নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রাজু সিদ্দিকের মননভুবন

আমার অনুমতি ব্যতীত কেহ আমার গল্প বা গল্পের অংশ এবং নাটক বা নাটকের দৃশ্য বা সংলাপ বা সংলাপের অংশ কোখায়ও ছাপাতে বা ব্যবহার করতে পারবেন না। -- রাজু সিদ্দিক

রাজু সিদ্দিক

আমার অনুমতি ব্যতীত কেহ আমার গল্প বা গল্পের অংশ এবং নাটক বা নাটকের দৃশ্য বা সংলাপ বা সংলাপের অংশ কোখায়ও ছাপাতে বা ব্যবহার করতে পারবেন না। -- রাজু সিদ্দিক .

রাজু সিদ্দিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

খেলারামের চার খেলা ( রম্য )

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:০৩

দিবা না রাত্রি



পাঞ্জাবী কী ?

পাঞ্জা তথা হাতের তালু পর্যস্ত বিসতৃত আস্তিনবিশিষ্ট ঢিলেঢালা জামা। হ্যাঁ, এই পাঞ্জাবী পোশাকটা কে আবিষ্কার করেছে তা যদি জানতে পারতাম, তবে ওই বেটাকে পাঞ্জাবীর আস্তিনে লটকে দিতাম। এটা এক যাচ্ছেতাই পোশাক, না আছে পর্যাপ্ত বোতাম, না আছে কলার ! বোতামের ফাঁক দিয়ে পেট চুলকানো যায় না, চুলকাতে হয় পাঞ্জাবী তুলে, সবাইকে পেট দেখিয়ে। আবার ভালবাসার অভাবে যখন মন উদাস হয়, তখন বসে বসে কলারের মাথা চাবানো যায় না।

কি এক যন্ত্রণাকর অবান্ধব পোশাক !

সবচেয়ে বড় কথা এ পোশাকটা পরলেই ঘুম পায়, মনে ঢিলেমি ভাব চলে আসে - গেলে গেলাম, খেলে খেলাম এ ধরনের আর কী। বাঙ্গালীর অলসতার সতেরটা কারণের একটা না হলেও আঠারো নম্বরটা যে পাঞ্জাবী, তা আমি বাম হাতে ভাঙা পেন্সিলে লিখে দিতে পারি।

আর এখন আমাকে সেই পোশাকটাই কিনতে বাসা থেকে পাঠিয়েছে। আমার জন্য হলে টাকাটা মেরে দিয়ে বাসায় ফিরে বলতাম পকেট মার হয়েছে। কিন্তু এটা কেনা হচ্ছে পারিবারিক উপহার হিসাবে একজনকে দেওয়ার জন্য, তাই টাকাটা না মারতে পারবার বেদনায় নীল হয়ে সিএনজিতে বসে আছি ।

মার্কেটের সামনে নামার মুহূর্তে দেখি বন্ধু শিমুল ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। সর্বনাশ এর সামনে পড়া যাবে না, এ যদি জানতে পারে আমি পাঞ্জাবী কিনতে এসেছি, তাহলে আমার পিছু ছাড়বে না, জোর করে পাঞ্জাবী কিনে দিবে। হয় তিনশো টাকার পাঞ্জাবী ছয়শো টাকায় কিনে দিবে, না হলে ছয়শো টাকার পাঞ্জাবী তিনশো টাকায় কিনে বাকি টাকা মেরে দিবে।

না, কোন ভাবে তার সামনে পড়া যাবে না। তাই সিএনজি থেকে নেমে দৌড়ে মার্কেটে ঢুকে পড়ি। মার্কেটের লোকজন আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে, একজন এসে চাপা স্বরে বলে,‘ব্রাদার কি টানা পার্টির সদস্য? (যাত্রীদের ঘড়ি, চেইন টেনে নেয় যারা) পিছে পুলিস নি ?’ আমি তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে গটগট করে হেঁটে যাই। কিন্তু তার কথায় যত না মন খারাপ হয়, তার চেয়ে বেশি মন বিতৃষ্ণ হয় পাঞ্জাবীর কথা আবার মনে হওয়ায়, পাঞ্জাবী বিরোধী মন নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরি। পছন্দ মত পাঞ্জাবী পাই না, পেলে দামে বনে না।

দোকানদারদের এ চালাকিটা আমি কখনই ধরতে পারি না-যে জিনিষটাই পছন্দ হয় সেটারই দাম সবচেয়ে বেশি হয় কিভাবে ?

