নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মুক্ত মানুষ , মুক্ত সমাজ, মুক্ত পৃথিবী; মুক্তিই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ।

সালমান মাহফুজ

সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা সেই কৈশোর থেকেই । মাঝে মাঝে লিখতেও চেষ্টা করি । যেই সাহিত্য আমাকে ধরেছে, সেই সিলেবাস আমাকে দূরে সরিয়ে দিছে । সুতরাং একাডেমিক কন্ডিশন চরম বাজে । প্রচণ্ড অলস এবং অসামাজিক । নিজের কাজের প্রতি চরম বিশ্বাসহীনতা । মাঝে মাঝে সবকিছুকেই অনর্থক ফাও ফাও মনে হয় । এমনকি বেঁচে থাকাটাও । তবুও বেঁচে আছি । কেন ? জানি না । শুধু জানি, কিছু একটা করতে হবে । কী সেটা ? তাও জানি না । মানবজন্মটাকে এভাবে বৃথা চলতে দেয়া যায় না, এই ভেবেই বোধোহয় আরেকটু বাঁচবার লোভ হয় ।

সালমান মাহফুজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প : প্রেম ও বিপ্লব

০৩ রা মে, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৩


ঘণ্টাপাঁচেক পরেই আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছি । সাজিদের সাথে আমার বিয়ে । কম নয়, সাড়ে চার বছরের প্রেম সাজিদের সাথে । এত্ত লং লাস্টিং প্রেম এই যুগে খুবি দুর্লভ ব্যাপার । আমার সামনে অজস্র স্বপ্নপাখির ওড়াউড়ি । কিন্তু একে একে সব স্বপ্নপাখিকে দৃশ্যহীন করে দিয়ে বার বার স্মৃতিতে ভেসে উঠছে দুঃস্বপ্নের একটা বীভৎস ক্ষত !
স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আমাকে একদিন এভাবে আনন্দ-গাঁথার পাশে বসে বিসর্জন-গাঁথা রচনা করতে হবে কে জানত । না, আমি তো বিসর্জন দিতে চাই নি । আমি কাছে পেতে চেয়েছি । একান্ত নিজের করে কাছে পেতে চেয়েছি । কিন্তু আমার চাওয়া আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে ! প্রত্যাখ্যানের গ্লানিতে জর্জরিত অনেক দিনরাত্রি পেরিয়ে আজ ওকে আমি বিসর্জন দিলাম । রূপক, আর তোমাকে বেঁধে রাখব না এই মিথ্যে বাঁধনে । যাও, উড়ে যাও । যেখানে খুশি সেখানে ।
হ্যাঁ, ওর নাম রূপক । রূপকের সাথে আমার মাত্র ২৩ দিনের পরিচয় । পরিচয়ের শুরুটা হয়েছিল ফেসবুকের মাধ্যমে । আকস্মিক ঝড়ের মত রূপক এল, আবার চলেও গেল । সাজিদের সাথে সাড়ে চার বছরের সম্পর্কের চেয়ে রূপকের সাথে মাত্র ২৩ দিনের পরিচয়ের ভিতর দিয়ে আমি আরো অনেক বড় কিছু আবিষ্কার করেছিলাম । তা শুধু প্রেম নয়, তার চেয়েও মহৎ কিছু । সেই মহৎ কিছুকেই আজ আমি বিসর্জন দিতে যাচ্ছি ।
