নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সংবর্ত

আমি এই ব্লগের নীতিমালা মেনে আমার সৃজনশীলতা বিকাশের চেষ্টা করব

সুব্রত মল্লিক

আমি একজন শিক্ষক...শিক্ষকতার পাশাপাশি পড়তে লিখতে ভালোবাসি..

সুব্রত মল্লিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাজারমুখী প্রতিযােগিতা ও শিশুর মেধাবিকাশ

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:২৭

সময়ের পরিক্রমায়; বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে; কালের কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই হয়ে মানবসভ্যতা আজ যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে আমরা আধুনিক মানব সভ্যতার চুড়ান্ত রূপ বা অবস্থান হিসেবে অভিহিত করে থাকি। আর মানবসভ্যতার এই উৎকর্ষ সাধন বা উত্তরণের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি অবদান রেখেছেন যুগে-যুগে অবতীর্ন সেইসব মহামনীষী.. প্লেটো, এরিস্টটল, আর্কিমিডিস, কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, আর্যভট্ট, আলবেরূনী, কার্ল মার্কস, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ আরও অনেকে যাদের নাম বলে শেষ করা মুশকিল। তাদের মেধা আর মননের উৎকর্ষতায় ধন্য হয়েছে মানব সমাজ। ব্যক্তি জীবনে তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন অসাধারণ মেধাবী, মননশীলতার বিচারে অদ্বিতীয়। যা প্রকাশ পেয়েছে তাদের প্রতিটি কথায়; প্রতিটি কাজে আর সর্বোপরি তাদের মার্জিত রুচির বহিঃপ্রকাশে।



কিন্তু আজ সমাজ বদলে গেছে। বদলে গেছে সময়-দেশ-কাল আর সর্বোপরি সকল কিছুর সংগা। আজকের মানব সভ্যতা এগিয়ে চলেছে কর্পোরেট বানিজ্যের স্লোগান নিয়ে। বাণিজ্য লক্ষ্ণী আজ প্রবেশ করেছে মানব সভ্যতার সকল অনু-পরমানুতে। একটি শিশু হাটি হাটি পা-পা করে যখন কংক্রিটের আবর্তে গড়ে ওঠা বর্তমান মানব সমাজে প্রবেশ করছে, তখনই তাকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ভয়ানক প্রতিযোগিতার মুখে। তাকে ভালো স্কুলে ভর্তি হতে হবে---আর এই ভর্তি পরীক্ষা নামক যুদ্ধক্ষেত্রের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে মুখস্থ বিদ্যা। কোমলমতি শিশুটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচেছ সাধারণ জ্ঞান-অংক-বিজ্ঞান থেকে শুরু করে---ইতিহাসকে সাথে নিয়ে ভূগোলের গোলক ধাঁধায় । এর সাথে আছে এক-দুই-এমন কি তিনজন পর্যন্ত গৃহ শিক্ষকের আনাগোনা আর কোচিং ক্লাসে বিরমিহীন ছুটে চলা । তাকে শুধু ভাল স্কুলে ভর্তি হলেই চলবে না-তাকে হতে হবে ক্লাসের প্রথম। গানের শিক্ষকের কাছে শিখতে হবে গান; নাচের শিক্ষকের কাছে নাচ---। শুধু এটুকু হলেই হবে না-পাশের বাসার ছোট্ট ছেলেটি কি সুন্দর ইংরেজী বলে আদো আদো সুরে সুতরাং ওকে ইংরেজি শেখাতেই হবে, না হলে সোসইটিতে মুখ দেখানো যাবেনা। শুরু হলো নতুন আর এক অধ্যায়। না এখানেই শেষ নয়! বর্তমান যুগ কম্পিউটারের যুগ আর তাই ছোট্ট শিশুটিকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে কম্পিউটার মাউসের সাথে----সাথে একটু টাইপিং, ই-মেইল আদান-প্রদান আর নিত্য নতুন কম্পিউটার গেমস খেলার অভ্যাস গড়ে তোলা। এ আর এমন কি! বর্তমান প্রতিযেগিতার বাজারে টিকে থাকতে হলে তাকে এই ছোট খাটো কাজটুকু শিখতেই হবে, নইলে পিছিয়ে পড়বে বাজারমুখী প্রতিযোগিতা থেকে। ওই যে ডারউইন সাহেব বলেছিলেন “survival of the fittest” আর তাই ছোট্ট শিশুটিকে শিখতে বাধ্য করা হচ্ছে survive করার বিভিন্ন কলাকৌশল, যা বোধ হয় মহাভারতের সেই চক্রব্যুহ ভেদ করা অভিমন্যুও পারতেন না।



