নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জানার অদম্য ইচ্ছেসহ আগামীর পথে

এম্বিগ্রামিষ্ট জুলিয়ান

আমি প্রতিসাম্য তৈরি করতে ভালবাসি

এম্বিগ্রামিষ্ট জুলিয়ান › বিস্তারিত পোস্টঃ

হরর গল্পঃ প্রতিশোধ (২)

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৬

প্রথম পোষ্টের লিংকঃ Click This Link



তিন

স্বল্পসময়ের ব্যবধানে তিন তিনজন সহপাঠীকে হারিয়ে ক্লাসে শোকের ছায়া নেমে এল । তাও আবার তিনটা মৃত্যুই অস্বাভাবিক । স্যারেরাও ক্লাস নিতে এসে ঠিকমত পড়াতে পারছেন না । এরকমভাবে দুই সপ্তাহ অতিক্রান্ত হবার পর ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা ট্যুরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হল । গন্তব্য কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত । এ ঘোষণায় সবাই যেন একটু স্বস্তি পেল ।

কিন্তু রবির মন থেকে খচখচানিটা মোটেও যাচ্ছে না । তার মনে হচ্ছে তিনটা মৃত্যুর মধ্যে অবশ্যই একটা যোগসাজশ আছে । মৃত্যু যেন বেছে বেছে তাদের সার্কেলটাতেই হানা দিচ্ছে বারবার । সে, শুভ, তৌফিক, খালেদ, রশীদ এই পাঁচজন সবসময় একসাথেই থাকত । সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই তাদের মধ্যে দোস্তি । ক্লাশের অন্যান্যরা তো আর সাধেই তাদের “পঞ্চপান্ডব’’ বলে ডাকত না । কিন্তু এমন কেন হচ্ছে ?

তৌফিক নিজের রুমের মধ্যে মারা গেল ব্যাখ্যাতীতভাবে, অনেক রহস্যের জন্ম দিয়ে । যে রশীদ সাঁতার জানত না ভালোমত, সে অত রাতে পুকুরপাড়ে কি জন্য গিয়েছিল ? আর খালেদটাই বা রাতে বাড়ি থেকে দূরে জমিদারের কুয়োর ভিতর মরতে গেল কোন দুঃখে? আর ওর গলার, মুখের রহস্যময় দাগগুলো কিসের ?

এমন সব প্রশ্ন পাক খেতে লাগল রবির মাথায় । মনে মনে পিছনের দিনগুলো হাতড়াতে লাগল । মনে হল কি যেন একটা ধরেও ধরতে পারছে না । এ নিয়ে শুভর সাথেও আলোচনা করল । নিজের ভীতির কথা বলল । কিন্তু শুভ সেগুলো আমলেই নিল না । বরং তাকে বলল, “ তুই একটু বেশিই চিন্তা করছিস এই নিয়ে । মৃত্যু মানুষের যে কোন সময় হতে পারে । দুর্ঘটনাও যে কোন সময় ঘটতে পারে । চিন্তা বাদ দে । দেখবি ট্যুরে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে । আমাদের এখন একটু খোলামেলা পরিবেশ দরকার ।’’

ট্যুরের আয়োজন শেষ করতে করতে দু’সপ্তাহ সময় লেগে গেল । শেষে নির্ধারিত দিনে তিনটি বাসে করে ছাত্র-ছাত্রী আর স্যার-ম্যাডামেরা রওয়ানা দিল গন্ত্যব্যের দিকে । সকলেই খুশি । ছাত্রদের বাসে তীব্রস্বরে রকগান চলছে, হাসিঠাট্টা করছে সকলে, কেউ কেউ আবার মনের সুখে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে । কিন্তু এসবের কিছুই রবিকে স্পর্শ করছে না । সে একটা জানালার পাশে বসে বিরস বদনে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল ।

এত হাসি-আনন্দ-উত্তেজনার মাঝে কেউ খেয়াল করল না, একেবারে পিছনের সিটের নিচে একটা কালো রংয়ের বিড়াল চুপচাপ বসে আছে। এক দৃষ্টিতে সেটা নির্দিষ্ট একজনের দিকে তাকিয়ে আছে । ক্ষণিকের জন্যও পলক পড়ছে না অস্বাভাবিক লাল রংয়ের চোখদুটোতে ।

