নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সবার কথা

আহমেদ রশীদ

আহমেদ রশীদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কেন তিনি বঙ্গবন্ধু , কেন তিনি জাতির পিতাঃ জনাব রিজভী সাহেবের কটুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:০৩


বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব জনাব রিজভী আহমেদ সাহেব গত ২৮,১,২০১৬ তারিখে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী অনুষ্টানে তার দেয়া বক্তব্যে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে যার ভূমিকা নেই তাকেই জোর করে জাতির পিতা বানানো হচ্ছে”
কথাটি শুনে চমকে ওঠার কথা হলেও আমি চমকাইনি, কারণ বিএনপি নামক দলটি জন্মলগ্ন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে অধিকতর মহিমান্বিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারই এক নবতর সংযোজন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কোন অবদান নেই এই প্রপাগাণ্ডাটি। স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রপতি মুজিবের ভূমিকার সমালোচনা হতে পারে,তর্ক বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর কোন ভূমিকা নেই এই কথা কি তারা আসলেই বিশ্বাস করেন? নাকি স্রেফ বিরোধিতার স্বার্থেই বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মহানায়ককে নিয়ে এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার?

পাকিস্তানের ২৪ বছরের মধ্যে ১০ টি বছরই তাঁর কেটেছিল কারা অভ্যন্তরে।৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে মুজিব ছিলেন এক অনুপ্রেরণার কেন্দ্রস্থল।নিজ স্বকীয়তায় তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন হক,ভাসানী,সোরোয়ার্দীর মতো অগ্রজদের। তাঁর দীপ্তিময়তার পাশে নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিলেন তারা। পাক সামরিক জান্তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল মুজিব নামটি।তার ৬ দফাতে উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার অব্যক্ত আকাংখা।তার কন্ঠে ধ্বনিত “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা” শ্লোগানে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মর্মবাণী।আড়মোরা ভেঙে জেগে ওঠে বাঙালী।আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে ফাসিতে ঝোলানোর চেস্টা করেও ব্যর্থ হয় তারা। জনগণের বাঁধভাঙা জোয়ার জেলের তালা টুটতে বাধ্য করে। জনতার ভালোবাসায় সিক্ত মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে যান এভাবেই।ইতিহাস তার সাক্ষী।

৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তাঁর বজ্রকন্ঠে ভেসে আসে “ আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায় রাখতে পারবানা............এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা”।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় বলতে গেলে,
“তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হদৃয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি”
কার্যত স্বাধীনতা ঘোষিত হয় সেদিনই।তবু নাকি তাঁর কোন অবদান নেই স্বাধীনতা সংগ্রামে!! এতোবড় মিথ্যাচার করার আগে রিজভী সাহেবদের হৃদয় কি একবারো কেপে ওঠেনা?

এচাড়াও অপারেশন বিগ বার্ড অভিযানে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে বংগবন্ধু দিয়ে যান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা।স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, ২৫শে মার্চ কালরাত্রে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান যা ইপিআর এর ওয়ারলেস দ্বারা রিলে করা হয়। ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু বলেন,
‘পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহবান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবেলা করুন। এটাই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’’

পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকে ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজও এই মেসেজ গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। আওয়ামিলীগ নেতা মরহুম এম,এ,হান্নান চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথমে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।ইপিআর এর যে সুবেদার সেদিন এই ঘোষণাটি রিসিভ করেছিলেন, তাকে পাক বাহিনী এই অপরাধে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মেজর জিয়া তখন ব্যস্ত ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরে “সোয়াত” জাহাজ থেকে পাকিস্তানী অস্ত্র খালাসের পথে বাধা সৃষ্টিকারী ডক শ্রমিকদের শায়েস্তা করার কাজে। কর্ণেল অলি(তখন ক্যাপ্টেন) প্রথম জীপে করে ছুটে গিয়ে তাকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা করার সংবাদ দেন আর জিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেন “we revolt” বলে।
এটা কোন আওয়ামী প্রপাগাণ্ডা নয়।এটা হচ্ছে ৭১এর রক্তভেজা ইতিহাস।পরবর্তীতে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় “একটি জাতির জন্ম” আর্টিকেলে জিয়াউর রহমান নিজেই তা স্বিকার করেন।স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠক আর ঘোষককে এক করে ফেলার চেস্টা করে জিয়াকে কোনদিন বঙ্গবন্ধুর সমপর্যায়ে যে উঠিয়ে নেয়া যাবেনা ,সেটা জিয়ার সৈনিকরাও ভাল করেই জানেন। তারপরেও তারা মিথ্যাকে আকড়ে ধরে টিকে থাকার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে আসছেন বিগত চার দশক ধরেই।জানি, রাজনীতিতে কোন শেষ কথা নেই।কিন্তু নীতির ক্ষেত্রে কিছু না কিছু শেষ কথাতো থাকতেই হবে।

(বিএনপির রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর লেখা এই প্রবন্ধটি দৈনিক বাংলা পত্রিকার ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ, ১৯৭৪ তারিখে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক পত্রিকা 'বিচিত্রা'-য় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তদানীন্তন উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম 'একটি জাতির জন্ম' শীর্ষক শিরোনামে লেখাটি পুনঃ প্রকাশিত হয় ।
লেখাটির অংশবিশেষ নীচে তুলে ধরলামঃ

“ ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনো হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্তরূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙ্গালী ও পাকিস্তানী সৈনিকদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল।১৩ই মার্চ শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়ার আলোচনা। আমরা সবাই ক্ষণিকের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।”

জিয়া তাঁর জীবদ্দশায় কোনদিন বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করেননি।কিন্তু আজ ক্ষ্মতার মসনদের লোভে আর হালুয়া রুটির ভাগীদার হতে বেগম জিয়া,গয়েশ্বরর রায়রা প্রশ্ন তুলছেন শহীদদের সংখ্যা নিয়ে, আর রিজভী সাহেব প্রশ্ন তুললেন স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান নিয়ে।মুজিব জেলে বন্দী ছিলেন সত্যি, কিন্ত যুদ্ধের ৯ মাসই তিনি ছিলেন মুক্তিকামী বাঙালীর বিপ্লবী চেতনায় মিশে।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার ঘোষিত হতো “ বঙবন্ধু আমাদের সাথেই আছেন” মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে শ্লোগান উঠতো, “তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব ,শেখ মুজিব। স্বাধীন দেশের জাতির পিতা শেখ মুজিব,শেখ মুজিব”, আর ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে বলেছিলেন, “mujib is a traitor,this time he will not go unpunished.”

