নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চন্দ্রবিনদু

চন্দ্রবিনদু › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধর্ষিতা

০৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১২:৩৩

মে মাসের বৃষ্টিভেজা কোন এক রাত

ছিল। পাশের বাড়ির তুলির মায়ের কাছ

থেকে দু’কোচ চাল ধার

করে এনে রান্নায় চড়িয়েছিল রঞ্জনা।

বৃদ্ধা মা চৌকিতে শুয়ে বাতের ব্যাথায়

কাতরাচ্ছিলেন। তিন বছরের পুত্র নিলয়

ক্ষুধায় কাতর

হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

পাঁচ বছরের অরিন্দম তখনো কাঁদছিল।

এমতাবস্থায় ঘটনাটা ঘটল। রঞ্জনা স্পষ্ট

শুনতে পেলেন বকরের কন্ঠ। পাশের বাড়ির

তুলির ওপর ওপর নজর রাখত এই বকর। একবার

পুকুরপাড়ের বাঁশবনে একা পেয়ে নষ্টামির

সুযোগও নিয়েছিল, সফল হয়নি। সেবার

সবাই চুপ থাকলেও হরিপদ খুব

হম্বিতম্বি করেছিল। মুসলিমের

ব্যাটা বলে যা ইচ্ছা তাই করবে নাকি?

মারতে উদ্যত হয়েছিল। ঠেকিয়েছিলেন

জ্যাঠা মশাই। বলেছিলেন, “জোয়ান বয়স,

প্রথম ভুল ধরতে নেই।“

সেই বকরের কন্ঠ। বাড়ির দরজায় প্রচন্ড

জোরে আঘাত করছে। “হরিপদর বইন

বাড়ি আছ নি?”। একটা অশুভ আতঙ্ক

রঞ্জনাকে ঘিরে ধরে।

দরজাটা ভেঙ্গে যাবে মনে হচ্ছে।

খুলে দেয়াই ভাল। দরজা ভাঙলে বাড়ির

পর্দা নাই। পুরুষ মানুষও নাই

যে দরজা বানিয়ে দিবে। তাছাড়া কিই

বা এমন করবে বকর? ওর দৌড় জানা আছে।

ঘরের কোনে রসুইয়ের

বটিতে কুটতে থাকা শাকটা ফেলে মাথ

কাপঢ় দিয়ে দরজা খোলে রঞ্জনা।

সাথে সাথে হুড়মুড়

করে ঘরে ঢোকে গোটা সাতেক লোক।

দুজন চেনা। এই এলাকারই, বাকি পাঁচজন

অচেনা। জলপাই রঙের চক্রাবক্রা কাপড়

পরা, পায়ে বুট, হাতে রাইফেল। প্রচন্ড

বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। রঞ্জনার

হাঁটুদুটো হঠাৎ কেঁপে ওঠে, বল পায় না।

সবকিছু অন্ধকার হয়ে যেতে থাকে।

**************************************************

“করেন স্যার, খায়েশ করে করেন।

শালি মালাউনের মালাউন। হিন্দু

কি আওলাদ। রেন্ডি,

মুক্তি কি বিবি হ্যায়। সাব শেতান সাফ

কার দি জিয়ে স্যার।“

হিসহিসিয়ে বলে বকর। আসলেই কি বকর?

নাকি অন্য কেউ?

জানতে ইচ্ছা করে না রঞ্জনার। প্রথমে খুব

চেষ্টা করেছে রঞ্জনা। কাঁটা মুরগীর মত

হাত-পা ছোড়াছুড়ি করেছে। তখন দু’জন

হাত চেপে ধরে বিছানার সাথে, অন্য

দু’জন পা দুইটা গোঁড়ালির

কাছে দড়ি দিয়ে বাঁধে দেয় চৌকির

পায়ার সাথে। পশুর মত

শক্তিওয়ালা লোমশ দুইটা হাত দানবের মত

ছিড়ে নেয় বুকের কাপড়। তিন বছরের

নিলয়ের বৃষ্টিভেজা রাতের শান্তির ঘুম

ভাঙতে দেরি হয়। ঘুম

ভেঙ্গে দেখে পাশে নগ্ন মা শুয়ে আছে।

তার উপর শুয়ে আছে গোঁফওয়ালা এক ষাঁড়

আকৃতির লোক।

রঞ্জনার উরুসন্ধিতে এখন কোন

অনুভূতি নেই। তৃতীয়জন চলছে। চিৎকার

করতে করতে গলার স্বর ভেঙ্গে গেছে।

আওয়াজ বের হয় না।

চোখটা ভেজা ভেজা, কিন্তু আর কোন

পানি নেই সেখানে। চোখটা খুব জ্বলছে।

অরিন্দমটা এখনো চিৎকার করে কাঁদছে।

একটা সৈনিক বারবার তার বিশাল

হাতে প্রচন্ড বেগে থাপ্পড় দিচ্ছে আর

উর্দুতে গালি দিচ্ছে। অরিন্দম

থামছে না। রঞ্জনা সব দেখে। কোন

অনুভূতি হচ্ছে না। রঞ্জনা নিলয়ের

দিকে তাকায়। নিলয় কাঁদছে না। একবার

মায়ের দিকে তাকাচ্ছে, একবার

লোকগুলোর দিকে তাকাচ্ছে।

বৃদ্ধা মা শ্লেষ্মাযুক্ত কন্ঠে আর্তনাদ

করে কি যেন একটা বলে হাহাকার করে।

বকর খেঁকিয়ে ওঠে, “চোপ বুড়ি !

