নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জানার অদম্য ইচ্ছেসহ আগামীর পথে

এম্বিগ্রামিষ্ট জুলিয়ান

আমি প্রতিসাম্য তৈরি করতে ভালবাসি

এম্বিগ্রামিষ্ট জুলিয়ান › বিস্তারিত পোস্টঃ

থ্রিলার বড় গল্পঃ হ্যালুসিনেক্সিন (১)

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:০৮



“ওয়াও। ইশশ”
চমকে উঠল শৈবাল। পরস্পর বিপরীতমুখী দুটি শব্দ একসাথে উচ্চারিত হয়েছে সীমান্তের মুখ থেকে। তার দিকে তাকালো সে। কোন কাজ নেই বলে শৈবাল-সীমান্ত দুজনে অলস সময় কাটাচ্ছে। শৈবাল একটা বই পড়ছে আর সীমান্ত একটা খাতা নিয়ে কি যেন করছে। সম্ভবত নতুন শেখা কোন কিছু নিয়ে সময় কাটাচ্ছে । সীমান্তের এই একটা অভ্যাস। নতুন একটা কিছু শিখলেই হল, সেটা নিয়ে মেতে উঠে। এই যেমন ড্যান ব্রাউনের “এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস” বইটা পড়ে এম্বিগ্রাম নিয়ে কিছুদিন খুব খাটাখাটুনি করেছিল। মাথা খাটিয়ে সে নিজের নাম, শৈবালের নামসহ আরও কিছু নামের এম্বিগ্রাম করে ফেলেছে। তা নিয়ে তার সে কি গর্ব! হয়ত আজও এমন কিছু করছে, ভাবল শৈবাল। কেননা গতকাল রাতে সে একটা বই পড়ে শেষ করেছে। খুব বিখ্যাত বই। দ্য ডা ভিঞ্চি কোড।

“কি হল ?”, প্রশ্ন করল শৈবাল।
তার দিকে তাকাল সীমান্ত। তার চোখে মুখে নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দ।
“আর বোলো না”, বলল সে। “একটা অক্ষরই সব গুবলেট করে দিল। ইশশ! কি চমৎকার একটা এনাগ্রাম হত।”

যা ভেবেছিলাম তাই, হাসল শৈবাল। ভিঞ্চি কোডের বিখ্যাত এম্বিগ্রামের কথা কে না জানে। ভিঞ্চি আর পিকাসোর কয়েকটা মাস্টারপিসের চমৎকার এনাগ্রাম। নিশ্চয়ই সীমান্ত এখন এগুলি প্রাকটিস করছে।

“আমাকে বলা যাবে?”, হাসিমুখে বলল শৈবাল।
“অবশ্যই”, বলল সীমান্ত। “দেখো, কি আবিষ্কার করেছি!”

হাতের প্যাডটা নিয়ে শৈবালের কাছে চলে এল। শৈবাল দেখল তার উপর ব্লক লেটারে একটা শব্দ লেখা রয়েছে। PATRIOT । আরও কিছু কাটাকুটি রয়েছে আশেপাশে।

সীমান্ত হাতের পেন্সিল দিয়ে শব্দটাকে নির্দেশ করে বলল, “এই শব্দটা নিয়ে এনাগ্রাম করার চেষ্টা করছিলাম। দারুন একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। দেখো, এই শব্দটা দিয়ে নতুন কি শব্দ বানানো যায়। সম্পুর্ন বিপরীত একটা শব্দ বানানোর দোরগোড়ায় চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন একটা অক্ষর সব গুবলেট করে দিল।”

“কি রকম?”, মনোযোগ দেয় শৈবাল।
“PATRIOT মানে হল দেশপ্রেমিক। দেশদ্রোহীর ইংরেজিটা কি বলতো ?”, সীমান্তের মুখে হাসি।
“TRAITOR,” বলল শৈবাল। “কেন?”
“PATRIOT শব্দটার দিকে তাকাও। দেখতো তোমার বলা শব্দটা পাও কি না।”