গন্তব্যে পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । ভাড়া করা হোটেলের সামনে বাস থেকে নেমে সবাই হইচই করতে করতে হোটেলে ঢুকতে লাগল । রবিও তার ব্যাগটা নিয়ে বাস থেকে নেমে হাঁটতে লাগল । হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ কানে ঢুকল তার । যেন দ্রুত পায়ে কিছু একটা দৌড়ে যাচ্ছে । পিছন ফিরে তাকাতে চোখের কোনে ধরা পড়ল কালোমত কি যেন একটা স্যাত করে একটা গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েকটা হার্টবিট মিস হল তার । তারপর হোটেলের ঝলমলে লবিতে ঢুকে পড়ল ।

পরপর দুটো দিন যেন ঝড়ের বেগে কেটে গেল তাদের । সারাদিন সৈকতে ঘোরাঘুরি, ইচ্ছামত গোসল করা, ছবি তোলা, কেনাকাটা আরও কত কি ! দ্বিতিয়দিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল রবির । ভাঙ্গার কারণটা অনুমান করতে কষ্ট হল না তার । প্রচণ্ড শীত করছে । ঘরে এসি চলছে । ডিজিটাল ইনডিকেটরে যে তাপমাত্রা দেখাচ্ছে তাতে তো এত শীত লাগার কথা নয় । পাশে চেয়ে দেখল শুভ সহ আরও দুজন অঘোরে ঘুমাচ্ছে । একটা চাদর টেনে আবার ঘুমাতে যাবে এমন সময় আওয়াজটা কানে গেল তার । মনে হচ্ছে কেউ যেন টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । শরীর কাটা দিয়ে উঠল । শব্দটা খুব কাছে কোথাও হচ্ছে বলে মনে হল । ভয়ে ভয়ে শব্দের উৎসের দিকে তাকাতে দেখতে পেল সেটাকে ।

ওদের পায়ের কাছে বিছানার উপর সাত-আট বছরের একটা ছোট ছেলে হাতদুটো কোলের উপর নিয়ে বসে । সারা শরীর ফ্যাকাশে সাদা, রক্তহীন । চোখের সাদা অংশের কোন অস্তিত্বই নেই । মুখ হা করে আছে । আর শব্দটা ওই মুখ থেকেই বের হয়ে আসছে । বুকফাটা চিৎকার করে উঠল রবি । চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠল অন্য তিনজন । ফ্যাকাশে মুর্তিটা ততক্ষণে গায়েব ।

“ কী হইছে রবি ?’’, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল শুভ ।

“একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি,’’ ঘটনাটা চেপে গেল রবি ।

পরদিন গাঁ কাঁপিয়ে জ্বর আসল রবির । রুমে থেকে গেল সে । আজই কক্সবাজারে তাদের শেষ দিন । তাই খুব মজা করল সকলে । রবির কথা মনে করে মন খারাপ লাগল শুভর । বেচারা আসতে পারল না । সন্ধ্যায় আর সবার সাথে হোটেলে ফিরছিল শুভ । হঠাৎ কি মনে করে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে । সর্বনাশ ! ডিজিটাল ক্যামেরাটা নেই । মনে পড়ল সর্বশেষ সৈকতে একটা ছাতার নিচে বীচ চেয়ারে বসেছিল । বোধহয় ওখানেই রয়ে গেছে । জায়গাটা বেশি দূরে নয় । জোর পায়ে গেলে সাত-আট মিনিট লাগবে । দৌড় লাগাল সে । কাউকে ডাকার প্রয়োজন মনে করল না ।

অন্ধকারে ডুবে আছে সৈকতটা । সাগরের গর্জন কানে আসছে । আশেপাশে কোন লোক দেখল না । লোকজন কি আজ সব তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরেছে নাকি ? জোর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল সে । আর অল্প একটু দুরেই তার গন্তব্য । মনে মনে যখন ভাবছিল ক্যামেরাটা থাকলে হয়, তখন হঠাৎই সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে কানে এল নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ । আর প্রায় সাথে সাথেই ভেসে এল গানের সুর- “এক পায়ে নুপুর আমার, অন্য পা খালি / এক পাশে সাগর, একপাশে বালি’’

হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পেল শুভর । কোন মেয়ের কণ্ঠস্বর এত সুরেলা হতে পারে !! সেই সাথে অবাক হয়ে ভাবল এত নির্জন সৈকতে একটা মেয়ে এখন কি করছে ? আরেকটু এগোতেই আলোটা চোখে পড়ল তার, সেই সাথে মেয়েটাও । সে যে জায়গার উদ্দেশ্যে এসেছে সেটায়ই বসে আছে মেয়েটা । শুভ নিঃশব্দে গিয়ে পিছে দাঁড়াল, তারপর উঁকি দিল সামনে । একটা ক্যামেরার স্ক্রিন থেকে আলোটা আসছে । শুভ অবাক হয়ে লক্ষ্য করল তারই ছবি দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনে । মেয়েটা এতক্ষন বসে বসে আমার ছবি দেখছিল !!

