নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লেখালেখি

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ একটি জাল নোটের আত্মকাহিনী

২৬ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৯:১৫

আমি একশো টাকার একটি বাংলাদেশী জাল নোট। বাংলাদেশী হলেও আমার জন্ম কিন্তু পাকিস্তানে। এক বছর আগে সে দেশের এক শহরে একটি দোতলা বাড়ির ওপর তলার এক ঘরে আমার জন্ম। সে ঘরের দরজা জানালা সব সময় বন্ধ থাকে। ভেতরে বসে তিন চারজন লোক আমাদের জন্ম দেয়। সেখানে কম্পিউটার, স্ক্যানার, প্রিন্টারসহ অত্যাধুনিক আরও অনেক যন্ত্রপাতি ও কেমিক্যাল নিয়ে তারা কাজ করে। আমার আরো হাজার হাজার যমজ ভাইয়ের জন্ম হচ্ছে সেই ঘরে। আমার মেজভাই পাঁচশো টাকা ও বড়ভাই হাজার টাকারও জন্ম হচ্ছে সেখানে। আরো আশ্চর্য কি জানেন? রূপি দাদা ও ডলার আংকেলেরও জন্ম হচ্ছে একই ঘরে।

আমার জন্মের মাত্র পনের দিন পর আমার অন্যান্য ভাইদের সাথে প্যাকেটবন্দী হয়ে আমি বাংলাদেশে চলে আসি। ব্যাগের মধ্যে অন্ধকারে পড়ে থাকলেও আমরা যে বিমানে চড়ে আকাশপথে বাংলাদেশে আসছি সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। একজন পাকিস্তানি সুন্দরী মহিলা শাহজালাল বিমান বন্দরের বাইরে অন্য একজন সুন্দরী বাংলাদেশি মহিলার কাছে আমাদের ব্যাগটা হস্তান্তর করে ঢাকার একটি পাঁচ তারা হোটেলে চলে যান।

এরপর নানারকম লোকের হাত ঘুরে আমি এক পাইকারি গরু বিক্রেতার হাতে এসে পড়ি। আমার অন্যান্য ভাইরা এ হাত ও হাত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে তাদের কারো কারো সাথে দেখা হলেও বেশিক্ষণ একসাথে থাকার সুযোগ হয়নি। গরু বিক্রেতার সৌজন্যে অল্পদিনের মধ্যে বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় আমার সফর করা হয়ে যায়। সফরের এক পর্যায়ে আবার ঢাকায় ফিরে এলে মতিঝিলের এক ব্যাংকের লোকেরা কি একরকম যন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে এবং আমাকে আনফিট ঘোষণা করে টাকার বান্ডিল থেকে বের করে দেয়। যে লোকটি আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল, সে আমাকে দু’ভাঁজ করে পকেটে ভরে বাসায় নিয়ে আসে। কিছুদিন তার বাসায় আলমারির মধ্যে থাকার পর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে আমার সাথে আরো একটি কুড়ি টাকার আসল নোট দিয়ে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট কিনে লোকটি কেটে পড়ে। সিগারেট বিক্রেতা ছোকরা পরে বুঝতে পারলেও চাল ডাল তেল লবণ কেনার সময় সে এক মুদি দোকানদারের কাছে আমাকে চালান করে দেয়। দিনশেষে ক্যাশ মেলানোর সময় আমি ঐ দোকানের কর্মচারীদের হাতে ধরা পড়লেও পরদিন আমি কিভাবে কিভাবে যেন বাবুবাজারের এক পাইকারি চালের আড়তদারের হাতে এসে পড়ি। আড়তদার একশো টাকার বান্ডিলের মধ্যে লুকিয়ে আমাকে ব্যাংকে জমা দিতে গেলে ব্যাংকের লোকেরা আমাকে চিনতে পেরে আবার বের করে দেয়।

উপায়ন্তর না দেখে আড়তদার লোকটি তার ঠিকাদার ছোট ভাইয়ের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে আমার একটা গতি করতে বলে। ছোট ভাই আরো এক কাঠি সরেস। রোড এন্ড হাইওয়েজের এক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে ঘুষ দেয়ার সময় একতাড়া নোটের মধ্যে লুকিয়ে আমাকে সে চালান করে দেয়। পরদিন তার ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়ার কথা।

কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ওয়ার্ক অর্ডারে সই না করে ঠিকাদারকে মোবাইল ফোনে ডেকে পাঠালেন। টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমাকে বের করে নোংরা ফেলার মতো করে ঠিকাদারের সামনে ফেলে দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার সাথে দু’নম্বরি? এই নোটটা এখনই বদলে দেন।’ ঠিকাদার ছেলেটি লাইটের আলোয় আমাকে ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখে লজ্জিত হবার ভান করে বলল, ‘সরি, স্যার। আজকাল ব্যাংক থেকেও জাল নোট দিচ্ছে। আমরা কি করবো স্যার বলেন? আমি এখুনি বদলে দিচ্ছি, স্যার।’

