নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বেড়াই-পড়ি-লিখি.....

সজল জাহিদ

সজল জাহিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অ-সফল পুরুষের আত্ন-সম্মান! (গলপ)

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৩৬


পুরুষের সম্মান, মর্যাদা বা সামাজিক অবস্থান নির্ভর করে তার নিজের যোগ্যতা, আর্থিক অবস্থা আর সফলতার উপরে। যে পুরুষ সমাজে যতবেশী সফল বা অবস্থা সম্পন্ন তার মর্যাদা ততবেশী। পরিবারে, আত্মীয় স্বজনের কাছে আর তার চারপাশের সমাজে। অনেকে সেটা প্রকাশ করেন, অহংকারী হন, অনেকে হন না। নির্জীব থাকেন আর তার সফলতার জন্য যে তাকে সবাই সমীহ করছেন সেটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেন। সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু পুরুষ যদি অসফল হয়, সেখানেই বাঁধে বিপত্তি। কি বিপত্তি?

বিপত্তি এক) অসফল পুরুষের আত্ন-মর্যাদা বড় বেশী থাকে! সবকিছুতেই নিজেকে জাহির করার একটা অযৌক্তিক প্রবণতা দেখা যায়। সংসারের সব কাজেই সর্বাধিক গুরুত্ত প্রত্যাশা করে সে। আবার কোন কাজে তাকে গুরুত্ত না দিলে বা না পেলে ফালতু অভিমান করে। মোট কথা সব সময় একটা হীনমন্যতার মধ্যে থাকে, আর ভাবে এই বুঝি তাকে ছোট করা হল, এই বুঝি তাকে খাটো করা হল, অপমান বা অবহেলা করা হল। আবার সঠিক সম্মান করলেও ভাবে এই বুঝি তাকে হেয় করা হল! একটা অদ্ভুত রকম মানসিক সংকটে ভোগে সে, সবসময়।

বিপত্তি দুই) অসফল পুরুষরা অনেক গুরুত্তহীন কিছুই অনেক বেশী-বেশী বোঝে কিন্তু অনেক গুরুত্তপূর্ণ বিষয় তারা কেন যেন বোঝেনা যেমন...

টাইলসের মেঝেতে মাথা নিচু করে থাকার চেয়ে, মাটির মেঝেতে মাথা উঁচু করে থাকাটা অনেক আনন্দের, ভালোলাগার আর গর্বের।

আজ তেমন পুরুষের গল্প বলবো।

এখানে বলে রাখা সফল পুরুষ বলতে যে শুধু বিশাল ব্যাবসায়ি, বড় চাকুরে বা বিশাল কোন কোম্পানির এমডি হতে হবে তা কিন্তু নয়।
একজন দিন মজুর, একজন রিক্সা চালক, একজন ফেরীওয়ালা, একজন হকার, বাদাম বা চা-পান-সিগারেট বিক্রেতা, একজন হোটেল কর্মচারী, একজন অফিস পিয়ন, সাধারণ কেরানী, কোন অফিসার, ব্যাংকার, ব্যাবসায়ি বা অন্য যে কোন ক্ষেত্রের যে কোন ব্যাক্তি সফল হতে পারে, তার স্ব-স্ব যোগ্যতা সম্পন্ন যায়গায় সঠিক, সময়ানুবর্তী, যথাযথ কাজটুকু সম্পন্ন করে নিজেকে নিজের যায়গায় ঠিক রাখতে পারলে, তার পরিবার আর তার উপর নির্ভরশীলদেরকে দেখভাল করতে পারলেই সে সফল।

তার মানে এই নয় যে একজন ব্যাক্তির উপর নির্ভরশীল সবাইকে সে তাদের সকল চাহিদা পূরণ করে দিলেই সফল হবে। সেটা সফলতা নয়, কারণ চাহিদা আর আকাঙ্ক্ষার কোন শেষ মানুষের মধ্যে নেই। তাই চাহিদা মিটিয়ে সফলতার মাপকাঠি নির্ধারণ করা যায়না কিছুতেই। সফলতার মাপকাঠি হল, যার যে যোগ্যতা আর অবস্থা সে সেই অনুযায়ী তার কাজটা করতে পারছে কিনা? অন্তত মৌলিক চাহিদা মেটাতে বা মেটানোর জন্য যথাযথ চেষ্টাটা করছে কিনা?

