নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাহিত্য প্রিয় মানুষ আমি, বাংলা ভাষা চর্চার চেষ্টা করি। মূলত একজন একনিষ্ঠ পাঠিকা।

উজ্জয়নী

পেশায় গবেষক, নেশায় পাঠক

উজ্জয়নী › বিস্তারিত পোস্টঃ

পরিচয়

০৬ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৬

তোকে মারধোর করেছে? না; গালিগালাজ? না; অন্য কোন মহিলার সাথে এফেয়ার? না সেসব কিছু নয়। তাহলে আর কি চাস তুই তন্দ্রার মায়ের ব্যকুল জিজ্ঞাসা। সে তুমি বুঝবে না মা, তুমি কেন কেউই বুঝবে না।
ও, শুধু তুমিই সব বোঝো, মস্ত বিদ্বান, আর কেউ বুঝবে না, শুধু উনি বুঝবেন, আর কারুর কথার মূল্য নেই, ওনার সিদ্ধান্তই শুধু ঠিক। বিদেশের ডিগ্রীরএত গরম ভালো না তরু, মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছ এ দেশে, দশ বার ভেবে পা ফেলতে হয়, এ তোমার বিলেত নয়। গলায় উষ্মা স্পষ্ট শেফালি দেবীর। এই অবুঝ মেয়েকে নিয়ে এমুহূর্তে মহাবিপদে পড়েছেন তিনি।

একটু আগে সন্ধ্যেবেলা ঠাকুরের প্রদীপ জ্বালিয়ে সবে চা বসাতে যাবেন, দরজার বেল বেজে উঠলো। এই অসময়ে আবার কে এল? কালুর মা তো তিন দিনের ছুটি নিয়েছে, তাহলে এখন আবার কে? খানিকটা বিরক্ত মুখেই আই হোলে চোখ রাখলেন শেফালি দেবী। আর মুহূর্তেই বিরক্তি মুছে গিয়ে মুখভরা হাসি। তন্দ্রা এসেছে, স্বপ্ন নয়তো। দরজা খুলে মেয়েকে আলিঙ্গন করে নিশ্চিত হলেন, না সত্যিই তন্দ্রা। টানা দুবছর পরে, না বলে কয়ে কলকাতায় চলে এসে এভাবে সারপ্রাইজ দেবে তন্দ্রা সেটা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। ওরা কোথায় রে, প্রবীর, তিস্তা? নীচে? না মা, আমি একাই এসেছি। বলতে বলতে ট্রলি ব্যাগটা ঘরে টেনে নেয় সে। ও! অফিসের কাজ? না, সব পাট চুকিয়ে চলে এলাম মা। আমি বাড়ি ফিরে এসেছি চিরকালের মত।

কি বলছিস এসব তন্দ্রা? শরীর ঠিক আছে তো, জল খাবি? আগে বোস তো। খালি সোফার দিকে মেয়েকে টেনে নিয়ে গেলেন শেফালি দেবী। রান্নাঘরে গিয়ে দুকাপ চা বানিয়ে আনলেন, সাথে জলের বোতল। গুছিয়ে বোস তরু, শান্তভাবে বল, কি হয়েছে? বললাম তো মা, কিছু হয় নি। মানে এমন কিছু হয়নি যা তোমার কাছে কনভিনসিং মনে হবে। আমি কি নিজের বাড়িতে এমনিই আসতে পারি না? সেই ঢোকার পর থেকে জবাব তলব করছ! গলা ভারী হল তন্দ্রার। চশমা মোছার আড়ালে, চোখের বাষ্প গোপন করল সে। ধরা গলায় বলল মা আমি খুব ক্লান্ত। আজ স্নান করে শুয়ে পরি, বাকি কথা কাল হবে এখন, তাড়া কি, আমি তো আর চলে যাচ্ছি না। আশংকায় কাঠ শেফালি দেবী, ঘুম টুম পরে হবে তোমার, আগে কি হয়েছে বল। আমাদের ঘুম ঘুচিয়ে দিয়ে, নিজে আরাম করে ঘুমাবি? কি লজ্জা!
তন্দ্রা আর কথা বলে না। সোফায় শরীর ও মনের অবসাদ কে বিছিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। শেফালি দেবী ছাড়বার পাত্রী নন, তরুর বাবা অসীম বাবু এসে পরার আগেই, জেনে নিতে হবে পুরো ব্যপারটা, তারপরে সেইমত কোন গ্রহণযোগ্য গল্প বানাতে হবে তরুর বাবার জন্য। না হলে রগচটা মানুষটা যে এসে কি তাণ্ডব করবে, তার ঠিক নেই। কাজেই তার উপরোক্ত প্রশ্ন নানা পথে এঁকেবেঁকে তন্দ্রাকে বিদ্ধ করেই চলে, বিরামহীন, উত্তরে শুধুই 'না' বলছে মেয়ে, কি করবেন শেফালি দেবী ভেবে পান না। মরিয়া হয়ে বললেন তোকে তিস্তার দিব্যি তরু, কি হয়েছে খুলে বল, এভাবে দগ্ধাস না।

