নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মানুষ। আমি ত্বরীকতপন্থী-মুসলমান। আমি মানুষ বলে আমার ভুলত্রুটি হতেই পারে। বইপড়তে আমার ভালো লাগে। সাহিত্য ভালোবাসি। লেখালেখি আমার খুব শখের বিষয়। বাংলাদেশরাষ্ট্র ও গণমানুষের জন্য আমি লেখনিশক্তিধারণ করেছি।

সাইয়িদ রফিকুল হক

আমি লিখি “দেশ, জাতি, মানুষ আর মানবতার” জন্য। আমার লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সমালোচনা আমার নিজস্ব ও মৌলিক রচনা। তাই, আমার অনুমতি ব্যতিরেকে এগুলো কপি বা নকল করা আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ। পৃথিবীর সকল মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসা। জয় মানবের জয়।

সাইয়িদ রফিকুল হক › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোয়েন্দা লালভাই: অধ্যাপক-খুনের রহস্য (সম্পূর্ণ গল্প)

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৪৭



গোয়েন্দা লালভাই: অধ্যাপক-খুনের রহস্য
(সম্পূর্ণ গল্প)

সাইয়িদ রফিকুল হক



আজকের পত্রিকা পড়ে দেখি ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ে একজন প্রবীণ অধ্যাপক খুন হয়েছেন। খবরটা দেখে আমি আর বাসায় বসে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম, ঘটনাটা এখনই আমাদের গোয়েন্দা লালভাইকে জানানো উচিত। আমাদের বাড়ির পাশেই লালভাইয়ের বাড়ি। সম্পর্কের দিক থেকে তিনি আমার আপন চাচাতো ভাই। আর বয়সের দিক থেকেও তিনি আমার চেয়ে বেশ বড়।

আমি হন্তদন্ত হয়ে লালভাইয়ের বাসায় ছুটে এলাম। আর দেখলাম, লালভাই খুব মনোযোগ দিয়ে আজকের পত্রিকাটা পড়ায় ব্যস্ত, এবং আজকের সব দৈনিকের শিরোনাম অধ্যাপক-খুনের বৃত্তান্ত পড়ছেন। আমি আর কিছু বললাম না। শুধু সোফার একপাশে বসে রইলাম। আমি জানি, এ-সময় কথা বললে লালভাই খুব বিরক্ত হবেন। তিনি একটি ঘটনার বিবরণ কমপক্ষে দুই থেকে তিনবার মনোযোগ দিয়ে পড়েন। কোনো-কোনো সময় তিনি এরচেয়েও বেশি পড়েন। এতে নাকি ঘটনার গভীরে যাওয়া যায়। আমাদের লালভাইয়ের তদন্ত করবার কলাকৌশলও ভিন্ন। তিনি প্রথমে ঘটনাস্থলে ছুটে যান কিংবা ঘটনাস্থলে ছুটে যেতে না পারলে পত্রিকা কিংবা বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেট্রিক মিডিয়া থেকে খবরাখবর সংগ্রহ করেন। আর প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি শুনে ঘটনার গভীরতা ও সত্যতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এভাবে ঘটনার আরও গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। একসময় সবাইকে সন্দেহ করেন। শেষমেশ যারা ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে শুধু তাদের নাম সন্দেহের তালিকায় রেখে বাকিদের বাদ দেন। ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর তিনি ঘটনা সংঘটিত হওয়ার স্থান থেকে শুরু করে আশেপাশে সবজায়গা মানে সর্বত্র খুঁটে-খুঁটে দেখেন। তারপর প্রয়োজন মনে করলে তিনি বিভিন্নজনকে জেরা করেন। সবশেষে স্থিরসিদ্ধান্তে আসেন। তিনি অতিরিক্ত দৌড়-ঝাঁপে বিশ্বাসী নন।

লালভাইয়ের পত্রিকা পড়া দেখে আমি বুঝতে পারলাম, তিনি এখন খুব মনোযোগী। এ-সময় তার সঙ্গে কথা বলতে যাওয়াটা ভীষণ বোকামি। আমি দেখতে পাচ্ছি, দৈনিক পত্রিকার এই চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক খুনের সংবাদ দেখে আমাদের গোয়েন্দা লালভাই যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন। তিনি সবেমাত্র সকালের নাশতা শেষ করে ‘দৈনিক বঙ্গবাণী’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে শুরু করেছিলেন। প্রথমেই তার চোখ আটকিয়ে গিয়েছে আজকের হেডলাইনে। সেখানে লালকালিতে বড়-বড় অক্ষরে লেখা হয়েছে, নিজ-বাসভবনে খুন হলেন সরকারি কলেজের স্বনামধন্য সাবেক অধ্যাপক!
খবরটা নিঃসন্দেহে দারুণ চাঞ্চল্যকর, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু এরচেয়ে বড় চাঞ্চল্যকর খবর হলো খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে নিহত অধ্যাপকের আপন-ভাগ্নে! খবরটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলেন গোয়েন্দা লালভাই।
আমাদের লালভাই পেশায় একটা বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক। কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি পরিচয়-গোপন করে তিনি গোয়েন্দাগিরিতেও ব্যস্ত এবং এব্যাপারে যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত। বয়স তার খুব একটা বেশি নয়। মাত্র আটচল্লিশ। তবে তাকে দেখলে মনে হবে তিনি আটাশ বছরের তরতাজা যুবক। খুব স্মার্ট আর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা তার। অধ্যাপনার পাশাপাশি এতদাঞ্চলে তিনি একজন ছদ্মবেশী প্রাইভেট ডিটেকটিভ। গোয়েন্দাগিরির প্রয়োজনে তিনি সবসময় ছদ্মবেশধারণ করে থাকেন।
তিনি ঢাকার সাভারে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। আর অধ্যাপনাও করছেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটা কলেজে। শিক্ষকতার সময় তিনি অধ্যাপক লিটু মিয়া আর গোয়েন্দাগিরিতে লালভাই। এজন্য কেউই তার দুটো পরিচয় একসঙ্গে জানে না। ইতোমধ্যে এই কাজে তিনি বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন।
তিনি যখন কোনো ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরিতে নিয়োজিত হন তখন তাকে সবাই চেনে শুধু ‘গোয়েন্দা লালভাই’ হিসাবে। তিনি খুব ফর্সা আর সুদর্শন মানুষ। তার আত্মীয় ভাইবোনেরা সবসময় তাকে এই নামেই সম্বোধন করে থাকে। আত্মীয়স্বজনের ভালোবাসায় তিনি ছদ্মবেশী গোয়েন্দা হিসাবে এই নামটি বেছে নিয়েছেন। আজ পর্যন্ত গোয়েন্দাগিরিতে তিনি ফেল করেননি।

খবরটা পড়ে লালভাইয়ের খুব মনখারাপ হয়েছে। আর হয়তো ভাবছেন, একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপককে মানুষ কী কারণে খুন করতে পারে? আর তার আপন-ভাগ্নেই বা কেন একজন বয়স্ক মুরুব্বিশ্রেণির আত্মীয়কে খুন করবে? এব্যাপারে তিনি কিছুতেই নিজের মনে কোনো হিসাব মিলাতে পারছেন না। এসব আমি তার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো খবরটি পড়তে লাগলেন।

লালভাই এখনও একমনে পত্রিকা পড়ছেন। আর হয়তো পুরো ঘটনাটা চোখের সামনে ভিডিও করছেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি পত্রিকা পড়া শেষ করে আমার দিকে চেয়ে বললেন, “কীরে সাজিদ, কখন এলি?”
আমি হেসে বললাম, “মিনিট পনেরো আগে এসেছি ভাইজান।”
লালভাই হেসে বললেন, “দেখেছি। এমনি জিজ্ঞাসা করা আরকি!”
আমাদের লালভাই খুব রসিক মানুষ। তিনি ইচ্ছে করে মাঝে-মাঝে এরকম করেন।
লালভাইয়ের মনটা ভালো আছে দেখে আমি খুব আগ্রহভরে বললাম, “ভাই, এই কেসটার একটা তদন্ত করা দরকার। আপনি না হলে তো এর সুষ্ঠু তদন্ত হবে না।”
তিনি আমার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, “দেখি, সাহায্যের জন্য কেউ আসে কিনা। তুমি তো জানো, আমি আগবাড়িয়ে কিংবা গায়ে পড়ে কারও উপকার করার চেষ্টা করি না। যদি কেউ আসে তাহলে আমি প্রাণপণে কেসটা নিয়ে লড়তে পারবো।”

কথার একফাঁকে লালভাই আমার দিকে চেয়ে বললেন, “দৈনিক বঙ্গবাণীর নিউজটা তুই একবার পড়তো। আমি মন দিয়ে শুনি।”

আমি খুব খুশি মনে পড়তে লাগলাম: দৈনিক বঙ্গবাণীর বিশেষ সংবাদদাতা। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গতকাল আনুমানিক রাত সাড়ে আটটায় মানিকগঞ্জ সরকারি কলেজের ইতিহাসের সাবেক অধ্যাপক আবুল হাসান সরকার নিজ-বাসভবনে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। রাত সাড়ে আটটায় তার আপনভাগ্নে টাকাপয়সার লেনদেন নিয়ে বচসার একপর্যায়ে অধ্যাপক হাসানকে জবাই করে হত্যা করে। নিহতের ভাগ্নে ও হত্যাকারী আজাদ কালামকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। লোমহর্ষক এই খুনের তদন্তভার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য ধামরাই থানার ওসি গোলাম মওলা যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। মরহুমের একমাত্র পুত্র পিতার ওপর রাগ করে দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়া বসবাস করছেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে মনে করে তাকেও সন্দেহ করা হচ্ছে। নিহতের একমাত্র পুত্র প্রবাসী হলেও তার স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা পিতার বাড়িতেই অবস্থান করছে। উল্লেখ্য যে, মরহুম অধ্যাপকের ধামরাইয়ে বিশাল বাড়িসহ ঢাকায় তার একাধিক প্লটও রয়েছে। তদন্তকর্মকর্তা গোলাম মওলা বলেছেন, খুনের মোটিভ ও খুনী শনাক্ত হয়ে যাওয়ায় দুই-তিনদিনের মধ্যে চার্জশিট দেওয়া হবে। প্রয়োজনে মামলাটি দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হবে।...
আমি এই পর্যন্ত পড়তেই লালভাই আমাকে থামতে বললেন।
আমি থামার পর তিনি বললেন, “আর পড়তে হবে না। একটা ক্লু পেয়ে গিয়েছি।”
তদন্তের স্বার্থে আমি এব্যাপারে লালভাইকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলাম না।

আমরা যখন কেসটা নিয়ে লড়ার জন্য কারও একটা অনুরোধের অপেক্ষায় বসে রয়েছি তখনই দেখলাম, আমাদের লালভাইয়ের সাড়াজাগানো অনলাইন গোয়েন্দা-পেইজে একটা মেসেজ এসেছে। আমরা উৎসাহিত হয়ে উঠলাম।
লালভাইয়ের নির্দেশে আমি হুমড়ি খেয়ে মেসেজটা পড়তে লাগলাম:

প্রিয় গোয়েন্দা লালভাই,

শুভেচ্ছাসহ নিবেদন করছি: গতরাতে আমার মামা অধ্যাপক আবুল হাসান সরকার কুচক্রীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। অথচ, প্রকৃত খুনী ও ষড়যন্ত্রকারীদের আড়াল করতেই আমার আপন বড়ভাই ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আজাদ কালামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমিও পুলিশের ভয়ে পালিয়ে রয়েছি। আমার যারপরনাই অনুরোধ: আমার নির্দোষ ও নিরপরাধ ভাইটিকে বাঁচানোর জন্য আপনি কেসটা হাতে নিয়ে লড়াই করবেন। সত্যের পক্ষে তদন্ত করবেন। আপনার প্রাপ্য সম্মানী আমরা পরে দিবো। আর-একটা কথা: আপনারা ধামরাই নেমে ডানদিকের একটা রাস্তা ধরে কিছুটা অগ্রসর হলেই দেখবেন সরকারপাড়া। সেখানেই আমার মামা অধ্যাপক আবুল হাসান সরকারের বাড়ি। আর বাড়ির নাম ‘নিঝুম সন্ধ্যা।’ শুভকামনা।

বিনীত নিবেদক
আজাদ রায়হান
মোবাইল: ০১৭২৬ ৩৬৬৮...

আমি মেসেজটা পড়ে শেষ করতেই লালভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই রেডি তো?”
আমার ভিতরে এখন বিরাট উত্তেজনা। যেন আমরা কোনো যুদ্ধজয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি কেসের সময় আমার এরকম হয়। এ-সময় আমি বেশি কথা বলতে পারি না। তাই, আমি শুধু বললাম, “জ্বি।”

লালভাই দ্রুত তার ছদ্মবেশধারণ করে নিলেন। তার জমিদারি গোঁফ ও ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি লাগাতে বেশি সময় লাগেনি।
তিনি দ্রুত সঙ্গে নিলেন তার সবসময়ের সঙ্গী ম্যাগনিফায়িং গ্লাস, শক্তিশালী টর্চ, একটা কাপড়ের ব্যাগে কী যেন পেঁচিয়ে নিলেন, আর ডায়েরি-কলম।
আমরা দ্রুত ধামরাইয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। লালভাই তার এক বন্ধুকে দ্রুত ফোন করে সাভার-বাসস্ট্যান্ডে আসতে বললেন।
আমাদের বাসে যেতে হবে। কারণ, আমাদের লালভাইয়ের কোনো গাড়ি নাই। অনেক কষ্টে এই সাভারে তিনি একটা বাড়ি করেছেন মাত্র।
বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি, লালভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আতিকুর রহমান তালুকদার ওরফে আতিক তালুকদার দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি আমাদের দেখে একটু দূর থেকেই হাসলেন। তিনি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, এবং বিশিষ্ট সমাজকর্মী। আমরা একসঙ্গে ধামরাইয়ের একটা গাড়িতে উঠে পড়লাম।
আমাদের তৃতীয় সঙ্গী আতিক তালুকদার ভাই লম্বা-চওড়া দশাসই মানুষ। তার গায়ে প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে। বুঝতে পারলাম, লালভাই কাজের জন্যই তাকে সঙ্গে নিয়েছেন। অবশ্য লালভাইয়ের গোয়েন্দাগিরিতে তিনি বেশিরভাগ সময়ই তার সঙ্গে অবস্থান করেন।

বাস থেকে নেমে আমরা একটা ভ্যানে সরকারপাড়ায় চলে এলাম। দেখি, আমরা তিনজন ‘নিঝুম সন্ধ্যা’ নামক বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। বিশাল একটা বাড়ি। চারদিকটা দশফুট উঁচু দেওয়ালে ঘেরা। এর গেইটটা খুবই দর্শনীয়। জমিদার-আমলের মতো নকশাখচিত গেইট।
লালভাই সবার আগে। আমরা দুজন একটু পিছনে। গেইটের কাছে আসতেই একজন পুলিশ কনস্টেবল এগিয়ে এসে বললো, “কাকে চাই?”
লালভাই বললেন, “আমি একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা। আর এরা আমার সঙ্গী। তদন্তের কাজে ভিতরে যাবো।”
তবুও পুলিশটা কর্কশকণ্ঠে বললো, “ভিতরে যাওয়া নিষেধ।”
লালভাই বললেন, “আমাকে ভিতরে যেতেই হবে। আপনাদের অফিসারকে ফোন করে এখনই আমার কথা জানান।”
এবার দেখলাম, পুলিশটা একটু কাঁচুমাচু হয়ে বললো, “স্যার, আপনার নাম?”
লালভাই বললেন, “গোয়েন্দা লালভাই।”
লোকটা কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। শেষে একটু দূরে গিয়ে হয়তো ওসিসাহেবকে ফোন করলো। তারপর এসে গেইট খুলে দিলো।

লালভাইয়ের পিছনে আমরা দুজনও ভিতরে ঢুকলাম। লালভাই পুলিশ কনস্টেবলকে গেইটের পাহারায় রেখে আমাদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে অধ্যাপকসাহেবের বসতবাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। এটাকে বাড়ি বলা ভুল হবে। রীতিমতো একটা রাজপ্রাসাদ। লালভাই কলিংবেল চাপলেন।

আমাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে নিহত অধ্যাপকের পুত্রবধূ কাজের মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে মেইন গেইটের কাছে এসে বললো, “কাকে চাই?”
লালভাই দ্রুত বললেন, “আমি একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা। গতরাতে নিহত অধ্যাপক আবুল হাসান সরকারের মার্ডার-কেসটা নিয়ে তদন্ত করতে এসেছি। প্রথমে আমরা লাশটা দেখতে চাই। তারপর আপনাদের সঙ্গে কথা বলবো।”
মহিলা খুব বিরক্ত হয়ে বললো, “লাশ কোথায়? তাকে তো আজ সকালেই বাড়ির পাশে একটা গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আর সকালে তার ঘরটাও পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। বুঝতেই পারছেন, মরা-বাড়ি। দুটো ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাকে থাকতে হয়। তাই, ভয়ে সবকিছু সাফ করেছি।”
মহিলার কথা শুনে আমরা যেন আকাশ থেকে পড়লাম। লালভাই বললেন, “এতো রীতিমতো অন্যায়। মামলার চূড়ান্ত তদন্ত হওয়ার আগেই লাশ দাফন করা হয়েছে! আবার হত্যাকাণ্ডের স্থানও ধুয়েমুছে সাফ করা হয়েছে! লাশের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কোথায়? এভাবে আলামত বিনষ্ট করা বেআইনি। এতো খুনের ওপর খুন!”
মহিলা খুব সাহসের সঙ্গে বললো, “দেখেন, আপনাদের কোনো কথা থাকলে ওসিসাহেবকে বলেন। তিনি সবকিছু ঠিকঠাক করেই লাশ দাফন করেছেন। আর লাশের ময়নাতদন্ত গতরাতেই সম্পন্ন হয়েছে। আর হত্যাকাণ্ডের স্থান এভাবে রেখে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। খুনি হাতেনাতে ধরা পড়েছে। বাড়ির সবাই দেখেছে তাকে খুন করতে। আপনাদের তদন্তের কী প্রয়োজন?”
কথা শেষ করে মহিলা দ্রুত বাড়ির মেইন গেইটটা সশব্দে বন্ধ করে দিলো। আর কোনোপ্রকার ভদ্রতার লেশমাত্র তার মধ্যে ছিল না। আমরা তিনজন প্রচণ্ড হতাশ হয়ে সেখানে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।

মহিলাকে অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে সদর দরজা খুললো না, এবং আমাদের ভিতরেও ঢুকতে দিলো না।
উপায়অন্তর না দেখে লালভাই ওই কনস্টেবলের নিকট থেকে ওসির ফোন-নাম্বার নিয়ে তাকে ফোন করলেন। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করলেন না।
লালভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা চিন্তিতমুখে বললেন, “তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার ফোন রিসিভ করছেন না। এমনটি তো হওয়ার কথা নয়! একজন পুলিশ-অফিসার কেন ইচ্ছাকৃতভাবে ফোন রিসিভ করবেন না! পুলিশদের তো কখনো এমনটি করার কথা নয়! এ-তো রীতিমতো বেআদবি আর ধৃষ্টতা। দেশের কোনো আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাবাহিনীর নিকট থেকে এমন অদ্ভুত আচরণ কারও কাছে প্রত্যাশিত নয়। এখানে, কোনো ঘাপলা আছে মনে হয়। কেসটা মনে হচ্ছে আমাদের ভোগাবে। এই খুন-ঘটনার একেবারে গভীরে ঢুকতে হবে। প্রথমে এটাকে যত সহজ কেস মনে করেছিলাম, আসলে তা নয়।”
লালভাই এখন কেসটা নিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছেন। তাই, আমরা কেউ কোনো কথা বলছি না। তিনি ‘নিঝুম সন্ধ্যা’ মঞ্জিলের সামনে আরও কিছুক্ষণ একাকী পায়চারী করে শেষে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “চলো, আজকে আমরা ফিরে যাই। প্রথম দিনে ওদের সঙ্গে কোনো ঠোকাঠুকিতে যাওয়া ঠিক হবে না। চলো, বাসায় ফিরে একটা সুবুদ্ধি বের করতে হবে।”

লালভাই হাঁটতে লাগলেন। আর আমরা দুজন তার অনুগামী হলাম।

‘সন্ধ্যা-মঞ্জিলে’র বাইরে এসে আমরা বাসায় ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠিনি। লালভাইয়ের হাবভাব দেখে বুঝতে পারলাম, তিনি আরও কিছুটা সময় এর আশেপাশে থাকতে চাচ্ছেন। তার ইশারায় আমরা সরকারপাড়া পেরিয়ে পাকা-রাস্তা ধরে আরেকটু ভিতরের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এদিকটা একেবারে গ্রামের মতো। কিন্তু খুব উন্নত গ্রাম। ইউরোপের আধুনিক গ্রামগুলোর মতো এর সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। বাংলার গ্রাম এখন আর অবহেলিত নয়। এর আশেপাশের সবজায়গায় ইলেকট্রিসিটি রয়েছে। এদিকটায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে আরেক শহর। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার গ্রামউন্নয়নে খুব আগ্রহী ও মনোযোগী।
কিছুদূর হেঁটে লালভাইয়ের নির্দেশে একজায়গায় আমরা থামলাম। দেখি রাস্তার ডানদিকে বিশাল এক গোরস্থান। এর গেইট খোলাই ছিল। গেইটের উপরে বড়-বড় হরফে বাংলায় লেখা: সরকারপাড়া কবরস্থান।
লালভাই এর ভিতরে ঢুকতে আমাদের ইঙ্গিত করলেন। তিনি সবার আগে। আর আমরা তার পিছনে।
একটা নতুন কাঁচামাটির কবর দেখে তিনি থামলেন। আমরা তার সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
লালভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটাই মনে হয় নিহত অধ্যাপকসাহেবের কবর।”
আতিক তালুকদার ভাই বললেন, “আমারও তা-ই মনে হচ্ছে। কবরটা একেবারে নতুন। খুব তাজা।”
লালভাই তার কাজে নেমে পড়লেন। তিনি এই কবরের আশেপাশে খুব মনোযোগ দিয়ে সবকিছু দেখতে লাগলেন। কয়েক জায়গায় থমকে দাঁড়ালেন। শেষে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, “কিছু কি দেখতে পাচ্ছো? এখানে, পুলিশের বুটের ছাপ রয়েছে। পুলিশের তত্ত্বাবধানেই লোকটাকে কবর দেওয়া হয়েছে। আর সমস্ত আলামত নষ্ট করা হয়েছে। আর কবরস্থানে সাধারণ মানুষের পায়ের ছাপ খুব কম! হয়তো এলাকাবাসীকে এখানে আসতে দেওয়া হয়নি। এখানে, পুলিশ একটা গেম খেলছে।”
লালভাই কবরের আশেপাশে আরও কিছু খুঁজছেন। এই সুযোগে আতিক তালুকদার ভাই কবরের পিছনে একটা ঝোপের দিকে হাঁটতে লাগলেন। এই জায়গাটা বড়সড় ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। মনে হয়, এখানে পুরাতন কোনো কবর ছিল। বড় অযত্নে তাই এখানে বেড়ে উঠেছে আগাছা-পরগাছার ঘন জঙ্গল।

