নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

উল্টো পথিক

সয়ূজ

আমি কী তাই যা আমি হতে চেয়েছি? আমি কী তাই যা আমি হতে পেরেছি?

সয়ূজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

পথের গল্প

১৫ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১২:৫৮

কয়েকবছর আগেও ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর এক অদ্ভুত রোগ ছিল আমার। গতকাল হঠাৎ করেই যেন পুরোনো ব্যারাম মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। গন্তব্য গুলশানের কানাডিয়ান হাইকমিশন থেকে ধানমন্ডি। না, বর্তমান স্থূলকায় শরীর কিংবা অসহনীয় কোমরব্যাথা সম্বল করে হণ্টনের অতীত ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবু্ও অতীত রোমন্থনের মত ভরদুপুরে গুলশানের তপ্ত রাস্তাই হয়ে গেল আমার বিচরণক্ষেত্র।
দুধারের জৌলুস কিংবা রাস্তা দাপানো ঝা-চকচকে দামি গাড়িগুলো চোখের দৃষ্টিসীমায় আটকিয়ে রাখার মায়া যথাসম্ভব ত্যাগ করে হাঁটছিলাম। হঠাৎ বাংলা সিনেমার চিরায়ত দৃশ্য। আমায় ছেঁড়ে হুশ করে বেড়িয়ে গিয়েও একটি গাড়ির থেমে যাওয়া। অতঃপর সেই সাদা প্রেমিওর জানালার নিচে নেমে যাওয়া এবং যথারীতি এক সুন্দরী ললনার বিস্মিত চোখ আমার উপরে আটকে যাওয়া।
আমি খুব সহজে বিস্মিত হইনা। স্রষ্টা অনেক আগেই আমার আমার বিষ্ময়ের ঘরে বিস্ময়বোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন। তাই গাড়ির জানালায় যার মুখ দেখলাম সেই রমণীটি আমাদের শেষ দেখায় স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেছিলো তিনি যেন কোনদিন তাকে আমার মুখদর্শন না করান।
মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। আমাদের শেষ দেখার সময়কাল প্রায় সাতবছর হতে চললো। দীর্ঘ আটবছর আগে আমরা জড়িয়েছিলাম এক অদ্ভুত অম্লমধুর সম্পর্কে ।
ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় রাজধানীর শপিংমল, রেস্টোর‌্যান্ট, সিনেপ্লেক্স এবং পার্কগুলো আমাদের যুগল উপাধি প্রদান করেছিল। পরিচয়টা দুজনের এক কমন বন্ধুর মাধ্যমে। আমি তখন সদ্য ঢাকায় আসা মফস্বলের এক ছেলে। পরিচিত হচ্ছি রাজধানীর চাকচিক্যের সাথে। এমনই সময় ঝড়ের প্রাদুর্ভাব।
ফ্ল্যাশব্যাকে মগজের মাঝে স্মৃতির রিওয়াইন্ড হতে হতেই পরিচিতা এক্কেবারে নাক বরাবর।
-এখনো হাঁটার পাগলামিটা আছে?
বরাবরের মত উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার প্রশ্ন- কোথায় যাবে?
-ধানমন্ডি।
-উঠে পড়ো।
গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বললাম- হুকুম দেওয়ার অভ্যেসটা এখনও আছে দেখছি?
উত্তর যেন প্রস্তুত ছিল- হুমম, তোমার যেমন বিনা বাক্যব্যায়ে হুকুম পালনের …
অনেক পুরোনো অভ্যাসের মত খোঁচাটা গায়ে লাগলোনা। গাড়ির এসি শরীরের ঘাম যত দ্রুত শুষে নিচ্ছিল মনের অস্বস্তিটা দিচ্ছিল ততই বাড়িয়ে । নীরবতা ভাঙতে আমিই মুখ খুললাম-ভালো আছো?
আবার খোঁচা- কী মনে হয়?
উত্তর দিলে হয়তো বাংলা সিনেমার সিকোয়েন্স হয়ে যেত। তাই নীরবতাই সই।
