নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শরীরে শরীর নয়, ঠোঁটে ঠোঁট রাখাও নয়, মূহুর্তের ছোঁয়াও নয়, একটু দেখাতেই লিটার খানেক অগ্নিজলের ঘোর।

ত্রিশোনকু

না প্রেমিক না বিপ্লবী [email protected]

ত্রিশোনকু › বিস্তারিত পোস্টঃ

বৃক্ষকথা বৃক্ষমানব

২৯ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৫:০৫

বৃক্ষ আর দ্বিজেন শর্মা অংগাংগীভাবে জড়িত।

দূর থেকে রমনা পার্কে দেখা, বৃক্ষপ্রেমী দ্বিজেন শর্মার যে এত্ত বয়েস আমি তা চিন্তাও করতে পারিনি। তাঁর নড়া চড়া, চলাফেরায় জরা এখনো জাঁকিয়ে বসতে পারেনি।

আজ জানলাম যে তিনি যে বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে স্নাতোকোত্তর হন সে বছর আমার জন্ম।



১৯২৯ সালের ২৯ মে সিলেট বিভাগের বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে কবিরাজ চন্দ্রকাণ্ড শর্মা ও সমাজসেবী মগ্নময়ী দেবীর ঘরে জন্ম নেন দ্বিজেন শর্মা৷ বাবা ভিষক বা গ্রাম্যভাষায় কবিরাজ ছিলেন বলে বাড়িতেই দেখেছেন নানা লতা-পাতা আর বৃক্ষের সমাহার। প্রজাপতি ডানা মেলা দিনগুলোতে পাথারিয়া পাহাড়ের আরণ্যক নিসর্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই হয়তো গাছ-পালার প্রতি তাঁর এই ভালোবাসার জন্ম।

দ্বিজেন শর্মার ভাষ্য

“আমাদের গ্রামটি সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকায়, পাহাড়ঘেঁষা অন্য দশটি গ্রামের মতোই, আকারে ছোট, টিলাটালা ও গাছগাছালিতে ভরা, ছোট একটি স্রোতস্বিনী, সচ্ছল-অসচ্ছল জনগোষ্ঠী, সমসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান, আমার ছেলেবেলার স্বপ্নরাজ্য। পূর্ব কিনারে আসাম-বেঙ্গল রেলপথ, একটি স্টেশন ও সামান্য দূরে ঘাটাঘর আর ওখানেই আমাদের পাঠশালা। প্রথম পাঠশালা-যাত্রা, মনে আছে, চাচার কোলে চড়ে স্কুলে যেতাম। আমাদের স্কুলটা ছিল একটিই টিনের ঘর, লম্বা বারান্দা, সামনে রাস্তা, তারপর একসার আমগাছ, পেছনে উঠোন, এক পাশে একটি কাঁঠালগাছ, অন্য পাশে নাগেশ্বর, শেষ মাথায় বাঁশ ও গাছগাছালির জঙ্গল। পুরো ঘরে একটিই শ্রেণিক, প্রধান শিক নীরদচন্দ্র শর্মা, সর্বদাই অগ্নিশর্মা, সহকারী আছদ্দর আলী একেবারেই উল্টো, সর্বদাই স্নেহসিক্ত। ‘বেত নেই তো ছেলে নষ্ট’র আদর্শনির্ভর সেকালের পাঠশালাগুলো ছিল কিশোরদের জন্য আনন্দহীন অকুস্থল। এভাবে পড়াশোনার হাত ধরেই প্রকৃতির প্রেমে পড়ি। ভোরের আলোয় কাঁপত কচিপাতার সবুজ বাতাস, উতলা হতাম ফুলের মধুগন্ধে। সেইসব আশ্চর্য দিনে পৃথিবীর সব কিশোরের মতো আমিও প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কৈশোরের একটি দিনের কথা না বললেই নয়, ‘সরস্বতী পূজার সময় ফুল খুঁজতে গিয়ে ভিন্ন গাঁয়ে এক বৈষ্ণবীর আখড়ায় গাঁদা ফুলের একটি আশ্চর্য বাগান দেখেছিলাম। সারা উঠোনে ফুলের সে কী সমারোহ: হলুদ, কমলা, গাঢ় লাল, যেন রঙের বিস্ফোরণ। তার গোপালসেবার জন্য মানতি বলে বৈষ্ণবী আমাকে একটি ফুলও তুলতে দেননি। সেদিন বাড়ি ফেরার সময় পথ হারিয়ে এক বিলের কাছে পৌঁছে যে দৃশ্য দেখেছিলাম, আজও তা মনে আছে। আদিগন্ত দূর্বাশ্যামল মাঠ, মাঝে মাঝে হিজলবন, ছড়ানো-ছিটানো বনগোলাপ আর পুষ্পিত ভুঁইওকরার ঝোপ, বিলের স্বচ্ছ জলে রঙ-বেরঙের হাঁস, যেন এক স্বপ্নের দেশ। অনেকণ ওখানে দাঁড়িয়ে ফুল না পাওয়ার দুঃখটাই ভুলে গিয়েছিলাম। তবে মাটির বন্ধন মুক্তির ব্যর্থ আর্তিতে অরণ্য যেন মাথা কুটত। জল মর্মরের মতো সেই গোঙানি কিছুতেই শেষ হতো না। পুষ্পিত বনজুঁই কেঁপে কেঁপে ফুল ঝরাত আর আমি নির্বাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতাম। এভাবেই অরণ্যের মাঝে কেটে যায় আমার শৈশবের আনন্দময় দিনগুলো।”