অনেক হয়েছে নীতিবাক্য, এবার তবে আসল গল্পে যাই, যে গল্প বলে এতো দর্শনের অবতারণা করা হল।

লাড্ডু, হ্যাঁ লাড্ডু তার নাম! আর লাড্ডুর মতই কাজকাম। দেখতে মাকাল ফলের মত, আসলে ভিতরে কিছু নাই একমাত্র খোসা ছাড়া। ঠিক পুরনো প্রবাদের মত, উপরে ফিটফাট আর ভিতরে সদরঘাট!

লাড্ডু বাবা-মা হারা এক ছেলে। বেড়ে উঠেছে অন্যের অনুনয় আর অনুগ্রহে, অবহেলায় আর অপমানে। লাড্ডুর একটাই ইতিবাচক দিক ছিল, সেটা হল... দেখতে দারুণ সে, এক দেখাতেই মেয়েরা নয় শুধু মেয়ের মায়েরাও তার উপর ক্রাস খায়! নাহ, মেয়ের মায়েরা বিয়ের নিজেদের জন্য ক্রাস খায়না, তার মেয়েদের জন্য ক্রাস খায়। লাড্ডু, এমনিতে নম্র-ভদ্র-বিনয়ী ছেলে। যে কারণে বেশ কিছু অপমান আর অবহেলা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে কিছুটা অনুগ্রহ পেয়ে থেকে তার আশ্রিত জনের কাছে।

লেখা পড়ায় বেশ ভালো, কিন্তু সেটা ঠিকঠাক করেনা। ভালো ইংরেজি বলতে পারে কিন্তু চর্চা করেনা, প্রচুর মিথ্যা কথা বলাটা লাড্ডুর একটি অন্যতম খারাপ দিক। লাড্ডু চোখে-মুখে মিথ্যা কথা বলতে পারে, কিন্তু ওর সারল্য মাখা ধপধপে সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে এটা কেউ ধরতে পারতোনা। যে কারণে লাড্ডু যা বলতো সেটাই সবাই বিশ্বাস করতো। এভাবে লাড্ডু নিয়মিত পড়াশুনায় ফাঁকি দিতে লাগলো। যার ফল স্বরূপ প্রথমবার এসএসসি ফেল! কিন্তু পরীক্ষার আগে আগে কোন এক সামান্ন অসুখের কারণ দেখিয়ে বেঁচে গেল লাড্ডু। পরেরবার কোন মতে পাশ।

লাড্ডুর ইংরেজি জানার কিছুটা দক্ষতার কারণে কলেজে ভর্তি হয়ে গেল সহজেই। কিন্তু ওই কলেজে ভর্তি হওয়া পর্যন্তই শেষ। কলেজে ঠিকমত যায়না, ক্লাস করেনা, পড়াশুনা করেনা, সারাদিন এখানে-সেখানে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে। লাড্ডুর আশ্রিতজন লাড্ডুর প্রতি কিছুটা সহনশীল হয় ওর কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে। অল্প-স্বল্প সাহায্য সহজোগিতাও করতে লাগলো। কিন্তু সেই অবস্থানও লাড্ডু খোয়াতে লাগলো ধীরে ধীরে, প্রচুর মিথ্যা বলা, নিয়মিত কলেজ ফাঁকি দেয়া, মেয়েদের সাথে প্রচুর সময় নষ্ট করা, সিগারেট খাওয়া, আড্ডা মারা আর দিন শেষে বাসায় ফিরে সকল অপকর্মকে মিথ্যার বেড়াজালে বন্দী করে ফেলায়।

