নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শুধু দেশের জন্য

জীবন অতি সংক্ষিপ্ত

গ. ম. ছাকলাইন

আমি একজন সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ

গ. ম. ছাকলাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশের আলোচিত কার্যকর ও অকার্যকর মৃত্যুদণ্ড

১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:০৮

পশ্চিম ইওরোপের প্রায় সব দেশে, টার্কিসহ বিশ্বের বারোটি মুসলিম দেশে এবং বিশ্বের আরো বহু দেশে ক্রমেই যখন মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে তখন বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে।



এ বিষয়ে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ রিপোর্ট জানিয়েছে, বাংলাদেশে সামপ্রতিক বছরগুলোতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা ছিল:

২০০৭ (৬)

২০০৮ (৫)

২০০৯ (৩)

২০১০ (৯)

২০১১ (৫)

২০১২ (১)

২০১৩ (২)

২০১৪ (০)



(১৮ জুলাই ২০১৪ পর্যন্ত)



এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট মোতাবেক ৩১ জুলাই ২০১৪-এ বাংলাদেশে ডেথ সেলে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল অন্তত ১,১৭২।

একই রিপোর্ট বলেছে, ২০১৩-তে বাংলাদেশে অন্তত ২২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।



সর্বশেষ একটি খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৪ আগস্ট ২০১৪-তে দুটি পৃথক মামলায় দুটি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে এবং ১৫ আগস্ট ২০১৪-তে একটি মামলায় দুটি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কিশোরগঞ্জে স্বপ্না বেগমকে (২০) খুনের দায়ে তার প্রেমিক জামাল উদ্দিনকে (৩০), বাগেরহাটে মংলায় হোটেলবয়কে হত্যার দায়ে এক পর্যটক সোলায়মান হোসেনকে (৩৫) এবং কুমিল্লায় দেবীদ্বারে ক্লাস থৃ-র ছাত্রী ফারজানা আক্তারকে (১০) ধর্ষণ ও খুনের দায়ে আবদুর রশিদ ও বশির আহমেদকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।

বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতে পারে নিচের অপরাধগুলোর জন্য :

» হত্যা

» রাষ্ট্র বিরোধিতা (Sedition, সিডিশন)

» ড্রাগস বা নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য চোরাচালান

» রাষ্ট্রদ্রোহিতা (Treason, টৃজন)

» গুপ্তচরবৃত্তি

» সামরিক অপরাধ

» ধর্ষণ

» প্লেন হাইজ্যাক

» নাশকতামূলক কাজ (Sabotage, সাবোটাজ)

» সন্ত্রাসমূলক কাজ (Terrorism, টেররিজম)



১৯৭১-এর পর বাংলাদেশে বেসামরিক ও সামরিক আদালতে যেসব মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তার মধ্যে বেশিরভাগই হয়েছে রাজনৈতিক ও সামরিক নিয়ম ভঙ্গের কারণে। তবে কিছু মৃত্যুদণ্ড এখনো কার্যকর করা হয়নি বা আইনগত কারণে করা সম্ভব হয়নি।

এদের মধ্যে ঘটনার কাল অনুসারে বিভিন্ন আলোচিত মৃত্যুদণ্ডের একটি লিস্ট নিচে দেয়া হলো :



১. চিকন আলীর মৃত্যুদণ্ড



১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তার অভিযোগে স্বাধীনতার পর কুষ্টিয়ার চিকন আলীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল রাজাকার রূপে বর্ণিত প্রথম কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড।



৮ জুন ১৯৭২-এ কুষ্টিয়ার দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সদস্য রবীন্দ্র কুমার, দালাল আইনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে চিকন আলীর ফাসির আদেশ দিয়েছিলেন।



বিবিসির সংবাদদাতা মার্ক টালি এই সংবাদ প্রকাশ করলে চিকন আলীর মৃত্যুদণ্ড বহির্বিশ্বে আলোচিত হয়।



পরবর্তীকালে এই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলে উচ্চ আদালত চিকন আলীর শাস্তি কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। পরে দালাল আইন বাতিলের সুযোগে তিনি আট বছর জেল খেটে মুক্ত হন।



