নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যেয়

আনিসুর রহমান এরশাদ

আমি আমার দেশকে অত্যন্ত ভালবাসি ।

আনিসুর রহমান এরশাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল: একটি পর্যালোচনা (দুই)

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:০১

হাওরাঞ্চলে স্যানিটেশন ব্যবস্থা খুবই নাজুক। খোলা ল্যাট্রিনসহ ঝুলন্ত ল্যাট্রিন অধিকাংশ ব্যবহার করতে দেখা যায়। এমনো দেখা যায় পানির মধ্যে ঝুলন্ত ল্যাট্রিনে মলমূত্র ত্যাগ করে এবং একই ল্যাট্রিনের নিচে অজু গোসলসহ থালা-বাসন ও প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রি ধৌত করে। মাঝে মাঝে দুই একটি পাকা ল্যাট্রিন থাকলেও ইহা মলমূত্র বাহিরে খোলা অবস্থায় চারপাশের পরিবেশ দূষিত করে। বলা যায়, ইহা এমনই এক নাজুক নোংরা পরিবেশ যা রোগ ব্যাধি সংক্রমনের একটি ভয়ংকর কারখানা বললেও চলে। বাজারের খোলা ও পঁচা বাসি খাবার খেয়ে নান ধরণের পেটের পিড়ায় অসুস্থ হয়।

অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে হাওরগুলো হুমকির সম্মুখীন। মাটিভরাট করে হাওরে গড়ে উঠছে বসতবাড়ি, হাওরের প্রান্তিকভূমিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে বোরো চাষ, কেটে ফেলা হচ্ছে হাওরের বৃরাজি, সেইসঙ্গে বিলুপ্তি ঘটছে প্রাণিজগতের।হাওরে একটি মাত্র ফসল-ধান চাষ হয়। দেশের প্রায় এক পঞ্চমাংশ ধান এ হাওর এলাকায় উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত ধানের মাত্র এক দশমাংশ ধান হাওরে ব্যবহৃত হয়। বাকী সব ধান দেশের অন্যত্র, হাওর এলাকার বাহরে সরবরাহ হয়ে থাকে। শুকনা সময়ে উৎপাদিত ধান সারা বর্ষায় জুড়ে বেপারি নৌকায় করে দেশ ব্যাপী সরবরাহ হয়। হাওর অঞ্চলে নেই বড় কোন গুদাম ও চাতাল। ফলে, বড় বড় ধানের বেপারি নৌকা, আইত্ল্ল্যা নৌকা, লঞ্চ. কার্গো ভরে হাজার হাজার মন ধান আশুগঞ্জ, ভৈরব, মদনগঞ্জ, সিলেটে চলে যায়। এ ধান চাল হয়ে ছড়িয়ে পরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, কিছু অংশ ভ্যালু এড্ হয়ে হাওরে ফিরে আসে, আসা-যাওয়ার দ্বিমূখী খরচ যোগ হয়ে চাল বিক্রি হয় অধিক দামে। ধান বিক্রি ও চাল কেনা, এ দুই সময়ই কৃষক ‘শাখের করাত’র মতো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দামে কম দেয়া এবং ওজনে বেশী নেয়া, হাওর এলাকার কৃষকের ললাটের লিখন, একটি নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।


স্যাত স্যাতে আবহাওয়ায়, কাদা জলে মানুষের রোগ বালাই বৃদ্ধি করে। মৎস্যজীবীরা জাল নিয়ে ঘর হতে বের হতে পারে না। জলমহাল লীজ গৃহীতাদের উৎপাত তো রয়েছেই। অনেক সময় নৌকা ডুবিতে মানূষ মারা যায়। প্রচন্ড ঢেউ এর ফলে জলজ উদ্ভিদের পরিবেশ, মাছের আবাস বিনষ্ট হয়। পলি পরে ভরাট হয় বিল ঝিল। জলজ উদ্ভিদ মাটি হতে ্উপ্রে ছিড়ে ভাঙ্গনকে বেগবান করে। সুপেয় পানির অভাবে ডায়রিয়া সহ রোগ বালাই বৃদ্ধি পায়।

কর্মহীন মানুষেরা নিরুপায়, ঝুকছে দাদন ব্যবসায়ীদের উপর। মাসে পাচ টাকা হারে সুদের ব্যবসীদের গ্যাড়াকলে আটকা পরে। হাটবাজারে চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বর্ষাকালে হাওর এলাকায় সবচেয়ে বড় সংকট হয় জ্বালানি ও গো-খাদ্যের। জ্বালানির অভাবে এ সময়ে অনেক পরিবারে দিনে একবার রান্না করারও উপায় থাকে না। নিরুপায় লোকজন ৫-১০ ফুট হাওরের পানিতে ডুব দিয়ে এক ধরণের দুর্বা ঘাস তুলে। রোদে শুকিয়ে তা রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।


