নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বুদ্বিজীবি

পাহাড়ের বালক

i am sample

পাহাড়ের বালক › বিস্তারিত পোস্টঃ

মালাক্কার অন্ধকারে (দস্যু কাহিনী)

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১০:০২

সমুদ্রের ঘ্রাণ পাচ্ছি বন্দী বলল। অবাস্তব ব্যাপার অবশ্যই। সমুদ্রের সবচেয়ে কাছের জায়গাটাও এই বদ্ধ সেল থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে। স্যাঁতসেঁতে এই ঘরে শুধু অ্যামোনিয়ার গন্ধটাই পাচ্ছি, যেটা দিয়ে মেঝে পরিষ্কার হয়।





এদের কথা কতটুকু যে বিশ্বাস করা যায় বলা মুশকিল। একবার বলে সে নির্দোষ। একটু পরেই আবার স্বীকার করে, ইচ্ছা করেই অন্যায়টা করেছে। ছেলেমেয়ে নাকি তিনজন। পর মুহূর্তেই আবার সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ালো চারে। পাসপোর্ট বলছে, তার নাম জোহান আরিফিন। কিন্তু মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করছে না। বয়স লেখা ৪৪। মাথার সাদা-কালো চুল দেখলে সেটা আবার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। বাড়ি নাকি বাটামে। সিঙ্গাপুরের ঠিক দক্ষিণেই ইন্দোনেশিয়ার এক দ্বীপে জায়গাটা। এক গার্ড বলল, ওরা নাকি বাটাম থেকেই আসে।





নাম-ঠিকানা নিশ্চিত না হলেও জেল কর্তৃপক্ষ তার পরিচয় ঠিকই জানে। সে হলো লানুন। এর তেমন সঠিক প্রতিশব্দ নেই। এই শব্দটার সাথে দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি আর ইতিহাস জড়িত। সহজ ভাষায় বন্দী একজন জলদস্যু।







নয় সাগরেদসহ মালাক্কা প্রণালী থেকে তাকে ধরে মালয়েশিয়ার মেরিন পুলিশ। ‘নেপলিন ডেলিমা’ ট্যাঙ্কারটি ছিনতাই করেছিল তারা। ট্যাঙ্কারে সাত হাজার টন ডিজেল ছিল যার মূল্য তিন মিলিয়ন ডলার। ২০০৫ সালে যে ক’টি ছিনতাই হয় সাড়ে পাঁচ শ’ মাইল লম্বা এই চ্যানেলে, এটা তার একটা। এই চ্যানেলের এক পাশে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ, অন্য পাশে মালয় উপদ্বীপ। এর ঠিক উত্তরেই সিঙ্গাপুর।

ভারত থেকে শর্টকাটে চীন যেতে এই চিলতে সমুদ্রপথটি বরাবরই ছিল নাবিকদের পছন্দের।



চলতি পথে প্রাচুর্যও আছে মসলা, রাবার, মেহগনি আর টিন। এটা যেন একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ জলরাজ্য চ্যানেলের সাথে মিশেছে শত শত নদী, যেখানে নিরাপদে নোঙর ফেলানো যায়, মাইলের পর মাইল উপকূলরেখা আর ছোট ছোট দ্বীপ, শৈবাল আর ডুবোচরের এক বিশাল সাম্রাজ্য। উভচর জীবনে অভ্যস্ত ছিল এখানকার আদিবাসীরা। পানির ওপর গড়ে তুলেছিল গ্রাম। আর ছিল নৌকা। মাছ ধরা, ব্যবসা কিংবা যুদ্ধ সব কাজেই ছিল বিশেষ ধরনের জলযান। দস্যুবৃত্তিকে পেশা বানিয়ে নিয়েছিল অনেকে। যেসব বিদেশী জলযান তাদের জলসীমা মাড়ানোর সাহস করত, সেগুলো লুট করত তারা। প্রশিক্ষিত সশস্ত্র দস্যুরা নিয়মিত বের হতো হালকা দ্রুতগামী জলযান নিয়ে। জাহাজ লুট করে নদীপথে দ্রুত লুকিয়ে যেত নিরাপদ গ্রামের ভেতর। স্বর্ণ, রতœ, গানপাউডার, আফিম, এমনকি দাস-দাসীদেরও লুট করা হতো। এই দিয়ে তারা গড়ে তুলেছিল শক্তিমান সাম্রাজ্য। সুমাত্রা আর মালয়েশিয়ার উপকূলীয় এলাকার বড় অংশে এদেরই একচ্ছত্র রাজত্ব ছিল এক সময়।





মালাক্কা প্রণালীর জলসীমায় জলদস্যুদের নৃশংসতার বৃত্তান্ত লেখা আছে নাবিকদের খাতায়। উনিশ শতকে যারা লুটেরাদের হাতে পড়েছিলেন, তাদের একজন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন জেমস রস। তার জাহাজে রুপার কয়েনের চালান আছে ভেবে হামলা করেছিল লানুনরা। পরে জেমসের চোখের সামনেই তার শিশুপুত্রকে নোঙরে গেঁথে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এরপর এক এক করে কাটা হয় জেমসের আঙুলগুলো।