অথচ লাড্ডুর সামনে বেশ ভালো সম্ভাবনা ছিল, ভালো কিছু করার, ভালো পাশ করে, একটা ভালো চাকুরী পাবার। নিজেকে একটা অবস্থানে নিয়ে গিয়ে, নিজের দুর্দশা ঘুচিয়ে একটা ভদ্র আর সামাজিক অবস্থানে পৌঁছানোর। কিন্তু যার নিজের মধ্যে কোন আকাঙ্ক্ষা নেই, কোন উদ্যম নেই, কোন প্রচেষ্টা নেই, সে কিভাবে সামনে এগোবে? কিভাবে একটা অবস্থান তৈরি করবে আর কিভাবেই বা তার পরিবার বা সমাজের কাছে সফল, গুরুত্তপূর্ণ আর সম্মান আশা করতে পারে? সে যে সবার কাছে, উপেক্ষার, অবজ্ঞার আর অসম্মানের হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। তার সেটাই ঘটলো লাড্ডুর পরবর্তী জীবনে বেহিসেবি, অনিয়ন্ত্রিত, ফাঁকা বুলি ছড়ানো, মিথ্যার বেড়াজালে ফেলে লোক দেখানোর কার্যক্রমের মাধ্যমে।

লাড্ডু, দুই বা তিনবারের চেষ্টায় কোন রকমে এইচএসসি শেষ করেছে। এরপর ঢাকায় চলে গেল ভালো কিছু করবে আর ভালো কোন কলেজ থেকে পড়াশুনাটা আর একটু এগিয়ে নেবে বলে। পরিবারের সবাই, অসচ্ছল ভাই-বোন আর দূরের আত্মীয়-স্বজনরা লাড্ডুর এই সিদ্ধান্তের সাধুবাদ জানায়, অনেক খুশি হয়ে লাড্ডুকে ঢাকায় পাঠায়। সবাই যে যার সাধ্যমত আন্তরিক সাহায্য করে লাড্ডুকে। লাড্ডু ঢাকায় চলে যায়।

লাড্ডু ঢাকায় গিয়ে কি করে কেউ ঠিকঠাক জানেনা। কারণ লাড্ডুর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে কেউ কখনো ঢাকায় যায়নি, তাদের কেউ থাকেওনা ঢাকায়, তাই ঢাকা মানে তাদের কাছে অনেকটা বিদেশ বিদেশ একটা ভাবাবেগ! আর সেই ঢাকাতেই কিনা লাড্ডু থাকে! এটাই লাড্ডুর পরিচিত জনদের কাছে একটা বিশাল সম্মানের ব্যাপার। যে তাদের পরিচিত লাড্ডু ঢাকায় থাকে! এতেই সবাই অনেক গর্বিত বোধ করে!

লাড্ডুকে নিয়ে তার মফসল শহরের মানুষের মাঝে এই যে একটা অন্ধভক্তি বা গর্ব সেটা লাড্ডু বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারে। তার উপর লাড্ডু দেখতে দারুণ স্মার্ট, টকটকে গাঁয়ের রঙ, লম্বা, নায়কের মত চেহারা আর ঢাকায় থাকে সেটা তো আছেই। সবকিছু মিলে লাড্ডু তার এলাকায় বেশ জনপ্রিয় আর আগ্রহের ব্যাক্তিতে পরিণত হয়েছে। আর উঠতি বয়সী বা বিবাহ যোগ্য মেয়েদের মা-বাবাদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় পাত্রে পরিণত হয়েছে সেটাই সে বেশ ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে। আর এসব দেখে ও বুঝে লাড্ডুর ভাবসাব সাথে আরও বেড়ে গেল। সে নিজেকে আরও বেশী করে জাহির করার জন্য আরও অঢেল মিথ্যার আশ্রয় নিতে লাগলো।