আস্তে আস্তে উঠে বসে তন্দ্রা, দুই চোখের দৃষ্টি মায়ের মুখের উপর নিবদ্ধ, ঠোঁট বেঁকে যায় এক অদ্ভুত হাসিতে। কেটে কেটে উচ্চারণ করে, তোমার কিসের এত ভয় মা? কিসের লজ্জা? কিসেরই বা তাড়া? বাবা এসে পরবে? প্রতিবেশীরা প্রশ্ন করবে? আত্মীয়রা গসিপের খোরাক পাবে? আর কি ভয় বল? আমি ভালো চাকরী করি, তোমাদের আর্থিক বোঝা বাড়াবো না কিন্তু এখন দেখছি তোমাদের সামাজিকতায় আমি সত্যি বড় বোঝা হয়ে উঠবো। তোমরা সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না, মেয়ে স্বামী, কন্যা কে ছেড়ে বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে, এর থেকে তার মৃত্যুর খবর এলেও তো ভালো ছিল তাই না মা? হিস হিস করে ওঠে তন্দ্রার গলা।

নির্ভেজাল সত্যর সামনে শেফালি দেবী এবার নীরব। কয়েক মুহূর্ত অখণ্ড নিরবতা ঘরে। টেবিলের চায়ে ঠাণ্ডা সর পরেছে। পাশের ফ্ল্যটের থেকে 'দিদি নাম্বার ওয়ান' সিরিয়ালের আওয়াজ ভেসে আসছে। মাথার উপর ফ্যান ঘোরার মৃদু শব্দ, বাইরে লিফটের ওঠানামার আওয়াজ। মা ও মেয়ে একে অপরকে দেখছে খুঁটিয়ে, দুই অচেনা নারীর মত তারা, কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। নৈশব্দ ভঙ্গ করলেন শেফালি দেবীই - দ্যাখ তরু তুই যাই বলিস...ব্যস মা, ব্যস। আমি আর কিছুই বলছি না, চিন্তা কর না, এখনি বিদায় নেব; বাবা আসার আগেই। একটা কথা শুধু বলি; এক মেয়ের জননী বলে, সারা জীবন তো মার খেয়েই কাটালে, ছোটবেলা থেকেই দেখছি। আমি আজ স্বাবলম্বী, কোন ছেলের থেকে কম না, অন্তত তোমার মেয়ের ব্যক্তিজীবনও সম্মানের হোক এই স্বপ্নও কি কোন দিন দেখ নি?
ধীরে ধীরে উঠে, দরজার দিকে এগুলো তন্দ্রা। শেফালি দেবীর দুচোখের জলের ধারায় আঁচল ভিজে উঠেছে, কিন্তু কে জেন তার কন্ঠরোধ করে রেখেছে, একটা কথাও আর বলতে পারছেন না, পারছেন না বলতে তন্দ্রা আমার কোন প্রশ্ন নেই, তুই বস, নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবি? দরজার হাতলে হাত রাখে তন্দ্রা, নব ঘোরায় ধীরে, ভিতরে একগুঁয়ে এক বাচ্চা মেয়ে বলছে আরেকটু দাঁড়াও না, মা কি না ডেকে পারে? বাড়ি ফিরে যা তরু, তোর নিজের বাড়ি, সন্তান, সংসার ছেড়ে এভাবে ঝোঁকের মাথায় কেউ আসে? আমি মা হয়ে তো তোর খারাপ চাইতে পারিনা তরু। পিছন থেকে শেফালি দেবীর গলা ভেসে আসে।

দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে তন্দ্রা, লিফটের দিকে এগোতে এগোতে একবার পিছন ফিরে তাকায়। না দরজায় মা দাঁড়িয়ে নেই। দরজা বন্ধ। এই প্রথম কান্নার ঢেউ উথলে ওঠে তন্দ্রার ভিতরে। লিফটের বোতাম না টিপে, সেখানে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদে তন্দ্রা, সাহসিনী, শিক্ষিতা, চাকুরীরতা তন্দ্রা, জীবনে এত অবহেলিত, অসহায় কোনদিন বোধ করে নি। দশ মিনিট পরে এপার্টমেন্টের সামনে থেকে একটা ওলা ট্যাক্সি ধরে সে, এয়ারপোর্ট চলুন এরাইভাল হলে, ড্রাইভারকে নির্দেশ দেয়; তারপরে পিছনের সীটে চোখ বন্ধ তন্দ্রার, এয়ারপোর্ট পর্যন্ত।
আটটার দিল্লীর ফ্লাইট যথা সময়ে নেমেছে, এরাইভাল হলের বাইরে দাঁড়িয়ে তন্দ্রা, দূর থেকে প্রবীর আর তিস্তাকে দেখা যাচ্ছে, ট্রলি ঠেলে বেড়িয়ে আসছে। এক অদ্ভুত লজ্জায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে তন্দ্রা। সে যে শুধু একটা বাজি হেরেছে তাই নয়, কোথাও জেন জীবন যুদ্ধেই তার বড়সড় হার হয়েছে।

গত সপ্তাহে তিস্তার ইস্কুলে ছুটি পড়েছে, এবার জামাইষষ্ঠী কলকাতায় কাটানোর প্ল্যান করছিল তন্দ্রা ও প্রবীর। ঠাট্টা করে প্রবীর বলে, আমি ছাড়া তোমার আর কি গুরুত্ব এসমাজে, বউষষ্ঠী হয় কোনদিন শুনেছ, বলেই বেদম হাসি। হঠাৎ রাগ হয়ে গেছিল তন্দ্রার, বাজি ধরে বলছি, আমার বাড়ি সেরকম নয়। একবস্ত্রে ফিরে গেলেও আমার মা বাবা আমায় একটা কথাও শোনাবে না, আমার অনাদর করবে না, আমি তাদের মেয়ে, এটাই সব থেকে বড় পরিচয়, আমার সূত্রেই তো তুমি আত্মীয়। উফ তরু তোমার এখনো বাস্তব জ্ঞান হল না, ঠাট্টার সুর প্রবীরের। তাহলে পরীক্ষা প্রার্থনীয় জেদী জবাব তন্দ্রার। বাজি ধরলে হারবে তরু, এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হাল্কা গলায় বলে প্রবীর। রাখো তোমার পুরুষতন্ত্র, সে যুগ নেই, আর আমাদের বাড়িতে তো কোনভাবেই না, দ্বিধাহীন তরু। তাহলে ধর বাজি, যে জিতবে, সে পরের বার বেড়ানোর সব ব্যবস্থা করবে, প্রবীরের অফার, ঠিক হ্যায়, রাজী, তন্দ্রা মেনে নেয় চ্যালেঞ্জ।
সেই প্ল্যান মাফিক আগের ফ্লাইটে এসে বাড়িতে একটু অভিনয় শুরু করেছিল সে। কিন্তু তার ফলাফলটা যে এমনভাবে তাকে ভিতর থেকে থেঁতলে দেবে দুঃস্বপ্নতেও তা ভাবেনি তন্দ্রা।

