নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন মানুষ হিশেবে সৎ, নির্লোভ, সত্যান্বেষী, সত্যবাদী হওয়াটা জরুরী হয়ে পরে বিশ্বমানবতার জন্য, সমাজের জন্য।একজন মানুষ হিশেবে সৎ, নির্লোভ, সত্যান্বেষী, সত্যবাদী হওয়াটা জরুরী হয়ে পরে বিশ্বমানবতার জন্য, সমাজের জন্য।

মৌতাত গোস্বামী শন্তু

মানুষ বলে ভুল করলেও নিজেকে মানুষই বলব আমি।

মৌতাত গোস্বামী শন্তু › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের বিশেষ লেখ!

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৫৮



"ভাই ভাই । মেডিকেল কলেজের গেট কোন দিকে বলতে পারেন?"
যাকে জিজ্ঞেস করা হল তার দু হাতে দুটি বড় পোস্টার সমান কাগজ। হন্তদন্ত হয়ে ছোটার মুহূর্তে তার গতিপথে বাধার সৃষ্টি করলেন জব্বার । কিন্তু এ ছাড়া তার উপায় নেই। তার শাশুড়িকে ভর্তি করানো হয়েছে মেডিকেলে। তাকে দেখতেই আসা। লোকটি বলল, "সে কি!! ঢাকায় থাকেন আর মেডিকেল কলেজের গেট চিনেন না!!" যে জিজ্ঞেস করেছিল তার নাম জব্বার। জব্বার লজ্জিত হল। "আসলে ব্যাপারটা কি আমি বেশ কিছু দিন বার্মাতে ছিলাম। আর হাসপাতালে আমার তেমন আসা যাওয়া হয়না। আমার স্ত্রী আমেনার মা অসুস্থ। তাই দেখতে এলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখি সবাই যেমন ব্যস্ত ব্যস্ত।"
"ভাই সবাই কেন ব্যস্ত সেটা আপনার জানা উচিৎ ছিল। ঐ যে গেট দেখতে পাচ্ছেন সোজা ঢুকে পড়ুন। সেটাই মেডিকেলে ঢোকার গেট।" এই বলেই বরকত চলে গেল। বরকতকে পরিচয় করিয়ে দেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল সায়েন্সে বিএ করেছে এখন এমএ তে ভর্তি হয়েছে। বেশ সংস্কৃতিমনা ছেলে। প্রিয় কাজ কবিতা পড়া। রাজনীতির উপর আগ্রহ আছে। মুহম্মদ আলি জিন্নাহর বক্তব্য শুনতে রেসকোর্স ময়দান আর কার্জন হল দুই জায়গাতেই ছিল সে। তবে " উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের এক মাত্র রাষ্ট্র ভাষা" শোনার পর থেকে জিন্নাহ র প্রতি আকর্ষণ চলে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে তার সাথে অবশ্য তর্কও হয়েছে কয়েকজনের সাথে। আরে এত কষ্টের পর পাকিস্তান পাওয়া গেছে। জিন্নাহ তো চাইবেনই ৫ টি প্রদেশকে এক করতে! ৫ টি প্রদেশের রাষ্ট্র ভাষা ৫ রকম। এদের মধ্যে সম্প্রীতি আসবে কিভাবে!! বরকতের সোজা কথা, "তাই বলে এভাবে সম্প্রীতি আনতে হবে!! বাঙ্গালী মুসলমান কি আগে ছিলনা!! বাংলায় কোরআন কি আমরা পড়িনি? মনে নাই ৪০০ বছর আগে আব্দুল হাকিম কি বলেছিলেন?? যে জন বঙ্গে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার নির্ণয় ন জানি। ১০০০ বছর পুরানো আমাদের বাংলা ভাষা। ১০০০ বছর পুরানো আমাদের বর্ণমালা। আর তারা বলেন উর্দু বা আরবি হরফে বাংলা লিখতে। তাহলে ইংরেজি বর্ণমালাই বা রাখার দরকারটা কি?? সেটাকেও উর্দু হরফে দিয়ে দিক।" বরকত পোস্টার গুলা নিয়ে যাচ্ছে কারণ সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। রাতে অনেক মিটিং আছে। রাতে খাবার খাওয়ার সময় রফিকের বাবা রফিক কে বললেন আগামী কাল ঘর থেকে বের না হতে। প্রেসটাও নাকি খোলা রাখবে না। রফিকের বাবার প্রেস আছে। ৩ বছর হল রফিক মানিকগঞ্জ ছেড়ে প্রেসে কাজ করতে এখানে এসেছে। হঠাৎ রফিকের বাবার মনে হল কি জানি কাজ আছে একটা প্রেসে। রফিককে বললেন, ঠিক আছে। কিছু মুদ্রণের কাজ আছে সেটা জানি সে করে আসে। ২১ শে ফেব্রুয়ারী সকালে সালাম বুঝতে পারল না আজ অফিসে কাজ হবে কি হবেনা। পিয়ন হওয়ার যন্ত্রণা। সে তো আর মালিক না যে বিপদ বুঝে বলে ফেললেই হবে আর অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। পিয়নকে অন্যের কথা শুনতে হয়। সে অনেক সকালে গেটে এসে দাঁড়িয়ে থাকল।
সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হতে থাকল। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকল। মানি না মানব না রাষ্ট্র ভাষা বাঙলা চাই। উর্দুর পাশাপাশি বাঙলাকেও রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিতে হবে। এর কোন বিকল্প চলবে না। উর্দু হরফে বাংলা মানি না। পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানানোই ছিল ছাত্রদের উদ্দেশ্য।
পুলিশ উপস্থিত। তারা অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিকে প্রাচীর তৈরি করে ফেলল। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং উপাচার্য সে সময় উপস্থিত। বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামতে চাইলে পুলিস কাঁদানে গ্যাস বর্ষণ করতে লাগল। ছাত্ররা দুর্বার। কাঁদানো গ্যাস সহ্য করতে রাজি আছে কিন্তু কিছুতেই বাংলা ভাষার অমর্যাদা তারা সইবে না। মায়ের ভাষাকে অমর্যাদা করা যায়না।
কিছু ছাত্র এই সময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌড়ে চলে গেলেও বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আটকে পড়ে পুলিসের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিসকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে বললেন। তিনি ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করতে বলতে লাগলেন। কোন রকমের সহিংসতা যেন না ঘটে।। ছাত্ররাও ক্যাম্পাস ত্যাগ করা আরম্ভ করল। তখনই মূল সমস্যা শুরু হল। ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় পুলিস তাদের গ্রেফতার করা শুরু করল। অনেক ছাত্রদের গ্রেফতার করে তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। এই ঘটনায় ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী র দফতর থেকে কিছু মহিলাও তাদের এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাধা দিয়ে সভায় তাদের দাবি উত্থাপনের দাবি জানায়।
পরিস্থিতি আরো নাটকীয় হল যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা আইন সভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবে। পুরাটা সময়ের বরকতের বলিষ্ঠ কণ্ঠ বিদ্যমান ছিল। মেডিকেলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জব্বর দেখলেন বরকতকে। " আমাদের দাবী মানতে হবে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। আমাদের দাবী মানতে হবে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।" জোহরের নামাজ আদায় করার পর জব্বর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও মিছিলে যাবেন । সমগ্র বাঙ্গালি জাতি আজ এক। দীর্ঘদিন বার্মাতে থাকার কারণে ব্যাপারটা তিনি অনুধাবন করতে পারেননি। আজ বুঝতে পারছেন যে তিনি বাঙ্গালি। এখানে যারা আজ মিছিল করছে সবাই মায়ের ভাষাকে রক্ষার জন্য মিছিল করছে। তিনিও মিছিলে ঢুকে গেলেন। তখনও তার পরনে টুপি।
ওই দিকে রফিক সকালে প্রেসে কাজ করার সময় বাইরের সব খবর তার কানে আসছিল। কি জন্য ঢাকা আজ উত্তাল। সে এগুলোর সাথে পরিচিত নয়। প্রেসে ছাপানো কাগজের কাজ করছিল সে। বাচ্চাদের আদর্শলিপি। কাজ করতে করতে থেমে গেল সে।
আদর্শ লিপির ক, খ, গ, ঘ এর দিকে তাকাল। একবার হাত বুলাল প্রেসে তখন তার বাবা নেই। সে প্রেস থেকে বেরিয়ে এলো। ক, খ, গ, ঘ কে বাঁচাতে হবে। মায়ের ভাষাকে বাঁচাতে হবে।
