নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মুক্ত মানুষ , মুক্ত সমাজ, মুক্ত পৃথিবী; মুক্তিই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ।

সালমান মাহফুজ

সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা সেই কৈশোর থেকেই । মাঝে মাঝে লিখতেও চেষ্টা করি । যেই সাহিত্য আমাকে ধরেছে, সেই সিলেবাস আমাকে দূরে সরিয়ে দিছে । সুতরাং একাডেমিক কন্ডিশন চরম বাজে । প্রচণ্ড অলস এবং অসামাজিক । নিজের কাজের প্রতি চরম বিশ্বাসহীনতা । মাঝে মাঝে সবকিছুকেই অনর্থক ফাও ফাও মনে হয় । এমনকি বেঁচে থাকাটাও । তবুও বেঁচে আছি । কেন ? জানি না । শুধু জানি, কিছু একটা করতে হবে । কী সেটা ? তাও জানি না । মানবজন্মটাকে এভাবে বৃথা চলতে দেয়া যায় না, এই ভেবেই বোধোহয় আরেকটু বাঁচবার লোভ হয় ।

সালমান মাহফুজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাহিত্যপাঠঃ বুদ্ধদেব বসুর \'রাত ভ\'রে বৃষ্টি\' (১৮+)

১২ ই আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ২:৩৮

(১)
১৯৬৭ সালে প্রকাশ । বছর তিনেক না যেতেই ১৯৭০ উপন্যাসটির উপর নেমে এলো চূড়ান্ত দুর্যোগ । বিচারালয়ে অশ্লীল বলে চিহ্নিত হল । পাণ্ডুলিপিসহ সবগুলো কপি ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়া হল । রাষ্ট্রীয় কাঠগড়ায় নতজানু কল্লোল যুগের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসুর কলম । কতিপয় সমাজ-অনুগামী, সমাজবিরোধী — কেউই বাদ রইল না, সবাই থু থু ছিটাতে থাকল । এখন প্রশ্ন-- কী এমন ছিল উপন্যাসটির ভিতর ?

"হয়ে গেছে-- ওটা হ'য়ে গেছে, এখন আর কিছু বলার নেই । আমি, মালতী মুখোপাধ্যায়, একজনের স্ত্রী আর একজনের মা, আমি ওটা করেছি । করেছি জয়ন্তর সঙ্গে, জয়ন্ত আমাকে চেয়েছে, আমিও তাকে । নয়নাংশু হয়ত ভাবছে আগেই করেছিলুম, কিন্তু না-- আজই প্রথম । আজ রাত্রে-- চার ঘণ্টা আগে । এই বিছানায় । যেখানে মালতী এখন শুয়ে আছে ।"

এভাবেই উপন্যাসটির সূচনা । এইটুকু পড়ে যে কোনো পাঠকের পক্ষেই চমকে ওঠা অস্বাভাবিক নয় । সমাজ-নিষিদ্ধ প্রেমের ঝাঁঝালো একটা গন্ধ, শিউরে উঠে সমস্ত শরীর । বিস্ময় বেড়েই চলে ! প্রশ্নও চলে- এভাবেও কি বলা যায় ? এত খোলামেলাভাবে ?
হ্যাঁ, 'রাত ভ'রে বৃষ্টি' উপন্যাসে বুদ্ধদেব কোনো চাতুর্যতার আশ্রয় নেন নি । ইনিয়ে বিনিয়ে কিংবা জটলা পাকিয়ে তিনি জীবনকে বিমূর্ত জটিল শিল্পরূপ দেন নি । জীবন যেমন— ঠিক তেমনিভাবে তাকে আঁকতে চেয়েছেন । জীবনের সঙ্গে যে সত্যগুলো আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে, সেগুলোকে দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করে গেছেন । যে প্রেমকে সমাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে নির্মমতার সাথে, সেই পরকীয়া প্রেমকে আশ্রয় করে গড়ে তুললেন উপন্যাসের আখ্যান ।

অংশুর স্ত্রী মালতী । জয়ন্তের প্রেমিকা মালতী । মালতীকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের যাবতীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সূচনা । তবে মালতী তার অনুভূতির সাথে অকপট । জয়ন্তের সঙ্গে সঙ্গমের পর নির্দ্বিধায় মালতীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়--

"খিদে পেলে খেতে হয়, প্রেম পেলে প্রেম করতে হয়..."