এক দোকানে প্রথম যে পাঞ্জাবীটা পছন্দ করি, দোকানদার সেটার দাম বলে পাঁচশো টাকা, তারপর আরো ক’টা পাঞ্জাবী দেখি, সবগুলোর দাম ছয়শোর উপরে। শেষে প্রথম পাঞ্জাবীটা আবার হাতে নিয়ে দেখাই, বজ্জাত দোকানদার তখন সেটার দাম বলে ছয়শো পঁঞ্চাশ টাকা। অবাক হয়ে জানতে চাই,‘পাঁচশো টাকার পাঞ্জাবীটা কোথায় ?’

‘কী জানি,’ বলে বজ্জাতটা ঠোঁট উল্টিয়ে নির্লিপ্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে ।

শত্রুতাবশত মিথ্যা মামলায় প্রায়ই একজন আরেকজনকে জেল খাটায়, এখন আর মিথ্যা মামলা করবার দরকার নেই। যাকে জেল খাটাতে হবে, তাকে প্রতিদিন নিয়ম করে দু’বেলা কেনাকাটা করতে মার্কেটে পাঠিয়ে দিলেই হবে, সাতদিন পর অষ্টম দিনে সে মার্কেটে যাবে, কিন্তু আর ফিরে আসবে না। খোঁজ নিলে জানা যাবে, দোকান ভাঙচোরের অপরাধে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে, আর না হলে দোকান মালিক সমিতি তাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিয়েছে।

আমারও একবার দোকান ভাঙচোর করতে ইচ্ছে হয়েছিল। দূর সম্পর্কে এক ভাগনেকে নিয়ে দোকানে গিয়ে ভাগনেকে দেখিয়ে বলি,‘চব্বিশ নম্বর বাচ্চার পাঞ্জাবী আছে ?’

দোকানের ফটকা সেলস্‌ম্যান আরেক ফটকাকে ডেকে বলে,‘এই ছিটকু, ছিটকু দেখ, দেখ এই বেডার বলে আরো তেইশটা বাচ্চা আছে, এইটা চব্বিশ নম্বর, এর পাঞ্জাবী চায় !’

আর জুতার দোকানে গেলে মনে হয় বাংলাদেশ না চীন বা চিলিতে চলে এসেছি। হাজার টাকার জুতার দাম ছয়শো টাকা বলার পরে দোকানদাররা নিজেদের মাঝে এলকা, তেলকা শব্দে কিচিরমিচির করে কী যেন বলে। তারপর কিছু বুঝবার আগে ধুম করে ছয়শো টাকাতেই দিয়ে দেয়। ক্রেতা যখন হাজার টাকার জুতা ছয়শো টাকায়ে কিনে চারশো টাকা জেতার আনন্দে বিভোর থাকে, দোকানদার তখন হাজার টাকার জুতা ছয়শো টাকায়ে বিক্রি করে চারশো টাকা লাভ গোনে।

বড়ই আজব বানিজ্য !

এসব বিক্ষিপ্ত উড়ু উড়ু ভাবনা নিয়ে দোকানে দোকানে পাঞ্জাবী দেখি। এক দোকান থেকে বেরিয়ে থমকে যাই, শ্যালেন ফাইভ পারফিউমের গন্ধ ধাক্কা দিয়ে আমাকে থমকে দেয়। সামনে তাকাই, চোখের পাতা ফ্রিজ হয়ে যায়। এ কে শ্যাম বর্ণা ? শ্যালেন ফাইভের সুবাস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ! না, সে ফ্লোরোসেন্ট বাতির মত উজ্জ্বল না, প্রদীপের মত মাদা। তবে আগুন, পতঙ্গ-পোড়া-আগুন। সে ভেনাস বা আফ্রদিতি না, সে ক্লিওপেট্রা। আর আমি যেন প্রাচীন মিশরের কোন রাজপুরুষ, ক্লিওপেট্রার আগুনে পুড়ে যাচ্ছি।

ভুলে যাই আমি কে ? কোথায় এসেছি ? কেন এসেছি ?