পাঠশালার স্মৃতিচারণা, দীর্ঘবিস্মৃতির আবরণ উন্মোচন, কঠিন হলেও দুঃসাধ্য নয়। আজকাল অনেক ছেলেমেয়েরই বাড়ির চেয়ে স্কুলের প্রতি অধিক পপাত দেখি। আমাদের সময় কিন্তু এমনটি একেবারেই ছিল না। অভিভাবকরা ছেলেদের শিকের হাতে সঁপে দিয়ে বলতেন- প্রাণটা আমার, শরীরটা আপনার। এমন বন্দোবস্ত যেখানে, সেখানে কার যেতে ইচ্ছে হবে! তাই স্কুল ফাঁকি দেওয়ার নানা অজুহাত খুঁজতাম আর মোম ছিল পেটব্যথা ও জ্বর-জ্বর ভাব। এগুলো শনাক্তির কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় না থাকায় রেহাইও মিলত, কিন্তু পরিণতি সর্বদা শুভ হতো না। এমনটি একাধিকবার ঘটেছেÑ মা সামান্য পরীা করে স্কুলে না যাওয়ার আর্জি মঞ্জুর করেছেন, এক সময় পালিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে খেলায় বিভোর, তখনই মায়ের হাঁকডাক, একান্ত অনিচ্ছায় ঘরে ফিরে দেখি উঠোনে জনাতিনেক গাট্টাগোট্টা ছাত্র, যথার্থ যমদূত, স্কুলে নাকি ‘বাবু’ অর্থাৎ পরিদর্শক আসবেন, তাই হাজিরা একান্ত আবশ্যক। নিদয়া মা অসুখের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে প্যান্ট-জামা পরিয়ে ওদের হাতেই যখন তুলে দিতেন, মরে যেতে ইচ্ছে হতো।”

১৯৬০ সালে বরিশালে দেবী চক্রবতীর সাথে বিবাহ হয়। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নময়তার শুরু হয়েছিল। এখন তারা বড় হয়েছে, ছোট্ট চারা গাছ থেকে মহিরুহ হয়েছে তাঁর যত্নে, তাঁর ছায়াতেই। পরিবারের অনেকটা সময় কেটেছে মস্কোতেই। মস্কোর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আকাদেমিকা আনোখিনা সড়কে এক বহুতল ভবনের নবম তলার যে ফ্ল্যাটে দ্বিজেন পরিবারের কেটেছে অনেকগুলো বছর, সেটা এখনো দ্বিজেন শর্মার অন্যতম মূল গৃহ। পুত্র ডা. সুমিত শর্মা ও কন্যা শ্রেয়সী শর্মা। ড. দেবী শর্মা ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের দর্শনের সাবেক অধ্যাপিকা। এখনও তাঁর অনেক কাজ বাকি আর তাই নিয়েই তাঁর ব্যস্ত দিন কাটছে আপন নিবাসে।

নিভৃতিপ্রিয়, প্রচারবিমুখ উদ্ভিদবিদ, নিসর্গী, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাবিদ দ্বিজেন শর্মা সেই প্রজন্মের মানুষ যাঁরা এই উপমহাদেশের বৈপ্লবিক সব পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কিন্তু এসব রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যেই তিনি তাঁর প্রকৃতিপ্রেমকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ওপর পড়াশোনা থাকলেও তাঁর মধ্যে ছিল শিল্পবোধ আর দেখার চোখ, সুন্দরকে অন্বেষণের আকাক্ষা। মানবজাতির জন্য তাঁর মনে সব সময় এক অনিঃশেষ আশাবাদ ও শুভকামনা কাজ করে। লেখালেখির মধ্যেই তাঁর সৃষ্টিশীলতা ফুটে ওঠে বার বার। জীবনে প্রথম যে লেখা ছাপার অক্ষরে বেরিয়েছিল সেটি ছিল একটি গল্প, ১৯৪৯ সালে আই.এস.সি. ক্লাসের শেষবর্ষের কলেজ বার্ষিকীতে। সেটি ছিল একটি আত্নজীবনীমূলক গল্প। এক দরিদ্র ছাত্রের শিক্ষালাভের কঠোর সংগ্রামের কাহিনী, এরপর তত্‍কালীন পূর্ব পাকিস্তানের একাধিক দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে তাঁর লেখা গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলোর বিষয়বস্তুও ছিল অভিন্ন, দারিদ্র্যের জীবনযুদ্ধ। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতাজাত যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে, তা পুঁজিবাদী বিশ্বের সোভিয়েত গবেষক পণ্ডিতদের চেয়ে আলাদা। এসব বিষয় নিয়ে তিনি বেশ কিছু নিবন্ধ ও স্কেচধর্মী লেখা লিখেছেন।