যা কিছু নগ্ন তাকে পোশাক পরাবার চেষ্টা করেন নি এই সাহিত্যস্রষ্টা । বরং নগ্নতার ভিতর দিয়েই তিনি সৌন্দর্যকে মূর্ত করে তুলতে চেয়েছেন । ঘুমন্ত স্ত্রী মালতীর শারীরিক সৌন্দর্য নয়নাংশুর চোখে এভাবেই ধরা পড়ে-

"আলো জ্বেলে দেখলুম সুন্দর একটি ছবি । মালতী ঘুমিয়ে আছে, শাড়িটা উঠে গিয়ে নিটোল একটি পা দেখা যাচ্ছে হাঁটু থেকে পাতা পর্যন্ত, আঁচল সরে গিয়ে একটি স্তন সম্পূর্ণ বেরিয়ে পড়ছে-- সম্পূর্ণ গোল, নধর, উর্ধ্বমুখ । একটি শ্যামবরনী ভেনাস-- বতিচেলির সদ্যতরুণী নয়, বরং টিৎসিয়ানোর কোনো ছাত্রের আঁকা পক্বযুবতী, সারা ঘুমন্ত শরীরের মধ্যে ঐ একটি অনাবৃত স্তন যেন চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, রূপের চেতনা ও স্পর্ধা নিয়ে, লোকদের অভিনন্দন নেবার জন্য । চুপচুপে ভেজা ঠাণ্ডা শিটানো শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে আমার বেশ লাগছিলো, যেন চোখ দিয়েই কিছুটা তাপ কুড়িয়ে নিচ্ছিলাম ।"

এখানে যৌনতা আছে । নারীর স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর বর্ণনা আছে । আদিরসত্মক রোমাঞ্চ আছে । তবুও কেন জানি মনে হয় এটা অশ্লীল নয়, এটা শিল্প, এটা কলমের খোচায় বের করে আনা এক অনিন্দ্য সৌন্দর্য । কোনো সুড়সুড়ি দেয় না— একটা নিটোল অখণ্ড সৌন্দর্যকেই আমাদের সামনে দৃশ্যমান করে তোলে ।
এমন বর্ণনার সঙ্গে উপন্যাসের পরতে পরতে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে । খোলামেলা হওয়া সত্ত্বেও উদ্বৃতিকৃত লাইনগুলো অশ্লীলতাকে অতিক্রম করে গেছে । কারণ একটাই । বুদ্ধদেবের অসামান্য শিল্পবোধসম্পন্ন বর্ণনাভঙ্গি ।

(২)
বুদ্ধদেব বসু একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সম্পাদক, সংগঠক, পৃষ্ঠপোষক । অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো অঙ্গই নেই যেখানে তাঁর পদধূলি লাগে নি । এমনকি যে-কজন তাজা প্রাণ রবীন্দ্র-বলয় থেকে বের হয়ে বাংলাভাষায় নতুন সাহিত্যিক আদর্শের সন্ধান করেছেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে উচ্চারিত একটা নাম বুদ্ধদেব বসু । আধুনিক বাংলা-সাহিত্যের এমন পুরোধা ব্যক্তিত্বের হাতেই নাকি এই বিতর্কিত আখ্যানের নির্মাণ । ভাবতেই বিস্ময় লাগে । এটাকে আপনি স্রষ্টার ছেলেবয়সের পাগলামি বলেও উড়িয়ে দিতে পারবেন না । কেননা, উপন্যাসটি লেখার সময় বুদ্ধদেব ষাটের ঘরের প্রবীণ । উপন্যাসটির আখ্যান-চরিত্র-বক্তব্য-গঠনকৌশল-সংকট-জীবনজিজ্ঞাসা-- কোথাও লেখকের আবেগের উচ্ছ্বাস নেই । আছে বুদ্ধির ছাপ, উপস্থাপনায় অভিনবত্ব, পরিমিত শিল্পবোধ ।