শুধু জানি ক্লিওপেট্রা আমাকে টানছে, আগুন যেভাবে পতঙ্গকে টানে। পিছু নেই ক্লিওপেট্রার, সে যে দোকানে যায় আমিও সেই দোকানে যাই, সে যা দেখে আমিও তাই দেখি। তার পিছু পিছু ষষ্ঠ দোকানে যাবার পর সে আমাকে খেয়াল করে, আমার পানে আড় চোখে তাকিয়ে মিহি হাসি দেয়, সেই মিহি হাসিতে আমার হৃদয় গুঁড়ি গুঁড়ি ছিদ্র হয়ে যায়, শুরু হয় ক্ষরণ, রক্ত-ক্ষরণ। ততক্ষণে মার্কেটের সবাই আমার প্রাচীন মিশরীয় রাজকীয় স্বভাবের কথা জেনে যায়। তারা ক্লিওপেট্রাকে ছেড়ে আমাকে দেখে ।

দেখুক।

হঠাৎ ক্লিওপেট্রাকে হারিয়ে ফেলি, এ দোকান ও দোকান খুঁজি, পাই না। মনে শঙ্কা জাগে, কোন রোমান সম্রাট এসে নিয়ে যায়নি তো ? সিজার যেভাবে ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে গিয়েছিল। আরো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। খুঁজতে থাকি। খুঁজতে খুঁজতে যখন নিশ্চিত হই-না তাকে আর পাবো না, কোনো নব্য সিজার এসে তাকে নিয়ে গিয়েছে। ঠিক তখনই সে এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে প্রদীপের আগুন, না প্রদীপ না মোমের আগুনের স্নিগ্ধতা কণ্ঠে মেখে সে বলে,‘আচ্ছা ফোন করা য়ায় কোথা থেকে ?’

তার মোম জ্বলা কণ্ঠে আমি গলে যেতে থাকি, গলে গলে বলি,‘ইয়ে, জানি না, না, হু নীচে, উঁ হুঁ উপরে, ঠিক, হ্যাঁ উপরে।’

‘একটু যদি দেখিয়ে দিতেন।’

সে অনুরোধ করে আমাকে আরো গলিয়ে দেয়। গলে কাই হয়ে বলি,‘অ-অবশ্যই, আসেন।’ তারপর তাকে পাশে নিয়ে দোতলার সিঁড়ি ভাঙি। নিজেকে সত্যি সত্যি রাজা-বাদশা মনে হয়। আমার রাজভাগ্য দেখে পেছন থেকে এক নচ্ছাড় শিস্ দেয়। পাত্তা দেই না। রাজা-বাদশাদের সব কিছু পাত্তা দিতে নেই। ফিরে তাকাই ক্লিওপেট্রার দিকে, তারপর রাজকীয় মেজাজে বলি,‘কী নাম ?’

সে এবার কণ্ঠে জোছনার স্নিগ্ধতা মেখে বলে,‘ দিবা।’

তার জোছনা মাখা ‘দিবা’ উচ্চারণ আমাকে দ্বিতীয় বারের মত ঢাক্কা দেয়। আমি এ নামটি আশা করিনি, কেন যেন মনে হয়েছিল তার নাম হবে কঠিন। কঠিন কিছু - ক্লিওপেট্রা জাতীয় কিছু। তার এই এক পদী দু’মাত্রার পাখি পাখি নাম মুহূর্তে আমার রাজসিক মেজাজ তরল করে প্যাঁক (পাঁক) করে ফেলে। জামায় লেগে থাকা প্যাঁকের মত তার সাথে দোতালাটা দুই চক্কর দেই। ফোন-ফ্যাক্সের কোন দোকান খুঁজে পাই না ।

‘আপনি না জেনেই দোতালার কথা বলেছেন,’ দিবা কৌতুক মাখা কণ্ঠে মিষ্টি অভিযোগ করে ।

আমি দ্রুত মাথা ঝাঁকাই।

সে কৌতুকের রেশটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে ভ্রূ নাচায়,‘কাউকে জিজ্ঞেস করলে হত না, আচ্ছা দাঁড়ান, আমিই জিজ্ঞেস করছি,’ বলে সে দু’পা বাড়ে।

মুহূর্তের আমার মাঝে আবার রাজকীয় মেজাজ ফিরে আসে, হাত ধরে তাকে থামাই, সে অবাক চোখে তাকায় ! ‘দাঁড়ান আমি জিজ্ঞেস করছি,’ বলে এগিয়ে গিয়ে এক দোকানদারকে প্রশ্ন করি,‘এখানে ফোন-ফ্যাক্সের দোকান কোথায় ?’