এরপর ঠিকাদারের সাইট ম্যানেজারের হাত ঘুরে আমি এসে পড়লাম দৌলতদিয়ার এক পতিতার হাতে। দেহ বিক্রির টাকায় সে পতিতাপল্লীর মুদি দোকানে চাল ডাল কিনতে গেলে দোকানদার আমাকে নিতে রাজি হলনা। পতিতা মেয়েটি কেঁদে কেটে অস্থির। তবে এই পল্লীতে থেকে সে ইতিমধ্যে অনেক ছলা কলা শিখে ফেলেছে। পরদিন মোটাসোটা এক খদ্দেরের কাছ থেকে ফি পাওয়ার পর সে একটা আসল একশো টাকার নোট কৌশলে সরিয়ে ফেলে আমাকে খদ্দেরের হাতে দিয়ে বলল, ‘ফুর্তি করবার আইছেন জাল নোট নিয়া? বদলায়া দ্যান মিয়া!’

মোটা লোকটি সেতুর টোল আদায় করে। অতিরিক্ত ওজনের মালবাহী ট্রাক ছেড়ে দেয়ার জন্য সে ড্রাইভারদের কাছ থেকে চা পানি খাওয়ার পয়সা পায়। নিশ্চয় কোন হারামজাদা ড্রাইভার তাকে জাল নোটটি গছিয়ে দিয়েছে। সে আমাকে পকেটে রেখে পতিতা মেয়েটিকে একখানা আসল নোট দিয়ে মনে মনে বলল, ঠিক আছে, ব্যাটা তোদের টাকা আমি তোদের কাছেই উগরে দেব। দু’নম্বরি কাজে আমিও কম না।

এভাবে সত্যি সত্যিই আমি এক ড্রাইভারের হাতে এসে পড়লাম। ড্রাইভার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসছিল। পথে যাত্রা বিরতির ফাঁকে টিনের ছাউনি দেওয়া এক হোটেলের পেছন দিকের ঘরে এক হিজড়াকে দিয়ে গা মালিশ করিয়ে আমাকে তার হাতে গছিয়ে দিল সে। হিজড়া খুব খুশি। গা মালিশ করে সে পঞ্চাশ টাকার বেশি পায়না। আজ পেয়েছে একশো টাকা। সে আনন্দে ড্রাইভারের দেহের স্পর্শকাতর অঙ্গে আদর করে সুড়সুড়ি দিয়ে দিল এবং নিজের দু’হাতের তালুতে চাটা মেরে আমাকে চুমু দিয়ে ব্লাউজের ফাঁক গলিয়ে তার সমতল বুকের মধ্যে রেখে দিল।

এরপর আবার এক বোকা দোকানদারের হাত ঘুরে আমি চলে এলাম এক প্রাইমারী শিক্ষকের মানিব্যাগে। ভদ্রলোক পরে জাল নোট বুঝতে পেরে দোকানদারকে ফেরত দিতে গেলে দোকানদার ‘আমি দেইনি’ বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। অনেক ঝগড়াঝাঁটি করেও যখন কোন কাজ হলনা, তখন ‘ঠিক আছে, এই নোট কিভাবে চালাতে হয় আমি জানি’ বলে প্রাইমারী শিক্ষক নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে আমাকে ক’দিন তার নিজের কাছে রেখে দিলেন। তারপর একদিন ভ্যানগাড়িতে শাক সবজী, পিঁয়াজ রসুন নিয়ে এক হকার তাঁর বাড়িতে এলে তাঁর স্ত্রী শাক সবজী আর পিঁয়াজ রসুন কিনে আমাকে দিয়ে হকারের দাম শোধ করলেন। হকার লোকটা চোখে একটু কম দেখে। আমাকে এপিঠ ওপিঠ উল্টে দেখে হাসিমুখে পকেটে রেখে সে সালাম দিয়ে চলে গেল।