হাওড়ের সমস্যা সমাধানে করণীয়ঃ
হাওড় ও নিম্নাঞ্চল এলাকায় জনজীবন ও কৃষিপণ্য রক্ষা করা ছাড়াও প্রাকৃতিক মত্স্যব সম্পদসহ অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর রক্ষণাবেক্ষণে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির প্রচেষ্টা হিসাবে করণীয়গুলো হচ্ছে,

দেশের হাওড় এলাকায় অগ্রিম বন্যাই শুধু নয় যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবও একটি সমস্যা৷ অতএব হাওড় এলাকাগুলোতে সুষ্ঠু বন্যা-ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন এবং এর সাথে সমন্বিতভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে৷ বন্যা-নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের বাঁধগুলো এমন হওয়া চাই যা স্থানীয় জনগণকে সারাবছর যোগাযোগ সুবিধা দেবে, কিন্তু বন্যার পানি প্রবেশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না৷ হাওড় এলাকার জনগণ শুকনা মৌসুম ব্যতীত বছরের অধিকাংশ সময় যাতে নদীপথে যাতায়াত করতে পারে তার ব্যবস্থাপনা অব্যাহত রাখতে হবে৷ বর্তমানে যেসকল থানাসদর সারা বছরব্যাপী সড়ক নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত, ওইসব সড়ক ব্যতীত এমন কোন নতুন সড়ক নির্মাণ করা যাবে না যার ফলে হাওড় এলাকার পরিবেশকে ক্ষুণ্ন করতে পারে৷

পরিবেশ, মত্স্যনসম্পদ, জলজ ও পাখির জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনে হাওড়গুলোকে অভয়াশ্রম হিসেবে এবং সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড় এলাকাকে জাতীয় সংরক্ষিত সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে৷ হাওড় এলাকার ফসলবিন্যাস পরিবর্তন করে ফসল যাতে চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে উঠে আসে, পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তেমন উত্পাাদনের পরিকল্পনা নিতে হবে৷

সারাদেশের জলাভূমিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ড্রেজিং বা পলি অপসারণের নামে অতিনিষ্কাশন বন্ধ করা চাই৷ মত্স্য সম্পদ, জলজ পাখির জীববৈচিত্র সংরক্ষণ করার জন্য দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের নূন্যতমপক্ষে একটি জলাধার চিহ্নিত করে তাতে বছরব্যাপী সকল প্রকার মাছধরা নিষিদ্ধ করা দরকার৷

লীজের নামে জলমহালগুলোকে প্রভাবশালী ও সুবিধাভোগী মহলের অবৈধ দখল থেকে মুক্ত করা অত্যাবশ্যক৷ প্রতিটি ইউনিয়নের নির্দিষ্ট জলাভূমি ব্যতীত সকল জলাভূমিকে সারা বছর উন্মুক্ত মত্স্যথজীবী তথা আপামর জনগণের সম্পত্তি হিসেবে ফিরিয়ে দিতে হবে৷

পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য হাওড়, বাঁওড় ও জলাভূমি এলাকায় পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকর এমন শিল্প কারখানা নির্মাণ নিষিদ্ধ করা দরকার৷ ভূমিতে বিদেশী ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক গাছপালার পরিবর্তে দেশী এবং পরিবেশবান্ধব গাছ লাগানো দরকার৷

বন্যার সময় জনগণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা এবং ত্বরিত সহায়তা প্রদানের জন্য হাওড় এলাকায় প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, চিকিত্সামর সরঞ্জাম এবং আশ্রয় কেন্দ্রের ব্যবস্থা রাখা জরুরী৷

হাওড় এলাকার জনজীবন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিশু কিশোর তথা জনগণকে অবহিত এবং এই সম্পদের বিষয়ে সচেতন করার জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার৷ এই পর্যটন কেন্দ্র কেবলমাত্র সরকারী ব্যবস্থাপনায় চলবে এবং ব্যবসামূলক না হয়ে শিক্ষামূলক হবে৷