আমি লালভাইয়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তার সঙ্গে থাকতেই আমার ভালো লাগে। এমন সময় আতিক ভাই চিৎকার করে উঠলেন, “অধ্যাপক এদিকে একবার আসো তো। দেখে যাও, এটা কী জিনিস!”
আতিক ভাইয়ের চিৎকার শুনে লালভাই পড়িমড়ি করে সেদিকে ছুটতে লাগলেন। আর প্রবল একটা উত্তেজনায় আমিও ছুটছি তার পিছনে।





আতিক ভাইয়ের হঠাৎ চিৎকার শুনে আমরা দুই ভাই প্রায় একদৌড়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। অবশ্য লালভাই আমার কিছুটা আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন। তিনি একসময় দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। এখনও আমি তার সঙ্গে দৌড়ে পারি না। ঘটনাস্থলের কাছে গিয়ে আমাদের দুজনেরও চোখ ছানাবড়া!
দেখি, এখানকার ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা বড়সড় রক্তমাখা কাপড়ের পুতুল পড়ে রয়েছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, একটা ছোট শিশুর মৃতদেহ যেন পড়ে রয়েছে! আর তার পাশে একটা মাঝারি আকৃতির বস্তার মধ্যে আরও কিছু জিনিসপত্র দেখা যাচ্ছে। রক্তের গন্ধে হয়তো শিয়ালগুলো গতরাতে বস্তাটা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। তাই, কিছু-কিছু জিনিস সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েছে।
একটু দূর থেকে বস্তার ভিতরে আমরা মেয়েলি কিছু কাপড়চোপড়ও দেখতে পেলাম। আমরা সবাই কিছুক্ষণের জন্য এতসব জিনিসপত্র দেখছিলাম, আর নিজেদের মধ্যে মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছিলাম। আমরা যেন ঘটনা দেখে হতবিহ্বল।
একটু পরে লালভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এসব দেখে তো মনে হচ্ছে ভয়ংকর আলামত। খুব সাবধানে উপরে তুলে আন তো। আর দেখিস, সামনে খুব ঘন জঙ্গল। সাপ-পোকামাকড়ও থাকতে পারে। সেদিকেও একটু খেয়াল রাখিস।”
একথা শুনে আমি একটু সাবধানই হলাম। তবে এসময় পিছন থেকে আতিক ভাই অভয় দিয়ে বললেন, “এখন তো শীতকাল! ভয়ের তেমনকিছু নাই।”
লালভাই তবুও বললেন, “ঢাকায় যে শীত পড়ে! তাই, সাবধানে থাকা ভালো।”
আমি খুব সাবধানে কিছুটা ঢালু পথ বেয়ে নিচে নেমে এসেছি। আর ততক্ষণে আতিক ভাইও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমার সঙ্গে তিনিও কাজে হাত লাগালেন। আমরা সবকিছু উপরে টেনে তুলে দেখি—তা কমপক্ষে আট-দশ কেজি হবে!
লালভাই তার পকেট থেকে তিনটা কালো কাপড়ের ব্যাগ বের করে আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “এগুলো তাড়াতাড়ি তিনটা ব্যাগে ভাগ করে ভরে ফেল। আর সঙ্গের বস্তাটাসহ। এখানে দেখাদেখির কোনোকিছু নাই। সবকিছু চোখ বন্ধ করে ব্যাগে ভরে ফেল। তারপর বাসায় নিয়ে ধীরেসুস্থে সবকিছু দেখা যাবে।”
আমি আর আতিক ভাই তা-ই করতে লাগলাম। ইত্যবসরে লালভাই চারপাশটা আরও ভালোভাবে দেখতে লাগলেন। তিনি হয়তো আরও কিছু খুঁজছেন। কিন্তু আর কোনোকিছু না পেয়ে একটু পরে তিনি ফিরে এলেন আমাদের কাছে।
লালভাইয়ের নির্দেশে আমরা কোনোকিছু না-দেখে দ্রুত সবকিছু তিনটা ব্যাগে ভরে ফেললাম। তারপর তিনজনে তা তুলে নিলাম হাতে।
এখানে একটা কথা বলে রাখি: আমাদের লালভাইয়ের সঙ্গে সবসময় রশি, ব্যাগ, ছুরি, কাঁচি, টর্চলাইট, ম্যাগনিফাইং গ্লাস, প্রাইভেট ডিটেকটিভের ব্যক্তিগত পরিচয়পত্র ইত্যাদি থাকে। তিনি গায়ে যে পোশাকআশাকই ব্যবহার করেন না কেন তারউপরে কৌশলগত কারণে সবসময় অফ-হোয়াইট কালারের একটা সুতি-কাপড়ের হাফ-জ্যাকেট পরিধান করে থাকেন। অনেকটা সাংবাদিকদের জ্যাকেটের মতো। এতে অনেক পকেট! কাজের সুবিধার জন্য আমাদের লালভাই সবসময় এমনটি করে থাকেন। লালভাইয়ের এই বিশেষ জ্যাকেটে ভিতরে-বাইরে মিলিয়ে কমপক্ষে ত্রিশটা পকেট আছে। আর এই একইরকম জ্যাকেট আছে তার তিনটি। অফ-হোয়াইট কালারের দুইটি আর কালো-রঙের একটি। অফ-হোয়াইট কালারের জ্যাকেট তিনি শুধু দিনের বেলা পরিধান করেন। আর রাতের বেলা সবসময় পরিধান করেন কালো-রঙেরটি। আবার শীতকালে তিনি মাঝে-মাঝে কালো-রঙের হাঁটুপর্যন্ত লম্বা ওভারকোটও গায়ে দেন। তখন তাকে পৃথিবীর দ্বিতীয় শার্লক হোমস বলে মনে হয়।

দুপুরের খাঁ-খাঁ রোদে চারদিকটায় এখন মানুষজন খুবই কম। তবুও আমাদের লালভাই বারবার চারিদিকে সতর্কতার সঙ্গে তাকাতে লাগলেন। শেষে বললেন, “আমাদের, এই জায়গাটা দ্রুত ত্যাগ করতে হবে। এখন আমাদের হাতে অধ্যাপক-খুনের এমনকিছু আলামত এসে গেছে যে—তাতে আমরা খুনীদের টার্গেটে পরিণত হতে পারি। আর কালবিলম্ব নয়। চলো সবাই। এখান থেকে আমাদের এখনই সটকে পড়তে হবে। আমি নিশ্চিত যে, খুনীরা ইতোমধ্যে আমাদের পিছনে লেগে গেছে।”

তার কথা শুনে হঠাৎ আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। বুকটা দুরু-দুরু করতে লাগলো আমার। এমনিতে একটু আগে ওই মহিলার হাবভাব আমার মোটেও ভালো লাগেনি। ওসিসাহেবের আচরণও কেমন যেন সন্দেহজনক! লালভাই কী ভাবছেন কে জানে!
গোরস্থান থেকে আমরা তিনজন একসঙ্গে বেরিয়ে এলাম। তারপর বাসায় ফেরার জন্য মনোযোগ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

আমরা তিনজন পাশাপাশি হাঁটছি। এমন সময় ঘটলো একটা বিপত্তি। একটা আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে দ্রুতবেগে সাইকেল চালিয়ে আমাদের সামনে একটা চিঠি ফেলে মুহূর্তের মধ্যে যেন কোথায় হাওয়া হয়ে গেল! আমরা পিছনফিরে তাকে ভালোভাবে দেখার কোনো সুযোগই পেলাম না। আর সে এত দ্রুতগতিতে সাইকেল চালিয়েছে যে, তাকে ধরা তো দূরের কথা—তার ছায়াটুকু পর্যন্ত একনজরের বেশি আমরা কেউই দেখতে পাইনি!
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা একেবারে তাজ্জব বনে গিয়েছি। ছেলেটা যেন ঝড়ের গতিতে এসেছিল! আবার চলেও গেছে তদপেক্ষা বেশি গতিতে! সে যেন কোনো সাক্ষাৎ শয়তানের দূত!
আমাদের বুঝতে বিলম্ব হলো না যে, খুনীরা সবকিছু ধামাচাপা দিতে এখনও খুব সক্রিয়। আর অচেনা আগুন্তুকের এই ঝটিকা আগমনে কিছুটা হতবাক হয়েও লালভাই আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে খুব আস্তে-আস্তে বললেন, “এই কেসে সবেমাত্র বিপদের সূচনা হলো। সামনে আরও কী যে আছে—তা কে জানে!”
কথাটা শেষ করে তিনি একটুখানি হাসলেন। তবে তিনি খুব সাহসীমানুষ। ভয়ডর কখনো তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তার পূর্বপুরুষেরা ১৯৭১ সালে, এই দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তিনি তো তাঁদেরই প্রকৃত উত্তরাধিকারী। আসলে, আমাদের গোয়েন্দা লালভাই একজন নবপ্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা।

লালভাই চিঠিটা মাটি থেকে তুলে আমার হাতে দেওয়ার আগে নিজে একবার পড়ে নিলেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন, “এবার তুই এটা জোরে-জোরে পড়।”
আগেরবার, লালভাই পড়ার সময় আমি একফাঁকে চিঠির একটু দেখতে পেয়েছিলাম। এবার পুরা চিঠিটা হাতে পেয়ে আমি দারুণভাবে শিহরিত। আর এই শিহরণ ভয়ের না রোমাঞ্চকর—তা আমি জানি না।
হাতে লেখা সাদামাটা একটা চিঠি। কিন্তু হুমকিতে ভরপুর!

আমি সরবে চিঠিটা পড়তে লাগলাম:

শোন শালা গোয়েন্দার বাচ্চা গোয়েন্দা,

এখানে বেশি গোয়েন্দাগিরি করবি না। ভালো চাইলে তোরা তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালিয়ে যা। আর এই বাড়ির সামনে তোদের যেন আর কখনো না-দেখি। আর গোরস্থান থেকে যে-সব জিনিসপত্র চুরি করেছিস তা যথাস্থানে রেখে আয়। নইলে, সামনে তোদের ভীষণ বিপদ। গুলিতে তোদের বুক ঝাঁঝরা করে দেবো। জান বাঁচাতে চাইলে তিনজনের হাতের সব জিনিস ফেলে রেখে খুব তাড়াতাড়ি পালা এখান থেকে। যা, এখনই পালিয়ে যা।

ইতি
তোদের যম

এত বিপদের মধ্যেও লালভাই খুব শান্তভাবে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, “ব্যাপারটা বুঝলে? আমাদের হাতে খুনীদের সবকিছু এসে গেছে। ওরা এখন খুব বেপরোয়া। আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। প্রয়োজনে ওরা আমাদের হাতের জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা করতে পারে। তাই, এখন থেকেই সবাই সাবধান হও।”
একথা শোনার পর আতিক ভাই তার ছোট ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এটা তুমি রাখো। আমাকে খালি হাতে থাকতে দাও। যাতে কেউ ধারে-কাছে আসামাত্র দুই-একটাকে খালি হাতেই ঘায়েল করতে পারি।”
লালভাই বললেন, “তোমার বুদ্ধিটা খুব ভালো হয়েছে। হুমকি দিয়ে ওরা কিন্তু বসে থাকবে না। এতসব আলামত আমাদের হাতে এসে পড়ায় ওদের এখন মাথা খারাপ। তার মানে, গোরস্থানেও কেউ আমাদের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রেখেছিল। আর আমরা এখনও ওদের নজরদারিতে। ওদের এই নজরদারির শৃঙ্খলা ভেঙে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে।”
কথা শেষ করে তিনি আমাদের দিকে চেয়ে পুনরায় বললেন, “একটা রিক্সাভ্যান পেলে ভালো হতো। দ্রুত আমাদের বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে। এখানে থাকাটা আমাদের জন্য আর একমুহূর্তও নিরাপদ নয়। হেঁটে যাওয়ায় রিস্ক আছে। এতে বিলম্ব হবে। ওদের সেই সুযোগটা দেওয়া যাবে না। আর ওদের চিঠির ভাষা দেখেছো? একেবারে মাস্তানি ভাষা। ওরা যেকোনো খারাপ কাজ করতে পারে। তাই, আমাদের এখনই আরও সাবধান হতে হবে।”
আতিক ভাই হাঁটার ফাঁকে-ফাঁকে বলতে লাগলেন, “এসব ঘটনা থানায়ও জানানো যাবে না। তার কারণ, ওসি আমাদের সঙ্গে একবার কথা বলারও প্রয়োজন মনে করলো না। তাই, যা করার আমাদেরই বুঝেশুনে করতে হবে। আর ভয় পেলে চলবে না।”
তারপর তিনি লালভাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন, “ভয়ের কিছু নাই। আমি তোমার সঙ্গে আছি প্রোফেসর।”
আতিক ভাইয়ের কথায় মাথা ঝুঁকে আমিও সম্মতি জানালাম।
বলতে-না-বলতে আমরা একটা রিক্সাভ্যান পেয়ে গেলাম। তিনজনে প্রায় লাফিয়ে উঠে পড়লাম এতে। কোনোরকম ভাড়া না মিটিয়েই এতে উঠেছি আমরা। ভাড়া মিটানোর মতো সময় আমাদের হাতে এখন নাই।
ভ্যানচালককে একটু জোরে ভ্যান চালাতে বললেন লালভাই। তার কথা শুনে আতিক ভাই চারিদিকে সতর্কদৃষ্টিতে বারবার চোখ বুলাতে লাগলেন। আর আমি ভ্যানের মাঝখানে তিনটি ব্যাগ আগলিয়ে বসে রয়েছি। এগুলো কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না।
আমার এখন ভয়-ভয় লাগছে। তবে গা-কাঁপছে না। আবার কেমন যেন একটা উত্তেজনাও অনুভব করছি।
লালভাই শুধু একবার বললেন, “আমাদের রিভলবার দুটো সঙ্গে আনা উচিত ছিল।”
আতিক ভাই মনখারাপ করে বললেন, “ঠিক তা-ই। খুব ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, তোমারটা তো সঙ্গে রয়েছে।”
লালভাই এই বিপদের মধ্যেও একটু হেসে বললেন, “আর আমি ভেবেছি, তোমারটা বুঝি সঙ্গে আছে।”
এসব কথাবার্তা শুনে আমার সতর্কতাও একটু বেড়ে গেল।

রাস্তার পাশে দুটো লাঠি পড়ে ছিল। লালভাই ভ্যানচালককে একটু থামতে বললেন। তারপর লাঠি দুটো দ্রুত কুড়িয়ে এনে একটা নিজে রাখলেন। আরেকটি তুলে দিলেন আমাদের বডিবিল্ডার আতিক ভাইয়ের হাতে। ছ’ফুট উচ্চতার আতিক ভাই লাঠিটা শক্তভাবে কৌশলে হাতে ধরে রাখলেন। এবার আমার মনে সাহস ফিরে আসতে লাগলো। তবুও তো আত্মরক্ষার জন্য আমরা কিছু-একটা জোগাড় করতে পেরেছি।
বড় রাস্তায় উঠার একটু আগে দেখি দুটো মোটর সাইকেল দ্রুতগতিতে আমাদের ভ্যানের কাছে এগিয়ে আসছে। দুটো মোটর সাইকেলে দুজন করে মোট চারজন মানুষ রয়েছে। ওদের হাবভাব যে ভালো নয়—তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। প্রত্যেকের মাথায় কালো হেলমেট থাকায় এদের কাউকে পুরাপুরি চেনার বা দেখার কোনো উপায় নাই। শুধু এদের চোখ দুটো দেখা যায়।

মোটর সাইকেল আরোহীরা আমাদের ভ্যানের কাছে এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে ব্যাগগুলো ছিনিয়ে নেওয়ার মতলব করছে। ওরা কাছাকাছি আসতেই লালভাই নিজে পুরা প্রস্তুত হয়ে আতিক ভাইকে ইশারা করতেই তিনি এগুতে থাকা বামদিকের হোন্ডারোহীর কোমরে সজোরে একটা ঘা বসিয়ে দিলেন। আর ডানদিকেরটাকে আঘাত করলেন লালভাই। সঙ্গে সঙ্গে দুদিক থেকে রাস্তার দুপাশে ছিটকে পড়ে গেল হোন্ডারোহীরা। ওদের উঠতে এবার কিছুটা সময় লাগবে।

লালভাই এই সুযোগে আমাদের ভ্যানচালককে আরও স্পিড বাড়িয়ে দিতে বললেন। ছেলেটা তা-ই করলো। আর দেখলাম, আমাদের ভ্যানচালক ছেলেটা সাহসী। সে ভীতুপ্রকৃতির নয়।
হোন্ডারোহীরা পড়ে গিয়েও পড়িমড়ি করে উঠে আমাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। এসব দেখে লালভাই আরও সতর্ক হয়ে আমাকে ব্যাগ তিনটা আরও শক্তভাবে ধরে রাখতে বললেন। আমি আল্লাহর নামে তা-ই করতে লাগলাম। তবে এইসময় আমরা বড় রাস্তার কাছাকাছি এসে পড়েছি।

হোন্ডারোহী-সন্ত্রাসীদলের একটা ছেলে কোমরে হাত দিয়েছে। তা দেখে লালভাই বললেন, “ওরা পিস্তল কিংবা রিভলবার থেকে গুলি চালালে আমরা সঙ্গে-সঙ্গে ভ্যানে কাত হয়ে শুয়ে পড়বো। কিন্তু ছেলেগুলো তা আর করলো না। হয়তো এখনও ওদের সেরকম কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। কিন্তু পোটলাগুলো ওদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ওরা যে ভীষণভাবে মর্মাহত—তা ওদের চেহারা ও আচরণ দেখেই বুঝা গেল। এখন আমাদের মুখে বিজয়ীর হাসি।

বাকি রাস্তাটুকুতে আমাদের আর কোনো বিপদাপদ হলো না। আমরা দুই-তিন মিনিটের মধ্যে বড় রাস্তায় উঠে এলাম।
ভ্যানচালককে আমি দ্রুত ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছি। এই কাজটা সবসময় আমার ওপর ন্যস্ত থাকে। আজও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
বাসস্ট্যান্ডে আসার পর লালভাই আমার হাত থেকে ব্যাগ তিনটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন, “এসো, তাড়াতাড়ি একটা বাসে উঠি। আমরা দ্রুত একটা বাসে উঠলাম। সাভারে পৌঁছুতে এখন আমাদের আর বেশি সময় লাগবে না।”

গাড়িতে উঠেও আমাদের মধ্যে সতর্কভাব বজায় রইলো। এতক্ষণে আমরা বুঝে গিয়েছি যে, আমাদের প্রতিপক্ষ যেকোনোমূল্যে আমাদের নিকট থেকে গোরস্থানে প্রাপ্ত যাবতীয় আলামত ছিনিয়ে নিতে চাইছে। আর ওরা হয়তো তাড়াহুড়া করে অধ্যাপক-খুনের সমস্ত আলামত গোরস্থানে এনে ফেলেছিল। কিন্তু এখন শীতকাল হওয়ায় একদিনে তা আগের মতো অক্ষত রয়েছে। বর্ষাকাল হলে হয়তো রাতের বৃষ্টিতে সকল আলামত ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যেত। কিন্তু সৌভাগ্য আমাদের আর দুর্ভাগ্য ওদের।

ওরা যে মাথামোটা-লোক তা আমরা বুঝতে পেরেছি। তবে ওরা যে এখন ভয়ংকর হিংস্র হয়ে উঠেছে—তারও আমরা হাতেনাতে প্রমাণ পাচ্ছি। সামনের দিনগুলোতে আমাদের লালভাইকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। তার চিন্তায় আমি বিচলিত হয়ে পড়লাম। তিনি হয়তো আমার মনোভাব বুঝতে পেরে কয়েকবার আমার দিকে তাকালেন আর শেষে বললেন, “ভাবনার কিছু নাই। গোয়েন্দাদের জীবনে এমন সব ঘটতেই থাকবে। আর এসব মোকাবেলা করেই আমাদের টিকে থাকতে হবে। অবশ্য আমাদের একটা বড় ভুল হয়ে গিয়েছে সঙ্গে অন্তত একটা রিভলবার না রেখে।”

লালভাই বাসে উঠে এতক্ষণ কী যেন ভাবছিলেন। এই প্রথম তিনি মুখ খুললেন। তারপর তিনি আবার আগের মতো চুপচাপ বসে রইলেন। তিনি সামনের সিটে একজন লোকের সঙ্গে বসেছেন। আর, আমি আর আতিক ভাই বসেছি তার পিছনে পাশাপাশি দুই সিটে। আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপআলোচনা চালাচ্ছিলাম।