আর রক্ত আর ধ্বংসের স্তূপে দাড়িয়েও তার আশাতেই অন্নদাশংকর লেখেন,
“ দিকে দিকে আজি অশ্রুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান,
তবু নাই ভয়,হবে হবে জয়,জয় মুজিবুর রহমান”
আর আজ ৪৪ বছর পরে এসেও কিছু কুলাঙ্গার বলে চলেছে,মুক্তিযুদ্ধে তার কোন অবদানই নেই! সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!!

পরিশেষে রিজভী সাহেবের জন্য হুমায়ুন আজাদ স্যারের “ আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম” থেকে সামান্য অংশ উদ্দৃত করে গেলাম,
“ বাঙলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে দিয়েছিলেন মুজিব, বন্দী থেকেও তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে, তিনিই সৃষ্টি করে চলছিলেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। মুজিবকে আমরা প্রচণ্ড সমালোচনা করতে পারি, কয়েক দশক ধরে তো কোটি কোটি বামন প্রাণভরে তাঁর সমালোচনা করছে।
কিন্তু সত্য হচ্ছে তিবি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাঙলাদেশের মহাস্থপতি।
মুজিব ছাড়া হাজার হাজার জিয়া বা অন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিলেও মুক্তিযুদ্ধ ঘটতো না, তখন সেটা হতো হাস্যকর হঠকারিতা ও পরিণতিতে শোকাবহ; মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসতো না,এবং বিশ্ব আমাদের পক্ষ নিতো না, সাড়া দিতো না। এটা ঘটেছিলো মুজিবের জন্যই। মুজিব বাঙলাদেশের স্থপতি, মহাস্থপতি; তিনি সৃষ্টি করে চলছিলেন বাঙলাদেশকে। তাঁকে ছাড়া বাঙলাদেশের কথা ভাবাই যায় না। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিলো, সাড়া বিশ্ব আমাদের পক্ষে ছিলো; আমেরিকা, চীন, আর অন্ধকারযুগাচ্ছন্ন মুসলমান দেশগুলো ছাড়া-ওগুলো যে কখন একবিংশ শতকে আসবে; তখন বিশ্বের পরিস্থিতি ভিন্ন ছিলো- আজকের পরিস্থিতিতে যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধে যেতাম, তাহলে হয়তো শোচনীয় পরিণতি মেনে নিতে হতো।
২৬-এ মার্চের দুপুরে আকাশবাণী বাঙলা ও ইংরেজীতে বারবার ঘোষণা করছিলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, সিভিল ওয়ার হ্যাজ ব্রোকেন আউট ইন ইস্ট পাকিস্তান’, তাতে ভয় পেয়েছিলাম, কেননা গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না, এবং ভয়াবহ ধারণা ছিলো, কিন্তু ২৮-এ মার্চে তা পরিণত হয় মুক্তিযুদ্ধে।
ওই ঘোষণায় বাঙলা ও ইংরেজীতে, কম্পিত ও আবেগস্পন্দিত কণ্ঠে স্পষ্ট করে বলা হয়, যদিও খুবই অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো, যে মুজিব জীবিত আছেন, তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুজিবের পক্ষে ঘোষণা পাঠ করছেন একজন মেজর, যাঁর নাম মেজর জিয়া।
কে মেজর জিয়া? তাঁর নাম তো কখনো শুনি নি।
একটি ঘোষণাপাঠের ফলে, তাঁর কাঁপাকাঁপা কণ্ঠের আবেগ, মুহূর্তেই তিনি এক নতুন নায়ক হিশেবে দেখা দেন। অনেক সময় হঠাৎ কেউ কেউ অসাধারণ হয়ে ওঠেন, এজন্যে লাগে সুযোগ ও আকস্মিকতা। কেউ হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হয়ে উঠতে পারেন না, কিন্তু কেউ কেউ হঠাৎ মেজর জিয়া হয়ে উঠে সারা দেশকে আলোড়িত করতে পারেন। এটা হঠাৎ আকাশে মহাগোলমাল থেকে উদ্ভুত নক্ষত্রের মতো। কিংবদন্তি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে মুহূর্তেই, আকস্মিকভাবে, ঐতিহাসিক সুযোগে; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হওয়ার জন্য লাগে দীর্ঘ সাধনা।
ওই কাঁপাকাঁপা, অনভ্যস্ত, স্খলিত বাঙলা ও ইংরেজি ঘোষণাটির আগে আমরা কি কেউ জানতাম কে মেজর জিয়া? তাঁর কণ্ঠস্বর ও ঘোষণা আমাদের সঞ্জীবিত করেছিলো, কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিলো আমাদের? কোনো ধারণা ছিলো না, কিন্তু মুহুর্তেই ধারণা হয়ে যায়, আমরা কল্পনায় একজন অদম্য তরুণ মেজর ও যোদ্ধাকে দেখতে পাই। তিনি যদি বলতেন, ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বলছি’, তাহলেও তিনি এতোটা দাগ কাটতে পারতেন না, আমরা হয়তো একজন ক্লান্ত বুড়ো মেজরের কথা ভাবতাম, যে পদোন্নতি পায় নি, দেহে শিথিল হয়ে গেছে, কেননা ওইটিই বাঙালিদের জন্য স্বাভাবিক ছিলো পাকিস্তানে; মেজর ও জিয়া, এ-দুটি শব্দের সমাবেশ খুবই উদ্দীপক ছিলো।
তবে এটি ছিলো এক ঐতিহাসিক আকস্মিকতা ও সুযোগ, যাতে একজন সাধারণ মেজর অসাধারণ যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন, সারা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি অপরিহার্য ছিলেন না, কালুরঘাটের বেতারযন্ত্রীরা যদি অন্য কোনো মেজরকে পেতেন, তাকে দিয়ে ঘোষণা করাতেন, তাহলে তিনিই হয়ে উঠতেন কিংবদন্তি।”
মুজিব তাই বঙ্গবন্ধু,মুজিব তাই জাতির পিতা। [
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব জনাব রিজভী আহমেদ সাহেব গত ২৮,১,২০১৬ তারিখে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী অনুষ্টানে তার দেয়া বক্তব্যে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে যার ভূমিকা নেই তাকেই জোর করে জাতির পিতা বানানো হচ্ছে”
কথাটি শুনে চমকে ওঠার কথা হলেও আমি চমকাইনি, কারণ বিএনপি নামক দলটি জন্মলগ্ন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে অধিকতর মহিমান্বিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারই এক নবতর সংযোজন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কোন অবদান নেই এই প্রপাগাণ্ডাটি। স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রপতি মুজিবের ভূমিকার সমালোচনা হতে পারে,তর্ক বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর কোন ভূমিকা নেই এই কথা কি তারা আসলেই বিশ্বাস করেন? নাকি স্রেফ বিরোধিতার স্বার্থেই বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মহানায়ককে নিয়ে এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার?