আট বছর দীর্ঘ সময়। পরিবর্তনটাও হয়তো চোখে পড়ার মত। তবে আমার ড্যাবড্যাবে দৃষ্টি পরিবর্তন খুঁজে পেলনা। যদি টপস, জিন্স আর স্লিভলেস কামিজের জায়গায় শাড়িটাকে পরিবর্তন বলা যায় তবে ভিন্ন কথা।
-কি ভালো থাকার নমুনা খঁজছো?
হাসিকে কেন সকল রোগের মহৌষোধ বলা হয় তার মাহাত্ম্য আজ টের পাচ্ছি। খোঁচার বিপরীতে হাসির লড়াই চলছে।
– মৌনি বাবা সেজে থাকার রোগটা আজো যায়নি দেখছি?
আবার একঝলক দৃষ্টি বিনিময়।
-প্রেম করছো?
রাস্তা এখনও ঢের বাকি। আক্রমণটা এত তাড়াতিাড়ি আসবে ভাবিনি।
-বলতে পারো। একরকম…
-মানে?
এই প্রথম তার চোখে কৌতুহল দেখলাম। তবে তা মুহূর্তের। চোখের দৃষ্টিতে সহসাই যেন কিছু একটা মিলিয়ে গেল।
-বাদ দাও।
– দেখতে কেমন? বিয়ে করবে তো?
এই জিনিসটা একেবারেই নতুন। কৌতুহল নামক কোন বস্তু তার কোন কালে ছিল বলে মনে পড়ছেনা।
আটবছর আগের সময়টা চৈত্রমাস ছিল না তাই তার চোখে আমার সর্বনাশ দেখারও কোন কথা না। তবুও প্রথম পরিচয়ে করমর্দনের জন্য তার বাড়িয়ে দেয়া হাত স্পর্শ না করাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো আমার জন্য।
আগেই বলেছি আমার ছেড়ে আসা শহরের তুলনায় ঢাকার জমাটি বাতাস ছিল যথেষ্ট দমকা। নিজেকে খাপ খাওয়াতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল। তার মাঝেই নিজেকে আবিস্কার করলাম এক শহুরে রমণীর বাহুলগ্ন হিসেবে।
কলাভবনের করিডোরে আঁড়িপেতে সে যেন অপেক্ষায় থাকতো আমার শতছিন্ন পেরেক ঠোকা স্যান্ডেলের শব্দের। তারপর ছিনতাই হয়ে যেত আমার দুপুর। শ্রেণিশত্রু ভাবতে থাকা দামি রেস্তোরাগুলোর খাবারই তখন নৈমিত্তিক ব্যাপার।
সবটাই কি তবে আমার অনিচ্ছাকৃত? মোটেও না। সহপাঠিরা যখন আমার আধুনিকা প্রেমিকার দোহাই দিয়ে আমায় হিংসায় পোড়াত, আমারতো তখন পোয়াবারো।
সিনেপ্লেক্সের আলোগুলো নিভে গেলে যখন দুটো হাত আমার রুগ্ন বাইসেপ আঁকড়ে ধরতো কিংবা দুজনের মিলিত দশটি আঙ্গুল যখন তার তপ্ত নিঃশ্বাস বা ঠোঁটের ছোঁয়া পেত তখন নিজের ভূবনের কথা ভুলে যেতাম।
– উত্তর দেবেনা?
কন্ঠের আকুতিতে বর্তমানে ফিরে এলাম।
কিছু না বলে আবার শুধুই হাসলাম।
এবার সে নাছোড়বানন্দা।
-হাসবেনা। উত্তর দাও।
-কী জানতে চাও?
-এবারে তুমি সিরিয়াস?
-এবারে মানে?
-দুদিন পর তোমার অন্য প্রেমিকাদের মত একেও ছুঁড়ে দেবে না তো?
বুঝতে পারছিনা আমার কি রেগে যাওয়া উচিৎ না অপমানিতবোধ করা? পরিচিতার দৃষ্টির হন্যেভাব আমায় কাবু করে ফেলেছে। রীতিমত অসহায়বোধ হচ্ছে। অভিযোগগুলো গুরুতর। তবে বিবাদী হিসেবে অভিযোগ খণ্ডনে অবশ্যই আমার নিজস্ব যুক্তি রয়েছে। অবশ্য বর্তমান আবেগের তোড়ে তার দাঁড়ানোর সামর্থ নেই।
মানুষের ভালোবাসা অগ্রাহ্য করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছি আমি। তাই আটবছর আগে আবেগে লাগাম দিয়ে সরে দাঁড়ানোর পর কখনোই অপরাধবোধে ভুগতে হয়নি।
সবকিছু ভালোই চলছিল। তবু হীনমন্যতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল আমায়। আমার মধ্যবিত্ত মনে বিশ্বাস জন্মেছিল ওটা প্রেম নয়, ফাঁদ। আমার মলিন পোশাক আর মাসশেষে পিতার পাঠানো স্বল্প টাকার বিপরীতে সুন্দরীর ভালোবাসাটা মিথ্যে মনে হতে লাগলো।