আতিক ভাই বললেন, “আজ থেকে আমাদের অনলাইন দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক সত্যবাণী’ আবার চালু করবো। এতদিন পত্রিকাটা আলসেমি করে ফেলে রেখেছিলাম। এইসব অপরাধীকে শায়েস্তা করতে হলে আমাদের নিজস্ব একটা দৈনিক পত্রিকা হাতে থাকা ভালো।”
তারপর তিনি একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগলেন, “ভাবছি, আমি এর সম্পাদক হিসাবে থাকবো। কারণ, তোমার ভাইয়ের তো সময় নাই। আর তুমি হবে এর একমাত্র সহকারী সম্পাদক। আজ থেকেই আমি তোমাকে এই পদে নিয়োগ করলাম। আসলে, পত্রিকাটা এখন থেকে তুমিই চালাবে। আমরা দুজন শুধু অভিভাবক হয়ে তোমার উপরে থাকবো।”
কথাটা শুনে আমি যেন তাজ্জব হয়ে গেলাম। হঠাৎ এতবড় একটা দায়িত্ব! আমার যেন নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তার কারণ, আমাদের আতিক ভাইয়ের সম্পাদিত অনলাইনভিত্তিক দৈনিক সত্যবাণী পত্রিকাটা ঢাকা-শহরে ভালো একটা ইমেজসৃষ্টি করতে পেরেছে। আর আমি হবো সেই পত্রিকার একজন সহকারী সম্পাদক! অবশ্য আমি ইতঃপূর্বে দুই-একটি পত্রিকায় সংবাদকর্মী হিসাবে কাজ করেছি। তবুও...।
আতিক ভাই ধীরে ধীরে আরও বললেন, “তুমি হয়তো ভাবছো, তুমি এতবড় দায়িত্বপালন করতে পারবে না। আসলে, তা নয়। আমার মন বলছে, তুমি পারবে। আর তোমাকে পারতেই হবে।”
তার উৎসাহে আমি একটু হেসে অবশেষে বললাম, “পারবো ভাই, আপনারা পাশে থাকলে পারবো, ইনশা আল্লাহ।”
হঠাৎ লালভাই সামনে থেকে বললেন, “তোকে পারতেই হবে।”
সামনে থেকে লালভাই যে আমাদের সব শুনেছেন—তা বুঝতে পেরে আমরা দুজনে অবাক হলাম।
তিনি আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, “তোমরা হয়তো ভাবছো, আমি তোমাদের এত আস্তে বলা কথা কীভাবে শুনলাম! আরে, এইজন্যেইতো আমরা গোয়েন্দা। আমাদের নার্ভগুলো অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদা।” বলে তিনি হাসতে লাগলেন।
লালভাই যখন আমাকে খুব বেশি স্নেহ করেন তখন তুই বলে সম্বোধন করেন। আর যখন তার স্বাভাবিক স্নেহ থাকে কিংবা লোকজনের সামনে তিনি আমাকে তুমি বলেই সম্বোধন করে থাকেন।
বাসের একটা লোক আমাদের পাশের সিট থেকে নেমে গেলে লালভাই তার জায়গায় এসে আমাদের পাশাপাশি বসলেন। আর বললেন, “আতিকের ধারণা-ভাবনা যাই বলি না কেন—তা একেবারে সঠিক। সমাজবিরোধী-অপরাধীদের শায়েস্তা করার জন্য আমাদের নিজের একটা দৈনিক পত্রিকা থাকা জরুরি। দেশে অনেক দৈনিক আছে। কিন্তু এদের বেশিরভাগই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশবিরোধী-শয়তানী অপকর্মে নিয়োজিত। এজাতীয় শয়তানদের সংবাদ ও যাবতীয় নিউজসমূহ জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। আর কোনো-কোনোক্ষেত্রে তা ছড়াচ্ছেও। এদের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আমাদের দৈনিক সত্যবাণী রাষ্ট্র ও সমাজকে রক্ষা করতে পারবে বলে আমি মনে করি। তাই, তুই আজ থেকেই কাজে লেগে যা।”
আমি এবার ভিতরে-ভিতরে মানসিক প্রস্তুতিগ্রহণ করতে লাগলাম।
একটু পরে আমার দিকে চেয়ে লালভাই আবার বললেন, “তুই তো ইতিহাসে অনার্স ও এমএ ডিগ্রী অর্জন করেছিস। তারপর নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য অধ্যয়ন করছিস। তোকে দিয়ে এ-কাজ হবে। আর তা হতেই হবে।”
লালভাইয়ের এই উৎসাহে ও সমর্থনে আমার মনোবল আরও বেড়ে গেল। আমিও মনে মনে শপথ নিলাম: আজ থেকে নতুনভাবে ‘দৈনিক সত্যবাণী’ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাবো।
আতিক ভাই আমার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, “সাজিদ মনে হয় একটা কথা জানো না!”
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “কী?”
তিনি বললেন, “আমাদের এই পত্রিকার মালিক কিন্তু তোমার লালভাই।”
সত্যি, এবার আমি দারুণভাবে উত্তেজিত ও বিস্মিত। একথা আমার আগে কখনো জানা ছিল না।
আর একথা শুনে আমাদের লালভাই হেসে বললেন, “মালিক হলেও পত্রিকাটা এবার চালাতে হবে তোমাদের।”

আমরা নিরাপদেই সাভার বাসস্ট্যান্ডে এসে নামতে পারলাম। পথে আমাদের ওপর আর কোনো হামলার প্রস্তুতি কেউ করেছিল কিনা তা জানতে না পারলেও একপ্রকার স্বস্তিতে আমরা এখন বাসায় ফিরে যাচ্ছি। তবে এখনও সতর্কতার কোনো ঘাটতি নাই। আমাদের চোখকান সবসময় খোলা রয়েছে। আমরা যে বিশ্ববিখ্যাত গোয়েন্দা তথা গোয়েন্দাসম্রাট শার্লক হোমসের উত্তরসূরী।

গোরস্থান থেকে প্রাপ্ত সমস্ত আলামত দেখার জন্য আমাদের সবার মন ছটফট করছে। তাই, আমরা যে যার বাসায় না গিয়ে লালভাইয়ের বাসায় একত্রিত হলাম। কিন্তু ব্যাগ খোলার মতো ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য কারও নাই। কারণ, ক্ষুধায় আমাদের পেটের ভিতরে কেমন যেন করছে! আমরা হাত-মুখ ধুয়ে তাই আগে খেতে বসলাম।





পড়ন্ত দুপুরে আমরা খাবার-টেবিলে বসে উদরপূর্তিতে ব্যস্ত । আমাদের তিনজনের পেটে এখন প্রচণ্ড ক্ষুধা। আর ক্ষুধার রাজ্যে যেন আমরা তিনজন দীর্ঘকাল যাবৎ বসবাস করছি। গোরস্থান থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন আলামত দেখার ইচ্ছে থাকলেও এইমুহূর্তে তা আমরা করতে পারছি না। তাই, আগে জীবন বাঁচাবার কাজে আমরা লেগে পড়লাম।
আমার চাচীমা খাবার পরিবেশন করতে লাগলেন। আমি বাধা দিয়ে তাকে বিশ্রামের জন্য ভিতরে পাঠিয়ে দিলাম। এই কাজটি এবার আমি নিজেই করতে লাগলাম। আমি প্রায় সময় এই কাজটি করি। এটা করতে আমার ভালো লাগে।
আজ বাসায় আমাদের লালভাবি নাই। তিনি খুব সম্ভবত তার বাবার বাড়িতে গিয়েছেন। যদিও এব্যাপারে আমি এখনও লালভাইকে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। শুধু অনুমানে বুঝে নিয়েছি। আর এব্যাপারে কিছু বলার মতো অবস্থাও আমাদের নাই। সবাই আমরা কেসটা নিয়ে খুব চিন্তাভাবনা করছি।
ভাবি বাড়িতে থাকলে আমাদের খাওয়াদাওয়া আরও জাঁকজমকপূর্ণ হয়। তিনি সবসময় পাশে থেকে সবকিছুর তদারকি করে থাকেন। আজ আমি আর আতিক ভাই তার অভাবটা বুঝতে পারলাম।
আমরা তিনজন তাড়াতাড়ি খাচ্ছিলাম। তবে আতিক ভাই সবচেয়ে এগিয়ে। তিনি আরও দ্রুত খাচ্ছেন। তার খাওয়ার স্টাইল দেখে লালভাই বললেন, “একটু ধীরে খাও ভাই। খাবার তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না! সব তো টেবিলেই পড়ে থাকবে।”
একথা শুনে তিনি হেসে ফেললেন। তারপর মুখের গ্রাসটুকু হজম করে হেসে বললেন, “গোরস্থানের জিনিসপত্রগুলো দেখার জন্য মনে মনে খুব অস্থির হয়ে রয়েছি। তাই, একটু জোরে হাত-মুখ চালাচ্ছিলাম আরকি!”
খাওয়ার পরে আমরা তিনজন ডাইনিং-রুম পেরিয়ে ভিতরের কক্ষের দিকে প্রবেশ করলাম। এটা লালভাইয়ের পড়ার ঘর। এর তিনদিকে দেওয়ালসংলগ্ন বুক শেলফে বই-আর-বই। এখানে, চারিদিকে শুধু বই। আমাদের লালভাই গ্রন্থপ্রেমিক মানুষ। চাকরির সময়টুকু বাদে তিনি অবসরে বই পড়ে কাটান। বই তার নিত্যসঙ্গী। আর জীবনসঙ্গী বললেও হয়তো ভুল বলা হবে না।
লালভাই তার রুমের দরজাটা একটু চাপিয়ে দিলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এবার তুই ব্যাগ তিনটা থেকে জিনিসপত্রগুলো আস্তে-আস্তে বের কর তো। আর দেখিস, কোনো জিনিস যেন অসাবধানতায় নষ্ট না হয়।”
আমি জিনিসপত্রগুলো মেঝেতে ধীরে ধীরে ঢালতে লাগলাম। এত জিনিসপত্র দেখে আমাদের তিনজনের চক্ষু চড়কগাছ! হত্যাকারীরা তাদের হত্যাসংক্রান্ত যাবতীয় সরঞ্জামাদিসহ সবকিছু একজায়গায় পূঞ্জীভূত করে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু ওদের ভাগ্য খারাপ। ওদের পাপের সমস্ত আলামত এসে পড়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঠাণ্ডা মাথার দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা আমাদের লালভাইয়ের হাতে।
সেই রক্তমাখা পুতুলটা ব্যতীত আমরা আর যা পেয়েছি তার একটি তালিকা তৈরি করতে লাগলাম। এ পর্যন্ত আমরা গোরস্থানে প্রাপ্ত বস্তা থেকে পেয়েছি: রক্তমাখা একটি হলুদ শাড়ি, রক্তমাখা একটি লাল ব্লাউজ, রক্তমাখা একটি কালো ব্রেসিয়ার, রক্তমাখা একটি লালরঙের পেটিকোট, একটি রক্তমাখা মাঝারি আকৃতির বালিশ, দুইটা বিছানার চাদর (একটা হলুদ রঙের ও আরেকটি গোলাপি), একটা পলিথিনের মধ্যে কাপড়ে মোড়ানো একটা মাঝারি আকৃতির রক্তমাখা ছোরা, রক্তমাখা একটি বই (রাইফেল রোটি আওরত), দুইটি ডায়েরি, রক্তমাখা একটি সালোয়ার ও একটি কামিজ, পুরুষদের ব্যবহার্য একটি রক্তমাখা গেঞ্জি, একটি রক্তমাখা নীল-সাদার সংমিশ্রণের লুঙ্গি, আর মেয়েদের ব্যবহার্য ও ব্যবহৃত একজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল।
আমি খুব অল্পসময়ের মধ্যে তালিকাটা তৈরি করে ফেললাম। তারপর লালভাই সব জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে খুব মনোযোগ দিয়ে তা দেখতে লাগলেন। এসময় আমরা কেউই কোনো কথাবার্তা বললাম না। তবে একটু দূরে বসে আমরা দুজন নিজেদের মধ্যে কিছু ব্যাপার নিয়ে আলাপআলোচনা করতে লাগলাম। মাঝে-মাঝে আমরাও তাকিয়ে দেখতে লাগলাম জিনিসগুলো।
লালভাই জিনিসগুলো দেখেশুনে আমাদের মুখোমুখি একটা সোফায় বসে বলতে লাগলেন, “যা ভেবেছিলাম তা-ই। এই কেসেও মেয়েদের সম্পর্ক রয়েছে। আর যেকোনো খুনের সঙ্গে মেয়েদের একটা-না-একটা সম্পর্ক থাকেই। এখানে, যে-সব আলামত আমরা পেয়েছি তার প্রায় সবই খুনীদের। রক্তমাখা গেঞ্জি ও লুঙ্গিটা খুব সম্ভবত নিহত অধ্যাপকসাহেবের। আর ডায়েরি দুটো আজাদ কালামের। তার কিছু প্রমাণও আমি পেয়েছি। আমি ডায়েরি দুইটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। সেখানে এই খুনের আগের কোনো ঘটনার কথা লেখা নাই। পুরা ডায়েরি দুইটা ঘেঁটে দেখলাম, সেখানে শুধু জমিজমা আর টাকাপয়সার সমস্ত হিসাবনিকাশ রয়েছে। তবে এটাও আমাদের কাজে দিবে। আর এটার দুই জায়গায় শুধু লেখা রয়েছে: ‘আজকাল মামাকে খুব হতাশাজনক অবস্থায় দেখি। তারউপরে কেউ কোনো চাপসৃষ্টি করছে কিনা জানি না। এব্যাপারে তিনি আমাকে কিছু বলছেন না।...মামাকে কেউ মনে হয় হুমকি দিচ্ছে। তার ভিতরে একটা চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। কিন্তু এখনও তিনি এব্যাপারে আমাকে কিছুই বলছেন না।’ এছাড়া ডায়েরিতে আর-কিছু লেখা নাই।”
তিনি মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, “পরে তুই ডায়েরি দুইটা আরও ভালোভাবে ঘেঁটে দেখবি তো। কোথাও কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা!”
এরপর লালভাই গভীরভাবে চিন্তায় মগ্ন হয়ে রুমের মাঝখানের প্রশস্ত জায়গাটায় পায়চারী করতে লাগলেন। এভাবে কয়েকবার পায়চারী করতে-করতে তিনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে পায়চারী না থামিয়ে বললেন, “আমি এখন যা বলি তুই সবকিছু তাড়াতাড়ি একটা কাগজে নোট কর তো।”
আমি লালভাইয়ের নির্দেশে কাগজ-কলম নিয়ে নোট করতে শুরু করলাম।
তিনি পায়চারী করতে-করতে বলতে লাগলেন, “এই খুনে কমপক্ষে তিনজন অংশ নিয়েছিল। একজন পুরুষ আর দুইজন মহিলা। হলুদ শাড়ি, লালরঙের ব্লাউজ ও কালো-ব্রেসিয়ার একজন মহিলার। আর সালোয়ার-কামিজটা ও তৎসঙ্গে পাওয়া লাল-ব্রেসিয়ার আরেকজন মহিলার। এরা হত্যার অংশীদার কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী ও সহযোগী। তবে আমার এই সালোয়ার-কামিজটা ও লাল-ব্রেসিয়ার দেখে মনে হচ্ছে, এটা কোনো কাজের মেয়ের। তার কারণ, এই পোশাকগুলো একটু নিম্নমানের। এখানে, যে মূল খুনী সে পুরুষ। আর সে কিন্তু নিজের কোনো জামাকাপড় বা পোশাকপরিচ্ছদ এইসব আলামতের সঙ্গে রাখেনি। বুঝা যায়, সে খুব ধূর্ত আর সাবধানী। আমরা আজ নিহত অধ্যাপকসাহেবের পুত্রবধূ শাহীনা বেগমের সঙ্গে তার বাড়িতে যে কাজের মেয়েটিকে দেখেছি, এগুলো তার পোশাক নয়। সে বয়সে ছোট। একদম কিশোরী। তার ব্রেসিয়ার পরার বা এতবড় সালোয়ার-কামিজ পরার সুযোগ নাই। এখন আমাদের শনাক্ত করতে হবে যে, ওই সালোয়ার-কামিজ ও লাল-ব্রেসিয়ার, আর হলুদ শাড়ি, লাল-ব্লাউজ আর কালো-ব্রেসিয়ারটি কার? তাহলে, আমরা অতিসহজেই খুনীর কাছে পৌঁছে যেতে পারবো।”
এরপর লালভাই পায়চারী থামিয়ে সোফায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন।
লালভাই আমাদের বসতে বলে একটু ভিতরের দিকে গেলেন। এই সুযোগে আমরা দুজন জিনিসপত্রগুলো নাড়াচাড়া করে দেখতে লাগলাম। এসব দেখতে আমাদের যে ভালো লাগে তা নয়। আমরা শুধু লালভাইকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য এসব করে থাকি। আর যেকোনো খুনের ঘটনাই আমাদের কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
আতিক ভাই সব জিনিস দেখেশুনে বললেন, “তোমার ভাইয়ের কথাই ঠিক। এই কেসটাতে আমিও ধারণা করছি এখানে কোনো মহিলার হাত রয়েছে কিংবা তার যোগসাজশেই এগুলো হয়েছে।”
আমার মনে হলো তিনি যেন আমার মনের কথাটাই বলেছেন। আমি তার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলাম।
লালভাই ফিরে এলেন একটু পরেই। তারপর তিনি পুনরায় আলামতসমূহ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বসলেন। তিনি এমনই করেন। একটা বিষয় নিয়ে তিনি বারবার গবেষণা করেন। তিনি মনে করেন, এভাবে কাজ করলে প্রমাণ খুঁজে পেতে সহজ হয়। একবারে হয়তো অনেককিছু চোখে পড়ে না। কিন্তু বারবার প্রচেষ্টার ফলে সেই বিষয়ে বাদ পড়া এমন অনেককিছু আবার নতুনভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়।
আমাদের লালভাইয়ের গোয়েন্দাগিরিতে তদন্তের মূলনীতি বা মূলসূত্র হলো পাঁচটি। প্রথমত; যেকোনো খুনের ঘটনার সঙ্গে সবসময় কোনো-না-কোনোভাবে কোনো মহিলা হয়তো খুনের আর নয়তো খুনসৃষ্টির ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এখানে, দুই-একজন মহিলা মূলঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো একটি ঘটনাক্রমে জড়িত থাকবেই। দ্বিতীয়ত; খুনের যেকোনো ঘটনার সঙ্গে স্বার্থসংল্লিষ্ট যেকোনো বিষয়, জমিজমা, অর্থসম্পদ, নারীঘটিত বিষয়, তহবিল-তসরুফ ইত্যাদির সম্পর্ক জড়িত থাকবে। তৃতীয়ত; যেকোনো খুনের ঘটনার সঙ্গে পরকীয়া-প্রেমের একটা সম্পর্ক রয়েছে। খুনী বা খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকারও পরকীয়া-প্রেমের সম্পর্ক থাকতে পারে। চতুর্থত; রাজনৈতিক ও ধর্মীয় হত্যকাণ্ডের বাইরে পৃথিবীর যেকোনো সামাজিক ও পারিবারিক খুনের সঙ্গে আত্মীয়স্বজনের সংশ্লিষ্টতা থাকবেই। পঞ্চমত; কোনো প্রবাসীর স্ত্রী দেশে থাকলে, এবং প্রবাসীর কোনো আত্মীয়স্বজন খুন হলে এর সঙ্গে তার স্ত্রীর বা স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যায় না। এদের সবসময় সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে।
তিনি এভাবেই তার সূত্রসমূহের মাধ্যমে তদন্তকাজে অগ্রসর হন। তার চিন্তাভাবনা নিরীহ কাউকে হয়রানি কিংবা লাঞ্ছিত করার জন্য নয়। প্রাথমিকভাবে তিনি মনে মনে সবাইকে সন্দেহ করলেও পরে তদন্তসাপেক্ষে শুধু সন্দেহভাজনদের রেখে বাকি সবাইকে তদন্ত থেকে বাদ দেন। তিনি সবসময় তার এই পঞ্চসূত্র মেনে চলেন।
লালভাই তার সর্বশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষাশেষে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এগুলো এখন একটা বড় বস্তার মধ্যে ভরে রাখো। আপাতত এ-বিষয়ে আমাদের কাজ শেষ। এগুলো তিনটি ব্যাগে আর ভরে রাখার প্রয়োজন নাই।”
আমি অম্লানবদনে লালভাইয়ের আদেশপালন করতে লাগলাম।
কাজের মেয়েটা আমাদের জন্য ইতোমধ্যে চা দিয়ে গেল। আমরা চা-পানে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
চায়ে চুমুক দিয়ে লালভাই বললেন, “আগামীকাল আমরা তিনজন আবার ধামরাই যাবো। এবার শুধু অধ্যাপকসাহেবের বাড়ির বাগানে বা আশেপাশে নয়—তার বাড়ির ভিতরেও—মানে অন্দরমহলেও প্রবেশ করবো। আর খুঁটে-খুঁটে সবকিছু দেখবো।”
তার একথা শুনে আতিক ভাই যেন রীতিমতো আঁতকে উঠে বললেন, “আবার ওই বাড়িতে! কিন্তু ওরা তো দরজাই খুলবে না! আর ওরা যদি আমাদের ওপর আবার কোনো হামলা করে?”
লালভাই এতে একটু হেসে বললেন, “আরে, এবার ওদের সে সুযোগ আমরা দিচ্ছি না। আর তুমি এত ভয় পাচ্ছো কেন? এবার আমরা ছদ্মবেশে যাবো। আর তিনজন একসঙ্গেই ছদ্মবেশধারণ করবো।”
তারপর তিনি একটু থেমে বলতে লাগলেন, “তবে শোনো, তোমাদের কাছে ব্যাপারটা খুলেই বলছি। আমি আর সাজিদ ‘দৈনিক সত্যবাণী’র সাংবাদিক হিসাবে সেখানে হাজির হবো। আর তুমি হবে আমাদের বহনকারী বিশ্বস্ত এক রিক্সাওয়ালা। এতে তিনজনেই প্রয়োজনে দাঁড়ি-গোঁফ ব্যবহার করবো। এবার বলো রাজী কিনা?”
এবার আতিক ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তিনি খুশিতে বললেন, “এবার আমি একশ’বার রাজী। আর ছদ্মবেশের কথা শুনে মনে মনে দারুণ একটা উত্তেজনা অনুভব করছি।”
হঠাৎ লালভাই একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। আমরা সেখানে একটা রিক্সা কীভাবে জোগাড় করবো? আমার তো সেখানে পরিচিত কেউ নাই।”
লালভাইয়ের মুখ থেকে একথা শুনে আতিক ভাই বীরত্বের সঙ্গে হেসে বললেন, “শোনো প্রোফেসর, তুমি নিজেকে এতটা একা মনে করছো কেন? আমি তো সঙ্গে রয়েছি। আর আমি তো রাজনীতি করি। এর সুবাদে আশেপাশের সবজায়গায় আল্লাহর রহমতে আমার পরিচিতজন রয়েছে। আমি এখনই একটা রিক্সার ব্যবস্থা করছি।”
আতিক ভাই কথা শেষ করে তখনই কাকে যেন ফোন করলেন। ওপাশ থেকে কারও কথা শুনে তিনি হেসে ফোন রেখে লালভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাও, তোমার রিক্সার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমাদের জন্য আগামীকাল সকাল দশটায় একটা ভালোমানের রিক্সা ধামরাই-বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমাণ থাকবে।”
লালভাই হেসে বললেন, “তুমি আসলেই একটা কাজের মানুষ। তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না।”

