নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অধরায় অধরা

সেরাজুম মুনীরা ১৪১

সেরাজুম মুনীরা ১৪১ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডগম্যান

১৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১০:৪০

জীবনের চলার পথে তুচ্ছ কিছূ বিষয়ও মানুষের মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। এমনি একটা বিষয় শেয়ার করলাম আপনাদের সাথে...আমার ডায়রির আজকে লেখা যাকে নিয়ে সে হচ্ছে ডগম্যান....



ডগম্যান

------------



প্রতিদিন অফিস যাবার পথে রমনা থেকে মৎস্যভবনের দিকে রাস্তাটা পেরুতে হয়। ওটাই আমার অফিসে যাবার নিত্য পথ। প্রতিদিন এ রাস্তায় দেখা হতো একজনের সাথে। গাট্টাগোট্টা মোটাতাজা দীর্ঘদেহী একজনের সাথে। নির্দিষ্ট জায়গাটায় এলেই তাকে খুঁজে বেড়াতাম। না..না সে কোন মানুষ নয়। বলছিলাম পথে পথে হেটে বেড়ানো বিশালদেহী এক কুকুরের কথা। যাকে দেখলেই মনে হয় যেনো নেতা গোছের কেউ। গম্ভীর হাঁটা, ঘাড় না ঘুরিয়ে এক চোখে তাকানো।সবটায় যেনো একটা রাজকীয় রাজকীয় ভাব।



তার সাথে দেখা হতো কখনো রমনার রেস্টুরেন্টের পাশে ফুটপাতে, কখনো ওভারব্রীজের রাস্তায় আবার কখনো চৌরাস্তার সিগন্যালে। মনে পড়ে প্রথমবার যখন সিগন্যালে থেমেছিলো আমার রিকশা, ঠিক রিকশার গাঁ ঘেষেই দাঁড়িয়েছিলো সেই বিশালদেহী । আমার চোখে চোখ পড়লো। দেখলাম তার গভীর দৃষ্টি। একবার চোখ সরিয়ে আবার দেখছে আমায়। একটা বীর বীর ভাব। ভারী মজা লাগছিলো। সিগন্যালটাও অনেক সময় নিচ্ছিলো। অবাক হলাম কুকুরটার দীর্ঘসময়ের অপলক দৃষ্টিতে। কুকুর তো এমন করে তাকায় না। একটু একটু ভয় লাগছিলো নাকি আবার লাফিয়ে পড়ে। তবে না তার দৃষ্টিতে ছিলো লাজুকতা। কিছুক্ষণ পর পর সে চোখ সরিয়ে আবার তাকাচ্ছিলো, কারণটা একেবারেই অজানা। মনে মনে হাসলাম শেষমেষ কুকুর হিরো এসে জুটলো নাকি। হা হা হা। অবশেষে সিগন্যাল ছাড়লো। কিন্তু কুকুরের সেই মজার দৃষ্টি ভুলতে পারলাম না।



এরপর থেকেই যখন রিকশায় যাই সে পথে, প্রায়ই চোখে পড়ে চেনা সেই রাজকুকুরের । কখনো দেখি ধীরগতিতে হেঁটে যেতে, কখনো ফুটপাতে বসে থাকতে আবার কখনো বা ঘুমিয়ে। এভাবেই বেশ অনেকদিন আসা যাওয়ার পথে সাক্ষাৎ মেলে তার। তার লাজুক দৃষ্টি আর বীর ভাবটার জন্য তাকে দেখলেই ভীষণ মজা লাগে। নাম দিয়েছি তার ...ডগম্যান। নামের পেছনে কারণ তার চলাফেরা আর দশটা কুকুরের মতো সাধারণ ছিলো না। ব্যক্তিত্ব আর মানুষের অনুভূতির অনেককিছু লক্ষ্য করতাম তার মাঝে। চিৎপটাং হয়ে ঘুমাতো না। সামনে দু পায়ে আলতো করে মাথা রেখে ঘুম। সব আচরণগুলোই বেশ মজার। মাঝে মাঝে তার চেলাদের সাথে ও দেখা যেতো। হয়তো মিটিং এ ব্যস্ত। হা হা হা।



ব্যস্ততা আর কাজের চাপে বেশ কদিন আর সেই জায়গায় এলে খুঁজে বেড়ানো হয় না ডগম্যানকে।পুরো রাস্তা জুড়ে থাকে কাজ আর অন্য চিন্তা। তাছাড়া সিএনজিতেই বেশি যাওয়া হচ্ছে ইদানিং। একারণে সিএনজি থেকে ডগম্যানকে ট্রেস করা কঠিন। আর এভাবে প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম তার কথা।