রাওয়ালপিন্ডি থেকে নির্দেশ ছাত্রদের আটকাতে হবে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার লালবাগ থানার ওসি ছিলেন এম এ গোফরান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটি সেদিন তার দায়িত্বে। ঐ দিন ছাত্রদের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনকে বাংলা ভাষার দাবিতে স্মারকলিপি দেবার কথা ছিল। তখন ঢাকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (ডিএম) ছিলেন কোরেইশী নামের এক পাঞ্জাবি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রাত ১০টায় এম এ গোফরানের কাছে ডিসি স্বাক্ষরিত সেই চিঠিটি পৌছায় এবং তখনই তা সাধারণ ডায়েরি ভুক্ত করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজারবাগ থেকে স্পেশাল আর্মস ফোর্সের একটি বড় দল ক্যাম্পাসে আসে। তাদের ইন চার্জ ছিলেন পাঞ্জাবি কর্মকর্তা আর আই নবীশের খান। ঢাকার ডিএম কোরেইশী, ডিআইজিপি এ জেড ওবায়দুল্লাহ, এসপি ইদ্রিস ও এডিশনাল এসপি মাসুদ মাহমুদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্ররা ৫ জন একত্রিত হলেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে বলে ধরে নিতে প্রস্তুত ছিল পুলিশ। এ অবস্থায় বেলা ৩টা কি সাড়ে ৩টার দিকে ছাত্ররা ৪ জন করে অ্যাসেম্বলির হলের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তাতেও বাধা দেওয়া হয়। পুলিশের মারমুখী আচরণের প্রতিবাদে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। হোস্টেল থেকে বয়রা টুকরিতে করে, লুঙ্গিতে ভরে ইটের টুকরো ছাত্রদের কাছে সরবরাহ করতে থাকে। তারা নিজেরাও ইটপাটকেল ছুড়ে পুলিশকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। তখনি একটা অঘটন ঘটে। ডিআইজিপি ওবায়দুল্লাহর পিঠে ইট পড়ে। আর আই নবীশের খানের মাথায় পড়ে ইটের একটি টুকরো। তখনই ডিএম কোরেইশী গুলি করার নির্দেশ দেন । তবে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার নিয়াজ মোহাম্মদ খান ছাত্রদের মিছিল সমাবেশে বাধা দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেন। পুলিশ গুলি করল। পুলিসের গুলিবর্ষণে কিছু ছাত্র ছাত্র ছাত্রাবাসের বারান্দায় পড়ে গেল। আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। একজনের মাথার খুলি উড়ে গেল। হতভম্ব অবস্থায় সেই দৃশ্য তাকিয়ে দেখার সময় গুলি খেলেন বরকত। আরও গুলি লাগল সালামের। সবাইকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হল। তাদেরকে দেখে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে কর্তব্যরত ডাক্তার এবং নার্সরা পূর্বে আহত ছাত্রদের বের করে গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের চিকিৎসা করতে থাকেন। প্রেসে কাজ করা রফিক ইতিহাসের প্রথম ভাষা শহীদ । হাসপাতালে সেই সময় সম্ভবত আব্দুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন বরকতের পাশেই..... বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে উনার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, উনি বলে উঠে ছিলেন "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১ শে ফেব্রুয়ারী। আমি কি ভুলিতে পারি!" এটা সম্ভবত বাকিদেরও মনের কথা ছিল। তাই তারা পরদিনও ঝাপিয়ে পরে একই প্রত্যয় নিয়ে .......তার পরদিনও.......আজকেও, এমন আরও শত বছর পরেও........তারা কিছুতেই এটা ভুলতে পারে না কারণ তাদের ভাইয়ের রক্ত দিনটার গায়ে লেগে আছে।
ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে জনগণ ঘটনাস্থলে আসার উদ্যোগ নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত অফিস, দোকানপাট ও পরিবহণ বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলন সাথে সাথে জনমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়। রেডিও শিল্পীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শিল্পী ধর্মঘট আহবান করে এবং রেডিও স্টেশন পূর্বে ধারণকৃত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে থাকে।
বরকত আর সালাম দুইজনকেই মেডিকেলে নেওয়ার পর চিকিৎসা শুরু হয়। বরকতের লেখা পোস্টার তার বন্ধুর হাতে। এই পোস্টার সহই বরকতকে মেডিকেলে আনা হয়েছে। নিজে গুলি খাওয়ার থেকেও জব্বরের গুলি খাওয়ার দৃশ্যই যেন বরকতের কাছে বেশি দৃশ্যমান। রাত আটটার সময় ডাক্তাররা বললেন বরকতকে বাঁচানো যায়নি। সাথে সাথে তিনি অমর একজন ভাষা শহীদ হয়ে গেলেন। তার লেখা পোস্টার গুলা নিয়ে সবাই বলে উঠল, বরকত তুমি অমর। দীর্ঘদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে সালাম মারা যান ৭ই এপ্রিল।
লাশ রাতের আধারে কারফিউ'র সুযোগ নিয়ে সরকার লাশ কবর চাপা দিয়ে চেষ্টা করে ঘটনাটা চাপা দেবার কিন্তু তা হয়নায়। লাশ না পেয়ে আন্দোলনরত মানুষের সাথে সাধারন জনগণও যোগ দেয়, তারা জায়গায় জায়গায় গায়েবানা জানাযা পরে। পুরাটা সময়ই পুলিশ একই পদ্ধতিতে কারফিউ দিয়ে দিয়ে লাশ সরায়। ২২ তারিখে সারা দেশ হয়ে উঠে মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল।
জনগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করার পাশাপাশি শোক পালন করতে থাকে। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শহরের নাগরিক ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস পরিদর্শন করেন। পরে তাদের অংশগ্রহণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে বিশাল মিছিলে অংশগ্রহণ করে। বেলা ১১ টার দিকে ৩০ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। এই ঘটনায় সরকারি হিসেবে ৪ জনের মৃত্যু হয়।
শহরের বিভিন্ন অংশে একইভাবে জানাজা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে আর একটি বিশাল মিছিল পুলিশ দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা জুবিলী প্রেসে অগ্নিসংযোগ করে। কারণ জুবিলী প্রেস থেকে সকালের পত্রিকা বের হয়েছিল।
একই দিনে পুলিশ দ্বারা আক্রমণ ও হত্যার বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। শফিউর সাইকেলে করে অফিসে যাওয়ার পথে মিছিলে যোগ দেন। নবাবপুর রোডের বিশাল মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে ঘটনায় শফিউর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে মারা যান। একই রাস্তায় অহিদুল্লাহ নামে নয় বছরের এক বালকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুলিশ এর মাঝে কিছু লাশ কৌশলে সরিয়ে ফেলে। আজাদের (দৈনিক) তথ্যমতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৪ এবং সৈনিকের তথ্যমতে ছিল ৮ । বাঙ্গালি উত্তাল। বাঙ্গালি বাংলায় কথা বলতে চায়। বাংলার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়।
ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে ১৯৫২ সালে জেলে আটক ছিলেন রনেশ দাশ গুপ্ত ও মুনির চৌধুরী নামে অনেক লেখক-সাংবাদিক । রণেশ দাশ গুপ্ত গোপনে একটি চিরকুট পাঠান মুনির চৌধুরীর কাছে। একটি নাটক লিখে দেওয়ার অনুরোধ। যাতে করে জেলে থেকেও ভাষা আন্দোলনকে উপলব্ধি করা যায়। ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি নাটক লেখা হল। ১৯৫৩ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী জেলের সব কক্ষের বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর হারিকেনের আলোয় মঞ্চায়িত হল নাটক "কবর "। (পাঠ্য বইয়ে পড়া আমার প্রিয় লেখাগুলোর একটি। প্রতিবাদী চরিত্র মুর্দা ফকির প্রিয় চরিত্র।) এর বাদে তখন একুশের প্রথম সংকলন "একুশে ফেব্রুয়ারি " বের হল সম্পাদনায় ছিলেন হাফিজুর রহমান। ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম উপন্যাস " আরেক ফাল্গুন" লিখেছেন জহির রায়হান। ২৩ সে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সালে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। তবে সেটা ভেঙ্গে ফেলা হয় ২৬ শে ফেব্রুয়ারী। ১৯৫৩ সালে প্রথম বারের মত পালিত হয়
শহীদ দিবস । সবাই খালি পায়ে শহর প্রদক্ষিন করে শহীদদের মর্যাদা প্রকাশ করেন। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এতে অংশগ্রহণ করে।
১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। ১৯৫৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আবুল বরকতের পরিবারের সদস্যরা শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। অবশেষে, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেবার পরে ১৯৫৭ সালের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে।
১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ শহীদ মিনার আবার গুড়িয়ে দেওয়া হয়। যেই পাকিস্তানে এখন প্রতিনিয়ত মসজিদে বোমা বিস্ফোরিত হয় তারা শহীদ মিনার ভেঙ্গে লিখে রাখে "নামাজ পড়ার স্থান"। ২৭ শে মার্চ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম আর আমাদের সূর্য সন্তান রুমি যখন গাড়িতে করে পাকিস্তানিদের ধংসযজ্ঞ দেখতে বের হন শহীদ মিনারের এরকম অবস্থা দেখে জাহানারা ইমাম কেঁদে ফেলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন, "শহীদ মিনার, তোমার এই অপমানের শোধ আমরা নিব" ।
জাহানারা ইমামের কথা সত্যি হয়েছিল। শহীদ মিনারের অপমানের শোধ আমরা নিয়েছি। আজ শুধু বাংলাদেশে নয় সমগ্র বিশ্বে পালিত হয় এই দিবস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কানাডা প্রবাসী আব্দুস সালাম ও রফিকুল ইসলামকে তাদের অবদানের জন্য ধন্যবাদ।
পৃথিবীতে এখন মোট ভাষার সংখ্যা ৬৯১০ টি। সব ভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে শেষ একটা কথা দিয়ে লেখা শেষ করছি। এই যে পৃথিবীতে এত ভাষা এত এত বর্ণমালা। অনেক সমৃদ্ধশালী ভাষারই নিজেদের বর্ণমালা নেই । স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ভাষা লেখা হয় ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে। কিন্তু আমাদের আছে নিজেদের বর্ণমালা। কারো সাধ্য নেই আমাদের পছন্দের এই বর্ণমালা কেড়ে নেওয়ার। রক্ত ও ভালবাসা দিয়ে আমরা এটাকে পৃথিবীর বুকে চিরদিনের জন্য খোদাই করে দিয়েছি। পৃথিবীর প্রতিটা জাতিকে নিজেদের বর্ণমালা আর ভাষাকে ভালবাসতে আমরাই শিখিয়েছি। ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তাই এখন পাকিস্তানেও পালিত হয়। একুশ আমাদের চেতনা, একুশ আমাদের অহংকার। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা আর শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরের গানটি মনে হয় যেন সবসময় নতুন। ফেব্রুয়ারী আসলেই হৃদয়ে গানটি আমরা ধারণ করি। প্রবল আবেগ আমরা অনুভব করি বর্ণমালা নিয়ে সংগ্রাম করা নায়কদের কথা।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এই ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙ্গানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.