এতক্ষনে মেয়েটার পোশাকের দিকে চোখ পড়ল । চিনল সে । এখানে আসার প্রথম দিন থেকেই দেখছে সে । বলতে গেলে ও যেখানেই গেছে মেয়েটাকে দেখেছে । কালো পোশাক পরে থাকে সবসময় । সবচেয়ে অদ্ভুত হল, মেয়েটা একটা কালো বিড়াল পোষে । সব সময় তার সাথেই ঘোরে সেটা । তবে কি আমাকে পছন্দ করে ফেলল নাকি ?

“এক্সকিউজ মি,’’ বলে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শুভ ।

ক্যামেরা স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তাকাতে শুভর বাকি কথাগুলো গলায়ই থেকে গেল । তার দিকে যেটা তাকিয়ে আছে তার চোখ বলতে কিছু নেই । কোটরের ভিতর শুধুই অন্ধকার । সুচালো দুপাটি দাঁতকে আবৃত করে রাখার চামড়াটাও উধাও । কালো রংয়ের মাড়ি দেখা যাচ্ছে । সারা মুখে দগদগে ক্ষতচিহ্ন ।

শুভ জায়গায় জমে গেছে । ওই অবস্থায়ই দেখতে পেল উঠে দাঁড়াচ্ছে বিভীষিকাটা । হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেল শুভ । দৌড়াতে গিয়ে দেখল সাগরের পানি তার গোড়ালি পর্যন্ত উঠে এসেছে । দৌড়ে কিছুদুর যাবার পর থামতে হল ওকে । পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটার সাথে দেখা কালো বিড়ালটা কিন্তু পার্থক্য হল এখন ওটা আকারে অনেক বড় । যেইনা মাত্র থামল অমনি পিছন থেকে ঘাড়ের উপর এসে পড়ল মেয়েরূপী আতংক । দুজন মিলে পানিতে পড়ল মুখ থুবড়ে । সুচালো দাঁতগুলো ঘাড়ে বসতে ব্যাথায় চিৎকার করতে গেল শুভ কিন্তু মুখে পেল নোনা পানির স্বাদ ।

রবির জ্বর কমে গেছে প্রায় । রুমে শুয়ে আছে ও । অনেক রাতেও যখন শুভ রুমে ফিরল না তখন সে স্যারদের ব্যাপারটা জানাল । তখন একজন জুনিয়র টিচারসহ একটা দল খুঁজতে বের হল । আগেই ফোন দিয়ে দেখা হয়েছে শুভকে, ঢুকছে না । হাঁটতে হাঁটতে দলটা চলে এল সৈকতে । একটা ছেলে জানিয়েছে সন্ধায় নাকি ওখানেই শেষ দেখা গাছে তাকে । ছেলেটার কথামত জায়গায় এসে শুভর নাম ধরে জোরে জোরে ডাকতে লাগল সবাই । কিন্তু কোন সাড়া মিলল না ।

রবিরই প্রথম চোখে পড়ল জিনিসটা । তুলে নিল চেয়ার থেকে । শুভর ক্যামেরাটা । স্যারকে দেখাতেই বললেন,” আশেপাশেই কোথাও আছে হয়ত ।’’ মিনিট কয়েক পরে অর্ধেক পানিতে, অর্ধেক বালিতে এই অবস্থায় শুভর শরীর খুঁজে পাওয়া গেল । দূর থেকে শক্তিশালী টর্চের আলোতে কাউকে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে এসে শুভর লাশ দেখতে পেল সকলে । অবশ্য যেটুকু বাকি আছে শরীরের সেটুকু ।

কঠিন আক্রোশে শুভর শরীরের বিভিন্ন জায়গার মাংস খুবলে তুলে ফেলা হয়েছে । মুখ ধারালো কিছুর আঁচড়ে ফালা ফালা । চোখ দুটো কোটর থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে । হ্যাঁ করা মুখের ভিতর জিহ্বার কোন চিহ্নই নেই । শুধু কালচে লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে ভিতরে । দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে একজন বমি করে ফেলল । সেই মুহুর্তে বিনা নোটিশে অন হয়ে গেল রবির হাতে থাকা ক্যামেরাটা । ওটার স্ক্রিনে তাকিয়ে বিকট চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাল দুর্বল রবি ।