বাস্তব রূপককে আমি কখনো স্বচক্ষে দেখে নি । তবে ফেসবুকের ওয়ালে তার ফটো দেখেছি, সেই ফটো এখনো আমার মস্তিষ্কে নিখুঁতভাবে খোদাই করা আছে । সবুজ ঘাসের উপর রূপক চিৎ হয়ে শুয়ে আছে । গায়ে ফুলহাতা বাদামী শার্ট । মাথায় ঝাঁকড়া চুল, শ্যামবর্ণ মুখখানা জুড়ে খোচা খোচা দাঁড়ি । মুখে একটা অদ্ভুত হাসি । সেই হাসিতে দুঃখ-সুখ-ক্রোধ তিনটেই মিশে আছে ।
রূপক আমাকে কখনো ‘ভালোবাসি’ বলে নি । সে বলেছে বিপ্লবের কথা । সে আমাকে শুনিয়েছে রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লবের গল্প, চীনে মাও সে তুংয়ের লং মার্চের গল্প , বলিভিয়ার জঙ্গলে ১২জন সঙ্গী নিয়ে চে গুয়েভারার দুঃসাহসিক লড়াইয়ের গল্প । লেনিন, মাও সে তুং, চে— আমি কাউকে চিনতাম না । আমি চিনতাম রূপককে । তখন আমার কাছে সব গল্পের নায়কই ছিল রূপক ।
‘রূপক, তুমি এমন কেন ? তোমার হৃৎপিণ্ডে কি একটুও রক্ত-মাংস নেই ? ওটা কি পাথর দিয়ে গড়া ?’
‘না না লুবনা— পাথর কেন বলছ ? যাদের হৃৎপিণ্ড পাথর দিয়ে গড়া তাদের বিরুদ্ধেই তো আমাদের লড়াই । এই নগরের আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলোর দিকে তোমার কি কখনো চোখে পড়ে না ? কাদের শ্রমে ওসব গড়ে উঠে ? আর কারা ওসব ভোগ করছে ? ফুটপাথে খদ্দরের আশায় দাঁড়িয়ে থাকা পতিতার দিকে কি তোমার কখনো চোখ পড়ে না ? তুমি কি জানো কোন অভিশাপ তাকে এখানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ? সিস্টেম । যাদের হৃৎপিণ্ড পাথর দিয়ে গড়া সেই পাষণ্ডরাই এই সিস্টেম তৈরী করেছে । এই বিদ্যমান সিস্টেমটাকে ভেঙে ফেলার জন্যই তো আমাদের লড়াই ।’ রূপক বলে যায় ।
আমি মনোযোগ দিয়ে নিঃশব্দে শুনে যাই । আমার ভিতরে কেউ একজন চিৎকার করে বলতে থাকে— ‘রূপক তুমিই ঠিক, তুমিই ঠিক । অসংখ্য পোশাকি মানুষের ভিড়ে তুমিই প্রকৃত রক্ত-মাংস দিয়ে গড়া পূর্ণাঙ্গ মানুষ । আমিও তোমার মত হতে চাই ।’
কোনো রোমান্টিক গানের অডিও ক্লিপ নয়, রূপক আমাকে নজরুল-সুকান্ত-রুদ্রের কবিতা স্বকন্ঠে আবৃত্তি করে হোয়াটস-অ্যাপে, ম্যাসেঞ্জারে পাঠাত । আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত সেসব শুনতাম । বার বার শুনতাম । সেসব কবিতার প্রতিটা পঙক্তিতে ছিল এমন এক শেকল ভাঙার শপথ । যে শেকলে আমি নিজেই বন্দি ছিলাম । আজো বন্দি । রূপক, তুমি আমাকে মুক্ত করে যেতে পারো নি । তুমি ব্যর্থ বিপ্লবী, রূপক তুমি ব্যর্থ বিপ্লবী !