শুকরিয়া কর যে তুই বুড়ি হইয়া গেছস। এক

পা নড়বি না, বইয়া বইয়া তোর

রেন্ডি মাইয়ারে পাক হইতে দেখ।“

মা হাহাকার করতেই থাকে, রঞ্জনার

কাছে মায়ের হাহাকার বিরক্তিকর

লাগে। নিজের শরীরটাকে নিজের

লাগে না। মনে হয় নর্দমার কোন কীট।

অথবা লকলকে কোন ড্রেনের সাপের মত

অপবিত্র লাগে নিজেকে। নিজের

শরীরকে অনুভব করতে পারে না সে।

ইচ্ছে হয় না নিজেকে অনুভব করতে।

উলটো হয়ে থাকা মাথা, দরজার ফাঁক

দিয়ে বৃষ্টি পরবর্তী পরিস্কার

আকাশটা দেখা যায়। আকাশে আজ অনেক

তারা, অনেক। ঐ তারাগুলো কি হাজার

মেইল দূরে ভারতের কোন

প্রাঙ্গনে ট্রেনিংরত প্রিয়তমও দেখছে?

দেড় মাস হয়ে গেল। অঞ্জনের

কি মনে পড়ে রঞ্জনাকে?

পঞ্চমজনের সময় হঠাৎ কাছে কোথাও গুলির

আওয়াজ পাওয়া যায়। লোমশ শরীরের

নিচে কেঁপে ওঠে রঞ্জনার শরীর।

অজানা কারনে হঠাৎ জড় শরীরে প্রানের

সঞ্চার হয়, ঠিক কি কারন জানা নেই।

আকাশ কাঁপিয়ে আবার আর্তনাদ

করে ওঠে রঞ্জনা। বকর হন্তদন্ত

হয়ে এসে বলে, “মুক্তি আ গায়া সাব।

জালদি খাতাম কারিয়ে।“ সৈনিক

তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে হন্তদন্ত হয়ে।

প্যান্টের চেইন লাগাতে লাগাতে বুট

দিয়ে কষে দুবার পাড়া দেয় রঞ্জনার

পাজরে। তার রতিতৃপ্তি হয়নি।

রঞ্জনার গলা দিয়ে রক্ত ওঠে।

সে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে বিন্দুমাত্র জোর

নেই, হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হঠাৎ মনে হয় তার

কোন পা নেই। বাইরে প্রচন্ড গুলির

আওয়াজ। জয় বাংলা ধ্বনি শোনা যায়।

কিছুক্ষন পড় রঞ্জনার অসাড়

পায়ে অনুভূতি ফিরে আসে। দরজার

বাইরে যেতেই বৃদ্ধা মা হাত ধরে টান

দেয়। “ মুক্তি সব শ্যাষ। শিগগির পলা।“ টলমল

পায়ে পুকুরপাড়ে জঞ্জালের পিছে আশ্রয়

নেয় রঞ্জনা, বৃদ্ধা মা আর দুই ছেলে।

বাড়িতে কেরোসিন ঢালছে পাক

হানাদার বাহিনী। সবকিছু পুড়ে যাবে,

তারা না খেয়ে মরবে। রঞ্জনার হঠাৎ

মনে পড়ে তার ডায়েরিগুলোর কথা।

রঞ্জনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

থেকে সাহিত্যে মাস্টার্স

ডিগ্রিধারী। চট্টগ্রাম

শহরে থাকতে স্কুলশিক্ষিকা ছিল।

কিঞ্চিত লেখালিখি করে।

কখনো কাউকে পড়ানোর সুযোগ হয়নি।

ঘরে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের অসংখ্য বই। সব

পুড়ে ছাই হবে। বৃদ্ধা মা অবাক

হয়ে দেখেন তার

মেয়ে ছুটে চলেছে জ্বলন্ত বাড়ির দিকে।

নতুন আরো ডজনখানেক পাক হানাদার

লোলুপ চোখে তাকিয়ে রয়েছে রঞ্জনার

দিকে।

*********************************************

*****************

শ্রাবন মাসের সূচনালগ্নের এই

দিনে বৃষ্টির নামমাত্র নাই।

কাঠফাঁটা রোদের মধ্যে জনৈক বৃদ্ধা বড়

ক্লান্ত। আজকে কোন আয় হয়নি।

কাঁধে ঝোলানো ঝোলাটা নিয়ে বস্তা

কাপড়ের

সংমিশ্রনে ঘেরা দোকানটাতে ঢুকেন

রুটি কিনতে। রমজান

মাসে এদেশে খাবার

দোকানগুলোতে পর্দা নামে। বিশেষ

করে চায়ের টংগুলোতে। বৃদ্ধা চায়ের

দোকানে ঢুকে আচলে বাঁধা জমানো টা

দশ টাকা দিয়ে এক টুকরো পাউরুটি আর