চার



বিকালবেলা মার্কেট থেকে টুকটাক কেনা-কাটা করে হলে ফিরছিল তানভীর । গেট দিয়ে ঢোকার সময় দেখল সাধারণ লোকজন, ছাত্ররা সব দৌড়ে যেন কোথাও যাচ্ছে ।

“কি হয়েছে ?’’, ছুটতে থাকা একজনকে জিজ্ঞাসা করল সে ।

“হলের পানির ট্যাংকে নাকি এক ছাত্রের লাশ পাওয়া গেছে’’, উত্তর দিল সে ।

বুক ঢিপঢিপ করে উঠল তার অমঙ্গল আশংকায় । তড়িঘড়ি করে এগোল সেও । হলের সামনেই পেল ভিড়টাকে । বুঝল লাশটা এখানেই রাখা হয়েছে । কষ্টে সৃষ্টে ভিড় ঠেলে এগোল সে । লাশের মুখ দেখে বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করল । সাদা কাপড়ে ঢাকা রবির লাশটা যেন তাকে বলছে, “ বলেছিলাম তোকে আগেই ।’’

আর দাঁড়াতে পারল না তানভীর । ভিড় থকে বেরিয়েই ছুটল নিজের রুম অভিমুখে । মনে পড়ছে সেদিনের কথা যেদিন রাতে রবি এসেছিল টার কাছে । চোখের নিচে কালি, চুল উষ্ক শুষ্ক, চোয়ালের হাড় বেরিয়ে গেছে, এক কথায় ভয়াবহ অবস্থা ছিল রবির । ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের দুইজন তাই সচরাচর দেখা হত না । তাই তাকে এই অবস্থায় দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খায় সে ।

“একি দোস্ত’’, অবাক হয়ে বলেছিল সে । “তোর এ অবস্থা কেন ?’’

“সব জানবি’’, উত্তরে বলেছিল রবি । “তবে আজ নয় । একটা রিকোয়েস্ট নিয়ে এসেছি । বল রাখবি ।’’

“আচ্ছা রাখব । কি বল ।’’

রবি পকেট থেকে ব্রাউন পেপারের একটা ইনভেলাপ বের করে দেয় । “এর ভিতর সব আছে । তোর প্রশ্নের উত্তর পাবি। রিকোয়েস্টটা হল , তোকে কথা দিতে হবে আমার কিছু না হবার আগ পর্যন্ত এটা খুলবি না আর আমাকে একটা প্রশ্নও করবি না । কথা দে ।”

“আচ্ছা, দিলাম ।”বলেছিল সে । আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায় রবি । ইনভেলাপটা এখনও ওই অবস্থায়ই আছে । এক লাফে সিঁড়ির তিনটা ধাপ টপকে উপড়ে উঠছে তানভীর । রুমে ফিরে টেবিলের ড্রয়ারটা টেনে খুলল । ভিতরে কিছুক্ষন হাতড়ে পেল জিনিসটা । হাত কাঁপছে ওর । একটানে ইনভেলাপের মুখ ছিঁড়ে উপুড় করে ধরল সেটা । হাতে এসে পড়ল ভাগ করা একটা কাগজ । পড়তে শুরু করল সে ।

“পাপের স্বীকারোক্তি বলতে পারিস এটাকে । যে পাপ করেছি আমি, যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি এখন সেই পাপ । আমরা পাঁচ বন্ধু সবসময় একসাথে থাকতাম আমি, রশিদ,খালেদ, শুভ, আর তৌফিক। যেখানে যেতাম, যা কিছু করতাম পাঁচজন মিলে করতাম।

ঘটনাটা যখনকার তখন আমরা সবে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। জুনিয়র ব্যাচ এসেছে। আমরা সিনিয়র হয়েছি সবে তাই জুনিয়রদের র‍্যাগ দেওয়াটা খুব উপভোগ করতাম । দিনে-রাতে যেকোন সময় ডেকে ওদের নানাভাবে হ্যারাজ করতাম । অকারণে অপমান করা, শারীরিকভাবে শাস্তি দেয়া , গালাগালি করা এগুলো করতাম নির্দ্বিধায় । আসলে আমরা ও তো এর মুখোমুখি হয়েছিলাম আগেই, তাই এগুলো করতে বিবেকে খুব একটা বাঁধত না । তবে সবকিছুরই একটা লিমিট থাকা উচিত, যা অতিক্রম করলে খারাপ কিছু ঘটতে বাধ্য। আমরা একদিন লিমিটটা ক্রস করে ফেললাম । আমরা বলতে পাঁচ জন ।

