নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তুমি আসবে বলেই আমার দ্বিধারা উত্তর খুঁজে পায়নি।।

এই ফটকাবাজির দেশে স্বপ্নের পাখিগুলো বেঁচে নেই ...

আদনান মাননান

আমি হয়তো মানুষ নই , মানুষগুলো অন্যরকম...শখ করে লেখালেখি , পেশায় একজন শিক্ষক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াই।

আদনান মাননান › বিস্তারিত পোস্টঃ

পিতা পরম

২৪ শে জুন, ২০১৪ সকাল ৯:০৬

গত কয়েকদিন ধরেই চোখ বন্ধ করলেই, ঘুমাতে গেলেই বারবার বাবার কথা মনে পড়ছে। কেমন আছে চার হাজার মাইল দূরে থাকা আমার বাবা? কখনো খেয়াল করে দেখিনি বাবার কষ্ট, চাওয়া আর মমতা। এসব কিছু মনে হওয়ার কারণ আমার খুব প্রিয় বন্ধু মনোজ। সম্প্রতি বাবা হয়েছে সে। তার অন্যরকম উচ্ছ্বাস, ছেলের অসুস্থতা নিয়ে তার উদ্বেগ আমাকেও ভাবায়- বাবারা কি এমনই? অস্ট্রেলিয়াতেই তার বাবা কয়েকদিন আগে স্ট্রোক করলেন। তখন মনোজের উৎকণ্ঠার সাথে সাথে আমারও বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম- আচ্ছা, বাবার কষ্ট নিজের চোখের সামনে দেখার মত যন্ত্রণার ব্যাপার কি হতে পারে সন্তানের জন্য?

বুকপকেটে জমা হয়ে আছে একটা অন্যরকম শৈশব। শুধু মাত্র বিলাসী না হওয়ার জন্য আমার বাবা নিজেদের গাড়ি থাকা সত্ত্বেও আমাকে কখনও স্কুল বা কলেজে গাড়িতে চড়ে যেতে দেননি। আমার জন্য বরাদ্দ ছিল রিকশা আর টেম্পোতে করে যাওয়া আসার পাঁচ টাকা। ধন্যবাদ বাবা, তোমার কারণে আমি আমার আশেপাশের মানুষগুলোকে কাছ থেকে দেখেছি, তাদের কষ্টগুলো অনুভব করতে শিখেছি। আমাদের যখন পরীক্ষা চলত আমাদের বাবা মা আমাদের মত করেই দিন কাটাতেন, কোন টিভি দেখা হতোনা, জোরে শব্দ হতোনা এমনকি বাবা অনেক ভোরে আমার আশেপাশে হাঁটতেন যেন পড়তে পড়তে আমি ঘুমিয়ে না পড়ি। এতটা ত্যাগ নিয়ে আমি কখনো আমার সন্তানের পাশে দাঁড়াতে পারব কি? শুনলাম গত কোরবান ঈদে আমার বাবা মাংস মুখে দেননি। কারণ তার ছোট ছেলে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে কোন ঈদ দেখেনি। এত চাপা মমতা নিয়ে কিভাবে থাকেন বাবা’রা? দেশে আমি কখনও বাবার এই অদ্ভুত মমতা অনুভব করতে পারিনি। আমার বাবা ডাঃ এম এ মান্নান আমাকে চ্যালেঞ্জ নিতে শিখিয়েছেন, অনেক হতাশার মাঝেও ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন, নিজের স্বপ্নের পেছনে ছোটার প্রেরণা দিয়েছেন। বাবাকে কখনও কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু এয়ারপোর্টে আমাকে বিদায় দেয়ার মুহুর্তে ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন। আমাদের সব বাবারাই বাইরে কঠিন কিন্তু ভেতরে ভীষণ কোমল। মাঝে মাঝে মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ আমার বাবাকে মনে করেই বোধহয় উচ্চারণ করেছিলেন একটা অসাধারন সত্য -”পৃথিবীতে খারাপ মানুষ অনেক আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই” ।