সে ঢাকায়, অমুক বড় যায়গায় চাকুরী করে, অনেক বড় বড় লোকের সাথে পরিচয়, ওঠা-বসা ঘনিষ্ঠতা, যাওয়া-আসা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সবাই সেটা বিশ্বাসও করতে অনায়াসে। এই মিথ্যে মরীচিকার ভালোলাগায় আর আবেগে লাড্ডু হারিয়ে যেতে থাকলো অতলে যেখান থেকে তাকে আর কোনদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। যা আজ তাকে নিয়ে গেছে এক অসহ্য মানসিক যন্ত্রণার ভেতরে, যে মিথ্যে আর তাকে কুড়ে কুড়ে খায়, কিন্তু কাউকে বলতে পারেনা, বাস্তবতা আজ বড় কঠিন, নির্মম আর অসহ্য সত্য। তবে কি সেই অসহ্য আর নিরেট সত্য?

লাড্ডু বিএ পাশ করেছে খবর এলো সেই ঢাকা থেকে। এলাকার মানুষের গর্ব আরও বেড়ে গেল। লাড্ডু অনেকটাকা চাকুরীর বড় চাকুরী পেয়েছে, লাড্ডু নিজেই জানালো। লাড্ডু এখন বিশেষ মর্যাদায় আসীন। লাড্ডু আজকাল বাড়িতে আসে, আর সবাইকে খুশি করার জন্য দুই হাত ভর্তি খরচ করে। যার যা চাওয়া মোটামুটি পূরণ করে, খাওয়া-দাওয়া আর দেয়া থোয়ার অন্যরকম হাত। কিন্তু এই কাজ করতে করতে লাড্ডু ঢাকায় ফেরার সময় আর টাকা থাকেনা তার কাছে। তাই ঢাকার ফেরার সময় কারো না কারো কাছ থেকে টাকা ধাঁর করতে হয়! প্রথম প্রথম এটাকে অন্য সবাই খুশি মনে করলেও একসময় লাড্ডুর এই স্বভাব সবার কাছে বিরক্তিকর লাগতে শুরু করলো।

তাই লাড্ডুকে তার দুই একজন শুভাকাঙ্ক্ষী পরামর্শ দিতে লাগলো, যে সব টাকা দুই হাতে না উড়িয়ে কিছু টাকা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় কর। কিন্তু এই কথা শুনে লাড্ডু তাদের উপরে ক্ষেপে যায়, নিজের সম্মানে লাগে, আর অন্যের কাছে তার অবস্থান নষ্ট হয়ে যেতে পারে এই ভেবে সে যখনই বেড়াতে আসতো তখনই দুইহাত ভরে খরচ করতো আর যাবার সময় ধাঁর করে ঢাকায় ফেরত যেত! মাঝে লাড্ডু চাকুরী ছেড়ে দিল বলে জানালো, বসের সাথে মনমালিন্যের কারণে। লাড্ডু এলাকায় ফিরে এলো কিছু দিনের জন্য। চাকুরী লাড্ডুর কাছে কোন ব্যাপারনা, একটা ছেড়েছে আর একটা পেয়ে যাবে। তার আগে কিছুদিন আরাম করে নিক। এই মনোভাব।

এলাকায় কিছুদিন আরাম করে, অনেকের কাছে অনেক রকম ধাঁর দেনা করে লাড্ডু ঢাকায় ফিরে গেল। আর ঢাকায় গিয়েই লাড্ডু সবার পাওনা টাকা পাঠিয়ে দেবে বলে আশ্বাস দিয়ে গেল। কিন্তু লাড্ডু ঢাকায় গিয়ে আর কোন খোঁজ নেই। সবাই টাকার জন্য লাড্ডুর ভাই-বোনকে জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু তারাও ঠিকঠাক কিছু বলতে পারেনা। অনেক দিন পরে লাড্ডুর ফোন এলো, লাড্ডু আগের চেয়ে অনেক ভালো চাকুরী পেয়েছে। খুব ভালো কথা। সবাই আবার খুশি হয়ে ওঠে।

