নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বেড়াই-পড়ি-লিখি.....

সজল জাহিদ

সজল জাহিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

“তুই গ্যাছো আউগাইয়া...!!!”

০৮ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ৯:৫২

একদা বালক স্কুল ফাঁকি দিয়া, সন্ধাবানী সিনেমা হলে সালমান শাহ্‌-শাবনুরের এর “তুমি আমার” সিনেমা দেখিয়া, মনের সুখে গান গাইতে-গাইতে, ভর দুপুরে বাড়ি ফিরিতেছিল। দুইপাশে দুটি গ্রাম মাঝে সন্ধ্যা নদীর একটি বিসৃত প্রশাখা। পানি ছিল কি নেই সেই কথা তেমন করিয়া মনে করিতে পারিলনা। কারন অন্য গ্রামকে পাশ কাটাইয়া, লোহার ও কাঠের ব্রীজকে উপেক্ষা করিয়া, অন্য গ্রামের ইট বিছানো রাস্তায় না গিয়া, নিজ গ্রামে পা রাখিয়া সামনের দিকে আগাইতেছিল। কিছুদুর আগাতেই যাহা শুনিল, তাহা শুনিয়া গান, সিনেমার সংলাপ, সন্ধ্যা নদীর প্রশাখায় পানি ছিল কি ছিলোনা সব মুহূর্তেই ভুলিয়া গিয়া সেই কথাটাই তার সমস্ত সত্তা জুড়িয়া ঝংকার তুলিতে লাগিলো।

সেই গ্রামের সেই সময়ের ধনাঢ্য একজন ব্যাক্তি হালকা শীতে সন্ধার প্রশাখায়, শান বাঁধানো ঘাঁটে দুপুরের গোসলের নিমিত্তে একটু রোদ পোহাইতে ছিলেন। কথিত আছে তাহাদের হুট করে ধনাঢ্য হওয়া আর গ্রামের একমাত্র ইটের-সিমেন্ট এর বাড়ি বা দালান করাটা সৃষ্টি কর্তার কোন এক করুনা ছিল। মোট কথা মোটেই পরিশ্রমলব্ধ ছিলোনা। তবুও হুট করিয়া হাতে পাওয়া অজস্র কাঁচা পয়সা আর গ্রামের একমাত্র দালান উঠানোয় সেই গ্রামসহ কয়েক গ্রামের মানুষের কাছে সমীহ আদায় খুবই স্বাভাবিক হয়ে উঠিলো।

উহাই স্বাভাবিক ছিল। কাঁচা পয়সায় সাময়িক সমীহ আদায় যতটা সহজলভ্য, শ্রমলব্ধ পয়সায় ততটা সম্ভব নয়। কারন শ্রমলব্ধ উপার্জনে সম্মান আর শ্রদ্ধা অনেক ধীরে-ধীরে আর দেরিতে আসে, তবে তার স্থায়িত্ব থাকে অনেক বেশী হইয়া থাকে, যেটা আবার কাঁচা পয়সায় পাওয়া সম্ভব নহে। কাঁচা পয়সায় সমীহ পাওয়া যায়, তবে সাময়িক। যদিও সেকালের মত একালেরও সেই একই অবস্থা বিদ্যামান, সবাই শুধু সাময়িক সাময়িক সমীহ লইয়াই সুখী হইতে চায়, স্থায়ী শ্রদ্ধা বা চিরন্তন সম্মান নহে!

তো যে কথা বলিতেছিলাম, ধনাঢ্য ব্যাক্তি বালককে ডাকিলেন। বালক কাছে যাওয়াতে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন

“পর (পড়) কিসে? সিন্সে (সাইন্সে) নাকি এমনেতায় (আর্টস-কমার্স)...!

এই কথা শুনিয়া বালক হাসিবে না কাঁদিবে, নাকি তাহাকে ধাক্কা দিয়া সন্ধার প্রশাখায় ফেলিয়া দিবে বুঝিয়া উঠিতে পারিলনা। আসল ঘটনা যেটা বেশ কিছু পরে বালক বাড়িতে আসিয়া বুঝিতে পারিল তাহা ছিল এমন? সেই ধনাঢ্য ব্যাক্তির এক পুত্র বালকের স্কুলেই এক ক্লাস উপরের ছাত্র, সদ্য নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হইয়াছিল, যে কিনা আবার সাইন্স নামক দুর্লভ শাখায় অধ্যয়নরত। যাহা ছিল তাহার অক্ষরহীন, কাঁচা পয়সার মালিক ও গ্রামের একমাত্র দালান তোলা ব্যাক্তির কাছে অসীম অহংকারের আর নিরন্তর গর্বের ব্যাপার।

কারন তাহাকে বোঝানো হইয়াছিল, যে যাহারা সাইন্স এ পড়ে, তাহারা স্পেশাল। আর যাহারা আর্টস বা কমার্স এ পড়ে তাহারা ফালতু আর অতি নগন্য শ্রেণীর! অনেকটা আজকালকার বনেদী আর দলিত শ্রেণীর মত করিয়া সেই সময়ের সাইন্স আর আর্টসের ছাত্র-ছাত্রীদের বিচার করা হইতো। যে কারনে সেই ধনাঢ্য ব্যাক্তি সাইন্সে পড়াটাকেই একমাত্র সম্মান, অহংকার আর গর্বের ব্যাপার ধরিয়া লইলেন। সেটাই স্বাভাবিক ছিল। তাহার ছেলেও তাহাকে সেভাবেই বোঝায়াছিলেন, বোধ করি!