আমরা যখন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ব্যস্ত তখন দরজার কলিংবেল বাজার শব্দ শুনলাম। দরজা খুলতে আমিই ছুটে যাচ্ছিলাম। কিন্তু লালভাই আমাকে বাধা দিয়ে বসতে বললেন। তিনি নিজে উঠে গিয়ে দরজা খুলে ভিতরে নিয়ে এলেন একজন বিশ-একুশ বছরের যুবককে। ছেলেটি কিছু বলার আগেই লালভাই তাকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
বললেন, “এ হচ্ছে অধ্যাপক-খুনের প্রধান আসামী আজাদ কালামের আপন ছোটভাই আজাদ রায়হান। ও-কে আমি ডেকে এনেছি। এজন্য একটু আগে ও-কে ফোন করেছিলাম। ওর কাছে যদি কোনো তথ্য থাকে তাহলে আমাদের উপকার হবে। আর যেকোনো প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সামনাসামনি বসে বললে সবচেয়ে ভালো হয়। এজন্যই আসলে ও-কে ডেকেছি।”
লালভাই সরাসরি কাজের কথায় চলে গেলেন। তিনি রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রথমে সংক্ষেপে তোমার একটু পরিচয় দাও। তারপর আমাদের কিছু প্রশ্নের জবাব দিবে।”
রায়হান মলিনমুখে বললো, “আমার নাম আজাদ আবু রায়হান। সংক্ষেপে আজাদ রায়হান। আমার বড়ভাইয়ের নাম আজাদ আবুল কালাম। সংক্ষেপে আজাদ কালাম। আমরা দুই ভাই। আর আমাদের একজন বড় বোন রয়েছেন। তার বিবাহ হয়েছে বছর চারেক আগে। আমাদের মা জীবিত নেই। বাবা এখনও জীবিত আছেন। আর আমি বর্তমানে ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে দ্বিতীয় বর্ষে অনার্সে পড়ছি।”
“এবার বলো এই খুনের ঘটনায় তোমার কাকে সন্দেহ হয়?”—লালভাই আচমকা তাকে প্রশ্ন করলেন।
একথা শুনে সে মাথানিচু করে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবতে লাগলো। শেষে আমাদের দিকে মুখ তুলে বললো, “আমার কাউকে সন্দেহ হয় না। আমি খামাখা কাকে সন্দেহ করবো? আর কার নাম বলবো? তবে আমার মনে হয়, আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজন জড়িত থাকলেও থাকতে পারে। তবে এদের কারও নাম আমি বলতে পারবো না। কে যে জড়িত তা আমি আসলে জানি না। আর-একটা কথা, এই খুনের সঙ্গে আমার ভাইয়ের কোনো সম্পর্ক নাই। এব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত। সে এরকম কোনো অমানুষ নয়। আমার মরহুম মামাজান তাকে খুব বেশি বিশ্বাস করতেন। সে কখনো মামার বিশ্বাসভঙ্গ করেনি। মামার জমিজমা থেকে শুরু করে ব্যাংকের সকল হিসাবনিকাশও আমার ভাই দেখাশোনা করতো। বিশেষ করে আমার মামাজানের একমাত্র পুত্র শ্রদ্ধেয় আবুল বাশার সরকার সাহেব মামার ওপর রাগ করে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ার পর থেকে মামার সবকিছু দেখাশোনার দায়দায়িত্ব বর্তায় আমার এই ভাইয়ের ওপর। এতে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, মামাজান আমার ভাইকে কতখানি বিশ্বাস করতেন।”
“তোমার একমাত্র মামাতো ভাই কী কারণে পিতার ওপর রাগ করে হঠাৎ অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমালেন?”—একটু খুলে বলবে কি?
লালভাইয়ের একথা শুনে সে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো, “মামা সবসময় চাইতেন তিনি এই প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেঁচে থাকবেন। এজন্য তিনি এখানে বাড়ি করেছেন। তার একটি স্বপ্ন ছিল তিনি এখানে বড়সড় একটা কৃষিখামার গড়ে তুলবেন। এজন্য তিনি ধামরাইয়ের ওই বাড়িটা থেকে মাইল তিনেক দূরে মানে একটু ভিতরে একসঙ্গে একশ’ এগারো বিঘা জমি কিনেছেন। এই জমি ক্রয়ে কোনোপ্রকার ঘাপলা নাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও, স্থানীয় কিছুসংখ্যক টাউট ও হাউজিং কোম্পানির ভূমিদস্যুদের সঙ্গে মামার একটা বিরোধ হয়। আর এই বিরোধের জের ধরে ওরা মামার বিরুদ্ধে দুইটি মামলাও দায়ের করে। এখানে, বলে রাখি মামার ওই মামলা পরিচালনা করার সময় স্থানীয় ধামরাই-থানার ওসি গোলাম মওলা মামার কাছে যাতায়াত শুরু করে। ওর আচার-ব্যবহার দেখে মামাও তাকে নিজের ছেলের মতোই মনে করতেন। এভাবে, বর্তমান ওসি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে ওঠেন।”
“তোমার মামাতো ভাই কখন অস্ট্রেলিয়ায় যান?”—লালভাই আবার প্রশ্ন করলেন।
রায়হান নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলতে লাগলো, “মামার বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুদের মামলার বছরখানেক আগেই আমাদের মামাতো ভাই বিদেশে পাড়ি জমান।”
লালভাই একটুখানি গম্ভীর হয়ে বললেন, “আচ্ছা ভালো। এবার একটু বলো তো, এই ওসিসাহেব কেমন মানুষ?”
রায়হান এবার মনমরা হয়ে বললো, “তাকে তো আমরা নিজের ভাইয়ের মতোই মনে করতাম। তার সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। কখনো তাকে আমার খারাপ মনে হয়নি। কিন্তু এবার কেন যে তিনি খুনের অভিযোগে আমার ভাইকে গ্রেফতার করলেন! তাকে আসামী বানালেন। এমনকি এ-খবর শোনার পর আমি যখন তাকে ফোন করেছিলাম তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার ভাইয়ের হাতেই তোমার মামা খুন হয়েছেন। গত কয়েকদিন আগে সে তোমার মামার কাছে পাঁচ লক্ষ টাকা দাবি করেছিল। বেচারা দেয়নি বলে তাকে নির্মমভাবে খুন করেছে। আর-একটা কথা বলে রাখি, এই খুনের সঙ্গে তোমারও নাকি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তা আমাদের থানার দারোগাসাহেব খুঁজে পেয়েছেন।’ তারপর তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলেন, ‘তা তুমি এখন আছো কোথায়?’ এরপর তার কথা শুনে আমি ভয়ে ফোনলাইন কেটে দিয়েছিলাম। আর ওই মোবাইল-সিমও বন্ধ করে রেখেছি।”
লালভাই কিছুক্ষণ কী যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন, “তুমি এখন থাকো কোথায়?”
সে বললো, “আমি এক বন্ধুর বাসায় উঠেছি। আগে বঙ্গবন্ধু-হলে থাকতাম। আপনার জ্ঞাতার্থে আরও বলছি: আমি ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকে একটা মেসে থাকতাম। টাকা পাঠাতেন মামা। মানে আমার ভাইয়ের মাধ্যমে। এরপর আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে মামা আমাকে হলে উঠতে বললেন। আমি তা-ই করলাম। আর টাকা পাঠাতেন আমার এই মামা। আমার বড়ভাই কালাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে মামাজান খুব খুশি হয়েছিলেন। তাহলে, তার বিষয়সম্পদ সবকিছু কালাম ভাই দেখাশোনা করতে পারবে। এরপর থেকে আমার ভাই এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে ও মামার সবকিছু দেখাশোনা করতে লাগলো। এজন্য মামা তাকে খুব বেশি স্নেহ করতেন। আর সেও মামাকে পিতার মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করতো। আপনি হয়তো জানেন না, আমাদের মা মারা গিয়েছেন প্রায় এগারো বছর আগে। এরপর তিনিই আমাদের পিতার আদরে মানুষ করেছেন। আমাদের বড় বোনটিকে তিনি ভালো একটা পরিবারে বিবাহ দিয়েছেন। আমাদের বাবা একটু বাউণ্ডুলে স্বভাবের। তিনি তাবলিগ-জামাতের নামে চিল্লা দিয়ে বছরের বেশিরভাগ সময়ই এখানে-সেখানে পড়ে থাকেন। আমাদের বাড়ি কাছেই। এই তো মানিকগঞ্জে। কিন্তু আম্মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা আর সেখানে থাকতেন না। তিনি চিল্লা থেকে কখনো আমাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে এলে আমাদের এই মামার বাড়িতে এসে উঠতেন। সবকিছু মিলিয়ে এই মামা আমাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। তাই, আপনিই বলুন, এরকম একজন মহান আত্মীয়কে কেউ খুন করতে পারে? আমার বিশ্বাস হয় না স্যার। সেইজন্য আপনাকে সবকিছু তদন্ত করে দেখতে বলেছি। আর আপনার প্রাপ্য সম্মানী আমরা দিয়ে দিবো।”
তার শেষের কথাটা শুনে আতিক ভাই বললেন, “ও-সব নিয়ে এত ভাবনার কিছু নাই। আগে মহান স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা কর, যেন আমাদের লালভাই এই তদন্তে সফলকাম হন।”
ছেলেটি এবার কাঁচুমাচু হয়ে বললো, “সে তো অবশ্যই।”
“আচ্ছা তোমার মামাতো ভাই কি তার পিতাকে খুন করতে পারেন? তোমার কী মনে হয়? আর এব্যাপারে তুমি আমার কাছে কোনোকিছু গোপন করবে না।”—লালভাই কথাটা বলে রায়হানের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

রায়হান এবার খুব ভেবেচিন্তে বলতে লাগলো, “তাহলে, আপনাকে আরও কয়েকটি কথা বলি। আমার মামা খুব ভালোমানুষ ছিলেন। আর ছিলেন খুব হিসেবী। তিনি সারাজীবন খুব হিসাবনিকাশ করে চলেছেন বলে এত বিষয়সম্পদ করতে পেরেছেন। আমার জানামতে, তিনি প্রচণ্ড সৎমানুষ ছিলেন। সরকারি কলেজের চাকরির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন বই-পুস্তক-গাইড লিখে টাকাপয়সা আয় করতেন। আর সংসার-খরচের টাকা বাঁচিয়ে তিনি জমিজমা ক্রয় করতেন। এটা ছিল তার নেশার মতো। এতদিন তার স্ত্রী তাকে এই মহৎকাজে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু চার বছর আগে তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে মামা খুব একা আর নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। আমার মামার আর-কোনো ছেলেমেয়ে না থাকায় তিনি বাড়িতে প্রায় একাকী থাকতেন। তার কোনো মেয়ে ছিল না বলে তিনি একমাত্র ছেলের বউকে খুব ভালোবাসতেন। আর ছেলের ঘরের ছেলে-মেয়ে দুটো তো বলতে গেলে তার জান ছিল। আমার মামী মারা যাওয়ার পর থেকেই পরিবারের সম্পূর্ণ হিসাবনিকাশের দায়দায়িত্ব এসে অর্পিত হয় আমার ভাইয়ের ওপর। সে নিষ্ঠার সঙ্গে এই দায়িত্বপালন করে চলছিলো। আমাদের মামাতো ভাই আবুল বাশার সাহেব পিতার মতো দূরদর্শী কিংবা সঞ্চয়ী নন। তিনি বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সেইজন্য তিনি ধামরাইয়ে বসবাস করতে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু মামা তাকে সেখানে বাস করতে কখনো জোরজবরদস্তি করেননি। এমনকি মামা তাকে কয়েকবার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকায় গিয়ে থাকতে। ঢাকার মিরপুরে মামার একটি ১৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে। সেটি বর্তমানে ভাড়া দেওয়া আছে। ঢাকার তিনটি প্লটের সঙ্গে এটাও দেখাশোনা করে আমার বড়ভাই কালাম। মামা যে বাশার ভাইকে ঢাকায় গিয়ে বসবাস করতে বলেছেন—তা আমি একাধিকবার নিজের কানে শুনেছি। কিন্তু আমাদের বাশার ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল ঢাকায় মামার যে তিনটি প্লট আছে তা ডেভেলপারদের হাতে তুলে দেওয়া। এতে একদিকে নগদ প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে অন্যদিকে কয়েকটি ফ্ল্যাটও পাওয়া যাবে। এসব চিন্তাভাবনা করে তিনি সবসময় চাইতেন তার পিতার তিনটি প্লট ডেভেলপারদের হাতে তুলে দিয়ে নগদ টাকাপয়সা আর একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক হতে। কিন্তু মামা এসবের একেবারে ঘোরবিরোধী ছিলেন। সেই থেকে তাদের মধ্যে প্রথম বিরোধের সূত্রপাত। এভাবে একসময় তাদের বনিবনা আরও বাড়তে থাকে। আর মামী বেঁচে না থাকায় আমাদের এই মামাতো ভাইটি আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। আরেকটি কথা, আমার মামা এই ডেভেলপার-কোম্পানি বা হাউজিং-কোম্পানিকে দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য থাকলেও বাশার ভাই কখনো মামার সঙ্গে অশোভন আচরণ প্রকাশ করেননি। আর সবকিছু বিবেচনা করেও আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের বাশার ভাই কখনো তার বাবাকে খুন করতে পারেন না। আসলে, খুনটা অন্য কেউ করেছে। আর এসব করে সে আমার ভাইকে ফাঁসিতে ঝুলাতে ও বাশার ভাইকেও ফাঁসাতে চাইছে।”
“তোমার মামাতো ভাই কী করতেন?”
লালভাইয়ের এই প্রশ্ন শুনে সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে শেষে বলতে লাগলো, “তিনি ঢাকার একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ-এমবিএ করেছিলেন। কিন্তু কোনোদিন চাকরি করা তো দূরের কথা চাকরির একটা দরখাস্ত লিখেছিলেন কিনা সন্দেহ। আসলে, তিনি কর্মঠ নন, এবং নিজে কোনোকিছু করার মতো ছেলে ছিলেন না। তাই, মামার একমাত্র সন্তান তথা পুত্র হওয়ার সুবাদে তিনি সবকিছু নিজের হাতে পেতে চাইতেন। তিনি কোনো কাজের ছেলে নন। শুধু জেদের বশে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাও প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। হঠাৎ মামা খুন হলেন। কবে যে তিনি দেশে ফিরবেন!”
লালভাই কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললেন, “তোমার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে তোমার ভাবীও কি তোমার মামার সবকিছু ডেভেলপারদের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন?”
রায়হান এবার সরাসরি বললো, “না। তা আমি দেখিনি। আমার কখনো তাকে সেরকম মনে হয়নি। বিশেষত তিনি এব্যাপারে মামার সঙ্গে কখনো কথা বলেননি। আর তিনি আমার মামাতো ভাইয়ের মতিগতি জানতেন। তাই, তিনি মামার সবকিছু তার হাতে তুলে না দেওয়ারই বরং পক্ষপাতী ছিলেন। সম্ভবত এসব বিষয় নিয়ে এবং আরও কোনো ব্যাপারে তার সঙ্গেও আমার এই মামাতো ভাইয়ের বিরাট মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়। এজন্য তিনি এই দুজনের ওপর রাগ করেই বিদেশে পাড়ি জমান। আমি এব্যাপারে এর বাইরে আর-কিছু জানি না। হয়তো কালাম ভাই এর চেয়ে বেশি জানে।”

ইতোমধ্যে আমাদের গৃহসাথী নুরজাহান চা-বিস্কুট দিয়ে গেল। আমরা এর সদ্ব্যবহার করতে লাগলাম। আমাদের অনুরোধে রায়হানও চা-পান করতে লাগলো।
চা-পানের ফাঁকে-ফাঁকে আমাদের মধ্যে আগের মতো কথাবার্তাও চলতে লাগলো। আমরা রায়হানের নিকট থেকে আরও জানতে পারলাম, সে মাঝে-মাঝে তার ওই মামার বাড়িতে বেড়াতে কিংবা অন্যকোনো প্রয়োজনে গেলে দুই-এক রাতের বেশি কখনো থাকতো না। পড়ালেখার ক্ষতি হবে ভেবে অধ্যাপকসাহেবও তার এই ভাগ্নেকে এখানে বেশি সময় ধরে রাখতে চাইতেন না। তাই, লালভাই যখন স্বহস্তে বস্তা খুলে তাকে ওইসব রক্তমাখা শাড়ি-কাপড় ও সালোয়ার-কামিজ দেখালো তখন সে এগুলো কার—তা শনাক্ত করতে পারলো না। এতে আমরা দারুণভাবে আশাহত হলাম।

এতে লালভাই কোনোপ্রকার মনখারাপ না করে সবশেষে রায়হানকে রক্তমাখা ‘রাইফেল রোটি আওরত’ বইটি দেখিয়ে বললেন, “এটা কি চিনতে পারছো?”
বইটা দেখেই রায়হান প্রায় লাফিয়ে উঠে বললো, “হ্যাঁ, এটা তো মামার বই। আর বইটা মামার খুব প্রিয় ছিল। তিনি এটা বারবার পড়তেন। কিন্তু আপনারা এটা পেলেন কোত্থেকে?”
লালভাই একটু হেসে বললেন, “সেসব পরে জানবে। তদন্তের স্বার্থে এখন এসব না জানাই ভালো।”
একথা শুনে রায়হান চুপ করে রইলো। আর চা-পান করতে লাগলো।

চা-পান শেষে লালভাই রায়হানকে বিদায় জানালেন। তবে তাকে বলে দিয়েছেন, সে যেন তার বর্তমান ঠিকানা অন্যকোনো বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিচিতজন কাউকে না জানায়। আর ধামরাই-থানার ওসি গোলাম মওলা কোনো কৌশলে তাকে কাছে ডাকলেও সে যেন তাতে সাড়া কিংবা তার অন্য যেকোনো ফাঁদে পা না দেয়। এব্যাপারে রায়হান সম্মত হয়েছে।

রায়হান চলে যাওয়ার পর লালভাই আবার ঘরময় পায়চারী শুরু করলেন। আর ইঙ্গিত করলেন আমাকে আবার কাগজ-কলম নিয়ে বসার জন্য। আমি তৈরি হয়ে গেলাম। আমার ডানদিকে বসা আতিক ভাই এই খুনের কেসটা নিয়ে পত্রিকায় আর-কোনো নতুন কিছু বের হয়েছে কিনা তা আজকের কয়েকটি ভালোমানের দৈনিক পত্রিকা ঘেঁটে-ঘেঁটে দেখছেন। আতিক ভাই এই কাজটি বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে করে থাকেন।
লালভাইয়ের নির্দেশে আমি দ্রুত লিখতে শুরু করলাম:
গোরস্থান থেকে প্রাপ্ত দুই মহিলার পোশাকের মধ্য থেকে অন্তত একজন মহিলার কাপড়চোপড় শনাক্ত করতে হবে। এই খুনের সঙ্গে কারও-কারও ব্যক্তিগত লোভ ও লাভের হিসাবনিকাশ রয়েছে। পুরুষ খুনীটার নেতৃত্বে এই খুনটা সংঘটিত হয়েছে। এর সঙ্গে কোনো-একজন মহিলার পরকীয়াপ্রেম জড়িত থাকতে পারে। তবে অধ্যাপকসাহেব নিরীহ ও ভালোমানুষ। আর এই ভালোমানুষির সুযোগ গ্রহণ করেছে খুনীচক্র। আর খুনীরা পুলিশের সহায়তায় তাড়াহুড়া করে নিহত ব্যক্তির লাশের ময়নাতদন্তসহ তা অতিদ্রুত দাফন করার মধ্য দিয়ে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। আগামীকাল এই বিষয়গুলোর ওপর আমাদের খুব জোর দিতে হবে। আশেপাশের লোকজনের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। আর সবশেষে সঠিক সিদ্ধান্ত।

তারপর তিনি পায়চারী থামিয়ে সোফায় বসলেন। আর আমাদের আগামীকালের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিলেন। আতিক ভাইকেও নির্ধারণ করে দিলেন তার পোশাক। আমারটাও ঠিক করে দিলেন। আর ঠিক করে নিলেন নিজেরটাও।

আজকের রাতে আমি ভিতরে-ভিতরে দারুণ একটা উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম। আমার মনোভাব বুঝতে পেরে লালভাই হেসে বললেন, “তুই আজকের রাতটা আমার এখানেই থেকে যা। আর কম্পিউটার অন করাই আছে তুই এখন আমাদের পত্রিকার কাজে লেগে পড়। আমি একটু বই পড়বো। কথা শেষ করেই তিনি বই পড়ায় নিমগ্ন হলেন।
আতিক ভাই পত্রিকার খোঁজখবর শেষ করে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে গেলেন। কিন্তু রাতে আমার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কখন, কীভাবে খুনীরা ধরা পড়বে তা-ই শুধু ভাবছিলাম। আরও ভাবছিলাম কখন সকাল হবে?