আঠার শ’ শতকের শেষ দিকে এ সাম্রাজ্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছিল ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিক আর নৌবাহিনী। কিন্তু লানুনদের কর্মকাণ্ড কখনই বন্ধ হয়নি। একুশ শতকেও তাদের উত্তরসূরিরা দস্যুবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে। তিন ধরনের দল আছে এখানে : এক দল জাহাজ আর নাবিকদের লুট করে, আরেক দল আছে বহুজাতিক সিন্ডিকেটের অংশ পুরো জাহাজ ছিনতাই করে। আরেক দল আছে নাবিকদের বন্দী করে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য।





এই সময়ে লানুনদের টার্গেটের অভাব হয় না। লন্ডনের লয়োডের হিসেবে প্রতি বছর ৭০ হাজার বাণিজ্য জাহাজ এ প্রণালী পাড়ি দিচ্ছে। পৃথিবীর পুরো জলবাণিজ্যের পাঁচ ভাগের এক ভাগ, আর তেলবাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশের পরিবহন হয় এ পথেই। ভূ-প্রকৃতিই মূলত এই প্রণালীর নিরাপত্তার ব্যাপারটিকে মোটামুটি কঠিন করে রেখেছে। জলপথটার অবস্থান মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার মাঝখানে, যে দু’দেশের সম্পর্ক ভালো নয়। তা ছাড়া নিরাপত্তার প্রশ্ন তো আছেই। প্রণালীর উত্তরমুখ প্রায় আড়াই শ’ মাইল চওড়া। সেটাই আবার সরু হয়ে গেছে দক্ষিণে। প্রস্থ দাঁড়িয়েছে ১০ মাইলের মতো। এই পুরো পথজুড়ে আছে শত শত জনমানবহীন ম্যানগ্রোভ দ্বীপ যেগুলো দস্যুদের লুকিয়ে থাকার জন্য আদর্শ জায়গা।





২০০২ সালের পর থেকে মালাক্কা প্রণালী আর আশপাশে ২৫৮টি জলদস্যু হামলার হিসাব আছে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর কাছে। এসব ঘটনায় জিম্মি হয়েছে দুই শ’রও বেশি নাবিক। নিহত হয়েছে আটজন। লয়েডের ইন্স্যুরেন্স বিভাগ এই প্রণালীকে ২০০৫ সালে ‘ওয়ার জোন’ ঘোষণা দিয়েছিল। পরে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর আর ইন্দোনেশিয়া নিজ নিজ জলসীমায় নিরাপত্তা বাড়ালে ২০০৬ সালের আগস্টে আবার রেটিং উঠিয়ে নেয় লয়েড।





জলদস্যু হামলার হিসাব করতে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর প্রধান নোয়েল চুঙ দেখেছেন, অর্ধেক হামলার ঘটনা হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে জাহাজ মালিক নিজেই ক্যাপ্টেনকে রিপোর্ট করতে নিষেধ করেন। নেতিবাচক প্রপাগান্ডা বা তদন্তের কাজে সময়ক্ষেপণ এড়াতেই তারা এটা করছেন। সে জন্যই সঠিক বলা মুশকিল, মালাক্কায় জলদস্যুর সংখ্যা কত।





সমুদ্র শিকারি

আরিফিনের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। সাত বছরের কারাদণ্ড জুটেছে তার কপালে। ইন্দোনেশিয়ান কনস্যুলেটের নিয়োগ করা এক আইনজীবী ছাড়া তাকে দেখতে যাওয়ারও কেউ নেই। গার্ড আমাকে যেখানে নিয়ে গেল, সেখানে বুলেটপ্র“ফ জানালা গলে চোখে পড়ে একটা ইন্টারোগেশন সেল। সেখানে নিয়ে আসা হলো আরিফিনকে। যেমনটা ভেবেছিলাম কল্পনার সাথে মোটেই মেলে না। উচ্চতায় টেনেটুনে পাঁচ ফুট। খালি ঘাড়ের ওপর একটা হার্ট আকৃতির ট্যাট্টু। এক বিদেশী দেখা করতে চায় শুনে কেমন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে তাকে। জলদস্যুর চেয়ে তাকে বরং পকেটমার বললেই মানায়।





জানালার ওপাশে টেলিফোন উঠাল সে, এ পাশে আমার দোভাষী। বললাম, তার মামলা সম্পর্কে পড়েছি আমি। এখন পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে এসেছি তার গল্প শুনতে। কেন সে লানুন হলো, সেটাই জানতে চাই আমি। হাতেগোনা কয়েকজন মিলে কিভাবে নেপলিন ডেলিমার মতো বিশাল জাহাজ ছিনতাই করে তারা।

কোনো কথা সরে না আরিফিনের মুখে। কানে তখনো তার টেলিফোন। চোখের দৃষ্টি দোভাষী আর আমার চেহারায় ঘুরছে। শার্ট পুরো ঘামে ভেজা। শেষমেশ গলা দিয়ে কথা বেরোলো তার ‘আইনজীবী আমার সব টাকা নিয়ে গেছে। কোনো সাবান নেই আমার কাছে। এখানে আসার পর আমি ব্রাশ করতে পারিনি এখনো।’





বললাম, গার্ডের কাছে তার জন্য কিছু সাবান-শ্যাম্পু-টুথব্রাশ রেখে যাবো। চেহারা কিছুটা উজ্জ্বল হলো তার। ধীরে ধীরে শুরু হলো গল্প। অথবা বলা যায়, গল্পের একটা ভার্সন।