শৈবাল অক্ষরগুলো মেলাতে শুরু করল। কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারল সব। সত্যিই চমৎকার এনাগ্রাম হত। কিন্তু একটা অক্ষরই ভজগট পাকিয়েছে।

“ভাবতে পারো”, সীমান্তের কণ্ঠে এখনও উত্তেজনা। “যে শব্দটার মানে দেশপ্রেমিক, ঠিক তার একটা এনাগ্রামই দেশদ্রোহী শব্দটা হতো। যদি দেশপ্রেমিক শব্দটা RATRIOT হত বা দেশদ্রোহীর ইংরেজিটা TRAITOP হতো তাইলেই হত!! বেশি কিছু তো না ! P এর নিচে একটা মাত্র ছোট কোনাকুনি দাগ। ইশশ!!”

তার কণ্ঠের হাহাকারটা টের পেল শৈবাল। হাসল সে। বেচারা! বইটা আবার তুলে নিল। তারপর সীমান্তের দিকে না তাকিয়ে ফোঁড়ন কাটল,“ইংলিশ ভাষাবিজ্ঞানীদের রিকোয়েস্ট করে দেখতে পারো। তোমার কথা শুনতেও পারে তারা। অক্সফোর্ড ডিকশনারির পরবর্তি সংস্করণে দেশপ্রেমিক শব্দটার ইংরেজি প্রতিশব্দ RATRIOT করে দিতেও তো পারে তোমার এই আবিষ্কারের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে। হা হা হা।”

“হাসো হাসো”, বলল সীমান্ত। “আমার আবিষ্কারের সত্যিই একটা মাহাত্ম্য আছে। আমাদের এই দেশটার পরিপ্রেক্ষিতে এই আবিষ্কার বেশ অর্থবহ।”
“কেমন?”, এখনও শৈবালের মুখে হাসি।
“আমাদের দেশের কিছু তথাকথিত, স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকের কথা বলছি। মাঠে-ময়দানে, রাজপথে, টেলিভিশনের পর্দায় বিরামহীন দেশপ্রেমের বুলি কপচায় আর তলে তলে দেশটা বেচবার তালে থাকে, নিজের স্বার্থদ্ধারের ধান্দায় থাকে, দেশের ক্ষতি করে । এই সব দেশপ্রেমিকের একটা চমৎকার প্রতিশব্দ RATROIT । মানে TRAITOR । এরা দেশপ্রেমিক না। দেশপ্রেমিকের ছদ্মবেশে দেশদ্রোহী। RATRIOT শব্দটার ছদ্মবেশের আড়ালে TRAITOR”, সীমান্তের কণ্ঠে এবার ঘৃণা ঝরে।

হাসিটা থামিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় শৈবাল। বন্ধুবরের যুক্তিটা অকাট্য। সত্যিই ব্যাপারটা এরকম। দেশের জন্য কিছু না করে উল্টো দেশকে ধ্বংস করা আর দিনরাত অমুক তমুকের আদর্শের সৈনিক বলে মুখে ফেনা তোলা দেশদ্রোহের নামান্তর। সত্যিই এদের জন্য অভিধানে RATRIOT এর মত একটা শব্দের প্রয়োজন, যা দিয়ে এদের মত মানুষদের সংজ্ঞায়িত করা যায়।

রুমটার ভিতর অকস্মাৎ নিরবতা নেমে আসে। চুপচাপ দুজনে নিজের মতো ভাবতে থাকে।
“ওহ, তোমাকে তো একটা কথা বলা হয় নি,” নিরবতা ভঙ্গ করে সীমান্ত।
শৈবাল বই থেকে মুখ তুলে তাকায়। চোখে প্রশ্ন।
“আমার এক বন্ধু আজ তোমার সাথে দেখা করবে বলে এখানে আসতে চেয়েছে। আমি হ্যা বলে দিয়েছি। তোমার সাথে নাকি কথা আছে তার।”
“কে?,’’ প্রশ্ন করে শৈবাল।
“অয়ন,” বলল সীমান্ত। “আগে একবার আমার সাথে এখানে এসেছিল। মনে নেই তোমার?”