কিন্তু কিছুদিন পরে আবার জানায় যে সে নতুন চাকুরী ছেড়ে দিয়েছে, সেখানে তার ভালো লাগছেনা, তাই নতুন চাকুরীতে ঢুকবে। কয়েকটা অফার আছে তার কাছে। এভাবে কিছুদিন পরপর লাড্ডু চাকুরী ছাড়ে আর নতুন আর এক যায়গায় জয়েন করে। বাড়িতে আসে, ধাঁর করে আবার ঢাকায় ফেরত যায়। কয়েকবার এরকম করতে করতে লাড্ডুকে এলাকার আর কেউ তেমন পছন্দ করতে পারেনা, ধীর ধীরে সবার কাছে লাড্ডু মিথ্যেবাদী, ভণ্ড আর লোক দেখানো অভিনেতা হিসেবে পরিচিত পেয়ে গেল!

লাড্ডু আবার ঢাকায় যায়, আবার চাকুরী পায়। আবার বাড়ি ফিরে তার সেই আগের মত করে টাকা পয়সা ওড়ায়। ভবিষ্যতের জন্য কোন ভাবনা লাড্ডুর নেই, কারো কোন কোথায় সে কখনো কান দেয়না, সে আছে তার মতই। মিথ্যে আগেব আর ঠুনকো অহমিকা নিয়ে। তারপরেও লাড্ডুর ভালো চেহারার জন্য বেশ কিছু ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকলো, কিন্তু ঢাকার লাড্ডুর কি আর মফসলের মেয়েকে মনে ধরে! তাই নাক সিটকিয়ে ঢাকায় চলে যায় লাড্ডু। সেখানে গিয়ে প্রেমে পরে এক অতি সাধারণ মেয়ের। যত সাধারণই হোক, ঢাকার মেয়ে বলে কথা।

হুট করে বিয়ে করে বসে সেই মেয়েকে। এই কথা জানতে পারে এলাকার সবাই। বেশ হতাশ হয়, কেউ কেউ খুব কষ্ট পায়, আর কেউ কেউ আফসোস করে লাড্ডুর এই ভুলের জন্য। কিন্তু লাড্ডু, লাড্ডুর মতই। নতুন বিয়ে করেছে, চাকুরী করে ভালো বেতন পায়। তাই সে বৌকে নিয়ে এলাকায় আসে। এসেই আগের মত খরচ করে, সবাইকে নিয়ে বসে, আড্ডা দেয়, খাওয়ায়। বেশ চলে কিছুদিন। দুই একজনের পূর্বের ধাঁর শোধ করে। আর যাদের ধাঁর শোধ করেনা, তদেরকেও আশ্বাস দেয়, ঢাকায় গিয়েই তাদের টাকা পাঠিয়ে দেবে সে। কিন্তু যাবার সময় আবার সেই চিরাচরিত ধাঁর করা চিত্র! বাসার লোকজন লাড্ডুকে টাকা ম্যানেজ করে দেয়। লাড্ডু ঢাকায় চলে যায়। কিন্তু ঢাকায় গিয়েই লাড্ডু আবারো কোন এক অজানা কারণে চাকুরী ছেড়ে চুপ মেরে যায়!

অনেকদিন লাড্ডুর কোন খোঁজ নেই, ওর আত্মীয়-স্বজনরা খোঁজ পায়না কোন। কারো কাছে কোন খবর নেই। সবাই কম-বেশী চিন্তিত। হুট করে একদিন লাড্ডুর ফোন আসে এলাকায়। লাড্ডু একটি কোম্পানির বড় পদে চাকুরী পেয়েছে। আগের চেয়ে অনেক বেশী বেতন! কিন্তু কত টাকা সেটা কেউ জানেনা, কখনো কাউকে সেটা লাড্ডু বলেনা। তবে লাড্ডুর ঠাট-বাট আর পোশাক-আসাকে বোঝা যায় যে লাড্ডু বেশ অবস্থা সম্পন্ন। আবারো লাড্ডু আগের মত বনেদী ভাবে চলাফেরা করতে শুরু করলো।

