নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেখা-লেখির জগতে আমাকে আসতে হবে তা’ কোনোদিন ভাবিনি।ছোট-খাটো পত্র-পত্রিকায় লিখতাম, তা’ ছিল নিতান্ত খামখেয়ালিপনা।এসব নিয়ে কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি।‘মুক্তাঙ্গন’ নামে এক সাময়িক পত্রিকায় আমার লেখা একটি রূপক প্রকাশিত হয়;শিরোনাম ছিল:”বাঁচি কি মরি!” সেই থেকে বাঁচা-মরার খেলা চলছে।আমি তখন কর্মসূত্রে মধ্য-উত্তর আন্দামানে মায়াবন্দর কলেজের সরকারি বাসভবনে থাকি।শ্রী কৃষ্ণপ্রসাদ বিশ্বাস নামে এক শিক্ষক-বন্ধু স্থানীয় বাঙলা খবরের কাগজে প্রকাশিত এক দুঃসংবাদের কথা জানালেন।খবরটি সংক্ষেপে এই: পোর্টব্লেয়ারে সরকারি‘কলেজ-কর্তৃপক্ষ বাংলা বিভাগের বিলুপ্তি চাইছেন এক অযুহাত দেখিয়ে,তা’ হ’ল:- বাংলাভাষী ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা নাকি প্রতি বছর অস্বাভাবিক হারে কমে যাচ্ছে।বর্তমান সংখ্যা নগণ্য। তা’ ছাড়া বাংলা মাধ্যমে পড়ায় নাকি ছাত্র-ছাত্রীদের অনীহা প্রকাশ পাচ্ছে।আমার বন্ধুটি আমাকে এ বিষয়ে প্রতিবাদস্বরূপ কিছু লেখার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন যেহেতু কলেজ কর্তৃপক্ষের রিপোর্ট বিন্দুমাত্র সত্য নয়।এ শুধু বাংলা ভাষাকে নির্মূল করার এক কূট চক্রান্ত!এই অপ্রত্যাশিত খবর পেয়ে বন্ধুর ঠিকানায় এক দীর্ঘ চিঠি লিখে পাঠালাম।বন্ধু যে রাতারাতি সেই চিঠি কোনো সংবাদ-পত্রিকায় পাঠাবেন,তা’ ভাবতে পারিনি।‘সমুদ্র মেখলা’ পত্রিকায় প্রকাশের পর জনমানসে তার প্রতিক্রিয়া শোনা গেল।কলেজ-কর্তৃপক্ষ অবশেষে মাতৃভাষার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হলেন।বাংলা ভাষা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হ’ল।এই ঘটনার পর থেকে আমি লেখা-লেখির জালে জড়িয়ে পড়লাম।........
আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা সময়াভাবে বলতে পারছিনা।এজন্য কৌতুহলী পাঠক-বন্ধুদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী! তবে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপূঞ্জে ঘটে যাওয়া প্রলয়কান্ড সুনামির পর কিছু পত্র-পত্রিকায় লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম; সেসব অভিজ্ঞতার কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি।
আন্দামান-বিষয়ক কিছু লিখতে বসার আগে, গ্রন্থাগারে সযত্নে রাখা ‘চিরহরিৎ আন্দামান,প্রবাল দ্বীপ নিকোবর’ নামে এক বইতে চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলাম এই ভেবে,--যদি কোনো নতুন তথ্য আমার চোখে ধরা পড়ে,তার সংযোজনে হয়তো আমার লেখার মান কিছুটা বেড়ে যাবে।কিন্তু হ’ল তার উল্টোটাই।মান বাড়াতে গিয়ে,মান বাঁচানো দায় হ’য়ে পড়লো!