নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সপ্রসন্ন

সপ্রসন্ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সমুদ্রলগ্ন (গল্প)

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৫৪

দিকপ্রান্তে সমুদ্র আর আকাশের ভাব পুরনো। আজ সেখানে তাকালে ভ্রম হয়, তারা বুঝি নীলাম্বরী অপরাজিতার মত নীল আভরণে সজ্জিত হবার অলিখিত আয়োজন করে এসেছে। দিগন্তের ওপার হতে সমুদ্রজলকে ভাসিয়ে আনছে বিরামহীন ঢেউস্রোত। হাজার ঢেউয়ের মাথায় লক্ষ সফেদবিন্দুর মুকুট নিয়ে নীল ফেনিল জলরাশি সদর্পে চুমু খেয়ে যায় অপেক্ষারত বালুকারাশির জমিনে। আর সাথে বয়ে নিয়ে আসে বিশুদ্ধ বাতাস।

এখন জোয়ার চলছে। বিপুল গর্জনে সমুদ্রঢেউ তটরেখায় এগিয়ে আসছে ক্রমশ।

সেই দিগন্তসীমায় নিবিষ্টনয়নে এক তরুণী চিত্রার্পিত। তার মনও কী নিবিষ্ট সমুদ্রপানে? তাকে একাকী দেখা যায়। তার আঁখি দর্পণে প্রতিফলিত হয় সমুদ্রঢেউয়ের ছবিচিত্র। তার মনছবিও কি ঢেউয়ের মত বিক্ষিপ্ত নয়? হয়তো সমুদ্র ছাড়িয়ে আরো কোন অজানা ব্যাপকতায় তার চেতনা আচ্ছন্ন। সমুদ্র পেরিয়ে দূর মায়াদ্বীপের কোন রাজকুমারের সন্ধানে তার মনপ্রাণ ব্যাপৃত। সহসা বিপুল জলরাশি বালু পার হয়ে তার পদপল্লব ছুঁয়ে যায় সন্তর্পণে। কি আশ্চর্য! তার মন ছুঁতে পারে না এতটুকু। ভেজা হাওয়ায় তার খোলা চুল উড়তে থাকে লাল দোপাট্টার মত।

ওদিকে সমুদ্র ঢেউয়ের সাথে দুরন্তপনায় পাল্লা দিচ্ছে জনাকয়েক যুবাকিশোর। গোসলের সময়ও চোখে পড়ে তাদের চোখের বেমানান রোদচশমা। অবশ্য তাদের প্রাণোচ্ছল উচ্ছ্বাস নিশ্চিত করে, এটাই তাদের প্রথম সমুদ্রদর্শন। তাদের উল্লাসের শব্দ সমুদ্রগর্জনের সাথে মিশে যায়, কিন্তু উল্লাস হারিয়ে যায় না। তারা কি শহর থেকে এসে নেমে গেছে সমুদ্রস্নানে? শহুরে আগন্তুকদের স্নান ও সাঁতার প্রক্রিয়া তো ওয়াসার পানিতে চারদেয়ালের প্রকোষ্ঠে সীমাবদ্ধ। তাহলে তাদের হয়তো সাঁতার জানার কথা নয়! কে জানে, আপন আনন্দের কাছেই হয়তো সহজে সমর্পণ করা যায় আপন অজ্ঞতা।

সমুদ্রপারে ঠাণ্ডা ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। ঝলমলে আকাশে ঝকঝকে বাতাসে অবশ্য অনুমিত হয় না, দূরে কোথাও একটা ঝড় হয়েছে। তিরতির করে কাপছে সমুদ্রপারের ঘন ঝাউবন। নারকেল শাখে সূর্যালোকের বর্ণিল বিচ্ছুরণ। এসব কিছুই হয়তোবা অলখে প্রভাব ফেলে থাকবে বালুকাবেলায় পায়ের ছাপ আঁকতে আঁকতে হেঁটে যাওয়া নবদম্পতির। বাস্তবিকই এরকম নতুন জীবনে সবকিছুই মধুময় নয় কি? তাদের মুখরিত আলাপে সদ্য কথা বলতে শেখা শিশুর মতই নবোচ্ছ্বাস। বধূর অনভ্যস্ত সিঁথিতে সিঁদুরের লাল আভা। পাশে হাত ধরে রাখা হাতে যুবকের নিশ্চিত বন্ধন।