কিছুক্ষন ভাবতেই শৈবালের মনে পড়ে গেল। বেশ কয়েকমাস আগে একবার এসেছিল ফ্ল্যাটে। সে তখন টাকা জাল করে এমন একটা সংঘের মূলোৎপাটনের জন্য পুলিশের সাথে কাজ করছিল। তাই খুব ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছিল। কথাবার্তা তেমন হয়নি অয়নের সাথে।
“হ্যা মনে পরেছে,” বলল শৈবাল। “লম্বা চুলের সেই ছেলেটা। হাসলে মুখে টোল পড়ে।”
“তোমার তাও মনে আছে,” সীমান্ত অবাক হয়। তারপর আবার বলে।“ এবার বোধহয় সেই টোল পড়া হাসি আর দেখতে পাবেনা।”
“মানে?”
“মানে হল, ছয়দিন আগে অয়নের বাবা মারা গেছে। মেধাবী একজন কেমিস্ট ছিলেন ভদ্রলোক। বয়স বেশি হয়নি, কিন্তু হঠাৎই মারা গেলেন।”
“মারা গেলেন কিভাবে?”
অয়ন বলল যে রাতে বাসারই একটা কক্ষে মারা গেছেন। ডাক্তার বলেছে , হার্ট এটাক।
“সো, স্যাড,” বলল শৈবাল।

ঘড়িতে যখন সাড়ে দশটা বাজে তখন কলিংবেল বেজে উঠল। শৈবাল-সীমান্ত দুজনেই জানে কে এসেছে। একটু আগেই ফোন দিয়ে সীমান্তকে তার আসার কথা জানিয়েছে অয়ন। সীমান্ত গিয়ে দরজা খুলে দিল। তারপর অয়নকে নিয়ে এল শৈবালের কাছে।

অয়নকে দেখে মন খারাপ হয়ে গেল শৈবালের। সর্বদা হাসিখুশি ছেলেটা কেমন মনমরা হয়ে গেছে। চোখেমুখে কেমন উদ্ভ্রান্তভাব। মুখ ফোলা ফোলা, চোখেও লালচেভাব। নিদ্রাহীনতার সুস্পষ্ট ছাপ। সে বুঝল ছেলেটা খুব মানসিক যন্ত্রনার ভিতর দিনাতিপাত করছে। অয়ন তার কাধের ব্যাগটা একটা সোফার উপর রাখল। তারপর বসল শৈবালের মুখোমুখি।

“কেমন আছ অয়ন?,” অবান্তর হলেও প্রশ্নটা করল শৈবাল।
মুখভঙ্গি খুব একটা পরিবর্তন হলনা অয়নের। শুধুমাত্র ঠোঁটটা সামান্য প্রসারিত হল। মুখে টোল পড়তে না পরতেই মিলিয়ে গেল।
“এইতো,” বলল সে।

সীমান্ত তাদের থেকে সামান্য দূরে বসে আছে। সেও অবাক হয়ে গেছে অয়নকে দেখে। অয়নের সাথে বেশ কয়েকদিন সামনাসামনি দেখা হয়নি। শুধুমাত্র ফোনে যোগাযোগ ছিল। আগের দেখা অয়নের সাথে এই অয়নের কোন মিলই যেন পাচ্ছেনা। বুঝল শুধু বাবার মৃত্যুই এজন্য দায়ী নয়, আরও কোন ব্যাপার আছে।

“কি হয়েছে অয়ন?,’’ বলল শৈবাল, “কোন সমস্যা?”