ওই বইতে ‘আন্দামানে বাঙালি’ শীর্ষক প্রবন্ধ পড়ার সময়,এক জায়গায় থমকে দাঁড়াতে হ’ল।লেখিকা (বন্দনা গুপ্ত) বলছেন: “এত বিশাল সংখ্যক বাঙালি ওখানে(আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপূঞ্জে)গিয়ে বসবাস করছে যে একে রীতিমতো একটি বাংলাদেশই বলা যায়।কিন্তু এদের সঠিকভাবে পরিচালনা করার কেউ নেই।কেবলমাত্র চাষী পরিবার নিয়ে যাওয়ার ফলে শিক্ষিত ‘বর্ণহিন্দু’ নেই বললেই হয় এবং সেই জন্য এখানে সুস্থ সুন্দর একটি সমাজ গ’ড়ে উঠতে পারেনি।সামাজিক বন্ধনের অভাবে নীতিবোধ ও এদের বড়ই দূর্লভ।ওখানকার ঊর্বরা জমিতে প্রচুর ফসল ফলিয়ে হয়তো হাতে এসে গেল প্রচুর পয়সা,ভবিষ্যতের ভাবনা না ভেবে সরকারের ঋণ ঠিকমতো পরিশোধ না ক’রে বিরাট এক মহোৎসব বা নানা রকম বাবুয়ানি করেই হয়তো উড়িয়ে দিল সব পয়সা।বিরাট এক জনশক্তি নষ্ট হ’য়ে যাচ্ছে এইভাবে,কে তাদের পথ দেখাবে?ঠিকমতো পরিচালিত হ’লে,এরাই বাঙালির গৌরব হ’তে পারতো”।.....
এই বইটি আন্দামান দর্শনার্থীদের বিশেষতঃ কচি-কাঁচাদের অনেকটা প্রাথমিক গাইড্ হিসেবে কাজ করতে পারে,কিন্তু আন্দামানে বাঙালিদের সঠিক অবস্থান,তাঁদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে,কোনো মন্তব্য করা শোভনীয় নয়।লেখিকার ‘বর্ণহিন্দু’ কথাতেই আমার আপত্তি।বর্ণপ্রথা, বঙ্গীয়/ভারতীয় সমাজ-সভ্যতা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে দূর্বল ক’রে দিয়েছে।এই বর্ণ বৈষম্যই আদি ভারত মাতাকে খন্ড-বিখন্ড করেছে।ক্রন্দনরতা দেশজননীর দূর্দশায় অসহায় সন্তানদল একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হ’য়ে গেল,পূব থেকে পশ্চিম—পশ্চিম থেকে পূবে,উত্তর থেকে দক্ষিণে,—সুদূর দক্ষিণে,শুধু প্রাণরক্ষার তাগিদে;বাঁচার কথা তো পরে! কে পরালো মুন্ডমালা? বর্ণমালার অভিশাপ,নাকি বর্ণশ্রেষ্ঠদের বর্ণময় আশীর্বাদ?
লেখিকার কথায় ‘বাঙালি’ বলতেই যেন হিন্দু ধর্মালম্বীদের চিহ্ণিত করে;কিন্তু তাই কি? হিন্দু-মুসলিম-খৃস্টান যে কেউ বাঙালি হতেই পারেন।আর আন্দামানে এঁদের সহাবস্থান লক্ষ্য করার মতো।উত্তর আন্দামানে পশ্চিম সাগর,তালবাগান প্রভৃতি অঞ্চলে বহু খৃস্টীয় ধর্মালম্বী বাঙালিদের বসবাস।এদেঁর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যও লক্ষণীয়:-এঁরা গির্জায় যীশুর কাছে প্রার্থনা করেন আবার হরিসভায় হরি সংকীর্তণও করেন।একদিকে বড়দিন বা ক্রিসমাস্,অন্যদিকে পূজা-পার্বণ,ঈদ,পোঙ্গাল(তামিল উৎসব),ওনাম(মালয়ালম উৎসব) কিছুই বাদ যায়না।আর এসব কিছুই উদযাপিত হয় জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।যে কোনও উৎসব ভিন্ন ভিন্ন ধর্মপন্থীদের সমারোহে বর্ণাঢ্য হ’য়ে ওঠে।ধর্মবিচারে কাউকে আলাদা ক’রে চেনা যায়না।এটাই আন্দামান সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য।এমনই সর্বধর্মসমন্বিত মিলনাত্মক দৃশ্য দর্শনে,শুধু আন্দামানবাসী ছাড়া যে কোনও দেশী-বিদেশী মানুষের মনে খটকা লাগবে।সংস্কারবদ্ধ সনাতন সভ্য ব্যক্তিবর্গ তো একেবারেই সহ্য করতে পারবেননা।
