নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাহিত্য প্রিয় মানুষ আমি, বাংলা ভাষা চর্চার চেষ্টা করি। মূলত একজন একনিষ্ঠ পাঠিকা।

উজ্জয়নী

পেশায় গবেষক, নেশায় পাঠক

উজ্জয়নী › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাবিক

০৪ ঠা মে, ২০১৮ সকাল ৭:২১

হেমন্তের বিকেল, সূর্য গলানো সোনা মাখিয়ে দিয়েছে লাল, হলুদ বর্নের বিশালাকার গাছ গুলির মাথায়। শান্ত ভঙ্গিতে বয়ে চলা রাইনের ধারের বেঞ্চগুলি খালি পাওয়া ভার। সপ্তাহের মাঝামাঝি বলে চান্সটা নিয়েই ফেলল তমাল, নদীর ধারে, এক বিশেষ বেঞ্চি তার প্রিয়, ঝোপের আড়ালে বলে অন্যের চোখে পরে না কিন্তু চারপাশের দৃশ্য দিব্যি দেখা যায় ওখান থেকে। একটা বই হাতে বসলে ঐ ধীরবাহী রাইনের মতই অনায়াসে সময় কেটে যায়, বড় শান্তিতে। রোজকার হাজার কাজের ফাঁকে, এই ছেদ তমালের একান্ত নিজস্ব, প্রিয়। কাউকে এখানে নিয়ে আসেনা সে। বেঞ্চে বসেই মোবাইল বন্ধ করে দেয়, হাতে থাকে পড়তে থাকা  বই ও সাথে থাকে পছন্দমত খাবার আর কফি, স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তাহলে সেটা নিশ্চই এরকম হবে, প্রকৃতির কোলে,অবিচ্ছিন্ন ভালোলাগায় ভেসে যাওয়া।

তমাল ইতিহাস নিয়ে গবেষণা  করতে জার্মানীর ডার্মস্টার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে বছর তিনেক হল,  নতুন দেশ, শহর, মানুষ, পড়াশুনোর ধরন, সব মিলিয়ে মাঝে মাঝে একটু কোনঠাসা লাগে তার। মনটা উড়ে যায় কাঁথিতে তাদের গ্রামের বাড়ির উঠোনে, মা নিশ্চয় এতক্ষণে সন্ধ্যাদীপ জ্বেলে রান্না চাপিয়েছে। দাদু সুর করে রামায়ণ পড়ছেন, যদিও চোখের জ্যোতি কম, তাই বেশীরভাগটাই স্মৃতি থেকে। কখনো আবার সে হঠাৎ হাজির হয় হিন্দু হস্টেলের নিজের সিটে, সেখান থেকে বন্ধুদের সাথে প্রিন্সেপ ঘাটে বসে রাত গড়ানো আড্ডায়। যতক্ষন না পুলিশ এসে উঠিয়ে দিত। মন ভার হয় তমালের। ঘরকুনো ছেলে সে, কি ভাবে যে এসে পড়েছে এই বিদেশ বিঁভুইতে। অবশ্য তার স্কলারশিপ পাওয়া নিয়ে কম লোকের চোখ টাটায়নি। যদিও যোগত্যার বিচারে সেই ছিল সেরা দাবিদার। সোমেনকে মনে পরে খুব, বিদেশে আসার দ্বিধা সেই তো কাটিয়ে দিয়েছিল। বলত - তুই এখনো ভাবছিস তমাল, লাখে একজন পায় এমন সুযোগ, তুই দেখবি না দুনিয়াটাকে? তোর চোখ দিয়ে আমাদেরো দেখা হবে, নে নে কন্ট্রাক্ট ফর্মটা বের কর। একদিন, সেই জোর করে সেটা সই করিয়ে পোষ্ট করে এল। তারপর বন্দরের কাল হল শেষ। নতুন শহরকে এখনো পুরো আপন করতে পারেনি তমাল। দুবেলা ডাল ভাত না হলে তার এখনো চলে না। শুধু এই নদী তার ভারি প্রিয়, ভারি আপন। তমালের মনে হয় শেষমেস সব নদীর দেখা হয় একে অন্যের সাথে। তাই তার কথাগুলিও ঠিক পৌঁছে যায়  হুগলী নদীর বুকে বা তাদের গ্রামের বৈ নদীর তটে।