দ্বিজেন শর্মার বইগুলোঃ

১. শ্যামলী নিসর্গ ১৯৮০,১৯৯৭ বাংলা একাডেমী
২. সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণী বিন্যাস ১৯৮০ বাংলা একাডেমী
৩. ফুলগুলি যেন কথা ১৯৮৮, ২০০৪ বাংলা একাডেমী
৪. গাছের কথা ফুলের কথা ১৯৯৯ শিশু একাডেমী
৫. এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি ১৯৯৫, ১৯৯৯ শিশু একাডেমী
৬. নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা ২০০০ ইউপিএল
৭. সমাজতন্ত্রে বসবাস ১৯৯৯ ইউপিএল
৮. জীবনের শেষ নেই ১৯৮০, ২০০০ জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন
৯. বিজ্ঞান ও শিক্ষা : দায়বদ্ধতার নিরিখ ২০০৩ জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন
১০. ডারউইন ও প্রজাতির উত্‍পত্তি ১৯৯৭ সাহিত্য প্রকাশ
১১. বিগল যাত্রীর ভ্রমণ কথা ১৯৯১ সাহিত্য প্রকাশ
১২. গহন কোন বনের ধারে ১৯৯৪ সাহিত্য প্রকাশ
১৩. হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার ২০০৪ সাহিত্য প্রকাশ
১৪. বাংলার বৃক্ষ ২০০১ সাহিত্য প্রকাশ
১৫. সতীর্থ বলয়ে ডারইউন ১৯৭৪, ১৯৮৪, ১৯৯৯ মুক্তধারা
১৬. মম দুঃখের সাধন ১৯৯৪ সাহানা
১৭ আমার একাত্তর ও অন্যান্য ফেব্রুয়ারি ২০০৮ অনুপম প্রকাশনী

তার বেশীর ভাগ বইই রকমারী ডট পাওয়া যায়।

কর্মক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে দ্বিজেন শর্মা বিভিন্ন সময় সংবর্ধিত হয়েছেন।
ক্রমিক পুরস্কারের নাম পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থা সাল
১. ড: কুদরত-এ খুদা স্বর্ণপদক চট্টগ্রাম বিজ্ঞান সমিতি ১৯৮৬
২. বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার বাংলা একাডেমী ১৯৮৭
৩. এম নুরুল কাদের শিশু-সাহিত্য পুরস্কার ২০০০
৪. একুশে পদক বাংলাদেশ সরকার ২০১৫

মানবসেবায় নিবেদিত সংগঠন সিলেট বিবেক তাঁকে ২০১২ সালে সংবর্ধনা দিয়েছে। এছাড়া তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া গ্রন্থাবলীর জীববিদ্যা বিভাগের অনুবাদ ও সম্পাদক (২০০১- ২০০৩) এবং বাংলা একাডেমীর সম্মানিত ফেলো।

_________________________________________________________

শুভ ছিয়াশিতম জন্মদিন দ্বিজান শর্মা।

আরো কয়েক যুগ বেঁচে থাকুন সুস্থ্য শরীর ও মন নিয়ে।
_________________________________________________________

সুত্র সমুহঃ

১। গুনীজন, আমাদের প্রেরণার উৎস।

২। দ্বিজেন শর্মা- The University Press Limited.

৩। আমাদের সময় আর্কাইভ সংবাদ » 2014-10-12

৪। উইকি।


মন্তব্য ৫ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৫:১৫

বাড্ডা ঢাকা বলেছেন: সুন্দর ভালোলাগলো ।

২৯ শে মে, ২০১৫ রাত ৯:২১

ত্রিশোনকু বলেছেন: ধন্যবাদ বাড্ডা।

২| ২৯ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৯

প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ পোষ্টের জন্য।

২৯ শে মে, ২০১৫ রাত ৯:২১

ত্রিশোনকু বলেছেন: স্বাগতম।

৩| ৩০ শে মে, ২০১৫ দুপুর ১২:১৬

এইচ তালুকদার বলেছেন: মাস দশেক আগে দ্বিজেন শর্মা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন,বিবর্তন নিয়ে চমৎকার একটা বক্তৃতাও দিয়েছিলেন,কিছু প্রশ্ন িলো কিন্তু প্রশ্ন গুলো করতে পারি নি কারন পাছে লোকে কিছু বলে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.