আজ সকালে আমাদের তিনজনের ব্যস্ততা খুব বেড়ে গেছে। আমরা ধামরাইয়ে যাওয়ার আগে নিজেদের সাজসজ্জা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সকল কাজকর্ম গুছিয়ে নিচ্ছি। আর সবখানে আমাদের শতভাগ মনোযোগ কাজ করছে। আমরা দুই ভাই—আমি আর লালভাই নিজেদের গোপন-ক্যামেরাসহ যাবতীয় সরঞ্জামাদি শরীরের জ্যাকেটে ও কাঁধ-ব্যাগে বহন করছি।

আমরা দ্রুত নাস্তা শেষ করে ফেললাম। তারপর একসঙ্গে প্রবেশ করলাম লালভাইয়ের পাঠকক্ষে। আতিক ভাই খুব সকালে আমাদের এখানে এসে হাজির হয়েছেন। তিনি খুব সুন্দরভাবে একজন পেশাদার-রিক্সাওয়ালার বেশধারণ করেছেন। আমরা দুই ভাই এখন নিজেদের কাজে ব্যস্ত। লালভাই তার দাড়ি-গোঁফ লাগানোর ফাঁকে-ফাঁকে বলতে শুরু করলেন:

সাজিদ, সবসময় আমার কাছে-কাছে থাকার চেষ্টা করবি। আমি না বললে কাউকে কোনো বিশেষ একটা প্রশ্ন করতে যাবি না। তবে আমি কোথাও ঢুঁ মারতে গেলে কিংবা তদন্তের প্রয়োজনে তোর সামনে থেকে সরে গেলে তখন বিশেষ কারণে দরকারি-কথা বললে কোনো সমস্যা নাই। আর আমি কোনোকিছু ইঙ্গিত করার সঙ্গে-সঙ্গে তা বোঝার চেষ্টা করবি। ওই বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে তুই সবকিছু খুব সাবধানে ও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ভিডিও-ধারণ করতে থাকবি। এব্যাপারে কখনো কোনোরকম গাফিলতি করবি না। আর বিশেষ-বিশেষ জায়গাগুলো খুব ভালোভাবে ভিডিও করবি। বাড়ির সকলকে ভিডিওয়ের আওতায় আনবি। কাউকে গুরুত্বহীন মনে করে তাকে ভিডিও-ধারণ করা থেকে বাদ দিবি না। আবারও বলছি: আমি যখন কোনো কাজে কোথাও ঢুঁ মারতে যাবো বা কোনো তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য হাতসাফাইয়ের কাজ করতে যাবো—তখন তুই বাড়ির লোকদের প্রশ্ন করে ব্যস্ত রাখবি। মানে, তাদের তোর কাছে ধরে রাখবি। যাতে আমি নিরাপদে আমার কাজগুলো সাবধানে করতে পারি। খুব সাহসের সঙ্গে নিজের কাজ করবি। এখানে, কোনো ভয়ের কিছু নাই। আমরা আজ সত্যিকারের পেশাদার-সাংবাদিক। নিজের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখিস। আর মনে রাখিস: ওই বাড়ির লোকজন কিন্তু খুব ধূর্ত বা চালাক। ওদের ম্যানেজ করেই আমাদের সবকিছু করতে হবে। আতিক আমাদের সঙ্গে বাড়ির ভিতরে যেতে পারবে না। কারণ, সে আজ একজন রিক্সাওয়ালা। তবুও আশা যে, সে মেইন গেইটের বাইরে থাকবে। আর গেইটের পাহারারত পুলিশের সঙ্গে নানারকম গল্প জমাবার চেষ্টা করবে।

তারপর তিনি বিশেষভাবে আতিক ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন, “তুমি আজ খুব সতর্ক থাকবে। আমরা ভিতর থেকে কোনো ইঙ্গিত করলে তুমি সঙ্গে-সঙ্গে তা পালন করতে থাকবে। এব্যাপারে কোনোপ্রকার কালবিলম্ব করবে না।”
আতিক ভাই হেসে বললেন, “আমি গেইটের পাশেই থাকবো। তুমি যা বলবে তা-ই পালন করবো। এব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।”
লালভাই একটু হাসলেন। তারপর আতিক ভাইয়ের কথায় সন্তুষ্ট হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই আজ খুব সাহসী হয়ে উঠবি। কোনো ভয় পাবি না। নিজেকে একজন সাংবাদিক ভাববি। আর গতকাল থেকে তোকে তো আমাদের দৈনিক সত্যবাণীর সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়েছে। তুইতো এখন জেনুইন সাংবাদিক। কাজেই কোনো ভয় পাবি না। আর সবকিছু ভিডিও করার পাশাপাশি ওদের বক্তব্যও রেকর্ড করবি। আর কোনোকিছুতে যেন ফাঁক না থাকে। আজকের দিনটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
আমি লালভাইয়ের কথায় সম্মতি জানালাম। আর ভিতরে-ভিতরে আমি এখন বেশ সাহসী হয়ে উঠেছি।
সকল প্রস্তুতিশেষে এখন থেকেই আমাদের চোখ-কান খোলা রেখে আমরা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তিনজনে রিক্সায় চড়ে এলাম বাসস্ট্যান্ডে। এখন একটা বাস ধরার অপেক্ষামাত্র।
আজ সকালে বাসে তেমন-একটা ভিড় নাই। আমরা তিনজনে বাসে উঠে পড়লাম। আর যথারীতি তিনজনে সিটও পেয়ে গেলাম। বাসে বসে আমরা কোনো কথাবার্তা বললাম না। এই ফাঁকে আমি আমার কাজগুলো মনে মনে আবার গুছিয়ে নিতে লাগলাম।

সকালে রাস্তা একদম ফাঁকা থাকায় খুব তাড়াতাড়ি আমরা ধামরাই-বাসস্ট্যান্ডে এসে নামলাম। আর এখান থেকেই শুরু হলো আমাদের সবরকমের সতর্কতা। আমরা তিনজন খুব হুশিয়ার হয়ে রাস্তা পার হলাম। তারপর সরকারপাড়া যাওয়ার রাস্তার মুখে এসে দাঁড়ালাম।
আতিক ভাই আমাদের চেয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। বুঝতে পারলাম, তিনি সেই রিক্সাটা খুঁজছেন। আর একটু পরে তা পেয়েও গেলেন ধারেকাছেই।
আতিক ভাই আমাদের আজকের প্রয়োজনে বিশেষ রিক্সাটা চেনার জন্য তার বন্ধুর কাছে দ্রুত ফোন করলেন। এর কিছুক্ষণ পরে একটা রিক্সাওয়ালার কাছে ফোন এলো। আর ফোন পেয়ে রাস্তার পাশ থেকে রিক্সাসহ একটা লোক আতিক ভাইয়ের কাছে এসে তাকে হাসিমুখে সালাম দিয়ে খুব সম্মানের সঙ্গে বললো, “স্যার, আপনে কি শফী ভাইয়ের বন্ধু?”
আতিক ভাই মাথা ঝাঁকাতেই সে রিক্সাটা তার সামনে রেখে বললো, “স্যার, আপনাদের যতক্ষণ খুশি এটা ব্যবহার করবেন। আর কাজ শেষ হলে ফোনে আমাকে জানাবেন। আমি এসে রিক্সাটা নিয়ে যাবো।”
আতিক ভাই ওর ফোন-নাম্বার রেখে দিলো। সে যাওয়ার সময় আমাদের জানালো—তার নাম আব্দুস সাদেক। লোকটাকে আমাদের ভালো লেগেছে।
আমাদের এই রিক্সা-হস্তান্তর খুব কৌশলের সঙ্গে করা হলো। যাতে কেউ এটার কোনো কারণ বুঝতে না পারে।
কাজ শেষে আমরা দুই ভাই রিক্সায় উঠে পড়লাম। আর আতিক ভাই চালকের আসনে। শক্তিমান আতিক ভাইয়ের প্যাডেলে আমাদের রিক্সা এখন অশ্বগতিতে ছুটছে!

আমরা অত্যন্ত স্বল্পসময়ে সরকার-মঞ্জিলের কাছাকাছি চলে এসেছি। লালভাই মঞ্জিলের একেবারে কাছে না গিয়ে এখানেই আতিক ভাইকে থামতে বললেন। একটু বাড়তি কৌশল অবলম্বনের জন্য যে তিনি এমনটি করছেন—তা আমার বুঝতে বাকি রইলো না।
লালভাই রিক্সা থেকে নেমে আতিক ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, “তুমি আপাতত এখানে দাঁড়াও। আমরা ভিতরে গেলে তারপর তুমি সরকার-মঞ্জিলের মেইন গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। আর সবসময় চোখ-কান খোলা রাখবে। আর তোমার পকেটের মোবাইলটা এখন হাতে রাখো। ভিতর থেকে আমাদের কোনো ইনফরমেশন পেলে সঙ্গে-সঙ্গে তা পালন করবে।”
আতিক ভাই ‘ঠিক আছে’ বলে লালভাইয়ের কথায় সায় জানালেন।
আমরা দুইজন সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। একটু পরেই এসে দাঁড়ালাম সরকার-মঞ্জিলের মেইন গেইটের সামনে।
গেইটের কাছে এসে দেখি, আজকে পুলিশ দুইজন। লালভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “নিরাপত্তা মনে হয় আগের চেয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সম্ভবত ওদের মনে ভয় ঢুকে গেছে।”
পুলিশ দুইটার চোখে-মুখে বেশ রাগ-রাগ-ভাব। বুঝতে পারছি, ওরা বেশ কড়া ডিউটি দিচ্ছে আজকাল। লালভাই এসব দেখে আমার দিকে একবার তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলেন। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন, “নিজেকে একজন সাংবাদিক ভাবতে থাক। আজ ওদের মেজাজ খুব কড়া।”
ওদের মেজাজ যতোই কড়া থাক না কেন—লালভাই এসব পাত্তা না দিয়ে সরকার-মঞ্জিলের মেইন গেইটের একেবারে কাছে এসে দাঁড়ালেন। তা দেখে একটা পুলিশ গেইটের ভিতর থেকে আমাদের খুব কাছাকাছি এসে বললো, “আপনারা কাউকে চাচ্ছেন?”
এদের কথাবার্তা একেবারে চাঁছাছোলা। ভদ্রতার সামান্যতম লেশমাত্র নাই।
লালভাই আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে অত্যন্ত বিনীতভঙ্গিতে বললেন, “আমরা দুজন সাংবাদিক। মরহুম অধ্যাপকসাহেবের ওপর একটা বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য আমরা এখানে এসেছি। এজন্য বাড়ির ভিতরে আমাদের ঢুকতে হবে।”
একথা শুনে পুলিশটি সঙ্গে-সঙ্গে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলতে লাগলো, “দাঁড়ান, দাঁড়ান। আগে ওসিসাহেবরে ফোন দেই। তিনি যদি আপনাদের ভিতরে ঢুকতে দেন তাইলে ঢুকতে পারবেন। আর তা-না-হলে আপনাদের এখনই ফিরে যেতে হবে। এখানে অনর্থক কারও ঘোরাফেরা করা একদম নিষেধ।”
লালভাই এসব শুনে কিছু বললেন না। তিনি খুব সাবধানী আর কৌশলী। কখন-কোন বুদ্ধি বের করতে হয় তা তিনি বেশ ভালোভাবেই জানেন। কারও সঙ্গে অহেতুক বাক্যালাপ করাটা তার স্বভাব নয়।
পুলিশটি ততক্ষণে ফোনে ওসির সঙ্গে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে।
একপর্যায়ে পুলিশটি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, “আপনাদের পত্রিকার নাম?”
লালভাই কোনোপ্রকার ভনিতা না করে বললেন, “দৈনিক সত্যবাণী।”
এরপর পুলিশটি গেইটের ভিতর থেকে লালভাইয়ের দিকে তার হাতের ফোনটি এগিয়ে দিয়ে বললো, “ধরেন, ওসিসাহেবের সঙ্গে একটু কথা বলেন।”এরপর সে গেইটের কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো।
লালভাই ফোনটা কানে লাগানোর আগে স্পিকার অন করে নিলেন—যাতে আমিও সবকিছু ভালোভাবে শুনতে পাই।
মুহূর্তের মধ্যে ওপাশ থেকে ওসিসাহেবের কর্কশকণ্ঠ ভেসে এলো, “আপনার নাম কী?”—আগের পুলিশটির মতো একেবারে চাঁছাছোলা কথা। এখানেও সামান্য ভদ্রতার কোনো লেশ নাই।
লালভাই স্মিত্যহাসে বললেন, “আমার নাম আবুল খায়ের মোহাম্মদ।”—স্বাভাবিক কণ্ঠ তার। সাংবাদিক পরিচয়ের জন্য তিনি সবসময় এই নামটি ব্যবহার করে থাকেন। এটি তার বড়সড় নামটার প্রথম অংশ মাত্র।
“আপনার পত্রিকার নাম?”—ওসি বিরক্তির সঙ্গে এবার প্রশ্ন করলো।
“দৈনিক সত্যবাণী।”—এবারও লালভাইয়ের কণ্ঠ একেবারে স্বাভাবিক।
“এই নামে বাংলাদেশে কোনো পত্রিকা আছে?”—ওপাশ থেকে ওসিসাহেব বেশ ঝাঁঝ নিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথাটা বললো। আর তার কণ্ঠে ছিল প্রচণ্ড বিদ্রুপভাব।
লালভাই সঙ্গে-সঙ্গে বলিষ্ঠকণ্ঠে বললেন, “আছে দেখেই তো আমরা এসেছি। এটা হলো ভদ্রলোকের পত্রিকা। বাংলাদেশের অধিকাংশ ভদ্রলোকই এই পত্রিকার নাম জানেন।” —লালভাই ওসিকে ভদ্রভাবে জুতা মেরে দিলেন।
“তা আপনারা কী করতে চান।”—লোকটার ঝাঁঝ ও তেজ এখনও কমেনি।
“বেশি কিছু না। এই নিহত অধ্যাপকসাহেবের বাড়িটা একটু ঘুরে দেখবো। তারপর অধ্যাপকসাহেবের আপন-ভাগ্নে যে এমন একটা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে—তা আমাদের এই বিশেষ প্রতিবেদনে তুলে ধরবো। আর সঙ্গে অধ্যাপকসাহেবের পুত্রবধূর একটা সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নিবো, এই আরকি।”—লালভাই কৌশলগত কারণে খুব সহজ একটা রিপোর্ট তৈরির কথা বললেন।
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ পরে গমগমে আওয়াজ ভেসে এলো: “আচ্ছা উনার সঙ্গে বেশি কথা বলবেন না। ভদ্রমহিলা এমনিতেই ভীষণ শকড্। আর বুঝতেই পারছেন এই মামলা তো শেষপর্যায়ে। অধ্যাপকসাহেবকে উনার আপন-ভাগ্নেই খুন করেছে। এব্যাপারে আমার চার্জশিট প্রায় কমপ্লিট। আচ্ছা, এরচেয়ে বেশি কিছু জানার থাকলে আপনারা আমার থানায় আসবেন।”
লালভাই বললেন, “জ্বি, আচ্ছা।”
তারপর ওসি ওপাশ থেকে বললো, “ঠিক আছে, আপনারা বেশি সময় নিবেন না। আর আপনার হাতের ফোনটা আমার কনস্টেবলকে দিন তো।”—তার একথাটার মধ্যেও একটা আদেশভাব।
লালভাই ফোনটা সেই কনস্টেবলকে দিয়ে একটু ঘুরে দাঁড়াতেই দুই পুলিশ আমাদের জন্য গেইট খুলে দিলো। আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আর তখন থেকেই আজ আমাদের তদন্তের কাজ শুরু হয়ে গেল।
ভিতরে ঢুকে আমি একটু পিছনফিরে তাকিয়ে দেখি—আতিক ভাই তার অবস্থানে রয়েছেন।

অনেকবড় বাড়ি। আমরা আজ মেইন গেইট দিয়ে ঢোকার পর থেকে সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে লাগলাম। আর আমাদের সঙ্গে লুকানো ক্যামেরা দ্বারা সবকিছু ভিডিও করতে লাগলাম।
একটা পুলিশ আমাদের পিছনে আসছে। আমরা সেটা আড়চোখে দেখে নিলাম। ভেবেছিলাম, পুলিশটি আমাদের সঙ্গে সারাক্ষণ ঘুর ঘুর করে বিরক্ত করবে। দেখলাম, তা নয়। সে বরং আমাদের উপকারই করলো। ভিতরবাড়ির গেইট খোলার ব্যাপারে সহযোগিতা করলো।

শাহীনা বেগম আজ অত্যন্ত নীরসবদনে গেইট খুলে ভবনের ভিতরে আমাদের ঢুকতে দিলো। পুলিশটি আমাদের সঙ্গে আর ভিতরে ঢুকলো না। তারপর নীরবে সে যে-ভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল। তা দেখে মনে মনে আমরা তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
ভবনের ভিতরে ঢোকার সময় লালভাই আমাকে বললেন, “প্রথমে হয়তো আমাদের ড্রইংরুমে বসতে দিবে। আমি কোনো একটা অজুহাতে বা ছুতো খুঁজে ঘরের ভিতরে ঢুকে যাবো। তুই এইসময় শাহীনা বেগমকে নানারকম প্রশ্ন করে ব্যস্ত রাখবি। আর মনে রাখিস: সমস্ত বক্তব্য কিন্তু আমাদের রেকর্ড করতে হবে। আর এসব যেন শাহীনা বেগম কখনো টের না পায়। তাহলে, সে আমাদের সঙ্গে অনেক কথা এড়িয়ে যাবে।”
লালভাইয়ের কথাই সত্য। শাহীনা বেগম আমাদের প্রথমে ড্রইংরুমেই বসতে বললো। আমরা তার কথামতো সেখানেই বসলাম।
আমাদের বসতে বলে সে ভিতরের দিকে গেল। আর বললো, “ছেলে-মেয়ে দুটো বাইরের লোকজন দেখলে ভয় পায়। তাই, ওদের কাজের মেয়েটার জিম্মায় রেখে আসি। তারপর আপনাদের সঙ্গে কথা বলবো।”
আমরা এতেই খুশি। আমাদের যা করার আমরা এখন থেকেই তা করতে শুরু করে দিয়েছি।
শাহীনা বেগম ভিতরে ঢুকে যেতেই লালভাই পাশের রুমটাতে ঢুকে পড়লেন। তিনি অত্যন্ত সতর্ক আর সজাগ। তার মনটা সবসময় অনুসন্ধানে তৎপর।
ড্রইংরুমে এখন আমি একা বসে রয়েছি। আর ভাবছি: কখন লালভাই আসবেন!
লালভাই পাশের রুমে ঢুকে পড়ায় আমার মনে কেমন যেন একটা ভয়-ভয়-ভাব বিরাজ করছে। চারিদিকে কয়েকবার তাকাতে লাগলাম। কোনোপ্রকার আলামত আমার চোখে পড়ছে না। আমার সঙ্গে থাকা ক্যামেরা দুটো এখনও সচল রয়েছে। একটা হাতে। বাকিটা শরীরের এমন জায়গায় লাগানো রয়েছে যে, তা শাহীনা বেগম কেন ওসি গোলাম মওলার বাপও ঠিক পাবে না।