পাকিস্তানের ২৪ বছরের মধ্যে ১০ টি বছরই তাঁর কেটেছিল কারা অভ্যন্তরে।৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে মুজিব ছিলেন এক অনুপ্রেরণার কেন্দ্রস্থল।নিজ স্বকীয়তায় তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন হক,ভাসানী,সোরোয়ার্দীর মতো অগ্রজদের। তাঁর দীপ্তিময়তার পাশে নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিলেন তারা। পাক সামরিক জান্তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল মুজিব নামটি।তার ৬ দফাতে উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার অব্যক্ত আকাংখা।তার কন্ঠে ধ্বনিত “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা” শ্লোগানে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মর্মবাণী।আড়মোরা ভেঙে জেগে ওঠে বাঙালী।আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে ফাসিতে ঝোলানোর চেস্টা করেও ব্যর্থ হয় তারা। জনগণের বাঁধভাঙা জোয়ার জেলের তালা টুটতে বাধ্য করে। জনতার ভালোবাসায় সিক্ত মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে যান এভাবেই।ইতিহাস তার সাক্ষী।

৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তাঁর বজ্রকন্ঠে ভেসে আসে “ আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায় রাখতে পারবানা............এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা”।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় বলতে গেলে,
“তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হদৃয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি”
কার্যত স্বাধীনতা ঘোষিত হয় সেদিনই।তবু নাকি তাঁর কোন অবদান নেই স্বাধীনতা সংগ্রামে!! এতোবড় মিথ্যাচার করার আগে রিজভী সাহেবদের হৃদয় কি একবারো কেপে ওঠেনা?

এচাড়াও অপারেশন বিগ বার্ড অভিযানে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে বংগবন্ধু দিয়ে যান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা।স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, ২৫শে মার্চ কালরাত্রে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান যা ইপিআর এর ওয়ারলেস দ্বারা রিলে করা হয়। ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু বলেন,
‘পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহবান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবেলা করুন। এটাই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’’

পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকে ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজও এই মেসেজ গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। আওয়ামিলীগ নেতা মরহুম এম,এ,হান্নান চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথমে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।ইপিআর এর যে সুবেদার সেদিন এই ঘোষণাটি রিসিভ করেছিলেন, তাকে পাক বাহিনী এই অপরাধে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মেজর জিয়া তখন ব্যস্ত ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরে “সোয়াত” জাহাজ থেকে পাকিস্তানী অস্ত্র খালাসের পথে বাধা সৃষ্টিকারী ডক শ্রমিকদের শায়েস্তা করার কাজে। কর্ণেল অলি(তখন ক্যাপ্টেন) প্রথম জীপে করে ছুটে গিয়ে তাকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা করার সংবাদ দেন আর জিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেন “we revolt” বলে।
এটা কোন আওয়ামী প্রপাগাণ্ডা নয়।এটা হচ্ছে ৭১এর রক্তভেজা ইতিহাস।পরবর্তীতে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় “একটি জাতির জন্ম” আর্টিকেলে জিয়াউর রহমান নিজেই তা স্বিকার করেন।স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠক আর ঘোষককে এক করে ফেলার চেস্টা করে জিয়াকে কোনদিন বঙ্গবন্ধুর সমপর্যায়ে যে উঠিয়ে নেয়া যাবেনা ,সেটা জিয়ার সৈনিকরাও ভাল করেই জানেন। তারপরেও তারা মিথ্যাকে আকড়ে ধরে টিকে থাকার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে আসছেন বিগত চার দশক ধরেই।জানি, রাজনীতিতে কোন শেষ কথা নেই।কিন্তু নীতির ক্ষেত্রে কিছু না কিছু শেষ কথাতো থাকতেই হবে।

(বিএনপির রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর লেখা এই প্রবন্ধটি দৈনিক বাংলা পত্রিকার ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ, ১৯৭৪ তারিখে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক পত্রিকা 'বিচিত্রা'-য় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তদানীন্তন উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম 'একটি জাতির জন্ম' শীর্ষক শিরোনামে লেখাটি পুনঃ প্রকাশিত হয় ।
লেখাটির অংশবিশেষ নীচে তুলে ধরলামঃ

“ ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনো হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্তরূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙ্গালী ও পাকিস্তানী সৈনিকদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল।১৩ই মার্চ শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়ার আলোচনা। আমরা সবাই ক্ষণিকের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।”

জিয়া তাঁর জীবদ্দশায় কোনদিন বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করেননি।কিন্তু আজ ক্ষ্মতার মসনদের লোভে আর হালুয়া রুটির ভাগীদার হতে বেগম জিয়া,গয়েশ্বরর রায়রা প্রশ্ন তুলছেন শহীদদের সংখ্যা নিয়ে, আর রিজভী সাহেব প্রশ্ন তুললেন স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান নিয়ে।মুজিব জেলে বন্দী ছিলেন সত্যি, কিন্ত যুদ্ধের ৯ মাসই তিনি ছিলেন মুক্তিকামী বাঙালীর বিপ্লবী চেতনায় মিশে।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার ঘোষিত হতো “ বঙবন্ধু আমাদের সাথেই আছেন” মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে শ্লোগান উঠতো, “তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব ,শেখ মুজিব। স্বাধীন দেশের জাতির পিতা শেখ মুজিব,শেখ মুজিব”, আর ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে বলেছিলেন, “mujib is a traitor,this time he will not go unpunished.”