এত সব কাজের ভার সামলে সে খেলাধূলার কোন সময় পায়না; পায়না কোন গল্পের বই পড়ার সুযোগ; পায়না কোন কিশোর সাহিত্যের সংস্পর্শ, এমনকি কোন অবসর। বাবা-মায়ের ধারণা এগুলো করে কোন লাভ নেই কারণ এগুলো ক্লাসে প্রথম হওয়াতে সাহায্য করবেনা বরং ক্ষতিই করবে। হায়রে কর্পোরেট জগতের বাবা-মা! খেলাধূলা হল শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্যতম মাধ্যম, এর মাধ্যমে শিশুর মাঝে গড়ে ওঠে নেতৃত্বের গুনাবলী। সাহিত্য হল মনের জানালা, মননশীলতার বাহন আর তাই কোমলমতি শিশুদের মনের জানালা যদি নাই খোলে তাহলে তাদের মানসিক বিকাশ কিভাবে হবে! স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থই বলেছেন “যে শিক্ষা ‘নেতি’ ভাবকে প্রবর্তিত করে, সে শিক্ষা মৃত্যু অপেক্ষাও ভয়ংকর। কতকগুলো তথ্য মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হল, সারা জীবনেও সেগুলো হজম হল না, সব তথ্যগুলো এলোমেলো ভাবে মাথায় ঘুরতে লাগলো-এটা শিক্ষা নয়। আজকালকার শিক্ষা পদ্ধতি মনুষ্যত্ব গড়ে তোলে না, গড়া জিনিস ভেঙে ফেলতে পারে।’’



বৃটিশ ভারতে আমরা দেখেছি জ্ঞানীদের নক্ষত্রপুঞ্জ- রাজা রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দ, জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন বোস, সুভাষ বোস, চিত্তরঞ্জন দাশ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, এ কে ফজলুল হক কাজী নজরুল ইসলামের মত মহামনীষীদের। এরপর বৃটিশ পরবর্তী সময়ে পেয়েছি ডঃ মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ, সত্যজিত রায়, মুনির চৌধুরী, শহীদুলস্নাহ কায়সার, মাওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমেদ আর বঙ্গবন্ধুর মত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বর্তমান সময়ে কি আমাদের এই বঙ্গ জননী কি পারছেন তাদের মানের মনীষীকে জন্ম দিতে! না পারছেন না। আর এখানেই প্রশ্নটা অবধারিত ভাবে এসে যায়, তবে কেন আমাদের রত্নগর্ভা বঙ্গ জননীর গর্ভে আজ ভাটির টান? কারণ আর কিছুই নয় বদলে যাওয়া সময়; বদলে যাওয়া সমাজ, বদলে যাওয়া ধ্যান ধারনা।



একটি শিশুর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন রুচিশীল সংস্কৃতি চর্চা, মার্জিত শিক্ষা আর সর্বোপরি তার নিজস্ব ভাবনাকে প্রস্ফুটিত হতে দেওয়া। যার মাধ্যমে সে বুঝতে পারে এই মানব সমাজকে, নিজেকে মনে করতে পারে এই সমাজের একজন সদস্য হিসাবে আর সর্বোপরি বিকাশ ঘটাতে পারে তার অন্তরে লুকায়িত অমিত সম্ভাবনাকে। প্রাচীন ভারতবর্ষে শিক্ষার্থীরা তাদের গুরুগৃহে প্রবেশ করতো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। যেখানে ছিলনা কোন প্রতিযোগিতা, এমনকি ভীতিকর মুখস্থ বিদ্যার আনাগোনা। যেখানে ছিল নতুন কিছু পাওয়ার আকাঙ্খা, অজানাকে জানার আগ্রহ আর নিজেকে গুরুর পদতলে সঁপে দিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। আর বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে একটি শিশু কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মুখস্থ বিদ্যা আর প্রতিযোগিতার চক্রব্যুহে।



