নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি: কবিতা, প্রবন্ধ। প্রশংসা, নিন্দা- সবই ভুলে যাই।

সরওয়ার ফারুকী

লিখি।

সরওয়ার ফারুকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

হ্যঙার ছিল ঐ কাঞ্চির ঠ্যাং----

২২ শে মে, ২০১৬ বিকাল ৫:১৪

হ্যাঙার ছিল ঐ কাঞ্চির ঠ্যাং
রোজ রাতে মুতে দিত চিকা আর ব্যাঙ!
----------
হেই তোর প্যান্ট কিয়ানো?
স্যার, আইছলাম ফিন্দিয়া! ফতো হাখোম তাকি ফড়ি গেছলাম, বাদে বাড়িত গিয়া লঙি ফিন্দি আইছি!- বাক্য সমাপ্তির আগেই বেতের চ্যাটাংচ্যাটাং পড়ে যায় পিঠের উপর।
তোরটা কিয়ানো রে?
স্যার, নানাবাড়ি আছলাম! খাইল তাকি আনমু! ( কান্না ভেজা কণ্ঠে)
তে আইজকুর অগুইন লইলা!- বলেই আরো জোরেশোরে।
কিতারে তুইন ফিন্দি আইলে না?
স্যার, প্যান্টোর চেইন ছিড়ি গেছে, সিলাই খরাত দিছি!
হাছানি! তে লঙি ছিড়েনা নি!!!!!
তারপর......
ও স্যার গো স্যার, আর ফাউরিতাম নায়, আর ফাউরিতাম নায়। সাথে সাথে বাইঙমোরা মার্কা শারিরিক কসরত!
এভাবেই আমাদের স্কুলজীবন প্যান্ট না পরার অপরাধে দুর্দান্ত জারউল্লাহ স্যারের পিটুনি খেয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে! ৬০/৭০জনের ক্লাসে প্রায়ই গণহারে পিটুনি খেতে হত আমাদের।
হ্যা, আমরা প্যান্ট পরতাম না। মাঝেমধ্যে পরতাম না এমন নয়, কিন্তু না পরার হার ছিল ৯০%। লুঙি পরে গ্রামের মেঠোপথ ডিঙিয়ে হৈহৈ রৈরৈ আওয়াজ তুলে পথ চলতে গিয়ে লুঙি-ই ছিল আমাদের প্রাণের পোষাক, মনের পোষাক, আমাদের সংস্কৃতির পোষাক।
লুঙি পরে গেলে কি মেধা কমে যায়?
না, লুঙি পরেই আমাদের ব্যাচের একনাম্বার ছাত্র S.S.C-তে ৮১৯ মার্ক পেয়ে তখন পর্যন্ত আমাদের স্কুলের পুর্ববর্তী সকল রেকর্ড ভেঙে দেয়, মাত্র ১০মার্ক্সের জন্য সে পায়নি মেধা তালিকায় স্থান। আমিও হারিয়েছিলাম! তবে মাত্র ২৫০মার্কের জন্য- এই আর কী!
প্যান্টের জন্য শুধুমাত্র জারউল্লাহ স্যারই আমাদের বেশি পিটিয়েছেন। অন্যান্য স্যারেরা বড়জোর ঝাড়ি দিতেন এর বেশি নয়। জারউল্লাহ স্যারের পিটুনির ধরনও ছিল ভিন্ন! একসাথে হাতে, কানে, পিটে খুব দ্রুততার সাথে! পড়া শেখা না-শেখা নিয়ে তিনি কখনও বেত হাতে নিয়েছেন বলে মনে পড়ে না!
এ মুসিবত থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের সর্বাধুনিক ফর্মুলা আবিষ্কার করেছিল বীরদল গ্রামের বন্ধু মরহুম মাস্টার সামসুদ্দীন। বন্ধুটি অল্প বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমাদের বাল্যবন্ধু'র মধ্যে সে-ই প্রথম মৃত্যুর বারান্দা অতিক্রম করেছে। তার মুরব্বীয়ানা মার্কা কথা বলার ধরনই তাকে 'মাস্টোর সামসুদ্দীন' খেতাব এনে দেয়। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় তার উদ্ভাবিত পদ্ধতি আমাদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মাস্টোর সাব নিজের প্যান্ট ব্যগে ভরে স্কুলে নিয়ে আসলেন। জারউল্লাহ স্যার ক্লাসে আসার আগেই ব্যাগ খুলে প্যান্ট পরে নিলেন! সুবোধ ছাত্রের সুনাম কুড়ালো মাস্টোর! স্কুল ছুটি হয়ে গেলে প্যান্টের ব্যাগ আর বাড়ি যায় না! ভ্যান্টিলেটরের সাথে গিট্টু দিয়ে রেখে দেয়! এবার মাস্টারের অনুসারী আরো অনেকে! অনেকগুলো প্যান্ট ভ্যান্টিলেটরের সাথে, আবার কয়েকটি কাঞ্চির বর্গার (সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ জানা নেই- সরি) সাথে লুকিয়ে বেঁধে রাখা!