আসল ব্যাপার হ’ল---বর্ণহিন্দু মানসিকতার উদ্ভব,ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে।‘আর্য্য’ শব্দটা-ই যত বিপত্তির/বিপর্যয়ের কারণ।ভাষাতত্ত্ববিদ্ সুনীতিকুমার চট্টোপধ্যায়ের কথায়: “‘আর্য্যামি’ নামের এই গোঁড়ামি,আমাদের দেশে নানা স্থানে,নানা মূর্তি ধরেছে---স্বাধীন চিন্তার শত্রু এই বহুরূপী রাক্ষসকে নিপাত না করলে,ইতিহাসচর্চা বা ভাষাতত্ত্বের আলোচনা কোনোটারই পথ নিরাপদ হয়না”।আরও বলেছেন: “বাঙালি জাতিটা যে একটা মিশ্র-অনার্য জাতি---মোঙ্গল,কোল,মোনখোর,দ্রাবিড় এইসব মিলে সৃষ্ট খিচুড়ী,যাতে আর্যত্বের গরম মশলাটুকু উপরে পড়েছে মাত্র,এ কথাটা স্বীকার করতে যেন কেমন লাগে! বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ নাকি শতকরা ১০ জন মাত্র; যাঁরা ব্রাহ্মণাদি উচ্চ জাতির,তাঁদের মধ্যে দু’চারজন বড় গলায় ‘বাঙালী-অনার্য্য’ এ কথাটা বলেন বটে,কিন্তু বোধ হয়,তাঁরা মনে মনে একটু আত্মপ্রসাদ লাভ করেন যে তাঁরা ‘ব্রাহ্মণ’।অতএব আর্য্যদের আর্য্যত্ব গরম মশলার একটা কণা,অনার্য্য চাল,ডাল,নুন।
আমি নিজে ব্রাহ্মণবংশীয়;কিন্তু আমার বিশ্বাস,গরম মশলাটুকুতেও ভেজাল আছে।প্রচ্ছন্ন আর্য্যামিটুকুর হাত থেকে অনেকেই একেবারে মুক্ত হতে পারেননা।Scientific disinterestedness যাকে বলে,সেটা বড় দূর্লভ [বাংলা ভাষার কুলজী:সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়]
আগের কথায় ফিরে আসি। লেখিকা নীতিবোধের কথা তুলেছেন।কিন্তু যদি প্রশ্ন ওঠে(প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক)---‘বর্ণহিন্দু’ হ’লেই কি নীতিজ্ঞান বা নৈতিক দায়িত্ববোধ জন্মায়? না,জন্মায়না;অন্ততঃ সাধারণ মানবিক বোধটুকুও আসেনা।আসুন,সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতা খুলে দেখি:-রবীন্দ্র-সাহিত্যে ‘মুসলমানী’ গল্পে পিতৃমাতৃহীন ব্রাহ্মণ-কন্যা ‘কমলা’ কাকা-কাকীমার আশ্রয়ে আদরে-অনাদরে পালিতা হলেও বয়োঃসন্ধিকালে তাকে দ্বিজবরে সমর্পণ করা হয়। যাত্রীসহ পথিমধ্যে দস্যুর কবল থেকে কমলা-কে নবাব হাবিব খাঁ রক্ষা করেন এবং নবাব-প্রতিষ্ঠিত মায়ের (নবাবের রাজপুতানী মা) স্মৃতিমন্দিরে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীর তত্ত্বাবধানে রাখেন।রাত্রি অবসানে কমলার ইচ্ছানুসারে কমলা, কাকা-কাকীমার বাড়িতে ফিরে এলে,তা’ সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়।মুসলমান-নবাবের আশ্রয়ে অস্পৃশ্যতার দোহাই দিয়ে,কমলাকে বিতাড়িত করা হয় ব্রাহ্মণ-সমাজ থেকে।এরপরের ঘটনা অজানা থাকলে আগ্রহী পাঠক নিশ্চয়ই জেনে নেবেন।