আমি চুপচাপ বসে লালভাইয়ের মঙ্গল কামনা করতে লাগলাম। দশ মিনিট পেরিয়ে গেলেও শাহীনা বেগমকে আসতে দেখলাম না। এদিকে লালভাইও আসছেন না! আমার মনটা অনেককিছু ভাবতে থাকে।
আরও কয়েক মিনিট পরে শাহীনা বেগম ড্রইংরুমে ঢুকলো। তার আগে দেখি, আমার ডানপাশের একটা খোলা দরজা দিয়ে লালভাই আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। লালভাই এত দ্রুত রুমে প্রবেশ করেছেন যে, শাহীনা বেগম তাকে দেখে কোনোকিছু সন্দেহ করতে পারলো না।
শাহীনা বেগম খুব জড়সড় হয়ে আমাদের সামনের সোফাটায় বসলো। আর আমরা দুজন তার মুখোমুখি বড় সোফাটায় বসেছি। তার মধ্যে একটা জড়সড়-ভাব। কিন্তু মানুষের ভয়ভীতি বলে যে একটাকিছু থাকে—তা এই মহিলার মধ্যে একবারও দেখতে পেলাম না।
আমরা যে গতকাল গোয়েন্দা হিসাবে এখানে হাজির হয়েছিলাম—তা সে বুঝতে পারেনি। আমাদের সাজপোশাকে আজ অন্যরকম লাগছে। আর বেশ মানিয়েছে আমাদের।
তাকে চুপচাপ বসতে দেখে লালভাই বললেন, “শুভসকাল। কেমন আছেন আপা?”
শাহীনা বেগম একটু হাসার চেষ্টা করে বললো, “জ্বি, ভালো।”
তারপর সে খুব রুক্ষভাবে আমাদের উদ্দেশ্যে বললো, “আপনাদের যা জিজ্ঞাসা করার তাড়াতাড়ি করেন। আমার হাতে অনেক কাজ জমে আছে। বুঝতেই তো পারছেন, ছোট-ছোট দুটি ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। কত কাজ যে পড়ে আছে!” কথাটা শেষ করে সে ব্যস্তসমেত এদিক-ওদিক কয়েকবার তাকালো।
লালভাই বললেন, “আপনাদের বাসার আগের কাজের মেয়েটা কোথায়? তাকে দেখছি না যে!”—লালভাই এমনভাবে কথাটা বললেন যেন ওই মেয়েটাকে তিনি কতদিন ধরে চেনেন।
কথাটা শোনামাত্র শাহীনা বেগম খুব বিরক্তির সঙ্গে বললো, “সে চলে গেছে।”
লালভাই বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, “কেন?”
এবার আরও রুক্ষভাবে শাহীনা বেগম বললো, “কেন আবার? তার অন্য কোনো জায়গায় হয়তো কাজ হয়েছে।”
“মেয়েটার নাম কী ছিল?”—লালভাই স্বাভাবিককণ্ঠে জানতে চাইলেন।
অনেকটা ভেংচি কাটার মতো করে শাহীনা বেগম বললো, “মরিয়ম।”
লালভাই বললেন, “ওর বয়স কত?”
অন্যদিকে তাকিয়ে মনভার করে শাহীনা বেগম বললো, “বাইশ-তেইশ হবে।”
“আপনাদের বাসায় কতদিন কাজ করেছিল? এব্যাপারে একটু বলুন।”—লালভাই বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন।
আগের মতো মুখভার করে শাহীনা বেগম বলে, “তা বছর আষ্টেক হবে।”
“এতদিন কাজ করার পর হঠাৎ সে চলে গেল! কেন?”—লালভাই খুব বিস্মিত হয়ে বললেন। তিনি যেন নিজের সঙ্গে হিসাব মিলাতে পারলেন না। এসময় তিনি কী যেন ভাবতে লাগলেন।
কিন্তু শাহীনা বেগম বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, “তা তাকে জিজ্ঞাসা করেন গিয়ে। সে কেন গেল আমি তার কী জানি?”
“না, আপনি কিছু জানেন কিনা?”—তবুও লালভাই কিছু জানার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন।
শাহীনা বেগম এবার সোজাসাপটা বললো, “এব্যাপারে আমার কিছুই জানা নাই।”
লালভাই বললেন, “মরিয়মের গ্রামের বাড়ি কোথায়? যদি বলতেন।”
শাহীনা বেগম হঠাৎ একটুখানি নরম হয়ে বললো, “আমি এতকিছু জানি না। শুনেছি, ময়মনসিংহের কোথায় যেন ওদের বাড়ি। আমরা তাকে এত ভালোভাবে চিনতাম না। আমার শ^শুরের এক ছাত্র ও-কে আমাদের এখানে কাজের জন্য নিয়ে এসেছিল। সেই থেকে সে দীর্ঘদিন আমাদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর সে কাউকে কিছু না বলে পরদিন কোথায় যেন চলে গিয়েছে! তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
শাহীনা বেগম এমনভাবে কথা বলছেন যেন অধ্যাপকসাহেব স্বাভাবিকভাবে মারা গিয়েছেন।
“যে ছাত্রটি মরিয়মকে এখানে এনেছিল সেই ছাত্রটির নাম কি জানা যাবে?”—লালভাই যেন একটা ক্লু পেয়ে গেছেন। তাই, খুব জরুরি মনে করে তাকে প্রশ্নটি করেছেন।
শাহীনা বেগমের ঝাঁঝ আবার বেড়ে গেল। আর খুব রাগতস্বরে বললো, “আমি তাকে চিনি না—জানি না।”
“আপনার শ্বশুর যখন খুন হন তখন আজাদ কালাম কোথায় ছিল?”—লালভাই এই প্রশ্নটি করে নিষ্পলকদৃষ্টিতে শাহীনা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই প্রশ্নটি যে খুব গুরুত্বপূর্ণ তা আমি তার হাবভাব দেখেই বুঝতে পারলাম।
শাহীনা বেগম কয়েক সেকেন্ড কী যেন চিন্তা করে খুব দক্ষতার সঙ্গে বললো, “সে তো ঘরেই ছিল। আর আমার শ্বশুরের পাশের রুমে ছিল। সেই তো হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বুড়ো মানুষটাকে খুন করেছে। আমরা তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি।”—কথাটা শাহীনা বেগম এমনভাবে বললো যেন সে কতটা আন্তরিক।
“আপনার শ্বশুর যখন খুন হচ্ছিলেন তখন আপনি কোথায় ছিলেন?”—লালভাইয়ের এই প্রশ্নে যেন শাহীনা বেগম ভিতরে-ভিতরে কিছুটা চমকে উঠলেন।
তারপর শাহীনা বেগম নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “আমি ভিতরের রুমে মেয়েটাকে পড়াচ্ছিলাম। ও তো সবেমাত্র স্কুলে যায়। আর ছোটটি আমার কাছেই বসা ছিল। আর ওসিসাহেব ছিলেন ড্রইংরুমে। তিনি আমাদের খামারবাড়ির কাজে এসেছিলেন।”
এরপর লালভাই শাহীনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপাতত আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ এখানে মুলতবী রইলো। বাকিটা আপনার শ^শুর যে ঘরে থাকতেন সেটা দেখার পর করবো।”—কথাটা বলে লালভাই সেই রুমটা দেখতে চাইলেন। আর এই কথাটা শেষ করে লালভাই উঠে দাঁড়ালেন।
শাহীনা বেগম কিন্তু উঠে দাঁড়াবার কোনো নাম করলো না। সে চুপচাপ আগের মতো বসে থেকে খুব ঠাণ্ডাগলায় বললো, “ওই রুমটা তো ওসিসাহেবের নির্দেশে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আর এর চাবিও আমার কাছে নাই। ওটা ওসিসাহেবের কাছে। রুমটা দেখতে চাইলে আপনারা থানায় যান। ওসিসাহেবের নিকট থেকে চাবি নিয়ে আসেন।”
কথাটা শোনার পর আমাদের মনে হলো সে যেন আমাদের বিদ্রুপ করছে। অবশ্য আমরা তা গায়ে মাখলাম না।
লালভাই দ্রুত কী যেন ভাবছেন। আমি স্থিরদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। তিনি একটু হেসে বললেন, “ঠিক আছে, এটা কোনো ব্যাপার নয়। আমরা পরে ওসিসাহেবের নিকট থেকে চাবি নিয়ে পরেও রুমটা দেখতে পারবো। আপাতত আপনার পুরো বাসাটা আমরা একটু ঘুরে দেখতে চাই। যদি আপনি রাজী থাকেন?”
এতে শাহীনা বেগম তেমন কোনো আপত্তি না করলেও মুখটা ভয়ানকভাবে মলিন করে কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের ভিতরের দিকে নিয়ে গেলেন। লালভাইয়ের নির্দেশে, চোখের ইশারায়, আগের পরিকল্পনা মোতাবেক এই মুহূর্তে আমি সবকিছু ভিডিও করতে লাগলাম। এই মুহূর্তে আমাকে একজন দক্ষ সাংবাদিকই মনে হচ্ছে।
আমরা প্রতিটি রুম খুব ভালোভাবে দেখতে লাগলাম। এই বাসার কোনোকিছুই আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না। আর পুরো বাসাটা আমি ভিডিও করছি।

আমরা যখন বাসাটা দেখে ড্রইংরুমে এসে বসেছি, তখন দেখলাম, বাসার মেইন গেইটের কলিংবেল বেজে উঠলো। অমনি শাহীনা বেগম আমাদের কাউকে কিছু না-বলে ছুটে গেল দরজার কাছে। তারপর কাকে যেন কী-জন্য অপেক্ষা করতে বলে নিজে খুব দ্রুততার সঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়লো।
লালভাই আর কালবিলম্ব না করে গেইটের কাছে ছুটে গেলেন। এবার আমি আর বসে রইলাম না। লালভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর দেখলাম, গেটের বাইরে একটা আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে ব্যস্তভাবে অপেক্ষা করছে। আমাদের দেখে সে কেমন যেন চমকে উঠলো। লালভাই স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকে পর্যবেক্ষণ করে আমার হাতে সামান্য একটা গুতো দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লেন।
তারপর তিনি সোফায় বসে একদিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, “ছেলেটোকে চিনতে পেরেছিস?” এরপর তিনি আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে বললেন, “গতকাল এই ছেলেটাই আমাদের উড়ো চিঠি দিয়েছিল। সে এদের ডাকপিয়ন। ওর পিছু নিতে হবে। দাঁড়া, আতিককে বলে দিচ্ছি। এই বলে তিনি সোফা থেকে উঠে ডানদিকের জানালাটার পাশে দাঁড়িয়ে দ্রুততার সঙ্গে ফোনে আতিক ভাইকে বললেন, “শোনো, একটা ছেলে এখনই বাইরে বের হবে। তুমি তার পিছু নিবে। আর যে করেই হোক, তার গন্তব্যস্থল আজ আমাদের জানতেই হবে। আর এরমধ্যেই এই কেসটার আসল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। তুমি এখন থেকেই প্রস্তুতিগ্রহণ করতে শুরু করে দাও। রেডি হও।”
কথাটা শেষ করে তিনি ফোন রেখে আবার সোফায় বসে পড়লেন। কোনোদিকে না তাকিয়ে তিনি কী যেন ভাবতে লাগলেন।
আমরা বসতে-না-বসতে দেখি, শাহীনা বেগম দুইটা বড়সড় টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার নিয়ে বাসার মেইন গেইটের দিকে গেল। আমরা তা দেখেও না-দেখার ভান করে সোফায় আগের মতো বসে রইলাম।
লালভাই হঠাৎ আবার তার সেলফোনটা বের করে খুব আস্তে-আস্তে আতিক ভাইকে বলতে লাগলেন, “শোনো, ভিতরে যে ছেলেটা ঢুকেছে সে যদি সাইকেল নিয়ে আসে আর তা যদি সে বাড়ির বাইরে মেইন গেইটের কাছে বা তার আশেপাশের একজায়গায় রাখে তাইলে তুমি তার সাইকেলের পিছনের চাকার টিউবটা খুব সাবধানে ছিদ্র করে দাও। যাতে সে সাইকেলে চড়ে খাবার নিয়ে অজ্ঞাতস্থানে পালাতে না পারে। আমাদের ওর গন্তব্যস্থল আজ জানতেই হবে। ওর সাইকেলের দফারফা হলে তখন সে বাধ্য হয়ে তোমার রিক্সায় উঠবে। দ্রুত এই কাজটা সমাধা কর তো। আর লক্ষ্য রাখবে: কেউ যেন তা না দেখে। বাইরে গেইটের কাছে কিন্তু দুই-দুইটা পুলিশ রয়েছে। তুমি খুব সাবধানে কাজটা শেষ করবে।”
তারপর শাহীনা বেগম ফিরে আসার আগেই তিনি আমার কনুইয়ে জোরে গুতা দিয়ে ইশারা করলেন, “তুইও বাইরে যা। আতিক একা সব ঠিকঠাক করতে পারছে কিনা দেখে আয়। আর ছেলেটা মেইন গেইটের কাছে পৌঁছানোর আগে তুই পুলিশদের একটু ব্যস্ত রাখ্। আর ওদের বলবি যে তুই আমার জন্য বাইরে এক প্যাকেট সিগারেট আনতে যাচ্ছিস। যা, এখনই যা।”
আমি দ্রুত উঠে পড়লাম। এই সুযোগ কোনোভাবেই আজ হাতছাড়া করা যাবে না।

লালভাইকে ভিতরে একা রেখে আমি ঝড়ের গতিতে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আর দেখলাম, সেই ছেলেটা কিছুটা দূরে চলে গেছে। তবে তার দুই হাতে বড়সড় দুইটা টিফিন-ক্যারিয়ার থাকায় সে বেশি জোরে হাঁটতে পারছে না। এই সুযোগে আমি ওর আগেই বাড়ির মেইন গেইটের কাছে চলে এলাম। পুলিশ দুটোকে কয়েকটা অহেতুক প্রশ্ন করে ওদের ব্যস্তও রাখলাম। ছেলেটা মেইন গেইট পর্যন্ত আসার আগেই আতিক ভাই ওর সাইকেলটার দফারফা একেবারে শেষ করে ফেললেন। এতক্ষণে তিনি সম্ভবত ওর সাইকেলের দুই চাকার পাম্পই বের করে ফেলেছেন।
আমি আতিক ভাইয়ের দিকে বেশি না তাকিয়ে মেইন রোডের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে একটা দোকান থেকে সিগারেট কিনতে গেলাম। তবে এবার আড়চোখে চারিদিকের সবকিছুও দেখতে লাগলাম।
সিগারেট কিনে মেইন গেইটের কাছাকাছি ফিরে আসতেই দেখলাম, ছেলেটা তার সাইকেল দেখে খুবই হতাশ। সে তার সাইকেলটা সরকার-মঞ্জিলের মেইন গেইটের একপাশে ফেলে রেখে আতিক ভাইকে কী যেন বললো। বুঝলাম, সে আতিক ভাইয়ের রিক্সাটা ভাড়া করতে চাচ্ছে। একটা দক্ষ রিক্সাওয়ালার মতো আতিক ভাই ভাড়াটারা মিটিয়ে ছেলেটাকে তুলে নিলেন। আমি মনের আনন্দে দ্রুত আবার ভিতরবাড়িতে ঢুকে পড়লাম।

ভিতরে ঢুকে আমার চক্ষু চড়কগাছ! দেখি, আমাদের লালভাই এখন শাহীনা বেগমের সঙ্গে খুব খাতির জমিয়েছেন। তার রুপযৌবনের খুব প্রশংসাও করছেন। এতে দেখলাম, এখন আর আগের শাহীনা বেগম যেন নাই। সে মুহূর্তের মধ্যে রঙবদল করে ফেলেছে। আমি লালভাইয়ের পাশে বসার আগেই শাহীনা বেগম লালভাইয়ের দিকে তাকিয়ে খুব মোলায়েম হাসিতে বললো, “আপনাকে চা করে দিই?” ‘আপনাদের’ না বলে শুধু ‘আপনাকে’ বলায় আমি যারপরনাই বিস্মিত। বুঝলাম, লালভাই তাকে খুব ফুলিয়েছেন! আর নয়তো কিছু-একটা বলে তাকে ভীষণভাবে পটিয়েছেন।
আমাদের লালভাই স্মিতহাস্যে শাহীনা বেগমের চোখে চোখ রেখে খুব ভদ্রভাবে বললেন, “তা পান করা যায়। আর কফি হলে কিন্তু আরও ভালো হয়।”
একথা শুনে শাহীনা বেগম হাসিমুখে উঠে পড়লো। আর ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। লালভাই আগের মতো আবার কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর হাতে কোনো কাজ না থাকায় আমি সোফার টেবিলের নিচে রাখা পুরানো পত্রিকাগুলো ঘাঁটতে লাগলাম। আর এখানেও আমার ভিডিও ধারণের বিষয়টি সমানতালে চলছে।

কফিপানের পর আমাদের লালভাই দেখতে-দেখতে শাহীনা বেগমের সঙ্গে আরও ভালোভাবে আলাপ জমিয়ে ফেললেন। তার আলাপ জমানোর কায়দাকানুন খুবই ভালো। যেকোনো মানুষের সঙ্গে তিনি অতিসহজে মিশতে পারেন। আমাদের লালভাইয়ের মতো এতো মিশুক মানুষ আমি এই জীবনে আর দেখিনি।

শাহীনা বেগমের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে আমাদের খুব একটা লাভ যে হয়েছে তা বলা যাবে না। আর আমার মনে হচ্ছে: বাইরের দিক থেকে মহিলা আমাদের সঙ্গে কিছুটা মিশলেও ভিতরে-ভিতরে এখনও সে খুবই সতর্ক, এবং চালাকির আশ্রয়গ্রহণ করে রয়েছে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সে আমাদের কাছে কোনোভাবেই প্রকাশ করছে না।
লালভাই নানান কায়দায় তাকে বশীভূত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। তবে ব্যর্থ হলেও আমাদের প্রতি তার আগের মতো রাগটা আর নাই। সেখান থেকে হয়তো শাহীনা বেগম কিছুটা হলেও সরে এসেছে। অবশ্য আমার তা-ই মনে হচ্ছে—কিন্তু এই মুহূর্তে লালভাই কী ভাবছেন তা আমার জানা নাই।

ভিতরে একটা শব্দ হওয়ায় শাহীনা বেগম প্রায় একদৌড়ে ভিতরে চলে গেল।
এই সুযোগে লালভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “খুব ভয়ংকর একটা মহিলা রে! বাইরে এখন কিছুটা নরমপ্রকৃতির ভাব দেখালেও আসলে ভিতরে-ভিতরে সে এখনও খুব কঠিন। এ-কে হাতকরা এতো সহজ নয়। আর একটা ব্যাপার দেখেছিস, বাড়ির ভিতরে কিন্তু শিশুদের কোনো আওয়াজ নাই!”

আমরা যখন এখানে আরও কিছুটা সময় থাকার পরিকল্পনা করছিলাম ঠিকই তখনই লালভাইয়ের ফোন বেজে উঠলো। তিনি ফোন রিসিভ করতেই আতিক ভাইয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো, “প্রোফেসর, দ্রুত খামারবাড়িতে চলে এসো। যেকোনো একটা রিক্সাভ্যানে চড়ে আসো। জায়গাটার নাম শিবমন্দিরের মোড়। যেকোনো রিক্সাভানওয়ালাই চেনে। আমি এখানে রাস্তার একপাশে বসে রয়েছি। তোমরা এলে কথা হবে। শুধু এখন শুনে নাও—দারুণ একটা খবর আছে।”
কথা শেষ হওয়ামাত্র ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আমি লালভাইয়ের একদম পাশে বসায় সব কথাই শুনতে পেয়েছি। তাই, এব্যাপারে লালভাইকে আর-কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না।
লালভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “চল, এখানকার কাজ আপাতত শেষ। সামনে মনে হয় ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আতিকের কণ্ঠস্বর শুনে আমার তা-ই মনে হলো।”

শাহীনা বেগম ফিরে আসতেই লালভাই আগের মতো বিনয়সহকারে বললেন, “আজ তবে আসি, যদি কোনো বিশেষ প্রয়োজন হয় তাহলে আমাদের আর-একবার আসার প্রয়োজন হতে পারে। ভালো থাকবেন।”

আমাদের একথা শুনে শাহীনা বেগম যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। তার মুখে এখন দারুণ পরিতৃপ্তির একটা হাসি।
তবে এসব দেখার সময় আমাদের হাতে নাই। আমরা খুব দ্রুত বাসার ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আরও দ্রুত পার হলাম বাড়ির মেইন গেইট। তারপর লালভাইয়ের পিছনে হাঁটতে লাগলাম সরকারপাড়া-গোরস্থানের রাস্তার দিকে।
গোরস্থান পার হয়ে লালভাই বললেন, “এই দিকেই মাইল তিনেক দূরে সরকারসাহেবের খামারবাড়িটা। এতোটা রাস্তা হেঁটে গেলে সময় বেশি লাগবে। এইমুহূর্তে আমাদের একটা রিক্সাভ্যান খুবই প্রয়োজন।”
আমরা এখানটাতেই দাঁড়িয়ে পড়লাম।

এদিকের রাস্তাটা এখনও কাঁচা। গ্রামের কাঁচাসড়কের মতো উঁচু করে ফসলি জমির ওপর দিয়ে রাস্তাটা তৈরি করা হয়েছে। তবে এটাকে দীর্ঘদিনের কাঁচাসড়ক মনে হচ্ছে। একদিন তো এইসব গ্রামই ছিল। শহরে মানুষবৃদ্ধি পাওয়ায় আজ চারিদিকে মানুষের আবাসন গড়ে তোলার হিড়িক পড়ে গেছে।

মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর আমরা একটা রিক্সাভ্যান পেলাম। দরদাম করেই তাতে উঠে পড়লাম। ভাড়া চল্লিশ টাকা। আমরা এতে যথেষ্ট সন্তুষ্ট।
একটা বিশ-বাইশ বছরের তরুণ দ্রæতগতিতে ভ্যানটা চালাচ্ছে। তবে কাঁচামাটি বলে পাকারাস্তায় চালানোর মতো স্পিডটা সে এখানে শত চেষ্টা করেও যেন তুলতে পারছে না। দেখতে-দেখতে আমরা শিবমন্দিরের মোড়ে এসে পৌঁছুলাম। আমরা তাকিয়ে দেখি, সামনেই সরকারসাহেবের খামারবাড়ি।
আমাদের দেখে আতিক ভাই একলাফে কাছে এসে দাঁড়ালেন।
আমি ভ্যানভাড়া মিটিয়ে দিতেই তিনি লালভাইয়ের হাত ধরে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “তোমার কথামতো আমি ছেলেটাকে আমার রিক্সায় তুলে এখানে নিয়ে এসেছি। ছেলেটাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমি রিক্সাটাকে একটানে খামারবাড়ির গেইটের কাছে নিয়ে গিয়ে থেমেছি। যাতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। তারপর ছেলেটা আমার রিক্সাভাড়া ভিতর থেকে নিয়ে আসার কথা বলে আমাকে খামারবাড়ির গেইটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে যায়। এই সুযোগে আমি চোখ-কান খোলা রেখে আশেপাশের অনেককিছু বুঝতে চেষ্টা করেছি। এখানে, অনেক আলামত আছে। আর এখানে আমি একটি মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনেছি। সে বারবার কাদের কাছে যেন কাকুতিমিনতী করছিল আর বলছিল: ‘ভাই, আমরারে ছাইড়ে দেন। আমি, তো কিছু করি নাই। আমি কাউরে কিছু বলবো না। আমরারে ছাইড়ে দেন ভাই। আমি গফরগাঁও চইলে যাবো।’ তারপর কে যেন মেয়েটির মুখ চেপে ধরে খুব ঝাঁঝালোকণ্ঠে বলতে লাগলো: এই মাগী, চুপ করে থাক। আর-একটা কতা কইবি কি তোরেও কিন্তু প্রোবেচরের কাছে পাঠায়ে দিমু। চুপ মাগী, চুপ। তারপর আর-কিছু শুনি নাই। আমি একা দেখে আর বেশি কিছু করার চেষ্টা করিনি। তবুও ওই ছেলেটা যখন মিনিট কয়েক পরে আমার রিক্সাভাড়া দিতে এলো তখন আমি তার কাছে ইচ্ছে করে এক গেলাস পানি চাইলাম। আমার উদ্দেশ্য এখানে আরও কিছুটা সময় ক্ষেপণ করা। সে কিছুক্ষণ পরে পানি নিয়ে এলে আমি তা সময়ক্ষেপণ করে পান করেছি। আর কান পেতে আরও কিছু শোনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আর-কোনো আওয়াজ পাইনি।”

একথা শোনার পর লালভাইয়ের ফর্সা মুখখানি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, “আমরা কেসটার শেষমুহূর্তে এসে পৌঁছেছি। আমরা যাকে খুঁজছি সে এখানেই রয়েছে। কাজের মেয়ে মরিয়মকে এখানেই আটকিয়ে রাখা হয়েছে। এই মামলাটা ওসি গোলাম মওলা যদি একবার আজাদ কালামের বিরুদ্ধে শক্তমতো দাঁড় করাতে পারতো তাহলে মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী মরিয়মকে হত্যা করে তার লাশটা কোনো হাইওয়ের পাশে ফেলে রাখতো। তারপর আর কী? মামলা খতম হয়ে যেত! কেসটা বেশ ভালোভাবে সাজিয়েছে ওসি গোলাম মওলা। কিন্তু কেসের আখেরটা মনে হয় আমাদের পক্ষে।”
লালভাই এরপর খুব চঞ্চল হয়ে উঠলেন আর বললেন, “আমাদের এক্ষনি এই মেয়েটাকে উদ্ধার করতে হবে। তার আগে আমাদের জানতে হবে এখানে কয়টা লোক আছে। ওদের সংখ্যাটা না জেনে এই উদ্ধার-অভিযান পরিচালনা করা ঠিক নয়।”

লালভাই আমাদের সবার বেশভূষা খুলে ফেলে আসল গোয়েন্দারূপে আবির্ভূত হতে বললেন। আমরা একনিমিষে তা-ই করলাম। আমি দেখতে পাচ্ছি, লালভাই ও আতিক ভাই তাদের রিভলবার ঠিকঠাক করে নিলেন। এটি উদ্ধার-অভিযানের প্রাথমিকপ্রস্তুতি।