দরবারী রীতিনীতিতে অজ্ঞ, জঙ্গলী দোকানদার চোখ-মুখ খিঁচায়,‘নিচে বা সিঁড়িতে তীর দেওয়া কোন ফোন-ফ্যাক্সের দোকানের সাইনবোর্ড দেখছেন ?’

দোকানদারের কাউন্টার প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই, মাথা এপাশ ওপাশ করি।

‘তাইলে উপরে আইলেন ক্যান ? উছিলা খুঁজেন ?’

আমি কিছু বলতে পারি না, আমার নাক গাল লাল হয়ে যায়।

সে তখন পাশের দোকানদারকে বলে,‘ঐ দোকান বন্ধ কর্, ল’ মেয়ররে জিগাই গিয়া, ঢাকা শহরে ভিসার ব্যবস্থা করেন না ক্যান ? শহরতো উছিলা উছিলিতে ভইরা গেল !’ তার কথা শেষ হওয়ার আগেই পাশের দোকানদার টান দিয়ে স্যাটার নামিয়ে ফেলে।

এবার পুরাপুরি ভরকে যাই, সত্যি সত্যি মেয়রের কাছে যাবে না কী ! স-স্যা-স্যাটার নামায় কেন ? বোকা বোকা চোখে দোকানদারকে দেখি, আড়চোখে দেখি দিবাকে।

দিবা ক্রুদ্ধ চোখে দোকানদারকে দেখে,‘বাদ দেন, চলেন নীচে যাই,’ বলে নীচে রওয়ানা দেয়।

আমি তার পিছু পিছু নামি। নামতে নামতে রাজা থেকে ভিক্ষারী হয়ে যাই, তার প্রতি ভালবাসায় ভিক্ষারী হয়ে যাই। নীচে এসে বলি,‘আসেন দেখি কোথা থেকে ফোন করা যায়।’

‘আর ফোন করতে ইচ্ছে করছে না তার চেয়ে বরং কেনাকাটা সেরে ফেলি। আপনি আমাকে আরেকটু হেল্প করবেন ?’

‘কী ?’

‘পাঞ্জাবী কিনব কিন্তু আমি নিজের জন্য কিছু পছন্দ করতে পারি না, যদি করে দেন।’

ব-ব-বলে কী ! এতো না চাইতেই জল, আরে ধুর ! জল কী, এ তো সরবত, সরবত কী কেউ ফেলতে পারে। সাথে সাথে রাজি হয়ে যাই। কয়েকটা দোকানে ঘুরে এক দোকানে দিবা একটা লেডিস পাঞ্জাবী পছন্দ করে। দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবী দেখি। আমার আরেক পাশে রাগী রাগী চেহারার এক ভদ্রলোক পাঞ্জাবী দেখছে। তার পরনে পাঞ্জাবী। দোকানের ফ্যানের বাতাস ফ্লোরে বাধা পেয়ে উঠে এসে তাঁর পাঞ্জাবী সাম্পানের পালের মত ফুলিয়ে দিচ্ছে।

দোকানদার আমাদের পাঞ্জাবীর দাম সাতশো টাকা হাঁকে, তাতেই আমি রাজি হয়ে যাই। দিবা ভ্রূ কোঁচকায়, তবে কিছু বলে না, সে পার্স থেকে টাকা বের করে। আমি টাকাসহ তার হাত ধরে বলি,‘পাঞ্জাবীটা আমি তোমাকে গিফ্ট করতে চাই।’

‘কেন ? না, না ছিঃ ছিঃ কী বলছেন ? না।’

‘প্লিজ, প্লিজ,’ কাতর কণ্ঠে বলি। দিবা মুখ কঠিন করে মাথা এপাশ ওপাশ করে।

‘পি- লি-জ,’ হাত জোর করি।

দোকানদার বলে,‘দিক না, ভাইয়ে যখন ইচ্ছা করছে, আপনে না হয় আরেকটা কিনেন।’

আমি এবার ক্লিওপেট্রার হাত ধরি। কী জানি কেন ফোলা পাঞ্জাবী আমার অনুনয় বিনয় দেখে আরো রেগে যায়। তার হারানো প্রেমের কথা মনে পড়েছে কী না কে জানে ?

