নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সংবর্ত

আমি এই ব্লগের নীতিমালা মেনে আমার সৃজনশীলতা বিকাশের চেষ্টা করব

সুব্রত মল্লিক

আমি একজন শিক্ষক...শিক্ষকতার পাশাপাশি পড়তে লিখতে ভালোবাসি..

সুব্রত মল্লিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

নারীর জয় সবার জয়

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:২৯

‘‘নারী সম্ভবত মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত প্রাণী’’ কথাটি ভার্জিনিয়া উলফের। নারী হচ্ছে সেই রহস্যময় সত্ত্বার একটি অনন্য প্রকাশ যার রয়েছে সুদীর্ঘ পদযাত্রার এক বিপরীতমুখী ইতিহাস। নারী একদিকে শোষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, পুরূষতন্ত্রের শিকলে বন্দী এক পরাশ্রয়ী প্রাণী আবার ঠিক তার উল্টোদিকে এই নারীকে নিয়েই পুরূষ সৃষ্টি করেছে এক কল্পনার জগত। সঙ্গীত, সাহিত্য, শিল্পকলার এক আদি এবং অকৃত্রিম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে নারী। নারীকে নিয়ে পুরূষ সৃষ্টি করেছে নানা রকমের আখ্যান-কাব্যগাথা। রোম্যান্টিক কবি রাতের পর রাত নিদ্রাহীন থেকেছেন নারীকে নিয়ে একটি অসাধারণ পঙক্তি রচনার অভিপ্রায়ে। তাইতো বিশ্বকবির কণ্ঠে শুনতে পাই

‘‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!

পুরূষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারী’’।



সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সৃষ্টির শুরুতে মাতৃতান্ত্রিকতার জয়গানে মুখরিত ছিল মানবসমাজ। এই নারীর হাত ধরেই সম্ভবপর হয়ে উঠেছে কৃষির আবিষ্কার, মানুষ পেয়েছে সমাজে যুথবদ্ধ হয়ে বসবাসের ধারণা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দেখা গেল নারীর ক্রমে পিছিয়ে পড়তে থাকল সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে। পুরূষতন্ত্র ক্রমে এগিয়ে এল, দখল করে নিল নারীর আসন। কিন্তু কেন নারী জাতির এই ঐতিহাসিক পরাজয়?



এঙ্গেলস বলছেন, কৃষি আবিষ্কারের পর ক্রমে সম্পদ বাড়তে থাকে, আর সম্পদই শত্রু হয়ে দেখা দেয় নারীদের সমানে। পুরূষ যখন জমির মালিক হয়, সে তখন নারীর মালিকানাও দাবী করে। জমি আর নারী পুরূষের কাছে হয়ে ওঠে অভিন্ন এক সত্ত্বা। আরেক মতবাদে দেখা যাচ্ছে, পিতৃত্বের রহস্যটি যখন জানা হয়, তখনই ঘটে পুরূষতান্ত্রিক বিপ্লব। আগে মনে করা হতো নারীদের গর্ভে দৈব প্রক্রিয়ায় পুনরায় শিশু হয়ে জন্ম নেয় পূর্বপুরূষেরা, কিন্তু পিতৃত্বের রহস্য জানার পর পুরূষ প্রজননে নারীর ভূমিকাকে অস্বীকার করে নিজের ভূমিকাকেই গুরম্নত্বপূর্ণ বলে ঘোষণা করে।



ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এই নারী মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রয়াস পেয়েছে, কিন্তু মূল বাঁধাটি এসেছে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে। বিশেষ করে ধর্মকে যুগে যুগে ব্যবহার করা হয়েছে মুক্ত চিন্তার নারীদের বিপক্ষে। ‘ম্যালিয়াস মেল ফিকারাস’ বা ‘ডাইনী শায়েস্তাকরণ’ এমন একটি মতবাদ, যাতে বলা হয়েছে ‘‘মুক্তচিন্তার নারীরা বিপজ্জনক’’। আর পুরোহিতদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কীভাবে মুক্তচিন্তার নারীদেরকে খুঁজে বের করে অত্যাচার করে ধ্বংস করা যেতে পারে। চার্চ যাদেরকে ডাইনী বলে মনে করেছিলো তাদের মধ্যে জ্ঞানী, নারী যাজক, জিপসি, আধ্যাত্নিক নারী ব্যক্তিত্ব, প্রকৃতি প্রেমী, লতাপাতা সংগ্রহকারী এবং প্রাকৃতিক বিশ্বের সাথে মিলে যায় যে কোনো নারী। ইউরোপে ১৪০০ থেকে ১৭০০ অব্দের মধ্যে তিন শত বছর ধরে ডাইনী শিকারের সময় চার্চ অবিশ্বাস্য সংখ্যক পঞ্চাশ লক্ষ নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলো।



