নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুকান্ত কুমার সাহা

I like to seek knowledge.

সুকান্ত কুমার সাহা › বিস্তারিত পোস্টঃ

এডিসন’রা এখনো ভোগায়!

০৯ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:০৯

আমি ছোটবেলায় গারো ছেলেদের দেখেছি, ওরা নিজ ভূমি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল কাজের খোঁজে দেশের ভিতরেই অনেক জায়গায়। তাদের কয়েকজন আমাদের বাড়িতেও কাজ করত; খুবই নিম্নশ্রেণীর কাজ! এই যেমন - গরুর রাখাল, বাড়ীর পাহারাদারসহ আরও অনেক শ্রমঘন কাজ কিন্তু মজুরী ছিল অনেক কম, পেটে-ভাতে আর মাসে মাসে কিছু টাকা। এ নিয়েই তারা খুব সন্তুষ্ট থাকতো।

ওরা ছিল অসম্ভব বিশ্বাসী। লক্ষ টাকা ওদের হাতে দিলেও তা থাকতো নিরাপদ! আমাদের মা-দিদিরা ওদেরও মা-দিদি হয়ে যেত! যে বাড়ী বা পাড়ায় ওরা থাকতো- সে এলাকা চোরেরা মাড়াতও না কারণ চোররা জানতো ওরা নাকি বাঘ-হাতির সাথে যুদ্ধ করে, রাতে তাদের মতই চোখে দেখে আর কোমরে দা নিয়ে ঘোরে; যা আবার যখন তখন ব্যবহারও করে। এই ভয়েই এলাকায় চুরি বন্ধ থাকতো। আবার রাতে ওরা খুব সুন্দর বাঁশী বাজাত, যমুনার বাতাসে তা ছড়িয়ে পড়তো আমাদের পুড়ো পাড়ায়। ভাল লাগতো সেই সুর। ভীষণ ভাল!

ওরা ছিল সরল, খুবই সরল। আমাদের গরুর রাখাল এডিসন; মাঝে মাঝেই গরুর খাবারের চারি থেকে হাতের আঁজলে জল মেশানো খাবার তুলে মুখে দিত। একদিন আমার বড়মা ওকে জিজ্ঞাসা করলো, হ্যাঁরে এডিসন তুই এটা কি করস? এডিসনের উত্তর ছিল, দ্যাখো না বড়মা, এত সুন্দর করে খাবার বানিয়ে দেই তাও ওরা খায় না, তাই খেয়ে দেখলাম লবণ হয়েছে কিনা! স্বাদ কেমন! গরুরাও ওকে খুব পছন্দ করত; কথা মানতো ওর। এমনকি নদীতে স্নান করতে নেমে যেতে বললেও একাই নেমে স্নান-টান করে উঠে আসতো গরুরা। অথচ যে জানে, সে নিশ্চয় বুঝবে গরুকে স্নান করানো কত কষ্টের। তাও আবার নদীতে? গুঁতা-লাত্থি কারে কয় যে খেয়েছে সে ঠিক জানে।

একদিন খুব শীতের সকালে পরিচিত একজন গারো আদিবাসী; হাফপ্যান্ট পড়া খালি গায়ের ছোট একটা কালো ছেলেকে নিয়ে এসে হাজির আমাদের বাড়ীতে যার নাক মুখে তখনো সর্দি-ময়লায় জট পেকে আছে। সেই মানুষটি ছেলেটিকে আমার জ্যাঠার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “বড়বাবু ছেলেটাকে আপনার বাড়ীতে রেখে দেন, খুবই গরীব আর এতিম। আমার ভাগ্নে, রেখে দেন ওকে”। তখন আমাদের বাড়ীর অবস্থা এমন ছিল যে, এই রকম দুই-পাঁচটা ছেলেকে রেখে কাজে লাগানো ছিল ডালভাত। আর বড়মা তার বিশাল গরুর পালের জন্য এমন ছেলেই খুঁজছিল। তাই ছেলেটির কাজ হাতেনাতে মিলে গেল। অপরদিকে আমার বাবার টোটকা চিকিৎসা আর বাড়ীর খাওয়ায় সুস্থ-তাগড়া হয়ে গেল এক মাসেই। বড় ষাঁড়েরাও ওকে সমজে চলতে শুরু করলো। - সেই ছেলেটি ছিল আমাদের এডিসন।

কিন্তু ওরা ছিল চরম নিরীহ। আমরা বাঙালীরা অনেকেই ওদের চরম অপমান করতাম! খেপাতাম! দেখে আমরা ছোটরা মজাও পেতাম, কখনো কখনো পেতাম কষ্ট! খুব কষ্ট! তাদের অপমানিত হতে দেখে! শেষের দিকে বাধা দিতাম বড়দের এসব করতে; আর ছোটদের দিতাম দৌড়ানি, ঠ্যাঙ্গানি নগদে! তাতে বড়রাও বুঝতো আমাদের মোটিভ! থেমে যেত তারা!

আমরা দেখেছি ও বুঝেছি- ওদের মধ্যে ছিল সবাইই ছিল কম-বেশী শিক্ষিত ও জ্ঞানী। কখনো তারা তা প্রকাশ করত না; কিছু বলতোও না কাউকে। কিন্তু আমরা জেনে ফেলেছিলাম ওদের আদান প্রদানের চিঠি দেখে। ওরা যে সেই সময়েই ইংরেজিতে চিঠি লিখতো। গোপনে ইংরেজি ভাষার বড় বড় বই পড়ত; যা ছিল আমাদের বড়দের কল্পনার বাইরে। কেউ কেউ ছিল বিএ পাশ বা তারও বেশী কিন্তু কাজ করত কামলার!

পরবর্তীতে আমাদের ধারণা পাল্টাতে থাকে ওদের প্রতি; কেউ কেউ গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে থাকে পার্ট টাইম জব হিসেবে কারণ রাতে থাকতো পাহারার কাজ বা দিনে কামলার! কেউ কেউ দায়িত্ব পায় ব্যাংকে, মহাজনের নগদ টাকা লেনদেনের বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসেবে। আর ছিল ছোট বাচ্চা স্কুলে আনা নেওয়ার কমন ডিউটি। তবে একটাই সমস্যা ছিল ওদের নিয়ে; একবার ছুটিতে বাড়ী গেলে সহজে আসতো না, ওদেরই কাউকে দিয়ে খবর পাঠাতে হত। কখনো কখনো রিপ্লেস আসতো। আর ছিল অভিমানী ভীষণ! ওদের নিজেদের মধ্যে বলা ভাষাটা আবার আমরা কেউ বুঝতাম না; যা ওদের খেপানোর একটা কারণ ছিল।

ওদের দেখে আমাদের খুব কষ্ট হত! এখনো মনে পড়লে হয়। শরৎ, এডিসন নাম গুলো মনে পড়ে মাঝে-মধ্যে! তাদের সাথে কাটানো ছোটবেলাটা; ভোগায়।

আর ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষ দেখলে কষ্ট হয়!

বুঝি !!!

৮/১১/২০১৪ রাত, ১০.১৮

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.