নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাহিত্য প্রিয় মানুষ আমি, বাংলা ভাষা চর্চার চেষ্টা করি। মূলত একজন একনিষ্ঠ পাঠিকা।

উজ্জয়নী

পেশায় গবেষক, নেশায় পাঠক

উজ্জয়নী › বিস্তারিত পোস্টঃ

সংঘাত

০৫ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪৫

ফ্রাইবুর্গের শহরতলীতে তখন শীতের সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে, আমাদের ভাগ করে থাকা তিন কামরার এপার্টমেন্টের বসার ঘরে আমি ও সুজাতাদি - আমার ফ্ল্যাট মেট। ধুঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিয়ে, দিনের ক্লান্তি মুছে ফেলার চেষ্টায় রোজকার মত, টুকটাক গল্প চলছে, চলছে মুখও। সামনের থালায়, আজ্ঞে হ্যাঁ প্লেটে নয়, কাঁসার থালায়, মিনি শিঙাড়া। এই থালা, এই খাবার, ঘরে জ্বেলে দেওয়া ধুপের গন্ধ, সুদূর বিদেশে বসেও স্বদেশের স্পর্শ বুলিয়ে দেয়, বিশেষ করে এরকম শীতের বিকেলে যখন, জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই সাদা চাদরের আস্তরণ ছাড়া আর কোন রঙ চোখে পরে না। তখন সুজলা সুফলা, শস্য শ্যামলা দেশ বড় টানে।
প্রথম তুষারপাত অবশ্য বেশ উপভোগ করে সবাই, ক্রমশ সপ্তাহ গড়ালে, সেটাই উপদ্রব বলে ঠাওর হয়। এইবার যেমন হয়েছে। বিগত কিছু বছরের মধ্যে সেরা শীত এবার। আমাদের ফ্ল্যাটের পিছন দিয়ে চলে গেছে রেল লাইন, বিখ্যাত ব্ল্যাক ফরেস্টের দিকে আর সেই লাইনে বরফ পড়ায় প্রায়ই ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।
আমরা বসে আছি এক অতিথির প্রতীক্ষায়। সুজাতাদির দেশ (বাংলাদেশ) থেকে আগত, নতুন এক ছাত্রী, ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য সদ্য এখানে ডেরা বেঁধেছে। আমি ভারতীয় হলেও বাঙালি, আর বিদেশে বাংলাদেশীরা খুবই আপন হয়ে ওঠেন সহজেই। দুই বাংলা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, দুদেশের সীমানার থেকে দূরে সরে এলে। দেশের থেকে নতুন কেউ এলেই তাদের সাথে আলাপ করা, সাহায্য করা এক অলিখিত নিয়ম। এভাবেই চলে আসছে চিরকাল, আমিও প্রচুর সাহায্য পেয়েছি অনেকের কাছে। আজ আমার, আমাদের সাহায্য করার পালা। রুবিনার আসার কথা সাতটায়, রাতে আমাদের সাথেই খাবে, সবে দুদিন হল জার্মানীর মাটি ছুঁয়েছে সে। কাজেই আমরা বেশ উদগ্রীব ওর প্রথম অভিজ্ঞতার কথা শুনতে আর আমাদের প্রথম পাঠ দেওয়া শুরু করতে। কফির মগ রেখে কিচেনে গেলেন সুজাতাদি, ভাতটা বসিয়েই দি কি বলিস? সাতটা তো বাজে; চিকেন ম্যারিনেট করা আছে, রুবিনা আসলে চাপিয়ে দেব। দশ মিনিট লাগবে, ডাল ও ভাজি তো ফ্রিজেই আছে, বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘর মুখী সুজাতাদি। রান্নাবাড়ার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে নিয়েছেন তিনি। রান্না তার হবি আর খাওয়াতে দারুন ভালোবাসেন, আমি ঠিক উল্টো, তাই দুজনের জমে ভালো। ভাত চাপিয়ে, আবার বসার ঘরে সুজাতাদি। অন্যমনস্ক হয়ে টিভির রিমোটটা টিপে দিয়ে, ঠান্ডা কফির কাপেই চমুক দিলেন। আরে দাঁড়ান কফি বসিয়ে আসি বললাম আমি, পানীয়র দায়িত্ব আমার। না না বোস, এখন আর কফি খেলে রাতে ঘুম হবে না। বসলাম, উশখুশ করছি, আচ্ছা সুজাতাদি আপনি রুবিনাকে অনেকদিন চেনেন? নারে চিনিই না। আমার এক মামাতো বোনের রেফারেন্স। বেচারি কোনদিন ঢাকা শহরেও আসেনি, চট্টগ্রামের শহরতলি থেকে একা একা সোজা ফ্রাইবুর্গ। তাহলে তো নিশ্চয় খুব মনের জোর, স্মার্ট মেয়ে নিশ্চই। এই তো এল বলে, নিজেই দেখবি, বলে চ্যানেল পাল্টালেন সুজাতাদি। দেখতে দেখতে সাতটা থেকে আটটা গড়িয়ে নটা বাজলো, কারুর দেখা নেই। এযাবৎ নির্লিপ্ত সুজাতাদির কপালেও চিন্তার ভাঁজ। কি হল বলত, কাকেই বা ফোন করি! নিজের ছোট ফোনের খাতাটা টেনে নিয়ে নাম্বার খুঁজতে শুরু করলেন, তখনই ডোরবেলটা বেজে উঠলো, সাড়ে নটা বাজে। আমিই উঠে দরজা খুললাম, বাইরে জোর হাওয়া, নিরন্তর বরফ পড়ছে, দুর্জোগ, দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে এক ছিপছিপে যুবতী। পরনে একটা সুতির সালোয়ার কামিজ, পায়ে চটি, শীতে কাঁপছে, কিন্তু মুখে এক আন্তরিক হাসি। একি অবস্থা এস এস, তোমার কোট কোথায়? পরিচয় পর্বের আগেই এত কিছু জিজ্ঞেস করে ফেললাম। নিউমোনিয়া হয়ে যাবে যে। জুতো পরনি কেন? একটা গরম জামাও গায় দাও নি! মাইনাস ছয় চলছে। ঘরের গরমে একটু ধাতস্থ হল রুবিনা, এতগুলি প্রশ্নের উত্তরে এক গাল হেসে একটাই উত্তর দিল - 'নাই' আমি ও সুজাতাদি চরম অবাক। ডিসেম্বরে ফ্রাইবুর্গে আগত কেউ যে শীতের পোশাক আনবে না, তা আমাদের কল্পনার বাইরে। যাই হোক, তখনকার মত আমাদের গরমজামা ইত্যাদি জোর করে পড়ানো হল রুবিনাকে। বেচারি ভারী কুণ্ঠিত উপকারের ধাক্কায়। সেই রাতে আমাদের ফ্ল্যাটেই থেকে গেল সে। পরের দিন তাকে সোজা জুতোর দোকানে নিয়ে গিয়ে উপযুক্ত শীতের বুট ও পরে একটি কোট কিনে দিয়ে, তার হস্টেলে তাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। রুবিনা সারাটাক্ষন লজ্জায় লাল হয়ে রইল। এরপরে আমি আর মাস দুয়েক ছিলাম ফ্রাইবুর্গে, বেশ কয়েকবার আমাদের বাসায় এসেছে রুবিনা, আমরাও তাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছি এই শহরের প্রবাসী বাঙালী সমাজে। ইতিমধ্যেই সহজ ও ধাতস্থ হয়ে উঠেছিল সে, প্রথম বিদেশে পদার্পনের সাংস্কৃতিক ধাক্কা কাটিয়ে দিব্বি মানিয়ে নিচ্ছিল চারপাশের সাথে। এক বিকেলে কাজ থেকে ফেরার পথে দেখি দোকানে কেনাকাটা করছে রুবিনা। আমায় জোর করে টেনে নিয়ে গেল কাছের কফির দোকানে, সে যাত্রায় ঐ শেষবার আড্ডা ওর সাথে।