সমগ্র হাওড় এলাকায় বন্যা ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ উন্নতি করা, লীজ বন্ধকরণ করা, মুক্ত জলাশয় রক্ষা করা, সকল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সারা বছর মাছধরা নিয়ন্ত্রণ করা, প্রতিটি ইউনিয়নে অন্তত ১টি জলাভূমি তৈরি,সারা বছর পাখিধরা নিয়ন্ত্রণ করা, প্রতিটি উপজেলায় ১টি করে পর্যটন কেন্দ্র করা, কিছু অভয়াশ্রম ঘোষণা করা, কিছু জাতীয় সংরক্ষিত সম্পদ ঘোষণা করা, আইন শৃঙ্খলার প্রয়োগ করা, স্থানীয় পরিষদের বিশেষ বাহিনী দ্বারা ক্ষতিকারক বনায়ন রোধ করা, পরিবেশের ক্ষতিকারক বিদেশী গাছ লাগিয়ে তথাকথিত বনায়ন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা, ড্রেজিং এর মাধ্যমে জলাভূমি করা, জলাভূমি ভরাটের কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করাকে গুরুত্ব দিতে হবে।

হাওড় অঞ্চলের গ্রাম গুলো গুচ্ছাকারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভক্ত।এগুলোকে যুক্ত করে মাটি ভরাট করা গেলে স্যানিটেশন সমস্যা দূর করা সহজ হতে পারে। নদী ভাঙ্গনের ফলে যে সব জনপদ বিলীন হয়ে যেত, সে সব পরিবারগুলোকে Flood Shelter- এ আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। হাওড় এলাকায় সুষ্ঠভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য গুচ্ছগ্রাম গুলোতে শুকনো মৌসুমে সমবায় ভিত্তিতে মাটি কাটার কার্যক্রম গ্রহন করতে হবে। ভিজিডি,ভিজিএফ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য অর্থ,টি আর কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। কাছাকাছি যেসব গুচ্ছগ্রাম সরুখালের দ্বারা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে সে গুলো মাটি ভরাট করে সংযুক্ত করে রাস্তা তৈরী করা যেতে পারে।এতে গুচ্ছ গ্রাম গুলোতে যাতায়াত সহজ হবে। আরো বেশী ক্লিনিক,স্বাস্থ্যকেন্দ্র,ডাক্তার নার্সের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে সরকারী খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদান করতে হবে। বর্ষাকালে কর্মহীন অবস্থায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিকল্প কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ১০০% স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে রিং-স্লাব নির্মাণ ও সল্পমূল্যে বিতরনের কর্মসূচী জোরদার করতে হবে। গুচ্ছ পরিবার গুলোর সুবিধাজনক উঁচু জায়গায় কমিউনিটি স্যানিটারী ল্যাট্রিন তৈরী করার ব্যাপারে আগ্রহী করা যেতে পারে।

অবকাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে।হাওরাঞ্চলে অনেক কৃষি জমি ৪/ ৬ মাস ৩/ ৬ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। সামান্য কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়নে এ সমস্ত প্লাবন ভূমিতে মাছের চাষ করা সম্ভব।

বাংলাদেশে মোট ২ কোটি গবাদি পশু রয়েছে। এতে ৩০ লক্ষ বায়ুগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ করা সম্ভব। গবাদি পশু সংখ্যা হাওরাঞ্চলেই বেশি দেখা যাওয়া সত্বেও বায়ুগ্যাস প্লান্ট অল্পই চোখে পরে। বলা যায় হাঁস মুরগির বিষ্ঠা ও গরু গোবর তুলনামূলক বায়ুগ্যাস প্লান্ট তৈরি হলে বিদ্যুৎ এবং পরিবেশ বান্ধব গ্যাস ব্যবহারে অধিক ফলনসহ সার্বিক উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়াও বারি জাতের মিষ্টি আলু, বাদাম, সরিষা এবং গ্রীষ্মকালীন পিঁয়াজ উৎপাদন পদ্ধতি কৃষকের মধ্যে অজানা রয়েছে।

