নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভজলে সোনার মানুষ

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:২১

বছর দুই আগেও শ্রীলঙ্কা এসেছিলাম। একটা গ্রুপের সাথে। ওয়ার্কশপে।

সেই গ্রুপে একজন ছিলেন আমার আধাচেনা, আরেকজন ছিলেন ফর্মাল জানা-শোনার দূরত্বে মোড়ানো মানুষ। আর বাকি কাউকেই চিনতাম না। এয়ারপোর্টেই তাদের সাথে মোলাকাত।

কিন্তু একটা সফর একদল অচেনা মানুষকে কতখানি বুকের ভেতরে জায়গা দিতে পারে তা আমাকে শিখিয়েছে সেই সফর।

সফরকালে ওয়ার্কশপে কী শিখেছিলাম, কী শিখিনি কিচ্ছু আর এখন সুস্পষ্ট মনে নেই। শুধু মনে আছে, একটানা ৫/৬ দিন দিনে-রাতে আমি কলম্বোতে সাগর পাড়ে বসে থেকেছি।

কেমন সেই বসে থাকা?

আমাদের কল্পকাহিনী মতে, বীণ বাজতে থাকলে আর নাগিনীর কানে সেই শব্দ পৌঁছালে সে তখন সুরের দিকে ছুটে আসে। স্বেচ্ছায় সে তখন ধরা দেয় সাপুড়ের কাছে।

আমারো ছিল তেমনই দশা।

যেন একশটা মুখওয়ালা একটা বীণ বাজছিলো অহর্নিশ।

রাত দুইটা-আড়াইটা-তিনটার সময় আমি সেই বন্ধুদের কাছে বায়না ধরে বলেছি, আমর না খুব সাগর পাড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। প্লিজ, চলো না আমার সাথে।

বন্ধুরা আমার! দল বেঁধে হৈ হৈ রৈ রৈ করতে-করতে তারা আমাকে সাগর পাড়ে নিয়ে গেছে। ওরা বসে থেকে বা দাঁড়িয়ে থেকে গল্প করেছে রেললাইনের ধারে।

আর আমি নেমে গেছি নিচে। একটার পর একটা পাথুর পাড় হয়ে একেবারে ঢেউয়ের সন্নিকটে গিয়ে বড় একটা পাথর দেখে তার উপরে গা এলিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে পড়েছি।

এরই মধ্যে কেটে গেছে হয়তো ঘন্টা! তারারা পূব থেকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে পশ্চিমে। কিন্তু বন্ধুরা আমার সাথে ছিল।

এবার শ্রীলঙ্কায় আমার একা সফর। একা একা আমি যথা সম্ভব বসে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আটটা বেজে গেলে আর বসে থাকার ঝুঁকি নিলাম না।

সাগর পাড়ে আমার একটা প্রিয় নির্জন জায়গা আছে। সেই জায়গাটাতে আজ বসেছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যাটা যেনো আজ একটু বেশীই ঘোর কালো হয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এলো!

রাত-বিরেতে একা আর বসে থাকার ঝুঁকি না নিয়ে উঠে গেলাম। চা নিতে হবে। টি ট্রাইয়াম্ফ নামে কাছেই আমার চেনা একটা টি-বুটিক আছে।

টি-ট্রাইয়াম্ফে বিক্রয়কর্মীদের সাথে বহু গল্প হলো। আগের বারের রেফারেন্স দিলাম। মোহসিন বলে একজন বিক্রেতা ছিলেন। তার কথা বললাম। সে নেই। এবারে সবাই নতুন। এদের সাথেই গল্প হলো।

তারা আমাকে এক্সট্রা খাতির করলেন। এক কাপের জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন ফ্ল্যাভার দিয়ে তিন কাপ চা খাওয়ালেন।

প্রচুর চা কিনলাম। নিজের জন্য। বন্ধুদের জন্য। টোকেন হিসেবে গিফট দেয়ার জন্য। চায়ের দামে অপ্রত্যাশিতভাবেই তারা আমাকে কমিশনও দিলেন।

শো রুমে আমি বেশ ক'টা ছবি তুললাম। এমনকি তাদের সাথেও ছবি তুলে আনলাম। কেনা-কাটা শেষ। বোচকা-পাতি নিয়ে এবার ঘরে হোটেলে ফেরার পালা।

