নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাহিত্য প্রিয় মানুষ আমি, বাংলা ভাষা চর্চার চেষ্টা করি। মূলত একজন একনিষ্ঠ পাঠিকা।

উজ্জয়নী

পেশায় গবেষক, নেশায় পাঠক

উজ্জয়নী › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাক্ষাত

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:৩৬

ফাইলের পাহাড় জমেছে টেবিলে, দ্রুত চোখ বুলিয়ে সই করে টেবিল খালি করছিলেন জেলা কোর্টের বিচারপতি সুমিতা। মফস্বল শহরে শীত নামছে, পাঁচটা না বাজতেই বিকেলের মরা আলো, পুরনো গরাদওলা জানালা গলে, আলো আঁধারচিত্র আঁকছে ঘরের কোণে। আফিসের সহযোগী রতন বাবুর এর মধ্যেই পাঁচ বার ঘড়ি দেখা হয়েছে, ম্যডামের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই দেখে, বাইরে গেলেন আরো এক কাপ চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে সময় কাটাতে। আনমনে সব কিছু লক্ষ করতে করতেই ফাইল পড়ছেন সুমিতা। বাড়িতে ফাইল নিয়ে যেতে তিনি পছন্দ করেন না, তবুও অনেক সময় সেটাই করতে হয়। সবারই এখন বাড়ি ফেরার মন, এদের নিয়েই তাঁর কর্মক্ষেত্র, কাজেই নিজের অনিচ্ছাতেও কিছু নিয়ম যেন তৈরি হয়ে আছে, যা স্বয়ং বিচারপতিও মেনে নিয়েছেন। উত্তরোত্তর কাজের চাপ বাড়ছে, বহু খালি পদে নিয়োগ বন্ধ থাকায়, কর্মরত বিচারপতিদের নাজেহাল অবস্থা। আর মামলারও কি শেষ আছে, এই সাত বছরের কর্মজীবনেই কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা সুমিতার, স্বচ্ছন্দে এক বই লেখা যায়, কিন্তু রায় ছাড়া আর কিছু লেখার কথা ভাবাই তো বিলাসিতা।

বাইরের সেকেলে ঘড়িতে ছটা বাজার আওয়াজ হল। দিনের শেষ ফাইলটা হাতে নিলেন সুমিতা। মলাটের নাম্বার পেড়িয়ে নামে এসেই চোখ আটকে গেল। আজ আর রতন বাবুর সাড়ে ছটার ট্রেন ধরা হল না।
ঘন্টাদুয়েক কোথা দিয়ে কেটে গেছে, দরজায় আর্দালীর গলা খাঁকানিতে আবার বাস্তবে ফিরলেন সুমিতা, সেই বিশেষ ফাইলটা হাতে করে, বেড়িয়ে এসে বসলেন গাড়িতে। অন্যরা স্বস্তির  নিশ্বাস ফেলে বাড়ির পথ ধরলেন, আজ তবু অল্পের উপর দিয়ে গেল হে, পান মুখে দিয়ে স্টেশনের পথে হাঁটতে হাঁটতে, জুনিয়ার শম্ভুকে বললেন রতনবাবু। এরকম ফাইল হাতে স্ট্যাচু হয়ে যাওয়া ম্যাডামের জন্য নতুন নয়। মাঝে মাঝে অনেক রাত পর্যন্ত গড়ায় সেই মামলা। মা কালীর কৃপায় আজ তবু সাড়ে আটটার ট্রেনটা ফেল হবে না। বাড়িতে গিন্নীর মেজাজ খারাপ, ছেলের পরীক্ষা চলছে।