পরিকল্পনা হয় বাটামের এক কফি শপে। মালয়েশিয়ার একজন শিপিং কর্মকর্তা কথা বলেন লুকম্যান নামের এক ইন্দোনেশীয় নাবিকের সাথে। শিপিং কর্মকর্তা জানতে চান, ট্যাঙ্কার জাহাজটা ছিনতাই করা যাবে কি না। টিনএজ বয়সে সমুদ্রে নেমেছিল আরিফিন। নৌ র‌্যাঙ্কের হিসেবে সে একজন মেকানিক। লুকম্যানের সাথে বেশ কিছু সফরে কাজও করেছে সে। দু’জনেই বেশ কিছু দিন ধরে কাজ খুঁজছে। এ রকম একটা প্রস্তাব লুফে নিলো লুকম্যান। বলল, জাহাজ লুট করা কোনো ব্যাপার হবে না। কারণ ট্যাঙ্কারের একজন ক্রুও ছিল পরিকল্পনার সাথে।





আরিফিন বলল, একবার তাদের একটা জাহাজ জলদস্যুর কবলে পড়েছিল। জাহাজের সবাইকে খুন করার হুমকি-ধমকি দিয়ে সব অর্থ-কড়ি আর খাবার নিয়ে চম্পট দিয়েছিল দস্যুরা। সে কথা মনে করে মনে মনে হাসছিল সে। এবারে উল্টোটা ঘটবে। ইন্দোনেশীয়দের জন্য কাজটা কঠিন বটে। কিন্তু আমাদের অর্থ দরকার। লুকম্যানকে বলল, সেও আছে দলে। ‘আমাদের কোনো রকমে জাহাজে উঠে সব ক্রুকে বেঁধে ফেলতে হবে। তার পর জাহাজ চালিয়ে দিতে হবে খোলা সাগরের দিকে। থাইল্যান্ড থেকে আসা একটা জাহাজে তেলগুলো তুলে দিয়ে, নেপলিন ডিলেমাকে সাগরে পরিত্যক্ত ফেলে আসতে হবে’। ট্যাঙ্কারের ইঞ্জিনরুমের দায়িত্ব পড়ল আরিফিনের কাঁধে। এ জন্য সে পাবে ১০ হাজার ডলার।





পরিকল্পনার শুরুটা ভালোই হলো। পর্যটকের সাজে বাটাম দ্বীপের আরো দু’জনকে সাথে নিয়ে বের হলো আরিফিন আর লুকম্যান। ছবি তুলছিল তারা এদিক-ওদিক। মালয়েশিয়ার পেনাং বন্দরমুখী একটা ফেরিতে উঠে প্রণালীর দিকে রওনা হলো তারা। সেখানে তাদের সাথে জুটল আরো ছয়জন। সুমাত্রার একেবারে উত্তরের আচেহ প্রদেশের লোক এরা। কেউই তারা নাবিক নয়। পেশিশক্তির জন্যই তাদের দলে নিয়েছিল লুকম্যান।





কাছের সৈকত থেকে ফাইবারগ্লাসের স্পিডবোট চুরি করা হলো। বোটের রঙ ছিল নীল। গ্যাস, পানি আর খাবার দিয়ে ভর্তি করা হলো বোট। সাথে দু’টি সেলফোন, একটা জিপিএস আর পাঁচটি চকচকে ধারালো অস্ত্র। প্রত্যেকের সাথে আরো ছিল একটা করে স্কি-মাস্ক, অতিরিক্ত এক সেট পোশাক, কিছু টাকা আর একটা করে পাসপোর্ট। মধ্যরাতের পর প্রণালীর পথে বেরিয়ে পড়ল তারা। ট্যাঙ্কার থেকে নির্দিষ্ট লোকটি টেক্সট মেসেজে জাহাজের অবস্থান আর গতিবেগের খবর দিচ্ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সে আমাদের জানিয়েছিল কখন পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব নেবে সে।





কয়েক ঘণ্টা পর স্কি-মাস্ক পরা জলদস্যুরা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল নেপলিন ডিলেমার ব্রিজের। সবার হাতে তখন ধারালো অস্ত্র। জাহাজের মেসেজ পাঠানোর সিস্টেম ততক্ষণে অকেজো করা হয়েছে। ১৭ ক্রুর মধ্যে ১৬ জনকে বেঁধে একটা কেবিনে আটকে রাখা হয়েছে। তাদের কয়েক জনের শরীর থেকে তখনো রক্ত ঝরছিল। জলদস্যুরা খোলা সাগরের দিকে জাহাজ চালিয়ে দিলো। পরদিন সন্ধ্যায় তাদের বাটামে ফেরার কথা। তাদের সংস্কৃতিতে এই ফিরে আসার নাম ‘আনন্দ আনন্দ!’ এ সময় তারা মদ আর মেয়ে মানুষ নিয়ে ইচ্ছেমতো আমোদ-ফুর্তি করে।