অথচ লাড্ডুকে অনেকেই বুঝিয়েছে যে খরচ কর ভালো, কিন্তু কিছু কিছু করে জমিয়েও রাখো, বিপদে কাজে লাগবে। কিন্তু এতে লাড্ডুর বড় আঁতে ঘা লাগে। সে কারো কোন কথাকেই কখনো গুরুত্ত দেয়না। লাড্ডু আরও বেশী করে অন্যকে দেখিয়ে তার ঠাট-বাট বাড়িয়ে দেয়! কিন্তু লাড্ডু কি চাকুরী করে আর কত টাকা বেতন পায় সেটা কেউ কখনো জানতে পারেনি।

লাড্ডুর ছেলে হল। রাজপুত্রের মত দেখতে। স্বাভাবিক ভাবেই, লাড্ডুর যে রাজকীয় চেহারা তাতে তার ছেলে তো অমন সুদর্শন হবে সেটাই স্বাভাবিক। এবার লাড্ডুকে আর পায় কে? লাড্ডু ছেলেকে রাজারহালে গড়ে তুলতে যা যা করার সব করতে লাগলো। লাড্ডু ভালো চাকুরী করে, বেশ ভালো বেতন পায়, তাই মিনারেল ওয়াটার দিয়ে ছেলেকে গোসল করায়! কোন রকম দূষণ যেন ছেলেকে ছুঁতে না পারে তার সব ব্যাবস্থা লাড্ডু সব সময় করে যায়। খুবই ভালো কথা, কিন্তু তাই বলে কি বাস্তবতা বিবর্জিত হতে হবে মানব জীবন! ছেলেকে মিনারেল ওয়াটার দিয়ে তার গোসল থেকে শুরু করে বাথরুমের ধোঁয়া মোছাও? এটা কি স্বাভাবিক?

অনেকেই লাড্ডুকে বোঝালো, কিন্তু উল্টো লাড্ডুর সাথে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেল। লাড্ডু তাদেরকে তার ছেলের আশপাশ থেকে দূর দূরে রাখতে লাগলো। এদিকে হুট করে লাড্ডু আবার তার বর্তমান চাকুরী ছেড়ে দিল, ভাগ্যক্রমে আবার একটা চাকুরী পেয়েও গেল। তাই লাড্ডুর বিলাসী জীবন আরও বিলাসী হয়ে উঠলো। লাড্ডু সকাল ১০ টায় ঘুম থেকে উঠে ১২ টায় অফিসে যায়, রাত ১ টায় অফিস থেকে ফিরে রাত ৩ টায় রাতের খাবার খায়, সারারাত ছেলের সাথে জেগে থেকে সকালে ঘুমোতে যায়, আর বেলা ১২ টায় তাই অফিসে যায়! এভাবে করতে করতে লাড্ডুর একদিন চাকুরী চলে যায়। লাড্ডু কিছুদিন বেকার থাকে, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত জনদের কাছে ধাঁর করে চালিয়ে যায়।

বেশ কিছুদিন চেষ্টা করে লাড্ডু আবার চাকুরী পায়। এবারেও তার বোধোদয় হয়না, লাড্ডু তার জীবন সব সময়ের মত করেই কাটাতে চায়। আর লাড্ডুর বউটাও পেয়েছে সেই রকম, যা পায় তা একবারে শেষ করে দেয়, সে হোক টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় বা খাওয়া-দাওয়া। কোন বাসি জিনিষ ব্যাবহার করেনা, ইস্ত্রি ছাড়া বাসার কাপড়ও পড়েনা, একটু পোকা ধরা বেগুন ছুড়ে ফেলে দেয়, কালো রঙের কোন পেঁয়াজ বা কাঁচা মরিচ দেখলে প্যাকেট সহ ডাস্টবিনে ছুড়ে দেয়! মিনারেল ওয়াটার ছাড়া তো কখনোই মুখেই তোলেনা!