আর রক্ত আর ধ্বংসের স্তূপে দাড়িয়েও তার আশাতেই অন্নদাশংকর লেখেন,
“ দিকে দিকে আজি অশ্রুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান,
তবু নাই ভয়,হবে হবে জয়,জয় মুজিবুর রহমান”
আর আজ ৪৪ বছর পরে এসেও কিছু কুলাঙ্গার বলে চলেছে,মুক্তিযুদ্ধে তার কোন অবদানই নেই! সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!!

পরিশেষে রিজভী সাহেবের জন্য হুমায়ুন আজাদ স্যারের “ আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম” থেকে সামান্য অংশ উদ্দৃত করে গেলাম,
“ বাঙলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে দিয়েছিলেন মুজিব, বন্দী থেকেও তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে, তিনিই সৃষ্টি করে চলছিলেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। মুজিবকে আমরা প্রচণ্ড সমালোচনা করতে পারি, কয়েক দশক ধরে তো কোটি কোটি বামন প্রাণভরে তাঁর সমালোচনা করছে।
কিন্তু সত্য হচ্ছে তিবি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাঙলাদেশের মহাস্থপতি।
মুজিব ছাড়া হাজার হাজার জিয়া বা অন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিলেও মুক্তিযুদ্ধ ঘটতো না, তখন সেটা হতো হাস্যকর হঠকারিতা ও পরিণতিতে শোকাবহ; মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসতো না,এবং বিশ্ব আমাদের পক্ষ নিতো না, সাড়া দিতো না। এটা ঘটেছিলো মুজিবের জন্যই। মুজিব বাঙলাদেশের স্থপতি, মহাস্থপতি; তিনি সৃষ্টি করে চলছিলেন বাঙলাদেশকে। তাঁকে ছাড়া বাঙলাদেশের কথা ভাবাই যায় না। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিলো, সাড়া বিশ্ব আমাদের পক্ষে ছিলো; আমেরিকা, চীন, আর অন্ধকারযুগাচ্ছন্ন মুসলমান দেশগুলো ছাড়া-ওগুলো যে কখন একবিংশ শতকে আসবে; তখন বিশ্বের পরিস্থিতি ভিন্ন ছিলো- আজকের পরিস্থিতিতে যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধে যেতাম, তাহলে হয়তো শোচনীয় পরিণতি মেনে নিতে হতো।
২৬-এ মার্চের দুপুরে আকাশবাণী বাঙলা ও ইংরেজীতে বারবার ঘোষণা করছিলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, সিভিল ওয়ার হ্যাজ ব্রোকেন আউট ইন ইস্ট পাকিস্তান’, তাতে ভয় পেয়েছিলাম, কেননা গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না, এবং ভয়াবহ ধারণা ছিলো, কিন্তু ২৮-এ মার্চে তা পরিণত হয় মুক্তিযুদ্ধে।
ওই ঘোষণায় বাঙলা ও ইংরেজীতে, কম্পিত ও আবেগস্পন্দিত কণ্ঠে স্পষ্ট করে বলা হয়, যদিও খুবই অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো, যে মুজিব জীবিত আছেন, তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুজিবের পক্ষে ঘোষণা পাঠ করছেন একজন মেজর, যাঁর নাম মেজর জিয়া।
কে মেজর জিয়া? তাঁর নাম তো কখনো শুনি নি।
একটি ঘোষণাপাঠের ফলে, তাঁর কাঁপাকাঁপা কণ্ঠের আবেগ, মুহূর্তেই তিনি এক নতুন নায়ক হিশেবে দেখা দেন। অনেক সময় হঠাৎ কেউ কেউ অসাধারণ হয়ে ওঠেন, এজন্যে লাগে সুযোগ ও আকস্মিকতা। কেউ হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হয়ে উঠতে পারেন না, কিন্তু কেউ কেউ হঠাৎ মেজর জিয়া হয়ে উঠে সারা দেশকে আলোড়িত করতে পারেন। এটা হঠাৎ আকাশে মহাগোলমাল থেকে উদ্ভুত নক্ষত্রের মতো। কিংবদন্তি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে মুহূর্তেই, আকস্মিকভাবে, ঐতিহাসিক সুযোগে; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হওয়ার জন্য লাগে দীর্ঘ সাধনা।
ওই কাঁপাকাঁপা, অনভ্যস্ত, স্খলিত বাঙলা ও ইংরেজি ঘোষণাটির আগে আমরা কি কেউ জানতাম কে মেজর জিয়া? তাঁর কণ্ঠস্বর ও ঘোষণা আমাদের সঞ্জীবিত করেছিলো, কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিলো আমাদের? কোনো ধারণা ছিলো না, কিন্তু মুহুর্তেই ধারণা হয়ে যায়, আমরা কল্পনায় একজন অদম্য তরুণ মেজর ও যোদ্ধাকে দেখতে পাই। তিনি যদি বলতেন, ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বলছি’, তাহলেও তিনি এতোটা দাগ কাটতে পারতেন না, আমরা হয়তো একজন ক্লান্ত বুড়ো মেজরের কথা ভাবতাম, যে পদোন্নতি পায় নি, দেহে শিথিল হয়ে গেছে, কেননা ওইটিই বাঙালিদের জন্য স্বাভাবিক ছিলো পাকিস্তানে; মেজর ও জিয়া, এ-দুটি শব্দের সমাবেশ খুবই উদ্দীপক ছিলো।
তবে এটি ছিলো এক ঐতিহাসিক আকস্মিকতা ও সুযোগ, যাতে একজন সাধারণ মেজর অসাধারণ যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন, সারা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি অপরিহার্য ছিলেন না, কালুরঘাটের বেতারযন্ত্রীরা যদি অন্য কোনো মেজরকে পেতেন, তাকে দিয়ে ঘোষণা করাতেন, তাহলে তিনিই হয়ে উঠতেন কিংবদন্তি।”
মুজিব তাই বঙ্গবন্ধু,মুজিব তাই জাতির পিতা।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব জনাব রিজভী আহমেদ সাহেব গত ২৮,১,২০১৬ তারিখে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী অনুষ্টানে তার দেয়া বক্তব্যে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে যার ভূমিকা নেই তাকেই জোর করে জাতির পিতা বানানো হচ্ছে”
কথাটি শুনে চমকে ওঠার কথা হলেও আমি চমকাইনি, কারণ বিএনপি নামক দলটি জন্মলগ্ন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে অধিকতর মহিমান্বিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারই এক নবতর সংযোজন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কোন অবদান নেই এই প্রপাগাণ্ডাটি। স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রপতি মুজিবের ভূমিকার সমালোচনা হতে পারে,তর্ক বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর কোন ভূমিকা নেই এই কথা কি তারা আসলেই বিশ্বাস করেন? নাকি স্রেফ বিরোধিতার স্বার্থেই বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মহানায়ককে নিয়ে এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার?