কিন্তু টি-ট্রাইয়াম্ফ থেকে দরজাটা খুলে বাইরে বের হওয়া মাত্রই আমাকে গ্রাস করে নিলো সাগরের হাওয়া। আমাকে গ্রাস করে নিলো ঢেউয়ের কল্লোল। মন চাইলো দৌড়ে গিয়ে রেইললাইনটা পাড় হয়ে একটা পাথরের উপর বসে পড়ি চুপচাপ।

রাত অনেক হয়ে গেছে। যাওয়াটা ঠিক হবে না। কিন্তু চুম্বকের সাথে আঁটকে যাওয়া লৌহখন্ডের মতন আমার পা আটকে এছে ফুটপাথে। আমার কান আটকে গেছে ঢেউয়ের কল্লোলে।

থাক। রাত যথেষ্ঠ হয়েছে। একা একা আর যাওয়াটা ঠিক হবে না। এই ভাবি। ভেবে হোটেলমুখো হয়ে কয়েক কদম ফেলি। কিন্তু মনের মধ্যে খচ-খচ খচ-খচ করতে থাকে।

ধুর! কী আছে এতো ভয়ের! এই ভেবে আমি চকিতে ঘুরে ফিরে গেলাম টি ট্রাইয়াম্ফে।

আমাকে দেখে ওরা ভেবেছিল, আরো কিছু নিতে এসেছি বুঝি।

কিন্তু ওদেরকে বললাম, আমি একটু সাগর পাড়ে বসতে চাই। তবে, একা বসে থাকাটা নিরাপদ মনে হচ্ছে না। ওরা কি কেউ একটু হাওয়া খেতে যাবে?

এরকম অনুরোধ বা আহ্বানে এরাও যে কম বিস্মিত হয়নি তা মুহূর্তেই বোঝা গেলো।

একজন এলো আমার সাথে। চা কিনতে গিয়ে ওর সাথেই বেশি কথা বলা হয়েছে। খুনসুটিও হয়েছে কিছু।

রাস্তা পাড় হয়ে, রেল লাইন পেড়িয়ে আমি যখন একটার পর একটা পাথর বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছি ও হাত বাড়িয়ে আমার হাত থেকে চায়ের ব্যাগগুলো নিতে নিতে বললো, তুমি এগুলো আমাকে দিয়ে সাবধানে নামো।

আমিও কথা না বাড়িয়ে ওকে দিলাম প্যাকেটগুলো। তারপর পাথর পেরিয়ে পেরিয়ে সাবধানে নেমে এলাম একেবারে জলের কাছাকাছি। শেষ ধাপের কাছাকাছি এসে একটা পাথরের উপরে বসলাম। সে-ও বসেছে আমার সাথে।

আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ছটা এসে লাগছে আমার গায়ে। আপছে-আপ বন্ধ হয়ে আসে আমার চোখের পাতা। আমাকে এ ফোঁড় করে দিয়ে হাওয়া বয়ে যায়। যেনো আমি ছাদের উপর তারে নেড়ে রাখা পাতলা পুরনো সুতি কাপড়। আমার ভেতর দিয়ে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। হাওয়ার ভেতর দিয়ে আমি দুলছি সন্ধ্যারাতের সাগর পাড়ে।

সেই যুবকও রইলো আমার সাথে। এটা-ওটা টুকিটাকি প্রশ্ন করলো সে। গল্প হলো দু'চার কথা। কিন্তু গল্প সেখানে আধিক্য তখন। আমি তাই, অতি বিনয়ে আমার বিনয়ী সঙ্গীকে জানাই, কথা না বলে আমি শুধু চুপচাপ বসে থাকতে চাই।

এরপর সেও চুপচাপ। আমিও। শুধু কথা বলে যায় ইন্ডিয়ান ওশানের ঢেউ।

মিনিট দশ-পনেরো থেকে ওঠলাম। সে আমাকে সাবধানে রেললাইন পাড় হতে বললো। রেল লাইন পাড় হয়ে বড় রাস্তা পাড় হবার পর আমার হাতে চায়ের ব্যাগগুলো দিতে দিতে বললো, সাগর তোমার এতো প্রিয়!

ওর এই কথা শুনে মনে হলো, কী জানি! নিতি নিতি এই মহাসঙ্গীত শুনতে-শুনতে এরা হয়তো বেমালুম হয়ে গেছে যে, এক দারুণ মাধুর্যের ভেতর এদের বাস!