যাঁরা নিজেদের ‘সনাতন হিন্দু’ ব’লে গর্ব প্রকাশ করেন,তাঁদের প্রতি আমার আন্তরিক সহানুভুতি জানিয়ে বলতে চাই--- শুধু সামাজিক নিষ্ঠুর আচার-বিচার পদ্ধতি নয়,বর্ণবৈষম্যের জন্য তথাকথিত নিম্ন শ্রেণীভুক্ত মানুষদের কাল্পনিক দেবীর উদ্দেশে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।অসংখ্য উল্লেখ্য ঘটনা আছে;আমি তার একটা মাত্র মনে করিয়ে দিচ্ছি।
ইতিহাসের সূত্র ধ’রে ১৬০৬ খৃ: সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে,সুতানুটির উত্তর সীমান্তে ভয়াবহ ঘন জঙ্গলে আর জন্তু জানোয়ারে ভরা চিত্রপুর গ্রামে ‘চিত্তেশ্বর রায়’ দেবীর পরম ভক্ত ছিলেন।ষোড়শ উপচারের অন্যতম ছিল ‘নরবলি’। এই চিত্তেশ্বরের নামানুসারে দেবীর নাম হয় ‘চিত্রেশ্বরী’ বা ‘চিত্তেশ্বরী’।চিৎপুর নামের উৎপত্তিও একই কারণে।এই নরবলি প্রথা যে বংশপরম্পরায় চলেছিল, তার প্রমাণ মেলে ১৭৮৮ খৃ:২৪ শে এপ্রিল ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এর প্রকাশনায়। খবরটি ছিল এরকম:-“গত ৬-ই এপ্রিল(১৭৮৮ খৃ)তারিখে অমাবস্যার দিন শনিবারে চিৎপুর কালীমন্দিরে একটি ভীষণ ‘নরবলী’ হইয়া গিয়াছে।অন্ধকারময় রজনীর অন্তরালে এই ভীষণ কান্ড,এক বা একাধিক লোক দ্বারা সংঘটিত হইয়াছে বলিয়া অনুমিত হইতেছে।কয়জন লোক এ ব্যাপারে লিপ্ত ছিল তাহার বিশেষ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই।।মন্দিরের পুরোহিত বলেন যে,তিনি রাত্রে পূজাদির পর যথারীতি দ্বার বন্ধ করিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন।সম্ভবতঃ কেহ গভীর রাত্রে দ্বার ভাঙিয়া মন্দির মধ্যে প্রবেশ করে। যে মানুষটিকে বলী দেওয়া হইয়াছিল,তাহার রুধিরাক্ত মুন্ডটি মন্দিরের প্রতিমার পদতলের উপর ছিল।ধড়টা মন্দিরের বাহিরে একটি স্থানে পড়িয়াছিল।তাহা ছাড়া একখানি রৌপ্যালঙ্কারও প্রতিমার নিকট ছিল।এই নরবলী যজ্ঞের উপযুক্ত যে সমস্ত পাত্রাদির প্রয়োজন,তাহাও সেই স্থানে পাওয়া গিয়াছে।যে শাস্ত্রের বিধানানুসারে এইরূপ নরবলী দিবার নিয়ম আছে,তদনুযায়ী এই সমস্ত পাত্রাদি নির্মিত হইয়াছে।পূজার উপকরণ,জিনিসপত্র ও মূল্যবান বস্ত্রালঙ্কারাদি দেখিয়া প্রমাণ হইতেছে,কোনো ধনবান বাঙ্গালী এই ঘটনার মূলে আছেন।অনুষ্ঠান পদ্ধতি দেখিয়া ইহাও বোধ হয়,তিনি কেবল ধনবান নহেন,তন্ত্রাদি শাস্ত্রে সুপন্ডিত।যাহাকে বলী দেওয়া হইয়াছে,তাহার আকৃতি দেখিয়া চন্ডাল শ্রেণীর লোক বলিয়া বোধ হইতেছে।সাধারণে এই অনুমানেরই সমর্থন করিয়াছে।নিহত ব্যক্তি কলিকাতার লোক নহে,সম্ভবতঃ নিকটস্থ কোনো পল্লীগ্রাম হইতে তাহাকে আনা হইয়াছিল।ঘটনাস্থলে ফৌজদার সাহেব স্বয়ং উপস্থিত থাকিয়া তদারক করেন।তিনি মন্দিরের নিত্য-পূজক ব্রাহ্মণকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন বটে,কিন্তু এ পর্য্যন্ত কোনোরূপ নূতন কথা এখনও জানিতে পারা যায় নাই।...২৪/৪/১৭৮৮” [হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ গ্রন্থ থেকে]