মাঝে প্রায় দেড় বছর কেটে গেছে, আমি কোবলেন্সে থাকি বর্তমান কাজের সূত্রে। সুজাতাদির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। সামারে আমার বাসায় কয়েকদিন কাটিয়েও গেলেন তিনি। নানা কথায় রুবিনার কথা উঠলো, বেজায় অবাক হলাম যে রুবিনা আর তেমন
যোগাযোগ রাখে না শুনে। যাই হোক ভালো আছে এটুকু জেনে ভালো লাগলো, অবশ্য কোথাও এক অস্বস্তিকর অনুভূতিও হল। তার পরেও কেটে গেছে কিছু মাস। কোলোন শহরে কার্নিভাল এক বড় উৎসব। প্রায় সারা শহর হই হল্লায় মেতে ওঠে, বিয়ারের স্রোত রাইনের মত বয়ে চলে। আমার হট্টগোল পছন্দ নয় কিন্তু সেবার দেশ থেকে মামাতো বোন এসেছে, সে কার্নিভাল না দেখে বাড়িই ফিরবে না, সাফ কথা। অগত্যা, উৎসবের দিন আমরা দুজনে কোলনের জনসমুদ্রে মিশে গেলাম। এক সময়ে মন্দ লাগছিল না, নিজেকে পুরো হারিয়ে ফেলতে না পারলে, এই সব উৎসবের মজা অনুভব করা যায় না। অনেক ঘুরে ক্লান্ত হয়ে দু মগ বিয়ার নিয়ে, আমরা দুজন এক পাবের বাইরে বসলাম। মামাতো বোন টিয়া মগে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসল। আমি বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে চারপাশে চোখ বোলাচ্ছি হঠাৎ নিজের চোখকেই বিশ্বাস হল না। একদল, অর্ধ মদ্যপ ছেলে মেয়ের সাথে রুবিনা, এক বিদেশী ছেলের গায়ে ভর দিয়ে চলেছে, পরনে এদেশীয় মেয়েদের গ্রীষ্মকালীন পোশাক, বেজায় খোলামেলা, হাতে বিয়ারের ক্যান। চলতে চলতেই প্রেমিকের ঠোঁটে কয়েকটা চুম্বন এঁকে দিল, এদেশে অবশ্য নেহাতই সাধারন দৃশ্য; কিন্তু; আমাদের দেশীয় কিন্তুবোধ মাথাচাড়া দেওয়ার আগেই তাকে চাপা দিলাম। রুবিনার জীবনচর্যা নিয়ে মন্তব্য করার আমার কি অধিকার আছে? ক্রমশ আমাদের পাশ দিয়েই চলে গেল দলটি, মনে হল না সে আমায় চিনতেও পেরেছে। কিন্তু আমার ভুল। হঠাৎ দলছুট হয়ে পিছনে দৌড়ে এল রুবিনা, উজ্জয়িনী আপা, কেমন আছেন, উত্তরের অপেক্ষা না করে আমায় জড়িয়ে গালে একটা চুমু দিয়ে, আবার দৌড়ে নিজের দলে ফিরে গেল সে। টিয়া জিজ্ঞাসু - কে গো? আমার চেনা বলে ঐ আলোচনাতে ইতি টানলাম। সেদিন রাতে অনেকক্ষন ঘুম এল না। রুবিনার কি বিচিত্র যাত্রা, সেই ডিসেম্বরের রাত্রে সুতির জামা আর চটি পরা লাজুক রুবিনা আর আজকের চপল, নেশায় আচ্ছন্ন রুবিনা যেন দুই পৃথক সত্ত্বা। মনে হল সভ্যতার সংঘাত তাকে পালটে দিয়েছে।