এক সময় দিবা হাল ছেড়ে দেয়,‘ঠিক আছে দেন, কিন্তু.... ,’ দিবার কণ্ঠে দ্বিধা ।

‘কিন্তু কী ?’ বলে মানিব্যাগ বের করার জন্য প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকাই।

‘না, মানে, পরে বলতে পারবেন না আমি আপনাকে নিষেধ....,’ দিবা কথা শেষ না করে বিস্ফুরিত চোখে আমাকে দেখে।

‘নিষেধের কী আছে,’ বলে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে পাঞ্জাবীর দাম দিয়ে বেরিয়ে আসি। দিবার চোখের বিস্ফোরণের শক-ওয়েভ সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে। সে শক্ত হাতে পার্স ধরে আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটে। কয়েক দোকান পেরিয়ে মানিব্যাগ পকেটে রাখতে গিয়ে আমার হাত অবশ হয়ে যায়, চোখ বিস্ফারিত হয়, শরীর কে-কে-কেঁপে উঠে। দিবাকে থাবা দিয়ে আমার দিকে ফেরাই। সে তার পার্স আরো শক্ত করে ধরে ভয়ার্ত চোখে তাকায়। ‘দিবা আ-আ-আমার পকেটে দু-দু-দুইটা মানিব্যাগ !’

দিবা কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে আমাকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,‘আমি জানি।’

‘জা-জা-জানো ! কিভাবে ?’

‘আপনি পাঞ্জাবীর টাকা দেয়ার সময় আপনার মানিব্যাগ বের না করে পাশের ভদ্রলোকের ফুলে থাকা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করেছেন।’

‘স-স-সর্বনাশ !’

সত্যি সত্যি টানা পার্টি হয়ে গেলাম ! ‘গিয়ে দিয়ে আসি ?’

এবার দিবা আমাকে থামায়,‘ভুলেও যাবেন না, তারা এতক্ষণে পকেটমারকে খুঁজছে, আপনি গেলে হয়তো আপনাকেই....’ দিবা তার কথা শেষ করে না। আমার কা-কা-কাঁপুনি বেড়ে যায়।

‘ব-ব-বলো কী ? এ-এ-এখন ! আচ্ছা কোথায়ও ফেলে দে-দে-দেই।’

‘ফেলার সময় যদি কেউ দেখে ?’ দিবা সায় দেয় না, তারপর একটু ভেবে বলে,‘ঠিক আছে আমাকে দিন, আমি দিয়ে আসি।’

‘তু-তু-তুমি ! গিয়ে কী-কী-কী বলবে ?’

‘বলব..... , বলব কিছু একটা।’

আমার মানিব্যাগ হতে পাঞ্জাবীর সাতশো টাকা ফোলা পাঞ্জাবীর মানিব্যাগে ভরে ব্যাগটা দিবাকে দেই। সে সাবলীলভাবে হেঁটে দোকানে ফিরে যায়। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে দেখি কী হয় ? কিন্তু সাহসে কুলাল না। অল্পক্ষণ পর দিবা হাসি মুখে ফিরে আসে, তার ফেরার পথে দোকান থেকে লোকজন উঁকি দিয়ে দেখে। সে এসে বলে,‘চলেন।’

দোকানে গিয়ে সে কী করেছে ? কী বলেছে ? কেন যেন ঐ মুহূর্তে তা জানতে ইচ্ছে করল না, যেভাবেই হোক আপদ বিদায় হয়েছে এটাই যথেষ্ট। হঠাৎ আমার মনে হলো, দিবাকে আমার দরকার, খুব দরকার, জীবনের জন্য দরকার। তার প্রতি ভালবাসায় কিছুক্ষণ আগে আমি ভিক্ষারী হয়েছিলাম এখন কাঙ্গাল হয়ে গেলাম। দ্রুত গিয়ে তার হাত থেকে শপিং ব্যাগটা নিতে চাই। সে বাধা দেয়,‘না, না, লাগবে না, আমি পারব।’

