নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মুক্ত মানুষ , মুক্ত সমাজ, মুক্ত পৃথিবী; মুক্তিই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ।

সালমান মাহফুজ

সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা সেই কৈশোর থেকেই । মাঝে মাঝে লিখতেও চেষ্টা করি । যেই সাহিত্য আমাকে ধরেছে, সেই সিলেবাস আমাকে দূরে সরিয়ে দিছে । সুতরাং একাডেমিক কন্ডিশন চরম বাজে । প্রচণ্ড অলস এবং অসামাজিক । নিজের কাজের প্রতি চরম বিশ্বাসহীনতা । মাঝে মাঝে সবকিছুকেই অনর্থক ফাও ফাও মনে হয় । এমনকি বেঁচে থাকাটাও । তবুও বেঁচে আছি । কেন ? জানি না । শুধু জানি, কিছু একটা করতে হবে । কী সেটা ? তাও জানি না । মানবজন্মটাকে এভাবে বৃথা চলতে দেয়া যায় না, এই ভেবেই বোধোহয় আরেকটু বাঁচবার লোভ হয় ।

সালমান মাহফুজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোপনে চুপচাপ বাঁচতে চাই (গল্প)

১১ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ২:৪৬


(১)
ধেৎ ! আর ভাল্লাগছে না । ঘন্টাখানেকও তো হল না কম্পিউটার-স্ক্রিনের সামনে বসেছি । তবুও কেন জানি ভিতরে অস্বস্তি শুরু হয়ে গেছে । ইদানিং কেন জানি কাজে মনই বসতে চাচ্ছে না । অথচ ওই যে ছেলেটা— এদিক ওদিক একদম দৃষ্টি নেই; কাজে ডুবে আছে । খুব মনোযোগী । মাত্র সপ্তাহখানেক হল জয়েন করেছে । এরই মধ্যে বসের একটা বিশেষ সন্তুষ্টির জায়গা দখল করে নিয়েছে । আর আমি ? ছয় মাস আছি এখানে । সন্তুষ্টি তো দূরের কথা— এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার রেড ওয়ার্নিং পড়েছে । মুটকো শালার মুখে খালি একই বাক্য— ‘সিরায়াস্‌ হোন মাসুদ সাহেব, আরো সিরিয়াস হোন— আরো এক্টিভ হোন ।’ কী যে জিদ চাপে তখন ! মন চায়, চাকরির কপালে লাত্থি মারি ।
অসহ্য লাগছে বসে থাকতে ! ক্যান্টিন থেকে ঘুরে আসা যাক । সিগারেটের নেশাটাও ঠোঁটের আঙিনায় এসে ভীষণ সুড়সুড়ি দিচ্ছে । ঘুরে আসা যাক । একা ? একা যেতে ভাল্লাগছে না । ছেলেটাকে ইনভাইট করলে কেমন হয় ? না, না— ডিস্টার্ব ফিল করতে পারে । আলাপ-টালাপও তেমন হয় নি এখনো । কেমনে হবে ? যখনই তাকাই, ব্যাটা মনে হয় চৈতন্যদেবের মত গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছে । নাহ, যথেষ্ট ইয়াং ছেলে— এখুনি যদি এমন কাজ কাজ করে মরে, ব্যাটা লাইফের আসল মজাটার সন্ধান পাবে কখন । লাইফে সাইন করতে হলে ক্যারিয়ারের প্রতি সুদৃষ্টি থাকা দরকার । তাই বলে ওটাই সব নয় । জীবিকার তাগিদে গোটা জীবনটাকে বিসর্জন দেওয়ার কোন মানে হয় ! জীবনটাকে এত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ জায়গা থেকে দেখার দলে আমি অন্তত নই । এই ছেলেটার মগজের ভিতরে নিশ্চয়ই কোন কূপমন্ডূক ওই ধারণাই ঢুকিয়ে দিয়েছে— উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরকে ছোঁয়া চাই । আর তার জন্য চাই, কাজ— শুধু কাজ । পরিশ্রম ও উদ্যম— দুটোর সমন্বয়ে কাজ । ওসব বন্ধু-গল্প-আড্ডা-মজা-মাস্তি আজে বাজে দিকে একদম মন দেওয়া যাবে না ।
ছেলেটাকে ওইসব ব্যর্থ চিন্তা-চেতনার বন্দিশালা থেকে মুক্ত করে আনা চাই । সমস্ত রকমের সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে জীবনের মুক্ত আঙিনায় এসে দাঁড়াক । দেখুক, বুঝুক, শিখুক— এই ক্ষুদ্র জীবনের প্রকৃত সার্থকতাটা কোথায় ?
(২)
আমি ছেলেটার দিকে পা বাড়ালাম । ওর ডেস্কের কাছাকাছি আসতেই মাথা তুলল । একটু হাসল । নিঃশব্দ হাসি ।
‘কেমন আছেন মাসুদ ভাই ?’ ছেলেটার মুখে এখনো হাসি লেগে আছে । হাতদুটো ওর ঠিক-ই কম্পিউটারের কী-বোর্ডে ।
‘ভালো নেই মিস্টার ! আমাকে দিয়ে সত্যিই মনে হয় এসব চাকরি-বাকরি হবে না । বড্ড অস্বস্তিতে ভুগছি । এই চার দেয়ালের অফিসঘর, চেয়ার-টেবিল, কম্পিউটার— কী যে অসহ্য লাগছে ইদানিং জানো !’
‘কেন ভাই ? পারিবারিক কোন জটিলতা ? বিয়ে-টিয়ে তো এখনো করেন নি ।’ ছেলেটার মুখে বেশ কৌতূহল । কী-বোর্ড থেকে হাতটা সরিয়ে নিল ।
‘আরে নাহ্‌— ওসব ফ্যামিলি-কেন্দ্রিক ফাউল চিন্তা আমি করি না । মনটা বড় বাউণ্ডেলে বুঝলা । সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে । আড্ডার নেশাটাও আমার প্রবল, সেই কলেজ লাইফ থেকে । ভার্সিটি লাইফে এসে তো শুধু পলিটিক্সের পিছনেই দৌঁড়ালাম । কত ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশেছি, কত জীবনের উত্থান দেখেছি, পতনও দেখেছি অনেক । তবুও সর্বক্ষণ ভিতরটায় এক চরম অতৃপ্তি— যেন আরো অনেক কিছু দেখা এখনো বাকি । শুধু ছটফটাচ্ছে, ভিতরে একটা বাউণ্ডেলে মন সর্বক্ষণ ছটফটাচ্ছে ।’