১৩ অক্টোবর ২০০৩-এ চিকন আলীর মৃত্যু হয়।



২. শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড



২৫ মার্চ ১৯৭১-এ সন্ধ্যার পরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে যান তার বিশ্বস্ত সহনেতা তাজউদ্দীন আহমদ যিনি শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেন স্বাধীনতার ঘোষণা টেপ রেকর্ড করতে। শেখ মুজিব তাতে রাজি হন না। মনঃক্ষুণ্ন হয়ে তাজউদ্দীন চলে যান। শেখ মুজিব একা বসে থাকেন তার বাড়িতে এবং সেই রাতে তাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। প্রায় সাড়ে নয় মাস পাকিস্তানে বন্দি থাকার পর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ ফিরে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে। এরপর ১৯৭৪-এ দেশে বিশাল দুর্ভিক্ষ (যার ফলে কারো কারো মতে মুক্তিযুদ্ধের চাইতে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল), একদলীয় শাসন ব্যবস্থা (বাকশাল গঠন), সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, স্বজন ও দলপ্রীতির কারণে একদা জনপ্রিয় নেতা হয়েছিলেন অজনপ্রিয়। পরিণতিতে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ ঘটেছিল সামরিক অভ্যুত্থান। স্ত্রী, তিন পুত্র ও দুই নববিবাহিত পুত্রবধূসহ ওই ঘটনায় তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ২০ জন নিহত হয়েছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার রোডের বাসভবনে।



এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০ ব্যক্তির বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আমলে ৮ নভেম্বর ১৯৯৮-এ। ঢাকা জেলা ও সেশন বিচারক মোহাম্মদ গোলাম রসুল অভিযুক্তদের মধ্যে ১৫ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেন। যদিও বাংলাদেশে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কোনো রেওয়াজ ছিল না।



এদের মধ্যে পাচ ব্যক্তি তাদের দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এই পাচ দণ্ডিতদের মধ্যে রিটায়ার্ড মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ফখরুদ্দীন-মইন ইউ আহমেদের সামরিক সরকারের সময়ে তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের আপিল শুনানি ৭ আগস্ট ২০০৭-এ আবার শুরু হয়।

১৯ নভেম্বর ২০০৯-এ শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুপৃম কোর্ট অ্যাপেলাট ডিভিশন তাদের রায় দেন। বিচারপতি মোহাম্মদ তফাজ্জ্বল ইসলামের (পরবর্তীকালে প্রধান বিচারপতি) নেতৃত্বে পাচ সদস্য বিশিষ্ট একটি স্পেশাল বেঞ্চ ২৯ দিনব্যাপী শুনানির পর যেদিন এই রায় প্রকাশ করেন সেদিন হাই কোর্ট প্রাঙ্গণে প্রায় ১২,০০০ অতিরিক্ত পুলিশ নিয়োগ করা হয়।



জানুয়ারি ২০১০-এ সুপৃম কোর্ট আপিল নাকচ হয়ে যায় এবং ২৮ জানুয়ারি ২০১০-এ নিম্নোক্ত পাচ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় :



» কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান

» কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান

» মেজর মোহাম্মদ বজলুল হুদা

» লেফটেনান্ট কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ

» লেফটেনান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ

এদের মধ্যে আমেরিকায় ধৃত এবং বাংলাদেশে আনীত মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ ফাসির মঞ্চে যাবার মুহূর্ত পর্যন্ত ক্রন্দনরত অবস্থায় নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন।



শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হবার পর মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বজিত্ নন্দী সশস্ত্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। পুলিশ, বিডিআর ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি একটি সংঘর্ষে লিপ্ত হন পাচ সহযোদ্ধাসহ বিশ্বজিত্ নন্দী। টানা আট ঘণ্টার এই সংঘর্ষে কিছু ব্যক্তি হতাহত হয়। পরে বিচারে বিশ্বজিত্ নন্দীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে এই দণ্ড কার্যকর করা হয়নি।



৩. অক্টোবর ১৯৭৭-র ব্যর্থ ক্যু মৃত্যুদণ্ড



২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭-এ জাপান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৪৭২ টোকিও-র হানেদা এয়ারপোর্ট থেকে মুম্বাই হয়ে প্যারিস অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।

মুম্বাই থেকে টেকঅফ করার পরে জাপান রেড আমির্র (সংক্ষেপে জেআরএ, JRA) পাচ সশস্ত্র সদস্য ডগলাস ডিসি-এইট প্লেনটি হাইজ্যাক করে পাইলটকে ঢাকায় ল্যান্ড করার নির্দেশ দেয়। ওই প্লেনে ওসামু মারুকান্ডর নেতৃত্বে পাচ হাইজ্যাকার ছাড়া ১৩৭ যাত্রী এবং ১৪ জন ক্রু ছিল।