যখনই জারউল্লাহ স্যারের ক্লাস, তার ঠিক আগেই আমরা প্যান্টগুলো নামিয়ে লুঙির উপরে পরে নিতাম। তখন কি যে গন্ধ- ইইইইইইইইসসসসস! সারারাত এগুলোর উপর চিকা-পোঁকারা দৌড়াদৌড়ি করেছে আর আরামে নরম জায়গায় কোনটি মুতেছে(পেশাব) কোনটি হাগু দিছে! তবুও স্যারের টেংটেঙানি থেকে পরিত্রাণ পেতে এ মহৌষধ ছিল দুর্দান্তভাবে কার্যকর!
এ প্যান্টগুলো ধোয়া লাগত না! মাসের পর মাস একই প্যান্টে চলে গেছে, কখনো বা বারোমাস! একটি প্যান্টের সুবিধা অনেকেই নিত, কারণ প্যান্টগুলোর মালিকানা একক ছিল না। আদি-মালিক যে-ই থাকুক ব্যবহারের অধিকার ছিল সবার। কেউ একদিন এলো না, আবার একজনের রিজার্ভ প্যান্ট নেই- তখন যে কেউ একটি প্যান্ট নামিয়ে পরে নিত। অন্যের প্যন্টটি হয়তো বা খুব লম্বা অথবা হয়তো হয়ে গেছে খুবই টাইট; তাতেও সমস্যা নেই! একদিন একজন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে চিকার হাগু সহ পরে নিয়েছে; উফফফফফফ! কী গন্ধ না সেদিন! এ নিয়ে হাসাহাসিরর বন্যাও কম বয়ে যেত না আমাদের।
প্যান্ট নিয়ে উপমহাদেশের উপর বয়ে গেছে নানা বিড়ম্বনা! বিজাতী এ পোষাক জোর করে পরিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় ঝরে গেছে লক্ষলক্ষ তুখোড় প্রতিভা! হীনমন্যতায় হারিয়ে গেছে কোটি জনতার প্রাণস্পন্দন! কিভাবে?
একটু বলি তাহলে...........
ব্রিটিশেরা এলো ভারতে ব্যবসায়। ছলেবলে, কলেকৌশলে ভাগিয়ে নিল তখত। ভারতীয় রাজাও হয়ে গেলেন তখন গোলাম। ব্রিটিশেরা প্রভু। ভারতবর্ষের স্বাধীন জনতার হৃদয়স্পন্দন দমিয়ে দিতে তারা এমন কোন পদ্ধতি নেই যা প্রয়োগ করেনি।
১৮৫৭সালে মাত্র কয়েকদিনেই হত্যা করেছে পঞ্চাশহাজার আলিম। ভারতবর্ষের শেষ স্বাধীন বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙুনে নির্বাসিত করেছে। ১৮০৩সালে লর্ড লেক মারাটা বাহিনীকে পরাজিত করার পর এক আদেশ জারি করে। এ আদেশে ছিল,
"সৃষ্টি স্রষ্টার, সম্রাজ্য সম্রাটের আর কর্তৃত্ব হবে ইংরেজ কোম্পানীর।"
একপর্যায়ে তারা ভারতীয়দের মানুষ ভাবতে ভূলে যায়!- সে দীর্ঘ ইতিহাস। প্রভূত্ব বজায় রাখতে তারা চিরস্থায়ী গোলাম তৈরীর কারখানা তৌরীর সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৩৪সালে লর্ড ম্যাকলে-র সভাপতিত্বে একটি নতুন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলার সুপারিশ করে। লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিজেই বলে-
"আমাদেরকে এমন একটি দল গড়ে তুলতে হবে, যারা বস্তুতঃ আমাদের ও আমাদের কোটি প্রজার মধ্যে অনুবাদকের ভূমিকা পালন করবে। এ দলটি এমন হবে- যেন তারা রক্ত ও বর্ণের দিক থেকে থাকবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, চিন্তাধারা, কথাবার্তা, চালচলন, ও অনুভূতির দিক থেকে হবে ইংরেজ!"
মাত্র ত্রিশ/পঁয়ত্রিশ বছরের ব্যবধানে এ শিক্ষাব্যবস্থার সুফলও পেয়ে যায় তারা।