‘প্লিজ, প্লিজ,’ জগতের সমস্ত প্রেমিকের ভালবাসা কণ্ঠে এনে বলি,‘পি-লি-জ।’

দিবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে জোছনা মেশানো কণ্ঠে বলে,‘ঠিক আছে।’

দিবার হাত ও শপিং ব্যাগের কড়া এক সাথে ধরি, মুহূর্তে শরীরে ভাল লাগার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। নীরবে শপথ নেই, ছাড়ব না, এই হাত ছাড়ব না। হাত ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার পর দিবা লাজুক কণ্ঠে বলে,‘হাত ছাড়বেন না ?’

‘না, ছাড়ব না।’

‘কষ্ট পাবেন।’

‘ছেড়ে দিলে আরো বেশি পাব।’

দিবা থমকে তাকায়, মনে হয় তার চোখে পানি ! সে চোখ আড়াল করে। দু’জন হাত ধরে নীরবে হাঁটি, আমাদের সব কথা হয় দুর্বোধ্য ভাষায়- হাতে হাতে। যে ভাষা শুধু প্রেমিক প্রেমিকারাই বুঝতে পারে। একসময় মনে হয় সেই আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে, যেন ছুটে না যায়। এভাবেই মার্কেটের বাহিরে এসে দাঁড়াই। আমাদের সম্পর্কটাকে স্থায়ী করার জন্য বলি,‘দুজনে মার্কেটে ঢুকেছি আলাদা আলাদা, বের হলাম এক সাথে, হাত ধরে।’

দিবা হাসি মুখে বলে,‘হু, কিন্তু আপনি জানতে চাননি মানিব্যাগটা আমি কী বলে...’ দিবার কথা শেষ হয় না একটা গাড়ি হার্ড ব্রেক কষে মার্কেটের সামনে থামে। চমকে দেখি একটা লেটেষ্ট মডেলের বিএমডব্লিউ, যেন নব্য কোনো রোমান সম্রাটের বাহন। সেটা থেকে বদ চেহারার এক লোক বেরিয়ে আসে। দিবা আমার হাত ছেড়ে দেয়। লোকটা দিবার সামনে এসে বলে,‘রাত্রি তোমার মোবাইল বন্ধ কেন ?’

‘মোবাইলের চার্জ শেষ,’ দিবা মিন মিন করে বলে।

আমি অবাক হয়ে ভাবি, দিবাকে এই লোক রাত্রি বলছে কেন ?

‘আমি তোমার বাসা হয়ে এসেছি, আজ বিকালে তোমার ফ্লাইট না ? পার্টির গাড়ি পাঠিয়েছে, চলো,’ বলে লোকটা কিছুটা জোর করে দিবাকে গাড়িতে নিয়ে বসায়, সে নিজে বসতে গিয়ে দিবার সাথে কিছু বলে, তারপর ফিরে এসে আমার হাত থেকে দিবার শপিং ব্যাগ নিতে নিতে বলে,‘রাত্রি আজ ব্যাংকক যাচ্ছে, আপনি যদি রাত্রিকেই চান তাহলে সাত দিন অপেক্ষা করেন, আর যদি অন্য কাউকে চান, তাহলে এই যে আমার কার্ড, ফোন দিয়েন,’ একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে লোকটা আমার কাঁধে দু’টা চাপড় মারে ।

জগতটা কেঁপে উঠে, খড়-কুটা আকড়ে ধরার মত বলি,‘দিবাকে রাত্রি বলছেন, আপনার ভুল হচ্ছে না তো ?’

‘না হচ্ছে না, এদের অনেক নাম,’ লোকটা হেসে একটা চোখ টিপে গাড়িতে গিয়ে বসে। গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়ির ভেতর থেকে রাত্রি ফিরে তাকায়, তার চোখে জল। আমার বুকটা হু হু করে উঠে। বুঝতে পারি না জল ভরা ঝাপসা চোখে সে কাকে দেখতে চাচ্ছে - আমাকে, না ফেলে যাওয়া দিবাকে ?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.