জুনিয়রদের মধ্যে রুদ্র নাম করে একটা ছেলে ছিল । নাম ওরকম হলে কি হবে, ছেলেটি ছিল ভদ্র আর খুব লাজুক । একারণে প্রায়শই র‍্যাগ দেবার সময় বলির পাঠা হতো ও । ওকে ঘাটাতে সবাই খুব মজা পেত । ওর মুখ দিয়ে খারাপ কথা বলিয়ে নেবার সময় যেভাবে ওর চোখ মুখ, কান, লাল হয়ে উঠত তা দেখে খুব আনন্দ পেতাম । অন্যান্য ছেলেরা মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ করলেও রুদ্র কোনদিন প্রতিবাদ করেনি । তাই আমরা ধরেই নিয়েছিলাম আমরা যাই বলি না কেন ও সেটা করবে।

তারপর একদিন একটা ঘটনায় আমরা পাঁচজন ওর উপর খুব রেগে যাই । সিদ্ধান্ত নেই রাতে ওকে একা ডেকে মনের ঝাল মেটাবো। সেই মতো রাতে ওকে পুকুর ঘাটে ডাকি । তখন শীতকাল ছিল । শীতও পড়েছিল প্রচণ্ড সেবার । ও আসে ভারী জামাকাপড়ে শরীর ঢেকে । সাড়া শীতকালই ওকে এরকম কাপড়চোপড়ে মোড়া অবস্থায় দেখতাম । কিন্তু কারণটা জিজ্ঞেস করা হয় নি । জিজ্ঞেস করলেই বোধহয় ভাল হত।

ও আসার পর যাচ্ছেতাই ভাষায় ওকে গালিগালাজ করিয়ামরা, অপমান করি । ও কাঁদতে শুরু করে দুঃখে, অপমানে । কিন্তু আমরা তখন বিবেকবর্জিত নরপশু একেকজন । শুভ বলে, “আর একটা কাজ করবি তারপর তোর ছাড়া, যা হাঁটু পানিতে গিয়ে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাক ।’’

“পারব না ।’’, মুখ শক্ত করে বলে রুদ্র । এমন উত্তর শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমরা । মাথায় রক্ত চড়ে যায় সবার । এত বড় আস্পর্ধা রুদ্রর !! মুখের উপর না বলল । শুভ উত্তেজিত হয়ে বলে, “ পারবি না মানে ?’’

“পারব না । সমস্যা আছে আমার’’, আবারও বলে রুদ্র ।

“সমস্যার গুল্লি মারি তোর । নাম শালা’’, বলে তাকে মৃদু ধাক্কা দেয় শুভ । পুকুরের বাঁধানো ঘাটের ধাপে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল দুজনে। মাত্র দুইধাপ নিচেই ঠাণ্ডা পানি । শুভর ধাক্কায় পিচ্ছিল ধাপ থেকে তাল হারিয়ে পানিতে পড়ে যায় রুদ্র ।

ও পানিতে পড়ে যেতেই যেন সম্বিত ফেরে আমার । এ আমরা কি করছি ? শেষে আমিই গিয়ে পানি থেকে তুলি ওকে । ওর মেসে নিয়ে যাই । পরদিন সকালেই প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে রুদ্র । দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । খবর পেয়ে বাড়ি থেকে ওর বাবা-মা চলে আসে । সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থার কোন উন্নতি না হওয়াতে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় । হাসপাতালে থাকতে ওর এক আত্মীয়ের কাছে শুনি, ছোটবেলা থেকেই ওর নিউমোনিয়ার প্রকোপ ছিল । শীতকালকে ও খুব ভয় পেত, ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারত না বলে ।

পরে বেশ কয়দিন নিয়মিত ফোনে খোঁজ নিতে থাকি আমি । খুব ভয় পেয়েছিলাম । ভেবেছিলাম ওর কিছু হলে আমরা ফেঁসে যাব । তারপর মাসদেড়েক পরে রুদ্রর বাবা এসে ওর ভর্তি বাতিল করে কাগজপত্র নিয়ে যায় । তারপর ওর আর কোন খবর পাইনি । ওই রাতে কি ঘটেছিল তা শুধু আমরা পাঁচজন আর রুদ্র জানত । ওর অসুস্থতাকে সবাই আকস্মিক বলে ধরে নিয়েছিল । তাই ও আর ফিরে না আসাতে আসল ঘটনাটা কেউ জানল না । আমরাও ওই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা মানে করে মনকে বুঝ দিলাম যে, এরকম তো অনেকেই করে ।