এদের জিম্মি করে হাইজ্যাকাররা। ঢাকায় ল্যান্ড করার পর তারা জাপান সরকারের কাছে মুক্তিপণ রূপে ছয় মিলিয়ন ডলার এবং জাপানে নয়জন বন্দি রেড আমির্র সদস্যের মুক্তি দাবি করে। তখন ঢাকায় এয়ারপোর্ট ছিল তেজগাওয়ে - বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কাছে, উল্টো দিকে। প্লেনটি এয়ারপোর্ট টারমাকে পার্ক করা থাকে।



হাইজ্যাকারদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যস্থতায় যখন জাপান সরকারের সমঝোতা আলোচনা চলছিল ঠিক সেই সময়ে, বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের মধ্যে একটি বিদ্রোহ হয়।



১ অক্টোবর ১৯৭৭-এ জাপানের প্রধানমন্ত্রী টাকেও ফুকুদা ঘোষণা করেন হাইজ্যাকারদের দাবি মেনে নিয়েছে জাপানিজ সরকার, কারণ তিনি বলেন, ‘মানব জীবনের ওজন পৃথিবীর ওজনের চাইতে বেশি’ (Human life outweighs the earth)। জাপানে ছয়জন বন্দি রেড আর্মির সদস্যকে মুক্তি দেয়া হয়।



জাপান এয়ারলাইনসের আরেকটি প্লেনে টোকিও থেকে ওই ছয়জনকে এবং ছয় মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয় ঢাকায়। ২ অক্টোবর ১৯৭৭-এ বিনিময় হয়- হাইজ্যাকাররা মোট ১৫১ জনের মধ্যে ১১৮ জন যাত্রীকে ছেড়ে দেয়। ৩ অক্টোবর ১৯৭৭-এ বাকি ৩৩ জনকে নিয়ে হাইজ্যাকাররা ঢাকা ছেড়ে প্লেনটি নিয়ে কুয়েত সিটিতে যায়।



সেখান থেকে তারা যায় দামাস্কাস-এ এবং সেখানে আরো ১১ জিম্মি যাত্রীকে ছেড়ে দেয়।



এরপর প্লেনটি যায় এলজেরিয়াতে। সেখানে এলজেরিয়ান সরকার প্লেনটি আটক করে এবং বাদবাকি সকল যাত্রীকে মুক্ত করে। হাইজ্যাকাররা পালিয়ে যাবার সুযোগ পায়।



এর দশ বছর পরে ১৯৮৭-তে হাইজ্যাকার দলের নেতা জাল পাসপোর্টসহ জাপানে ধরা পড়ে। তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় এবং ২০১১-তে জেলে মৃত্যু হয়। পরবর্তীকালে আরো একজন হাইজ্যাকার জাপানে ধরা পড়ে এবং তারও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।



সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৭৭-এ ঢাকা এয়ারপোর্টে যখন জাপান এয়ারলাইনসের প্লেনটি পার্ক করা ছিল তখন বিদ্রোহী এয়ার ফোর্সের সদস্যদের মধ্যে গোলাগুলি হয়। এই ঘটনায় ছয়জন এয়ার ফোর্স অফিসার নিহত হন। কেন এই ক্যু-র প্রচেষ্টা হয়েছিল এবং কে বা কারা এর নেতৃত্বে ছিল সেটা আজও স্পষ্ট নয়। পরে সরকারিভাবে জানানো হয়, এই ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অপরাধে সামরিক আদালতে (কোর্ট মার্শালে) কিছু ব্যক্তির বিচার হয়। এই বিচারে মোট ১,১৮৩ ব্যক্তি (৫৬১ এয়ার ফোর্স সদস্য এবং ৬২২ আর্মি সদস্য) দণ্ডিত হন। কিন্তু এদের মধ্যে মোট কতজন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাদের সেই দণ্ড কখন কার্যকর করা হয়, সেই তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে পাওয়া যায় না।



৪. সালেহা হত্যাকাণ্ড



১৮ এপৃল ১৯৭৮-এ সালেহা খুন হন। তাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন তার স্বামী ডা. ইকবাল। আদালতে বলা হয় গৃহপরিচারিকার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের পরিণতিতে ডা. ইকবাল খুন করেন তার স্ত্রীকে। আদালতে আরো অভিযোগ করা হয় যে যৌতুক আদায়ের লক্ষ্যে ডা. ইকবাল নির্যাতন করতেন সালেহাকে।



বিচারে ডা. ইকবালের মৃত্যুদণ্ড হয় এবং ১৯৮৭-তে সেই দণ্ড কার্যকর করা হয়।



এই মৃত্যুদণ্ড তখন খুব আলোচিত হয়েছিল। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের কোনো ব্যক্তির ফাসি হওয়ার সম্ভবত এটা ছিল প্রথম ঘটনা।



