নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আফনানের নিকেশ জগৎ.....।

আফনান আব্দুল্লাহ্

প্রত্যেকটা মানুষের জীবনের গল্প তার আঙ্গুলের ছাপের মতই ভিন্ন। দূর থেকে এক মনে হলেও যতই তার গভীরে যাবে কেউ ততই বৈচিত্রময় বিভিন্নতা পাবে। নিজের জীবনের গল্পে চরে বেড়ানো মানুষগুলো সবাই’ই যার যার জগতে বন্ধী। সহস্র বছর বাঁচতে পারলে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের জীবনের গল্প আমি শুনতাম।নিজের দেখা জগৎ দেখা আদেখা মানুষদের জগতের সাথে গেঁথে নিতেই লিখি এবং আন্যের লিখা পড়ি। কেউ যদি মিথ্যুক বা ভন্ড না হয় তাহলে তার যে কোন ভিন্ন মতের কারন তার চার পাশের ভিন্ন জগৎ, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন শিক্ষা। তাই মানুষকে বুজতে হলে তার জগৎটাকে জানতে হবে, তার গল্পগুলো শুনতে হবে।আফনান আব্দুল্লাহ্

আফনান আব্দুল্লাহ্ › বিস্তারিত পোস্টঃ

রোদেলা রোদ্দুরে

০৫ ই মে, ২০১৪ রাত ১২:৫৭

রোদেলা রোদ্দুরে



নীনাদ বেশ দরদ দিয়ে গাচ্ছিলো ’আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি তোমায়, দেখতে আমি পাইনি…”। ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রানে, এই জীবন পূর্ণ করো, এই জীবন পূর্ণ করো।” খাটের পাশে খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছিলো, সাথে জোছনা। জানালায় পিঠ দিয়ে নিনাদের দিকে ফিরে বসে থেকে গানের সুরে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো রোদেলা। সে কি শীতে কেঁপে উঠছে নাকি আসলে কাঁদছে নিনাদ বুজতে পারছেনা, কারন রোদেলা হাঁটুতে হাত রেখে তাতে মাথা গুঁজে দিয়ে গান শুনছে। নিনাদ একটু এগিয়ে রোদেলার পিঠে হাত রাখলে মুখ তুলে সে। বড় বড় দুচোখে প্লাবন। ভেজা গাল চাঁদের আলোয় চকচক করছে। বৌয়ের কান্নাদেখে নিনাদের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠে। তার ঝাপটায় তার গানের সুর আরো করুন হযে উঠে আর জলের বেগ বাড়ে রোদেলার চোখে। রোদেলার কানে নীনাদের গলা ছাপিয়ে বাজতে থাকে রামিনের গানের সুর। তাদের পাড়ায় বার্ষিক সাঙস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাইছিলো রামিন। আর সেই সুরের হাহাকার এখনো রোদেলার বুকে ঝড় তুলে যাচ্ছে।





রামিন এলাকায় পরিচিত ছিলো ‘খাইষ্টা রামিন’ নামে। লম্বা পেটা গড়নের শরীর। ফর্সা লম্বাটে মুখে টানা চোখ, মাথা ভরা কোঁকড়ানো চুল, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। পাড়ার মোড়ে জটলা পাকিয়ে ‘আওউল ফাউল’ পোলাপাইন নিয়ে আড্ডা দিতো। সিগারেটের ধোঁয়ায় আড্ডাবাজদের চেহারা ঢাকা থাকতো সবসময়ই। পাড়া আর পাড়ার বাইরে যেকোন গন্ডগোলে খাইষ্টা রামিন আর তার গ্রুপকে পাওয়া যেতো। যদিও তাদের কারনেই মূলত পাড়ার ভেতরে মেয়েদের কে কেউ যন্ত্রনা দিতোনা, তথাপি পাড়ার মেয়েরা ওদের থেকে বিশ হাত দূর দিয়ে চলাফেরা করতো। তবু এক দুপুরে রামিন দেখা পেয়ে গিয়েছিলো রোদেলার।



-’এ্যাই মেয়ে’ বলে ডাক দিলো রামিন। বুকের ভেতরে মাটির কলশি ভাঙতে লাগলো রোদেলার। -’ কি হলো ডাক দেই শুননা!, কাছে আসো’।

গুটি গুটি পায়ে ধোঁয়ার জটলার দিকে গেলো রোদেলা -’জী ভাইয়া?”