আমরা যদি বাংলার নারীদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তাহলে দেখতে পাই, ঊনিশ শতকের পূর্বে হাজার বছর ধরে বাংলার নারী ছিলো গাঢ় অন্ধকারে, তার নিজের কোনো সত্ত্বা ছিলোনা, স্বাধীনতার কথা সে কখনো শোনেনি, তার কোনো স্বপ্ন ছিলো কিনা তা কেউ জানেনা। পুরূষ তাকে পশুর থেকেও নিকৃষ্টরূপে বাঁচিয়ে রেখেছে। আগুনে পুড়িয়েছে, ইচ্ছেমতো গ্রহণ করেছে ও ছেড়েছে, তাকে অবরোধের কারাগারে আটকে রেখেছে।



১৮১৭ সালে যেদিন হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেদিনই অনিবার্য হয়ে ওঠে নারী শিক্ষা-শুরু হয় বাংলার নারী শিক্ষার বীজ বপন। ঊনিশ শতকে আবির্ভাব ঘটে কৈলাসবাসিনী দেবী, বামাসুন্দরী, কুমুদিনী, জ্ঞানদানন্দিনী প্রমুখ গৃহ-শিক্ষিত নারীর। যারা সূচনা করেছিল নারীর অগ্রযাত্রার এক নয়া ইতিহাসের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম ভারতবর্ষীয় আইসিএস অফিসার যেভাবে স্ত্রীকে শিক্ষিত করে তোলেন, তা নিজের জন্য উপযুক্ত স্ত্রী সৃষ্টির এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে। এর সাথে রাজা রামমোহন রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় হিন্দু নারীরা সতীদাহের মতো ঘৃন্য প্রথা থেকে মুক্তি পায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিরলস পরিশ্রমের কারণে হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ চালু হয়। বিদ্যাসাগর বাংলায় নারী শিক্ষা প্রসারে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন। বেগম রোকেয়া স্মরণীয় হয়ে আছেন বাংলার নারীদের চিরকালীন অবগুন্ঠনকে ভেঙে নারীর জন্য এক মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির অভিপ্রায়ে অবরোধবাসিনী, মতিচুর প্রভৃতি নারীমুক্তির এক অনন্য দলিল রচনায়। ১৯২৭ সালে ফজিলাতুন্নেসা নামক অকুতোভয় নারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম যখন গণিতে এমএ পাশ করেন তখন তাঁর পরীক্ষার ফল জাতীয় উলস্নাসে পরিণত হয়।



আমরা যদি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ছবিগুলি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখি, তাহলে দেখতে পাই নারীর সগর্ব উপস্থিতি। এরপর ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখতে পাই। তবে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহন আমরা দেখতে পাই গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশের হাত ধরে। এর বাইরে গ্রামীন ব্যাংক, ব্র্যাকের মতো বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে নারী ঘর ছেড়ে বাইরে এসছে, সম্পৃক্ত হয়েছে মূলধারার অর্থনীতির সাথে। স্বাধীনতার পর জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে আমরা উন্নয়নশীল বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি, যদিও কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা আমাদের অর্জিত সাফল্যকে কিছুটা ম্লান করেছে। আজ আমাদের দেশের তিন স্তম্ভ প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও স্পীকার এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অবস্থান করছেন তিনজন নারী।



আজ আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ শতভাগ। উচ্চশিক্ষায় নারীরা এগিয়ে আসছে, নিশাত মজুমদারের মতো নারী এভারেস্ট জয় করে দেখিয়ে দিচ্ছে যে সুযোগ পেলে নারী সর্বোচ্চ শিখর কেন, সবকিছুই জয় করতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু কিছু সাফল্য পেলেও নারীর অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে কাঙ্খিত সাফল্য এখনও অধরা। নারীর অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে বাঁধা আসছে বিভিন্ন দিক থেকে। বেগম রোকেয়া যথার্থই বলেছিলেন, ‘‘যখনই কোনো ভগিনী মস্তক উত্তলোনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে...আমরা যখনই উন্নত মস্তকে অতীত ও বর্তমানের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, অমনই সমাজ বলে; ঘুমাও ঘুমাও, ঐ দেখ নরক। মনে বিশ্বাস না হইলেও অন্তত আমরা মুখে কিছু না বলিয়া নীরব থাকি’’। তাই আজ সময় এসেছে সমাজের সবার এগিয়ে আসার। কারণ নারী-পুরূষ কেউ অসম নয়, তাদের কারো ভূমিকা কম মুল্যবান নয়, তাদের উভয়ের ভূমিকাই সমান মূল্যবান। তারা সমান এবং পরস্পরের পরিপূরক। তাই নারীর জয় মানে পুরূষের পরাজয় নয়...বরং নারীর জয় সমাজের দুটি অংশের মাঝে পারস্পরিক বাতবরনের এক অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মানব সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কাঙ্খিত ঠিকানায়। উদ্ভাসিত হবে নতুন এক সমাজ ব্যবস্থার। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলি-

‘‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি

চির কল্যানকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,

অর্ধেক তার নর’’।

তথ্যসূত্র:

১. আজাদ হুমায়ুন, নারী

২. ব্রাউন ড্যান, দ্যা ভিঞ্চি কোড

৩. চট্টোপাধ্যায় শরৎ, নারীর মূল্য

৪. রোকেয়া বেগম, অবরোধবাসিনী

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.