৫. কর্নেল আবু তাহেরের মৃত্যুদণ্ড



১৪ নভেম্বর ১৯৩৮-এ তদানীন্তন বৃটিশ আসাম প্রদেশের বাদারপুরে আবু তাহেরের জন্ম হয়েছিল। তিনি ছেলেবেলায় চট্টগ্রামের প্রবর্তক স্কুল ও কুমিল্লার ইউসুফ স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৯-এ সিলেটের এমসি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হন।



আবু তাহের ১৯৬১-তে পাকিস্তান আর্মিতে যোগ দেন এবং ১৯৬২-তে কমিশন পান। ১৯৬৫-তে ইনডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি কাশ্মির ও শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধ করেন এবং মেরুন প্যারাশুট উইং সম্মাননা পান।

এরপর পাকিস্তান আর্মিতে তিনি কমান্ডো ট্রেইনিং পান ও পরে আর্মিতে ট্রেইনার অফিসার রূপে কাজ করেন।



মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ১১ নাম্বার সেক্টরে তাহের সম্মুখ সমরে আহত হন এবং এক পা হারান। তিনি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরে তাহের প্রথমে বাংলাদেশ আর্মির কর্নেল পদে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু পরে মতবিরোধের কারণে পদত্যাগ করেন।

৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এ খন্দকার মোশতাক আহমদের সরকারকে সরিয়ে দিয়ে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ক্ষমতাসীন হন এবং জিয়াউর রহমানকে বন্দি করেন। চার দিন পরে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এ আবু তাহেরের নেতৃত্বে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সিপাহিদের অভ্যুত্থান হয়। সিপাহিদের হাতে খালেদ মোশাররফ নিহত হন। এরপর সিপাহিরা জিয়াউর রহমানকে কারামুক্ত করে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হন।



খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে আবু তাহের পাল্টা-ক্যু করেছিলেন বাংলাদেশে শ্রেণীবিহীন আর্মি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা-র হাতে কিছু অফিসার ও সেনা সদস্য নিহত হন। সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে।



সেনাবাহিনীতে হত্যা ও দেশদ্রোহিতার দায়ে ২৪ নভেম্বর ১৯৭৫-এ তাহের গ্রেফতার হন।



২১ জুন ১৯৭৬-এ একটি সামরিক আদালতে তার বিচার শুরু হয়। বিচারে ১৭ জুলাইয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ২১ জুলাই ১৯৭৬-এ তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।



৬. জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড



৩০ মে ১৯৮১-তে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে থাকার সময়ে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হবার পরে সংবিধান অনুযায়ী উপ-রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার হন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। কিন্তু নেপথ্যে মূল ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হন তদানীন্তন সেনাপ্রধান পাকিস্তান প্রত্যাগত লেফটেনান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।



জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরদেহ ২ জুন ১৯৮১-তে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়। সেদিন সংসদ চত্বর প্রাঙ্গণে তার জানাজায় কয়েক লক্ষ শোকার্ত মানুষের সমাবেশ হয়।



১ জুন থেকে ৩ জুন ১৯৮১-তে জিয়া হত্যার অভিযোগে ১৮ সেনা অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়। ১০ জুলাই ১৯৮১-তে একটি কোর্ট মার্শালে (সামরিক আদালত) তাদের বিচার শুরু হয়। এই কোর্ট মার্শালের চেয়ার অফিসার ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত মেজর জেনারেল আবদুর রহমান।

১০ জুলাই ১৯৮১ থেকে ২৮ জুলাই ১৯৮১ পর্যন্ত ১৮ দিন গোপনে বিচার চলে চিটাগং সেন্ট্রাল জেলে। মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের রায়ে ১৩ অফিসারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং পাচ অফিসারকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যে ১২ অফিসারকে ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১-তে ফাসি দেয়া হয়। এক অফিসারকে দুই বছর পরে ফাসি দেয়া হয়। এরা ছিলেন :



» বৃগেডিয়ার জেনারেল মহসীন উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম

» কর্নেল নওয়াজিশ উদ্দীন

» কর্নেল এম আবদুর রশিদ

» লেফটেনান্ট কর্নেল এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান

» লেফটেনান্ট কর্নেল এম দেলওয়ার হোসেন

» লেফটেনান্ট কর্নেল শাহ মোহাম্মদ ফজলে হোসেন (আহত ও অসুস্থ থাকায় তার ফাসি হয় ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩-তে)

» মেজর এ জেড গিয়াসউদ্দীন আহমেদ

» মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঞা

» মেজর কাজী মোমিনুল হক

» মেজর এম মজিবুর রহমান

» ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুস সাত্তার

» ক্যাপ্টেন জামিল হক

» লেফটেনান্ট মোহাম্মদ রফিকুল হাসান (মৃত্যুকালে বয়স ছিল ২৩)