যোগাযোগ ও ফসল উঠানোর সময় পরিকল্পিত রাস্তা ঘাটের অভাবে মাঠের ফসল ঘরে তুলতে খুবই ক্ষতি সাধিত হয়। বন্যার ক্ষতি থেকে হাওরাঞ্চলকে রক্ষার জন্য খাল খনন, নদীর বাঁক সোজা করে খনন কার্য সাধন করা। নদীর পাড় উঁচু করে হাওরের গুরত্বপূর্ণ পয়েন্টে বেরী বাঁধ ও সুইচ গেইট নির্মাণ করা। পরিকল্পিতভাবে সাবমার্চেবল রাস্তা তৈরি করলে এক এলাকার সঙ্গে অন্য এলাকার যোগযোগ ও মাঠের ফসল ঘরে তুলার সহায়ক ব্যবস্থা হবে। হাওরাঞ্চলে যোগাযোগের ভালো রাস্তা ঘাট না থাকায় এক এলাকার সঙ্গে অন্য এলাকা সর্ম্পুণ বিচ্ছিন্ন প্রায়। বর্ষাকালে নৌকা ও শুকনা মৌসুমে ভাঙ্গাচুরা কাদাকার রাস্তায় দুই পা একমাত্র সম্বল। ফলে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেনিটেশন সকল দিক থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ। রাস্তা ঘাটের অভাবে হাওরাঞ্চলের মানুষের উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি বেসরকারি কিংবা বুদ্ধিজীবী, প্রযুক্তিবিদদের যোগাযোগ হয়না। ফলে উন্নত প্রযুক্তির বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয় না। যোগাযোগের অব্যবস্থার জন্য অত্র এলাকায় ব্যবসায় বাণিজ্য মানুষ থেকে বঞ্চিত হয়।

ঔষধি গুণ সম্পন্ন আমিষ জাতীয় পুষ্টিকর সবজি মাশরুম ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সার, টিউমার, মেদ ভুরি, জন্ডিস, রক্ত স্বল্পতা, যৌন অক্ষমতা, ডেঙ্গু জ্বর, এ্যাজমা প্রভৃতি দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময়ক। কিডনী রোগিদের আদর্শ খাবার। মাশরুম ৭-১০ দিনের মধ্যে উৎপাদন হয়। ঘরে বসে কোন পরিশ্রম ছাড়াই অধিক লাভবান হওয়া যায়। এর বীজ সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা যায়। এ বিষয়ে হাওরাঞ্চলে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

হাওরাঞ্চলের প্লাবন ভূমিতে ব্যক্তি মালিকানা কিংবা সমাজ ভিত্তিক খাঁচায় মাছের চাষ পদ্ধতি চালু হয়েছে। যাতে আমিষের ঘাটতি পূরণসহ বেকারত্ব হৃাস ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সকল মৎস্য চাষিদের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে।

হাওরাঞ্চলে চাটনি পাতা নামে পরিচিত বিলাতি ধনিয়া খাবারকে সুস্বাদু করা ছাড়াও অল্প খরচে মসলার ঘাটতি পূরণ করতে পারে। ঘর বাড়ির আঙ্গিনায় উঠোনের কোন অংশে কিংবা পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথে উঁচু জায়গায় বিলাতি ধনিয়া চাষ করে মসলার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব কিংবা একই পর্যায়ে মসলার ঘাটতি পূরণের জন্য মসলার চাষ বদ্ধি করে মসলার মূল্য হৃাস ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। কিন্তু এ সকল প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌছাতে হবে।

কৃষককে সচেতন করে তুলতে কৃষককে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দান করা দরকার। মধ্যসত্বভোগীরা হতদরিদ্রদের নানাভাবে ঠকিয়ে কৌশলে অধিক মুনাফা লুটে নেয়। তাই সহজ কিস্তিতে তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় ঋণ এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নূন্যতম মূল্যে প্রদান করা দরকার।সমবায় ভিত্তিক বিদ্যুৎ পাম্প চালু করতঃ পানি বন্টনের মাধ্যমে কৃষকের সেঁচ মূল্য কমিয়ে আনতে হবে।

বর্ষাকালে হাওরাঞ্চলে প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে ঘর বাড়ি ভেঙ্গে নিয়ে জানমালের প্রচুর ক্ষতি সাধন করে। এই ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে হলে গ্রাম প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা একান্ত অপরিহার্য কিন্তু অত্র এলাকার মানুষ দরিদ্র বিধায় প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করতে পারেনা।

মৎস্য সম্পদ সংরক্ষনের ব্যাপারে জেলেদের সচেতন করা দরকার। জলাশয় সংকোচন এবং পরিবেশ বিপর্যয় রোধকল্পে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। জলাশয়ে পোনা এবং মা মাছের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি ও আহরণ বন্ধ করা দরকার। মাছের প্রজনন মৌসুমে ১ বৈশাখ থেকে ৩০ আষাঢ় পর্যন্ত মাছ ধরা বন্ধ রাখা দরকার। প্রতিটি বিল ও হাওরে নার্সারী স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ। হাওর এলাকায় জেলেদের সঠিক তালিকা তৈরি করে তাদের পুনর্বাসন ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা দরকার। জলাশয়ে বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় প্রজাতির পোনা মাছ অবমুক্তকরণ প্রয়োজন। আধুনিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র এবং মৎস্য সংরক্ষনের জন্য হিমাগার স্থাপন করা দরকার। মাছের প্রজনন উল্লেখিত ৩ মাস জেলেদের বেকারত্ব লাঘব কল্পে ১০০ দিনের কর্মসংস্থান কর্মসূচির ব্যবস্থা করা দরকার। প্রতি ইউনিয়নে কম পক্ষে ৩ টি করে প্রদর্শনী মৎস্য খামার স্থাপন করা উচিৎ। জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করা দরকার।

