নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বেড়াই-পড়ি-লিখি.....

সজল জাহিদ

সজল জাহিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

হাসিহীন জীবনের গল্প......

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:৫৬

মোখলেস, জমকালো এক গ্রামের নিরীহ, নির্বাক আর নিতান্ত একজন। যাকে জীবনে কেউ কখনো হাসতে দেখেনি। হাসির কোন কারণই যে ঘটেনি কখনো তার জীবনে। একটু যে হাসবে সেই সুযোগ বিধাতা তাকে দেয়নি। বড় নির্মম সেই জীবনের গল্পটি।

জমকালো গ্রাম এই জন্য বললাম যে, এই গ্রামে সকালটা হতো ঝলমলে, কারো গান-বাজনা দিয়ে, কারো কলকাকলি আর কারো নিত্য দিনের ঝগড়া দিয়ে। দুপুরটা থাকতো ছোট ছেলে-মেয়েদের হাসি-খেলা আর দৌড়-ঝাঁপে মুখরিত। বিকেল থাকতো খেলার জন্য কিশোর-যুবকদের মাঠ, উঠোন আর খোলা যায়গা দখলের ব্যাঞ্জনায়। আর সন্ধা জমতো বড় রাস্তার উপরে চা, টিভি, গান আর তাসের আড্ডায় মুখরিত হয়ে। সবকিছু মিলে এক জমকালো গ্রাম ছিল সেটি।

আর সেই জমকালো গ্রামের মাঝেই ছিল এক অনন্ত নিরানন্দ আর নির্জীব ঘর, যে ঘরে কেউ কখনো হাসেনি, যে ঘরের কেউ কখনো খেলেনি, যে ঘরে কেউ কখনো উচ্ছ্বসিত হয়নি, যে ঘরে বিধাতা কখনো হাসি বা আনন্দের এক বিন্দুও বরাদ্দ করেনি, কোন এক মুহূর্তের জন্যও।

মোখলেস সেই পরিবারের কর্তা, তার প্রায় সব সময়ের অসুস্থ স্ত্রী, বছর-বছর, ছেলের আশায় আশায় একটি করে পর-পর ৫ টি মেয়ে। প্রতি বছর মখলেসের বউ অসুস্থ হয় আর মখলেস সহ প্রতিবেশী সবাই কিছুটা আশা নিয়ে বসে থাকে এবার বুঝি এই ঘরে হাসি ফুটবে, যদি ছেলে হয়। একটি ছেলের জন্মই দিতে পারে এই ঘরের সব নিরানন্দ আর দুঃখ দূর করে একটু হাসির খোরাক দিতে।

মোখলেস গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারকেল আর সুপারি গাছে চড়ার কাজ করে, যেটাকে গ্রামের ভাষায় গাছ বাওয়া বলে। যাদের নারকেল গাছের ডাব পরিপক্ক হয়ে নারকেলে রূপান্তরিত হয়েছে, তারা মখলেসকে ডাকে সেগুলো পাড়ার জন্য, যাদের সুপারি গাছের সুপারি শক্ত হয়ে হলুদ রঙ ধারন করতে শুরু করেছে, তারাও ডাকে তাকে, সুপারি পাড়ার জন্য। গাছ প্রতি সে টাকা পায়। নারকেল গাছ প্রতি এক টাকা, আর সুপারি গাছ প্রতি ৫০ পয়সা।

প্রতিদিন মোটামুটি ১৫/২০ টি নারকেল গাছ আর ২০/৩০ টি সুপারি গাছে উঠতো সে। নিজ গ্রামের বাইরে গিয়েও, যখন যেখানে যে বা যারা তাকে ডেকে নিয়ে যেত। এভাবে গাছ বেঁয়ে বেঁয়ে দিনে সে ৩০/৩৫ টাকা আয় করতো। তবে যাদের একটু বেশী গাছ একসাথে পেত তারা হয়তো কখনো কখনো একটি ডাব বা নারকেল দিত তাকে, কেউ দিত ৮/১০ টা ছোট সুপারি। সেই ডাব বা নারকেল আর সুপারিও সে বিক্রি করে দিত পাশের দোকানেই। আরও দুই একটি টাকার জন্য।

সারাদিনের উপার্জিত টাকা দিতে এক কেজি চাল, একটু আলু, দুটো পেঁয়াজ, কয়েকটা মরিচ, আধা ছটাক সরিষার তেল, একটু লবণ, প্রায় পচে গেছে এমন একটু চিংড়ী বা টাকি মাছ যা সবচেয়ে কম দামে বা প্রায় নাম মাত্র দামে পাওয়া যেত। সেসব কিনে ঘরে ফিরত সে। কখনো কখনো বড় বাজারের দিক থেকে কাজ শেষে ফিরলে তার হাতে দেখা যেত, অর্ধেক বা প্রায় নষ্ট তরকারীর কিছু তার ছোট্ট ব্যাগে। ভাঙা মুলো, অর্ধেক গাজর, কেউ কেনেনা এমন ফুলকপি, ছোট্ট প্রায় নষ্ট বেগুন, বিক্রির অযোগ্য কাঁটা বেরিয়ে থাকা কোন পাঙ্গাস, শোল বা তেলাপিয়া মাছের সংগ্রহ।