হঠাতই অয়ন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অন্য দুইজন। সীমান্ত গিয়ে অয়নের পাশে বসল। একটা হাত রাখল তার কাঁধে। শৈবাল চোখ কুচকে তাকিয়ে আছে।
“আব্বুকে খুন করা হয়েছে,” কাঁদতে কাঁদতে বলল অয়ন। “আমি জানি আমার আব্বু হার্ট এটাক এ মারা যায় নি। তাকে খুন করা হয়েছে।’’
শৈবাল-সীমান্ত দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে পড়ল। এমন একটা কথা শুনবে তা তারা ভাবতেও পারেনি। শৈবাল নড়েচড়ে বসল।
“কে খুন করেছে তোমার আব্বুকে?,’’ প্রশ্ন করল শৈবাল।

হাত দিয়ে চোখ মুছল অয়ন। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল।
“আমি জানিনা,’’ বলল সে। “কিন্তু মৃত্যুর আগের দিনগুলোয় আব্বুকে কোন একটা ব্যাপার নিয়ে খুব চিন্তিত দেখেছি। সারাক্ষণ কেমন একটা তটস্থ ভাব ছিল তার মধ্যে।” থামল সে।
“আমাকে খুলে বল সবকিছু,” বুক পকেট থেকে ছোট একটা কাল রংয়ের নোটবুক বের করল শৈবাল। নিত্যসঙ্গী জিনিসটা তার। “একেবারে প্রথম থেকে। তোমার এরকম সন্দেহের কারন কি। কি দেখে তোমার মনে হয়েছে তোমার আব্বু হার্ট এটাক এ মারা যায় নি, যেখানে ডাক্তাররা সেরকমই রায় দিয়েছে?”

সীমান্তও নড়েচড়ে বসল। নিমেষে ব্যাপারটা সিরিয়াস হয়ে গেছে। সে ভাবতেও পারেনি তার কোন বন্ধুর বাবার মৃত্যুরহস্যের কিনারা করার জন্য একদিন শৈবালের মাথা ঘামাতে হবে।

“আব্বু একটা হাইটেক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে কাজ করতেন ,’’ শুরু করল অয়ন। “কোম্পানিটা চট্টগ্রামে। তিন বছর আগে সেটা কাজ শুরু করে। প্রথম থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল অত্যন্ত উন্নতমানের সব ঔষধ তৈরি করা , যা এতদিন শুধু পাশ্চাত্য সব দেশেই উৎপাদিত হত। তার জন্য তারা বিভিন্ন দেশ থেকে মেধাবী সব লোককে নিয়োগ দিতে থাকে। আর বাংলাদেশের যেসব মেধাবীরা বিদেশে কর্মরত তাদেরও অনেককে প্রস্তাব পাঠায়। আমার আব্বুকেও পাঠিয়েছিল। আব্বু তখন যুক্তরাষ্ট্রে একটা কোম্পানিতে কাজ করতেন। দেশে এরকম একটা কোম্পানির কথা শুনে তিনি চলে আসেন বাংলাদেশে।”
থামল অয়ন। তারপর পালা করে শৈবাল- সীমান্তের দিকে তাকিয়ে বলল, “আব্বু বাংলাদেশকে খুব ভালবাসতেন। বিদেশে কর্মরত অবস্থায়ও যখনই একটুখানি সময় পেতেন, চলে আসতেন দেশে। তাই প্রস্তাবটা পাবার পর আর কালক্ষেপন করেননি। ফিরে এসে যোগ দেন কোম্পানিতে। কোম্পানিটার মালিক বাংলাদেশের এক শীর্ষস্থানীয় কোটিপতি।”
“নাম কি কোম্পানিটার?”, প্রশ্ন করল শৈবাল।
“BANGEN Pharmaceuticals Company Ltd. উচ্চপ্রযুক্তির একটা ঔষধ ফ্যাক্টরি। আব্বু আমাকে বলেছেন। তারা বেশ বড়সড় পরিসরেই কাজ শুরু করেছে। খুবই ব্যয়বহুল কয়েকটা প্রজেক্ট চালু করেছে। দেশীয়দের পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যক বিদেশী সেসব প্রজেক্ট এ কর্মরত,’’ বলল অয়ন।

