নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লেখালেখি

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতিচারণঃ ঠিকানা

১৩ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ২:৫০

আমাদের শহরে গনকপাড়া নামে একটা বাণিজ্যিক এলাকা আছে। পুরাতন ও নতুন অবকাঠামো মিলিয়ে জায়গাটা ব্যাবসা বাণিজ্যের জন্য বেশ জমজমাট স্থান। ব্যাংক, বীমা, গার্মেন্টস, ইলেকট্রনিক্স, ফার্মেসী, হোটেল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি প্রায় সব ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের হাঁক ডাকে এলাকাটি সারাদিন গম গম করে। স্বাধীনতার আগে গনকপাড়ার কয়েকটি ছোট ছোট চায়ের দোকান খুব বিখ্যাত ছিল। সে সময় এই চায়ের দোকানগুলো শুধু চা আর বিস্কুট বিক্রি করতো। মোষের ঘন দুধ মিশিয়ে উন্নতমানের চা-পাতা দিয়ে তৈরি করা এসব দোকানের চা ছিল খুবই সুস্বাদু। এই চা খাওয়ার জন্য শহরের প্রায় সব এলাকার মানুষ সকাল থেকে রাত নটা দশটা পর্যন্ত দোকানগুলোর সামনে ভিড় জমাতো। দোকানদাররাও ভিড় সামলাতে হিমশিম খেত। স্বাধীনতার পরেও কয়েক বছর এই অবস্থা বজায় ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আমাদের মহল্লার সমবয়সী বন্ধুদের সাথে আমিও নিয়মিত বিকেলবেলা সেখানে চা খেতে যেতাম। তখন আমি কলেজের ছাত্র। সেই ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমি গনকপাড়ার চা (এই নামেই বিখ্যাত) খেতে যাই। তবে এখন আমার এই যাওয়াটা অনিয়মিত হয়ে গেছে। আগের মত আর রোজ রোজ যাওয়া হয়না। হয়তো সপ্তাহে একদিন বা মাসে দু’মাসে একদিন যাওয়া হয়।

চল্লিশ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। দোকানগুলোর মালিক ছিল প্রধানতঃ ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে আসা উর্দুভাষী মোহাজিররা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা অনেকেই পাকিস্তান চলে যায়। রাস্তা চওড়া করার জন্য ভাংচুর হওয়ায় অনেকেই তাদের দোকান হারিয়ে অন্য পেশায় চলে যায়। অনেকে এই চল্লিশ বছরে মারাও গেছে। সর্বশেষ যে দু’তিনটি দোকান ছিল, সেগুলোর এখন বেহাল অবস্থা। চায়ের স্বাদ আর আগের মত নেই। ফলে সেই রমরমা ব্যবসাও আর নেই। আমরা যে দোকানে চা খেতে যেতাম, সৌভাগ্যক্রমে সেটি এখনও টিকে আছে। এই দোকানের মালিক রহমতুল্লাহ মারা যাওয়ার পর তার ছেলে বরকতুল্লাহ দোকানের হাল ধরেছে। সেও প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। বাহাত্তর সালে আমরা যখন গনকপাড়ায় চা খেতে যেতাম, তখন বরকতুল্লাহর বয়স ছিল বার তের বছর। সে তার বাবাকে দোকানের কাজে সাহায্য করতো। তিনটি বড় বড় লাকড়ির চুলার একটিতে বিশাল হাঁড়িতে সারাদিন পানি ফুটতো, একটিতে বড় সসপ্যান ভর্তি ঘন দুধ জ্বাল হতে হতে লাল হয়ে যেতো আর একটিতে ফোটানো পানি ভর্তি বড় বড় তিনটি কেটলি বিরামহীনভাবে রহমতুল্লাহর হাতে ওঠা নামা করতো। টিনের তৈরি বিশাল ট্রেতে করে চা নিয়ে বরকতুল্লাহ দোকানের সামনে ভিড় জমানো খদ্দেরদের কাছে পৌঁছে দিতো। কেউ চাইলে সাথে একটা বা দু’টা নোনতা বিস্কুট। পর্যাপ্ত বসার জায়গা না থাকায় অধিকাংশ খদ্দেরই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেয়ে চলে যেতো। বরকতুল্লাহর বয়সী একজন কর্মচারী ছোকরাও কাজ করতো দোকানে। রমরমা বেচাকেনা। রহমতুল্লাহর সাহায্যকারী না হলে চলবে কেন? দোকানের কোন সাইনবোর্ড ছিলনা। রহমতুল্লাহর চা বললেই সবাই চিনে ফেলতো।

সেই দোকান এখন চালায় তার ছেলে বরকতুল্লাহ। কিন্তু দোকানের সেই রমরমা দিন আর নেই। লাকড়ির চুলা উঠে গিয়ে একটা মাত্র পাম্প করা কেরোসিনের চুলা জ্বলে। সেই চুলার এক পাশে গরম পানির জন্য একটা আর এক পাশে গরুর দুধের জন্য একটা কেটলি। কনডেনসড্ মিল্কের কৌটাও রয়েছে। তবে অনেকে কনডেনসড্ মিল্কের চা খেতে চায়না বলে কেটলিতে সামান্য কিছু দুধ রাখা হয়।