যাই হোক, ওর এই মন্তব্যের উত্তরে আমি মৃদু হাসি। তারপর বিদায়ী করমর্দন করতে-করতে দু'জনেই পরস্পরকে বলি: স্টে ব্লেসড।
মাথার উপর পূর্নিমার চাঁদ। কিন্তু আকাশ খানিক মেঘলা। মেঘলা আকাশের ফাঁকে-ফোঁকরে আলো ঠিকড়ে পড়ে।

ভরা পূর্ণিমার রাতে মেঘলা আকাশের নিচে হোটেলে পথে হাঁটি। হাঁটতে-হাঁটতে আমার সেই পুরনো বন্ধুদের কথা মনে পড়ে।

একদল অচেনা মানুষ কী করে বন্ধু হয়ে যায়! বন্ধুরা কী করে জীবন পাল্টে দেয়!

খুব করে এই ছেলেটির কথাও আমার মনে পড়ে। মানুষের কাছে গেলে মানুষ অচেনা থাকে না আর। মানুষের কাছে গেলে মানুষ বন্ধু হয়ে যায়।

পেছনে অতল অসীম ভারত সাগর। মাথার উপর মেঘে ঢাকা চাঁদ। তার নিচে মহা সমুদ্রের সঙ্গীত প্রাণে নিয়ে বাঁধানো ফুটপাথ ধরে আমি সামনে হাঁটি। হাঁটতে-হাঁটতে আনত হয়ে থাকা মন ভাবে, মানুষকে মানুষের কাছেই ফিরতে হয়। দূরের আড়াল রচনা করলে দূরত্বই বাড়ে শুধু। সাগর দেখা হয় না।

২৮ জুলাই। ২০১৮।

মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৩১

আতোয়ার রহমান বাংলা বলেছেন: সাগর আমার ও অনেক ভালো লাগে ................

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ৯:৫৯

আফরোজা সোমা বলেছেন: :)

২| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৫৭

বাকপ্রবাস বলেছেন: সাগর পাড়েই আমার ঘর। বাতাসে জোয়ারের ঘ্রাণ নিয়ে বেড়ে উঠা। আমার বাড়ীর ছাদ থেকে সেই সাগর দেখা যায় আর যায় আকাশ।

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ৯:৫৯

আফরোজা সোমা বলেছেন: ওহ গড! তাই নাকি! আপনি তো দারুণ সৌভাগ্যবান!

৩| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:২৭

সনেট কবি বলেছেন: সুন্দর++

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:০০

আফরোজা সোমা বলেছেন: ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

৪| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:১২

নজসু বলেছেন: শেষের কথাগুলো হৃদয়কে আপ্লুত করলো।

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:০০

আফরোজা সোমা বলেছেন: ভালো থাকবেন :)

৫| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৮

হাসান জাকির ৭১৭১ বলেছেন: সাগরের বিশালতা আছে, কিন্তু মন বৈচিত্র খোজে, যেটা পাহাড়ে-ঝর্ণায় খুজে পাই। তাই পাহাড় আমার প্রিয়।।

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:০১

আফরোজা সোমা বলেছেন: হুমম। পাহাড় দারুণ আকষর্ণীয়।

৬| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:০৩

রাজীব নুর বলেছেন: ছবি কই?

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:০২

আফরোজা সোমা বলেছেন: ছবি খুঁজলে পাওয়া যাবে। কিন্তু ছবি আর খোঁজাখুজি করি নাই।

৭| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:১৮

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি!
আহা কি দারুন সত্যোচ্চারন!

সাগরের টানের মুগ্ধতা মুগ্ধ করলো :)

+++

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:০২

আফরোজা সোমা বলেছেন: ভালো থাকবেন :)

৮| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৬

ঢাকার লোক বলেছেন: খুবই সুন্দর লেখা ! আপনি বেশ সাহসী, তবে বিদেশ বিভুঁইয়ে ( স্বদেশেও) সাবধান থাকার কোনো বিকল্প নেই !

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:০৩

আফরোজা সোমা বলেছেন: জী। ঠিক বলেছেন। সাবধানের মার নেই। ভালো থাকবেন।

৯| ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:০৩

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: আসলে বন্ধু ভাগ্য সবার হয় না; যার হয় সে অবশ্যই ভাগ্যবান। আপনার লেখা আগে কখনো পড়া হয় নাই কেন জানি না। মিস করেছি, আপনার লেখার ধরনটা চমৎকার। ++++

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:২৯

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। অনেক শুভ কামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.