মধ্যবিত্ত পুরুষ মন স্বপ্ন দেখতো অন্যকিছুর। ধীরে ধীরে সরে আসা সম্ভব ছিলনা। তাতে আরো বেশি আঁকড়ে ধরার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। তাই শেষ দেখায় একবাক্যে বিদায় জানিয়ে ফেরার সময় তার চোখের দিকে তাকানো হয়নি। গলার স্বর জানিয়ে দিচ্ছিলো চোখের জলের কথা। বিদায় সম্ভাষণটুকু হজম করে এগোতে এগোতো সে জলের থেকেও আমার ভাবনাও ছিল সদ্য পাওয়া টিউশনির টাকার আনন্দ।
-সেদিন তুমি কি একবারও হাসপাতালে আসতে পারতেনা?
হাসি ছাড়া আর কোন শব্দ মাথায় আসছেনা।
-লাবণী বলেছিল তুমি নাকি ফোনে খবরটা পেয়ে হাসপাতালের নামটা পর্যন্ত জানতে চাওনি।
-…আমি যদি সেদিন মরে যেতাম?
– তবে আজ আর আমায় এমন জেরার মুখে পড়তে হোতনা।
মুখের মেঘ আরও ঘনিয়ে এলো। ভয় হচ্ছে তার বাতাস আবার চোখে না এসে পড়ে। গুমোট ভাবটা কাটাতে আমিই মুখ খুললাম।
– এদিকে কোথায় এসেছিলে?
-খালামণির বাসায়।
-তুমি?
– একটা ইন্টারভিউ ছিল।
-আগের জবেই আছো?
-আগের মানে?
তার মুখে এক অদ্ভুত হাসির রেশ দেখা দিল।
-তুমি ভুলে যেতে পারো। আমি ঠিকই তোমার খোঁজ রাখি।
এবার হাসতে গিয়েও বিষণ্নতা জেঁকে বসলো। সবভুলে বিদায় নেবার পর সত্যিই ভুলে বসেছিলাম সব। ভুলে গিয়েছিলাম বিদায়ের দুদিন পর তার বান্ধবীর ফোনের কথা। ভুলে গিয়েছিলাম এই মেয়েটি কষ্ট ভুলতে সত্যি বিদায় নিতে চেয়েছিল। বাম হাতের কবজিতে লম্বা দাগটি বেশ সহজেই সে কথা আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।
– জানো, এই দাগটাই না তোমায় ভুলতে দেয়না। অনেক চেষ্টা করেছি। পারিনি।
আমার কথা আটকে গেছে। কথার পিঠে কথা বলা আমার স্বভাব নয়। একমনে তাকিয়ে ছিলাম হাতটির দিকে। এই হাতের উষ্ণতা মুঠোয় পুরে এক সময় অনেক নীরবতা পালন করেছি। সে হাতটা ছিলো দাগবিহীন।
-বাকি রাস্তা চলে যেতে পারবেনা?
চমকে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখি গাড়ি বিজয়সরণীতে। চারপাশে গাড়ির স্তূপ। এ কথার পর আর বসে থাকা যায়না।
– বাকি রাস্তাটা জেরায় জেরবার হতে হয়তো তোমার ভালো লাগবেনা।
কথার ঢঙে না হেসে পারলামনা। তার চোখে কৌতুকের ছিটেফোটাও নেই। সাতবছর আগের প্রেম এখনও ঠিকরে পড়ছে দুচোখে। কান্না বাধ ভেঙে দিয়েছে। কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়লাম।
সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। শ্লথগতিতে চলতে শুরু করা গাড়ির জানালার কাঁচ দিয়ে একজোড়া চোখের দৃষ্টি তখনও আমার ওপর নিবদ্ধ।
কারও অশ্রু নয় আমার চিন্তায় তখন গাড়ির পাহাড় ডিঙিয়ে ওপারে যাবার তাগিদ।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১:১৯

ডাঃ প্রকাশ চন্দ্র রায় বলেছেন: সর্বনাশ একি করেছেন ভাই! আপনি এখনও সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন। অসম্ভব! এ আপনার একদম উচিৎ হয়নি কিন্তু!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.