অয়নের মুখে কোম্পানিটার নাম শোনামাত্র শৈবালের মনে পড়ল একটা ঘটনার কথা। বছর পাঁচেক আগে হোটেল সোনারগাঁওয়ে কোম্পানিটার মালিক এবং তার বিদেশী অংশীদাররা তাদের কোম্পানিটার রূপরেখা নিয়ে এবং তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে একটা সভার আয়োজন করেছিল। দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে উচ্চপদে কর্মরত এক বন্ধুর সাথে সেও গিয়েছিল অনুষ্ঠানে। কোম্পানিটার মালিক একটা বড়সড় হৃদয়ছোয়া বক্তব্য দিয়েছিল। উন্নতমানের ঔষধপত্র দেশের মানুষদের জন্য সহজলভ্য এবং তুলনামুলক সল্পমুল্যে পাবার ব্যবস্থা করার জন্য নিজের আন্তরিকতার কথা বর্ননা করছিলো। যুব সমাজের কর্মসংস্থানের জন্য নিজের আরও কয়েকটা প্রকল্পের কথাও তার বর্ননায় ছিল। সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের মত সব কথা। শৈবালের মনে আছে বক্তব্য শেষ হবার পড় সে বেশ জোরেশোরেই করতালি দিয়েছিল অন্যান্যদের মত। মুগ্ধ শ্রোতার করতালি।
“কাজের সুবাদে আব্বুকে চট্টগ্রামে থাকতে হত,” বলে চলেছে অয়ন। “ছুটিছাটায় বাসায় আসতেন। আমার পড়াশোনার জন্য আম্মু আর আমি ঢাকাতেই থাকতাম। আমাদের উত্তরার ফ্ল্যাটে। কাজে যোগ দেবার পর দুই বছর বেশ ভাল কাটল। ফোনে যোগাযোগ তো আছেই। দুই মাস পরপর আব্বু আসতেন ঢাকায় । মাঝে মাঝে আমরা যেতাম চট্টগ্রামে। তারপর সেখান থেকে সবাই মিলে কক্সবাজার ঘুরতে যেতাম। আব্বু বিদেশে থাকাকালে যে শুন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল আমার আর আম্মুর মনে, তা আবার পুর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে। তারপর সাত-আট মাস আগে হঠাত করেই আব্বুর মাঝে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। সর্বদা হাসিখুশি আব্বু হঠাত করেই গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমি খেয়াল রাখলাম যে কয়দিন বাসায় থাকলেন। আগের মত হাসি ঠাট্টা করেননা আমার সাথে। আব্বুর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল অনেকটা বন্ধুর মত। সব বিষয়ে কথা বলতাম। জিজ্ঞাসা করলে বললেন শরীরটা ভাল নেই। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝলাম আব্বু কিছু লুকাচ্ছেন। অভিমান হলেও কিছু বললাম না। আব্বু আবার কাজে ফিরে গেলেন। আমিও আর মাথা ঘামালাম না। আব্বু পরেরবার বাসায় এলে পুরানো সন্দেহটা আবার মাথাচাড়া দিল আমার মনে। ভেবেছিলাম আব্বু এবার আগের মত হয়ে যাবেন। কিন্তু আব্বু তা হননি। তার বদলে আরও গম্ভীর। এবার আম্মুও ব্যাপারটা খেয়াল করল। জোর করে আব্বুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার সবকিছু চেক করে রিপোর্ট দিলেন, কোন সমস্যা নেই। আব্বু নাকি বেশি টেনশন করছেন। আম্মু চিন্তামুক্ত হল কিন্তু আমার চিন্তা গেল না। আমার কেন জানি মনে হতে লাগল খুব শিগগিরই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এবার আব্বুর উপর গোয়েন্দাগিরি শুরু করলাম।”