গোপনে, দ্রুতগতিতে এবং অভিযুক্তদের পক্ষ সমর্থনে ন্যায়সঙ্গত সুযোগ না দেয়ায় এই মৃত্যুদণ্ডগুলো সমালোচিত হয়েছিল। দণ্ড কার্যকর হবার পরে নেপথ্য থেকে সামনে চলে আসেন জেনারেল এরশাদ।



ডিসেম্বর ১৯৮১-তে নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি হন আবদুস সাত্তার। ২৪ মার্চ ১৯৮২-তে তাকে পদচ্যুত করে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। এই ক্যু-তে সহযোগী মেজর জেনারেল আবদুর রহমানকে ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দেন এরশাদ। সেখানে প্যারিসে ১৯৮৪-তে আবদুর রহমানের মৃত্যু হয়।



ঢাকায় বনানী কবরস্থানে বৃগেডিয়ার মহসীন উদ্দিন আহমেদের সমাধি ফলকটি বিখ্যাত হয়েছে সেখানে উত্কীর্ণ নিচের পঙক্তিগুলোর জন্য :

এ দেশের মাটি একদিন কথা বলবে।

ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয়।

আল্লাহ তোমাকে চিরশান্তি দিন।

ফিরোজা মহসীনা (স্ত্রী)

কবিতা, কুতু ও তানিম

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮১



৭. শারমিন হত্যাকাণ্ড



মুনির হোসেন ছিলেন বিত্তশালী ব্যবসায়ী। তার মা ছিলেন নামী ডাক্তার মেহেরুন্নিসা। মুনিরের স্ত্রী ছিলেন শারমিন রিমা। শারমিনের পিতা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিহত বিবিসির সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদ। মুনির দীর্ঘকাল জুড়ে অ্যাফেয়ার চালাচ্ছিলেন মধ্যবয়সী হোসনে আরা খুকুর সঙ্গে, যার স্বামী ছিলেন পঙ্গু।



৯ এপৃল ১৯৮৯-এ শারমিনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন মুনির। মুনির ও খুকু, উভয়ের বিচার শেষ হয় ২১ মে ১৯৯০-এ। দুজনই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। তারা আপিল করেন। দুই বছর পরে জুলাই ১৯৯২-এ আপিল আদালত খুকুকে মুক্তি দেন। মুনিরকে রক্ষার জন্য আরো আপিল ও প্রাণভিক্ষা করা হয়। কিন্তু সেসব নাকচ হয়ে যায়। জুলাই ১৯৯৩-এ মুনিরের ফাসি হয়। তবে মুনিরের সত্যিই যে ফাসি হয়েছে সেটা সেই সময়ে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে চায়নি। উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং প্রভাবশালী পরিবারের কোনো ব্যক্তির ফাসিতে মৃত্যু হওয়াটা ছিল তাদের কাছে অকল্পনীয়।



৮. শাজনীন হত্যাকাণ্ড



ঢাকায় গুলশান এলাকায় ২৩ এপৃল ১৯৯৮-এ ট্রান্সকম গ্রুপ, দৈনিক প্রথম আলো ও দি ডেইলি স্টার-এর কর্ণধার মি. লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে, স্কলাস্টিকা স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্রী শাজনীন তাসনিম রহমান (১৫) ধর্ষিতা ও খুন হয়। শাজনীন অন্ততপক্ষে ২০ বার ছুরিকাহত হয়েছিল। তার ঘাড়ে রোলেক্স ঘড়ি সাইজের একটা বড় ক্ষত ছিল। তিন ইঞ্চি গভীর এই ক্ষত সম্ভবত কোনো বাটালি দিয়ে করা হয়েছিল। শাজনীনের তালুতে ছুরিকাঘাত ছিল। সম্ভবত ধর্ষণ প্রতিহত করতে গিয়ে সেই তালুতে আঘাত পেয়েছিল।



এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্ল্যানার রূপে চিহ্নিত হন কনসট্রাকশন কনট্রাকটর সৈয়দ সাজ্জাদ মইনুদ্দিন হাসান ওরফে আজাদ, যিনি আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেত্রীর আত্মীয়রূপে কথিত। হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল সাজ্জাদ হাসানের দুই এসিস্ট্যান্ট শহীদ (বাড়ি গোপালগঞ্জের দুর্গাপুর গ্রামে) ও বাদল এবং কাঠমিস্ত্রি শনিরাম মন্ডল, কাজের মেয়ে দুই বোন, এজতেমা খাতুন মিনু ও পারভিন। মোট ছয়জনের মধ্যে বাড়ির কাজের লোক ছিল তিনজন : শহীদ, মিনু ও পারভিন।



