নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নব নব সৃষ্টি

সোলায়মান সুমন

সৃষ্টির আনন্দে ঈশ্বর এ মন

সোলায়মান সুমন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সুচেতনা, তুমি এক দূরতম দ্বীপ

১০ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৮:৫৮



আয়েশার চোখের দিকে তাকিয়ে সুচেতনার নীলসাগর খুঁজে তরু। সাগরের অজর ঢেউ বাঁধা পাড়ে তরুর ছোট্ট হ্রদে। স্বচ্ছ জলের স্ফটিক দৃশ্য কোন সুদূরের শূন্যতায় ঘেরা। সেই শূন্যতার কী যে বেদনা কী যে তার হাহাকার। অন্যরা কি জানবে কোনো দিন। তরুও চাই না জানুক কেউ। শুধু আয়েশার প্রশ্নের উত্তরে বিব্রত হয় তরু। ‘তুমি আমার চোখে তাকিয়ে বিষন্ন হয়ে পড় কেন?’ উত্তরে কী বলবে তরু, ‘তোমার চোখে সুচেতনার নীল চোখ খুঁজি। আর কোনো বিষন্ন মুহূর্তে খুঁজেও পাই তাকে। তোমার আবলুস রাতের চোখ তখন নীল সাগর হয়ে যায়। আর তুমি! ঠিক যেন আঁধার রাতে সমুদ্রের বুকে হঠাৎ কোথা থেকে ষোল কলা পূর্ণ করে যুবতী চাঁদ এসে দাঁড়িয়েছে।’ সাগরের মন্থনে অতল গভীর থেকে জেগে ওঠে জিয়ন-তরু। নোনতা স্নানে নেয়ে ওঠে দুটি শরীর। অস্ফুট আদুরে স্বরে বলে ওঠে আয়েশা, ‘হিংস্র প্রেমিক।’ তরু জানে প্রেম তো হিংস্র, আদি- কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক। অথবা ভয়ানক বিরহের।
কুয়াশা ঢাকা সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড দিয়ে সাদা কুয়াশা উড়য়ে হাঁটছে একটি মেয়ে। তরু সম্মুখে রাস্তার ঠিক বিপরীত প্রান্ত থেকে। এগিয়ে আসছে তরুর দিকে। ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে মেয়েটি। একটু একটু করে কুয়াশার জাল ছিড়ে বেরিয়ে আসছে। মেয়েটির শাড়ীর উপরে শুভ্র চাদর জড়ানো। তরুর সামনে যেন এক নাটকীয় চমক। চারিদিক শুনশান, মাঝে মাঝে গাছের আড়াল থেকে ঢেকে উঠছে পাখিরা। মেয়েটি যখন একেবারে সামনে এসে পড়ে নাটকীয় চমক এবার ক্লাইমেক্সে গিয়ে স্থির হয়। মেয়েটির নীল দুটি চোখ স্বপ্নের মত ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূর থেকে দূরে। এতক্ষণ রাস্তার ধার ঘেঁসে বসেছিল তরু। অজানা শিহরনে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। হাজার বছরের পথ পেরিয়ে একটি মুহূর্তে এসে সময় এখন নিশ্চুপ, স্তব্ধ। এবার মেয়েটি বলে উঠবে, এতদিন কোথায় ছিলেন? তাহলে এভাবেই কোনো কোনো সময় একটি মুহূর্তে সময় এসে স্থির হয়। এত দিন সে শুনেছিল আজ উপলব্ধি করল। মেয়েটি তরুর সামনে এসে দাঁড়ায়। চারিদিকে জীবনান্দীয় নীরবতা। দুটি নীরবতা একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে অনন্তকাল। এভাবেই সময় পেরেয়ি যেতে থাকে। অথবা স্থীর হয়ে থাকে। মেয়েটির নাম দিল সে সুচেতনা। সুচেতনা এক সময় চাদরের নিচ থেকে তার স্বর্ণরাঙা হাতটি বের করে আনে। কাঁচের চুড়ি বাজতে থাকে কিনিকিনি, রিনিঝিনি। ‘নমস্কার।’ হাত দুটি মুখের কাছে তুলে আনে ও।
উত্তরে তরু ‘আদাব।’ বলতে গিয়ে শ্লেষ্মা জড়ানো কণ্ঠে শব্দটা আঁটকে যায়।
আচ্ছা দাদা, ‘শহীদুল্লাহ্ কলাভবন কোথায় বলতে পারেন?’
হাতের ডানেই কলাভবন কিন্তু কেন জানি তরু হাতের ইশারায় সম্মুখের সোজা পথ দেখিয়ে দেয়। মেয়েটি এগিয়ে যায় সেই ভুল পথ ধরে। পথ কি কখনো ভুল হয়। ভুল হয় পথিক। কখনো কখনো ভুল পথে চলতে- কাউকে চালাতে ইচ্ছে হয়। সুচেতনার পথটাকে সে দীর্ঘ করে দেয়। সে ভুল পথ তাকিয়ে থাকে তরু। ‘সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে- এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।’ বিড় বিড় করে তরু। সে রাস্তার পাশের ছোট্ট সাঁকোর ঘেরায় আবার বসে পড়ে। দুহাত দিয়ে চোখ দুটো ঢেকে ফেলে। এখন জরুরি একটা ক্লাস ছিল। তাই তো শীতের সকালে উঠে আসা। কিন্তু সে ক্লাসের কথা ভুলে যায়। প্রেমের আগুনে শীতের সকালে দাউ দাউ করে জ্বলছে সে। ভয়ানক ভাললাগা। সমস্ত শরীরে ছুটছে প্রেমের বারুদ। ধমনি থেকে ধমনিতে- স্নায়ুর বৈদ্যুতিক পথ ধরে। কাউকে কথাটা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে , ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি।’ একের পর এক ক্লাস কেটে যায় তরু সেখানেই এটলাসের মূর্তির মত পাথর হয়ে থাকে। সেদিন আর ক্লাসে যাওয়া হয় না তার। নিজ হলের রুমে ফিরে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে,
ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি...


