নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নব নব সৃষ্টি

সোলায়মান সুমন

সৃষ্টির আনন্দে ঈশ্বর এ মন

সোলায়মান সুমন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মৃত্যুখেকো মানুষগুলো

২০ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:১৯



নীলকান্ত তার নামকে সার্থক করে পূর্বপাড়ার পুরনো স্কুলের দেয়ালের মত নীল হয়ে উঠছে দিন দিন। গোখরা সাপের কামড় খেলে এমনই রঙ ধারণ করে মানুষ মরার আগে। ‘এমন রোগ দেখিনি বাপু, বাপের জনমে!’ ‘জগত সংসারে পাপ বাড়ছে- রোগ বাড়ছে।’ ‘কত রকম আবিঝাবি রোগ আসছে বাপু। নামগ্যালার কী ছিরি।’ নানা জন নানা কথা বলে, নীলকান্তকে দেখতে এসে। এ কোন দেশি, কোন জাতের রোগ, এলোবা কোথা থেকে, কে বলতে পারে? বৈদ্য আসে, কবিরাজ আসে- রোগের জাত, পাত, কুষ্ঠি মেলাতে পারে না তারা। অষ্টমীর দিন কালী মন্দিরের পুরত মশাই বেলপাতায় গঙ্গাজল নিয়ে নীলকান্তর দেহে ছিটাতে ছিটাতে বলল, ‘অতো মন মরা কেনরে নীলকান্ত। জানিসনে কৃষ্ণ নীল বর্ণা ছিল। তোর নামের আশীর্বাদে এমন বর পেয়েছিস। তোর নাম রেখেছিল আমাদের মন্দিরের জগৎ ঠাকুর।’ তারপরও কি নীলকান্তর বাবা-মা আশ্বস্ত হতে পারে। ছেলে যে দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। দেহের ত্বক শুকিয়ে খস্খসে হয়ে উঠছে। গরীব বাবা-মার পক্ষে যতটুকু সম্ভব চিকিৎসার ত্রুটি করেনি। রোগ হাসে তাকে নিয়ে মানুষের কিত্তি দেখে।

-ঐ আকাশে উড়া যুদ্ধজাহাজ গ্যাল্যা যবে থেকে মহারাজপুরের আকাশে দেখা গেছে তখন থেকে কত কি ঘটছে গাঁয়ে। বিচ্ছিরি সব অসুখ হোছে মানুষের। হাটে চাল,ডাল, লবণ উধাও। পয়সা থাকলেও বাজারে সদায় নাই।

-সৈন্যদের জন্য খোরাক মজুদ করছে। ব্রিটেন থেকে প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল আদেশ পাঠিয়েছেন।

-তুমি আমি না খেয়ে মরলে ওদের কি।

-গাঁয়ে আজব আজব রোগ দেখা দিচ্ছে। মৃণালের বেটা নীলকান্তর কথাই ধরো না...

-হ্যাঁ। সৈন্যরা এমন সব পাউডার ফ্যালে পিলেন থেক্যাÑ শরীরের চামড়া পুড়ে যায়।

-নীলকান্তর ব্যাপারটা ওরকম কিছু হতে পারে।



কথা খেয়ে বাঁচতে শিখছে মানুষ। ফিল্টের মরা হাটের আধমরা বটগাছটার নিচে হাভাতে, আধপেটা মানুষগুলো বসে একে অপরের কথা খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। ভনভন্ করে মাছি উড়ে ওদের আশেপাশের বাঁশের মাচা, চকিগুলোর উপর। যেহেতু একদা এখানে বাতাসা, জিলেপি, কটকটি বিক্রি হত। মাছিগুলো ভীষণ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। হারু আর হারুর ছেলে গেনুও এখন সারা দিন এখানে মানুষের গল্প গিলে খায়। মাঝে মাঝে টক টক লালা মিশিয়ে পান করে মহানন্দার সরস জল। ফাঁকা ঢেকুর তোলে অসুস্থ কুকুরের মত ফেউ ফেউ শব্দে। মহানন্দা হাসে বাপ-বেটার কিত্তি দেখে।





হারুর বউয়ের পেটে আরেকটি পেট জেগে উঠছে। আট কি নয়... কয় মাস হলো হারুর মনে নেই। আরেকটা পেটের অন্ন কীভাবে যোগাবে এই ভাবনাই তাকে তিলে তিলে খাচ্ছে। হারুর ভাবনা দেখে ঘরের শূন্য হাড়িগুলো মালো পাড়ার মন্দিরের ঘণ্টার মত ঢং ঢং করে হেসে ওঠে।