পাকিস্তানের ২৪ বছরের মধ্যে ১০ টি বছরই তাঁর কেটেছিল কারা অভ্যন্তরে।৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে মুজিব ছিলেন এক অনুপ্রেরণার কেন্দ্রস্থল।নিজ স্বকীয়তায় তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন হক,ভাসানী,সোরোয়ার্দীর মতো অগ্রজদের। তাঁর দীপ্তিময়তার পাশে নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিলেন তারা। পাক সামরিক জান্তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল মুজিব নামটি।তার ৬ দফাতে উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার অব্যক্ত আকাংখা।তার কন্ঠে ধ্বনিত “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা” শ্লোগানে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মর্মবাণী।আড়মোরা ভেঙে জেগে ওঠে বাঙালী।আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে ফাসিতে ঝোলানোর চেস্টা করেও ব্যর্থ হয় তারা। জনগণের বাঁধভাঙা জোয়ার জেলের তালা টুটতে বাধ্য করে। জনতার ভালোবাসায় সিক্ত মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে যান এভাবেই।ইতিহাস তার সাক্ষী।

৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তাঁর বজ্রকন্ঠে ভেসে আসে “ আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায় রাখতে পারবানা............এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা”।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় বলতে গেলে,
“তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হদৃয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি”
কার্যত স্বাধীনতা ঘোষিত হয় সেদিনই।তবু নাকি তাঁর কোন অবদান নেই স্বাধীনতা সংগ্রামে!! এতোবড় মিথ্যাচার করার আগে রিজভী সাহেবদের হৃদয় কি একবারো কেপে ওঠেনা?

এচাড়াও অপারেশন বিগ বার্ড অভিযানে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে বংগবন্ধু দিয়ে যান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা।স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, ২৫শে মার্চ কালরাত্রে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান যা ইপিআর এর ওয়ারলেস দ্বারা রিলে করা হয়। ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু বলেন,
‘পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহবান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবেলা করুন। এটাই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’’

পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকে ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজও এই মেসেজ গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। আওয়ামিলীগ নেতা মরহুম এম,এ,হান্নান চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথমে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।ইপিআর এর যে সুবেদার সেদিন এই ঘোষণাটি রিসিভ করেছিলেন, তাকে পাক বাহিনী এই অপরাধে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মেজর জিয়া তখন ব্যস্ত ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরে “সোয়াত” জাহাজ থেকে পাকিস্তানী অস্ত্র খালাসের পথে বাধা সৃষ্টিকারী ডক শ্রমিকদের শায়েস্তা করার কাজে। কর্ণেল অলি(তখন ক্যাপ্টেন) প্রথম জীপে করে ছুটে গিয়ে তাকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা করার সংবাদ দেন আর জিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেন “we revolt” বলে।
এটা কোন আওয়ামী প্রপাগাণ্ডা নয়।এটা হচ্ছে ৭১এর রক্তভেজা ইতিহাস।পরবর্তীতে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় “একটি জাতির জন্ম” আর্টিকেলে জিয়াউর রহমান নিজেই তা স্বিকার করেন।স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠক আর ঘোষককে এক করে ফেলার চেস্টা করে জিয়াকে কোনদিন বঙ্গবন্ধুর সমপর্যায়ে যে উঠিয়ে নেয়া যাবেনা ,সেটা জিয়ার সৈনিকরাও ভাল করেই জানেন। তারপরেও তারা মিথ্যাকে আকড়ে ধরে টিকে থাকার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে আসছেন বিগত চার দশক ধরেই।জানি, রাজনীতিতে কোন শেষ কথা নেই।কিন্তু নীতির ক্ষেত্রে কিছু না কিছু শেষ কথাতো থাকতেই হবে।

(বিএনপির রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর লেখা এই প্রবন্ধটি দৈনিক বাংলা পত্রিকার ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ, ১৯৭৪ তারিখে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক পত্রিকা 'বিচিত্রা'-য় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তদানীন্তন উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম 'একটি জাতির জন্ম' শীর্ষক শিরোনামে লেখাটি পুনঃ প্রকাশিত হয় ।
লেখাটির অংশবিশেষ নীচে তুলে ধরলামঃ

“ ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনো হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্তরূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙ্গালী ও পাকিস্তানী সৈনিকদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল।১৩ই মার্চ শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়ার আলোচনা। আমরা সবাই ক্ষণিকের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।”

জিয়া তাঁর জীবদ্দশায় কোনদিন বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করেননি।কিন্তু আজ ক্ষ্মতার মসনদের লোভে আর হালুয়া রুটির ভাগীদার হতে বেগম জিয়া,গয়েশ্বরর রায়রা প্রশ্ন তুলছেন শহীদদের সংখ্যা নিয়ে, আর রিজভী সাহেব প্রশ্ন তুললেন স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান নিয়ে।মুজিব জেলে বন্দী ছিলেন সত্যি, কিন্ত যুদ্ধের ৯ মাসই তিনি ছিলেন মুক্তিকামী বাঙালীর বিপ্লবী চেতনায় মিশে।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার ঘোষিত হতো “ বঙবন্ধু আমাদের সাথেই আছেন” মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে শ্লোগান উঠতো, “তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব ,শেখ মুজিব। স্বাধীন দেশের জাতির পিতা শেখ মুজিব,শেখ মুজিব”, আর ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে বলেছিলেন, “mujib is a traitor,this time he will not go unpunished.”

আর রক্ত আর ধ্বংসের স্তূপে দাড়িয়েও তার আশাতেই অন্নদাশংকর লেখেন,
“ দিকে দিকে আজি অশ্রুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান,
তবু নাই ভয়,হবে হবে জয়,জয় মুজিবুর রহমান”
আর আজ ৪৪ বছর পরে এসেও কিছু কুলাঙ্গার বলে চলেছে,মুক্তিযুদ্ধে তার কোন অবদানই নেই! সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!!