এর পরে আরো বছর দুয়েক পার হয়েছে। এক বিশেষ প্রোজেক্টের কাজে হাইডেলহাইমের এক মানিসিক চিকিৎসার বিখ্যাত ক্লিনিকের সাথে কাজ করতে শুরু করেছি। রিসার্চের বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বলার এটা ক্ষেত্র না। কিন্তু এই গবেষণার জন্য আমায় দিন দশেক থাকতে হচ্ছে সেই হাসপাতালের কাছে, আমাদের দেশের ভাষায় পাগলা গারদের গেষ্ট হাউসে। বেশ কিছু কেস স্টাডি শুরু করার কথা, সংক্ষিপ্ত বিষয়, অন্যদেশের, অন্য সংস্কৃতির মানুষদের এদেশে বসবাস করার মানসিক ফলাফল। কি জানি হয়ত রুবিনার স্মৃতি আমায় সহজেই প্রোজেক্টটিতে আকর্ষন করেছিল। পড়াশোনা করে বুঝতে - কি এই সংঘাত আর শেষ পর্যন্ত মানাতে না পারলে কি হয় তার পরিণাম? সেদিন সকালে এসিস্টেন্ট গবেষক বেছে বেছে কিছু দক্ষিণ এশিয় কেস আমায় দিয়ে গেল। কেস পড়তে পড়তে বিকেল গড়িয়েছে। কফির তৃষ্ণা বোধ করায় মেশিনের দিকে গেলাম। নিকটস্থ মেশিনটা হাসপাতালের ভিতরের অংশে, যেখানে অত্যন্ত অসুস্থ রোগীরা থাকে, সেইদিকে। এদের অধিকাংশই একাধিকবার সুইসাইডের চেষ্টা করেছে, তাই পৃথক সেল। অনেকেই বেশ হিংস্র, সবাই নয়।
গুন গুন করে বাংলা গান করতে করতে মেশিনের দিকে চললাম। নির্দিষ্ট খুচরো মেশিনে দিতে, কফির গ্লাস বেড়িয়ে আসল, কফি পড়ছে নল বেয়ে, 'আপা' - এক পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পিছনে ফিরলাম। রোগীদের সেলের বন্ধ দরজা কেটে বানানো জানালায় কে দাঁড়িয়ে? রুবিনা! কফি রইল পড়ে, আমি দ্রুত সেই জানালার কাছে উপস্থিত। রুবিনা তুমি এখানে? কবে থেকে? কেমন আছে শরীর, অনেক কষ্টে এই কটা কথা জিজ্ঞেস করলাম, বিস্ময়ে তখন আচ্ছন্ন আমি। আপা আমায় একটা বিয়ার কিনে দ্যান। প্লীজ, রুবিনার চোখে কোন ভাষা নেই, নেই কোন পূর্ব পরিচয়ের স্মৃতি। রুবিনা আমায় চেনেনা। প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ বলে হঠাৎ চিৎকার জুড়ে দেয় সে। পাশের ঘর থেকে দুজন নার্স ছুটে আসে, একজন ওকে সামলায়, অন্যজন কড়া গলায় আমায় বলে, এখানে কি করছেন, বোর্ড দেখেননি এদিকে বাইরের লোকের আসা বারণ। আমি তখনো হতভম্ব, ইংগিতে কফি মেশিনটা দেখাই। প্লীজ চলে যান, প্রফেসার জানলে বিরক্ত হবেন। আমি ধীর পায়ে নিজের কাজের টেবিলের দিকে হাঁটা দিলাম, কফিটা নিয়ে যান; কানে নার্সের ঠাণ্ডা গলা, হাতে ঠান্ডা কফির কাপ আর মনে একগাদা প্রশ্ন নিয়ে ফিরে এলাম নিজের চেয়ারে।
পরদিন সহকারী এলিনাকে বললাম, রুবিনা খাতুন বলে এক বাংলাদেশী পেশেন্ট আছে এখানে, কই তার ফাইল তো এই ফাইলের মধ্যে নেই, কেন? এলিনা ব্যখা করল, প্রফেসার রাইবেল শুধু সেই পেশেন্টদেরি এই রিসার্চে নিয়েছেন, যাদের ইন্টারভিউ নেওয়া যাবে, যাদের কথা রেকর্ড করা যাবে। রুবিনা অতি অসুস্থ, সে তাই এই দল বহির্ভুত।
দুদিন পরে, প্রফেসার রাইবেলের কাছে বিদায় নিতে গেলাম। ক্লিনিকের কেস স্টাডি আমার আপাতত শেষ। উঠে আসার আগে এক বেয়াড়া অনুরোধ করে বসলাম, প্রফেসার প্লীজ রুবিনার কেস ফাইলটা একবার দেখতে দেবেন? আমার সাথে রুবিনার সাক্ষাতের কথা ইতিমধ্যেই শুনেছেন তিনি, তাই খুব অবাক হলেন না, শুধু জিজ্ঞেস করলেন - চেনেন নাকি? সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম। তাহলে তো আপনার দেখা অবশ্যই উচিত। এই দেড় বছরে তো রুবিনার চেনা কেউ আসেনি। সেক্রেটারিকে ফাইল আনতে বলে, জানতে চাইলেন কি ভাবে চিনি? সব বললাম। তিনি দুঃখিত ভঙ্গীতে ঘাড় নেড়ে বললেন সভ্যতার সংঘাত!