সুমিতা নিজের বাংলোর হাতায় নামলেন, হাতে সেই ফাইল। সামান্য হাত মুখ ধুয়ে, কাশীকে এক কাপ কফি দিতে বলে, বসার ঘরে, আবার ফাইল খুলে, তাকিয়ে থাকলেন নামের দিকে, সাথে একটা আবছা ছবিও আছে, খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। কি যেন খুঁজছেন, পেয়েও পাচ্ছেননা। সামনের কাপে কফি জুড়িয়ে ঠাণ্ডা। বহু বছর পরে কেন যেন সুমিতার মনে হচ্ছে তাঁর খোঁজ শেষ হয়েছে। কেসটির তিনদিন পরে তাঁরই কোর্টে শুনানি, ধর্ষণ  ও খুনের মামলা, তাও আবার নিষিদ্ধ পল্লীর আবাসিকার ঘরে। কেসের কোন বৈশিষ্ট্য নেই, এরকম কেস নতুন নয়। কিন্তু সুমিতার কাছে গুরুত্বটা অন্যখানে। ফাইলটা জনৈক কানু মাহাতোর, নিবাস ঝাড়্গ্রামের মানিকপাড়া, বয়স ৬২, এত মিল; তাহলে কি এবার সত্যি দেখা হবে। ছবিটা এত খারাপ করে তোলা বলে মনে মনে বিরক্ত বোধ করলেন সুমিতা, চোখ, মুখ, গলা, কান - সবই দায়সারা করে তোলা ছবি। উঠে নিজের শোয়ার ঘরে গেলেন সুমিতা, আলমারির ভিতর থেকে বেড়িয়ে এল এক হলদে হয়ে যাওয়া খাম আর খামের ভিতর থেকে বের করলেন এক হলদেটে সাদা কালো ছবি। স্বামী-স্ত্রী, কোলে এক বছরের সন্তান। গ্রাম্য স্টুডিয়োতে তোলা, পিছনে তাজমহল। না, কিছু বোঝা মুশকিল। আবার কেস ফাইলে ডুব দিলেন সুমিতা, তদন্তের রিপোর্ট ইত্যাদি পড়ে, বেশ বুঝলেন মজবুত কেস। এরপর ক্লান্তিতে নুয়ে আসা শরীরে, সামান্য খাবার মুখে তুলে, বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন তিনি। ঘুমের মাঝে পৌঁছে গেলেন ফেলে আসা শৈশবে, স্মৃতি জুড়ে শুধু লড়াই, অনাথালয়ের সেই বেঁচে থাকার খুঁটিনাটি বারবার স্বপ্নে ফিরে আসে। নানান অসহায় মুহূর্তে অপেক্ষা একজনের জন্য, স্বপ্নে এক বিশাল মরুভুমিতে সুমিতা একা, জল তেষ্টা পেয়েছে, সাথে জল নেই। হঠাত বালির ঝড়ে ঘূর্ণিতে হারিয়ে যাচ্ছেন তিনি, হাত বাড়িয়ে কাকে যেন আঁকড়ে ধরতে চান, একটা হাত পিছলে যাচ্ছে বারবার। আকন্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে ঘুম ভাঙল, পাশেই জলের গেলাস, এক চুমুকেই শেষ; বাইরে ভোরের আলো ফুটছে। বারান্দায় সূর্য ওঠার অপেক্ষায় বসে রইলেন সুমিতা। একা।

তিন দিন পরে, আজ আদালতে সেই কেস। একটু যত্ন নিয়ে সাজলেন সুমিতা, কপালে আজ একটা টিপ, কানে দুল, অন্যদিনের থেকে গুছিয়ে বাঁধা চুলের ঘাড় লোটানো খোঁপা, আজকের দিনটা বিশেষ হয়ে উঠতেই পারে, কে বলতে পারে।
আদালতের কাজ রুটিনমাফিক এগুচ্ছে, জজের চেয়ারে বসে, ক্রমশ অধৈর্য সুমিতা। শেষে এল সেই প্রতিক্ষিত সময়, আসামী কানু মাহাতো হাজির। কাঠগড়ায় মধ্যবয়স্ক এক গ্রাম্য চেহারা, গায়ে সাদামাটা সার্ট ও সস্তার প্যান্ট, চোখের দৃষ্টি জ্যোতিশূন্য, ভাবলেশহীন, অনুতাপহীন। বোঝাই যায়, শ্রীঘরে যাওয়া নতুন নয়। চোখে মুখে বেপরোয়া জীবনযাপনের স্থায়ী ছাপ।  দুই পক্ষের উকিল বাদানুবাদ শুরু করল, সুমিতা খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন অপরাধীকে। না, নেহাতই অচেনা এক মানুষ, ইনি তিনি নন যার জন্য স্বপ্নে সুমিতা বারবার হাত বাড়ান। শুনানিতে মন দিলেন, মোটের উপর সাক্ষ্য প্রমাণ যা পেশ হল, তার খণ্ডন  না হলে শাস্তি অনিবার্য। খণ্ডন হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অপরাধ পাশবিক, এক ঝড় জলের রাতে, জোর করে পতিতালয়ের এক ঘরে ঢুকে, ধর্ষণ, খুন ও চুরি। আসামী নির্বিকার, চুরির মালও তার কাছ থেকেই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সরকারী পক্ষের উকিল, আসামীর অতীত বর্ণনা করলেন, কম বয়েসেই পাড়ার এক মেয়েকে ফুঁসলিয়ে পালায়, পরে তাকে হত্যা করে, একমাত্র শিশুসন্তান কে পথে ফেলে ফেরার। মাঝে আরো বহু অপরাধের ইতিবৃত্ত। আগেও বেশ কয়েকবার কারাবাস করেছে আসামী, তবে প্রথম খুনের অভিযোগে  যথেষ্ট প্রমান না থাকায়, বেনিফিট অফ ডাউটে পার পেয়ে যায়, ইত্যাদি। আদালতের কাজ শেষ, সেদিনের মত। নতুন তারিখ দিয়ে কোর্ট  ছাড়লেন তিনি।

