলোও রক্তে ভিজে চুপসে গেছে বিকট একটা চিৎকার মুখ থেকে বেরিয়ে আসার মূহুর্ত পরেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। এরপর কি ঘটেছে তা আমার অজানা।



নয়

চার মাস দশদিন হয়ে গেছে দিদির মৃত্যুর পর। আমি এই প্রথম চোখ খুলে তাকালাম। মা পাশে বসে কাঁদছে। আমাকে চোখ খুলতে দেখে মা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠল। ডাক্তার ছুটে আসল। কি সব পরিক্ষা করে মাকে বলল, পুরোপুরি সেরে উঠতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে। মাথায় এক প্রকার যন্ত্রনা হচ্ছে। ঘুমের ঔষধ দিয়ে ডাক্তার ঘুম পাড়িয়ে দিল। অনেক রাতে ঘুম ভাঙ্গল। মা আমার পাশে বসে কোরআন পড়ছে। খুব ভালো লাগছে শুনতে। আমাকে খাওয়ানোর ”েষ্টা করছে। কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না। মাকে অবাক করে কাঁচা তিৎ করলা খাচ্ছি। আমি নাকি তিৎ করলার নামই শুনতে পারতাম না। অথচ এখন খুব মজা করে খাচ্ছি। কেন বুঝছি না। মনে হয় মা ঠিকই বলতেন সবকিছু বোঝার মতো বয়স আমার হয়ে উঠেনি।

এক সপ্তাহের পরের কথা আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। বাসায় চলে এসেছি। দিদির রুমে ঢুকা আমার জন্যে মানা। অন্য সব ক্ষেত্রে আমি যা বলি তা সবাই মেনে নেই। আমার রুমে ঢুকে অনেক্ষন অপরাহেৃর গল্প ডাইরিটা খুজলাম। পাওয়া গেল না। তন্য তন্য করে খুঁজেছি। পায়নি। মাকে ডাকলাম। ডাক শুনে মা দৌড়ে এলেন

-মা আমার রুমে কেউ ঢুকেছিল ?

-নাতো তোমার রুমেতো তালা ঝুলানো ছিল।

-কিন্তু আমি একটা বই পাচ্ছি না।

-কোথাও ফেলেছিস হয়তো ?

-না আমি এখানেই রেখেছিলাম। তখন বড়দি দুধ নিয়ে ঢুকল। আমার ব্যস্ততার কারণ জেনে তিনি বললেন। মেহের এসেছিলেন। ও চাবি নিয়ে তোমার রুমে ঢুকেছিল।

-মা আমার ফোনটা দাওতো। মা ফোন এনে দিল। আমি মেহেরকে ফোন করলাম। মেহের রিসিভ করে বলল, জানতাম তুমি ফোন করবে। আমি রেগে মেগে জানতে চাইলাম, তুমি আমার কামরা থেকে কিছু নিয়েছিলে ? মেহের সহজ কন্ঠে বলল, হ্যাঁ ভাই নিয়েছি। তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে। তোমার পকেটে সময় হবে ? আমি না ভেবে হ্যাঁ বলে দিলাম। কাল তাহলে আমরা দেখা করি? আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম কোথায়?