দেখলাম বিশেষ আগ্রহ নিয়েই আমার কথাগুলো ও শুনছে । এই মুহূর্তে ক্যান্টিন থেকে ঘুরে আসার নিমন্ত্রণটা নিশ্চয়ই করা যায় ।
‘ আমি কিন্তু একদমই আপনার বিপরীত । আপনার মত আমার পৃথিবীটা অত বিস্তৃত নয় । বড় ক্ষুদ্র পৃথিবীতে আমার বসবাস । ছোট বোন মিলি , মা আর বাবা— এটাই আমার পৃথিবী । এর বাইরে যা কিছু আছে— ওসব নিয়ে আমার একদম মাথা-ব্যথা নেই ।’ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কথাগুলো বলল ছেলেটা । আমি কোন রিপ্লাই না দিয়ে চুপ হয়ে আছি । আমি ওর সম্পর্কে পূর্বে যা অনুমান করেছি তার মধ্যে কিঞ্চিত ভুলের চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছি । ও কাজ-পাগল হলেও পুরোপুরি কাজ-পাগল নয় । কাজের ফাকে টুকটাক গল্পগুজবের প্রত্যাশা থেকেই তো নিঃসঙ্কোচে আমার সাথে বেরিয়ে এসেছে । তবে বুঝাই যাচ্ছে, ফ্যামিলির প্রতি ছেলেটার বিশেষ একটা কর্তব্যবোধ আছে । এই ধরনের ছেলেকে আমাদের সমাজে কমবেশি সবাই পছন্দ করে । যদিও এরা সমাজ নিয়ে কখনো খুব মাথা ঘামায় না । আমৃত্যু এরা ‘পরিবার’ নামক বৃত্তের মধ্যেই পড়ে থাকে ।
(৩)
ক্যান্টিনে পৌঁছতেই নিঃশব্দতা ভেঙে বললাম, ‘ সিগারেট খাও ?’
‘তেমন না । টুকটাক ।’
‘এখন চলবে ?’
‘হুম । নিতে পারেন ।’
সিগারেট ধরালাম । দুজনেই । ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছেলেটা বলল, ‘জানেন মাসুদ ভাই , এই চাকরিটা না পেলে আমি হয়ত আত্মহত্যা করতাম ।’
‘কেন ?’
‘খুব দুঃসময় পার করছিলাম । সদ্য মাস্টার্স শেষ করে বেকার । চাকরির সন্ধানে ঘুরছি দুয়ারে দুয়ারে । কিছুতেই কিছু হচ্ছে না । বাবা রিটায়ার করেছেন বছরখানেক হল । ছোটখাট চাকরি করতেন । অবসর ভাতা যা পেয়েছেন সবটাই চলে গেছে মায়ের চিকিৎসায় !
‘কী অসুখ হয়েছিল মায়ের ?’
‘মা দুবার হার্ট এটাক করেছেন । বোনটিরও ইউনাভার্সিটি ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে আসছিল । যাক, অবশেষে খোদার মেহেরবানি— চাকরিটা মিলল ।’
সিগারেটে টান মেরে একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ও ।
হ্যাঁ , এতক্ষণে কিছুটা বুঝা গেল কাজ নিয়ে ওর সিরিয়াসনেসের রহস্য । না, এটা অন্যায় নয়— কর্তব্যবোধ থেকে কেউ যদি নিজেকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে । হোক সেটা আপন কারো জন্য কিংবা পরের জন্য ।
আমার ধারণা তো কেবল পাল্টেই যাচ্ছে । ওকে শিখাতে এসে আমি নিজেই ওর কাছ থেকে শিখছি ।
হঠাৎ ক্যান্টিনের চৌদ্দ ইঞ্চি কালার টিভিটার দিকে আমার দৃষ্টি পড়ল । ব্রেকিং নিউজ : নির্দলীয় নিরেপক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলের টানা ৭২ ঘন্টা হরতাল ঘোষণা ।
‘এইসব হরতাল-ফরতাল দিয়ে এই সরকারের টনক নড়ানো যাবে না । খামোকাই দেশের গরীব-নিরীহ মানুষগুলার ভোগান্তি ।’ কথাগুলো বলে আমি ছেলেটার দিকে দৃষ্টি ফেরালাম । প্রতিক্রিয়া জানানো তো দূরের কথা— আমার কথা সে শুনেছে কিনা সন্দেহ । সে অন্যমনস্ক ।
‘মিস্টার, ৭২ ঘন্টা হরতাল ! দেশের রাজনীতির কী হালচাল বুঝো ।’ আমি ওর মনোযোগ এদিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলাম ।
ছেলেটা একটু হাসল । তারপর বলল, ‘রাজনীতি ব্যাপারটা যে কী— আমি একদম বুঝি না । বুঝার চেষ্টাও করে নি কখনো । এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার ইন্টারেস্ট জিরো ।’
‘কিন্তু আমি তুমি— কেউই তো রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নই । প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এটা তো আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করেই চলেছে । দেখুন, ৭২ ঘণ্টা হরতাল ! এটা কি তোমার জীবনে কোনো প্রভাবই ফেলবে না মনে কর ? প্রতিদিন তুমি যেমন স্বাভাবিক গতিতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরো, আজ কি সেই গতিটা একটু হলেও কি অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে না ? এতটা রাজনীতি-বিমুখ...’
আমি কথাটা শেষ না করতেই ও বলল, ‘দেখুন মাসুদ ভাই । আমি হয়ত আপনার মত অতটা বুঝি না । আসলে, রাজনীতি ব্যাপারটাই আমার কাছে কেন জানি হই-হট্টগোল, কাঁদা-ছুঁড়াছুঁড়ি, খুন-খারাবি— ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না । গোপনে চুপচাপ বাঁচতে চাই ।’
আমি চুপ হয়ে গেলাম । যার যেটার প্রতি আগ্রহ নেই, সেটা নিয়ে আলোচনা বৃথা । আগ্রহ জাগা তো দূরের কথা, বরং বিরক্তির উদ্রেক ঘটে । বিলটা মিটিয়ে দিয়ে আমরা উপরে উঠে যে যার কাজে মন দিলাম।