বালক বাড়িতে যাইয়া সেই ব্যাক্তির ওই কথা রাষ্ট্র করিয়া দিলো। আর সেই সময় সেই কথাই পুরো গ্রামের সবার কাছে অত্যন্ত রসালো কৌতুকে পরিণত হইয়াছিল। এরপর হইতে কোথাও কোন রকম রঙ্গ-রসের কমতি হইলেই যখন-তখন সেই বাক্য নানা ভাবে বর্ণিত হইতে লাগিল।

“তুই পর কিসে? সাইন্সে না এমনেতায়!!”

যেন চিরন্তন এক আনন্দের খোরাক যোগাইয়াছিল সেই সময় এবং আদ্যবধি!

উহার কিছুকাল পরে সেই বালক, বালক থেকে কিশোর হইলো মানে, সেও নবম শ্রেণীতে উঠিল কিন্তু কিছুটা ভালো বাংলা বলতে পারা ছাড়া আর সব কিছুতেই ডাব্বা প্রকৃতির ছাত্র হওয়ায় এমনেতা (আর্টস) এ পড়িতে লাগিল। আবারো একদিন সেই ধনাঢ্য ব্যাক্তির মুখোমুখি হওয়াতে সেই জানাইয়ায়ে দিল, যে সে সিন্সে না, “এমনেতায়” (আর্টসে) পরে।

আরও কিছুদিন পরে বালক কোন রকমে স্কুল পাশ করিয়া কলেজে ভর্তি হওয়াতে, বালকের ভাব বাড়িয়া গেল! একদা বালক সেই শান বাঁধানো ঘাঁটের পাশ দিয়া হাঁটিয়া নিজ বাড়ির দিকে যাইতেছিল। তবে এইবার বালক হাঁটিয়া যাইবার সময় গানের পরিবর্তে বালকের খুবই প্রিয় “মাদার ইন ম্যানভিল” ছোট গল্পের ইডিয়মস এন্ড ফ্রেজ মুখস্ত করিতে করিতে! বালককে দেখিয়া, তাহার কাছে কলেজের বই-খাতা আর গানের বদলে অচেনা শব্দের উচ্চারণ শুনিয়া, ভীষণ অবাক হইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিল,

“তুই হর কি?” (পড়ুন তুই কি করিস?)

বালক বলিল, কলেজে ভর্তি হইয়াছি, আর ইংরেজি গল্প মুখস্ত করিতেছি...!!

বালকের এই কথা শুনিয়া তিনি বলিলেন, “তুই গ্যাছ আউগাইয়া!” (পড়ুন, তুই এগিয়ে গেছিস!)

আগে যাহাই ঘটুক আর যাহাই বলিয়া থাকুক, তাহার এই কথা বালকের কাছে খুবই ভালো লাগিল আর এই কথাও বালক তাহার বাড়িতে যাইয়া মুখে মুখে প্রচার করিতে লাগিল। অবশ্যই কিছু রঙ্গ-রস আর কৌতুক মিশাইয়া। অতপর তাহার সেই দুই অতি সাধারন বাক্য পুরো এলাকা জুড়িয়া খ্যাতি পাইয়া গেল।

কাউকে পড়ার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করিতে হইলে সবাই কৌতুক করিয়া জিজ্ঞাসা করিত,

“তুই পর কিসে? সিন্সে না এমনেতায়!!”

আর কেউ কোন কিছুতে কিছুটা ভালো করিলেই একমাত্র প্রশংসা সূচক বাক্য বর্ষিত হইতো,

“তুই গ্যাছো আউগাইয়া!”

সে তাহা, স্কুল-কলেজ পাশ হউক, ভালো কোন কাজ হউক বা বিবাহ হউক না কেন।

এই গল্পটা এইখানেই শেষ হইয়া যাইতে পারিত বা তাহাই যথার্থ হইতো। কিন্তু তাহা হইলোনা। হইতে দিলোনা সেই ধনাঢ্য ব্যাক্তির সিন্সে (সাইন্সে) পড়া সেই শিক্ষিত পুত্র! যদিও ইহা ঘটিয়া ছিল বেশ কিছুকাল পরে। তথাপি তাহার দুই যুগ পরে করা নতুন প্রশ্ন তাহার পিতার কথা মনে করাইয়া দিতে বাধ্য করিল। কথিত আছে আর আছে বাস্তবেও, বাঁশের গোঁড়া দিয়া বাঁশই হয়, আম-জাম বা কলা নহে। যেমন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছেলে বাবার ন্যায়ই হইয়া থাকে। এক্ষেত্রেও তেমনই ঘটিয়াছিল! সেই গল্পটুকু বলিয়া আজকের এই গল্প শেষ করিব।