লাড্ডুর ছেলে ধীরে ধীরে বড়, হয়। আর লাড্ডুর নতুন স্বপ্ন বোনে। ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবে, অন্য পরিচিত অনেকের মত করে। নইলে এই ঢাকা শহরে আর তার এলাকাতেও লাড্ডুর সম্মান থাকবেনা। তাই লাড্ডু তার ছেলেকে এক সময়, আসলে সময়ের আগেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে, অনেক টাকার বিনিময়ে। সমাজের কাছে উঁচু হয়, পরিবারের কাছে সম্মানিত হয়, আত্মীয়-স্বজনের কাছে সমীহর হয় আর আত্নসুখে বিলীন হয়। কিন্তু বিবেচক আর শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকেই লাড্ডুকে বলেছে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি না করিয়ে বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করাতে। যাতে করে ভবিষ্যতের জন্য কোন সমস্যা নাহয়। কিন্তু ওতে লাড্ডুর ইগোতে লাগে। লাড্ডু তার মত করে ছেলেকে ভীষণ বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত করে তোলে।

কিন্তু লাড্ডুর যে জীবন ধারা, অফিসের অনিয়মিত যাওয়া-আসা, কোন রকম সেভিংস না রাখা, আজকে খেয়ে আগামীর চিন্তা না করা, নিজেকে মিথ্যে বিলাসিতার মাঝে রাখা অনেকেই এতদিনে জেনে বা বুঝে ফেলেছে, কিন্তু কেউ কখনো সাহস করে কিছু বলতে পারেনি। লাড্ডুর অহংবোধর সামনে এসে। কিন্তু আজ নাহয় কাল তো সব বের হবেই। আর তাই-ই হল।

আবারো লাড্ডু চাকুরী ছেড়ে দিল! বা চলে গেল! কারণ লাড্ডু বলে ছেড়ে এসেছে, কিন্তু লাড্ডুর সামগ্রিক কার্যক্রম বলে যে তাকে ছাটাই করা হয়েছে। তার প্রমাণ পাওয়া গেল আরও কয়েকদিন পরে। যখন বেশ কয়েকদিনের মধ্যে লাড্ডুর বাসা আর বিভিন্ন অফিসের ঠিকানায় এসে জমে থাকা সবগুলো ব্যাংকের লাখ লাখ টাকার ক্রেডিট কার্ডের বিল! মিথ্যে ট্যাক্স সার্টিফিকেট আর স্যালারি স্টেটমেন্ট দিয়ে যেগুলো করা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর থেকে। যেখানে কখনো কোন বিল পরিশোধ করা হয়নি। ক্রেডিট কার্ডের লিমিট শেষ হয়েছে আর সেই কার্ড ব্যাবহার করেনি। কখনো চাকুরী ছেড়ে চলে এসেছে বিল এড়াতে, কখনো এসব দেখে মালিক চাকুরী থেকে বিদায় করে দিয়েছে!

আর এতোদিন ধরে মানুষ কে যে বেতন আর উঁচু মহলের মানুষের সাথে তার যোগাযোগের কথা বলেছে, সব ছিল নিজের বানানো, ভুয়া আর চরম আবেগিয় সব কথাবার্তা। একটা কল্পনার জগতে বাস করতো সে, কোন রকম পরিশ্রম, পড়াশুনা বা সত্যিকারের কোন চাকুরী, এমনকি জানা গেল যে সে যে বিএ পাশ করেছে বলে সবাই জানতো, সেটাও ছিল মিথ্যে! বাসা ভাড়া বাকি অনেক মাসের, দোকানে বাকি লাখ টাকা! চারপাশে শুধু ঋণের পাহাড়, বেদনার নদী, কষ্টের কুয়াসা।