১৫ জুন বিশ্ব বাবা দিবস। চিরন্তন সমাজ প্রথায় আমাদের দেশে বাবা- ছেলের সম্পর্কটা সবসময় আবছায়া, দেখানোর নয় বরং অনুভবের। মা কে নিয়ে অনেক গান, কবিতা আর গল্প লেখা হয়েছে। কিন্তু আজীবন পরিবারের জন্য শরীরের শেষ রক্তবিন্দু ঘাম করা বাবা সবসময়ই থেকে যান অগোচরে। এ সময়ের তুলনায় আমাদের যুগের বাবারা কঠোর, নির্লিপ্ত, অপ্রকাশিত। সন্তানের কাছে অনেক বাবা দূরের গ্রহের মানুষ। কিন্তু এর চেয়ে বড় সত্যটি হল মা যখন জীবনে আবেগের স্থান আমাদের বুঝতে শেখান বাবা তখন আমাদের অনেক বেশি বাস্তববাদী আর যৌক্তিক হতে শেখান। মা যখন স্নেহ ও নির্ভরতা শেখান, রুদ্রমুর্তি বাবা তখন স্বাবলম্বী হওয়ার প্রেরণা দেন। মা যখন ছেলেকে গৃহমুখি দেখতে পছন্দ করেন, বাবা তখন সন্তানকে সাহসী হতে শেখান। কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারিনা, বাবা আজীবন পেয়ে যান উপেক্ষা - আমার না-বলা বাণী ঘন যামিনীর মাঝে, তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে।

বাবারা এমনই। সে কারণেই আব্রাহাম লিঙ্কন তার ছেলের শিক্ষককে দেয়া চিঠিতে লিখেছিলেন- “আমার পুত্রকে অবশ্যই শেখাবেন-সব মানুষই ন্যায়পরায়ণ, সব মানুষই সত্যনিষ্ঠ নয়। তাকে এও শেখাবেন-প্রত্যেক বদমায়েশের মাঝেও একজন বীর থাকতে পারে, প্রত্যেক স্বার্থপর রাজনীতিকের মাঝেও একজন নিঃস্বার্থ নেতা থাকেন। আমার পুত্রের প্রতি সদয় আচরণ করবেন কিন্তু সোহাগ করবেন না, কেননা আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয়”। বাবা এভাবেই খাঁটি ইস্পাত হিসেবে তৈরি করেন সন্তানদের। এক মুক্তিযোদ্ধা পিতা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তার অন্তঃসত্বা স্ত্রীর কাছে অনাগত সন্তানের উদ্দেশে চিঠিতে লিখেছিলেন- “তোমার সহিত আমার দেখা হইবে কিনা জানি না। শুধু জানি যতক্ষণ বাঁচিঁয়া আছি, শুধু তোমাদের জন্যই দেশটাকে মুক্তি করিয়া যাইব। তুমি ছেলে বা মেয়ে যেই হও, মনে রাখিও, মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত। আর জন্মের পরে যে দেশটাকে দেখিবে তুমি, সেও তোমার মায়ের মতোই। মাকে কখনই কষ্ট দিওনা সোনা। বাঁচিঁয়া থাকিলে দেখা হইবে। তখন স্বাধীন দেশে একসাথে বিজয়ের পতাকা উড়াইবো দুইজন। ইতি, তোমার স্নেহময় পিতা”। এভাবেই বাবারা বুকের মাঝে তীব্রভাবে দেশকে অনুভব করতে শেখান।