সবকিছু নিয়ে ঘরে ফিরত সে, আর এসেই বৌয়ের সাথে দিনের দ্বিতীয় ঝগড়া শুরু হত। এই শেষ বেলায় কখন কি রান্না হবে, আর কিভাবে হবে? কারণ রান্নার জন্য তো জ্বালানি কাঠ বা শুকনো পাতা নেই ঘরে যে আগুন জ্বালাবে। এবার মোখলেস গলা চড়ালো, সারাদিন কি করেছে তার বউ?

সারাদিন ৪/৫ টি মেয়ে নিয়ে দিনপাত করেছে। কারো জন্য অন্য কারো ঘরে গেছে ভাতের মাড় জোগাড় করতে, কারো ঘর থেকে লবন আর কারো ঘরে অপেক্ষা করেছে সেই ভাতের মাড়ের ভিতরে এক চামচ ভাতের জন্য। এভাবে তিন চার ঘরে ঘুরে ঘুরে, তিন মেয়ে আর নিজের পেটের জন্য কিছু খাবার জোগাড় করেছে সে। আর কোন এক ঘরে অপেক্ষা করেছে, তাদের বাচ্চার খাওয়া শেষ হলে, যদি একটু বেঁচে থাকে তবে সেই টুকু ফেলে দেবার আগেই তার একদম ছোট মেয়ের জন্য নিয়ে নিতে। এভাবেই কেটেছে তার সকাল-দুপুর আর প্রায় বিকেল।

এবার মখলেস তেড়ে গেল বড় মেয়ের দিকে, তবে সে কেন সারাদিনে শুকনো কাঠ বা পাতা জোগাড় করেনি?

তার উত্তরও তৈরি আছে। মা যখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাতের মাড়, লবণ আর এক চামচ ভাতের জন্য ঘুরেছে কোলের মেয়েটাকে নিয়ে তখন সে ঘরে বসে অন্য ছোট তিন বোনকে পাহারা দিয়েছে। কাউকে গোসল করিয়েছে, কাউকে নিয়ে হেটে বেড়াতে হয়েছে অনবরত কান্না থামাতে, আর কেউ যেন পাশের গভীর ডোবায় পরে গিয়ে অকালে ঝরে না যায়, সেই খেয়াল রাখতে হয়েছে, তাই পারেনি। সেও ক্ষেপে উঠলো বাপের উপরে, তার ঝাঁঝালো কণ্ঠে। সবার কণ্ঠেই ঝাঁঝালো আগুনের ফুলকি, কোন নমনীয়তা নেই, সেই সুযোগই যে নেই। কারণ সবাই ক্ষুধার্ত, সারাদিন না খেয়ে থেকে মেজাজ হারিয়েছে বেশ আগেই। এখন এঁকে অন্যকে সামনে পেয়ে যে যার মত করে ক্ষোভের প্রশমনে নেমেছে তার মত করে।

মোখলেশ কারো কথার সাথে আর কোন যুক্তি দাড় করাতে পারেনা, কিন্তু তবুও পৌরুষের ইগো বলে একটা কথা তো আছে! সে কিভাবে হেরে যায়, এই অবলা বউ আর তার চেয়েও অবলা মেয়ের কাছে? তাই হাতের কাছে পরের মেয়েকেই বসিয়ে দিল দুই ঘা! শুরু হল দিনের তৃতীয় কলহ। এক মেয়েকে মারায় সেই মেয়ের কান্না, কেন তাকে অযথা মারলো সেই কৈফিয়ত বড় মেয়ে আর মায়ের, আর তাদের চিৎকার চ্যাঁচামেচি দেখে ভঁয়ে, বাকি দুজন মিলেও শুরু করলো কান্না। সেই সাথে মখলেসের চিৎকার তো আছেই। সব মিলে একটা নিত্য বিভীষিকা সেই ঘরের। মখলেশ বেরিয়ে যায়, কোমরের গামছাটা খুলে গাঁয়ের জমে থাকা ধুলো-বালি আর ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে, বাড়ির পাশে খালের পাড়ে গোসল করতে।