মালতী আর নয়নাংশুর বয়ানে এগিয়ে চলা ষাট পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি একদমে পড়তে পাঠকের খুব একটা হোঁচট খেতে হবে না, ক্লান্তির উদ্রেক ঘটবে না । তবে তর্ক চলতে পারে, রুচি-অরুচির তর্ক, শ্লীল-অশ্লীলের তর্ক । ভিতরে ভিতরে নানামাত্রিক মনস্তাত্ত্বিক সংঘাতের উদ্রেক ঘটতে পারে, প্রেমতত্ত্বের নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত হওয়ার সম্ভবনাও থেকে যায় ।

(৩)
নয়নাংশু আর মালতীর বারো বছরের দাম্পত্য-জীবনে যখন ক্লান্তি এসে গেল, পরস্পর পরস্পরের কাছে তিক্ত অসহ্য হয়ে উঠল, দুটো বিছানা আলাদা হয়ে গেল, প্রেম-কাম-ভালোবাসাবাসি সব ধুয়ে মুছে কেবল অভ্যাসের দাস হয়ে নিয়মের অনুগামী হয়ে একে অন্যের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করছিল, তখনো নয়নাংশুর ভিতরে প্রেমতত্ত্বের নানা তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে । পুঁথির মাধ্যমে প্রাপ্ত ইউরোপিয়ান ব্যক্তিবাদী চেতনা আর তত্ত্বনির্ভর জীবনভঙ্গি দিয়েই পৃথিবীর সবকিছুকে বিচার করে অংশু । এমনকি মালতিকেও সে একই দীক্ষায় দীক্ষিত করতে চায় । মালতী কী চায় তার চেয়ে অংশুর কাছে বড় হিসাবে দেখা দেয় সে মালতীকে কীভাবে দেখতে চায়, গড়তে চায় । আবার অংশুর আইডিয়ার মধ্যে প্রথমে মালতি নিজেকে সমার্পিত করলেও একসময়ে তাঁর ভিতরে আমরা স্বাধীন সত্তার আবির্ভাব হতে দেখি । জ্ঞানে শিক্ষায় রুচিতে মালতি সর্বদা অংশুর চেয়ে অনেক অনেক পিছিয়ে, নিজের পশ্চাদপদতা নিয়ে এক ধরণের হীন্যমন্যতায় কাজ করে মালতীর মধ্যে- তবুও আমরা দেখি কেমন করে মালতীর চোখে একে একে ধরা পড়তে থাকে অংশু চরিত্রের স্থুলতা ! জয়ন্তের কাছে মালতীর আত্মসমার্পণ অংশু টের পায় । তবুও সে চুপ । কারণ, অংশু জানে তার শরীরটা এখন আর মালতীকে টানে না । ভিন্ন কোনো স্বাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে মালতী । আর শরীর বাদ দিলে ভালোবাসার থাকেই বা কী...

"ভালোবাসায় শরীরই আসল-- আরম্ভ, শেষ, সব ঐ শরীর । আধা-বয়সী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অত ঝগড়াঝাঁটি খিটিমিটি কেন ? যেহেতু তাদের শরীর পড়ে আসছে ! বুড়ো স্বামী-স্ত্রীরা নানাভাবে উৎপীড়ন করে কেন পরস্পরকে ? যেহেতু তাদের শরীর মরে গেছে । প্রতিহিংসা-- প্রকৃতির উপর প্রতিহিংসা ! ভালোবাসা জৈব, ভালোবাসা যৌন, শরীর না-থাকলে কিছুই থাকে না ভালোবাসার ।"