নৌকাডুবি হাওরাঞ্চলের এক মর্মান্তিক দৃশ্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা নৌ সংঘর্ষের কারণে প্রায়ই মর্মান্তিকনৌকাডুবি দুর্ঘটনায় বহু মানুষ মৃত্য বরণ করে।নৌ দর্ঘটনা এড়ানোর জন্য নৌ এ্যাম্বুলেন্স এবং উদ্ধারকারী সংস্থা স্থাপন করা দরকার।

স্যানিটেশনের বিষয়ে নানা ধরনের প্রচার ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তুলা এবং আইন করে খোলা ল্যাট্রিন ব্যবহারের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বনভূমি শূন্য হাওরাঞ্চলে নদীর উঁচু পাড় ও বেরি বাঁধ নির্মাণে বনায়ন সৃষ্টি করা। জানা গেছে মিঠা পানিতে বাঁচতে পারে এমন ৭০ প্রজাতির গাছের মধ্যে হিজল, তমাল, রেন্ট্রি, বট, আম, জাম, করুই, শিল করুই, বরুন, মেড়া, বটগাছ ইত্যাদি। খাস জমি বাছাই করে বন নার্সারী ও গবেষনা কেন্দ্র স্থাপন করা দরকার। অল্প সুদে পোল্ট্রি ফার্ম, মৎস্য খামার প্রভৃতি গড়ে তুলা দরকার। প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে মৎস্য অভয়াশ্রম করা দরকার।

খেলাধূলা এবং শরীর চর্চা জীবনের অপরিহার্য অংশ। হাওরাঞ্চলে খেলাধূলার জন্য মাঠ নেই। ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলার সুযোগ সৃষ্টি হলে হাওরাঞ্চল থেকে অনেক প্রতিভা বিকশিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। সুতরাং খেলাধূলার মান উন্নয়নে প্রতি উপজেলায় একটি করে স্টেডিয়াম নির্মাণ করা দরকার।

হাওর বাসি মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে হাওর উন্নয়ন বোর্ড স্থাপন করা দরকার। হাওর বাসির জন্য জেলা শহরে উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও হাসপাতালে ভর্তি কোটা নির্ধারণ করা দরকার। হাওর বাসির জন্য বর্ধিত চাকরির কোটা নির্ধারণ করা দরকার। হাওরাঞ্চলে হাঁস মুরগির খামার, অটো রাইস মিল, আটা ও চাউলের মিল, বাঁশ ও বেতের কাজ প্রভৃতি কৃষি ভিত্তিক শিল্প স্থাপন করা দরকার।

পূর্বে হাওরাঞ্চলে মৌসুম ভিত্তিক অনেক অতিথি পাখির সমাগম হতো এবং পাখির কলকাকলীতে হাওরাঞ্চল মুখরিত হতো। বর্তমানে এ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আর দেখা যায় না। সুতরাং হাওরাঞ্চলে কৃত্রিম বনায়ন সৃষ্টি করে পাখিদের নিরাপত্তার জন্য অভয়ারণ্য ঘোষণা দিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা দরকার।

জলাবদ্ধতা স্থায়ীভাবে দূর করতে হলে হাওরের পাশ দিয়ে বয়ে নদী খনন করতে হবে।হাওরের জলাবদ্ধতা দূর করা এবং অকাল বন্যার হাত থেকে বোরো ফসল রক্ষায় নদী খননের বিকল্প নেই।

গ্রাম সুরক্ষার জন্যে গ্রাম ও হাওরে জলজ সহিঞ্চু বৃক্ষরাজি রোপন করতে হবে। প্রত্যেক গ্রামকে কেন্দ্র করে কয়েক স্তরের বিভিন্ন গাছ গাছালির সবুজ বেস্টনি গড়ে তুলতে হবে। প্রতিরক্ষার জন্য স্থানীয় উপকরণের উৎপাদন বাড়ানো, সহজ লভ্য করা, সংরক্ষণ এবং জনগণকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। ’আপদকালিন ফান্ড’ও রাখা যেতে পারে। শামুক, ছিনাই (ঝিনুক) বা মাছ ধরার জন্য পানির নীচের উদ্ভিদ রাজিকে ধবংস করা যাবে না। জলি ধান বা পাট চাষ কে ফিরিয়ে আনার টেকনিক বের করতে হবে। এগুলো পানির বা স্রেুাতের গতিকে (ঢেউ) ব্যহত করে। গ্রামের চারিদিকে স্থায়ী পাঁকা প্রতিরক্ষা দেয়াল দেয়া যেতে পারে।