সেই অল্পখানি আগাইয়া যাওয়া বালক, কলেজের চৌকাঠ পার হইয়া, অনেক চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইয়া ছিল। এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটি মাঝারি মানের ডিগ্রি লইয়া ঢাকা শহরে আসিয়া একখানা চাকুরী লইয়া বেশ হেলিয়া-দুলিয়া দিন কাটাইতে লাগিল।
কিছু অভিজ্ঞতা লইয়া বালক নতুন আর বেশী মাহিনায় আর একখানা চাকুরী লইয়া আনন্দে প্রায় উড়িতে লাগিল। যে অফিস হইতে বালক জীবনে প্রথমবারের মত নিজের নামে একখানা নীল-সাদা রঙের রোমাঞ্চকর ভিজিটিং কার্ডের মুখ দেখিয়া আত্নহারা হইয়া গিয়াছিল। আর সেই ভিজিটিং কার্ডের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া সুখে ঢেঁকুর তুলিতে লাগিল! যে ভিজিটিং কার্ডই একদা বালককে এক অনন্ত আনন্দের গল্প উপহার দিয়াছিল!

সেদিন বালক অফিসের কোন একটা কাজ করিয়া ফের অফিসে ফিরিতেছিল। বালক বাসে সিট না পাইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। বালকের পাশে কিছুটা পরিচিত মুখের একজন সিটে বসিয়া ছিল। বালক অনেকক্ষণ তাহার দিকে তাকাইয়া থাকিয়া চিনিতে পারিল। আরে ইনি তো গ্রামের সেই ধনাঢ্য ব্যক্তির সাইন্সে পড়া পুত্র! বালক তাহাকে চিনিতে পারিয়া মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করিতে লাগিল এবং এক সময় তিনিও বালককে দেখিয়া চিনিতে পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,

“আছো ভালো?”

“জি ভালো, আপনি ভালো?”

“আছি ভালো”

“কি করেন?” বালক জিজ্ঞাসা করিল।

কিন্তু তিনি কোন উত্তর না দিয়া, পিছনের পকেট হইতে মানিব্যাগ বাহির করিয়া, তাহার ভিতর হইতে একখানা চকচকে ভিজিটিং কার্ড বালকের মুখের সামনে ধরিলেন। মুখে বলার কোন প্রয়োজন বোধ করিলেন না। কারন ভিজিটিং কার্ড দেখিয়াই বুঝিয়া লইতে হইবে, তিনি কে, কি করেন আর কোথায় তাহার অবস্থান!

বালক ভিজিটিং কার্ড হাতে লইয়া দেখিলো কি দেখিলোনা এরই মধ্যে তিনি বালককে জিজ্ঞাসা করিলেন,

“তা তুই এহন হরটর কি?” (তুই আজকাল কি করিস?)

ব্যাপারখানা এমন...

সেই এলাকার অতি সাধারন আর অশিক্ষিত বালক-বালিকারা এই ঢাকা শহরে আসিয়া যাহা করিয়া থাকে, তাহার মধ্যে অন্যতম হইলো, কোন লঞ্চ বা ট্রলারের কেরানী, রান্নার বাবুর্চি, কাঠ বা রাজ মিস্ত্রীর সহযোগী, রঙের কাজের সহযোগী, বালু তোলা, ড্রেজারের কাজ, অন্যের বাসায় বাজার করার কাজ আর গার্মেন্টস এর হেল্পার। যা তাহার মত ভিজিটিং কার্ডধারীর কাছে কোন প্রকার কাজই নহে, উহা তাহাদের মতে “যোগালি” বা সকল কাজে সাহাজ্য করিবার জন্য কোন হেল্পার শ্রেণী।

অতপর বালকও মুখে কিছু না বলিয়া, তাহার পকেটে হাত দিয়া যথারীতি তাহার মানিব্যাগ বাহির করিল, চকচকে সাদা ল্যামিনেটিং যুক্ত কাগজের উপরে ঝকঝকে নীল অক্ষরে ছাপানো তাহার নাম আর পদবী লেখা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ভিজিটিং প্রদান করিল!

সেই সাইন্সে পড়া তিনি বালকের হাত হইতে ভিজিটিং কার্ডখানা লইয়া, একবার তাকাইয়া দেখিয়া, কোন কথা না বলিয়া, প্রায় চলন্ত বাস হইতে নামিয়া চলিয়া গেল, তাহার সিট খানা ছাড়িয়া দিয়া...!

বালক তাহার কিছু বুঝিয়া উঠিতে না পারিয়া, তাহার রাখিয়া যাওয়া ফাঁকা সিটে বসিল আর মনে মনে বলিল...

“তুই গ্যাছ আউগাইয়া...!!!”

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.