ফাইল হাতে গেষ্টহাউসে ফিরলাম। আজ রাতেই পড়ে কাল ফেরত দিয়ে যাব কথা দিয়েছি। পাতা উলটে গেলাম শুরুর ঘটনা, মানে রুবিনার সংরক্ষণশীল পরিবারের কথা তো জানতামই, তার এদেশে শুরুর দিকের দ্বিধা দ্বন্দও জানা। বাকিটা জানলাম। বাড়ি থেকে নিত্য বিয়ের তাগিদ অগ্রাহ্য করে পড়াশোনা চালাচ্ছিল রুবিনা। শাস্তিস্বরূপ বাড়ির অর্থ সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। রুবিনাও বাড়ির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এদেশে দিন চালাতে শুরু করে স্টুডেন্ট জব, মানে কম পয়সায় ঘন্টা ভিত্তিক কায়িক শ্রমের কাজ, কখনো কোন রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে বাসন মাজা বা কারুর বাড়িঘর ঝাঁটপাটের কাজ। এই সময় আমেরিকার ছেলে পলের সাথে ওর আলাপ, সহপাঠী। এই পলকেই আমি কোলনে দেখেছিলাম। পল ও তার বন্ধুদের মধ্যে ভেসে যায়  রুবিনা। এদেশের বাঙালীদের সাথেও আর
যোগাযোগ থাকে না। জীবনের প্রথম প্রেমে দেহ ও মন সম্পূর্ণ সঁপে দেয় সে, প্রেমিকের কাছে। দিন কাটছিল ভালোই, কিন্তু এক সন্দেহ ক্রমে দানা বাঁধে রুবিনার মনে, পল তাকে বিয়ে করবে তো? বাঙালিদের কাছে প্রেমের সেটাই তো স্বাভাবিক পরিণতি। একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলে, কবে বিয়ে করছি আমরা? পল অবাক? বিয়ে! কেন? রুবিনা মুহূর্তে উন্মাদ, আমার সব কিছু ভোগ করে এখন বলছ কেন বিয়ে? পল বুঝতে পারেনা রুবিনাকে। তারা দুবছর লিভ ইন রিলেশানে আছে, যেমন বেশীর ভাগ তরুণ তরুণী থাকে এদেশে, হঠাৎই বিয়ের কথা কেন আসছে, কেনই বা দোষারোপ? সে তো ঠকায়নি রুবিনাকে একদিনের জন্যও। সেদিনের পর সংসারে আর শান্তি ফেরেনি, রুবিনার জেদ, অভিমান, দোষারোপে বিরক্ত পল, একদিন সম্পর্কে ইতি টেনে, বাসা থেকে বিদায় নিয়েছিল। রুবিনা দুদিন ঘর থেকে বেরোয় নি। প্রতিবেশীদের তাগিদে সে চেষ্টা করে আবার ক্লাসে যেতে, স্বাভাবিক হতে, আশে পাশের বন্ধুরা খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়। এরপরে এক রবিবার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ যখন ফাঁকা, কখন যে চুপিসারে, ক্যাম্পাসের সব থেকে উঁচু বিল্ডিংএ উঠে, চারতালার উপর থেকে ঝাঁপ দিয়েছে সে, আগে কেউ টের পায়নি। ভাগ্য ভালো এক বড় গাছে আটকে গিয়ে পুরো মাটিতে পরেনি রুবিনা। তারপরে এদেশের নিয়ম মেনে তার মানসিক চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু ফল হয় না। আরো দুবার আত্মহত্যার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে সে, পরিণতিতে এই ক্লিনিকে একরকম বন্দী দশায় জীবন কাটছে তার। শারীরিক ও মানসিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। বাংলা ছাড়া কোন ভাষায় কথাই বলে না সে। তার জন্য সরকারি অনুবাদক নির্দিষ্ট আছে। তার বাড়ির লোকেরা তার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে, পরিবারের কলঙ্ক রুবিনাকে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না, তাদের তো সমাজে বাস করতে হবে!