হারু, হারুর বউ, আট বছরের ছেলে ফেকু তোরাব মিয়ার চাতালে কাজ করত। আকালের কারণে চাতাল বন্ধ। গোডাউনের বস্তা বস্তা চাল রাতারাতি কোথায় যে উধাও হয়ে গেল। হারুর মাথা চুলকেও কুল কিনারা করতে পারে না। কেউ বলে বড় বড় ট্রাক এসে সব চাল সরকারি গুদামে নিয়ে গেছে। কেউ বলে, তোরাব মিয়া তার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে। কে জানে সত্য কি। হারুর বউয়ের এখন ভালমন্দ খাওয়া দরকার। হেঁশেলের চুলোগুলো হা হয়ে বসে থাকে দিন রাত উপোস করে। হারুর মত ওরাও বেকার। কলমিপাতা, কচু সেদ্ধ, আর কুমোর পাড়ার এঁটেল মাটির পায়েস খেয়ে কাটছে ওদের দিন।

ফিল্টের হাটে সেদিন নীলকান্তের কথা উঠল। ভিন দেশি এক ওঝা আসবে নীলকান্তের চিকিৎসার জন্য। সে গুণিন অনেক কেরদানি জানে।

-আরে, মরা মানুষরে জিন্দা করা নাকি তার বাঁ হাতের খেল।

-এমন কথা যদি সে দাবী করে তহলে বুঝতে হবে সালা এক নম্বরের ভ-।

-আরে, সে বলে না। মানুষের মুখে মুখে রটনা আছে।

-তুমি কার কাছে শুনলা।

-নীলকান্তের বাবা মৃণালের সাথে দেখা হয়েছিল।

-কীভাবে চিকিৎসা করে?

-একজনের রোগ অন্যের ঘাড়ে চড়িয়ে দেয়।

-যজ্ঞ করে রোগীর শরীরের রোগটা মোরগের শরীরে চলান করে। ঐ মোরগ যে খ্যাবে তার শরীরে সে রোগ চল্যা যেবে।

হারু আর তার ছেলে গেনু একে অপরের দিকে তাকায়। ওরা মহানন্দায় নামে। মহানন্দার জল আঁজলা ভরে খায়। বাবা এ তো ভয়ানক যাদুকর, গেনু তার বাবাকে বলে। হারু তখন অন্য ভাবনায়। গেনুর কথা শুনে হারুর কনুই চুয়ে জল মহানন্দার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে খিলখিলিয়ে হাসে।



আজ শুক্ল পক্ষের অমাবস্যার রাত। মৃণালের বাড়ির সামনের বটগাছটার নিচে যজ্ঞ হবে। যজ্ঞের নানা আয়োজন লাল বস্তায় পুরে গুণিন এসেছে। গুণিনের উপদেশ মত টাটকা বেলপাতা, লেবুপাতা, বরইপাতা, শিউলি ফুল জোগাড় রেখেছে নীলকান্তের বাবা মৃণাল কর্মকার। সামান্যতেই এ গ্রামের মানুষজন বড় উৎসাহী। কিন্তু এত বড় ঘটনাতেও গ্রামের লোকজন একেবারেই নেই। সবাই দরজায় খিল দিয়েছে। ঐ ভয়ানক রোগ কার উপর ছুঁড়বে গুণিন কে বলতে পারে? হারু কিন্তু সময় মত তার ছেলেকে নিয়ে হাজির হয়েছে। গেনু অবশ্য আপত্তি করেছিল। ‘বাŸা সবাই বলছে, যে ওখানে যাবে রোগটা তার ঘাড়ে চাপবে।’

-কিচ্ছু হবে না বাপ, আমরা শুধু দেখব।

যজ্ঞ শুরু হল। গুণিনের তন্ত্র-মন্ত্র আর ধুপ ধোঁয়ার গন্ধে বাতাস ভৌতিক হয়ে উঠল। হারু চুপ-চাপ মোরগটার দিকে তাকিয়েছিল। মোরগটা শুঁড়িখানার মাতালের মত দুলছিল। তার দোলনে মাথার লাল ঝুঁটিটা বৃটিশ পতাকার মতো পদপদ করে উড়ছে। হেচাক বাতির আলোয় ওটা অপরূপ লাগছিল। হারু মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়েছিল। মোরগটার কণ্ঠে আতঙ্ক স্পষ্ট। জীবনকে সেও তো ভালবাসে। মোরগটার সাথে হারু কোথায় যেন একত্ম হয়ে গেছিল। যজ্ঞের আগুনে গুণিন ধুপ ছাড়লে হঠাৎ ধোঁয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। মোরগটার সাথে হারুÑ হারুর ছেলে খক্ খক্ করে কেশে ওঠে। চারিদিকের দৃশ্যপট অস্পষ্ট হয়ে যায়।