শাজনীন হত্যার অভিযোগে এই ছয়জনের বিচার শুরু হয় ৯ জুলাই ২০০০-এ এবং শেষ হয় ২ সেপ্টেম্বর ২০০৩-এ। হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চ শাজনীনকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে পাচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। শনিরাম মন্ডল মুক্তি পান।



এই লেখার সময়ে দণ্ডিত পাচজন জেলবন্দি আছেন। এদের মধ্যে সন্তানসম্ভবা ছিলেন পারভিন এবং তিনি জেলেই সন্তান প্রসব করেন। সেই সন্তানও মায়ের সঙ্গে জেলে কিছুকাল ছিল। এখন তাকে একটি সরকারি শিশু আশ্রমে রাখা হয়েছে।



৯. খুলনায় খালেদ ও ১৭ হত্যাকাণ্ড



১১ আগস্ট ১৯৯৯-এ এরশাদ শিকদার গ্রেফতার হন। এর আগে তার বডিগার্ড নূর-এ-আলম ধরা পড়েছিলেন এবং পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছিলেন তার জানা মতে অন্তত ২৪ জনকে নৃশংসভাবে খুন করেছিলেন এরশাদ শিকদার। তবে এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে মামলায় ১৭টি খুনের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে খুলনার পাচ নাম্বার ঘাটে একটি বরফ ফ্যাক্টরিতে ১৬ মে ১৯৯৯-এ এরশাদ শিকদার নিজের হাতে যুবলীগ কর্মী খালেদকে খুন করে সিমেন্ট ভর্তি ব্যাগে তার লাশ নদীতে ফেলা দেয়াটা ছিল প্রধান অভিযোগ। বিচারে এরশাদ শিকদারের মৃত্যুদণ্ড হয়।



তিনি আপিল করেন। ৩ মার্চ ২০০৩-এ হাই কোর্টে সেটা নাকচ হয়ে যায়। এরপর ৪ এপৃল ২০০৪-এ তিনি প্রাণভিক্ষা করে লেখেন তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদকে। তিনি সেটা নাকচ করে দেন। হতাশ হয়ে এরশাদ শিকদার ২৫ এপৃল ২০০৪-এ জেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ১০ মে ২০০৪-এ খুলনা জেলে ফাসিতে এরশাদ শিকদারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।



১০. ঝালকাঠিতে ৭ মৃত্যুদণ্ড



১৪ নভেম্বর ২০০৫-এ ঝালকাঠি জেলার সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাঁড়ের গাড়িতে বোমা ছুড়ে তাদের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন জামা’আতুল মুজাহিদীন (সংক্ষেপে জেএমবি, ঔগই)-এর ৭ সদস্য। অভিযুক্তদের মধ্যে এই জঙ্গি সংগঠনের দুই নেতা, শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম (বাংলাভাই নামে সমধিক পরিচিত) ছিলেন।

বিএনপির শাসন আমলে ২ মার্চ ২০০৬-এ সিলেটে গ্রেফতার হন শায়খ রহমান। চার দিন পরে ৬ মার্চ ২০০৬-এ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছাতে র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) একটি সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে বাংলাভাইসহ জেএমবির কিছু সদস্যকে গ্রেফতার করে। জেএমবির বিরুদ্ধে র্যাবের এই সশস্ত্র অভিযানটি এখনকার মতো গোপনে হয়নি। তখন বিএনপির আমলে অভিযানটি প্রকাশ্যে হয়েছিল এবং তা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সরাসরি সমপ্রচারিত হয়েছিল।



২৯ মে ২০০৬-এ ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত হত্যা মামলার রায়ে ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন। ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে ৩১ আগস্ট ২০০৬-এ হাই কোর্ট সেটা বহাল রাখেন। ফখরুদ্দীন-মইন ইউ আহমেদের সামরিক শাসন আমলে ৫ মার্চ ২০০৭-এ তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি তাদের প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন।



৩০ মার্চ প্রথম প্রহরে ২০০৭-এর চারটি কারাগারে তাদের ফাসি কার্যকর করা হয়।



জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের ফাসি হয় কুমিল্লা কারাগারে।

জেএমবির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই ও শায়খ রহমানের জামাই আবদুল আউয়ালের ফাসি হয় ময়মনসিংহ কারাগারে।