কিন্তু সেই রুদ্র যে এভাবে ফিরে আসবে আমরা কি তা ভাবতে পেরেছিলাম ? একে একে যখন তৌফিক, রশীদ আর খালেদ মারা গেল তখন কেন যেন মনে হল ওদের কাতারে আমাকেও দাঁড়াতে হবে একদিন । কিন্তু কেন ? শেষে শুভর বীভৎস মৃত্যুর দিন আমি কারণটা বুঝতে পারলাম । আমি ওকে দেখলাম ! রুদ্রকে দেখলাম আমি !! শুভর ক্যামেরা স্ক্রিনে দেখলাম রুদ্রর রুদ্রমুর্তি । উহ ! কি বীভৎস ! কি ভয়াবহ!!

অনেক খোঁজ খবর নিয়ে ওদের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে আমি যাই সেখানে । গিয়ে ওর সেই আত্মীয়ের কাছেই শুনি সব । রুদ্র সেই অসুস্থতা থেকে আর সেরে ওঠেনি । কয়াক মাস অসুস্থ থাকার পর কোমায় চলে যায় সে । তারপর প্রায় দুই বছর কোমায় থাকার পর মারা যায় ও । একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোকে ওর বাবা পাগল্প্রায় হয়ে যায় । উনি নাকি শেষদিকে বলতেন , “আমার ছেলের এ অবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের আমি ছাড়ব না ।” সবাই এটাকে পুত্রশোকে কাতর পিতার প্রলাপ বলে ধরে নিয়েছিল । তারপর তিনি নাকি স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় চলে গেছেন কেউ জানেনা ।

ওদের বাড়ি থেকে ফেরার পথেই প্রথমবার রুদ্রকে আমি সামনাসামনি দেখি । শুধু আমিই দেখি ওকে, আর কেউ না । তারপর থেকে প্রত্যেকদিন আমি ওকে দেখছি । যেখানে যাই না কেন অনুভব করতে পারি ওর উপস্থিতি । রাতে আরও বেশি করে অনুভব করি । আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে । আমি না পারি নড়াচড়া করতে, না পারি ওর ভয়াবহ দুই চোখ থেকে আমার চোখ সরাতে । যেন ওই দুই চোখ দিয়ে সে দিন দিন শুষে নিচ্ছে আমার প্রান । ও কি চাচ্ছে আমি জানিনা । কিন্তু আমি আর সহ্য করতে পারছি না । আর পারছি না..........’’

আর কিছু লেখা নেই কাগজে । একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তানভীর । র‍্যাগ নামক ঘৃণিত জিনিসটার উপর ঘৃণা আরও বাড়ল তার ।



পরিশিষ্ট.......



যোজন যোজন মাইল দূরে রহস্যময় ঘন কুয়াশায় ঢাকা গভীর, দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে এক জীর্ন কুটীরের জমাটবদ্ধ অন্ধকারের ভিতরে খুলে গেল এক জোড়া লাল শিরাযুক্ত চোখ । চোখদুটোর মালিকের দৃষ্টিটা গিয়ে পড়ল সামনে বসা ভিনদেশী লোকটার দিকে । তার কালো ঠোটের কোনে ফুটে থাকা নিঃশ্বব্দ হাসিই বলে দিচ্ছে, যে কাজ হাতে নিয়েছিল সে সফলভাবেই তার সমাপ্তি ঘটেছে ।



মন্তব্য ৫ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:১৪

শৈবাল সামি বলেছেন: এক দমে পড়ে ফেললাম। খুব ভালো লেগেছে।

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:৩০

এম্বিগ্রামিষ্ট জুলিয়ান বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে। সামনে আরও গল্প আসবে ইনশাল্লাহ । স্টে টিউণড---------

২| ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ভোর ৫:১৬

অপু তানভীর বলেছেন: একটানের পড়ে ফেললাম । চমৎকার একটা গল্প ।

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৯

এম্বিগ্রামিষ্ট জুলিয়ান বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে

৩| ২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ২:৪৮

BRITHA FOSOL বলেছেন: অসাধারন, তবে শেষের অংশটুকু পরিষ্কার না

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.