তারিখটা মনে নেই তবে মার্চের শেষ দিকটায়। খুব তাড়া ছিলো অফিসের। সিএনজি না পেয়ে রিকশায় উঠে পড়লাম। রিকশাওয়ালাকে বললাম খুব তাড়াতাড়ি যেতে। ব্রিজটা ছেড়ে আরো কিছুটা সামনে সেই ডগম্যানের অঞ্চলে এসে আবারো সিগন্যালে পড়লাম। আজ সিগন্যালটা বড়ো অসহ্য মনে হচ্ছে। বাতাসে একটা উৎকট গন্ধ পাচ্ছি। তীব্র বাজে গন্ধে পেটের নাড়িভুড়ি বের হবার যোগাড়। রিকশাওয়ালা বেশ কয়েকবার থুথু ফেলে নাকে হাত চেপে বলছে, এমন বাজে গন্ধ, দাড়াইতে পারতেসি না আপা। কথাটা কানে যেতে যেতে অল্প এগুতেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। খুব স্বাভাবিক ঘটনা হলেও চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। রাস্তার একপাশে চিরঘুমে এবার ডগম্যান। আজকে শোয়ার ভঙি নিজস্ব স্টাইলে নয় আর দশটা সাধারণ কুকুরের মতোই। রোড একসিডেন্টে পড়ে আছে রাস্তায়। নিথর বিশাল দেহটার পাশ কাটিয়ে সবাই নাক চেপে চলে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে রিকশাওয়ালাকে বললাম বাতাসে উৎকট গন্ধের কারণটা। সে বললো আজকে মরলে এতো গন্ধ বের হবে আপা? আমি বললাম ওটা গত রাতের একসিডেন্ট তাই গরমে পচে গন্ধ ছড়িয়েছে।



আর একটু এগুলেই ডগম্যানকে দেখা যাবে। ভীষণ কষ্ট লাগছে ওর মুখটার দিকে তাকাতে। তারপরও শেষ দেখা দেখতে সাহস নিয়ে তাকালাম ডগম্যানের দিকে। মুখের এক পাশ বিকৃত। চোখ আধ খোলা। নেই সেই লাজুকতা আর বীর ভাব। এই জায়গায় কোন মানুষ হলে হয়তো এতক্ষনে পুলিশ আর জনগণে ভরে যেতো। কিন্তু অসহায় ডগম্যানের দিকে তাকিয়ে নাক চেপে পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক মানুষ আর রিকশা-গাড়ি। স্বাভাবিকভাবেই নগর পরিষ্কারের নিয়োগ ব্যক্তিরা ডগম্যানকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে কোন এক ময়লা বহণকারী গাড়িতে। বেচারা ডগম্যান.. সমাপ্তি ঘটলো তার এই অঞ্চলে রাজত্বের।



পরদিন... দুর থেকে মনে হলো হয়তো তাই। কাছে যেয়ে দেখি পড়ে থাকা নিথর দেহের জায়গায় সুরকি আর মাটির স্তুপ।এখনো বাতাসে সেই গন্ধ। হয়তো ডগম্যানকে নিয়ে যাবার পর জায়গাটার গন্ধ দূর করতে এই ব্যবস্থা।



তৃতীয়দিন.... কৌতুহল নিয়ে তাকালাম জায়গাটার দিকে। কয়েকটা কাক ওই মাটির ডিবিটার ওপর বসে ঠোকরাচ্ছে। হয়তো পচাঁ গন্ধ টেনে নিয়ে এসেছে ওদের। ঠুকরে ঠুকরে বেশ খানিকটা গর্ত করে ফেলেছে ওরা।এখনো বাতাসে ক্ষীণ সেই বাজে গন্ধ। কাকদের ঠোঁকরানোতেই হয়তো গন্ধটা আবারো বাতাসে ছড়াচ্ছে।



চতুর্থদিন... রাস্তা খালি থাকায় দূর থেকেই চোখে পড়ছে সেই উচুঁ ‍ডিবিটা। আজ হয়তো কাছ দিয়েই যেতে হবে। আগেই তাই নাকে ওড়না চেপে ধরলাম। কাছে যেতেই আবারো চমকে উঠলাম। মাটির ডিবির ভেতর থেকে ডগম্যানের কিছুটা শুকিয়ে যাওয়া পা বেরিয়ে আছে। বুঝলাম ডগম্যান এখানেই শায়িত।



এরপর থেকে প্রতিদিন যেতেই একবার তাকাই ডগম্যানের কবরের দিকে।ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে মাটির উচুঁ ডিবিটা। ব্রিজ পার হয়ে রমনা রেস্টুরেন্টের মেইন রোড থেকে কিছুটা পার হয়ে হাতের বা দিকে কেউ যদি খুব ভালো করে লক্ষ্য করে, তাহলে এখনো হয়তো দেখতে পাবে ডগম্যানের কবর।



সত্যিকার এ কাহিনীর একমাত্র স্বাক্ষী আমি প্রতিনিয়ত দেখে যাচ্ছি,কিভাবে বিশালদেহী ডগম্যান ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে যাচ্ছে কংকালে। কেনো যেনো এখনো মাঝে মধ্যেই বাতাসে পাই সেই তীব্র বাজে গন্ধ। জানি এটা মস্তিষ্কের অসুস্থতা। ওই পথ দিকে গেলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বীর ডগম্যানের চলাফেরা। আর তখনি একটা মেসেজ পাই...যত বড় বীরই ই হওনা কেনো, যতো রাজত্বের অধিকারী হওনা কেনো...একদিন স....ব ফুরাবে....স....ব।





মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.