পরিশেষে রিজভী সাহেবের জন্য হুমায়ুন আজাদ স্যারের “ আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম” থেকে সামান্য অংশ উদ্দৃত করে গেলাম,
“ বাঙলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে দিয়েছিলেন মুজিব, বন্দী থেকেও তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে, তিনিই সৃষ্টি করে চলছিলেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। মুজিবকে আমরা প্রচণ্ড সমালোচনা করতে পারি, কয়েক দশক ধরে তো কোটি কোটি বামন প্রাণভরে তাঁর সমালোচনা করছে।
কিন্তু সত্য হচ্ছে তিবি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাঙলাদেশের মহাস্থপতি।
মুজিব ছাড়া হাজার হাজার জিয়া বা অন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিলেও মুক্তিযুদ্ধ ঘটতো না, তখন সেটা হতো হাস্যকর হঠকারিতা ও পরিণতিতে শোকাবহ; মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসতো না,এবং বিশ্ব আমাদের পক্ষ নিতো না, সাড়া দিতো না। এটা ঘটেছিলো মুজিবের জন্যই। মুজিব বাঙলাদেশের স্থপতি, মহাস্থপতি; তিনি সৃষ্টি করে চলছিলেন বাঙলাদেশকে। তাঁকে ছাড়া বাঙলাদেশের কথা ভাবাই যায় না। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিলো, সাড়া বিশ্ব আমাদের পক্ষে ছিলো; আমেরিকা, চীন, আর অন্ধকারযুগাচ্ছন্ন মুসলমান দেশগুলো ছাড়া-ওগুলো যে কখন একবিংশ শতকে আসবে; তখন বিশ্বের পরিস্থিতি ভিন্ন ছিলো- আজকের পরিস্থিতিতে যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধে যেতাম, তাহলে হয়তো শোচনীয় পরিণতি মেনে নিতে হতো।
২৬-এ মার্চের দুপুরে আকাশবাণী বাঙলা ও ইংরেজীতে বারবার ঘোষণা করছিলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, সিভিল ওয়ার হ্যাজ ব্রোকেন আউট ইন ইস্ট পাকিস্তান’, তাতে ভয় পেয়েছিলাম, কেননা গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না, এবং ভয়াবহ ধারণা ছিলো, কিন্তু ২৮-এ মার্চে তা পরিণত হয় মুক্তিযুদ্ধে।
ওই ঘোষণায় বাঙলা ও ইংরেজীতে, কম্পিত ও আবেগস্পন্দিত কণ্ঠে স্পষ্ট করে বলা হয়, যদিও খুবই অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো, যে মুজিব জীবিত আছেন, তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুজিবের পক্ষে ঘোষণা পাঠ করছেন একজন মেজর, যাঁর নাম মেজর জিয়া।
কে মেজর জিয়া? তাঁর নাম তো কখনো শুনি নি।
একটি ঘোষণাপাঠের ফলে, তাঁর কাঁপাকাঁপা কণ্ঠের আবেগ, মুহূর্তেই তিনি এক নতুন নায়ক হিশেবে দেখা দেন। অনেক সময় হঠাৎ কেউ কেউ অসাধারণ হয়ে ওঠেন, এজন্যে লাগে সুযোগ ও আকস্মিকতা। কেউ হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হয়ে উঠতে পারেন না, কিন্তু কেউ কেউ হঠাৎ মেজর জিয়া হয়ে উঠে সারা দেশকে আলোড়িত করতে পারেন। এটা হঠাৎ আকাশে মহাগোলমাল থেকে উদ্ভুত নক্ষত্রের মতো। কিংবদন্তি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে মুহূর্তেই, আকস্মিকভাবে, ঐতিহাসিক সুযোগে; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হওয়ার জন্য লাগে দীর্ঘ সাধনা।
ওই কাঁপাকাঁপা, অনভ্যস্ত, স্খলিত বাঙলা ও ইংরেজি ঘোষণাটির আগে আমরা কি কেউ জানতাম কে মেজর জিয়া? তাঁর কণ্ঠস্বর ও ঘোষণা আমাদের সঞ্জীবিত করেছিলো, কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিলো আমাদের? কোনো ধারণা ছিলো না, কিন্তু মুহুর্তেই ধারণা হয়ে যায়, আমরা কল্পনায় একজন অদম্য তরুণ মেজর ও যোদ্ধাকে দেখতে পাই। তিনি যদি বলতেন, ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বলছি’, তাহলেও তিনি এতোটা দাগ কাটতে পারতেন না, আমরা হয়তো একজন ক্লান্ত বুড়ো মেজরের কথা ভাবতাম, যে পদোন্নতি পায় নি, দেহে শিথিল হয়ে গেছে, কেননা ওইটিই বাঙালিদের জন্য স্বাভাবিক ছিলো পাকিস্তানে; মেজর ও জিয়া, এ-দুটি শব্দের সমাবেশ খুবই উদ্দীপক ছিলো।
তবে এটি ছিলো এক ঐতিহাসিক আকস্মিকতা ও সুযোগ, যাতে একজন সাধারণ মেজর অসাধারণ যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন, সারা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি অপরিহার্য ছিলেন না, কালুরঘাটের বেতারযন্ত্রীরা যদি অন্য কোনো মেজরকে পেতেন, তাকে দিয়ে ঘোষণা করাতেন, তাহলে তিনিই হয়ে উঠতেন কিংবদন্তি।”
মুজিব তাই বঙ্গবন্ধু,মুজিব তাই জাতির পিতা। [
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব জনাব রিজভী আহমেদ সাহেব গত ২৮,১,২০১৬ তারিখে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী অনুষ্টানে তার দেয়া বক্তব্যে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে যার ভূমিকা নেই তাকেই জোর করে জাতির পিতা বানানো হচ্ছে”
কথাটি শুনে চমকে ওঠার কথা হলেও আমি চমকাইনি, কারণ বিএনপি নামক দলটি জন্মলগ্ন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে অধিকতর মহিমান্বিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারই এক নবতর সংযোজন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কোন অবদান নেই এই প্রপাগাণ্ডাটি। স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রপতি মুজিবের ভূমিকার সমালোচনা হতে পারে,তর্ক বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর কোন ভূমিকা নেই এই কথা কি তারা আসলেই বিশ্বাস করেন? নাকি স্রেফ বিরোধিতার স্বার্থেই বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মহানায়ককে নিয়ে এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার?