হাওরে পর্যাপ্ত বন্যাশ্রম তৈরী করতে হবে। আবহাওয়া পূর্বাভাষ ব্যবস্থাকে জোড়দার করতে হবে। হাওরকে একমুখী শুধু ধান ফসল নির্ভর না করে বছর ব্যাপী বহুমুখী ফসল চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে বছরব্যাপী কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

হাওর অঞ্চলের ভূ প্রকৃতি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বাস্তবায়ন সময়কালও খুবই কম। এছাড়া হাওর এলাকার জনগণের জীবন ও জীবিকা এক ফসলের ওপর নির্ভরশীল। তাই হাওর এলাকার জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।মৎস্যজীবীদের জীবিকা নির্বাহের স্বার্থে নদীর ইজারা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং হাওর এলাকার নদীর নাব্যতা রক্ষায় ড্রেজিং এর ব্যবস্থা নিতে হবে।

গোখাদ্যসংকট ও পরিবারের অভাব ঘুচাতে কৃষকেরা অধিকাংশ গরুই বিক্রি করে দেয়। বেশি দামে খড় কিনে খাওয়াতে হয়। এতে কৃষকদের অভাব আরও বেড়ে যায়। হাওরের জমি আর গোয়ালের গরুই হাওরাঞ্চলের কৃষকদের বাঁচার অবলম্বন। প্রত্যেক কৃষক আপ্রাণ চেষ্টা করেন অন্তত দু-চারটি গরু তাঁদের গোয়ালে রাখার। এতে পরিবারগুলোতে আর্থিক অনটন আরও বাড়ে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা বা অতিবৃষ্টির কারণে ধান শুকানো ও বাজারজাত করা, কোয়ালিটি রক্ষা করা বা সঠিক মাত্রায় ধান শুকানো ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা সম্ভব হয়না। অনেক সময় ভিজা ধান অঙ্কুরিত হয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতি হয় এবং ধানের রঙ নষ্ট হওযার কারণে নাম মাত্র মূল্যে ধান বিক্রি করতে হয়। এক্ষেত্রে অটো রাইচ মিলের ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে বলে প্রতি ওয়ার্ডে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কমপক্ষে একটি করে অটোরাইচ মেইল স্থাপন করতে হবে।

হাঁস উভচর প্রাণী বলে, হাঁস চাষে খুবই উপযোগি স্থান হাওরাঞ্চল। শামুক ঝিনুকসহ অনেক জলজ কীটপতঙ্গ প্রভৃতি প্রাকৃতিক খাদ্য খেয়ে হাঁসগুলি বেড়ে উঠতে পারে। এতে কৃত্রিম খাদ্য কম লাগে এবং লাভ বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু হাঁসের মরক ও নানাবিধ রোগ ব্যাধির কারণে অধিকাংশ হাঁস মারা যায়। এবং হাঁসের খামারিরা লোকসানের মুখে পতিত হয়। হাঁস গুলি কি রোগে মারা যায় তা তারা বুঝতে পারেনা। কেন হাঁসগুলি মারা যায় এবং খামারিরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সে বিষয় প্রাণী সম্পদ বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গবেষনা মাধ্যমে হাঁসের খামারিদেরকে প্রশিক্ষিত করে তুলা দরকার।

নদীর স্বাভাবিক গতি-প্রবাহ অক্ষুণ্ন, নাব্যতার উন্নয়ন এবং বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণে আরো সতর্ক হতে হবে। খাদ্য উত্পাদনের জন্য এবং মাছ চাষ করার জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদীশাসন প্রয়োজন। তবে কোন অবস্থাতেই নদীর স্বাভাবিক গতি-প্রবাহকে ব্যাহত করা যাবে না।