নীলকান্তের আঙুল কেটে রক্ত নিয়ে মোরগের কপালে তীলক কাটে গুণিন। যজ্ঞ শেষে মোরগটাকে জঙ্গলে ছেড়ে দেয়া হয়। হারু তার ছেলে গেনুকে বলে, ‘তুই মোরগটা কোন দিকে যায় খেয়াল রাখিস আমি আসছি।’ হারু চুক্তি অনুযায়ী মৃণাল কর্মকারের বাড়িতে যায়। সাথে সাথে এক পুঁটলি চাল নিয়ে হাসি মুখে বেরিয়ে এসে গেনুকে বলে, ‘মোরগটা গেল কই? চল মোরগটা ধরি।’

-বাবা কী বলছ! তুমি জানো না ও মোরগে নীলকান্তের রোগ ঢুকেছে।

-চলতো। এমনিতেই মরে আছি। বাবার সাথে গেনু কচু বনে প্রবেশ করে। জীবনের সাথে মৃত্যুর ধস্তাধস্তি, দৌড়ঝাপ, লম্ফঝম্ফ শুরু হয়। তাড়া খেয়ে মোরগ গিয়ে ওঠে আতাগাছের ডালে, অতপর বদ্ধ পঁচা পানির ডোবায়।



বনের পুরনো কাদা মেখে বাপ-বেটা লদপদ হয়ে মোরগ নিয়ে বাড়ি ফিরে। উঠোনে তখন মহা হৈচৈ। গেদুর নানী দৌড়ে আসে ওদের দেখে। ‘কোথায় ছিল্যা তোমরা? হামার পোড়াকপালি মেয়ে তো মরতে বস্যাছিল। সকাল থেকে আমার মন কেমন করছিল তাই এস্যাছিলাম।সন্ধ্যা থেক্যা মা হামার কোঁকাছে যন্ত্রণায়।’



-কী হয়েছে আগে কহেন তো?

-বেদ্না উঠেছে গো, বেদ্না। প্রতিবেশি বউ-ঝিরা বলে ওঠে।

হারু ঘরে ঢুকতে গেলে কে একজন বলে ওঠে, ‘ভেতরে দাই মা আছে। ঘরে যাওয়া চলবে না।’

হারু চালের পুটলিটা তার শ্বাশুড়ির হাতে দিয়ে মোরগটা জবাই করে। ‘চল গেনু কলতলায় গোসল করে আসি।’ গেনুর নানী চুলোয় ভাত চড়িয়ে মোরগ রান্নার আয়োজন করে।



হারু যখন উঠানে শেষে ফিরে আসে, গরম ভাত আর মোরগের ঝোলের মৌ মৌ গন্ধে সারাটি উঠোন উৎসবের আমেজ পেয়েছে। পেট থেকে এক ধরনের আনন্দ হারুর জিব দিয়ে বেরিয়ে আসে। সাথে সাথে আরেকটা নতুন পেট তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে চিৎকার করে ওঠে।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৫

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
ফেলে আসা স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাসের মর্মস্পর্শী জীবনকথন ৷

অনেকদিন পর এ ধরণের লেখা পড়া হল ৷ মানুষের জয় হোক ৷

২| ২১ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১:১৩

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: ভাল লাগল পড়তে। লেখনি চমৎকার।

৩| ২১ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৬

হাসান মাহবুব বলেছেন: চমৎকার লেখেন আপনি।

৪| ২১ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১০:৩৪

সকাল রয় বলেছেন:
নীলকান্ত'র গল্পটা। সামাজিক ও জীবনের গল্পকথা।


অনেক ভালো লাগলো। আবার পড়বো।

৫| ২২ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ৮:২৪

সোলায়মান সুমন বলেছেন: ধন্যবাদ। আমি একজন নতুন ব্লগার। এভাবে আপনাদের উৎসাহ পেলে ব্লগে নিয়মিত হবো।

৬| ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১:০৬

সোলায়মান সুমন বলেছেন: বইটি পাওয়া যাবে ৩৪৭ নম্বর স্টলে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.