মোখলেস সব সময়ই ঠিক এই সময়ে, প্রায় সন্ধ্যায় গোসলে যায়, নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে আড়ালে রাখতে। কারো সাথে যেন কোন কথা বলতে না হয়। তার যে কিছু বলার নেই কাউকে, নেই কোন কুশলের খবর, না থাকে কোন নতুন কিছু বলার বা শোনানর মত। বরং দুই একটি কটূক্তি শুনতে হলেও হতে পারে, সেই শঙ্কায় সব সময় নিজেকে সে লুকিয়ে রাখে বা চেষ্টাটা করে যায়।

নিজের কোন ভিটে নেই। না আছে দিন চলার মত কোন উপার্জন, নেই মাথা গোঁজার ঠাই, শারীরিক সক্ষমতা ভালো কিছু করার আর না আছে কোন পুঁথিগত বিদ্যা। তার উপর আবার থাকে শশুরের রেখে যাওয়া একটা ছাপরা ঘরে। যেটার খোটা প্রতিদিন সন্ধ্যায় শুনতে হয় বৌয়ের কাছে, যেটার প্রভাব পরে মা আর মেয়ের পিঠে প্রতি রাতেই! তাই আর অন্য মানুষের কাছে শুনতে চায়না এসব, তাই সে নিজেকে লুকিয়ে রাখে সব সময়। দৈবাৎ যদি ভর সন্ধ্যায় দেখা হয়ে কারো সাথে, তো নিজেকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে পারলেই বেঁচে যায় সে।

বেশ সময় নিয়ে ঘরে ফেরে সে, যেন ততক্ষণে যেন অন্তত ভাত ফুটে যায়। ঘরে গিয়ে বিছানা করে বসতে বসতে তরকারী রান্না বা মাছ ভাঁজা হয়ে যাবে। মখলেস ঘরে ফিরে ভাত রান্না পায়। গায়ে পায়ে তেল লাগাতে লাগাতে রান্না শেষ হয়ে আসে প্রায়। গাঁয়ের ময়লা জমে আর প্রতিদিন তেল লাগিয়ে লাগিয়ে মোখলেসের চামড়ার পুরত্ত ইঞ্চি ছাড়িয়েছে সেই কবেই!

শেষ কেন, কোনদিন গায়ে সাবান লাগিয়েছে কিনা সেটাই তো মনে করতে পারেনা সে! মখলেস একা-একা খেতে বসে, আলাদা পাটি বিছিয়ে, মাটিতে। অন্যরা একটা দূরে। মখলেসের গায়ে গাছের, মাটির গন্ধে ঘেঁষা দায়। কুপি জ্বালিয়ে কোন মতে সবাই মিলে সন্ধা বেলাতে দুপুর আর রাতের খাবার এক সাথে খেয়েই অন্ধকার করে দিয়ে ঘর শুয়ে পরে। সবাই ঘুমে হারিয়ে যায় নিমিষেই।

আলো জ্বালানো ওদের বিলাসীতা, সাবান ওদের কাছে স্বপ্ন! আর সন্ধার পরে জেগে থাকা ওদের কাছে অবাস্তব, হাসি-কথা বা গল্প ওদের কাছে রূপকথা।

ওদের ভোর হয় ভোরের আগেই, বাচ্চার কান্না কাঁটিতে ঘুম ভেঙে যায় মোখলেসের। তখনই শুরু হয় প্রহরের প্রথম প্রহার আর সেই সাথে দৈনন্দিন কলহ, যার দ্বিতীয় অধ্যায় বিকেলে সবার ক্ষুধার্ত পেটে আর শেষটা সেই সন্ধার পরে ঘুমোনোর ঠিক আগে-পরে বা মাঝরাতে। তিন বেলা ভাতের পরিবর্তে ওদের তিনবার ঝগড়া হয় যাতে অন্তত, ক্ষুধা না গেলেও সময়টা তো কেটে যায়! সাথে দূর হয় জমে থাকা ক্ষোভ আর তিক্ততা। আর খাবারটা সেই একবেলাই, সন্ধ্যায় বা শেষ বিকেলে।

এই হল মোখলেসের একদিনের গল্প শুধু। কিন্তু মোখলেসের প্রতিটি দিন এভাবে একই রকমভাবে কাটে, কোন পরিবর্তন হয়নি কখনো। যেখানে নেই এক চিলতে হাসি, এতটুকু আনন্দ, এক বিন্দু উচ্ছ্বাস বা কলহহীন কোন দিন। হোক সে শীত, গ্রিশ্য বা বর্ষা।

সে এক হাসিহীন জীবনের গল্প......

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৩২

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: প্রান্তিক জীবনক েযেন কলমের খোচায় বাস্তব করে তুললেন.

খুব কষ্টের সাথেই এমন হাজারো মুখলেস জাননা মানবাধিকারের কথা
জানেনা স্বপ্নের কথা
কেবলই বেঁচে থাকা
মরতে জানে না বলেই.।

ছুঁয়ে যাওয়া গল্পে +++++

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:১০

সজল জাহিদ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.