দুপুর শেষে রুমমেট আসিফ রুমে ফিরে।‘কী ব্যাপার ক্লাসে যাসনি?’
- না।
- কেন রে শরীর খারাপ?
আসিফকে তরু জড়িয়ে ধরে, ‘বন্ধু হ্যাঁ, অসুস্থ, অপ্রকৃতস্থ।’
-বলিস কী! এই মধ্য দুপুরে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছিস, প্রেম পড়লি নাকি?
-ধুর। কী যে বলিস। তরু ভীষণ বিরক্ত হয়।
-ওরে বাবা রেগে যাচ্ছিস কেন?
-আসলে আমি নিজে জানি না, আমার কী হয়েছে? কারণ এতদিন আমার বিশ্বাস ছিল। প্রেম বিষয়টা আনেক জটিল, অনেক ঘভীর। হঠাৎ এক দেখাতে কাউকে ভাললাগতে পারে কিন্তু তা ভালবাসা নয়।
-অতপর? বন্ধু আসিফ অবাক হয়ে ওর কথা শোনে।
-গো টু হেল। আসিফের চাহনিতে তরু বিরক্ত হয়। একটু ধেমে সে আবার বলে, কিন্তু আমি এটাকে শুধু ভাললাগা বলতে পারছি না। আমার কেমন জানি সবকিছু এলোমেলো হযে যাচ্ছে।
দুজনে চুপচাপ থাকে কিচ্ছুক্ষণ। আসিফ বলে, ‘দোস্ত মেয়েটি কে? আমি চিনি?’
-না।
-তুই চিনিস?
-না।
-এল্লাও ঠ্যালা!
পরের দিন তরু শহিদুল্লাহ কলাভবনে তার বাংলা ডিপার্টমেন্টে যায়। তাকে দেখে আয়েশা দৌড়ে আসে। ‘তুই এত দুষ্টু আগে বুঝিনি।’
তরুর বুকটা ধক করে ওঠে,‘কেন?’
-তুই ওকে ভুল পথ দেখিয়েছিলি কেন?
-কাকে? তরুর বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়।
-আমার দিদিকে।
-কেমন দিদি?
-সেটা কাজের কথা নয়। আগে বল এমনটা করলি কেন?
-আসলে উনাকে ঠিকমত কিছু বলার আগেই ভুল পথে হাঁটা দিয়েছিল। উনি তোর কেমন দিদি?
-পরে একদিন বলব। এখন ক্লাসে চল। কী ক্লাস করবি না?
-আয়েশা প্লিজ বল না। সে তোর কেমন দিদি? আমি যে মনে মনে মরে যাচ্ছি তুই কেন বুঝতে পারছিস না। এমনটি আয়েশাকে তরুর বলতে ইচ্ছে হয়।
সুচেতনা কথা জানবার জন্য তরু আয়েশার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। ধীরে ধীরে সে জানতে পারে, সুচেতনা এবারই প্রথম বাংলাদেশে এসেছে। সে অনেক আগের কথা। এক সময় নাটোর শহরে আয়েশা আর সুচেতনাদের পাশাপাশি বসবাস ছিল। পিড়ির পর পিড়ি পাশাপাশি বাস করে আসছিল ওদের দুই পরিবার। সাতচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ও তারা একে অপরের পরিবারকে আগলে রেখেছিল। কিন্তু একাত্তরে হিন্দু হবার অপরাধে সুচেতনাদের পরিবারের উপর নেমে আসে হিংস্রতার রক্তাক্ত খড়গ। তখন সুচেতনার বাবা অনিমেস বাবু একজন কিশোর। অনিমেস বাবুর চোখের সামনে তার মায়ের উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে রাজাকাররা হত্যা করে। বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ দেশে বসবাস করার মত সাহস আর পায়নি পরিবারটি। অনিমেসের বাবা প্রায় পাগল হয়ে যায়। নিজ দেশ ত্যাগ করে তারা সামান্য বেঁচে থাকার অধিকার পেতে দেশের টান, নাড়ির টান ছিড়ে ভারতে চলে গেছে। সুচেতনার জন্ম কলকাতাতেই। সে এখন রবীন্দ্রভারতীতে ধ্রুপদী সঙ্গিতের ছাত্রী। বয়সে সে আয়েশার খানিক বড়। মাঝে মাঝে ওরা এদেশে আসে। আসলে আয়েশাদের বাড়িতেই উঠে। মাটির টানে তাদের এদেশে বারবার ফিরে আসা। পূর্বপুরুষদের দেহ মিশে আছে এই মাটি-জল-বাতাসে। সুচেতনার ঠাকুমা দেখতে নাকি ঠিক তার মতই ছিল। হ্রদের স্ফটিক জলের মত স্বচ্ছ দুটি নীল চোখ। কাঁচাসোনা রঙ। আয়েশা তার দিদার কাছে এমনটি শুনেছে।