জীবনের সব কিছুই ঠিকঠাক মত চলছিল । সাজিদের সাথে সাড়ে চার বছরের অ্যাফেয়ারের শুভ পরিণতির কথা উঠতেই কেন জানি সেদিন আমি ভেঙে পড়ি । আর কেউ নয়, সেদিন ভেঙে পড়ার একমাত্র কারণ ছিল রূপক । সাজিদ নয়, আমার সমগ্র অস্তিত্বই তখন দখল করে আছে রূপক । যদিও আমার সাথে প্রেম-ভালোবাসার টপিক নিয়ে বিন্দুমাত্র কথা বলার আগ্রহ রূপকের ছিল না; তবুও আমি রূপককে ভালোবেসেছিলাম । সমগ্র হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছিলাম । রাজনীতি, মার্ক্সবাদ, নারীবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, বিপ্লব— যে টপিক নিয়েই রূপক কথা বলত । সবকিছুতেই আমি ধীরে ধীরে প্রেম অনুভব করতে থাকি । রূপকের ঠোঁট দিয়ে উচ্চারিত প্রতিটা বাক্যই ছিল প্রেমের একেকটি অমর পঙক্তি ।
উভয়পক্ষের অভিভাবকবৃন্দ রীতিমত উঠে পড়ে লেগেছেন আমার সাথে সাজিদের বিয়ে ঘটিয়ে দিতে । কারণ, সাজিদ এখন অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত । ৫ মাস আগেই একটা ভালো জব পেয়ে গেছে । আর আমি ? মাস দুয়েকও হল না ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নিয়েছি । আমার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা ? সেটার গুরুত্ব যে এই সমাজের কাছে কতটুকু তা আপনারা খুব ভালোভাবেই জানেন । কিন্তু এই সমাজের দাসত্ব মুখ বুঝে সহ্য করে চুপচাপ বেঁচে থাকার জন্যই কি আমার জন্ম ? না না— এই দাসত্ব নিঃশব্দে মেনে নেওয়ার জন্য আমি জন্মে নি, আমার জন্ম এই বৈষম্যবাদী সমাজকে আপদমস্তক পাল্টানোর যে লড়াই, সেই লড়াইয়ে সামিল হয়ে সাম্যকে ছিনিয়ে আনার জন্য । এইরকম বৈপ্লবিক চেতনাই সেদিন আমার ভিতরে মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছিল । রূপকের কাছ থেকে বিপ্লবের দীক্ষা নিয়ে আমিও হয়ে উঠতে লাগলাম এক আপদমস্তক বিপ্লবী ।

ওই রাতে আমার একফোঁটাও ঘুম হয় নি । রূপকের ফোন অফ । ফেসবুকে গিয়ে দেখি, সন্ধ্যা ৭.২৩ টার পরে রূপক আর আক্টিভ হয় নি ।
ভোর ৭টা । সারারাতের নিদ্রাহীন ক্লান্ত শরীরে ঘুম নেমে আসতেই আকস্মিক জেগে উঠি । বাবার কাছ থেকেই প্রথম শুনি । তারপর টিভি স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি— ব্রেকিং নিউজ : চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে গুলিতে চরমপন্থি ছাত্রনেতা রূপক চৌধুরি খুন !
রূপকের বুকে নাকি ৬টা বুলেট বিঁধেছিল ! ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল রূপকের রক্ত-মাংসের হৃৎপিণ্ড ! যাদের হৃৎপিণ্ড পাথরের, সভ্যতার দোহাই দিয়ে ওরাই শেষ পর্যন্ত জিতে গেল । আমার হৃৎপিণ্ডটাও হয়ত পাথরের । রূপককে বিসর্জন দিয়ে একটু পরে হাসতে হাসতে বসে যাব বিয়ের পিঁড়িতে ।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা মে, ২০১৫ বিকাল ৩:৪১

ঢাকাবাসী বলেছেন: বেঁচে গেলেন তো অকালে বিধবা হওয়ার থেকে!

০৪ ঠা মে, ২০১৫ দুপুর ১:১৮

সালমান মাহফুজ বলেছেন: হুম্‌ম্‌ । মতামতের জন্য অশেষ ধন্যবাদ ঢাকাবাসী ।

২| ০৪ ঠা মে, ২০১৫ ভোর ৬:৪২

মন ময়ূরী বলেছেন: ভাল লেগেছে।

০৪ ঠা মে, ২০১৫ দুপুর ১:১৯

সালমান মাহফুজ বলেছেন: ধন্যবাদ @ময়ূরী দি

৩| ০৪ ঠা মে, ২০১৫ সকাল ১১:৪৬

ঘনায়মান মেঘ বলেছেন: অত্যন্ত সুন্দর। খুব ভাল লেগেছে।

০৪ ঠা মে, ২০১৫ দুপুর ১:১৯

সালমান মাহফুজ বলেছেন: ধন্যবাদ @মেঘ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.