সাপরপাড়ের সমান্তরাল ঘেঁষে দণ্ডায়মান অনেক বসার জায়গা, তার ওপরে আছে ছাতার ছায়া। সমুদ্রের নীল প্রেক্ষাপটে এইসব মুঠোফোনের কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ছত্রছায়ায় লাল ছাতাগুলো বড় দৃষ্টিকটু দেখায়। তাদের তরঙ্গে কথা বলতে গুনতে হয় টাকা, তাদের দেয়া ছাতার নিচে বসতেও। এখানেও অবশ্য সমুদ্রদর্শনার্থীর সংখ্যা কম নয়। এদিকওদিক অনেক ভ্রাম্যমান ফেরিওয়ালার বিচরণ। তারা কেউ বিক্রি করে ঝালমুড়ি, কেউ বার্মিজ আচার। আর ক্রেতারাও কেনে সাগ্রহে, কিন্তু খাবার পর কাগজের টুকরা বালুতে অসহায় পড়ে থাকে। তারা কি জানে, গোপনে বালুকাবেলার প্রতিটি বালুকণা তাদের অভিশাপ দিয়ে যায়?

মনের কোঠরে সমুদ্রদৃশ্য বন্দি করতে না পেরেই কি ক্যামেরা হাতে আজ দেখা যায় অনেক মানুষকে? মনের ছবিতে দৃশ্যবন্দি করতে মন প্রয়োজন, হয়তো সেই অভাব থেকেই সবার হাতে হাতে এখন ক্যামেরা বা ক্যামেরাসমেত মুঠোফোন। আর ক্যামেরাহীনদের জন্যও আছে ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রী। তারা টাকার বিনিময়ে উপহার দেয় বাঁধানো মুহুর্ত। কেউ টাকা গুনে ক্যামেরা কেনে, কেউ ছবি কেনে টাকা গুনে। নানান ভঙ্গিমায় পোজ দিয়ে ফ্রেমে ফ্রেমে সময়কে ধারণ করার চেষ্টা করে সবাই। উত্তাল সমুদ্র ঢেউ হয়তো সেই ফ্রেমে আটকে পড়ে কিন্তু থমকে যায় না। চিরনতুন তরঙ্গমালা প্রতিবারই নতুন আকারে আছড়ে পড়ে বালুতটে।

অনেক মানুষের ভিড়ে সমুদ্র থেকে দূরে এক কোণায় দেখা যায় কিছু লোক জটলা বাঁধিয়ে দাঁড়িয়ে। তাদের ক্লিষ্ট মুখের অভাবী চেহারায় স্পষ্ট, তারা আজকের দিনের কাজের সন্ধানে ব্যস্ত। তারা কি রোহিঙ্গা? রোহিঙ্গা আর বাঙালির চেহারায় অবশ্য অনেক মিল, ভাষায়ও। আসলে আদৌ কি কোন পার্থক্য আছে নাগরিকত্ব ছাড়া। আফসোস, তারা কোন দেশের নাগরিকও নয়! শোনা যায়, এই সমুদ্রশহরে প্রতিদিনই ভেসে আসে অনেক রোহিঙ্গা। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে এখানে তাদের আগমন। কাজের অভাবে বাধ্য হয়ে তারা জড়িয়ে পড়ে অবৈধ কাজে। হায় বিপুলা পৃথিবী, জন্মই যদি দেবে তবে ঠাই নয় কেন?