হাওর অঞ্চলের শিক্ষা
বৈরী আবহওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায়ই শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পরে। শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ক্ষুধার তাড়নায় পলিয়ে যায়। অনেক বিদ্যালয় প্রঙ্গণে খেলার মাঠ না থাকায় শিক্ষার্থীরা নিরুৎসাহিত হয়।এ এলাকার মানুষ দরিদ্র থাকায় শিশুদেরকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চায়না। অনেক পিতা- মাতা সন্তানদেরকে গৃহস্থালি কিংবা সংসারের অন্যান্য কাজে লাগিয়ে দেয়। এমন কি ফসলের মৌসুমে ছাত্র-ছাত্রী পুরোপুরই ফসল তোলার কাজে জড়িয়ে পরে। এই অনিয়মিত অবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পরে এবং ঝরে পরে অনেকেই। শিক্ষক ও শ্রেণী কক্ষের স্বল্পতার কারণে উন্নত পরিবেশে শিক্ষাদান সম্ভব হয়না। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য ও উপবৃত্তির পরিমান বৃদ্ধি করতে হবে এবং বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে দারিদ্রতা হৃাস করেত হবে এবং পিতা-মাতাকে সচেতন করতে হবে। নতুন বিদ্যালয় ও শিক্ষক নিয়োগ এবং শ্রেণী কক্ষসহ প্রয়োজনীয় সকল সুবিধা বর্ধিত করা।

প্রতারিত হাওরবাসী
হাওর অঞ্চলে ধান ক্রয় বিক্রয়ে হাতে মাপা দাঁড়ি পাল্লা ব্যবহৃত হয়। কেনার সময় সের এবং বিক্রির সময় কেজি ওজনের পাথর ব্যবহর করা হয়। পাঁচ সের করে ওজনের পাথর দিয়ে হাতে মাপা বিশেষ ভাবে তৈরী নিক্তি দিয়ে ধান মাপা হয়। এ ধান ক্রয়ের সাথে জড়িত এক শ্রেণীর দালাল যারা, স্থানীয়ভাবে ”কইয়াল” বা ’দালাল’ নামে পরিচিত তারা তাদের পাথর ব্যবহার করে। অর্ডার দিয়ে নাকি তারা এ পাথর কিনে/ তৈরী করে আনে। এ পাথরের ছিদ্রে ঝালাই দিয়ে লোহা বা শীসা সংযুক্তি করে ওজন বাড়ানো হয়। এ নিক্তিটি একটি কাঠের তৈরী কাঠির ভিতর দিয়ে রশি বা দড়ি প্রবেশ করিয়ে পাল্লার সাথে বেঁধে তৈরী করা হয়। এ কাঠিটিকে ’ডান্ডা’ বলে। পাল্লায় সংযুক্ত রশির বা দড়ির ভিতর দিয়ে লোহার রিঙ পড়ানো থাকে। ধান মাপার সময় “কইয়াল” এ রিঙ বা রশি/দড়ি হাতের মুটিতে ধরে/চাপ দিয়ে ডান্ডা এদিক ওদিক করে অতি সহজেই মাপার ওজনে হের-ফের করতে পারে।

কইয়াল’রা ধান মাপতে এক ধরণের বিশেষ গণনা রীতি ব্যবহার করে। দেশের আর কোথাও এ ধরণের গণনা রীতির প্রচলন নাই। সাধারণ গণনা হতে এ গণনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাধারণ মানুষের পক্ষ্যে এ গণনা বুঝা বেশ কষ্টকর। নাক্কা সুরে/গলায় ঘ্যান ঘ্যান করে একই সংখ্যা/ কথা বার বার বলে, প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে একটা ধুম্র্যজালের আবহ সৃষ্টি করে। কোন সংখ্যাই তারা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে না। যেমন “লাভে রে লাভ” মানে এক, “নাইশা’ মানে উনিশ, “উইনচা” মানে উনচল্লিশ। প্রত্যেকটা সংখ্যার একটা বিকৃত রূপ সৃষ্টি করে নাক্কা সুরে জোরে জোরে বার বার তা উচ্চারণ/ধ্বনি, প্রতিধ্বনি করে। “উইনচা” থেকে সহজেই “নাইশা” তে ফিরে আসে। তাদের ভ্যালকি বাজিতে কার বাপের সাধ্য তার সবগুলো গণনা বুঝা। হাওরবাসি সহজ সরল মানুষদের পক্ষে তো নয়ই। বিশেষ ধরণের সুরের তালে তালে তারা পাল্লায় ঝাঁকি/ ধাক্কা দিয়ে ছন্দে ছন্দে ঢেউ তুলে ধান ভর্তি বেত বা বাঁশের তৈরী পাত্রটি বস্তায় ছুড়ে ফেলে। কোন কোন সময় এক পাল্লায় এক কেজি ধান অতিরিক্ত বেশী নেয়া তাদের পক্ষে কোন ব্যাপারই না। ওজনে বেশী পরিমাণ ধান নেয়ার জন্য তাঁরা বেশী দাম দেয়ার প্রলোভণও দেখায়। মণ করা ১০ টাকা বেশী দাম দিলেও অতিরিক্ত ধান নিয়ে যায় হয়তো ১০০ টাকার।