পাঠক-বন্ধু !এবার আমার মুখ ফেরাতে হয়,আমার স্বপ্নে ঘেরা সবুজ আন্দামানের দিকে। আন্দামানে বাঙালি জনগোষ্ঠী মূলতঃ পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছেন।কিন্তু কেন? পূর্ববঙ্গে তাঁরা থাকতে পারলেননা কেন? ঐ একই কারণে---‘বর্ণবৈষম্য’। ব্রাহ্মণদের অকথ্য অত্যাচারে এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার চাপে,নিম্নশ্রেণিভূক্ত মানুষদের দম বন্ধ হয়ে আসতো।উদার প্রকৃতির আলো-বাতাস-জল গ্রহণ করার অধিকার তাদের ছিলনা।সিরাজসাঁই,লালন ফকির,সন্ত কবীর,কাজী নজরুলের মূল্য দিতে চাননি বর্ণশ্রেষ্ঠরা।মূল্য দিতে হয়েছিল অসহায় শিশু,নারী ও অভাগা-দলের প্রাণ দিয়ে।আন্দামানে মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছে সেই মর্মান্তিক ইতিহাসের সাক্ষ্য-প্রমাণ আজও আছে।শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর এই অসহায়,নিঃসম্বল মানুষদের মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন একতাবদ্ধ শক্তির সাহায্যে।এঁরা কোনো জাতপাতের ধার ধারেননা;কোনো ব্রাহ্মণকে দিয়ে পুজো করাননাআন্দামানে এক বড় জনশক্তির শক্তিধর এঁরাই ‘মতুয়া সম্প্রদায়’।...শিক্ষিত ‘বর্ণহিন্দু’ যে আন্দামানে উদ্বাস্তু হয়ে আসেননি তা’ বললে ভুল হবে।দক্ষিণ আন্দামানের শেষ প্রান্ত তিরুর গ্রাম থেকে মধ্য এবং উত্তর আন্দামানে সাগর দ্বীপ (Smith Island)[লিটল্ আন্দামান,নীল-দ্বীপ ও পরী-দ্বীপসহ]পর্য্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বহু ব্রাহ্মণ,বৈদ্য,কায়স্থ শ্রেণির লোকেদের বসবাস।কিন্তু তাঁরা আজ আর বর্ণবৈষম্যের কথা ভাবেননা।স্বজাতি-বিজাতি,স্বধর্মী-বিধর্মী,স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য,জল-পানি-ওয়াটার-তান্নি,ভাই-তাম্বি,দাদা-আন্না মিলেমিশে সব একাকার হয়ে গেছে।শুরু হয়েছে এক সংস্কারমুক্ত সমাজ, নতুন প্রজন্ম।
“পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি—তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু ক’রে আর রাখিওনা ধ’রে
দেশ-দেশান্তর মাঝে যার যেথা স্থান
খুজিঁয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান”।
বঙ্গমাতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই মর্মস্পর্শী আবেদন যেন সত্য হয়ে উঠেছে,রূপসী আন্দামানের জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে!আমরা সবুজ দ্বীপের বাঙালি আজ দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করতে পারি:বর্ণবৈষম্য ভুলে,পাপ-পুণ্য-দুঃখ-সুখের দোলায় চ’ড়ে,স্বাধীন মনুষ্যত্বের ধর্মাচরণে ‘মানুষ’ ব’লে পরিচয় দিতে পারছি।.......(চলবে)