পাকিস্তানের ২৪ বছরের মধ্যে ১০ টি বছরই তাঁর কেটেছিল কারা অভ্যন্তরে।৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে মুজিব ছিলেন এক অনুপ্রেরণার কেন্দ্রস্থল।নিজ স্বকীয়তায় তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন হক,ভাসানী,সোরোয়ার্দীর মতো অগ্রজদের। তাঁর দীপ্তিময়তার পাশে নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিলেন তারা। পাক সামরিক জান্তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল মুজিব নামটি।তার ৬ দফাতে উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার অব্যক্ত আকাংখা।তার কন্ঠে ধ্বনিত “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা” শ্লোগানে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মর্মবাণী।আড়মোরা ভেঙে জেগে ওঠে বাঙালী।আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে ফাসিতে ঝোলানোর চেস্টা করেও ব্যর্থ হয় তারা। জনগণের বাঁধভাঙা জোয়ার জেলের তালা টুটতে বাধ্য করে। জনতার ভালোবাসায় সিক্ত মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে যান এভাবেই।ইতিহাস তার সাক্ষী।

৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তাঁর বজ্রকন্ঠে ভেসে আসে “ আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায় রাখতে পারবানা............এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা”।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় বলতে গেলে,
“তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হদৃয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি”
কার্যত স্বাধীনতা ঘোষিত হয় সেদিনই।তবু নাকি তাঁর কোন অবদান নেই স্বাধীনতা সংগ্রামে!! এতোবড় মিথ্যাচার করার আগে রিজভী সাহেবদের হৃদয় কি একবারো কেপে ওঠেনা?

এচাড়াও অপারেশন বিগ বার্ড অভিযানে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে বংগবন্ধু দিয়ে যান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা।স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, ২৫শে মার্চ কালরাত্রে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান যা ইপিআর এর ওয়ারলেস দ্বারা রিলে করা হয়। ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু বলেন,
‘পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহবান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবেলা করুন। এটাই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’’

পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকে ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজও এই মেসেজ গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। আওয়ামিলীগ নেতা মরহুম এম,এ,হান্নান চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথমে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।ইপিআর এর যে সুবেদার সেদিন এই ঘোষণাটি রিসিভ করেছিলেন, তাকে পাক বাহিনী এই অপরাধে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মেজর জিয়া তখন ব্যস্ত ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরে “সোয়াত” জাহাজ থেকে পাকিস্তানী অস্ত্র খালাসের পথে বাধা সৃষ্টিকারী ডক শ্রমিকদের শায়েস্তা করার কাজে। কর্ণেল অলি(তখন ক্যাপ্টেন) প্রথম জীপে করে ছুটে গিয়ে তাকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা করার সংবাদ দেন আর জিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেন “we revolt” বলে।
এটা কোন আওয়ামী প্রপাগাণ্ডা নয়।এটা হচ্ছে ৭১এর রক্তভেজা ইতিহাস।পরবর্তীতে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় “একটি জাতির জন্ম” আর্টিকেলে জিয়াউর রহমান নিজেই তা স্বিকার করেন।স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠক আর ঘোষককে এক করে ফেলার চেস্টা করে জিয়াকে কোনদিন বঙ্গবন্ধুর সমপর্যায়ে যে উঠিয়ে নেয়া যাবেনা ,সেটা জিয়ার সৈনিকরাও ভাল করেই জানেন। তারপরেও তারা মিথ্যাকে আকড়ে ধরে টিকে থাকার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে আসছেন বিগত চার দশক ধরেই।জানি, রাজনীতিতে কোন শেষ কথা নেই।কিন্তু নীতির ক্ষেত্রে কিছু না কিছু শেষ কথাতো থাকতেই হবে।

(বিএনপির রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর লেখা এই প্রবন্ধটি দৈনিক বাংলা পত্রিকার ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ, ১৯৭৪ তারিখে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক পত্রিকা 'বিচিত্রা'-য় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তদানীন্তন উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম 'একটি জাতির জন্ম' শীর্ষক শিরোনামে লেখাটি পুনঃ প্রকাশিত হয় ।
লেখাটির অংশবিশেষ নীচে তুলে ধরলামঃ

“ ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনো হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্তরূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙ্গালী ও পাকিস্তানী সৈনিকদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল।১৩ই মার্চ শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়ার আলোচনা। আমরা সবাই ক্ষণিকের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।”

জিয়া তাঁর জীবদ্দশায় কোনদিন বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করেননি।কিন্তু আজ ক্ষ্মতার মসনদের লোভে আর হালুয়া রুটির ভাগীদার হতে বেগম জিয়া,গয়েশ্বরর রায়রা প্রশ্ন তুলছেন শহীদদের সংখ্যা নিয়ে, আর রিজভী সাহেব প্রশ্ন তুললেন স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান নিয়ে।মুজিব জেলে বন্দী ছিলেন সত্যি, কিন্ত যুদ্ধের ৯ মাসই তিনি ছিলেন মুক্তিকামী বাঙালীর বিপ্লবী চেতনায় মিশে।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার ঘোষিত হতো “ বঙবন্ধু আমাদের সাথেই আছেন” মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে শ্লোগান উঠতো, “তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব ,শেখ মুজিব। স্বাধীন দেশের জাতির পিতা শেখ মুজিব,শেখ মুজিব”, আর ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে বলেছিলেন, “mujib is a traitor,this time he will not go unpunished.”

আর রক্ত আর ধ্বংসের স্তূপে দাড়িয়েও তার আশাতেই অন্নদাশংকর লেখেন,
“ দিকে দিকে আজি অশ্রুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান,
তবু নাই ভয়,হবে হবে জয়,জয় মুজিবুর রহমান”
আর আজ ৪৪ বছর পরে এসেও কিছু কুলাঙ্গার বলে চলেছে,মুক্তিযুদ্ধে তার কোন অবদানই নেই! সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!!