বাবাকে নিয়ে ভাবতে গেলেই সবসময় আমার মনে পড়ে আমার সেইসব কাছের মানুষদের কথা যাদের বাবা নেই, কোন এক বিষন্ন দিনে হঠাৎ অনুভব করল- তার পায়ের নীচের মাটি সরে যাচ্ছে, কারণ বাবা আর নেই। বাবা কতদিন কতদিন দেখিনা তোমায় -জেমসের গানটির মতই না দেখার বেদনায় তাদের চোখে ঝরে অশ্রু। হয়তবা ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল কিংবা হুমায়ুন আহমেদের মত চল্লিশ বছর পরেও তারা বাবাকে খুঁজে বেড়াবে বাতাসের মাঝে, সাগরের জলে, ফুলের সুবাসে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার অপরাধে তাদের পুলিশ অফিসার বাবাকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করার পর লাশ ফেলে দেয় ধলেশ্বরীর পানিতে। নদীর জোয়ার ভাটায় সেই মৃত শরীর একবার এদিক আরেকবার ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছিল কখনও ঠেকে যাচ্ছিল পাড়ে। নদী থেকে সেই মৃত শরীরটি তুলে আশপাশের মানুষজন নদীর পাড়েই দাফন করে? আর জুতো জোড়া রেখে দেয় পরিবারের লোকজনকে দেখানোর জন্য যুদ্ধ শেষে জাফর ইকবাল বাবার মৃতদেহ শনাক্ত করে মায়ের কাছে নিয়ে আসে। তাই মুক্তিযুদ্ধ মানেই বাবাকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট, আর কোনদিন বাবাকে দেখতে না পাওয?ার গভীর যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা থেকেই চল্লিশ বছর বিচারের দাবিতে তারা ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু তবুও স্মৃতি থেকে বাবা মুছেনি। বাবা’রা হারিয়ে যাওয়ার নয়। আমরা যত বড় হতে থাকি, আমরা যত পরিণত হতে থাকি, একটু একটু করে বুঝতে শিখি বাবা আসলে কি, বাবার দৃঢ়তা আমাদের কতটুকু পৃথিবী চিনতে শিখিয়েছে, সংযমী হতে শিখিয়েছে।

আমার বাবা সুপারম্যান নন, আমার বাবা জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ব্রেকিং বেড এর বাবা ওয়াল্টার এর মত কোটি কোটি টাকার পাহাড় সন্তানের জন্য তৈরি করেননি, জর্জ বুশের বাবার মত ক্ষমতাধর বাবাও তিনি নন,আমার বাবা কোনো দেবতা নন। আমার বাবা হলেন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কাজ থেকে ফেরা সেই সাধারণ মানুষটি, সন্তানের সংকটময় মুহুর্তে জায়নামাজে পড়ে থাকা সেই চিরন্তন জনক, গভীর রাতে সন্তানের জন্য ভাতের থালা নিয়ে অপেক্ষা করা সেই পিতা, ঘরে ঢুকেই হাঁক দেয়া সেই মানুষটি আমার ছেলেরা সবাই বাড়ি ফিরেছে? দূরে বসে যতই বাবাকে আবিষ্কার করছি, আজকাল বাবার সাথে ফোনে কথা হলে নিজেকে বড্ড বেশি ক্ষুদ্র মনে হয়, অনেক বেশী তুচ্ছ। মাঝে মাঝে নিজেকে তুচ্ছ মনে হওয়াটাও বোধহয় জরুরি।

পৃথিবীর সব বাবাদের জন্য শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর অভিবাদন। আপনাদের সন্তান হয়ে হয়ত আমরা অনেকেই আপনাদের গর্বিত করতে পারিনি কিন্তু এটা জেনে রাখবেন- আপনাদেরকে নিয়ে আমরা অনেক গর্বিত। কারণ আপনারা কার্টুনের বা নাটকের বাবা নন, সত্যিকারের বাবা যিনি আমাদের প্রতিনিয়ত মানুষ হওয়ার তাগিদ দিয়ে যান, শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমাদের পাশে থাকেন। ভাল থাকুন বাবা। আর আমাদের ছায়া দিয়ে যাবেন কবির সুমনের গানের মতই-

তিনি বৃদ্ধ হলেন বৃদ্ধ হলেন বনষ্পতির ছায়া দিলেন সারাজীবন।

এই বুড়ো গাছের পাতায় পাতায় সবুজ কিন্তু আজো মাতায়,সুঠাম ডালে

(লেখক : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক এবং বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত. )

(লেখাটি দৈনিক আজাদী তে প্রকাশিত ২৪।০৬।২০১৪ তারিখে) -

Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.