কিন্তু পরদিন ভোরে সে পাইকারি রেটে মাল কেনার জন্য মোকামে গেলে তার মহাজন বলল, ‘জয়নাল, এই জাল নোটটা তুমি পাইলা কই?’
‘জাল নোট!’ আমাকে হাতে নিয়ে প্রায় চোখের সাথে ঠেকিয়ে আবার ভালো করে দেখে জয়নাল বলল, ‘এইডা জাল নোট?’
মহাজন পানের পিক ফেলে হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি আধাকানা মানুষ। কেউ না কেউ চালায়া দিছে। তুমি বুঝবার পার নাই। নোটটা বদলায়া দাও। এরপর থাইকা সাবধানে ট্যাকা পয়সা নিও জয়নাল। দিনকাল ভালো না।’
জয়নাল গরিব মানুষ। বাড়িতে আটটা মুখ। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে শাক সবজী বেঁচে আটটা মুখে ভাতের যোগান দিতে হয় তাকে। আমি জাল নোট শুনে সে কেঁদে ফেলল। মহাজন সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আরে, তুমি কাঁনতাছ ক্যান্? তোমারে যেমন চালায়া দিছে, তুমিও তেমনি কারো কাছে চালায়া দিবা। দুনিয়ায় কত বোকা লোক আছে না!’
‘না, মহাজন।’ জয়নাল জামার আস্তিন দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘এই কাম আমি করবার পারুম না। আমি ঠকছি বইলা আর একজনরে ঠকাইতে পারুম না। এই নোট আমি অহনই পুড়াইয়া ফেলুম।’

জয়নাল হকারের কথা শুনে আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে গেল। সর্বনাশ! আমাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলবে? গরু ব্যবসায়ী, সিগারেট বিক্রেতা, দোকানদার, আড়তদার, ব্যাংকের লোক, ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার, সাইট ম্যানেজার, টোল কর্মচারী, ড্রাইভার, শিক্ষক এমনকি বেশ্যা ও হিজড়াও এই ব্যাটা হকারের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। আমি জাল নোট হলেও ওরা আমাকে মেরে ফেলেনি। আর এই কানা হকার লোকটা কি বদমাশ্! বলছে, আমাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলবে!

আর সত্যি সত্যিই বদমাশটা তাই করলো। পকেট থেকে ম্যাচ বের করে আগুন জ্বালিয়ে আমাকে পুড়িয়ে দিল। আমি পুড়ে সম্পূর্ণ ছাই না হওয়া পর্যন্ত বদমাশটা অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই দেখলো সে দৃশ্য। অথচ কেউ ‘ইন্নালিল্লাহ’ পর্যন্ত পড়লো না।
*****************************************************************************************************************
রি-পোস্ট

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৯:৪৫

করিম কাকা বলেছেন: এমনটাই হয় ক্ষতি ভালো মানুষেরই হয়।

২৬ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৯:৫০

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: চিরকাল এমনটাই হয়ে এসেছে। তারপরেও দুনিয়াতে ভালো মানুষ থাকে। তা' না হলে ভালো মন্দের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে শুধু মন্দ লোকের কারণে মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেত।

ধন্যবাদ করিম কাকা। ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

২| ২৬ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৯:৪৫

হাসান মাহবুব বলেছেন: বেশ উত্তেজনাপূর্ণ গল্প। এই থিম নিয়ে আরো লিখতে পারেন। ভালোই লাগলো।

২৬ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৯:৫১

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ হাসান মাহবুব ভাই।

ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৩| ২৬ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৯

খোলা মনের কথা বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন। একটি গল্প কিন্তু আপনি সেটাকে জীবান্ত রুপ দিয়েছেন। খুব ভাল লাগলো। ভাল থাকবেন আবু হেনা ভাই

২৬ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:০৮

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ খোলা মনের কথা।

ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৪| ২৬ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৭

হাতুড়ে লেখক বলেছেন: অসাধারণ হইসে।

২৬ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:০৯

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ হাতুড়ে লেখক।

ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৫| ২৬ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১:৩৮

সুমন কর বলেছেন: ভালোই লাগল।

২৬ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:০৯

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ সুমন কর।

ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা রইল।

৬| ২৬ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১৫

মাঈনউদ্দিন মইনুল বলেছেন:

সব বদের জন্ম হয় ফাকিস্তানে....
শেষের বক্তব্যে 'আত্মকাহিনি নামের প্রচলিত রচনা' থেকে গল্প হয়ে গেলো। জাল নোটের সদগতি হলো। তবে ভ্রমণটা কিন্তু আনন্দেরই ছিলো :)

২৬ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৫

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: সব বদের জন্ম হয় ফাকিস্তানে..

আমার মনের মতো কথা। বড়ই তৃপ্তি পাইলাম মইনুল ভাই।

ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা রইল।

৭| ২৬ শে জুন, ২০১৬ রাত ৮:৩৫

শায়মা বলেছেন: ভাইয়া আবারও মুগ্ধ হলাম!!!!!!!!

২৭ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১:৩৯

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ বোন শায়মা।

ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৮| ২৭ শে জুন, ২০১৬ রাত ১:৫০

কালনী নদী বলেছেন: মুগ্ধ ভাইয়া!!

২৭ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১:৪০

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ কালনী নদী।

ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা রইল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.