প্রবীর হাত নাড়ছে, তিস্তা ডাকছে - মাম্মা মাম্মা, কি জবাব দেবে তন্দ্রা, কি মুখে ওদের সামনে দাঁড়াবে। ভিড় ঠেলে শেষে তন্দ্রার পাশে এসে দাঁড়ায় তার পরিবার, পরিচয়। তার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে প্রবীর বলে, তোমার মা ফোন করেছিলেন তরু,খুব দুশ্চিন্তা করছিলেন, আমি ওনাকে শান্ত করেছি। কি যে ছেলেমানুষি কর। চল।
না প্রবীর ও বাড়িতে আমি যাব না। সামান্য হাসল প্রবীর,এত মাথাগরম হলে চলে। সবাই ঠিক তোমার মতন করে কারেক্ট হবে, সেটা ভাবাটাই তোমার ভুল তরু। অবজেক্টিভলি দেখ, হয়ত এত খারাপ লাগবে না। প্রবীরের অফিসের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, সামনের সীট তিস্তার দখলে। পিছনের সীটে তন্দ্রার হাতটা নিজের হাতে নিল প্রবীর। আমায় ক্ষমা কর তরু, আমিই এসবের মূল। মোটেও না, কান্না চাপা গলা তন্দ্রার, ঢাকা পরে থাকলেই তো সত্যিটা পালটে যায় না। থ্যাঙ্কস প্রবীর, আমায় তুমি নতুন করে নিজের দুনিয়াটা চিনতে সাহায্য করেছ, খুব বড় উপকার করেছ। মুখ ঘুরিয়ে কান্না চাপে সে। ছাড় এসব তরু, গাড়িতেই একটু ঘুমিয়ে নাও, কাল ভোরে মন্দারমনির সমুদ্র সৈকতে সূর্যোদয় দেখে তবে হোটেলে ঢুকব আমরা। বাইরের থেকে চোখ ফেরায় তন্দ্রা, স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার অঝোরে কেঁদে ফেলে সে। তার মাথায় হাত রাখে প্রবীর, যে বাড়ি তোমার না, সেখানে আমার স্থান কোথায় বল? যুগ পাল্টাচ্ছে তরু, আমাদের সেই পাল্টানোর পালে হাওয়া ভরে দিতে হবে, না হলে তিস্তাকে কোন পৃথিবীতে রেখে যাব আমরা? সামনের সীটে তিস্তার চোখে তখন নেমে এসেছে গভীর, নিশ্চিন্ত ঘুম। সে জানে তারা যাচ্ছে সমুদ্র দেখতে। মা ও বাবার সাথে।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:২৮

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন: আবেগময়। সুন্দর।

০৯ ই মে, ২০১৮ রাত ১১:৫৯

উজ্জয়নী বলেছেন: ধন্যবাদ

২| ০৬ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৬

আবু আফিয়া বলেছেন: ভাল লাগল, ধন্যবাদ

১০ ই মে, ২০১৮ রাত ১২:০০

উজ্জয়নী বলেছেন: ধন্যবাদ

৩| ০৭ ই মে, ২০১৮ রাত ১২:০০

মাআইপা বলেছেন: প্রথম পাতায় অভিনন্দন
গল্পটা ভাল হয়েছে।
“এভাবে দগ্ধাস না।” ৩ শব্দের কম্বিনেশন খুব ভাল লেগেছে।

শুভ কামনা রইল

০৯ ই মে, ২০১৮ রাত ১১:৫৯

উজ্জয়নী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ

৪| ০৭ ই মে, ২০১৮ সকাল ১০:৩১

রাজীব নুর বলেছেন: লেখাটা অতি মনোযোগ সহ পড়লাম।

১০ ই মে, ২০১৮ রাত ১২:০০

উজ্জয়নী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.