মেহেরু বলল, বিপ্লব উদ্যানে। আমি ঠিক আছে বলে রেখে দিলাম। ফোন রাখতেই মা বলল, দুধটুকু খেয়ে ফেল খোকাবাবু। খোকাবাবু শব্দটি মাথায় দারুভাবে আঘাত করেছে। মা হাত বুলিয়ে দিলেন। তার বুকে মাথা রাখতেই মনে হলো হিমেল হাওয়া আমার শরীরে মৃদু স্পর্শ বুলিয়ে গেল। পরদিন মাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে মেহেরের সাথে দেখা করতে গেলাম। সময় মত মেহের উপস্থিত ছিল। ওর হাতে আমার ডাইরিটা ছিল সাথে অন্য একটা ডাইরি। আমাকে দু’টো ডাইরিই ফেরত দিলো। অন্য ডাইরিটা দেখে বললাম এটা কার? মেহের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আপুর মৃত্যুর দু’দিন পর আমি তোমাদের বাসায় যায়। আপু সবসময় তোমার কথা বলত। হিমেল এই করে হিমেল এই রকম। সারাদিন তোমার কথা মুখে লেগে থাকতো। তাই আমার মনে হলে তোমার রুমে কিছু একটা থাকবে। যাতে আমি আপুর মৃত্যুর কারণটা জানতে পারব। তোমার বিছানায় ডাইরিটা পেয়েছিলাম। তখনি যা লেখা ছিল সব পড়ে ফেলি। আর বেসিনের উপর এই আংটিটা পেয়েছিলাম। আমি ঝাপটি মেরে আংটিটা নিয়ে নিই। আমার হাতে পড়তেই মেহের বলল, তোমাকে খুবি মানাচ্ছে। আমি রেগে বললাম, এগুলো বাদ দাও বাকি কথা বল। এর পর পালংকের নিচে পাই ফ্লাক্সে এককাপ গরম চা। তোমার জন্য হয়তো বানিয়েছিল। আমি খেয়ে ফেলেছি। এটার জন্য দুঃখিত। আচ্ছা হে তুমি আমার নাম্বার পেলে কো’থেকে ? আপু ছাড়া তোমাদের কারো কাছে আমার নাম্বার থাকার কথা নয়। এখন আমার মাথা চক্কর খাচ্ছে। সত্যিই তো ! দাড়াও এক মিনিট। আমি মোবাইলে সার্চ করে দেখি। দিদি শেষ যেদিন আমার রুমে গিয়েছিল সেদিনেই আমার মোবাইলে মেহেরের নাম্বারটা সেইব করে দিয়েছিল। আরেকটা লম্বা নোটও মোবাইলে লিখেছিল।

মেহের। মেয়েটা খুবি ভালো। সবার কাছে তোর কথা বেশী বেশী বলতাম। তোর ব্যাপারে শুনতে শুনতে মেহের তোর প্রেমে পড়ে যায়। কখনও তোকে দেখেনি। অথচ না দেখেই তোকে ভালবেসেছে। মনে হয়েছে সত্যিই ও তোকে খুব ভালবাসে। তোর বেসিনে যে আংটিটা রেখেছি ওটা ভুল করে ফেলে আসিনি। মেহের তোর জন্য আমাকে কিনে দিয়েছিল। কিন্তু তুই আমাকে মিশুর ব্যাপারে বলাতে আর কিছু বলিনি। আজ লিখে দিলাম। এটা আমার দায়িত্ব ছিল বলে। যদি কখনো পারিস ওর ভেবে দেখিস।

আমি নোট পড়ে একবার আমার হাতের আংটি ও আরেকবার মেহেরের দিকে তাকিয়ে উঠে চলে আসছি।

কিছু না খেয়ে চলে যাচ্ছ ?

আজ নয় অন্য কখনো।

তোমাকে তো আসল কথাটাই বলা হয়নি। পরে শুনব বলে হাটা দিলাম। ও একটু জোরে মৃন্ময় দা বলে থেমে গেল। আমিও ফিরে আসতে বাধ্য হলাম।

- কী হলো বলো ? মৃন্ময় দা কী ?

-আসলে অন্য ডাইরিটা মৃন্ময়দার।

-উনি কোথায় ?

-উনি আপুর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেছে।

-মানে।

-আসলে তোমার ডাইরিটা এনে আমি উনাকে পড়তে দিই। ওই রাতে ওনি ডাইরিটা পড়ে আতœহত্যা করে। কেন আত্মহত্যা করেছে বুঝতে পাছো?

আমি চোখ বুজে ফেলি। মেহেরও হয়তো চোখ বন্ধ করল। দু’জনের চোখেই পানি চলে আসলো। চোখ খুলে সব ঝাপসা দেখছি। প্রথমে এপিট ওপিট উল্টে মৃন্ময়দার ডাইরিটা দেখলাম। কবারটা খুলতেই একটা কবিতা চোখে পড়ল। হয়তো রক্ত দিয়ে লেখা। ভালবাসা শুধু/তোমারই তরে/বিসর্জন দিলাম/আমরা দু’জনে.../জানবে না কেউ/ এই ভালবাসার শেষ পরিণাম/বুঝবে না কেউ কি পেলাম এউ বিসর্জনে/ স্বর্গে ঘর দু’জনে...