প্রতিবারের মতই স্বস্তি আর অস্বস্তি মেশানো অনুভূতি নিয়ে, লম্বা করিডর পার হয়ে হাঁটা দিলেন গাড়ির দিকে। আন্দাজ না মেলার স্বস্তি আর খোঁজ শেষ না হওয়ার চিরন্তন অস্বস্তি।
করিডরে ভিড়, নানা কেসের বাদী, বিবাদী পক্ষ, পুলিশ ও কয়েদী। বারান্দা থেকে নামার শেষ ধাপে বসে আছে কানু মাহাতো, এক পাশে মাথা ঘুরিয়ে কিছু দেখতে ব্যস্ত। দূরে মাঠে ছোট ছেলে মেয়েরা খেলছে, সুমিতার মনে হল কানু মাহাতো যেন সেই শিশুদের ভিতরে কাউকে খুঁজছে, নিজের এই অদ্ভুত খেয়ালকে দূরে ঠেলে কানুর পাশ দিয়েই গাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন তিনি। হঠাত সময় থেমে গেল সুমিতার, কানুর ঘাড়ে ওই বিশাল জড়ুল। সেটা ক্রমে আড়ো বড় হয়ে ঢেকে দিল অস্তগামী সূর্যকে, অন্ধকার নেমে এল সুমিতার দুই চোখে, পিছনেই ছিলেন টাইপিস্ট শিখা,'ম্যাডাম শরীর খারাপ লাগছে?' বলে ধরে ফেলল তাঁকে, সাবধানে গাড়িতে তুলে দিয়ে এল। গাড়িতে সুমিতার বন্ধ চোখের সামনে জরুল রাজ্যের অন্ধকার ডেকে এনেছে তখন। অজান্তেই নিজের হাত চলে গেল ঘাড়ে, ঘাড় খোঁপার আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা একই রকম জরুল, জন্মদাগ।

পরের দিন সুমিতার উপরওলা এক ছুটির দরখাস্ত পেলেন। আকস্মিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় একমাসের ছুটির আবেদন, সাথে চালু মামলাগুলিকে অন্য কোর্টে সরিয়ে দেওয়ার আর্জি, নিচে সই- ইতি সুমিতা মাহাতো।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৯

মাআইপা বলেছেন: বাহ্ চমৎকার হয়েছে। আদালতের সব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে পরিচ্ছন্ন লেখা।
শুভ কামনা রইল।

২| ০৪ ঠা মে, ২০১৮ সকাল ৭:১৯

উজ্জয়নী বলেছেন: ধন্যবাদ

৩| ১২ ই মে, ২০১৮ সকাল ৯:৪৫

খায়রুল আহসান বলেছেন: ব্লগে সুস্বাগতম! এখানে আপনার বিচরণ আনন্দময় ও স্বচ্ছন্দ হোক! হ্যাপী ব্লগিং!
এ ব্লগে প্রকাশিত আপনার প্রথম পোস্টটা পড়ে গেলাম। প্রথম পোস্ট হিসেবে, অবশ্যই বলতে হবে, ভাল লিখেছেন। লিখতে থাকুন, আপনার গল্প লেখার হাত ভাল।
গল্পের সমাপ্তিটা চমৎকার হয়েছে। গল্পে ভাল লাগা + +

১২ ই মে, ২০১৮ সকাল ৯:৫১

উজ্জয়নী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, শিখছি, ব্লগে তাই অন্যদের লেখা ও মন্তব্য আমার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ

৪| ১৩ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:১৭

খায়রুল আহসান বলেছেন: শিখছি, ব্লগে তাই অন্যদের লেখা ও মন্তব্য আমার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ - ভাল কথা, তবে অন্যদের লেখাও বেশী বেশী পড়বেন, এবং পড়ে আপনার ভাবনার কথাটুকু মন্তব্যের আকারে সেখানে শেয়ার করবেন, তাহলে পারস্পরিক ভাব আদান প্রদানের মাধ্যমে আরো দ্রুত শিখতে পারবেন। যারা আপনার লেখায় মন্তব্য করেন, তাদের লেখাও দুই একটা পড়ে দেখবেন।

২৮ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১:২৭

উজ্জয়নী বলেছেন: হয় আপনার মন্তব্যটি অনেকদিন আগের বা আমি অনেকদিন পড়ে পড়ছি। আমি ইচ্ছেমত অন্যদের লেখা পড়ি, অনুসরনও করি, আপনার এই ধারনার কারনটা হয়ত আমার স্বল্প সময় উপস্থিতি, কিন্তু কি আর করা, কাজের চাপ থাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.