আজ সাইকেলের প্যাডালে একটু দ্রুত চাপ দিল তমাল, যতটা বেশী সময় কাটানো যায় তার ক্ষুদ্র নীড়ে। যথাস্থানে সাইকেল পার্ক করে পা চালালো নিজের নির্দিষ্ট গন্তব্যে। দূর থেকে খালিই দেখাচ্ছে বেঞ্চটা, না ভাগ্য তার ভালোই। কিন্তু কাছে এসেই চমক, বেঞ্চের একপাশে বসে এক বৃদ্ধ। নেহাতই অল্প জায়গাতে নিজেকে গুছিয়ে বসে আছেন, চোখ বহমান নদীর দিকে, মন কে জানে কোন সুদূরে, আশেপাশের ঘটনা তাঁকে স্পর্শ করছে না সেটা স্পষ্ট। বলিরেখা অংকিত মুখে স্মিত হাসি, যেমনটা তমালের ঠোঁটে থাকে বাড়ির খুঁটিনাটি মনে পড়লে। বৃদ্ধর আর্থিক অবস্থা যে ভালো না সেটা বোঝার জ্ঞান এই তিন বছরে হয়েছে তমালের। মদ্যপ বা ড্রাগ সেবনকারী কিনা খুঁটিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করল সে, বেঞ্চি ভাগ করে বসা কতটা নিরাপদ তা বোঝা দরকার। অল্প সময়েই তমালের মনে হল অন্য কিছু না বৃদ্ধ একা, এটা এদেশের সাধারণ সমস্যা। সেও তো একা - কাজেই কোথাও যেন এক বাঁধনে বাঁধা।  নির্দ্বিধায় সে অধিকার করল বেঞ্চির অপরদিক, বৃদ্ধ তাকিয়েও দেখলেন না। দুই দেশের, দুই একাকী মানুষ এক বহতা নদীর স্রোতে ভেসে যেতে থাকলো, হেমন্তের সোনাঝরা বিকেলে, রবীন্দ্র গল্পগুচ্ছ, যা  এখানকার লাইব্রেরী থেকেই সংগ্রহ করেছে তমাল, তার পাতা উল্টাচ্ছে, কিন্তু কেন জানি মন বসছে না, কি যেন আছে ঐ বৃদ্ধর চোখে, যার সাথে তারো নিবিড় যোগ আছে। কি - সেটাই ঠাওর হচ্ছে না। নদী দিয়ে ভেসে গেল এক বিশাল বার্জ, ছোট দুচারটে ট্যুরিষ্ট লঞ্চ। হাল্কা কলরব তাদের ছুঁয়েই মিলিয়ে গেল। সূর্য পশ্চিমে ঢলেছে, শেষ বেলায় আলোর সাথে আঁধারের খেলা শুরু হয়েছে, শীত বাড়ছে, এবার উঠতে হয়। নড়েচড়ে বসল তমাল, ঠিক তখনি কথা বললেন বৃদ্ধ - ইন্ডার? (ভারতীয়?)। সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো তমাল, আউস হোয়েলসার স্টাডট? (কোন শহরের থেকে?) জার্মান তেমন রপ্ত নয় তমালের, সাধারণ দুচার কথা বলতে ও