আমি আর পারছিলাম না। ডাইরিটা বন্ধ করে রাস্তায় নেমে পড়লাম। মাথার ব্যাথাটা আবার ধরেছে। পেছনে ফিরে তাকালাম। মেহের আমার পেছনে পেছনে আসছে। রাস্তায় একটু দাঁড়ালাম। রাস্তায় একটা পানকৌড়ি হাটঁছে। হয়তো পাশের বিল থেকে উঠে এসছে। দারুন লাগছে দেখতে। হঠাৎ একটা গাড়ি পানকৌড়িটাকে ধাক্কা দিল। চারপাশ রক্তে রক্তে ভরে গেছে। প্রচন্ডভাবে সে ডানা ঝাপটাচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে ওটার দিকে হাঁটছি। পেছন দিক থেকে কেউ যেন ডাকছে আমায়। কিন্তু ওদিকে মন নায়। মেঝদির চেহারাটা চোখে ভাসছে। পানকৌড়ি আর মেঝদির চেহারাটা গুলিয়ে ফেলছি। একটা বাস আচমকা এসে ধাক্কা দিল। আমি বিকট একটা চিৎকার দিয়ে দূরে ছিটকে পড়লাম। চারপাশে বিদঘুটে আঁধার নামছে। মেহের দৌড়ে এসে আমার মাথাটা কোলে তুলে নিল। ও ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। এর পরে ?...



দশ



আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি একটু সুস্থবোধ করছি। চোখ মেলছি। আমার সামনে বাবা-মা আর মেহের বসে কোআন পড়ছে আর কাঁদছে। পায়ের দিকে বড়দা, মেঝদা, বড়দি ও ভাইরা নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে। পাশে বসে বসে আমার আদুরে ভাগ্নিরাও কাঁদছে। বড়ভাগ্নে ইহমা হঠাৎ বলছে। জান মামা, তুমি অনেক আগে যখন অসুস্থ ছিলে। ঘুমিয়ে ছিলে, তখন তোমার বিয়ে হয়েছিল। অনেক কষ্টে বললাম - মানে ? কী বলছ তুমি ?

-সত্যিই তো , মিশু মামীর সাথে।

আমি মার দিকে তাকালাম। মা অঝোরে কেঁদে দিলেন। মা তার কোরআন শরীফের পেছন থে দু’টা চিটি এবং কতগুলো ছবি বের করে দিলো। আমি প্রথমে ছবিগুলো বের করলাম একটা একটা করে দেখছি। আমার চোখ দিয়ে শ্রাবণধারা বইছে। আমি চোখ বন্ধ অবস্থায় শুয়ে আছি। আশপাশে কেউ নেই। শুধু কনের সাজে মিশু আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদছে। সবগুলো ছবি এভাবেই তোলা। ছবিগুলো রেখে আমি ভেজা চোখে মায়ের দিকে তাকালাম।

-মা ও কোথায় ? কাঁেদা কাঁেদা স্বরে জানতে চাইলাম। মা দুহাতে মুখ ঢেকে কান্না শুরু করে দিল। মেহের কোরআন বন্ধ করল। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বল্লো, আপনারা একটু বাইরে যান। মা যেতে চাইল না। তবু জোর করে পাঠিয়ে দিল। ও আমার পাশে বসল। আমার মাথায় হাত রেখে বলল, নিজেকে সামলাও। -কেন ? মিশু কোথায় একটু বলতো ? মেহেরের চোখের কোণাতেও অশ্রু বিন্দু চিক চিক করছে। আমি আবার বললাম, প্লিজ মেহের ওকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কোথায় মিশু ? মেহেরও বলছে না। খামগুলো খুলে চিটি দু’টা পড় বলে মেহের হু হু করে কেঁদে বেরিয়ে গেল। আমি প্রথমে ছোট খামটা খুললাম। খামের উপরে গোটা অক্ষরে লেখা “শুভ ভালবাসা দিবস”। নিশ্চয়ই আমাকে ভ্যালেন্টাইন ডে’তে উইস করেছে। ভেতরের কাগজটা বের করে পড়তে শুরু করি।

. .... ...