লালভাইয়ের বুদ্ধি মোতাবেক আমি আর লালভাই জমিজমা ক্রয়ের কথা বলে খামারবাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। বাইরে গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন আতিক ভাই। আমরা কোনো বিপদে পড়লে তিনি ভিতরে ছুটে আসবেন।
এখানকার গেইটা খুব একটা মজবুত নয়। আমাদের হঠাৎ বাড়ির ভিতরে এভাবে ঢুকতে দেখে সকালের নাস্তাবহনকারী ওই ছেলেটি দৌড়ে এলো। তারপর আমাদের দেখে কেমন যেন একটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। সে মনে হয় আমাদের চিনে ফেলেছে। তারপর সে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে ‘হাশেম ভাই’ বলে কাকে যেন ডাকতে লাগলো।
ওর ডাক শুনে হাশেম নামের একটা ষণ্ডামার্কা লোক আমাদের কাছে ছুটে এলো। আর এসেই সে ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললো, “আপনেরা! আপনেরা এখানে কী চান? এখানে ঢোকা নিষেধ—তা জানেন না?”
লালভাই একগাল হেসে বললেন, “আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আর কিছু জমিজমা কিনতে চাই। আপনারা এখানকার স্থানীয় লোক। যদি এর একটা সন্ধান দিতে পারেন... তা-ই...।”
এতে লোকটার রাগ কিছুটা কমলেও সে হন্তদন্ত হয়ে বললো, “আচ্ছা, এবার বাইরে আসেন তো। বাইরে আসেন, তাড়াতাড়ি। ভিতরে ঢোকা তো নিষেধ। আপনেদের সাহস কত!”
আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালাম।
লালভাই বললেন, “আপনি যদি আমাদের সঙ্গে একটু উত্তরদিকের মাঠে আসেন তাহলে আমাদের খুব সুবিধা হয়। ওদিকটায় নাকি জমি বিক্রয় করা হবে। আমরা একটা জমি দেখেছি। আপনি যদি দেখেশুনে...।”
এতে লোকটা ক্ষেপে গিয়ে বললো, “না-না, আমার হাতে এতো সময় নাই। তাছাড়া, এতোবড় খামারটা আজ আমরা মাত্র দুইজন পাহারায় রয়েছি। একজন গ্রামে গেছে। এখন যাইতে পারবো না।”
লালভাই মনে হয় এইটাই চেয়েছিলেন। তিনি শুধু জানতে চেয়েছিলেন—এখানে ওরা কয়টা রয়েছে।
ইতোমধ্যে আতিক ভাই লোকটার পিছনে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি লালভাইয়ের চোখের ইশারা পাওয়ামাত্র লোকটাকে ওরফে হাশেমকে একটা ল্যাং দিয়ে চিৎ করে ফেলে তার বুকে রিভলবার চেপে ধরে বললেন, “চুপ, একদম চুপ। একচুল নড়বি তো গুলি করে তোর মাথার খুলি উড়িয়ে দিবো।”—এতে হাশেম নামের লোকটি যারপরনাই বিস্মিত। সে যেন স্বপ্নেও এমনটি ভাবেনি।
হাশেম নামের লোকটা আর টুঁশব্দটি করার সাহস পেলো না। সে খুব অসহায়ভঙ্গিতে মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে।
এই আকস্মিক ঘটনা দেখে সেই ছেলেটি দৌড়ে পালাতে চেয়েছিল। আমি আর লালভাই তাকে দৌড়ে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিলাম।
তারপর দুইটাকে শক্ত রশি দিয়ে পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে খামারবাড়ির ভিতরে নিয়ে এলাম। এরপর ওদের পা-দুটোও বেঁধে ফেললেন আতিক ভাই। ওদের মোবাইল-ফোন দুটোও আমরা নিয়ে নিলাম। এ-দুটো তদন্ত-কাজে লাগবে।
আতিক ভাইয়ের সন্দেহ মোতাবেক সেই ঘরটাতে ঢুকে আমরা মরিয়মের দেখা পেলাম। তাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। তার সামনে আধখাওয়া নাস্তার একটা থালা। হঠাৎ আমাদের দেখে সে ভীষণভাবে চমকিত ও বিস্মিত। তবে তার মধ্যে কোনো ভয়ের ভাব দেখলাম না। তার চোখে-মুখে শুধু বাঁচার আকুতি ফুটে উঠলো।
লালভাই তাকে অভয় দিয়ে বললেন, “সত্যঘটনা খুলে বললে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। আমরা গোয়েন্দা। তোমাকে উদ্ধার করার জন্যই এখানে এসেছি। আমরা জানি, তোমার নাম মরিয়ম।”—এতে মেয়েটার স্বাভাবিক হতে বেশি সময় লাগলো না।
লালভাইয়ের নির্দেশে আমি ক্যামেরা রেডি করলাম। এবার ওদের সবার জবাববন্দি নিতে হবে।
প্রথমে সেই নাস্তাবহনকারী ছেলেটিকে অধ্যাপকসাহেবের খুনের ঘটনাসম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই সে হাউমাউ করে কেঁদে বললো, “সাহেব, আমি কিছু জানি না। আমি এইখানকার গার্ড। হাশেম ভাইয়ের আন্ডারে থাকি। আর বছরখানেক আগে কাজে যোগ দিছি। হাশেম ভাইয়ের নির্দেশেই গতকাল আমি আপনাদের সামনে ওই চিঠিটা ফেলছিলাম।”
লালভাই বললেন, “তোমার নাম বলো?”
সে কাঁদ-কাঁদ গলায় বললো, “আমার নাম মো. সোহেল খান।”
সে বারবার বলতে লাগলো, “আমি কিছু জানি না, স্যার। আমি কিছু জানি না, স্যার।”
হাশেম এবার নিজে থেকে মুখ খুললো আর সেও বললো, “আমিও তেমনকিছু জানি না। শুধু জানি, প্রোবেচর সাহেব খুন হইছেন। আর এই খুনটা ওসিসাহেবের নির্দেশেই হয়েছে। তিনিই সবকিছু করেছেন। তার নির্দেশেই আমরা দুইজন এ কয়েকদিন শুধু এই মরিয়মকে পাহারা দিচ্ছিলাম। আমাদের সঙ্গে এখানে আরও একজন গার্ড আছে। ওর নাম ইদ্রিস। ও গতকাল সকালে দেশের বাড়ি বরিশাল গিয়েছে। ওসিসাহেব আমাদের বলেছিলেন, ‘মামলাটা আজাদ কালামের নামে ভালোমতো আটকে গেলে মরিয়মকে পরে খুন করে একখানে ফেলে রাখা হবে। যাতে এই মামলার কোনো সাক্ষী-প্রমাণ না থাকে।’ এর বাইরে আমরা আর-কিছু জানি না, স্যার। সব জানেন ওসিসাহেব। আর মরিয়মও সব জানে। তাকে একবার সব জিজ্ঞেস করেন, স্যার।”
আমাদের মনে হলো: সভয়ে হাশেম সত্যকথাই বলেছে। লালভাই তাকে আর-কোনো চাপ দিলেন না।
ক্যামেরার সামনে এবার মরিয়মকে দাঁড় করিয়ে দিলাম। তাকে যথেষ্ট অভয় দেওয়া হয়েছে। সে আমাদের কথা বিশ্বাস করে বেশ সাহসের সঙ্গে বলতে লাগলো:

ঘটনার দিন আমি সন্ধ্যার সময় রান্নাঘরে চা-নাস্তা বানানোর কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় প্রোবেচর চাচাজানের গলা শুনলাম, তিনি খুব রেগে কাকে যেন বলতিছিলেন: তুমি আর-কখনো আমার বাড়িতে আসবে না। তুমি এতো খারাপ তা আমি আগে বুঝতে পারিনি। তুমি আমার বাড়ি থেকে আজ-এইমুহূর্তে বেরিয়ে যাও। আর কখনো এখানে আসবে না। আজ থেকে তোমার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নাই। তুমি আমাদের ঘরের বউয়ের ওপর হাত দিয়েছো! তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি তোমাদের ডিআইজিকে বিষয়টা জানাতে বাধ্য হবো। যাও, এখান থেকে এক্ষনি বেরিয়ে যাও।
এতো উত্তেজনা দেখে আমি বাইরের রুমে এসে দেখি, চাচাজানের সামনে ওসিসাহেব মুখভার করে বসে রইছেন। চাচাজান তাকেই এতক্ষণ এসব কথা বলেছেন। তখন ওসিসাহেবের পাশে বসে ছিলেন চাচাজানের ছেলের বউ শাহীনা ভাবি। তাগো দুইজনের চরিত্র ভালো না। আমি আগে থেকে এসব জানতাম। আর কালাম ভাই হয়তো আমার মতো সব জানতেন না। তারা দুইজন স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকতো। কিন্তু আমি ভয়ে কাউরে কিছু বলার সাহস পাই নাই। সেদিন চাচাজান ওদের দুইজনকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলেছিলেন। এই হইলো আসল ঘটনা।
এরপর এশার নামাজের কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ চাচাজানের ঘর থেকে বিরাট চিৎকার ও চেঁচামেচির আওয়াজ। চাচাজান বাঁচাও-বাঁচাও বলে চিৎকার করছেন। এইটা মরণ-চিৎকার। বুকফাটা কান্নার আওয়াজ।
আমি রান্নাঘরের কাজ ফেলে বাইরের রুমে ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি, শাহীনা ভাবি তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চাচাজানের দুই-পা ধরে রয়েছেন। আর ওসিসাহেব চাচাজানের বুকের ওপর বসে তাকে জবাই করছেন। আমি সেই সময় এতো ভয় পাইছিলাম যে আমি চিৎকার দিতেও ভুলে যাই। তখন আমার মুখ দিয়ে কোনো চিৎকার বের হয় নাই। আমার জীবনে এইরকম ঘটনা আর কখনো দেখি নাই। হঠাৎ আমার গলা দিয়ে ‘চাচাজান’ বলে একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে। তা দেখে ওসিসাহেব চাচাজানের বুক থেকে নেমে সোফায় বসে পড়লেন। আমি ছুটে গিয়ে চাচাজানকে জড়িয়ে ধরলাম। তাকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু তার বুকে ছুরি মারা হয়েছিল। আর তাকে জবাই করার ফলে তিনি আস্তে-আস্তে মারা গেলেন। আমি তখন কিছুই করতে পারি নাই।
এরপর আমার চুলের মুঠি ধরে ওসিসাহেব বললেন, “তুই যদি কাউরে কিছু বলছিস তো তোকেও এই অবস্থা করা হবে।” আর শাহীনা ভাবি ওসিসাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ও-কে এখানে রাখা ঠিক হবে না। একটাকিছু করেন।”
ওসিসাহেব গম্ভীরমুখে বললেন, “তাইতো ভাবছি।”
এরপর ওসিসাহেব আমার গায়ের রক্তমাখা জামা-কাপড় খুলে নিয়ে এই খামারের গার্ড হাশেম ভাইকে ডেকে তার হাতে আমাকে তুলে দেন। যেন মামলা চলা পর্যন্ত আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। তারপর চাচাজানকে ওরা কী করছে আমি আর জানি না। আমি সেসব বলতে পারবো না। কিন্তু একটা কথা সত্য। আমি নিজের চোখে ওসিসাহেব আর শাহীনা ভাবির হাতে প্রোবেচর চাচাকে খুন হতে দেখেছি।

এবার লালভাই বললেন, “এসব আমরা জানি। শুধু আমাদের সাক্ষ্যপ্রমাণের প্রয়োজন ছিল। আমরা গোরস্থান থেকে তোমার আর শাহীনার রক্তমাখা পোশাক পেয়েছি। তোমাদের কাজ আপাতত শেষ। এবার তোমরা সবাই কিছুদিন র‌্যাবের হেফাজতে থাকবে। আর সেখানে সবাই যদি সত্যি কথাটা বলো তাহলে তোমাদের কোনো ক্ষতি হবে না, এবং তোমাদের খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু নিজেদের বক্তব্য কখনো পরিবর্তন করার চেষ্টা করবে না। কারণ, তোমাদের আজকের সবকিছু আমরা রেকর্ড করেছি। আর তা যথারীতি আমাদের কাছে সংগৃহীত থাকবে।”

মরিয়ম দীর্ঘসময় কোনোরকমে খেয়েদেয়ে জীবনটা বাঁচিয়ে রেখেছিল। তাকে ভীষণ দুর্বল মনে হচ্ছে। এজন্য আমরা তাকে খাওয়ার সুযোগ দিলাম। তার সকালের আধখাওয়া নাস্তা শেষ হলে লালভাই তাকে প্রশ্ন করলেন, “খুনের সময় আজাদ কালাম কোথায় ছিল?”
“চাচাজানের পাশের রুমে, তার ঘরে।”—মরিয়ম এবার বেশ দ্রুত উত্তর দিলো।
“সে তার মামাকে বাঁচাতে ছুটে আসেনি কেন?”—সবিস্ময়ে বললেন লালভাই।
মরিয়ম মনভার করে বললো, “তা তো আমি জানি না, স্যার।”
“তাকে আগেই বেঁধে রেখেছিল ওসিসাহেব। বেচারা সেখানে হয়তো বন্দি-অবস্থায় তার মামার হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যটি পরোক্ষভাবে দেখতে পেয়েছে।”—লালভাই আচমকা কথাটা বলে আমাদের সবাইকে চমকিয়ে দিলেন।

লালভাই শুধু অস্ফুটস্বরে বললেন, “এরা ভয়ংকর পশু।”
তারপর তিনি ভাবতে-ভাবতে বললেন, “খুনের সময় অধ্যাপকসাহেবের নাতি-নাতনিরা কোথায় ছিলেন? তাদের রক্তমাখা খেলনা আমরা পেয়েছি!”
মরিয়ম মনখারাপ করে বলে, “ওরা সবসময় চাচাজানের কাছে থাকতো। ওদের খেলনাপাতিও তার বিছানায় পড়ে থাকতো। খুনের সময় ওরা ওদের ঘরে বসে পড়ছিল আর খেলছিল। ওদের রুমের দরজা আগেই বাইরে থেকে বন্ধ করে রেখেছিলেন শাহীনা ভাবি। তারপর থেকে ওরা কোথায় আছে আমি জানি না।”
লালভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শাহীনা বেগম আজ আমাদের কাছে একটা বড়সড় মিথ্যা বলেছে। সে তার সাক্ষাৎকারের সময় ছেলে-মেয়েদের একটা রুমে কাজের মেয়েটার কাছে রেখে আসার কথা বলেছিল—আসলে এটা মিথ্যা কথা। সেই সময় বাসার ভিতরে অন্য কেউ ছিল। আমরা যেন তা বুঝতে না পারি সেইজন্যে সে এই কৌশল অবলম্বন করেছিল। সে ভয়ানক নিষ্ঠুরপ্রকৃতির মহিলা। আমি কয়েকবার এজন্য বাসার ভিতরে ঢুঁ মেরেও তা জানতে পারিনি। আমার মনে হয়: তখন বাসার ভিতরে ওসিসাহেবই বসে ছিল। আমাদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য সে ছেলে-মেয়েদের নাম করেছে।”

লালভাই প্রশান্ত মনে এরপর কাকে যেন ফোন করলেন। ঘণ্টাখানেক পরে দেখলাম, বাইরে র‌্যাবের একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় র‌্যাব-কমান্ডার খামারবাড়িতে ঢুকে লালভাইকে অভিনন্দন জানালেন, এবং মামলার আরও আলামত সংগ্রহের জন্য এই বিষয়টি গোপন রাখার কথাও তাকে জানালেন। র‌্যাব-অধিনায়ক খামারবাড়িটা সীলগালা করে দিলেন। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। একসময় লালভাই তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন।

খামারবাড়িটায় আরও কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে একসময় আমরাও ফিরে এলাম সাভারে। আর বাসায় ফেরার আগে আব্দুস সাদেকের রিক্সাটা আমরা ফেরত দিয়ে এসেছি।


পড়ন্ত দুপুরে আমরা খাবার খাচ্ছিলাম। লালভাই বললেন, “আমাদের হাতে আরও কিছু প্রমাণ প্রয়োজন। নইলে ওসি গোলাম মওলা পুলিশের লোক হওয়ায় সে এই মামলার ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারে। এজন্য আমরা আগামীকাল সকালে আবার সরকার-মঞ্জিলে যাবো। আর এবার সরাসরি গোয়েন্দারূপে। দেখি, আরও কিছু তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে পারি কিনা।”

আমি আর আতিক ভাই ভেবেছিলাম, মামলা এখানেই শেষ। কিন্তু লালভাইয়ের কথায় আমাদের নাকে আবার রহস্যের গন্ধ আসতে শুরু করলো। আমরা কাল সকালের অপেক্ষায় রইলাম।





আজকে আমরা সরকারবাড়ির কাছে এসে দেখি, সেই পুলিশপ্রহরা আর নাই! এমনকি সেখানে কোনো দারোয়ান পর্যন্ত নাই! আমরা খুব অবাক আর বিস্মিত হলাম। এমনটি তো হওয়ার কথা নয়! শেষমেশ বুঝতে পারলাম, ওদের গ্রেফতারের খবর হয়তো ওসি গোলাম মওলা জেনে গিয়েছে। সে এখন হয়তো নিজে বাঁচার জন্য অন্য কোনো ধান্দা করছে।

বাসভবনের কাছে এসে আমরা কলিংবেল চাপতেই গেইটের কাছে এসে দাঁড়ালো শাহীনা বেগম। আজ তার হাবভাব একেবারে অন্যরকম। যেন আমরা তার ভীষণ শত্রু। তবে গতকালের সাংবাদিক-পরিচয়ের মানুষ হিসাবে আমাদের সে চিনতে পারেনি। প্রথম দিনের মতো আজও সে আমাদের কোনো পাত্তা দিলো না। আমরা গোয়েন্দা শুনে সে আবারও ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। আর গোয়েন্দা লালভাইয়ের নাম শুনে গতকালের মতো আজও তার হৃদকম্প যেন বেড়ে গিয়েছে।
লালভাই তাকে বাড়ির গেইট খোলার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু সে গেইট খোলা তো দূরে থাক গেইট খোলার কোনো আগ্রহও দেখালো না। এতে লালভাই হাল ছাড়লেন না। তিনি তদন্তের স্বার্থে ভিতরে ঢোকার জন্য তাকে বারবার অনুরোধ করলেন। শাহীনা বেগম গেইটের কাছে অনড়ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। আর তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। তাকে এইমুহূর্তে আমাদের বারুদের স্তূপ মনে হচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরে শাহীনা বেগম বললো, “ভিতরে ঢুকতে চাইলে ওসিসাহেবের সঙ্গে কথা বলেন।”
লালভাই কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে শেষে ওসিকে ফোন করলেন। কিন্তু ওসি ফোন ধরছে না। মনে হলো: ওসি যেন বাংলাদেশে নাই!

লালভাই অন্তত আরও ত্রিশবার ওসিকে ফোন করে তাকে পেলেন না। শেষমেশ তিনি বিরক্ত হয়ে আমার দিকে চেয়ে বললেন, “তুই কি সাহসের সঙ্গে আজ একটা কাজ করতে পারবি?”
আমি বললাম, “কেন পারবো না লালভাই। অবশ্যই পারবো। আপনি শুধু আমাকে একবার বলে দেখেন।”
লালভাই এবার আমার কাছে এসে বললেন, “কেসটায় খুবই ঘাপলা রে! আর রাঘব বোয়ালরা জড়িত। এর সাধারণ তদন্ত করে কোনো লাভ হবে না। এরা সাধারণ সাক্ষীটাক্ষী একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিবে। এদের বিরুদ্ধে চাই জলজ্যান্ত স্পষ্ট কিছু। তোকে এখনই এই দোতলা বাড়িটার ভিতরে ঢুকতে হবে। আর ভিতরে ঢুকে ওই মহিলার বেডরুমে এই ছোট্ট ক্যামেরাটা সংগোপনে একটা গোপন-জায়গায় এমনভাবে লাগাতে হবে যে, ওদের কারও নজরে যেন তা না পড়ে। আমার মনে হয়: এতে আমাদের বিরাট সুবিধা হবে। আর মহিলার ছেলে-মেয়ে কেউই এখন বাড়ি নাই। ওদের মনে হয় খুনের আগে-পরে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওরা হয়তো খুনের বিষয়ে কিছু জানতে পারে। তাই, ওদের ব্যাপারে এতসব সতর্কতা। আর এসবকিছুর পিছনে এই ওসি ব্যাটা হয়তো সাহায্য করছে। কারণ, সেই তো আসল খুনী। তাকে ধরতে চাই আরও বড়সড় প্রমাণ। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো বুদ্ধি নাই।”
লালভাই আমাকে বুদ্ধি শিখিয়ে দিলেন এই দোতলা বাড়িটার ছাদে ওঠার। বাড়ির পিছনদিকটায় বিল্ডিংয়ের গা-ঘেঁষে একটা বড়সড় কাঁঠালগাছ রয়েছে। সেটি মই হিসাবে কাজ করবে। তাছাড়া, আমি গাছে উঠতে পারদর্শী। শিশুকাল থেকে এই বিদ্যা শিখেছি।
লালভাই আবার মূলভবনের গেটের কাছে গিয়ে কলিংবেল চাপলেন। শাহীনা বেগম এবার কাজের মেয়েটাকে সঙ্গে করে আবার গেইটের কাছে এলো। লালভাই এবার শাহীনাকে দীর্ঘসময় এখানে আটকিয়ে রাখার জেরা শুরু করলেন। এরই ফাঁকে আমি লেগে গেলাম নিজের কাজে। আর যে-করেই হোক, বাড়িটার ভিতরে আমাকে ঢুকতেই হবে।

গাছে উঠতে আমার কোনো বেগ পেতে হয়নি। ছোটবেলা থেকে আমি গাছে ওঠায় খুব পটু ছিলাম। তাই, দ্রুত গাছ বেয়ে দোতলা ভবনের ছাদে উঠে এর দরজাটা খুলে সিঁড়ি বেয়ে খুব সাহসের সঙ্গে নিচে নেমে এলাম। তারপর অনুমানে বুঝে নিলাম কোনটি মহিলার বেডরুম। এখন শীতকাল। এসি ছাড়ার সম্ভাবনা খুব কম। তাই, এসির পানি-অপসারণের পাইপটার সঙ্গে ছাই রঙের ছোট্ট ক্যামেরাটা বেঁধে দিলাম। পাইপটার সঙ্গে এর রঙটা মিলে যাওয়ায় এটি অন্তত সাতদিন কারও চোখে পড়বে না। কিন্তু আমাদের দরকার আজকের রাতটা। কাজটা দ্রুত শেষ করে আবার উঠে পড়লাম ছাদে। তারপর খুব ধীরেসুস্থে নেমে এলাম ভবনটার পিছনে। একসময় কেউ কিছু বুঝার আগেই দাঁড়ালাম লালভাইয়ের পাশে।
এসে দেখি, লালভাই শাহীনাকে জেরায়-জেরায় একেবারে কাহিল করে ছেড়েছেন।

শাহীনা সিংহদ্বারের ওপাশে দাঁড়িয়ে বিরক্তির সঙ্গে লালভাইয়ের সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন।
লালভাই বললেন, “অধ্যাপকসাহেবের জমিজমা, টাকাপয়সার হিসাব কে রাখতেন?”
মহিলা মুখভার করে বললো, “কে আবার, ওই খুনীটা। আজাদ কালাম।”
লালভাই হঠাৎ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন, “ওসিসাহেবের সঙ্গে আপনাদের পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে কিনা?”
একথা শোনামাত্র মহিলা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললো, “আপনার কথাবার্তা ভয়ানক নোংরা। আমি এখনই ওসিসাহেবকে সব জানাচ্ছি। এবার বুঝবেন ঠ্যালা।”
কথাটা শেষ করে মহিলা সীমাহীন ক্রোধে ভিতরে গেল।
আমার মনে হলো: গতকালের খামারবাড়ির ঘটনাটা এই বেকুব মহিলার হয়তো জানা নাই। তার একটুখানি জানতে পারলে এই সোনার শরীরে এত রাগ আর থাকতো না।

শাহীনা বেগমের অগ্নিমূর্তি দেখে আমরা বোকার মতো সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।

লালভাই একটা গাছের নিচে ঘাসের ওপর বসে পড়লেন। তিনি খুব ভাবছেন। একটু পরে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, “কেসটা খুব জটিল নয়। কিন্তু এ-কে ইচ্ছাকৃতভাবে জটিল করে তোলা হয়েছে। সব দোষ আজাদ কালামের ওপর চাপানোর অপচেষ্টা চলছে। শুধু মরিয়মের সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে কালামকে বাঁচানো যাবে না। আমাদের হাতে আরও কিছু প্রমাণ চাই। আর মনে রাখতে হবে: এই কেসে আসামী একটা থানার ওসি।”
আমরা দুজন তার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমাদের মনে হয়েছিল, গতকালের ঘটনার পর আমরা মামলা সমাধান করে ফেলেছি। কিন্তু এখন দেখছি রাঘব বোয়ালকে শায়েস্তা করতে আরও প্রমাণাদি চাই।

এমন সময় গেটের বাইরে পুলিশের গাড়ির আওয়াজ পেলাম। আমরা কেউই উঠলাম না। আগের মতো গাছের নিচে বসে রইলাম।
গাড়িটা এসে আমাদের কাছে থামলো। একটা হৃষ্টপুষ্ট পুলিশ-অফিসার গাড়ি থেকে নেমে আমাদের সামনে এসে বললো, “তোদের মধ্যে গোয়েন্দা লালভাই কে রে?”

