নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লেখালেখি

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতিচারণঃ একজন উত্তমকুমারের বন্ধু

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:০১

বাংলায় ‘দৃষ্টিবিভ্রম’ বলে একটা শব্দ আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে Illusion বা Hallucination. সাধারণত ধু ধু মরুভূমি বা কূলকিনারাহীন বিস্তীর্ণ সমুদ্রে মানুষের দৃষ্টিবিভ্রম হয়। যার এই সমস্যা হয়, সে কিন্তু বুঝতে পারেনা। মনে করে সে যা দেখছে, তা’ সত্যি। কাছাকাছি যাওয়ার পর তার ভুল ভাঙ্গে। এই কারণে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি না থাকলে মরুভূমি ও সাগরে পথ হারিয়ে ফেলা খুবই স্বাভাবিক।

কিন্তু শহরের রাস্তাঘাটে, বাড়িঘরে বা দোকানপাটে এ ধরণের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটা অস্বাভাবিক। তারপরেও কখনো কখনো আমাদের অনেকের ক্ষেত্রে এমনটি হয়। যেমন মজিবর ভাইয়ের কথাই ধরুন। তিনি বয়সে আমার চেয়ে সাত আট বছরের বড়। আমার বড়ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, দৃষ্টিবিভ্রম মজিবর ভাইয়ের আজন্ম সমস্যা। তিনি যে চোখে কম দেখেন, তা’ নয়। ভালো করে লক্ষ্য করেন না বলে প্রায়ই তিনি ভুল দেখেন। আমার বড়ভাইয়ের মতো দেখতে কোন লোক হয়তো রেস্টুরেন্টে বসে চা খাচ্ছে। মজিবর ভাই রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে যাবার সময় তাঁকে দেখে ফেললেন। ব্যস্, পা টিপে টিপে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পেছন থেকে লোকটির পিঠে এক রাম থাবড়া মেরে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘আবে শহীদ, একা একা চা খেতে ভালোই লাগছে, না?’
তারপর লোকটির সামনের চেয়ারে বসে মজিবর ভাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে গেলেন। লোকটি যে তাঁর বাল্যবন্ধু শহীদ নয় সেটা বুঝতে পেরে তিনি কাঁচুমাচু মুখে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন এবং কোনমতে ‘ভাই, কিছু মনে করবেন না’ বলে তড়িৎ গতিতে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন।

বাজারের চিপা গলির ভেতর ভাতিজা আলমকে একদিন সিগারেট খেতে দেখে মজিবর ভাই পেছন থেকে তার কান ধরে টান দিতে গিয়ে আর একটু হলেই অপদস্থ হচ্ছিলেন আর কী! শেষ মুহূর্তে ছেলেটি মুখ ফেরানোয় তিনি বেঁচে যান। মজিবর ভাইয়ের এই সমস্যার কারণে তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরাও বিড়ম্বনায় পড়ে। বিয়েবাড়িতে হৈ চৈ ভিড়ভাট্টার মধ্যে মজিবর ভাই তাঁর স্ত্রীর ঘাড়ে হাত দিয়ে হয়তো বিয়েবাড়ির আলোকসজ্জার দিকে স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। দেখা গেল, যার ঘাড়ে তিনি পেছন থেকে হাত রেখেছেন তিনি তাঁর স্ত্রী নন। তাঁর স্ত্রী হয়তো তাঁর নিজের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। এসব ক্ষেত্রে যা হয়! অচেনা ভদ্রমহিলার হাতে ঠাস্ করে একটা চড় খেয়ে তিনি একশো আশি ডিগ্রী এ্যাঙ্গেলে ঘুরে গিয়ে নিজের স্ত্রীর মুখোমুখি হন। তারপর অচেনা ভদ্রমহিলার কণ্ঠে ভয়াবহ গালি গালাজ, ‘অসভ্য, ইতর, ছোটলোক, শয়তান! রবির আব্বা, এদিকে এসো তো। এই বদমাশ লোকটা আমার গায়ে..................।’ মজিবর ভাই তাঁর স্ত্রীর হাত ধরে পড়িমরি করে ভিড়ের মধ্যে পালিয়ে বাঁচেন।