২| ১৮ ই জুন, ২০১৬ রাত ১০:৩১
কালনী নদী বলেছেন: প্রিয় কবির কথানুসারে আপনার লিখাটা পড়ে দেখলাম যদিও আমি বর্তমানে অনেক ব্যস্ততার মাঝে থাকায় হয়তো লেখাটা একটু কঠিন মনে হয়েছে! তাই আপাতত প্রিয়তে সংগ্রহে রাখলাম বাসাতে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় বিষয়টা বোঝা যাবে।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে ইউরূপ ও বাংলাদেশের মধ্যে ফকিরি দ্বারা ও রাস্তাফরিয়ানের একটি গভীর সাদৃশ্য দেখতে পাই। কেন মানুষ ধর্মীয় পুস্তক থাকার পরেও নতুন করে যুগের পর যুগ ঈশ্বরকে খোজে যাচ্ছেন- সেটা আমারও প্রশ্ন যদিও সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর একটা অন্তমিল খোজে পাওয়া যায়। এমনি একটি অনুসরণের রাস্তা হচ্ছে বব মার্লের রাস্তাফারিয়ান!!!
কি সুন্দর বৈশাদৃশ্য আমাদের ফকিরি দ্বারা ও তাদের রাস্তাফারিয়ান ওয়েতে!!! যা একটু খেয়াল করলে বোঝা যায় সব ধর্মেই মানুষকে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে!!
হয়তো সময় স্বল্পতার জন্য ব্যাপারটা এখনও পুরোপুরি বোঝে আসতে পারে নি। আমাকে কয়েকবার এটা পড়তে হবে।
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া ব্যাপারটা আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য আর আন্তরিক কৃতজ্ঞতা আমার প্রিয় কবি সোজোন বাদিয়ার কাছে লেখাটি আমার দৃষ্টিতে আনার জন্য।
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই জুন, ২০১৬ রাত ১১:৪৪
সোজোন বাদিয়া বলেছেন: অপূর্ব! প্রিয় গায়েন ভাই। আপনার এই ৪র্থ পর্বটি সস্ত্রিক পাঠ করলাম। আমরা ২৩তম পাঠক। পাঠের পর, আমার স্ত্রীর মন্তব্য, "এতো সুন্দর লেখাটা ২২ জনে পড়ার পর কেউ মন্তব্য করল না। চলো আমরা আন্দামানেই চলে যাই।"
যদিও আপনারই লেখা তবুও আপনার কাছেই উদ্ধৃতি দেবার লোভ সামলাতে পারছিনা।
"আর আন্দামানে এঁদের সহাবস্থান লক্ষ্য করার মতো।উত্তর আন্দামানে পশ্চিম সাগর,তালবাগান প্রভৃতি অঞ্চলে বহু খৃস্টীয় ধর্মালম্বী বাঙালিদের বসবাস।এদেঁর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যও লক্ষণীয়:-এঁরা গির্জায় যীশুর কাছে প্রার্থনা করেন আবার হরিসভায় হরি সংকীর্তণও করেন।একদিকে বড়দিন বা ক্রিসমাস্,অন্যদিকে পূজা-পার্বণ,ঈদ,পোঙ্গাল(তামিল উৎসব),ওনাম(মালয়ালম উৎসব) কিছুই বাদ যায়না।আর এসব কিছুই উদযাপিত হয় জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।যে কোনও উৎসব ভিন্ন ভিন্ন ধর্মপন্থীদের সমারোহে বর্ণাঢ্য হ’য়ে ওঠে।ধর্মবিচারে কাউকে আলাদা ক’রে চেনা যায়না।এটাই আন্দামান সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য।" ... "তাঁরা আজ আর বর্ণবৈষম্যের কথা ভাবেননা।স্বজাতি-বিজাতি,স্বধর্মী-বিধর্মী,স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য,জল-পানি-ওয়াটার-তান্নি,ভাই-তাম্বি,দাদা-আন্না মিলেমিশে সব একাকার হয়ে গেছে।শুরু হয়েছে এক সংস্কারমুক্ত সমাজ, নতুন প্রজন্ম।"