আমি সভয়ে লালভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। দেখি, তার মুখে কোনো ভয়ডর বলতে কোনোকিছু নাই। তিনি যেন ভাবলেশহীন একজন মানুষ। তিনি চোখের ইশারায় আমাদের এখানে বসতে বলে নিজে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ওসির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনি বুঝি ওসি গোলাম মওলা।”
লোকটা হিংস্র শুয়োরের মতো গোঁ-গোঁ করতে-করতে বললো, “হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছিস। এবার বল গোয়েন্দা লালভাই কে?”
আমাদের লালভাই একটু হেসে বললেন, “আমি।”
কথাটা শুনে ওসির হিংস্রতা যেন আরও বেড়ে গেল। সে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো দাঁতমুখ খিঁচিয়ে লালভাইয়ের মুখের কাছে ঘুষি পাকিয়ে বললো, “শোন্ শুয়োরের বাচ্চা, তুই কোথাকার কোন গোয়েন্দারে? আমার কেসের ব্যাপারে বেশি নাক গলাবি না। আমি এই কেসের তদন্ত প্রায় শেষ করে ফেলেছি। আর আসামীও ধরা পড়েছে। তবুও তোর এত মাথাব্যথা কেন? আর যদি তোদের এই বাড়িতে কিংবা এর আশেপাশে তোদের দেখি তাহলে সবক’টাকে একরাতে ক্রসফায়ারে দিবো। বুঝলি শালা?”
লালভাই এবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা এসো। আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে।”

আমরা দুজন প্রায় টলতে-টলতে বাড়ির বাইরে চলে এলাম। লালভাই এবার ধীরপদক্ষেপে আমাদের পিছনে গেইট পার হলেন। তিনি এখনও শান্ত আর ধীরস্থির। তার চেহারায় পরাজয়ের কোনো আশংকা নাই।

আমরা হেঁটেই ধামরাই-বাসস্ট্যান্ডে এলাম। আবার গাড়ি ধরতে হবে। কিন্তু ফিরতি গাড়িতে চড়লাম মাত্র দুজন। আমি আর আতিক ভাই। লালভাই আমাদের গাড়িতে তুলে দিয়ে মহূর্তের মধ্যে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেলেন।
সারারাস্তা আমরা দুজন লালভাইয়ের চিন্তায় কত কী ভাবতে লাগলাম। আমরা বাসায় ফিরলাম ঠিক দুপুরে। আর তখনও আমাদের লালভাইয়ের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিলো।
বিকালে কয়েকবার লালভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখি তখনও তিনি আসেননি। দুশ্চিন্তা যেন আরও বেড়ে গেল। খানিকক্ষণ পরে দেখি লালভাইয়ের চিন্তায় আতিক ভাইও এসে উপস্থিত হয়েছেন।
তিনি আমার পাশে বসে বললেন, “তোমার ভাইটা খুব সাহসী। কিন্তু কোথায় যে গেল!”
কী জবাব দিবো তাকে? আমিও তা-ই ভাবছি।

আমরা যখন ভাবনাসাগরে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম—তখন এলেন আমাদের লালভাই। দেখি, তার মুখে বিজয়ের হাসি। আমরা দুজন একসঙ্গে বললাম, “কেসটার এবার সমাধান হলো নাকি?”
লালভাই মুচকি হেসে বললেন, “না এখনও হয়নি। তবে কাল সকালে সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। তোরা এখন ভাবনাচিন্তা রেখে যার-যার বাড়ি ফিরে যা। কাল ভোরে আমার এখানে চলে আসবি। আগামীকাল একসঙ্গে আমরা আবার সরকারবাড়িতে যাবো।”
আতিক ভাই যেন আঁতকে উঠে বললেন, “তাইলে তো ক্রসফায়ারে যেতে হবে!”
লালভাই বললেন, “সে ভয় আর নাই। আমি সারাদিনে এর একটা ব্যবস্থা করে এসেছি। আজ আর শুনে কাজ নাই।”
আমরা দুজন লালভাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। এখন আমাদের অনেক ভালো লাগছে।

পরদিন সকালে সরকারবাড়িতে গিয়ে দেখি বাড়ির সামনে র‌্যাবের একটা গাড়ি লালভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে।
লালভাইকে দেখামাত্র মেজরসাহেব গাড়ি থেকে নেমে বললেন, “আসুন গোয়েন্দাসাহেব, এবার বাড়ির ভিতরে যাওয়া যাক।”
আমরা আজ বিনাবাধায় বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। আর সেই মহিলা আজ সহজে গেইটও খুলে দিল। আমরা বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। এরপর লালভাই আমাকে শাহীনা বেগমের বেডরুমে ঢুকে সেই ক্যামেরাটা নিয়ে আসতে বললেন।
আমি মহিলার বেডরুমে ঢুকে দেখি, ক্যামেরাটা আগের মতোই রয়েছে। সেটা সাবধানে খুলে এনে লালভাইয়ের হাতে দিলাম।
মেজরসাহেব হাসিমুখে লালভাইয়ের হাত থেকে ক্যামেরাটা গ্রহণ করে এদের বাড়ির ড্রইংরুমে সবাইকে নিয়ে বসলেন। তারপর বড় টিভিটার সঙ্গে ক্যামেরার সংযোগ ঘটালেন। আর তখনই ভেসে উঠলো অধ্যাপক আবুল হাসানের পুত্রবধূ ও ওসি গোলাম মওলার পরকীয়ার গোপন ও বীভৎস দৃশ্য। আর তাদের গতরাতের গোপন-শলাপরামর্শও। তারাই অধ্যাপকসাহেবকে খুন করেছে গলাকেটে। এবার প্রমাণ মিলেছে একেবারে হাতেনাতে।

র‌্যাব-মেজর দ্রুত ওসিকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন। মেজরসাহেবের নির্দেশে র‌্যাব-সদস্যরা কাজে নেমে পড়লো। তারা ধামরাই-থানা থেকে ওসি গোলাম মওলাকে ধরে আনতে গেলেন।

আমরা ভিডিও দেখে বুঝলাম, অধ্যাপকসাহেবকে হত্যা করেছে তারই পুত্রবধূ শাহীনা বেগম ও তার পরকীয়া প্রেমিক ওসি গোলাম মওলা। আর এ দুজন নিজেদের স্বার্থের জন্য বলির পাঁঠা বানাতে চেয়েছিল তাদের পরকীয়ায় বাধাদানকারী তরুণ আজাদ কালামকে। বিদেশে থেকে অধ্যাপকসাহেবের একমাত্র পুত্র আবুল বাশার সরকার যেন আর কখনো দেশে ফিরতে না পেরে সেজন্য তাকেও এই খুনের মামলার আসামী করা হয়েছিল। ঠিক একইভাবে মামার বিষয়সম্পদ থেকে চিরতরে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আজাদ কালামের ছোটভাই আজাদ রায়হানকেও খুনের আসামী বানানো হয়েছিল। ছেলে-মেয়ে দুটোকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের পরকীয়ার সুখের জন্য এতসব ঘটনা ঘটেছে। প্রমাণিত হলো—মরহুম অধ্যাপকসাহেবও তাদের এই অনৈতিক সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। তাই, প্রতিহিংসাবশত তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ওসি গোলাম মওলা খামারবাড়িসহ সবকিছু গ্রাস করতে চেয়েছিল।

অনেক কর্মব্যস্ততা-শেষে লালভাই আমাদের দুজনকে নিয়ে ‘সরকার-মঞ্জিলে’র বড় বকুলগাছটার নিচে দাঁড়ালেন। তারপর তিনি ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, “শুরুতে আমি তোমাদের বলেছিলাম যে, এই কেসটাতে দুইজন মহিলা ও একজন পুরুষ জড়িত। তা ছিল গোরস্থানের পাশে রক্তমাখা কাপড়চোপড় পাওয়ার পর ধারণা থেকে। কিন্তু যখন দেখলাম, মহিলা একজন উধাও—তখন ধারণা পাল্টালাম। একজন মহিলাই জড়িত। মামলাটাকে অনেক জটিল করার চেষ্টা করেছিল ওসি গোলাম মওলা। কিন্তু পারেনি। গোরস্থান থেকে রক্তমাখা এতসব কাপড়চোপড় পাওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম, কালাম আজাদ সম্পূর্ণ নির্দোষ। তার কারণ, কালাম যদি অপরাধী হতো—তাহলে, সে ধরা পড়ার পর কীভাবে এতসব আলামত গোরস্থানের পাশে ফেলে রাখবে? আর তার দুজন মহিলা সঙ্গীর প্রয়োজন হতো। কিন্তু তার কোনো আত্মীয় মহিলা এখানে বসবাস করতো না। এগুলো যে শাহীনার—তা আমার দেখেই মনে হয়েছিল। তবুও সবকিছুর প্রমাণ প্রয়োজন। এজন্য আজ আমি শাহীনার কথিত সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় সাজিদকে ড্রইংরুমে বসিয়ে রেখে খুব কৌশলে দুই-দুইবার শাহীনার বেডরুমে ঢুকে পড়েছিলাম। তার আশেপাশেও ভালোমতো ঢুঁ মেরেছি। আর সবজায়গায় মিলিয়ে দেখেছি, গোরস্থানে প্রাপ্ত একসেট কাপড়চোপড়ের সঙ্গে শাহীনার পোশাক সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে। শুধু বুঝতে পারিনি, ওই সময় শাহীনার বেডরুমের পাশের রুমটাতে কে ছিল! সে তার ছেলে-মেয়ের কথা বলে এতবড় একটা সত্য আড়াল করতে চেয়েছিল। আমার এখনও মনে হয়: তখন গোলাম মওলা ভিতরেই ছিল। আমরা এত সকালে এসে পড়ায়—সে ভিতরে আটকা পড়ে যায়। তারপর আমরা যখন খামারবাড়ি-অপারেশনে যাই—তখন সে আলগোছে সেখান থেকে বেরিয়ে থানায় হাজির হয়। আর গোলাম মওলাই কেসটাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য শুরু থেকে এ কয়েকদিন এতসব অপচেষ্টা করেছিল। আর সে-ই সমস্ত আলামত বিনষ্ট করে মরহুম অধ্যাপকসাহেবের লাশ তড়িঘড়ি করে দাফন করেছিল। এবার সে ও তার পরকীয়ার দোসর শাহীনা পাপের শাস্তি পাবে।”
আতিক ভাই একটু হেসে লালভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রোফেসর, একটা বিষয়ে এখনও আমার মনে খটকা লেগে আছে!”
লালভাই একটু গম্ভীর ও উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “বল তো কী বিষয়?”
আতিক ভাই বললেন, “অধ্যাপকসাহেব যে-ঘরটাতে খুন হয়েছেন—ওরা সে-ই ঘরটা তালাবদ্ধ করে রেখেছিল কেন? আর তা আমাদের দেখতেই বা দেয়নি কেন? আর কী আছে ওর ভিতরে?”
লালভাই এবার হেসে বললেন, “ও এই ব্যাপার! আমি ভেবেছিলাম আরও জটিল কিছু। আরে, সেখানে এখনও অনেক আলামত আছে। অধিকাংশ আলামত ওরা তড়িঘড়ি করে গোরস্থানের কাছে ওই জঙ্গলটাতে ফেলে রেখেছিল। বাকি আলামতসমূহ এখনও ওই ঘরের ভিতরেই রয়েছে। বোঝ না কেন—একটা জলজ্যান্ত মানুষখুন হয়েছেন—তার কত আলামত থাকে। সবটা ওরা হয়তো ধুয়েমুছে সাফ করে ফেলতে পারেনি। এজন্য প্রচুর সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু ওরা একটা রাতের মধ্যে অনেককিছু—আলামত গুছিয়ে কবরস্থানের কাছে জঙ্গলে ফেলেছে। তারপর রুমটা হয়তো ধোয়ামোছাও করেছে। তারপরও অনেককিছু রয়ে গিয়েছে। ওই একরাতের মধ্যে ওরা নিজেদের পোষা-ডাক্তারের দ্বারা অধ্যাপকসাহেবের দেহ-ময়নাতদন্ত করে তা নিজেদের হেফাজতে রেখেছে। আর সবকিছু শেষ করে দেওয়ার জন্য খুব সকালে অধ্যাপকসাহেবকে তারই বাড়ির পাশে তারই জায়গার কবরস্থানে দাফন করেছে। ওরা ভেবেছিল, এভাবেই সব ওদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু বিধি বাম। কেসটা আমাদের হাতে চলে আসে। আর তুমি যে-তালাবদ্ধঘরটার কথা বলছো—সেটা এখন র‌্যাবের হেফাজতে। তোমার যদি ঘরটা দেখতে ইচ্ছে করে তো—আমরা নাহয় একদিন র‌্যাব-মেজর সাহেবের সঙ্গে দেখা করে তা দেখবো। কিন্তু আজ এই ঝামেলার মধ্যে আর নয়।”
আতিক ভাই একথা শুনে হেসে ফেললেন আর বললেন, “তার আর দরকার হবে না। আমার মনের খটকা দূর হয়েছে। এবার যা করার র‌্যাবই করবে। ওদের দফারফা আশা করি শেষ হয়ে যাবে।”

ঘণ্টাখানেক পরে র‌্যাব-সদস্যদের তত্ত্বাবধানে ওসি গোলাম মওলা ও তার দোসর শাহীনা বেগমকে কোমরে দড়ি বেঁধে জেলহাজতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর এই ঘটনা দেখতে সরকার-মঞ্জিলের সামনে জড়ো হয়েছে হাজারখানেক এলাকাবাসী।
থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আজাদ কালামকে। তার মুখে বিশাল সন্তুষ্টির ছাপ। সে আমাদের লালভাইকে প্রথমে কদমবুসি করে তারপর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তার চোখে আনন্দাশ্রু।
আমরা এবার বুঝতে পারলাম, গতকাল আমাদের লালভাই একাই র‌্যাবের সঙ্গে সুপরামর্শ করে সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন। আর তার বুকপকেটে রাখা ক্যামেরায় ধারণকৃত ওসির ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের ভিডিও র‌্যাবকে দেখিয়ে তাকে খুব সহজে ব্যাকফুটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জয় আমাদের লালভাইয়ের। জয় বাঙালির।

আমরা প্রশান্ত মনে ফিরে এলাম সাভারে। আবার প্রহর গুনতে হবে নতুন কোনো কেসের। আবার জমজমাট হয়ে উঠবে লালভাইয়ের গোয়েন্দা-অফিস।


সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।







মন্তব্য ৭ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:১১

রাজীব নুর বলেছেন: লাল ভাই বুদ্ধিমান মানুষ।

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:২৬

সাইয়িদ রফিকুল হক বলেছেন: লালভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন। যেন তিনি নামকরা গোয়েন্দা হতে পারেন।

আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা। ;)

২| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:১৭

রূপম রিজওয়ান বলেছেন: ওরে বাবা! এত বড় পোস্ট দেখে তো সবাই ভয় পেয়ে গেছে মনে হয়। হা হা।
পুরোটা পড়েছি।ওনেস্টলি,খুব ভালো লেগেছে। গোয়েন্দাকাহিনী আমার ফেভারিট! আগে কালেরকন্ঠে মগজধোলাই নামে একটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন দিত,ওটার রহস্যজট পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। অনেকদিন পর একটা ডিটেকটিভ কাহিনী পড়তে পেরে ভালো লাগলো। আপনার লেখার এ দিকটা খুব ভালো লাগে যে,বিভিন্ন ধরণের পোস্ট দেন,বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখেন,কিন্তু একটা ধ্রুব ধাঁচ বজায় রাখেন। আপনার নামোল্লেখ না থাকলেও চিনে নেওয়া যাবে যে এটা আপনারই লেখা।
যাহোক,দুটো বিষয়-
১)মূল চরিত্র লাল ভাইয়ের পেশা অধ্যাপনা হওয়াটা একটু আজব লাগলো। তবে হয়তোবা এটাই চরিত্রটিতে আরো 'ডিটেকটিভ ডিটেকটিভ' ভাব এনেছে। বিষয়টা আজব লাগলেও মন্দ লাগেনি তাই।
২) অংশ ২ অথবা ৩ এ কোথায় যেন পড়তে গিয়ে তালটা কেটে গিয়েছিল! ওখানে 'হোন্ডারোহী' শব্দটা ছিল। বিদেশী শব্দের সাথে আরোহী শব্দটার সন্ধি কেমন যেন শোনাল!
এছাড়া সব মিলিয়ে খুব ভালো লেগেছে।
শুভকামনা। সালাম জানবেন।

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:৩৩

সাইয়িদ রফিকুল হক বলেছেন: ভাই, আপনার মতো সুহৃদ পেয়ে আমি ধন্য।
আপনি যে এতোবড় পোস্ট একনিঃশ্বাসে পড়েছেন তাতে আমি যারপরনাই আনন্দিত ও অভিভূত।

লালভাইকে ডিটেকটিভ ও অধ্যাপক হিসাবে চিত্রিত করার কারণ হলো:

১. যে-মানুষটির ছায়া-অবলম্বনে লালভাই চরিত্রটি সৃষ্টি করতে চাচ্ছি, তিনি একাধারে শিক্ষক এবং সত্যিকারের একজন ডিটেকটিভ মনের মানুষ।
২. সমাজে অধ্যাপক একটি পরিশীলিত চরিত্র।
৩. একটু নতুনত্ব আনার জন্য।
৪. অন্যান্য কোনো-একদিন দেখা হলে বলবো। ;)

আর ‘হোন্ডারোহী’ শব্দটা ইচ্ছে করেই দিয়েছি। অনেক শব্দ এখন বাংলার মতো হয়ে গিয়েছে!

আপনি যদি বলেন তাহলে, ‘হোন্ডা-আরোহী’ করে দিবো।

আপনার সমালোচনা আমার খুব ভালো লাগে। এরকম সমালোচকই প্রয়োজন। কোনো ভুল হলে অকপটে বলবেন। আর অকপটে সমালোচনা করবেন।

পাশে থাকায় কৃতজ্ঞ, ভাই। ;)

অসংখ্য ধন্যবাদসহ শুভকামনা।

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:৩৯

সাইয়িদ রফিকুল হক বলেছেন: আর বলতে ভুলে গিয়েছিলাম:
কখনো আপনার সঙ্গে দেখা হলে আপনার জন্য চা-কফি-ঝালমুড়ি-সিঙ্গারা-সমুচা বা বার্গার বা অন্যকিছু বরাদ্দ থাকলো।
মন থেকে বলেছি। ;)

৩| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:১০

রূপম রিজওয়ান বলেছেন: উত্তম প্রস্তাব! ;) ঢাকায় এসে অনেকদিন সিঙাড়া খাওয়া হয় না।
একদিন হয়তো হুট করে দেখা হয়ে যাবে। বিলটা অবশ্য আমিই দিব। ;)
সে যাহোক,কালকের প্রোগ্রামে যাচ্ছেন? (আমার এক্সাম :( )

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১১

সাইয়িদ রফিকুল হক বলেছেন: আচ্ছা, বিলটা নাহয় দিবেন। তবুও আসবেন। =p~
আর ঢাকায় এলে অবশ্যই দেখা করবেন।
অনেক কথা আছে।

আর ব্লগডের অনুষ্ঠানে আমি যাইনি।
আপনি যদি আগামী বছর যান তাহলে আমি যেতে পারি!

আপনার কী পরীক্ষা? জানতে পারি কি?

অনেক ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা। ;)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.