এটি একটি বিচিত্র রেলগাড়ি। এর সঠিক রঙ কেউ বর্ণনা করতে পারেনি। একে নিয়ে নানা মতির নানা মত। এই ট্রেনে বিচরন করে শুধু দু’টো সত্তা। আর এর একমাত্র চালক বিশ্বাস। বিশ্বাসের অনুপস্থিতি মানে এই ট্রেনটা দূঘটনার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা একশোতে দু’শো...

আজ তার বিশেষ একটা দিন। এই দিনেই পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল তার তেজ, মহিমা। আজকের দিনটাতেই তার জয় সর্বত্র এই মহান সত্যকে প্রতিষ্টা করেছিল ভ্যালেন্টাইন। আমার ধারনা গাড়িটার রঙ লাল। ভ্যালেন্টাইনের রক্তে রঞ্জিত। এর বিচিত্র রঙ পৃথিবীকে রাঙিয়ে তুলে মনোহরী রূপে। আমি এ ট্রেনের যাত্রী হয়ে পড়েছি তোমাকে সাঙ্গ করে। হবে কি আমার সহযাত্রী....

পাগলিটার লেখা পড়তে পড়তে হাসি চলে আসল। প্রাণ খুলে হাসতে মন চাইল। পারলাম না। বাহির থেকে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ওরা ভাবছে আমি পাগলই হয়ে গেছি হয়তো। না হলে পুরো শরীরে যার ব্যান্ডেজ সে কিনা হাসে ? চোখে ব্যাথা অনুভব করছি। তাই চোখ বন্ধ করলাম। অনেক্ষন পর চোখ মেলি। আশপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা। একজন বসে বসে পেছন থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি মাথা তুলতে গিয়ে ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠি। পেছন থেকে বলে উঠল, আমি মেহের। আমি আর কথা না বলে অন্য খামটা খুললাম। নাতীদীর্ঘ একটা পত্র। মিশুর হাতেরই লেখা।

প্রিয় হিমেল,

জানি ভাল নেই। আজ আমার পূরনো সব স্মৃতি মনে পড়ছে। তোমাকে প্রথম কোথায় দেখেছিলাম। তোমার কোন কাজটা আমায় বেশী কাছে টেনেছে। তোমার সাথে কাঠানো সব মুহুর্তগুলোরই রোমান্থন করতে মন চাইছে এই চিটিতে। কিন্তু পারছি না। আমার হাতে যে সময় খুবই কম। ওসব বলতে গেলে মূল কথাটায় বলা হবে না। আমি অল্প বয়সে মারা যাব এটা জানতাম না। বাড়ির সবাই জানত। যখন আমি জানি তখন তোমাকে ছাড়া একটা মূহুর্ত থাকাও আমার জন্য অসম্ভব। এত কম বয়সে মরতে হবে জানলে তোমাকে আমার জীবনের সাথে জড়াতাম না। আমার হাতে মাত্র ৪৫ মিনিট সময় আছে। মূল কথা লিখতে এই সময় খুবই কম। কারন লিখতে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে।

তুমি জান, আমি তোমায় কদ্দুর ভালবাসি। মনে আছে তোমার ? একবার তুমি দু’তলা থেকে লাফ দিয়ে আমার ভালবাসার প্রমান চেয়েছিলে। আর আমি তখনই ওঠে লাফ দিয়ে একটা পা ভেঙ্গে ছিলাম। সেই কারণে হ্যাডস্যার তোমার সাথে দু’দিন কথাও বলেনি।

আমিও জানি। তুমি আমায় কতটুকু ভালবাস। কিন্তু আমাকে বুঝতে দাওনি। আমাকে নিয়ে লেখা তোমার প্রত্যেকটা কবিতা আমি চুরি করে করে পড়েছি। আমার কারণে তোমাকে তিনজন স্যার মিলে মারধর করেছিল। তুমি তাঁদের বলেছিলে,“যে ভালবাসা মারের ভয়ে পালায় তা ভালবাসা নামের কলঙ্ক। কিন্তু আমি যে ওকে প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসি। আমার শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত ওকে ভালবেসে যাবো...”