জেএমবির সামরিক শাখার কমান্ডার আতাউর রহমান সানি ও ইফতেখার হাসান মামুনের ফাসি হয় গাজীপুরে কাশিমপুর কারাগারে।

খালেদ সাইফুল্লাহর ফাসি হয় পাবনা কারাগরে।



১১. দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় ১৪ মৃত্যুদণ্ড



১ এপৃল ২০০৪-এ গভীর রাতে কর্ণফুলি নদীর তীরে অবস্থিত চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সংক্ষেপে সিইউএফএল)-এর জেটিতে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ধরা পড়ে দশটি ট্রাক। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ছিল ক্ষমতাসীন এবং খালেদা জিয়া ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। শিল্পমন্ত্রী ছিলেন জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন লুত্ফুজ্জামান বাবর।



৬ জুলাই ২০০৫-এ বাদী আহাদুর রহমানের সাক্ষ্য দিয়ে এই চোরাচালানের বিচার শুরু হয়। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা নামে এটি পরিচিত হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ধীরগতিতে এগোতে থাকে।



১১ জানুয়ারি ২০০৭-এ অর্থাত্ ওয়ান-ইলেভেনে ইনডিয়ান আশীর্বাদপুষ্ট মইন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে আর্মি ক্যুর পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদের পুতুল সরকার ক্ষমতাসীন হয়। এর পরে ২০ নভেম্বর ২০০৭-এ এই মামলার গতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাষ্ট্রপক্ষ আরো তদন্তের আবেদন করে। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে আরো বেশি ইনডিয়ান আশীর্বাদপুষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলে মামলাটি দ্রুত বেগে চলতে থাকে।



২৯ জানুয়ারি ২০০৯-এ এএসপি মনিরুজ্জামান নতুন তদন্ত শুরু করেন। ১০ অক্টোবর ২০১৩ পর্যন্ত এই মামলা চলে। ৩০ জানুয়ারি ২০১৪-তে চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান ঘোষিত মামলার রায়ে ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এরা হলেন :

» মতিউর রহমান নিজামী সাবেক শিল্পমন্ত্রী। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের অন্যতম চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং সেই সুবাদে এই মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে আসামি করা হয়। এর আগে তিনি ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে।



» লুত্ফুজ্জামান বাবর, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

» রেজ্জাকুল হায়দার, রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল ও সাবেক মহাপরিচালক, এনএসআই (সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ)।

» আবদুর রহিম, রিটায়ার্ড বৃগেডিয়ার জেনারেল ও সাবেক পরিচালক, এনএসআই।

» শাহাবুদ্দিন, উইং কমান্ডার ও এনএসআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা।

» লিয়াকত হোসেন, রিটায়ার্ড মেজর ও সাবেক উপপরিচালক।

» আকবর হোসেন খান, এনএসআইয়ের ফিল্ড অফিসার।

» মহসিন উদ্দিন তালুকদার, ফার্টিলাইজার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

» কে এম এনামুল হক, ফার্টিলাইজার কারখানার মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন)।

» হাফিজুর রহমান।

» দীন মোহাম্মদ।

» পরেশ বড়ুয়া, ইনডিয়ার পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার নেতা এবং পলাতক।



১২. পিলখানা হত্যা মামলায় ১৫২ মৃত্যুদণ্ড

২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী এবং ক্ষমতাসীন হবার মাত্র দুই মাসের মধ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ ঢাকায় পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস (সংক্ষেপে বিডিআর)-এর হেড কোয়ার্টার্সে এক বিদ্রোহের ফলে বাংলাদেশ আর্মির ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ অন্তত ৭৪ জন নিহত হন।



পরবর্তীকালে একটি মামলায় বিডিআরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৮৫০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের বেশির ভাগই বিডিআরের সদস্য ছিলেন। অভিযুক্তদের মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কিছু নেতাও ছিলেন।



৫ নভেম্বর ২০১৩-তে বিচারক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান এই মামলার রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

ইতিমধ্যে বিদ্রোহ ঘটনার পর বিডিআর লুপ্ত করে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর নতুন নাম রাখা হয় বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (সংক্ষেপে বিজিবি)।



এই মামলায় গণবিচার ও গণভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিষয়টি সমালোচিত হয়।



১৩. দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড



২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী এবং ক্ষমতাসীন হবার ১৮ মাস পরে ২৯ জুন ২০১০-এ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এর পরের বছর ১৪ জুলাই ২০১১-তে তার বিরুদ্ধে একাত্তরে যুদ্ধ চলাকালে হত্যা, লুণ্ঠন ও নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগ আমলে নেয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল (সংক্ষেপে আইসিটি)। রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী বিবিসিকে বলেন, মি. দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যায় সহযোগিতা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করা ইত্যাদি মোট ২০টি অভিযোগে বিচারের শুনানি হয়।