বুঝতে পারে। ক্যালকাটা, উত্তর দিল সে। বৃদ্ধ ঘুরে বসলেন, দুচোখে যেন প্রাণ ফিরে এল, কালকুটা - তুমি কালকুটা থেকে এসেছ, ভাঙা ইংরেজীতে বিড়বিড় করলেন তিনি। ধীরে ধীরে উঠে, পাশে এসে বসলেন তমালের, ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের জন্য। তমাল অবাক হুলেও হাত মেলাল। মনে মনে কিছু বাঁধা গতের প্রশ্নর জন্য সে প্রস্তুত হল- যেমনে সিস্টার টেরিজার শহর ও দারিদ্র নিয়ে আন্তুর্জাতিক সনাতন জিজ্ঞাসা। কিন্তু তাকে আবারো অবাক করে বৃদ্ধ বললেন, খিদিরপুর চেনো? তমাল সত্যি অপ্রস্তুত, সব ছেড়ে খিদিরপুর কেন? হ্যাঁ গেছি দুয়েকবার বললো তমাল। আমি ১২ বছর খিদিরপুরে ছিলাম, তমালকে বেজায় চমকে দিয়ে প্রায় স্পষ্ট বাংলাতে খানিকটা স্বগতোক্তি  বৃদ্ধর। বাংলা শুনে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি তমাল, আলাপ জমানোর জন্য একগাদা প্রশ্ন ভিড় করে এল মনে - কে এই বৃদ্ধ, কেন কলকাতাতে ছিলেন, কি করতেন আর এখনই বা কি করেন, জানার অদম্য কৌতূহল, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে পারার আগেই, বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে, ধীর পায়ে বৃদ্ধ রওনা দিলেন নদীর পাড় ধরে, শহরের দিকে। বাকি সময়টা তমাল অন্যমনস্ক হয়েই রইল, এক অজানা রহস্যের বাক্স তার সামনে শুধু তালার চাবিটা নেই।
পরের দিন, কাজ থাকা সত্ত্বেও কি এক আকর্ষণ টেনে আনল তমালকে সেই বেঞ্চিতে, দেখা না হওয়ার অনিশ্চয়তার ভয় মুহূর্তে কেটে গেল, বৃদ্ধ আজও সেই কোনটাতেই বসে। তাকে দেখে সামান্য নড করে হাসলেন। কোন কথা বলে চারপাশের নীরবতা ভঙ্গ করলেন না। এরপরে প্রায়ই দেখা  হয় দুজনের, শুধুমাত্র তাঁর নামটুকু জেনেছ তমাল, পাউল হার্ডার, ব্যস। সপ্তাহ পেরিয়ে মাস গড়ায়, বেঞ্চি এখন তমাল ও পাউলের, দুজনেই নিঃশব্দে একে অপরকে সংগ  দেয়, হেমন্তের সোনা ঝরা বিকেলে, রাইনকে সাক্ষী রেখে, এ এক অন্যমাত্রার বন্ধুত্ব।