সমস্যা হলো ১৭ নম্বর ক্রুকে নিয়ে। জাহাজে ওঠার পরপরই এক ক্রুকে লানুন লানুন বলে চিৎকার করতে শুনেছিল আরিফিন। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল ডেকে। দস্যুরা ভীত ক্রুদের বেঁধে ফেলছিল। দু’জনকে নিয়ে লুকম্যান ছিল ব্রিজের ওপর। জাহাজের মাইক্রোফোন অন করে ক্যাপ্টেনকে পেটানো শুরু করে তারা। মাইক্রোফোনে ক্যাপ্টেনের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল ‘আমাকে মেরে ফেলল’। ষোল জন ক্রুর সবাই এক সময় হাল ছেড়ে দিলো। প্রত্যেককে তার নাম জিজ্ঞাসা করা হলো প্রথমে। তার পর হাত-পা আর চোখ বেঁধে ফেলা হলো। আরিফিন বলল, ‘আমাদের কাছে জাহাজের জনশক্তির হিসাব ছিল। আমরা জানতাম যে, একজন ক্রু তখনো নিখোঁজ।’





এর মধ্যে সাগরের দিকে জাহাজ চলতে শুরু করেছে। আরিফিন স্পিডবোট ট্যাঙ্কারের রেলিংয়ে বেঁধে ইঞ্জিনরুম খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। এর প্রায় এক ঘণ্টা পর লুকম্যানের আতঙ্কিত চিৎকার শুনতে পেল সে। লুকিয়ে থাকা ক্রু আমাদের স্পিডবোট নিয়ে পালিয়েছে। নেপলিন ডেলিমার ইঞ্জিন সর্বোচ্চ গতিতে চালিয়ে দিলো আরিফিন। যত দ্রুত সম্ভব আন্তর্জাতিক জলসীমায় বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তেলভর্তি ট্যাঙ্কারের গতি ঘণ্টায় ১২ কিলোমিটারের বেশি উঠল না। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মালয়েশিয়ার মেরিন পুলিশ তাদের পথ বন্ধ করে দিলো। ডেকের ওপরে উঠে আরিফিন তখন অগত্যা একটা সিগারেট ধরালো শুধু। কিছুই আর করার নেই তখন।





একজন গার্ড এসে ইঙ্গিতে জানাল, আমাদের কথা বলার সময় শেষ। দ্রুত আরিফিনকে বললাম, আমি বাটাম যেতে চাই। গার্ড ততক্ষণে আরিফিনের কাঁধে হাত রেখেছে। শেষবারের মতো কানে ফোন চেপে ধরল আরিফিন। প্রথমবারের মতো তার পেশল বাহু নজরে পড়ল আমার। গার্ড তাকে নিয়ে যাওয়ার আগেই দ্রুত ফোনে কিছু একটা বলল সে। আমাকে বুঝিয়ে দিলো দোভাষী হারমোনি হোটেলের পেছনে কফি শপে যেতে হবে। ‘নাবিকদের বলো, জন প্যালেমব্যাঙ তাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। আর টুথব্রাশ দিতে ভুলে যেও না যেন।’





সিনডারেলার কালো বোন

বাটাম দ্বীপের সবচেয়ে বড় শহর নাগোয়ায় যাচ্ছি। ক্যাব ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল- ‘মেয়ে লাগবে?’ ‘মাদক?’ রিয়ার ভিউ দিয়ে আমাকে দেখছিল সে। ‘যা চাও দিতে পারব, কোনো সমস্যা হবে না।’

আলো ঝলমল প্রাসাদসজ্জিত বিত্ত-বৈভবে ঠাসা সিঙ্গাপুর বাটাম থেকে মাত্র সাত মাইল উত্তরে। সিঙ্গাপুরকে যদি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিনডারেলা বলা হয় তাহলে বাটামকে বলতে হবে তার কালো বোন। মালাক্কা প্রণালীর দুই পাশে দুটোর অবস্থান। মাঝখানের জলপথে বিরামহীন জাহাজের বহর চলছে সপ্তাহে হাজারেরও বেশি। বেশির ভাগই ভিড়ছে সিঙ্গাপুর উপকূলে। পৃথিবীর অন্যতম মুক্ত বন্দর, যেখানে অর্থনীতি আর প্রযুক্তি একসাথে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।





আশির দশকে সিঙ্গাপুরের আদলে বাটামকে গড়তে চেষ্টা করে ইন্দোনেশিয়ার সরকার। সুমাত্রার পূর্ব কোণের এই ম্যালেরিয়া-বিপর্যস্ত মৎস্য চারণভূমিকে বিনিয়োগকারীদের জন্য শুল্কমুক্ত করে দেয়া হয়। মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুরের পর্যটকদের টানতে ডেভেলপাররা জঙ্গল কেটে গলফ কোর্স তৈরি করে। নির্মাণ হয় ক্যাসিনো। কল-কারখানা, শপিং মল, অফিস, পার্ক আর অ্যাপার্টমেন্টের পেছনে টাকা ঢালতে থাকে বিনিয়োগকারীরা। কাজের খোঁজে বাটামে ভিড় করতে শুরু করে ইন্দোনেশিয়ার মানুষ। মাঝখান দিয়ে নৌপথের মধ্যস্বত্বভোগী একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয় এই দ্বীপ, যারা জাহাজ কোম্পানিগুলোর জন্য নাবিকদের ভাড়া করত।