আমি হলফ করে বলতে পারি যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জিপিএ ৫ পাওয়ার ইদুর দৌড়ে সামিল হয়ে রাতদিন পাঠ্য পুস্তকে মুখ গুজে বসে থাকতে হত, তাহলে আমরা তার কাছ থেকে এই সাহিত্যকর্ম পেতাম না....কাজী নজরুল ইসলামের মস্তিষ্কপ্রসূত বিদ্রোহী কবিতার মতো স্ফুলিংগ বের হতো না....বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাও তৈরি হতো না।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হলো জ্ঞান চর্চার সবচেয়ে উপযুক্ত ক্ষেত্র। কারন যৌবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টি আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটাই, কিন্তু এই সেমিস্টার সিস্টেমের নাম করে সেখানেও চলছে সৃজনশীলতাকে রুদ্ধ করার এক নির্মম প্রতিযোগিতা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লাস এরপর ক্লাস টেস্ট, কুইজ, প্রেজেন্টেশেন, ভাইভা, সেমিস্টার ফাইনাল, স্যারদের পেছনে ঘুরে ঘুরে তেল দেওয়া…সবকিছু মিলিয়ে একজন ছাত্রের হাতে সময় নেই পাঠ্য পুস্তকের বাইরের কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার। এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময় যখন একজন ছাত্র একটি বিশ্বসেরা বই পড়ে তার বন্ধুকে পড়তে বলবে, তাদের মধ্যে মতবিনিময় হবে, ভাবনার আদান প্রদান হবে, তাদের মননশীলতা একটু একটু করে বিকশিত হবে আর বিশ্বসেরা বইয়ের আলোয় আলোকিত হবে তাদের হৃদয়। পাঁচ বছর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে বের হয়ে আসবে একেকটা আলোকিত মানুষ, যাদের আলোর বিভায় বিভাসিত হবে গোটা সমাজ। অথচ আমরা দেখছি ঠিক তার উল্টোটা…বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা গ্রাজুয়েটই কিন্তু হচেছ বড় বড় অফিসের বড় বড় কর্তাব্যক্তি। আর এই কর্তা ব্যক্তিরাই ব্যক্তিস্বার্থ চরিতাতর্থ করার মানসে করে চলেছেন সকল প্রাতিষ্ঠানিক অপকর্ম…আর পেছনে পড়ে থাকছে সাধারণ মানুষের হাহাকার, যাদের করের টাকা না হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলতই না। তো এখানে দোষটা কার? বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ছাত্রটির নাকি বর্তমান সিস্টেমের? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্রটি কিন্তু শুরুতেই থাকে একতাল নরম কাদা, আর ঐ নরম কাদাটুকু ছাঁচে ফেলে গড়ে তোলার দায়িত্ব বর্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। আর এক্ষেত্রে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কত নম্বর পেতে পারে সেটি একটি বড় ভাবনার জায়গা।



হ্যাঁ বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতার প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা শুরু হোক কিছুদিন পর থেকে। তার আগে কোমলমতি শিশুটিকে গড়ে উঠতে দেওয়া হোক তাঁর মত করে। সে আগে নিজেকে জানুক, এই সমাজকে জানুক, খুঁজে পাক সমাজে বেঁচে থাকার আনন্দময় দিকগুলো। পাশ্চাত্য বিশ্বকে বলা হয় পুঁজিবাদের সূতিকাগার কিন্তু সেখানে শিশুর মনোজগতকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়না। তারা শিশুদের গড়ে উঠতে দেয় তাদের মত করে, তাদের পছন্দের মূল্যায়ন করা হয়, তাদের সৃজনশীলতাকে বিকশিত হতে সাহায্য করা হয়। তাইতো পাশ্চাত্য বিশ্বে এত বিজ্ঞানী, এত সাহিত্যিক, এত শিল্পী, এত গবেষক, এত---।





বিপরীতে আমরা শুরুতেই আমাদের শিশুদের নিয়ে শুরু করি এক অশুভ প্রতিযোগিতা। যেখানে শুধু গতির লড়াই, প্রথম হওয়ার লড়াই। যে লড়াইয়ে লড়তে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে শিশু মনোজগত । ফল স্বরূপ আত্নকেন্দ্রিকতার ঘোরটোপে আবদ্ধ হচ্ছে শিশুরা, তাদের মননশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিযোগিতার চোরাবালিতে। আর তাই এখনই সময় শিশুদের নিয়ে ভাববার, তাদেরকে তাদের মত করে বেড়ে উঠতে দেয়ার। পরিচ্ছন্ন, প্রতিযোগিতাহীন নির্মল বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে পরিগনিত হোক শিক্ষা। এই শিক্ষার মাঝে তাঁরা খুঁজে পাক এক অনিঃশেষ সৌন্দর্য। আর এই সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়ে আলোকের ঝর্ণাধারা হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে। শিশুদের মেধার জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় বদলে যাক এই ঘূনে ধরা সমাজ। শিশুরা পারবে-কারণ ওদের অমত্মরে লুকিয়ে আছে অনাবিষ্কৃত মুক্ত মানিক্য যা খুঁজে বের করে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রাথমিক দায়িত্ব আমাদের সমাজের অভিভাবকদের, সর্বোপরি সকলের।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.