অনুমানে তমাল বোঝে, পাউলের শারীরিক অবস্থাও ভালো না। আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা এদেশের সামাজিকতা বিরুদ্ধ। সেই একদিন ছাড়া আর বাংলাও বলেননি পাউল। শেষে কার্নিভালের আগের শনিবার, যখন, বেঞ্চি ছেড়ে উঠবে বলে জিনিষ গোছাচ্ছে তমাল, পাউল বললেন গান জানো? টেগোরের গান? রমার গানের গলা খুব ভালো ছিল। হ্যাঁ, না কিছু বলার আগেই, পকেট থেকে একটা মাউথ অর্গান বের করে, তাতে দেশী সুর তুললেন তিনি - 'আমি এসেছি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী' - শ্বাসের জোর নেই, সুর কাটছে, কিন্তু  সেই অভাব পূর্ন হয়েছে তন্ময়তায়। আস্তে আস্তে বিদায় নেয় তমাল, পাউলের বন্ধ দুচোখের কোন বেয়ে গড়ানো জলের ধারা তাঁর বলিরেখা ভরা মুখে নদীর মতই পথ খুঁজে এগিয়ে চলেছে, তাতে বাধা দেওয়া ধৃষ্টতা।

এরপর শীতের আগমনে, নদীর ধারে এসে বসে থাকা ক্রমশ কমে এল তমালের, পরীক্ষার চাপে, পাউল রহস্য আর নিত্যদিন মনেও পরে না। এরই মাঝে যে কদিন রাইনের সেই বেঞ্চিতে সে বসেছে, পাউলের দেখা মেলেনি আর। এখন  একেকসময় মনে হয়, পাউল ছিল তার বাড়ি ফেরার জন্য উন্মুখ মনের কল্পনা, নাহলে, বাংলা কথা, এমনকি রবীন্দ্রসংগীত, আদৌ কি কেউ বিশ্বাস করবে? তাই কাউকে বলেওনি সে এই ঘটনার কথা, এক সোমেনকে ছাড়া। বন্ধুকে লেখা শেষ চিঠিতে এই ঘটনার কথা লিখেছে সে, ব্যস।

ক্রমে মাস ঘুরে যায়, শীতের কামড় আরো তীব্র হয়, নদীর ধারে বসার আর কোন প্রশ্নই ওঠেনা। ফাইনাল ইয়ারের প্রস্তুতির চাপে তমাল ব্যতিব্যস্ত, তবুও নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে গেলেই পাউলের কথা মনে জেগে উঠে মিলিয়ে যায়, তরঙ্গর মত। এদেশের পাট তার চুকে আসছে দ্রুত। তার লেখা থিসিস বই হিসেবে প্রকাশিত হলেই, ফেরার প্লেন ধরবে তমাল, মনটা এখন আরো বেশী ঘরমুখো। এমনি এক দুপুরে লেটারবক্স খুলতে, এক দামি সাদা খামের চিঠি পেল সে, প্রেরক এক আইনজীবীর অফিস। ভয়ে ভয়েই চিঠি খুলে পড়লো সে, সংক্ষিপ্ত চিঠিতে তাকে একবার ঐ ফার্মে দেখা করার আবেদন, আইনজীবীর ক্লায়েন্ট পাউলের বিশেষ অনুরোধ। চিঠি হাতে অবাক হয়ে খানিক ভাবল তমাল, তার ঠিকানা কি করে পেল এই অফিস। মনে পরল তার নাম ও হোস্টেলের নাম একবার সে বলেছিল পাউলকে, অযাচিত ভাবেই। এদেশে তার থেকে ঠিকানা খুঁজে নেওয়া সহজ কাজ। চিঠিতে আগামীকাল দেখা করার অনুরোধ রয়েছে, সাত পাঁচ ভেবে, যাবে বলেই স্থির করল, এখন তার কর্মব্যস্ততাও নেই আর কৌতূহলও হচ্ছে জানার কি কারনে এই আহবান।
পরের দিন যথা সময়ে, নির্দিষ্ট অফিসে হাজির তমাল। অল্প সময় পরেই ডাক পড়ল আইনজীবী হান্স সুমাখারের চেম্বারে। সুন্দর করে সাজানো কক্ষে, এক অতিকায় টেবিলের অপর প্রান্তে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা করলেন হান্স। কফি এল। সাধারণ পরিচয় পর্বের পর, সোজা কাজের কথায় এলেন তিনি। বাঁদিকের একটা তাক থেকে এক ফাইল টেনে নিয়ে তার ভিতর থেকে এক বড় ব্রাউন খাম বের করে ঠেলে দিলেন তমালের দিকে, সাথে চ্ছোট্ট জিজ্ঞাসা, জার্মান জানেন কি? তেমন ভালো না, বলতে বলতে খাম খুললো তমাল। একটা দলিল জার্মানে লেখা ও সাথে হাতে লেখা একটা চিঠি। আর কি আশ্চর্য - চিঠিটা বাংলাতে লেখা, তাকেই লেখা। পাতা উল্টে লেখকের নাম দেখলো তমাল, যা ভেবেছিল তাই, চিঠিটা পাউলের।

ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে ডিপার্চার লাউঞ্জে বসে তমাল। দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে বাড়ি ফিরছে সে। কিন্তু একা নয়। সাথে পাউল। সুদীর্ঘ ৪০ বছর পরে সেও বাড়ি ফিরছে। তমালের হাত ধরে। দূরে আকাশে মুহুর্মুহু প্লেনের ওঠানামার ব্যস্ততা, চারপাশের সোরগোল সব ছাপিয়ে কানে বাজছে যেন পাউলের কথা, যা সে লিখেছিল তার চিঠিতে:

প্রিয় তমাল,
আমার শুভেচ্ছা নিও। তোমার সাথে বহুদিন দেখা হয়নি, আর হবে বলেও মনে হয় না। নাবিকের কাছে আবার মহাসমুদ্রে ভাসার ডাক এসেছে, সামনে মহাযাত্রা। তাই পিছুটান রেখে যাওয়া যাবে না। তমাল তোমাকে আজ আমার বড় দরকার। আমি বাড়ি যাব। ৪০ বছর বাড়ির থেকে দূরে এই প্রবাসে রয়েছি। রাইনের তরঙ্গ রোজ রমার ডাক নিয়ে আসে, নিয়ে আসে ক্রিস্টিনার আলিঙ্গন। আর উপেক্ষা করার সময় নেই। আমায় বাড়ি পৌঁছে দেবে দয়া করে?। একমাত্র তোমার ভিতরেই সেই বাড়ি ফেরার টানটা অনুভব করেছি, জানি তুমি বাড়ি ফিরবেই, আমায় নিয়ে যেও সাথে; দিশাহারা এক নাবিকের এই একমাত্র অন্তিম ইচ্ছা।
ইতি তোমার নদীর ধারের বন্ধু
পাউল

বিস্মিত তমালকে বাকিটা বলেছিলেন পাউলের আইনজীবী। পেশায় ও নেশায় নাবিক পাউল, ১৭ বছর বয়স থেকেই ঘরছাড়া, বন্দরে বন্দরে ভেসে পৃথিবীর পথেই ঘর বেঁধেছিলেন। কিন্তু সেই পাউলও বাধা পড়েন, রমার কাছে, কলকাতার খিদিরপুরের অজ্ঞাতকুলশীলা রমা তাঁর জীবনের নোঙর হয়ে ওঠে, কলকাতা হয়ে ওঠে তার আপন শহর। একমাত্র শিশুকন্যা ক্রিস্টিনা জীবনে নতুন খুশির ঢেউ আনে, কিন্তু আনে বাড়তি দায়িত্বও। উপার্জন বাড়ানোর জন্য আবার লম্বা জাহাজ সফরে যেতে শুরু করেন পাউল। আর তার প্রতিটি ঘরে ফেরা ছিল নদীর সাগরের সাথে একাত্ম হওয়ার আনন্দের মত। নাবিক পাউল তীরের ডোরে বাধা পড়েছিলেন সানন্দে। সেবার যখন হামবুর্গের জন্য রওনা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পাউল, দেশ জুড়ে তখন অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এরপরের বার তোমাদের নিয়ে যাব আমার দেশে, একটা ছোট কোন ব্যবসা শুরু করে এই নাবিক জীবনে পাকাপাকি নোঙর গাড়ব - স্ত্রী কে বললেন তিনি। চিরকালের মতই কোন দাবী, অভিযোগ বা সংশয় ছিল না রমার গলায়। শান্তভাবেই বিদায় জানিয়েছিল, সাবধানে থেক, আমাদের জন্য ভেব না, আমরা তোমার ফেরার অপেক্ষায় থাকব। মার কোল থেকে হাত নেড়ে টা টা করেছিল ছোট্ট ক্রিস্টি। মায়ের মত তারও কোন দাবী ছিল না ছোটবেলাতেও।
কিন্তু রমা কথা রাখেনি, রাখতে পারেনি, হঠাত লাগা দাংগায় হারিয়ে যায় নাবিকের বউ ও মেয়ে, কোন রক্তের নদী পথে ভেসে যায় তারা, কেউ সে হদিশ দিতে পারে না।