বাটামে অভাব একটা জিনিসের, সিঙ্গাপুরের মতো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তত উন্নত নয়। গডফাদার আর দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে দ্বীপটা হয়ে ওঠে গ্যাংস্টার, পাচারকারী, দেহব্যবসায়ী আর জলদস্যুদের স্বর্গভূমি। অবৈধভাবে কাটা কাঠ, ছিনতাই করা তেল, চুরি করা গাড়ি, মাদকদ্রব্য, অস্ত্র আর আধাসিদ্ধ গোশত আসে এখানকার বন্দর দিয়ে। সিঙ্গাপুর থেকে সপ্তাহ শেষে দলে দলে মানুষ আসে এখানকার বেশ্যালয়ে ফুর্তি করতে। এর মধ্যে একটা দল নিজেদের দুই নম্বরী ব্যবসা যথারীতি চালিয়ে যায়। এশিয়ার ক্রাইম সিন্ডিকেটে ভর্তি হতে থাকে জলদস্যুরা। ১৯৯৭ সালে এশিয়ায় মন্দা ভর করলে বাটামের উন্নয়ন থমকে যায়। হাত গুটিয়ে নিতে থাকে বিনিয়োগকারীরা। দ্বীপে তখন শুধু পরিত্যক্ত কিছু আধানির্মিত কাঠামো দাঁড়িয়ে। বাড়তে থাকে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা। বেশির ভাগ মানুষ জড়িয়ে পড়ে অবৈধ ব্যবসায়। যদিও বছর কয়েক হলো বিনিয়োগকারীরা ফিরতে শুরু করেছে বাটামে। তবু এখানকার অধিবাসীদের বড় অংশই এখনো বেপরোয়া জীবনযাপন ছাড়তে পারেনি।





হারমোনি হোটেলের পেছনে কফি শপের কথা জিজ্ঞাসা করলাম ক্যাব ড্রাইভারকে। এটা জোডোহ শহরে, জানাল শহরে। ‘ওখানে খুব খুনোখুনি হয়। তারচেয়ে আমাকে ফোন দিও, আমি তোমার জন্য মেয়ে নিয়ে আসব।’





ভৌতিক পাখিরাজ্য

সকালের দিকে জোডোহের সরু রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে প্রথম যে শব্দ কানে আসে, সেটা হলো পাখির কিচিরমিচির। এমনকি ফেরিঅলা, সেকেন্ডহ্যান্ড কাপড়, সিঙ্গাপুর থেকে পাচার করে আনা যন্ত্রপাতি বিক্রির হাঁকডাকও ছাপিয়ে শোনা যায় পাখির আওয়াজ। জোডোহের অনেক রকম প্রতারণার একটা করা হয় এই পাখিদের সাথে। কিচিরমিচির শব্দ রেকর্ড করে মাইকে বাজানো হয়, যাতে সত্যিকারের পাখিরা প্রজননের জন্য এসে উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলোতে ঘর বাঁধে। পরে এই পাখিগুলো ধরে শত শত ডলারের বিনিময়ে রেস্টুরেন্টগুলোতে বিক্রি করা হয়। সেখানে তৈরি হয় পাখির স্যুপ।





আরেক প্রতারণার জায়গা হলো কফি শপ। জুয়াড়িদের এই আড্ডায় জড়ো হয় নাবিক আর দালালরা, চলে চাপাবাজি, মদপান আর খেলা নিয়ে বাজির আসর। জোহান আরিফিন, বা জন প্যালেমব্যাঙ বন্দী হওয়ার পর বাটামের অনেক কিছুই অবশ্য বদলেছে। ইন্দোনেশিয়ার নতুন পুলিশ প্রধান এখানকার জুয়ার আড্ডাগুলোতে অভিযান চালিয়েছেন। আমি যখন হারমোনি হোটেলের পেছনে কফি শপে গেলাম, দেখি জানালাগুলো কালো রঙে ঢাকা। সামনের দরজায় শেকল ঝুলছে। কিছুটা আশাহতই হলাম। আরিফিনের খোঁজ পেতে হলে আগে জনি বাটামকে খুঁজে বের করতে হবে। এ নামটার কথাই বলেছে আরিফিন।

প্রথমে মনে হলো আমি যেন ভুতুড়ে পাখিদের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছি। যতবার ফোন দিই মোবাইলে, উত্তর নেই। শেষে এক সকালে জনি বাটামের ফোন পেলাম। সে আছে মালাক্কা প্রণালীর দক্ষিণে বাঙ্কা দ্বীপে। তার কিছু ব্যবসা নষ্ট হয়ে সে এখন দেউলিয়া। বাটামে ফিরে আসার জন্য তাকে ৮০ ডলার পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।





কথামতো পরদিন সারি সারি কসাই দোকানের কাছে আবির্ভূত হলো জনি বাটাম। তাজা গোশতের গন্ধ ছুটিয়ে পশুর রক্ত বয়ে যাচ্ছিল নালা দিয়ে। জনি দেখতে সুন্দর, পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। পরনে ধবধবে পরিপাটি সাদা স্পোর্টস শার্ট আর চাপা প্যান্ট। সুন্দর করে আঁচড়ানো ঢেউ খেলানো কালো চুল। কব্জিতে সোনালি রঙের নকল রোলেক্স ঘড়ি ঝুলছে। হাতে জড়ানো ট্যাট্টুটা নকল না হলে বলতে হবে গলফেও সে দক্ষ।