উইলিয়াম হান্টার 'দ্যা ইণ্ডিয়ান মুসলমান'-এ লিখেন, "আমাদের এংলো ইণ্ডিয়ান স্কুলগুলো থেকে অধ্যয়নোত্তীর্ণ কোন তরুন, হিন্দু হোক কিংবা মুসলিম, এমন কেউ নেই যে নিজের পূর্বপুরুষের ধর্মকে অস্বীকার করতে শিখে নি!"
এ বিকলাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থার উচ্ছিষ্ট হলেন আজকের আবদুল গফফার চৌঙেরা!
এ শিক্ষাব্যবস্থা প্রত্যাখান করলো মুসলমানেরা। খ্রিস্টানদের পোষাকে নিজের বাচ্চাকে রাঙিয়ে নিতে অস্বীকার করলো। ইংরেজপূর্ব ভারতে শিক্ষার হার ছিল ৫১%-এরও উপরে। ১৮৭১ সালের আদমশুমারিতে শিক্ষিতের হার পাওয়া গেল মাত্র ২%!
রাজার জাতি ভিখারিতে পরিণত হলো। কোটিকোটি মানুষ এ শিক্ষাব্যবস্থা অস্বীকার করে রাতারাতি পথের ভিখারি হয়ে গেল।
নিরোদ সি চৌধুরী নামের এক ভদ্রলোক লিখলেন, "মুসলমান কৃষকদের আমরা হালের গরুর চাইতে উন্নত কোন জীব বলে গণ্য করতাম না!"
এভাবে চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতির ছোবলে আমাদের দেহ-মন চিরস্থায়ী গোলামীর শিকলে বেঁধে নিলো বেনিয়া গোষ্ঠী। আর গোলাম পয়দা করার লক্ষ্যে গঠিত শিক্ষানীতি থেকে যারা বেরিয়ে এলো তারা আপন পিতা-মাতা, নিজ ধর্ম-কর্ম, ইতিহাস ঐতিহ্য সর্বোপরি জীবনের মূল্যবোধ হারিয়ে পরগাছা উচ্ছিষ্ট হয়ে গেল।
আমাদেরকে ওরা বাঙালী থাকতে দেয় নি, ভারতীয় থাকতে দেয় নি, সর্বোপরি মুসলমান থাকতে দেয় নি! আবার বৃটিশ করেও নেয় নি! লেঙড়া-নেংটা করে দিয়েছে।
প্যান্ট পরে স্কুলে যাওয়ার পথে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে ছেলেদের। নানা ধরনের চোখ বাঁকানো, ঠোঁঠ ফুটানো অথবা কৌতুক ছলে খোঁচা মারা ছিল সাধারণ ব্যাপার। নিজের ছেলেদের যখন বিদেশের ছাঁ মনে হয়েছে, তখন কৃষক হোক আর সমাজশিক্ষিত হোক কেউই ভেঙচি কাটতে সবুর করেনি। এ নিয়ে ঝগড়াফসাদের পরিমানও কম ছিল না। অনেক সময় অনেক স্থানে রক্তারক্তি হয়েছে। এ চিত্র ছিল সারা উপমহাদেশ জুড়ে।
আমরা এ চিত্রকর্মের প্রান্তবিন্দুতে অবস্থান করেছিলাম। আমাদের সময় পর্যন্ত জনতার অনেকাংশ এ ভীনদেশী চোঙা গ্রহণ করে নিয়েছে- শুধুমাত্র তার আঁচটা যেটুকু বাকী ছিল- এই যা। এ থেকেই অনুমান করতে অসুবিধা হয়নি কেমন ছিল শতবছর আগের রূপ!
আজকাল অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা। গ্রামের ছেলেরা সারাদিন প্যান্ট/ট্রাউজার পরে রাস্তায়, নদীর ধারে এমনকি গরু চরাতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে!
আমি?
হ্যা, স্কুল জীবনে বেতের ভয়েই প্যান্ট পরেছি। কলেজ জীবনে 'মুই কী হনুরে' অনুভূতি নিয়ে প্যান্ট পরেছি, কর্মজীবনে প্যান্ট পরছি পেটের দায়ে! কিন্তু যখনই স্বাধীন স্বাদে দেশের পথে ঘুরাঘুরি করি, যখনই চেতনায় জাতীসত্ত্বার অদম্য প্রেম কাজ করে তখনই ঘৃণাভরে ছুঁড়ে দেই ঐ বিজাতীয় চোঙাকৃতি বয়লার। অনেক দরদ নিয়ে গায়ে তুলি লুঙি-পাঞ্জাবি-পায়জামা।
প্যান্টের সাথে কোনকালই হৃদয় জড়ায় নি- আজও নয়। তবুও এ আমাদের দেহে বসে আছে ব্রিটিশ প্রভূদের রৌশন বাড়িয়ে দেয়ার জন্য!
ওরা প্রভু- আমরা যে গোলাম।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে মে, ২০১৬ বিকাল ৫:৩৮

বিজন রয় বলেছেন: ভাল লিখেছেন।
+++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.