ফিরে এসে দুবছর প্রায় অর্ধ উন্মাদের মতই পরিবারকে খুঁজেছেন পাউল, তাঁর চেনা কলকাতার অলিগলিতে। কিন্তু চেনা নদী যেন রাতারাতি অচেনা হয়ে উঠেছে, জনসমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া রমা ও ক্রিস্টির কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ হন নাবিক পাউল। অবশেষে স্থানীয় ফাদারের পরামর্শ মেনে ফেলে যাওয়া দেশে ফিরে আসে পাউল। মন ও প্রাণটা রয়ে যায় হুগলী নদীর তীরেই। রাইনের ধারে রোজ বসে কান পেতে হুগলীর কথা শুনতেন তিনি। বলতেন সব নদীই একদিন এক হয়ে যায়।

পৈতৃক কিছু সম্পত্তি উত্তরাধিকারে পান পাউল। শুরু করেন ছোট এক ভারতীয় গিফট আইটেমের দোকান। তাঁর উইলে সব টাকাটাই দিয়ে গেছেন তমালকে, দুটি শর্ত সাপেক্ষে, দ্বিতীয় শর্ত দেশে ফিরে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের সাহায্য করার কোন কাজে, কিছু অর্থব্যয় করবে তমাল আর প্রথম শর্ত তমাল তাকে দেশে নিয়ে যাবে।

তার অস্থিভস্মর ছোট্ট তামার কৌটোটা ব্যাগের ভিতর হাত দিয়ে আরেকবার স্পর্শ করে তমাল। হুগলীতে রমা ও ক্রিস্টির সাথে কত বছর পরে দেখা হবে রাইনের নাবিক পাউলের। প্লেনে ওঠার ঘোষণা হয়ে গেছে। তমাল আর পাউল পা বাড়াল এরোব্রীজের দিকে।

হুগলীর তীরে বসে সোমেনকে সব বলছিল তমাল। নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছে কখন। পাউল ফিরে এসেছে তার দেশে, মিশে গেছে তার একদা হারিয়ে যাওয়া পরিবারের সাথে। পাউলের আর্থিক অবদানে একটি শিশু ও একটি মহিলা আশ্রম সমৃদ্ধ হয়েছে।

আর তমাল হয়েছে সব বাঁধনশূন্য। পাউলের মতই সেও প্রতিদিন হুগলীর তীরে বসে, রাইনের ডাক শোনে, শোনে সারা বিশ্বের ডাক। সোমেন অবাক হয়ে দেখে ঘরের বাঁধন কাটিয়ে, ঘরকুনো তমাল আজ এক নাবিকেরই মত অনন্ত বিশ্বে ভেসে যাবার ডাকের জন্য নিরন্তর কান পেতে থাকে। পাউলেরই অবদান এই নতুন স্বত্তা, যদিও এই উপহারের কথা তার উইলে আলাদা করে লিখে যাননি নাবিক পাউল।
(সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা মে, ২০১৮ বিকাল ৪:০৬

মাআইপা বলেছেন: ভাল হয়েছে লেখা।

আমি কিন্তু খিদিরপুর চিনি। ১ সপ্তাহ ছিলাম ওখানে। জায়গাটা খুব ভাল লেগেছে।

শুভ কামনা রইল

০৫ ই মে, ২০১৮ ভোর ৪:৫০

উজ্জয়নী বলেছেন: ধন্যবাদ নাম।পালটে লেখা, আসলে এক সত্যি ঘটনা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.