কাছের এক রেস্টুরেন্টে কথা শুরু হলো জনির সাথে। জন প্যালেমব্যাঙকে চিনত সে। সে নাকি নিচু শ্রেণীর নাবিক। নেপলিন ডেলিমার গল্প শুনে হেসে গড়ালো কফি শপের লোকরা। ‘কাঁচা ছেলেমানুষী কাজ’ মন্তব্য করল জনি। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলল সে কার্গো জাহাজের হাল ধরার আগে টাগবোট আর ফেরি চালাতে হয়েছে তাকে। নাবিক আর বন্দরের শ্রমিকদের সাথে বন্ধুত্ব গড়েছে। পাশাপাশি কর ফাঁকি দিয়ে রসুন, সিগারেট, ইলেকট্রনিকস আর মাদকের অবৈধ ব্যবসাও করেছে। আশির দশকে হংকংয়ে গেছে চীনা সন্ত্রাসী সিন্ডিকেটে কাজ করতে। সেখানে সে শিখেছে কিভাবে বড় বড় কার্গো জাহাজ ভ্যানিশ করতে হয়।





জনির হিসাবে ৭৫ শতাংশ লুট হওয়া জাহাজেই ষড়যন্ত্রের সাথে ক্রুরা, এমনকি ক্যাপ্টেন নিজেও জড়িত থাকে। সে জন্যই এগুলো নিয়ে কোনো রিপোর্ট দেয়া হয় না। ঘটনা কিভাবে ঘটে ব্যাখ্যা করল জনি। ‘হয়তো কোনো জাহাজের ক্রুকে আমি জানি। তাকে ফোন করে বলি, সে কি সুখী। যদি সে হ্যাঁ বলে, তাহলে কিছু হয় না। যদি না বলে, তাহলে দু’জনে মিলে পরিকল্পনা হয় জাহাজ লুটের।’ কিন্তু এ কাজ করলে সে তো আর ভবিষ্যতে বৈধভাবে কাজ করতে পারবে না, বললাম আমি। হাসল জনি ‘নাবিকদের অনেক নাম থাকে। অনেকের পাসপোর্ট আছে তিন-চারটি। কোনো সমস্যা নেই।’





দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় জনির বিভিন্ন সঙ্গী-সাথীর সাথে কথা বললাম, যারা বিভিন্ন সময় তার সাথে কাজ করেছে। সবাই জনির কথার সাথে একমত হলো। একজন বলল সে জনিকে বিশ্বাস করে কারণ জনি কখনো মিথ্যা বলে না। সে যা চুক্তি করে, তা সব সময় শোধ করে। বৈধ ব্যবসাতেও অনেক সময় সেটা পাওয়া যায় না।





আমার হোটেলরুমে মালাক্কা প্রণালীর একটা ম্যাপ বিছিয়ে বসেছিলাম। ম্যাপে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে মোটা আঙুল বোলাচ্ছিল জনি ‘এখানে ডুবোচর আছে, এখানে একটা দ্বীপ আছে যেটা ম্যাপে নেই।’ স্রোতের গতিপথও জলের মতো বোঝাচ্ছিল সে। বাটাম আর সিঙ্গাপুরের দিকটাতে আঙুল বুলিয়ে জানাল, এ এলাকাটাতে এখন টহল খুব বেড়েছে। এরপর আঙুল চলে গেল প্রণালীর দক্ষিণে ‘কেনাকাটার জন্য এই জায়গাটা এখন সবচেয়ে ভালো।’





‘কেনাকাটা’ হলো ছোট ধরনের লুটপাট। যেসব জাহাজের নিরাপত্তা দুর্বল, সেসব জাহাজে রাতের অন্ধকারে উঠে পড়ে একদল দস্যু। শক্তিশালী ইঞ্জিনচালিত কাঠের ছোট ছোট নৌকায় এরা চলাফেরা করে। জাহাজে উঠে ক্রুদের কাছ থেকে অর্থ-মালামাল লুট করে পালিয়ে যায়। জনির ভাষায় এরা হলো ‘দুরন্ত কাঠবিড়ালী’। আমি বললাম, আমি দুরন্ত কাঠবিড়ালীর সাথে কথা বলতে চাই। ‘তা সম্ভব’ বলেই একটা নাম্বারে ফোন দিলো জনি।





দুরন্ত কাঠবিড়ালী

জনি তাকে পরিচয় করিয়ে দিলো বিচ-বয় হিসেবে। ব্রোঞ্জের মতো গায়ের রঙ, এথলেটিক শরীর। মাত্র দশ মাস আগেও সে ইন্দোনেশিয়ার জেলে ছিল। একটা বার্জ ছিনতাইয়ের ঘটনায় ধরা পড়েছিল সে। জানাল, কাস্টডিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, পেটানো হয়েছে, এমনকি পায়ে গুলিও করেছে। প্যান্টের কাপড় উঠিয়ে দেখাল- পায়ে বড় কাটা দাগ। এখনো গুলিটা নাকি ভেতরেই আছে। তবে তার সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো, ধরা পড়ার পর তার স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে পালিয়েছে।





কেন লুটপাট করছ, জানতে চাইলাম। কাজের অভাবে বলল সে। ব্যাখ্যা করল জনি বাণিজ্যিক জাহাজে কাজ করার জন্য যে সার্টিফিকেটের দরকার তা নেই ইন্দোনেশিয়ার বেশির ভাগ নাবিকের। বিচ-বয়ের মতো তরুণরা তাই নির্ভর করে বয়স্ক নাবিকদের ওপর। তাদের সাথে থেকে শিখে যদি কোনো জাহাজে কাজ পাওয়া যায়। কারণ সার্টিফিকেটের জন্য ব্যয়বহুল প্রশিক্ষণ নেয়ার সামর্থ্য নেই তাদের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শিপিং কোম্পানিগুলো এ ধরনের নিয়োগ বন্ধ করে দেয়ায় বাটামের অনেক নাবিক বেকার হয়ে পড়ে।