পরিশেষে রিজভী সাহেবের জন্য হুমায়ুন আজাদ স্যারের “ আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম” থেকে সামান্য অংশ উদ্দৃত করে গেলাম,
“ বাঙলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে দিয়েছিলেন মুজিব, বন্দী থেকেও তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে, তিনিই সৃষ্টি করে চলছিলেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। মুজিবকে আমরা প্রচণ্ড সমালোচনা করতে পারি, কয়েক দশক ধরে তো কোটি কোটি বামন প্রাণভরে তাঁর সমালোচনা করছে।
কিন্তু সত্য হচ্ছে তিবি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাঙলাদেশের মহাস্থপতি।
মুজিব ছাড়া হাজার হাজার জিয়া বা অন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিলেও মুক্তিযুদ্ধ ঘটতো না, তখন সেটা হতো হাস্যকর হঠকারিতা ও পরিণতিতে শোকাবহ; মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসতো না,এবং বিশ্ব আমাদের পক্ষ নিতো না, সাড়া দিতো না। এটা ঘটেছিলো মুজিবের জন্যই। মুজিব বাঙলাদেশের স্থপতি, মহাস্থপতি; তিনি সৃষ্টি করে চলছিলেন বাঙলাদেশকে। তাঁকে ছাড়া বাঙলাদেশের কথা ভাবাই যায় না। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিলো, সাড়া বিশ্ব আমাদের পক্ষে ছিলো; আমেরিকা, চীন, আর অন্ধকারযুগাচ্ছন্ন মুসলমান দেশগুলো ছাড়া-ওগুলো যে কখন একবিংশ শতকে আসবে; তখন বিশ্বের পরিস্থিতি ভিন্ন ছিলো- আজকের পরিস্থিতিতে যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধে যেতাম, তাহলে হয়তো শোচনীয় পরিণতি মেনে নিতে হতো।
২৬-এ মার্চের দুপুরে আকাশবাণী বাঙলা ও ইংরেজীতে বারবার ঘোষণা করছিলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, সিভিল ওয়ার হ্যাজ ব্রোকেন আউট ইন ইস্ট পাকিস্তান’, তাতে ভয় পেয়েছিলাম, কেননা গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না, এবং ভয়াবহ ধারণা ছিলো, কিন্তু ২৮-এ মার্চে তা পরিণত হয় মুক্তিযুদ্ধে।
ওই ঘোষণায় বাঙলা ও ইংরেজীতে, কম্পিত ও আবেগস্পন্দিত কণ্ঠে স্পষ্ট করে বলা হয়, যদিও খুবই অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো, যে মুজিব জীবিত আছেন, তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুজিবের পক্ষে ঘোষণা পাঠ করছেন একজন মেজর, যাঁর নাম মেজর জিয়া।
কে মেজর জিয়া? তাঁর নাম তো কখনো শুনি নি।
একটি ঘোষণাপাঠের ফলে, তাঁর কাঁপাকাঁপা কণ্ঠের আবেগ, মুহূর্তেই তিনি এক নতুন নায়ক হিশেবে দেখা দেন। অনেক সময় হঠাৎ কেউ কেউ অসাধারণ হয়ে ওঠেন, এজন্যে লাগে সুযোগ ও আকস্মিকতা। কেউ হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হয়ে উঠতে পারেন না, কিন্তু কেউ কেউ হঠাৎ মেজর জিয়া হয়ে উঠে সারা দেশকে আলোড়িত করতে পারেন। এটা হঠাৎ আকাশে মহাগোলমাল থেকে উদ্ভুত নক্ষত্রের মতো। কিংবদন্তি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে মুহূর্তেই, আকস্মিকভাবে, ঐতিহাসিক সুযোগে; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হওয়ার জন্য লাগে দীর্ঘ সাধনা।
ওই কাঁপাকাঁপা, অনভ্যস্ত, স্খলিত বাঙলা ও ইংরেজি ঘোষণাটির আগে আমরা কি কেউ জানতাম কে মেজর জিয়া? তাঁর কণ্ঠস্বর ও ঘোষণা আমাদের সঞ্জীবিত করেছিলো, কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিলো আমাদের? কোনো ধারণা ছিলো না, কিন্তু মুহুর্তেই ধারণা হয়ে যায়, আমরা কল্পনায় একজন অদম্য তরুণ মেজর ও যোদ্ধাকে দেখতে পাই। তিনি যদি বলতেন, ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বলছি’, তাহলেও তিনি এতোটা দাগ কাটতে পারতেন না, আমরা হয়তো একজন ক্লান্ত বুড়ো মেজরের কথা ভাবতাম, যে পদোন্নতি পায় নি, দেহে শিথিল হয়ে গেছে, কেননা ওইটিই বাঙালিদের জন্য স্বাভাবিক ছিলো পাকিস্তানে; মেজর ও জিয়া, এ-দুটি শব্দের সমাবেশ খুবই উদ্দীপক ছিলো।
তবে এটি ছিলো এক ঐতিহাসিক আকস্মিকতা ও সুযোগ, যাতে একজন সাধারণ মেজর অসাধারণ যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন, সারা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি অপরিহার্য ছিলেন না, কালুরঘাটের বেতারযন্ত্রীরা যদি অন্য কোনো মেজরকে পেতেন, তাকে দিয়ে ঘোষণা করাতেন, তাহলে তিনিই হয়ে উঠতেন কিংবদন্তি।”
মুজিব তাই বঙ্গবন্ধু,মুজিব তাই জাতির পিতা।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:১২

সাঈফ শেরিফ বলেছেন: পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সাথে যে ছাত্র নেতাটির আত্মত্যাগ জড়িয়ে আছে তার নাম শেখ মুজিব । ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি বলেই বহু বিলম্বে শেখ মুজিবের উপলব্ধি হয়েছিল যে তিনি পাকিস্তানি নন, বাঙালি । আপনি পশ্চিম বাংলায় গিয়ে বলুন যে এককালের গর্বিত পাকিস্তানী নেতাকে তারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে মানবে কিনা ।

আওয়ামীলীগ হলো পাকিস্তানের মাটিতে জন্ম নেয়া উর্দু নামের একটা দল।

বি এন পির জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে, বাংলাদেশ নাম ধারণ করে ।

২| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:২৭

আহমেদ রশীদ বলেছেন: হুমম বুজঝি আপনি পাকিস্তানের একটা কীট!!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.