আর তাই যা হবার তাই হল, একে একে বাস্তব জীবনে ফিরে এলো সে, চাকুরী নেই, ছেলের স্কুল বাদ দিতে হয়েছে অনেক আগেই! এরই মাঝে আর একটি মেয়ে হয়েছে। তারও স্কুলের বয়স হয়েছে, কিন্তু সেই সাধ্য আর নেই! ছেলেকে কোন রকম একটি পাড়ার স্কুলে পাঠায়, মেয়েকে ঘরে বসে লাড্ডুর বউ পড়ায়। লাড্ডুর বৌয়ের এক বড়লোক আত্মীয়র ফ্ল্যাটে থাকে, লাড্ডু আজ এইকাজ, কাল ওই কাজ করে বেড়ায়, কিন্তু কোথাও থিতু হতে পারেনি বা পারেনা। লাড্ডু এখন অন্যের টাইলস করা বাসায় মাথা নিচু করে থাকে আর রাগে ক্ষোভে ফোঁস ফোঁস করে!

অথচ লাড্ডুকে কত বোঝানো হয়েছে যে টাইলসের মেঝেতে মাথা নিচু করে থাকার চেয়ে, মাটির মেঝেতে মাথা উঁচু করে থাকা অনেক আনন্দের, অনেক ভালোলাগার, তৃপ্তির আর গর্বের। কিন্তু কখনো শোনেনি সে। তার মিথ্যে অহংকার, ফাঁকা সম্মান আর মরীচিকার মত সামাজিক মর্যাদার মাঝেই চলছিলো।

এখন লাড্ডুকে কেউ যদি কোন পরামর্শ দেয়, সেটা অবমাননাকর মনে করে, আগেও করেছে। কারণ সে জীবনে সফল নয়। সফল ব্যাক্তিরা অন্যের কথাকে গুরুত্ত দেয়, শোনে মানুক বা না মানুক।

লাড্ডু যাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করেছে, তারা আয অনেকেই অনেক ভালো আছে, তাদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে, তারা কোন পরামর্শ দিলে, লাড্ডুর কাছে অবজ্ঞা বা টিটকিরি মনে হয়, আবার সম্মান দিলে লাড্ডু মনে করে তাকে বুঝি অপমান করছে!

কেউ ডাকলে দূরে সরে থাকে, মনে করে তাকে হেয় করে বা দয়াকরে ডাকছে, আর না ডাকলে মনে করে এড়িয়ে যাচ্ছে, তাকে গুনছেনা, পাত্তা দিচ্ছেনা, তাকে কোন রকম হিসেবে নিচ্ছেনা কেউ!

ভালো কিছু বললে মনে করছে, বড় মানুষী দেখাচ্ছে আর না খারাপ কিছু বললে নিজের অসহায়ত্তকে দায়ী করছে। আবার কিছু না বলে চুপ থাকলে সেটাকেও সে মন্দ নজরে দেখছে!

প্রতিটি অ-সফল পুরুষের ভিতরেই উপরের লক্ষণ আর কার্যক্রমগুলো প্রকটভাবে দেখা যায়, সব সময়। তারা সব সময় একটা হীনমন্যতায় ভোগে। সব সময় ভাবে তাকে বোধয় সবাই ছোট করে দেখছে! একটা অদ্ভুত কষ্ট তাকে কুড়ে কুড়ে খায় জীবনভর।

মোটকথা একটা অদ্ভুত মানসিক সংকটে পড়েছে লাড্ডু এখন তার ফেলে আসা, বর্তমান আর আঁধার ভবিষ্যতের বিভীষিকাময় জীবন নিয়ে। না পারছে রাস্তায় নামতে, না পারছে গ্রামে ফিরে যেতে আর না পারছে তার চাওয়ার মত করে কিছু করতে।

অ-সফল পুরুষদের আত্ন-সম্মান বোধ খুব বেশী হয়! কারণ নিজের কাছেই যে নিজের কোন সম্মান বা মর্যাদা থাকেনা, আর যার নিজের কাছে নিজেরই সম্মান নেই বা থাকেনা সে তো এমন ভাববে, এটাই স্বাভাবিক।

তাই বলেছি, টাইলসের মেঝেতে মাথা নিচু করে থাকার চেয়ে, মাটির মেঝেতে মাথা উচু করে থাকা আনন্দের, তৃপ্তির আর গর্বের।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.