কিভাবে সবার অজান্তে জাহাজে ওঠো তোমরা, জানতে চাইলাম। ‘জাদু করে’, বলল সে। ‘আমরা মন্ত্র পড়ি, নাবিকরা ঘুমিয়ে থাকে। আমরা এমনকি অদৃশ্য বুলেটপ্র“ফ হয়ে যেতে পারি।’ নিজের মাথায় আঙুল ঠেকিয়ে বলল, ‘তুমিও শিখতে পারো’। তাহলে তোমার গুলি লাগল কিভাবে, জিজ্ঞাসা করলাম। বলল, ‘প্রথমটা ঠেকিয়েছিলাম। দ্বিতীয়টা ঠেকানোর শক্তি ছিল না।’





দস্যু প্রশিক্ষণ

দিন কয়েক পরে আমি, জনি আর বিচ-বয় একটা ক্যাব নিয়ে বন্দরের দিকে চললাম। দুরন্ত কাঠবিড়ালীরা কিভাবে জাহাজে ওঠে, তা আমাকে দেখানোর আয়োজন করেছে বিচ-বয়। সে জানাল, কাছেই একটা জনমানবহীন দ্বীপ আছে, যেখানে সে মাঝে মাঝে প্রশিক্ষণ দেয়।





জেটিতে আরো দু’জন পেশল তরুণের সাথে দেখা হলো। কাঠের নৌকা নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিচ-বয়ের এই দুই সাগরেদ। বিচ-বয় বলল, এই নৌকাগুলোই ভালো কারণ ফাইবারগ্লাসের নৌকাগুলো হালকা হওয়ায় পানির ওপর লাফায়।





কড়া রোদ মাথায় নিয়ে ঘাট ছেড়ে ঘন বনের মধ্যে চলল আমাদের নৌকা। মালাক্কার অসংখ্য ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে এটা একটা। চার দিকে উঁচু উঁচু গাছের শেকড় আর শাখা-প্রশাখা। কিন্তু এর মধ্য দিয়েই বাঁক খুঁজে এগিয়ে গেল আমাদের নৌকা। ম্যানগ্রোভ পেরিয়ে মাইল খানেক দূরে একটা ছোট্ট দ্বীপে গিয়ে পৌঁছলাম আমরা। তীরে ভেড়ার পর বিচ-বয় হারিয়ে গেল জঙ্গলে। বাকিরা আমরা তীরে অপেক্ষায় রইলাম। এখান থেকে মূল প্রণালীপথ পরিষ্কার দেখা যায়। নয়টি নৌযান যেতে দেখলাম আমরা। এগুলোর মধ্যে একটা প্রাকৃতিক গ্যাসবাহী বড় ট্যাঙ্কারও ছিল। বিচ-বয়ের এক সাগরেদ বলল, ‘এই জায়গাটা এক সময় জাহাজে হামলার জন্য আদর্শ জায়গা ছিল। কিন্তু এখন টহল অনেক বেড়ে গেছে।’ তবে কিছু জায়গা এখনো আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন জাহাজ লুট করে। সে বলল, ‘কিছুটা অর্থের জন্য, বাকিটা অ্যাডভেঞ্চার। জেমস বন্ডের মতো।’





জঙ্গল থেকে ২০ ফুট লম্বা একটা বাঁশ নিয়ে ফিরে এলো বিচ-বয়। বাঁশের পাতাগুলো ছেটে ফেলল সে। আর তার সাগরেদ ম্যানগ্রোভ শেকড় কেটে তৈরি করল ফুটখানেক লম্বা একটা ফলা। এর পর ফলাটা বাঁশের এক মাথায় গেঁথে দেয়া হলো। ‘এভাবেই আমরা জাহাজে উঠি’ বলে বিচ-বয় একটা গাছের দিকে ছুড়ে দিলো বাঁশটা। উঁচু একটা ডালে গেঁথে গেল সেটা। এবার চোখের পলকে সেটা বেয়ে তরতরিয়ে ওপরে উঠে গেল তিনজন। আবার নেমেও এলো চোখের পলকে।





ওরা নেমে আসার পর হঠাৎই পিঠে ধারালো ছুরির স্পর্শ পেলাম। সাথে কঠোর হুমকি, ‘বল, অর্থকড়ি কোথায় আছে’? মুহূর্তের জন্য আতঙ্কে দম আটকে গেল আমার। বেশ কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে যে, ওরা আসলে তখনো জাহাজ লুটের মহড়া দিচ্ছে।





বাটাম ফেরার পথে একটা বিরাট কার্গো জাহাজ নোঙর করা দেখতে পেলাম। ক্রুদের উদ্দেশে হাত নাড়ল বিচ-বয়। ক্রুরাও পাল্টা হাত নাড়ল। সাগরেদদের একজন অনেকটা মহড়ার ভঙ্গিতে নৌকা নিয়ে গেল জাহাজের পেছন দিকে। ‘এই এখান থেকে আমরা জাহাজে উঠি। এখানে কেউ আমাদের দেখতে পায় না। কিন্তু চলন্ত অবস্থায় জাহাজের পেছনে এখানে প্রচণ্ড স্রোত থাকে। সেই স্রোতে শক্ত করে বাঁশ ধরে রাখাটা খুব কঠিন। তাই যে বাঁশ ধরে রাখে, অর্থের ভাগটা তার সবচেয়ে বেশি।’