-’ আজান দেয়, কানে যায়না? মাথায় কাপড় কই?’ কাঁপা হাতে মাথায় ওড়না টানলো রোদেলা। - ‘শায়না তোমার বান্ধবী?’ হা করে তাকিয়ে আছ কেন, জবাব দাও’?

কেঁপে উঠে রোদেলা বললো-’জী ভাইয়া।’ রোদেলা হা করে তাকিয়ে ছিলো যতটা না ভয়ে তার থেকে বেশি বিষ্ময়ে। ’খাইষ্টা রামিন’ নামের একজন মানুষ যে এতটা সুদর্শন হতে পারে তা সে চিন্তা করতে পারছিলো না। খেয়াল করলো ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলেও ছেলেটা নিজে সিগারেট টানছেনা। ভরাট গলায় কথা বলে যাচ্ছে। ঠিক কথা না অবশ্য, শাশিয়ে যাচ্ছিলো।– ‘শুন, শায়নাকে বলবা স্কুল থেকে ফিরে সোজা যেনো বাসায় ফিরে, লেকের পারে যদি আরেকদিন দেখি তো থাপড়ায়া দাঁত ফালাই দিব। বুজছ?’

-’জি ভাইয়া’।

-যাও এখন। দুই দিনের পিচ্ছি, লটর ফটর শিখি গেছে! দাঁত ফালাই দেয়া উচিৎ সব গুলার।’



এর পর থেকে নিজের অজান্তেই রোদেলা স্কুলে আসা যাওয়ার পথে রামিনকে খুঁজে বেড়াতো। দু একবার দেখাও পেতো। কিন্তু লোকটার সাথে তার আর কখনো চোখাচোখিও হয়নি, ভাবটা থাকতো যেন তাকে কখনোই চিনেনা। তার প্রায়ই মনে হতো এই বুজি তাকে আবার ডাকলো –’এই মেয়ে বলে’। কিন্তু তা আর হয়নি। মরিয়া হয়ে সে একদিন শায়নাকে বলে কয়ে রাকিব ছেলেটার সাথে আবার একদিন লেকের পাড়ে ঘুরতে পাঠালো। রাকিব তাদের সাথেই ক্লাশ টেন এ পড়তো তখন। কিন্তু রামিন এইবার আর তাদের শায়েস্তা করতে রোদেলার দারস্ত হলোনা।



রাকিব তিন দিন জ্বরে ভুগলো ফোলা গাল নিয়ে। আর শায়না সারাক্ষন রামিনকে গালাগাল দিতে লাগলো পিছনে। হতাশ হলো রোদেলা। তবে এর পর থেকে শায়না রামিনের পিছে লাগে। কখন কোথায় যায়, কোন দিন কি করে সব খোঁজ খবর নিতে লাগলো। আর রোদেলা সহজেই রামিনের সব জানতে লাগলো।



দেখা গেলো এই ছেলে কোন ধরনের নেশা করেনা। বন্ধুরা সিগারেট খেলেও, সে তা ও টানেনা। গাল ভর্তি দাড়ি ছাড়া তার মধ্যে আর কোন অপরিচ্ছন্নতা নেই। ইঞ্জিনিয়ারিঙ পড়া মাঝপথে ঝুলে আছে। ’খাইষ্টা’ শব্দটা তার নামের আগে জুড়েছে মূলত তার ব্যবহারের কারনে। যার তার মুখের উপর যা তা বলে বসে। সব কিছুতে নাক গলাতে যায়। শারিরীক আকৃতির সুবিধা নিয়ে মারামারিও বাধাই বসে যেখানে সেখানে। সহজে কেউ তাকে তাই ঘাঁটায়না।



একদিন শায়না বললো – ‘ জানিস, খাইষ্টা রামিন্না এইবার ধরা খাবে’।

-কেন, কি করছে’? চমকালো রোদেলা।

- হারামজাদা লতিফ বাবুদের সাথে লাগছে’।

-কেন! কি নিয়ে?