যখন জানতে পারি আমি মারা যাব তখন আমার সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল, এ ভেবে এই জন্মে তোমার সাথে বিয়ের পিঁড়ীতে বসা হবে না। কিন্তু আমি মানতে পারছিলাম না। তুমি যখন অজ্ঞান ছিলে। বন্ধুরা সবাই প্রায় সময় তোমাকে দেখতে যেতাম । তখনই আমার জেদটা আরও বেড়ে যায়। একদিন রাতে আমি কান্না করছি। আর জোছনা দেখে দেখে তোমার কথা ভাবছি। জোছনাকে বলছিলাম, তোর সাথে যে আমার বন্ধুত্ব গড়িয়ে দিয়েছিলো সে আমাদের ছেড়ে পালাচ্ছে। আমার কান্না শুনে মা জেগে উঠে। মা ভীত হতে জানতে চাইল। কী হলো মিশু ? তুই কাঁঁদছিস কেন ? আমি মাকে বললাম, মা আমি কয়েকদিন পরে মারা যাব আমার একটা শেষ ইচ্ছে আছে। পূরন করবে মা ? শুনেছি মৃত্যুগামী মানুষের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করে। মা তখনই কেঁদে উঠলেন। মা বলেলন, বল মা, আমি অবশ্যই পূরন করব। আমি মাকে তোমার আর আমার সম্পর্কের কথা খুলে বলি। আর মাকে বলি। আমার শেষ ইচ্ছে হলো, হিমেলকে মৃত্যুর আগে বিয়ে করা। মা বাবাকে বললে বাবা আমাকে অনেক সমস্যার কথা বলে। আমি কিছুই মানতে নারাজ। রেগে মা-বাবাকে বললাম, মুমুর্ষ মেয়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করার ক্ষমতাটুকুও তোমাদের নেই? বড়ইতো বলতে, আমাকে খুব ভালবাসো। শেষ পর্যন্ত বাবা-মা রাজি হলেন।

উনারা তোমার বাবা-মাকে এসে ব্যাপারটা বলে। বাবা-মা কোন মতেই রাজি হয়নি। একদিন আমি রাতে তোমার দেওয়া একটা বই পড়ছিলাম। তখন তোমার মা-বাবা এসে বলে ওনারা দু’জনেই রাতে স্বপ্নে দেখে আমি মারা গেছি। তাই সবাই রাজি হয়ে গেল।

ভালবাসা-দিবসেই আমাদের বিয়ে হয়। তোমার কেবিনে আমি ছাড়া কেউ ছিলনা। তোমার সাথে অনেক ছবি তুলেছি। সব ছবি তোমার দেওয়া ক্যামরা দিয়ে তোলা। আমাদের খুব মানিয়েছে। পরকালে আমি প্রভুর কাছে স্বামী হিসেবে তোমাকে প্রর্থনা করব। তুমি আমাকে চাইবে তো ? আমার হার্টের ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। ঘড়ি দেখলাম। আর একটা মিনিট সময় আছে। ভাল থেকো। এখন আমি কি লিখছি নিজেও জানিনা।

ইতি

মিশু -

চিটিটা ভেজা ভেজা লাগছে। এখনও চোখ বেয়ে পানি পড়ছে আমার। মাথায় খুব ব্যাথা। মা বলে চিৎকার দিলাম। মা দৌড়ে ভেতরে ঢুকল। মা, আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। মাথার ভেতরে কিসের জন্য হলুস্তুল টানাটানি পড়েছে। মনে হচ্ছে কেউ আমার মাথা আঘাত আঘাতে চূর্নবিচুর্ন করছে। মা। মাগো...

-বল হিমেল, এইতো আমি তোর পাশেই আছি।

- সব ঝাপসা লাগছে কেন ? কিছুইতো স্পষ্ট দেখছি না । মনে হচ্ছে অতলস্পর্শী এক সমুদ্্ের ডুবছি।

-মা, একটা কবিতা শুনবে?