-আহ! এর চেয়ে সুন্দর আর কী কল্পনা করা যেতে পারে! মানুষের সত্যিকারের মনুষ্যত্ব ফুটে উঠছে সমাজপতি বর্ণহিন্দু বা 'বর্ণমুসলমানদের' খবরদারী মুক্ত হয়ে। এটকি সত্যিই সত্যি? যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা এমন তো নয়, আপনি ভাবুক, স্বাপ্নিক, শিল্পী তাই বাস্তবতাকে না দেখে আপনার স্বপ্নগুলোকেই দেখছেন? আপনার সাথে এখনও পূর্ণ পরিচয় হয় নি, তাই প্রশ্ন রাখলাম, অপরাধ হলে ক্ষমা করে দেবেন।
আপনি যা বললেন, তা ঐতিহাসিক এবং মহাকাব্যিক। অবশ্য অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে বিশদভাবে লেখার আয়োজন করুন। আমার মনে হচ্ছে বিষয়টা এতো বিশাল যে আপনার একার জন্য দুঃসাধ্য হবে। প্রয়োজনে আপনার সহমর্মী মানুষদেরও সাথে নিয়ে কাজ ভাগ করে নেবেন। আমার তীব্র আশা জাগছে যে আন্দামান থেকেই আমাদের হতভাগা জাতিটা কিছু হয়তো শিখতে পারে।
আপনি এক জাগায় লিখেছেন:
"আন্দামানে বাঙালি জনগোষ্ঠী মূলতঃ পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছেন।কিন্তু কেন? পূর্ববঙ্গে তাঁরা থাকতে পারলেননা কেন? ঐ একই কারণে---‘বর্ণবৈষম্য’। ব্রাহ্মণদের অকথ্য অত্যাচারে এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার চাপে,নিম্নশ্রেণিভূক্ত মানুষদের দম বন্ধ হয়ে আসতো।উদার প্রকৃতির আলো-বাতাস-জল গ্রহণ করার অধিকার তাদের ছিলনা।" - আপনি হয়ত প্রধানত বর্ণহিন্দুর শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে বন্দনা গুপ্তের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন তাই শুধু তাদের অত্যাচারকে দায়ী করেছেন। তবে মনে হয় পূর্ববাংলা (পূর্ব-পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশ) ত্যাগ করার পিছনে, 'বর্ণমুসলমানদের' লোভ-লালসা-ক্ষমতার রাজনীতি আরও বেশি দায়ী। বিশেষকরে অতি সম্প্রতি আপনি নিশ্চয়ই পড়ে থাকবেন যে আমাদের বাংলাদেশে ইসলাম রক্ষার নামে হিন্দু-খ্রীষ্টান-বৌদ্ধ সকলকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা শুরু হয়েছে। সবই ঘটছে ক্ষমতার হিংস্র লড়াইয়ের প্রকাশ হিসেবে, এবং সবখানেই জড়িত ওই বর্ণবাদী (হিন্দু-মুসলমান ভারত-বাংলাদেশে) সমাজপতি এবং নেতা-নেত্রীরা। এখন আমার একটি বড় জিজ্ঞাসা, আন্দামানের অধিবাসীরা কি এদের অনুপ্রবেশ সত্যিই ঠেকাতে পারবে?
আপনার লেখার ছোঁয়ায় উচ্ছসিত। অশেষ শুভ কামনা।