-পাড়ার মধ্যে বাবুদের যে গোডাউন দুটা আছেনা, রামিন্না সেখানে গিয়ে চিল্লাচিল্লি লাগাই দিছে। ঐ গোডাউনে নাকি আজেবাজে নেশা-ফেশার জিনিশ আছে। লতিফ বাবুর ম্যানেজার চরম খেপছে।’



এর কিছু দিন পরই লতিফ বাবুর গোডাউন সিলগালা হলো, ম্যানেজারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো। এতে এলাকার মানুষের মনে রামিনকে নিয়ে ভীতি আরো বেড়ে গেলো। সবাই তাকে আগের থেকেও বেশি এড়িয়ে চলতে লাগলো। শুধু রোদেলা তার আশেপাশে পাশে ঘোরা ফেরা বাড়িয়ে দিলো।



এর কয়দিন পরেই এলো সেই সন্ধা। পাড়ার বার্ষিক সাঙস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাইতে স্টেজে উঠলো রামিন। সবাই অস্বস্তিতে কেমন যেন উসখুস করতে লাগলো। একদম খালি গলায় গাইলো রামিন;

-‘আগুনের পরশ মনি ছোঁয়াও প্রানে, এই জীবন পূর্ণ করো’।



হালকা শীতের সেই সন্ধায় বুকের ভিতরে যেন কিসের এক হাহাকার তুলে সেই সুর। জীবন পূর্ণ করার আহ্বানে যেন সব দু:খ দুচোখ বেয়ে ভেসে যাচ্ছিলো রোদেলার। গান শেষেও পুর অডিটোরিয়াম নিরব হয়ে রইলো। শুধু দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল সুরের রেশ।



একটু বিব্রত হয়ে স্টেজ থেকে নামার আগে রামিন অবাক হয়ে দেখলো একটা মেয়ে হঠাৎ প্রচন্ড জোরে তালি দিয়ে উঠলো, গুমোট নিরবতার মাঝে সেই শব্দ ঝনঝন করে বেজে উঠলো সবার কানে। দ্রুতই তালি ছড়িয়ে পড়লো পুর অডিটরিয়ামে। রামিন অবাক হয়ে তখনো তাকিয়ে রইলো প্রথম যে মেয়েটা তালি দিলো তার পাশের মেয়েটার দিকে। বড় বড় দু’চোখ উপছে পানির বন্যা বয়ে যাচ্ছে মেয়েটার দুগাল বেয়ে, পাথরের মত বসে রামিনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তালি দিতে দিতে রোদেলাকে কুনুইয়ের খোচা দিতে লাগলো শায়না। শায়না’ই হলো প্রথম তালি দেয়া মেয়েটা। খোঁচা দিতে দিতে সে কি বলতে চাইছিলো রোদেলা শুনতে পায়নি সেদিন।



শুনলো পরদিন সকালে। নতুন যে রাস্তাটার কাজ চলতেছে তার বালির ঢিবির পাশে রামিনের গলাকাটা শরীরটা পাওয়া গেছে, আরো বিভৎস ব্যপার হলো তার জিহ্বাটাও কেটে নিয়ে গেছে কেউ।



ঘরের কেউ বুজতে পারলো না হঠাৎ করে রোদেলা অসুস্থ হয়ে গেলো কেন? ঐবার সে এস.এস.সি পরীক্ষাটা দিতে পারলোনা। দীর্ঘ্য দিন পর সুস্থ হয়েও সে মনে মনে ঐ সূর খুজে বেড়াতে লাগলো। ভার্সিটির ক্যাম্পাসে একদিন অনুষ্ঠানে হঠাৎ নিনাদের গলায় গানটা শুনেই আবার কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। পরে ধীরে ধীরে নিনাদ তার কাছে আসে। তার পরিনতি বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়।



প্রায়ই রাতে ঘুমানোর আগে রোদেলা নিনাদকে জোর করে গান গাওয়ার জন্যে। নিনাদ খালি গলায় গান ধরে আর অবাক হয়ে রোদেলার চোখের বন্যা দেখে।



[email protected]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.