দুজনের দিকে তাকিয়ে একটু মলিন হাসল অয়ন। “বাসায় আব্বুর একটা নিজস্ব রুম আছে। মোটা মোটা বইপত্র, ছোট খাট যন্ত্রপাতি ভরা একটা রুম। বাসায় আসলে আব্বু তার বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতেন এই রুমে। ছোট একটা ম্যাট্রেস ছিল। দেখা যেত কোন কোন রাতে কাজ শেষ করে ওই রুমেই ঘুমিয়ে থাকতেন। আম্মু মাঝে মাঝে রসিকতা করে আব্বুকে বলত যে, রুমটা তার সতীন। আমি সেই রুমের পাশে ঘুরঘুর করতে লাগলাম। মাঝেমাঝে দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করতাম কিছু শোনা যায় কিনা। এরকম এক রাতে দেখলাম রুমের দরজা খোলা। আমি আস্তে করে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিলাম ভিতরে। আব্বু ভিতরেই ছিলেন। আমার দিকে পিছন ফিরে সেলফোনে কারও সাথে কথা বলছিলেন। খুব নিচু স্বরে কথা বলছিলেন বলে ছাড়াছাড়া ভাবে কিছু কথা ছাড়া বেশি কিছু শুনতে পেলাম না। আব্বুর কণ্ঠস্বর টা কেমন রাগী রাগী। কাকে যেন বলছিলেনযে, তিনি সবার মুখোশ খুলে দিবেন। আরও কিছু তথ্য জোগাড় করা বাকি। আমি আর দাঁড়ালাম না সেদিন। তাড়াতাড়ি নিজের রুমে ফিরে এলাম। বুঝলাম আব্বু বিপদজনক কিছুতে নিজেকে জড়িয়েছেন। কাউকে কিছু বললাম না।”
“তোমার আব্বু কি কারও নাম বলেছিলেন, যে তার মুখোশ খিলে দেবেন?”, প্রশ্ন করল শৈবাল।
“না,” অয়ন উত্তর দিল। “অন্তত আমি শুনিনি। যা হোক, তারপর সেবারের মত তিনি কাজে গেলেন। প্রায়দিনই রাতে আব্বুকে ফোন দিতাম। তিনিও বেশ হাসিখুশিভাবে কথা বলতেন। কিন্তু আমি শান্তি পেতাম না। মনে হত এরকমভাবে আব্বুকে কাছে পাবার আনন্দের থেকে বিদেশে থাকার কষ্টটাও ভাল ছিল।”

থামল অয়ন । নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সীমান্ত তার কাঁধে হাত রেখে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিল স্বান্তনা দেবার জন্য। “তারপর?”, বলল সে।

“শেষবার আব্বু যখন বাসায় এলেন তখন গভীর রাত,” বলল অয়ন। “আমি দরজা খুলে দিলে ব্যস্তভাবে রুমে ঢুকলেন। দেখলাম হাতে ফাইলবন্দী প্রচুর কাগজপত্র। বাসায় ঢুঁকেই কাগজপত্রগুলো তার সেই রুমে নিয়ে গেলেন। পরদিন খুব সকালে তার রুম থেকে একটা কালো ব্রিফকেস নিয়ে বাসা থেকে বেরুলেন। ফিরলেন দুপুরে। তখন তাকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। রাতে খাবার টেবিলে বেশ উৎফুল্লভাবেই আম্মু আর আমার সাথে কথা বললেন। সেই আগের আব্বু। তারপর তার সেই রুমে গিয়ে ঢুকলেন। আমি আমার রুমে চলে গেলাম। পরদিন সকালে অনেক বেলা হয়ে গেলেও আব্বু তার রুম ছেড়ে বেরুলেন না। আম্মু ইতোমধ্যেই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। আমি দৌড়ে গিয়ে রুমের নকল একটা চাবি নিয়ে এলাম যেটা আসল চাবিটা থেকে মোমের ছাপ দিয়ে গোপনে আমি বানিয়েছিলাম। দরজা খুলে দেখি আব্বু ম্যাট্রেসের উপর পড়ে রয়েছেন। দ্রুত গিয়ে তার কবজি ধরলাম। পালস নেই। আব্বু আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

চলবে------------

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.