বছর খানেক বাদের কথা। আয়েশার বড় বোনের বিয়েতে সুচেতনার আসার কথা ছিল। তরু তাই আয়েশার বোনের বিয়ের দাওয়াতে নাটোরে আসে। সুচেতনাদের ভগ্নপ্রায় সেই বাড়িটি এনিমি প্রপার্টি হিসেবে সরকারের দখলে। ও বাড়িতে এখন ক্ষমতাসিন রাজনৈতিক দলের অফিস। তরু যেন অনেক দূর দেশ হতে জীবনানন্দের কোনো নায়িকার খোঁজে এসেছে। কিন্তু কোথায় সে? তাকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়েছে কোথায়? সামনে এসে তো বলে না,‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ আয়েশাদের ছাদে কাঠের তকতা পেতে খবু সহজেই সুচেতনাদের বাড়ির ছাদে যাওয়া যায়। যে ক’দিন ওখানে ছিল তরু সন্ধ্যায় সুচেতনাদের বাড়ির ছাদে বসে একের পর এক সিগারেট নিঃশেষ করেছে। আর এক অবাস্তব অসম্ভব কল্পনায় মেতেছে মনের আনন্দে। সারাটি সন্ধ্যায় সুচেতনার নীল চোখ ভেসে ফিরেছে সমস্ত ছাদ জুড়ে। এ ছাদে তো সুচেতনার জীবনের একটি সময় কাটার কথা ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। হয়ত তরু আরেকটিবার ওকে প্রাণ খুলে দেখার সুযোগ পেত। হয়ত তরুর আপন হতেও তো পারত সুচেতনা। তদের দুজনের মধ্যে আজ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কে? রাজনীতি? ইতিহাস? ধর্ম? স্বার্থ? নাকি সময়? কে
বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুজনের মাঝে?

সুচেতনা, তুমি এক দূরতম দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছ;
সেইখানে দারুচিনি বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;
তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।

শেষ পর্যন্ত সুচেতনার সাথে তরুর আর দেখা হয়নি। আয়েশা এখন তার ঘরনি। আর মেয়েটির নাম কিন্তু সুচেতনা ছিল না।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১২:২১

ভুরের ফুল বলেছেন: পরে ভালো লেগেছে , ধন্যবাদ আপনাকে ।

২| ১১ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:১৮

সোলায়মান সুমন বলেছেন: ধন্যবাদ

৩| ১১ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:৩০

হাসান মাহবুব বলেছেন: খুব ভালো লাগলো।

৪| ১২ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১:১৫

সোলায়মান সুমন বলেছেন: অশেষ কৃতজ্ঞতা হাসান মাহবুব ভাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.