সপ্তদশ নাবিক

জলদস্যুদের কর্মকাণ্ডে যে নাবিক কখনো মজা পায়নি, তার নাম মোহাম্মদ হামিদ। নেপলিন ডেলিমা থেকে পালিয়ে পুলিশ ডেকে এনেছিল সে। মালাক্কা প্রণালী থেকে অনেক দূরে মালয়েশিয়ায় তার বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি। নেপলিন ডেলিমার অভিজ্ঞতার কারণেই মাত্র ২৮ বছর বয়সে সে সম্ভাবনাময় নাবিকের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। তার গ্রামের নাম যাতে না বলি, সে জন্য অনুরোধ করেছিল সে। তার ধারণা, এখনো তার ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে জলদস্যুরা।





হামিদের বাবার বাড়িতে মাদুরে বসে সেদিনের গল্প শুনছিলাম আমরা। সেটা তার জীবনের ভয়াবহতম রাত। সেদিন জাহাজে ক্যাপ্টেনের আতঙ্কিত গলা শুনছিল যখন, তখন হঠাৎ জলদস্যুদের একজন তার গলায় ছুরি ধরে। ‘ভেবেছিলাম, এই বুঝি শেষ’। কিন্তু জলদস্যুকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে মূল ডেকের কিছু পাইপের নিচে লুকিয়েছিলাম। ‘মনে মনে তখন দোয়া পড়ছিলাম শুধু, এমন সময় চোখ গেল রেলিংয়ে বাঁধা স্পিডবোটের দড়ির দিকে।’





রেলিং পা দিয়ে জড়িয়ে ধরে বোটে লাফিয়ে পড়েছিল সে। এর পরের কয়েক মিনিট ছিল চরম আতঙ্কের। ভোঁতা পকেট ছুরি দিয়ে মোটা রশি কাটতে হয়েছে তাকে। এর পর ঘামে চুপচুপ ভিজে সে পড়েছিল বোটের মেঝেতে যতক্ষণ না স্রোত তাকে ট্যাঙ্কার থেকে দূরে অন্ধকারে নিয়ে আসে। নিরাপদ দূরত্বে এসেছে ভেবে হাতড়ে স্পিডবোটের মোটর স্টার্ট নেয়ার দড়ি উদ্ধার করে সে। মেঘে তারাগুলো ঢেকে ফেলায় দিক নিয়েও তখন সে বিভ্রমে। এর মধ্যে নেমেছে বৃষ্টি। দূরে তখনো মাইক্রোফোনে ক্যাপ্টেনের আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল। ‘আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম আমি। এরপর ইঞ্জিন স্টার্ট দিলাম।’





২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে রীতিমতো নায়ক হয়ে গেল হামিদ। মালয়েশিয়ান দ্বীপ লাঙ্কাওয়িতে পৌঁছে পুলিশকে খবর দিতে পেরেছিল সে। পরে তার দেখানো পথেই নেপলিন ডেলিমা ফিরিয়ে আনে পুলিশ। আত্মসমর্পণ করে সব জলদস্যু।





দস্যুদের নয়জনেরই জেল হয়েছে। একজন নিজেকে নির্দোষ দাবি করায় তার বিচার এখনো ঝুলে আছে। জাহাজের কর্মকর্তা আর জাহাজে থাকা ষড়যন্ত্রকারী গ্রেফতার হয়েছে। দু’জনেই অবশ্য নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছে। তাদের এখনো বিচার হয়নি। সঙ্গী নাবিকের ষড়যন্ত্রের কথা শুনে রীতিমতো চমকে গেছে হামিদ।





দুই মাস পর

যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসেছি। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে একদিন হঠাৎ মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠল। জন বাটামের একটা টেক্সট মেসেজ। ‘মোটর ট্যাঙ্কারে মাস্টারের কাজ পেয়েছি জন।’ বিয়ে অনুষ্ঠানের অতিথিরা তখন ব্যান্ডের সাথে গাইতে স্টেজে উঠছে। আমি হঠাৎ যেন বাটামে ফিরে গেলাম জন বাটাম আর বিচ-বয়দের ভিড়ে। আমি চলে আসার পর আর কোনো দস্যু হামলার খবর শুনিনি মালাক্কায়। এই জলপথে টহল বাড়াতে বিদেশীদের সাহায্য চেয়েছে ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়া সরকার। তবে সাহায্য বা উপকরণ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী কত দিন এ টহল চালু রাখতে পারবে কে জানে।





মনে মনে নিজেকে বলি, নেপলিন ডেলিমার ঘটনার কারণেই হয়তো নতুন বৈধ পথ বেছে নিয়েছে জনি বাটাম। অনুগতভাবে কাজ করছে মালিকের জাহাজে। কিন্তু যদি অন্য পথে আরো বেশি রোজগারের সুযোগ আসে, কী করবে সে, বলা মুশকিল!



সুত্র ::::

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.