বরকতুল্লাহ ইতিমধ্যে বুড়ো হয়ে গেছে। তার চুল দাড়িতে পাক ধরেছে। বরকতুল্লাহর বউ ছেলে নাই। বাবা মা তো অনেক আগেই দুনিয়াছাড়া। একজন বাঙালী ছেলেকে পেটে ভাতে কর্মচারী নিয়ে সে দোকান চালায়। চায়ের মান একেবারে জাহান্নামে গেছে। অন্ততঃ তার বাবার আমলের তুলনায়। তবু নস্টালজিয়ার টানে আমি এখনও মাঝে মধ্যে সেই দোকানে চা খেতে যাই আর চা খাওয়ার সময়টুকু বরকতুল্লাহর সাথে গল্প করি। বিস্বাদ চা খাওয়ার পরেও আগের সেই চা খাওয়ার অনুভূতি হয়। গনকপাড়ার চা।

আমি নিজেও বুড়ো হয়ে গেছি। তবু বরকতুল্লাহ আমাকে চিনতে পেরে এখনও সমাদর করে বসায়। গরম পানি দিয়ে ভালো করে কাপ ধুয়ে চা দেয়। ওর চোখের সামনেই দিনে দিনে বুড়িয়ে গেলাম বলে আমাকে চিনতে ওর কখনো ভুল হয়না। আমি জিজ্ঞেস করলে বলে, না স্যার, আপনার বন্ধুদের কেউ আর এখন আসেনা। শুধু আপনিই আসেন।

আচ্ছা বরকত মিয়া, তোমার কি মনে আছে আমরা আট দশ জন বন্ধু মিলে দল বেঁধে আসতাম আর হৈ চৈ করতে করতে তোমার বাবার হাতের চা খেতাম?

বরকতুল্লাহ ম্লান হেসে বলে, মনে থাকবেনা স্যার? খুব মনে আছে। আপনারা চা খেয়ে মাঝে মাঝে আমাকে দু’এক আনা বখশিশ দিয়ে যেতেন। সেসব দিনের কথা কি ভোলা যায়, স্যার?

বরকত মিয়া, তুমি কি এখনও উর্দুতে কথা বলতে পারো?

বোলনা ঠিক সে আতা নেহি স্যার। বিহারী লোগ সব চলে গ্যায়ে। মেরা আপনা তো কোই নেহি। বোলনে কা মওকা কাহাঁ?

তা তুমিও তো ওদের মতো পাকিস্তান চলে যেতে পারতে!
বরকতুল্লাহ এ কথার কোন জবাব দেয়না।

একই প্রশ্ন আর একদিন করায় সে মৃদু হেসে বলে, স্যার আমরা হলাম না ঘরকা, না ঘাটকা। আমার জন্ম তো এ দেশেই। জন্মভূমি ছেড়ে কোথায় যাবো, স্যার? জিনা ইঁহা, মরনা ভি ইঁহা। আমি বাংলাদেশের মাটিতেই মরতে চাই, স্যার। কাঁহি নেহি যানা।

এ বছর একুশের বইমেলা উপলক্ষে আমার একটি উপন্যাসের বিক্রয় কার্যক্রম তদারকির জন্য আমি পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ঢাকায় ছিলাম। সেখান থেকে ফিরে মার্চের মাঝামাঝি একবার গনকপাড়ায় চা খেতে যাওয়ার সুযোগ হলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি, বরকতুল্লাহর দোকান বন্ধ। আশেপাশের দোকান গুলোতে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, বরকত মিয়া মারা গেছে। শেষের দিকে তার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ধার দেনা করে চিনি, চা-পাতা আর দুধ কিনে সে দোকান চালাতো। মারা যাওয়ার সময় তার ক্যাশ বাক্সে টাকা পয়সা তেমন ছিলনা। এই গনকপাড়ার দোকানদাররাই চাঁদা তুলে তার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেছে। টিকাপাড়া গোরস্থানে তার মাটি হয়েছে।

চা না খেয়ে ফিরে আসার সময় রিক্সায় বসে আমার কেন যেন মনে হলো, বরকতুল্লাহ তার স্বজাতির লোকদের মতো হেরে যায়নি। এদেশে জন্মে এদেশের মাটিতেই সে তার চিরস্থায়ী ঠিকানা করে নিয়েছে। হ্যাটস্ অফ টু ইউ, বরকত মিয়া।
*******************
[ এই গল্পটি সাপ্তাহিক রাজশাহী বার্তার আগস্ট/ ২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম। ]
রি-পোস্ট।

মন্তব্য ২২ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (২২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ২:৫৮