শুধু অংশু নয় । মালতীর কাছেও শরীরটাই মূখ্য । নিজের দুর্দশাগ্রস্ত দাম্পত্য জীবনের পদাঘাতে পিষ্ট হয়ে মালতীর কণ্ঠেও বাজে আফসোসের সুর--

"যদি ভালোবাসার শরীর না-থাকতো, তাহলে কতই না সুখী হতে পারতাম আমি আর নয়নাংশু ।"

শরীর-প্রেম-যৌনতা-অতৃপ্তি-কলহ-পরকীয়া-প্রতিশোধ সবকিছু নিয়েই দুটো চিন্তার স্রোত প্রবাহমাণ, জিজ্ঞাসারও অন্ত নেই ওদের । যেমন মালতীর , তেমন অংশুরও । তবুও কী অদ্ভুত ! ওরা কেউ বিচ্ছেদের দিকে আগায় না । হয়ত এখানে দেয়াল তুলে রেখেছে তাদের দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা কিংবা তাদের একমাত্র সন্তান বুন্নি ।

তবে রাতভর বৃষ্টি শেষে যখন ভোর হল, টুকরো টুকরো স্মৃতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জীবনের হিসাব-নিকাশ শেষে যখন ঝলমলে রোদে ভরে উঠল ওদের উঠোন, তখন নয়নাংশুর বয়ানে বুদ্ধদেব আমাদের একটা আশার বাণী শুনালেন, চিরায়ত অভ্যাসগ্রস্ত বাঙালি জীবনের জয়ধ্বনি শুনালেন, সমস্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কেবল বেঁচে থাকার মন্ত্র শুনালেনঃ
"ভালোবাসা জরুরী নয়, স্বামী স্ত্রী জরুরী, বেঁচে থাকাটা জরুরী ।"


©️ সালমান মাহফুজ


মন্তব্য ৭ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৬

অপর্ণা সেন বলেছেন: উপন্যাসটি পড়েছি।
ভালো লাগা রইলো।

১৩ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১২:১৬

সালমান মাহফুজ বলেছেন: মতামত ব্যক্ত করা জন্য অশেষ ধন্যবাদ । ভালো থাকবেন ।

২| ১২ ই আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৫:২৪

জাহিদ অনিক বলেছেন: বেশ বেশ ভাল লাগল । গল্পটা জানা তাই অনেক বেশিই ভাল লাগলো পোষ্টটি ।

স্বামীর সংগে স্ত্রীর যেভাবে বই পত্রের সম্পর্ক হতে পারে, স্ত্রীর মনের চাহিদা বা স্বামীটির চাহিদা একে অপরকে বুঝতে না পারলেই এমন ঘটনা হতে পারে ।

বুদ্ধদেব বসু বেশ চমৎকার লিখেছিলেন । মুগ্ধ হয়েছিলাম এটা পড়ে ।

রাত ভরে বৃষ্টি কেবল হতেই থাকে । সে বৃষ্টির জল কাউকে ছুঁতে পারে না ।

১৩ ই আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২২

সালমান মাহফুজ বলেছেন: চমৎকার মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ । ভালো থাকবেন ।

৩| ১২ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ৮:২০

এডওয়ার্ড মায়া বলেছেন: দারুন রিভিউ ।
লেখায় যৌনতা স্বাদ থাকলেও লেখক মুগ্ধ শিল্প এঁকেছেন ।
যা এখনাকার সাহিত্যে পাওয়া যায় না।যা পাওয়া যায় তা চটি -ফিতা খোল,গোসল করে এসো ।

১৩ ই আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৬

সালমান মাহফুজ বলেছেন: সেটাই । যৌনতাকেও যে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায়, সেটা প্রকৃত শিল্পীই শুধু জানেন ।

মতামতের জন্য ধন্যবাদ ।

৪| ১৭ ই আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১:৩০

দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: ভালো লেগেছে।






ভালো থাকুন নিরন্তর। ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.