-হ্যা, বাবা বল।

স্মৃতিটা ঝাপসা ঝাপসা / হয়ে পড়েছে, নতুবা স্মৃতির অবয়বে/ মরীচা পড়েছে হয়তো? বড় ক্লান্ত সে;/আর কতইবা বয়ে বেড়াবে পাগলের /বোঝা সে? দিনক্ষন কিছুই ঠিক মনে পড়ছে না।/কত সময় গড়ালো তাও ঠিক ধরতে পারছি না।/তবে মনে আছে শুধু এইটুকু,/তোমাকেই খুঁজার জন্যে বেরিয়েছিলাম আমি/এবং আমার পাগলাটে বন্ধু।/আজ হয়তো হাজার বছর নতুবা যুগের /কাছাকাছি গিয়ে কালের ঘড়ি বকছে আমায়/“অদ্ভুদ এই পাগলটার হলোটা কী?/কতো বিদগ্ধ দুপুরে পুড়ে খাক/হয়েছি তোমার অন্বেষণের নেশায়?/কিন্তু কোথাও খূঁেজ পাইনি কো তোমায়।/এমন অনেক দিন গেছে,/প্রখর সূর্য়ের তাপ সয়তে না পেরে/পিচঢালা পথ চৌচির হয়েছে ফেটে; অথচ/আমি সামান্য কষ্ট অনুভব করিনি। কারণ/আমার অনুভূতির রাজ্যে একা/তুমিই করছিলে বিচরণ।/আমার পাগলাটে সুহৃদ? সে হয়তো/অনুভব করেছিল, কিন্তু প্রকাশ/করেনি আমায় ভালবাসে বলে.../কখনো দেখেছি পথ-ঘাট সব/অথৈ পানির নিচে বিলীন হয়েছে।/সেখানে দু’জনে মিলে সাঁতরে সাঁতরে/খুঁজেছি শুধু তোমায়। কিন্তু/তোমায় পাওয়া হলো না.../এখন তোমাকে আর স্বপ্নেও দেখা হয় না!/আাগে, অনেক আগে; তুমি/প্রতিদিন আমায় স্বপ্নে এসে/জড়িয়ে ধরে বলতে, এতো/উষ্ণ কেন তোমার বাহু? আমি/হেসে উড়িয়ে দিতাম সেই অনুযোগ/এই বলে, তোমার উষ্ণ আদরে.../আজো আমি এবং/আমার পাগলাটে বন্ধু তোমায়/খুঁজছি হন্যে হয়ে।/দেখো, আমাদের পায়ের তলা/ঝাঝরা হয়ে গেছে; আমি কেমন কচি বাঁশের/ফালির মতো দেখতে হয়েছি। আর আমার বন্ধু?/সে তার এতসব ক্লান্তি, দুঃখ ভুলে গেছে/আমার ভালবাসার ঐশ্বর্য দেখে। অথচ,/তোমার হলো না আজো আমায় বুঝা?/কবে বুঝবে তুমি আমায়?/আমার এই অদ্ভুদ পাগলামি?/হয়তো তুমি বুঝে উঠার আগেই আমি....

মা কবিতাটা কেমন হলো? মা কেঁদে কেঁদে বলল খুবই ভাল হয়েছে। আমি কথা বলতে গিয়ে অশ্রু সংবরন করতে পারছিনা। কবিতাটা মিশুর জন্যে লিখেছিলাম। মা নিরবে কাঁদছে। কোন কথা বলছেনা।

পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম মায়ের দেওয়া ৫ উপদেশের কাগজ এখনও আছে। লেমেনটিং করা হয়নি। বুঝতে পারছি আমার মুমুর্ষ অবস্থা। বাঁচার গ্যারান্টি শূণ্যের কোটায় আর পটল তুলার নিশ্চয়তা একশোর ঘরে। মায়ের শেষ উপদেশটা পড়তে ইচ্ছে করছে। জন্মের মতো কেঁদে নিতে মন চাইছে। চোখ দিয়ে পানি সরছেনা। কাগজটা বের করলাম। আস্তে আস্তে পড়ছি...

৫. মা যখন মারা যাবো; মায়ের জন্যে বেশী বেশী আল্লাহর কাছে দোয়া করবি। ওখানে তোর মুখের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে তাকবো আমি। আমি নিরাশ করিস না। এতটুকু পড়তেই বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো। মা জড়িয়ে ধরলো আমাকে।

মা, এখন আমিতো তোমার আগেই যাচ্ছি। দোয়া করবেতো আমার জন্যে। আমি তোমার পথ চেয়ে বসে থাকবো। অপেক্ষা করবো তোমার জন্যে...

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ১:১২

উদাস কিশোর বলেছেন: ব্লগে এত বড় লেখা খুব কমই পড়া হয় । তবু সময় করে পড়ে নিলাম ।
ভাল লেগেছে

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.