(৪)
রাত ৮টার আগেই অফিস থেকে ফিরলাম । বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসেই টিভির সুইচটা অন করলাম । ব্রেকিং নিউজ : মতিঝিলে লোকাল বাসে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ ২১; নিহত ৯ ।
খুব একটা চমকে উঠলাম না । এ আর নতুন কী ! বরং হরতাল-অবরোধে এরকম ঘটনা এখন খুব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছি । বরং এমনটা না ঘটলেই সবাই বিস্মিত হয় ।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল । স্ক্রিনে দৃষ্টি নত করতেই নামটা দেখতে পেলাম— সুমন । আমার আরেক কলিগ । হঠাৎ এই সময়ে !
সুমন এইমাত্র আমাকে যে নিউজটা দিল— শুনতেই গা শিউরে উঠল ! সত্যিই ছেলেটা নেই ! ওই যে সেই ছেলেটা— রাজনীতি নিয়ে যার ইন্টারেস্ট জিরো; গোপনে চুপচাপ বাঁচতে চেয়েছিল যে । আর বাঁচল কই ! রাজনীতির পেট্রোল বোমা তাকেও ঝলসে দিল !
মৃত দগ্ধ ছেলেটাকে সেই রাতে তার বাসায় দেখতে গিয়ে তার মুখের পাশে আরো কয়েকটা ঝলসানো মুখ দেখলাম; অশ্রুর আগুনে ঝলসানো সেইসব প্রিয় মুখ !

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৩:১৪

হাসান মাহবুব বলেছেন: গোপনে চুপচাপ বেঁচে থাকতে চেয়েছিলো, কত্ত বড় স্পর্ধা! এখন প্রকাশ্যে পুড়ে কয়লাখন্ড হিসেবে মরুক! আর আমরা প্রহর গুনবো কখন আমাদের সিরিয়াল আসে!

১১ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৩:১৭

সালমান মাহফুজ বলেছেন: মূল্যবান মতামতের জন্য ধন্যবাদ হাসান ভাই ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.