এক বস্তায় সাধারণত ৮ পাল্লা বা এক মণ ধান ভরা হয়। এক তালে “কইয়াল” চল্লিশ পাল্লা বা পাঁচ মণ ধান মাপে। একে এক “চাইল্লা” বলে। এক “চাইল্লা ধান” মাপার পর দৃশ্যমান ভাবেই তারা কেজি খানেক ধান অতিরিক্ত নিয়ে থাকে। অনেক সময় ’চাইল্লা’ ছেড়ে দেয়া তো তাদের জন্য ডাল ভাত। পাল্লার “আয় ফের” বা “ব্যয় ফের” এর হাতিয়ার তারা সচেতনভাবে ব্যবহার করে। বেপারির সাথে ’কইয়াল’ এর দৃশ্যমান চুক্তি হচ্ছে-এক মণ ধান মাপ্লে বেপারি কইয়াল’কে দশ টাকা দেবেন। তবে শর্ত হচ্ছে ওজনে কারচুপি করে বা গনণায় ছলনা করে শতকরা কমপক্ষে ১০-১৫ মণ ধান বেশী দিতে হবে। বেশী পরিমাণ ধান দিতে পারলে ’কইয়ালি’র টাকার পরিমাণও বাড়ে। কোন বেপারিই “কইয়াল” এর সহায়তা ছাড়া সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করে না। অনেক সময় কৃষকও ’কইয়াল’ কে উল্টো টাকা দিয়ে থাকে যেন সঠিক মাপটি মাপে। কিন্তু চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী। দু’পক্ষের কাছ থেকে টাকা নিলেও সে তো বেপারির স্বার্থটাই বড় করে দেখে। কারণ, বেপারি তার নিত্য কাষ্টমার। এ পদ্ধতিতে ’মইয়াল’ থেকে বেশী দামে ধান কিনে ’আড়ত’ এ কম দামে বিক্রি করলেও বেপারির লাভ থাকে, ওজণের মারপ্যাচে।

উপসংহার:
হাওরাঞ্চলকে ভাত ও মাছের ভান্ডার বলা হয়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রায় ২৫% এলাকা জুড়ে হাওর বিস্তৃত। ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, খালিয়াজুরি এলাকা জুড়ে “বড় হাওর”, অষ্টগ্রামের “সুমাই হাওর”, বাজিতপুরের “হুমাই”, মিঠামইনের “বাড়ির হাওর”, বাজিতপুর, নিকলী, মিঠামইন এলাকা জুড়ে “তল্লার হাওর”, নিকলীর “মাহমুদপুর হাওর”, নিকলী “সুরমা বাউলার হাওর” সুনামগঞ্জের “শনির হাওর”, সিলেট ও মৌলভীবাজারের “হাকালুকি হাওর”, নেত্রকোনা “জারিয়া হাওর”, ছিলনীর “শাপলা ও পাতলা বোড়া হাওর”, নূরপুর ও কাতিয়ার কোনা হাওর, এলংজুরির “চিমনীর হাওর”, ইটনার “বনপুর হাওর,” সহ এদেশে ছোট বড় মিলে প্রায় ৪৫০টি হাওর রয়েছে। যা প্রায় ৮ হাজার বর্গ কি.মি. এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। বিদ্যুৎ বিহীন জোৎস্না মাখা হাওর এলাকাও অনুপম। হাওর-ভাটি বাংলায় প্রতিবছর এভাবেই আতঙ্ক, কর্মহীনতা, জঠর জ্বালা, হতাশা এবং বেচেঁ থাকার সংগ্রামের বারতা নিয়ে বর্ষা আসছে, যাচ্ছে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে জীবনের চলছে নিরন্তর যুদ্ধ। হাওরবাসির জীবনে সুখ শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সমন্বিত প্রয়াস চালাতে হবে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৫০

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: ++++++++++++
বেশ বড় পোস্ট । পর্যবেক্ষণে রাখলাম । পরে আরও ভালমতো পড়তে হবে ।

ভালো থাকবেন :)

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৮

আনিসুর রহমান এরশাদ বলেছেন: পড়বেন আশা করি। আপনিও ভাল খাকুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.