কেস ফাইল বন্ধ করে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। সত্যি, কি এই সভ্যতার সংকট? যা এক দেশের মানুষের কাছে দৈনন্দিনতা তাই আরেক দেশের মানুষকে সম্পূর্ণ দিগভ্রান্ত করে কি করে?

পরের দিন ব্যাগ হাতে চলে আসার সময় দেখলাম, সুন্দর রোদ উঠেছে বলে, অতি অসুস্থদেরও বাইরে বাগানে উপযুক্ত তত্ত্বাবধানে বসতে দেওয়া হয়েছে, একটা বেঞ্চিতে একা রুবিনা, একটু দূরে সেদিনের নার্স, আমায় দেখে হাসল। একটু ভরসা পেয়ে তাকে বললাম, রুবিনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? জাস্ট এক মিনিট, একটু ইতস্তত করে, শেষে সম্মতি দিল। রুবিনার সামনে আমি, কলকাতার আমি, বাঙালি আমি, প্রায় একইরকম সভ্যতার সংঘাতে লড়ে যাওয়া আমি, ডাকলাম, রুবিনা, সে তাকাল আমার দিকে, ভাষাশূন্য দুই চোখ। বাড়ি যাবে, দেশের বাড়ি? আমি নিয়ে যাব। দ্যাশ? জিজ্ঞাসু রুবিনা, আর কোন কথা না বলে শূন্য দৃষ্টিতে আমাকে দেখতেই থাকলো। আমি আস্তে আস্তে সরে এলাম, মনে একটা প্রশ্ন কোথায় আমাদের 'দ্যাশ'? তিনজন রুবিনা যেন করছে একই প্রশ্ন - প্রথম দেখা শীতে কাঁপা রুবিনা, কার্নিভালের রুবিনা আর আজকের রুবিনা, কে দেবে উত্তর।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ১১:২৩

মোঃ ফখরুল ইসলাম ফখরুল বলেছেন: সুন্দর হয়েছে

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.