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩-তে আইসিটি-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ঘোষিত রায়ে বলা হয়, প্রমাণিত অভিযোগের মধ্যে দুটি হত্যার অভিযোগে (পিরোজপুরে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসা বালি-কে) আদালত মি. সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ফাসির রায়ের পর দেশব্যাপী সহিংসতায় বহু মানুষ প্রাণ হারায়। সেদিন দেশ জুড়ে সাঈদী সমর্থকদের মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৭০ থেকে ১৭০-এর মধ্যে। জামায়াত দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে। এই মামলার সরকার পক্ষের একজন সাক্ষী ছিলেন সুখরঞ্জন বালি। ধারণা করা হয়, তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ৩ নভেম্বর ২০১২-তে তাকে কোর্টের সামনে থেকে অপহরণ করা হয় এবং এখনো তিনি নিখোজ আছেন।

এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষ উভয়েই আপিল করে। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ তাদের রায় দেন। এই বেঞ্চে অপর চার বিচারপতি ছিলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। প্রধান বিচারপতির রায়ে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড বদলে তার আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত দুই দিন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে।



১৪. আবুল কালাম আজাদের মৃত্যুদণ্ড



২১ জানুয়ারি ২০১৩-তে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল (সংক্ষেপে আইসিটি) তাদের প্রথম রায়ে যুদ্ধাপরাধে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা আবুল কালাম আজাদ (বাচ্চু রাজাকার নামেও পরিচিত)-কে তার অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড দেন। আবুল কালাম আজাদ এখনো পলাতক।



১৫. আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড



১৩ জুলাই ২০১০-এ জামায়াতে ইসলামী নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়। ২১ জুলাই ২০১০ থেকে তদন্ত শুরু হয়। ২৮ মে ২০১২-তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ৩ জুলাই ২০১২ থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল-২ (সংক্ষেপে আইসিটি) ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪-তে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

এই রায়ের বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে সমবেত অনেক মানুষ প্রতিবাদ জানায়। সূচিত হয় তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ। এই গণজাগরণ মঞ্চের দাবিতে আওয়ামী লীগ সরকার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইন সংশোধন করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩-তে পার্লামেন্টে এই সংশোধনী বিল পাস হয়। সংশোধনের ফলে আসামি পক্ষের মতো রাষ্ট্রপক্ষও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সমান সুযোগ পায়। এর আগে আইনে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার সুযোগ ছিল না।

আইন সংশোধনের পর ৩ মার্চ ২০১৩-তে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। পরদিন ৪ মার্চ ২০১৩-তে শাস্তি থেকে অব্যাহতি চেয়ে আপিল করেন কাদের মোল্লা। ১ এপৃল ২০১৩ থেকে আপিলের শুনানি শুরু হয়।



শুনানি শেষে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩-তে প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাচ সদস্যের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।



১২ ডিসেম্বর ২০১৩-তে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

গণদাবিতে আইন বদলিয়ে, সেই আইনের রেট্রসপেটিভ এফেক্ট দিয়ে, মৃত্যুদণ্ড দেয়া এবং সেটা কার্যকর করা-র (অর্থাত্, ব্যাক ডেট দিয়ে ফাসি দেয়া) এই অভূতপূর্ব অনৈতিক ঘটনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে তখন প্রতিবাদের সাহস দেখা যায়নি। কিন্তু বিদেশে এই বিষয়টি তীব্রভাবে নিন্দিত ও সমালোচিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ৩০ মে ২০১৪-তে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলতে বাধ্য হন, ‘আজ জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা হবে, কাল আইন পরিবর্তন করা হবে, আমি এর পক্ষে নই। আমাকে সারা পৃথিবীতে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে কাদের মোল্লার ব্যাপারে। কোনো বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুলুক আমি তা চাই না।’



এটি ছিল আইনমন্ত্রীর সত্ বক্তব্য। তবে বহু বিলম্বিত।

আইনের শাসনের প্রতি যারা শ্রদ্ধাশীল তারা বলেন, আইনমন্ত্রীর এই অবস্থানটি ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩-র আগে জানানো উচিত ছিল।




মৃত্যুদণ্ড দেশে বিদেশে যুগে যুগে - ১৯ ইওরোপিয়ান ডিপ্লম্যাট, ক্ষমাপ্রাপ্ত খুনি ও উপকৃত পাখিরা



মূল লেখক: শফিক রেহমান



তথ্যসূত্র: Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.