কল্লোল পথিক বলেছেন: স্যার আমরা হলাম না ঘরকা, না ঘাটকা। আমার জন্ম তো এ দেশেই। জন্মভূমি ছেড়ে কোথায় যাবো, স্যার? জিনা ইঁহা, মরনা ভি ইঁহা। আমি বাংলাদেশের মাটিতেই মরতে চাই, স্যার। কাঁহি নেহি যানা।

১৩ ই জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:০১

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: খুব গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো উদ্ধৃত করেছেন। ধন্যবাদ ভাই কল্লোল পথিক।
ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

২| ১৩ ই জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:৪৩

বিজন রয় বলেছেন: নিজের ঠিকানাই আসল।
++++

১৩ ই জুন, ২০১৬ রাত ৮:৩০

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: যথার্থই বলেছেন। ধন্যবাদ ভাই বিজন রয়।
ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৩| ১৩ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৫

সুমন কর বলেছেন: হ্যাটস্ অফ টু ইউ, বরকত মিয়া। -- ভালো লাগল।
+।

১৩ ই জুন, ২০১৬ রাত ৮:৩৩

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই সুমন কর।
ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৪| ১৪ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১০:০৫

হাসান মাহবুব বলেছেন: অনেক দিন পর লিখলেন। সব ভালো তো? লেখা ভালো লেগেছে।

১৪ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১১:২৪

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: হাঁ মাহবুব ভাই, বর্তমানে ভালোই আছি। দুটো পত্রিকার ঈদ সংখ্যার জন্য লেখা তৈরিতে ব্যস্ত থাকায় প্রায় এক মাস অনলাইনে ছিলাম না।
আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। শুভকামনা রইল।

৫| ১৪ ই জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:২০

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: বেশ মর্মস্পর্শী!

১৪ ই জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:২৮

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই রূপক বিধৌত সাধু।
ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৬| ১৪ ই জুন, ২০১৬ রাত ১১:২০

কালনী নদী বলেছেন: অনেকদিন পর আপনার স্মৃতিচারণ মূলক গল্প পড়ে ভাল লাগল!

১৫ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:০৯

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ কালনী নদী।
ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৭| ১৫ ই জুন, ২০১৬ সকাল ৮:৩৭

সাদা মনের মানুষ বলেছেন: বরকতুল্লার জন্য মনটা হু হু করে উঠল, আত্মীয় স্বজন ছাড়া জীবনটা কল্পনাই করা যায়না, ওর জন্য রইল ভালোবাসা

১৫ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:১৯

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ কামাল ভাই। দেশ স্বাধীন হবার পর প্রান্তিক শ্রেনীর অসহায় অবাঙ্গালীদের নিয়ে তেমন কোন লেখালেখি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বরকতুল্লাহ ছিল একেবারে ছোট একজন বালক। সে বাংলাদেশকে ভালোবাসতো। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে দেশ ত্যাগ করেনি। দারিদ্র্য ও অভাব অনটনের মধ্যেও সে মাটি কামড়ে পড়ে ছিল।

আপনার সংবেদনশীল মনের প্রতি শ্রদ্ধা রইল। ভালো থাকুন।

৮| ১৫ ই জুন, ২০১৬ সকাল ৮:৩৮

সাদা মনের মানুষ বলেছেন: গনকপাড়ায় যেন মান্না দে এর কফি হাউজের সেই বিষাদ মাখা সুরেরই আরেকটি চিত্রনাট্য রচিত হল।

১৫ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:২৩

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: আপনার ব্যস্ততার কারণে এই গনকপাড়া জায়গাটা আপনাকে দেখাতে পারিনি। মনেও ছিল না। ভবিষ্যতে দেখাবো কখনো ইনশাআল্লাহ।

৯| ১৫ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ২:২৬

সাদা মনের মানুষ বলেছেন: ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে গনকপাড়ায় যাওয়ার ইচ্ছেটা মনের মাঝে রাখলাম

১৬ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১১:৩৮

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: যাক, আবার দেখা হবে তাহলে।

১০| ১৬ ই জুন, ২০১৬ রাত ৮:৫৯

মাঈনউদ্দিন মইনুল বলেছেন:


শুরুতে গণকপাড়ায় অন্তত একবার যাবার বাসনা হয়েছিল। কিন্তু শেষে এসে সে ইচ্ছা মিইয়ে গেলো।

শেষের কথাগুলো আমারও।

১৭ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:২২

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ মইনুল ভাই। হ্যাটস অফ টু ইউ অলসো।

১১| ১৯ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:২৯

আরাফআহনাফ বলেছেন: "বরকতুল্লাহ তার স্বজাতির লোকদের মতো হেরে যায়নি। এদেশে জন্মে এদেশের মাটিতেই সে তার চিরস্থায়ী ঠিকানা করে নিয়েছে। হ্যাটস্ অফ টু ইউ, বরকত মিয়া।"
"মাঈনউদ্দিন মইনুল " ভাইয়ের মতো গল্পের শুরুতে গনকপাড়া যেতে ইচ্ছে হয়েছিলো, শেষে যা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে গেলো যেন!

+++++হেনা ভাই জয়তু।

১৯ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:৪২

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই আরাফআহনাফ। ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.