ছোট মেয়েটি কলেজে পড়ে। উঠতি বয়স। প্রেম ভালোবাসা করবে এটাই স্বাভাবিক। মজিবর ভাই বাড়িতে তাঁর এই মেয়েটির উদ্দেশ্যে ভীষণ তর্জন গর্জন করছেন। কালো মতো বখাটে একটা ছেলের সাথে মেয়েকে দেখা গেছে। ঐ ছেলেকে মজিবর ভাই ভালো করেই চেনেন। মুরুব্বীদের সামনে সে ভুস ভুস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। আদব লেহাজ বলে কিছু নেই। এমন বাজে একটা ছেলের সাথে তাঁর মেয়ে............? ভাবা যায় না। ভাবতে গেলে মজিবর ভাইয়ের কান গরম হয়ে যায়।
মেয়ের মা বললেন, ‘তুমি কখন দেখলে?’
‘এই তো ঘণ্টাখানেক আগে। বাজার থেকে ফেরার সময়।’
‘ঝর্ণা তো সকাল থেকে বাড়িতেই আছে। তাকে তুমি বাইরে দেখলে কীভাবে?’
‘কেন, সে আজ কলেজে যায়নি?’
‘কলেজ আজ বন্ধ।’ ঘর থেকে বেরিয়ে ঝর্ণা তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ফেললো। বললো, ‘শবে মেরাজের ছুটি।’
‘ওহ্ হো! তাহলে বোধ হয় অন্য কেউ হবে।’ ভুল দেখাটা খুবই স্বাভাবিক। তাই মজিবর ভাই নির্বিকার চিত্তে মা ও মেয়ের সামনে থেকে সরে গেলেন।

ছেলে অর্ণবকে সিনেমা হলের সামনে দেখা গেছে। বাড়িতে টেলিভিশনে এত সিনেমা দেখেও ছেলের মন ভরছে না। রিক্সাওয়ালা কুলি কামিনদের সাথে হলে বসে সিনেমা দেখতে হবে কেন? অর্ণব এক ঘণ্টা ধরে ধ্বস্তাধস্তি করেও তার বাবাকে বোঝাতে পারছে না যে, সে হলে সিনেমা দেখতে যায়নি। এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা হলে সিনেমা দেখতে যায় না। সিডি, ডিভিডি, পেন ড্রাইভ, ইন্টারনেট এসব থাকতে ছারপোকার কামড় খেতে কেউ হলে যায়? কিন্তু মজিবর ভাই ছেলের সাফাই শুনে সন্তুষ্ট নন। তিনি ছেলের মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘সিনেমার কী জঘন্য নাম! পীরিতি কারে কয়! নাম শুনলেই বমি আসে। কেন বাবা, বাড়িতে বসে ইটিভি জিটিভিতে উত্তম সুচিত্রার সিনেমা দেখা যায় না?’
মজিবর ভাই উত্তম সুচিত্রার খুব ভক্ত। আমার বড়ভাই মারা যাবার পর একদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘একজন উত্তমকুমার চলে গেল রে! তোর বড়ভাই দেখতে অবিকল উত্তমকুমারের মতো ছিল।’
আমি বললাম, ‘ভাই, আমার মনে হয় এ জন্যেই আপনার মানুষ চিনতে ভুল হয়। আমার বড়ভাই দেখতে সুশ্রী ছিলেন সেটা ঠিক। কিন্তু উত্তমকুমারের মতো না।’
মজিবর ভাই আমার সাথে তুমুল তর্ক জুড়ে দিলেন। বললেন,‘তুই শহীদের ভাই হতে পারিস। কিন্তু আমার চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠভাবে তাকে দেখিস নি। আমি শহীদের ছোটবেলার বন্ধু। আমার চেয়ে তুই বেশি জানিস?’
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ‘জি না।’
‘তাহলে চুপ করে থাক।’