একটু দূরেই মনের আনন্দে ঝিনুক কুড়িয়ে যাচ্ছে ইশকুল পড়ুয়া কিছু কিশোরী। হাতে রেখে ছবিও তুলছে তারা। সমুদ্রভ্রমণের আনন্দস্মৃতি হয়ে হয়তো এগুলো শোভা পাবে তাদের বাসার শোকেজে। কিছুক্ষণ পরই তাদের কাছে হাজির হয় মলিন মুখের এক শিশু, হাতে ঝিনুকের মালা। সেই ভোরে প্রথম ভাটার সময় সে এগুলো কুড়িয়েছিল, আজ বিক্রি করে কিছু টাকা পেয়ে পেট চালানোর আশায়। ঝিনুকের গর্ভধারিণী অসীম সমুদ্র কি জানে, কেউ তার ঝিনুক কুড়ায় আনন্দের নিমিত্তে আর কেউ কুড়ায় ক্ষুধা নিবৃত্তে?

সমুদ্রসংলগ্ন মানুষগুলোর মাঝে সবচেয়ে রোমাঞ্চিত কি কবিরা? সমুদ্রদর্শনে সবাই মুগ্ধ হয়, কিন্তু মুগ্ধতার ভাষা তৈরি করতে পারে কয়জনইবা! এরকমই একজন কবিমনের তরুণকে দেখা যায় একাকী। একই সময় তার বন্ধুরা জলে দাপাদাপি করছে কিন্তু কিসের কারণে সে একলা দাঁড়িয়ে আছে? হয়তো নানারকম দার্শনিক চিন্তায় ডুবে আছে সে। কজন ঝিনুক কুড়ানো কিশোরী দেখে সে ভাবে, জীবনের এই জ্ঞানসমুদ্রে তার জানার পরিধিও এই কুড়ানো বিশাল বালিতে পড়ে থাকা কয়েকটা ঝিনুকের মতই। এরপর কিছু কবিতার লাইন তার মাথায় আপনাতেই খেলা করতে থাকে। সমুদ্রধ্বনির গর্জন তার মনে কাব্যিক অনুপ্রাসের দ্যোতনা তৈরি করে। এমন নিবেদিত কবিপ্রাণকে পেয়ে নীল দরিয়া অশান্ত কল্লোলে কিন্তু ফিসফিসিয়ে তাকে তার মনের কথা শুনিয়ে যায়।

ঢেউয়ের নাগরদোলায় চেপে শত ফেনিল বুদবুদ ক্রমে মিশে যায় বালুতে। অদ্ভুত শব্দ করে। সেই রহস্যময়ী তরুণী তখনো দাঁড়িয়ে আছে একাকী। তার পায়ের নিচে ঢেউয়ের ধাক্কা সরিয়ে নিচ্ছে পায়ের তলার বালি। এই মায়াবী শিহরণ কি সে টের পাচ্ছে না? চারদিকে জীবনের সমুদ্রসফেন। তবু জীবনের বিবিধ জটিলতা পাশ কাটিয়ে তার স্বপ্নালু চোখ খুঁজে বেড়ায় কোন স্বপ্নপুরুষকে। মাতাল হাওয়ায় সামুদ্রিক ভেলায় চড়ে সে ভেসে যাবে দূর সমুদ্রের দূরতম কোন দ্বীপে। এরপর সেই দ্বীপবাসীটিকে জানাবে, “আমি পেয়েছি তোমার জীবনের চিরন্তন সমুদ্রস্রোত!”

অনতিদূরে মগ্ন কবিও নিভৃতে খুজতে থাকে তার স্বপ্নকন্যা। সমুদ্রপানে চেয়ে সে ভাবে, গভীর সমুদ্রের আরো গভীরে কোন সমুদ্রনন্দিনী কি হারিয়ে আছে তার জন্য? বিশাল সাগরের সমুদ্রকূল খুঁজে না পাক, সমুদ্রতল সে ঠিকই খুঁজে বের করে হাজির হবে সেই স্বপ্নমানবীর কাছে। এরপর জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় স্পন্দিত করে তাকে বলবে, “আমি পেয়েছি তোমার শরীরের সমুদ্রলোনা ঘ্রাণ!”

এখন ভাটা চলছে। বিপুল গর্জনে সমুদ্রঢেউ তটরেখা থেকে দূরাগমন করছে ক্রমশ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.