একটা কলা কিনেন। ক্ষুধার নিবারন

করতে করতে খেয়াল করেন চায়ের

টংয়ের ছোট টিভিতে খবর দেখাচ্ছে।

বৃদ্ধা দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে খবর

সম্পর্কে। দোকানদার এবাদত মিয়ে বলে,

“গোলাম সাব’রে নব্বই বছরের কারাদন্ড

দিয়া দিল চাচী। হ্যাতের বয়স নব্বই এর

উপ্রে। খোদ আল্লাহ তায়ালার কুদরত

বুজলা নি?

হ্যাতেরে ফাঁসি দিলে দেশে গজব পড়ত।

আহারে ! বুড়া লোকটা আমার বাপের

লাহান। জেলে কেমনে কষ্ট কইরা থাকব !

এদের কি মানবতা বইল্লা কিছু নাই?”

এবাদত মিয়া কেঁদে ওঠে প্রায়।

খবর শেষ হলে চ্যানেল পরিবর্তন

করে এবাদত মিয়া। বিটিভিতে সংসদ

অধিবেশন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য

রাখছেন। “সরকার এ রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ

করছে।“ বৃদ্ধার

কানে বাজতে থাকে বারবার বাক্যটা।

সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে। বঙ্গবন্ধু

কন্যা জাতির

মঞ্চে দাঁড়িয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে।

বৃদ্ধার মাথা ঘুরতে থাকে বের

হয়ে আসেন। হাঁটতে পারেন না রাস্তায়

বসে পড়েন। রাতের বেলা খাবার কিছু

নেই, টাকা নেই। আজ একটাও বই বিক্রয় হয়

নি। একে একে স্বামী সন্তান

হারিয়েছেন সব, আত্মীয়রা লাঞ্চিতার

অপবাদ দিয়ে পর করেছে। কেউ আজ নেই।

বই লিখে, বিক্রি করে নিজের অন্নের

সংকুলান করেন।

বৃদ্ধা রঞ্জনা রোদে পোড়া আকাশের

দিকে তাকান, রাস্তায় কোলাহল নগরীর

ব্যস্ততা দেখেন। সবখানে আজ মানবতার

জয় জয়কার। মানবতা জয়ী। বাংলাদেশের

স্বাধীনতার সবচেয়ে বড়

শত্রুকে “মানবতার খাতিরে” নব্বই বছরের

চক্ষুধোলাই কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।

অচেনা দুই পথচারীর বাক-বিতন্ড

কানে আসে। অজস্র বিতর্ক, নির্বাচন,

নাস্তিকতা, প্রজন্ম, কোটা, ভারত,

পাকিস্তান, আওয়ামী লীগ, বিএনপি,

জামাত। রঞ্জনার মাথায় কিছু ঢুকে না।

হঠাৎ করে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে।

মনে হয় রাস্তাভর্তি লোক সবাই

তারদিকে ছুটে আসছে। চাকুরিজীবি,

রিকশাওয়ালা, ট্র্যাফিক পুলিশ, স্কুলছাত্র

সবাই তাকে ধর্ষন করতে আসছে। চারিদিক

নিকষ আঁধারে ছেয়ে যায়।

নাকে আসে দূর্গন্ধযুক্ত উত্তেজিত

শ্বাসপ্রশাস। গলা চেপে ধরে লাখ লাখ

কালো লোমশ হাত। সবার চোখে লোলুপ

দৃষ্টি। মানবতা অন্তরীক্ষ থেকে করুনার

হাসি হাসে। মানবতার জয়।

রাস্তাভর্তি লোকজন দেখে একজন

থুরথুরে বৃদ্ধা তার সম্ভ্রম ঢাকার

ভঙ্গিতে দুহাতে বক্ষ ঢেকে চিৎকার

করছে। রাস্তাঘাটে এরকম পাগলী হর-

হামেশা দেখা যায়। সবাই আবার আপন

পথে ছুটে চলে।

** চট্টগ্রামের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর

প্রতি সম্মান জানিয়ে লেখা। উপরোক্ত

গল্পের নিরানব্বই ভাগ তার জীবন

কাহিনী। তিনি এখনো জীবিত আছেন।

বই বিক্রি করে অন্নের জোগান করেন।

জানিনা আমরা কোনদিন এই তাদের

ত্যাগের মূল্যায়ন করতে পেরেছি কিনা,

পারব কিনা এ জন্মে।**

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.