পঁয়ষট্টি বছর বয়সে স্ট্রোক করার পর মানুষকে চিনতে ভুল করার এই সমস্যা আরও প্রকট হলো মজিবর ভাইয়ের। ছেলে মেয়ে কাউকেই আর চিনতে পারতেন না। আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গেলে তিনি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। তারপর একদিন তিনি চলে গেলেন তাঁর ছোটবেলার বন্ধু একজন উত্তমকুমারের কাছে। তাঁর দৃষ্টিবিভ্রমের জন্য এখন আর কেউ বিব্রত হয়না। তিনিও যাকে তাকে দেখে সোল্লাসে ‘কি রে কেমন আছিস’ বলে ভুল করার পর আর বিব্রত হয়ে কেটে পড়েন না।
( সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:২৫

তার আর পর নেই… বলেছেন: ভুল করার ঘটনা গুলো খুব মজার। তবে শেষের দিকের ভুলে যাওয়ার অসহায়ত্ব কষ্টদায়ক।

ভাল লেগেছে।

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪৭

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ তার আর পর নেই।
ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা রইল।

২| ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:২৬

কল্লোল পথিক বলেছেন: ভাল লেগছে।

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪৮

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই কল্লোল পথিক।
ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৩| ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:২৭

বিজন রয় বলেছেন: ভাল লিখেছেন।
++++

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪৯

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই বিজন রয়।
ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা রইল।

৪| ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:০৬

হাসান মাহবুব বলেছেন: কত বিচিত্র চরিত্রের সাথে পরিচিত হচ্ছি আপনার লেখাগুলো পড়ে হেনা ভাই! মজিবর ভাইয়ের আত্মার শান্তি কামনা করি। আশা করি জান্নাতের বাগানে ঠিকঠাক পথ বুঝে নিয়ে পৌঁছুতে পারবেন, কোনো দৃষ্টিবিভ্রম ব্যতিরেকেই।

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫২

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই হাসান মাহবুব। মজিবর ভাই খুব সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাঁর জন্য আপনার দোয়া নিশ্চয় আল্লাহর দরবারে পৌঁছাবে।
ভালো থাকবেন। শুভকামনা রইল।

৫| ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:২৮

মোঃ সাইফুল্লাহ শামীম বলেছেন: মানব জীবনের অতি সুক্ষ বিষয়গুলো খুবই সাধারণ ভাবে, আবার খুবই সাধারণ বিষয়গুলো অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তোলার একটা অদ্ভূত ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে আপনার ভেতর। যতই পড়ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি!
প্রচন্ড হাসির পর শেষ দিকে এসে বিশাল একটা ধাক্কা আপনার এই সত্য গল্পটিকে অত্যন্ত ............কিভাবে প্রশংসা করবো আর ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
বেঁচে থাকুন আপনি, বেঁচে থাকুক আপনার গল্পগুলো!

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫৯

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই সাইফুল্লাহ শামীম। আমার লেখাগুলো আপনাদের অন্তরে বেঁচে থাকলেই আমি বেঁচে থাকবো। সশরীরে আমার বেঁচে থাকাটা অত জরুরী নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে একদিন তো চলে যেতেই হবে। তারপরেও আমার জন্য আপনার মঙ্গল কামনার জন্য
আমি কৃতজ্ঞ রইলাম।
ভালো থাকবেন। শুভকামনা রইল।

৬| ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:০৭

জুন বলেছেন: গল্পটি পড়ে অনেকক্ষন ভাবলাম মজিবর ভাইকে নিয়ে । সহজ সরল একজন মানুষ ।
কিন্ত আপনি তার চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত দক্ষতায় ।
মুগ্ধ হয়ে গেলুম । আপনার ভাইকে যেন খুজে পায় সেই দোয়াই করি ।
+

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:১০

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ জুন। আসলেই মজিবর ভাই খুব সহজ সরল মানুষ ছিলেন। আপনার দোয়া যেন কবুল হয়।
ভালো থাকবেন। শুভকামনা রইল।

৭| ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:২৯

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: কষ্টদায়ক এক বিভ্রম, আপাত দৃষ্টিতে যা হয়ত কিছুটা মজার। আল্লাহ্‌ উনাকে বেহেশত নসীব করুন।

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:০৮

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই।
আপনার দোয়া যেন আল্লাহ কবুল করেন।
ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা রইল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.