নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যেয়

আনিসুর রহমান এরশাদ

আমি আমার দেশকে অত্যন্ত ভালবাসি ।

আনিসুর রহমান এরশাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অক্ষমতা থেকে অসহায়ত্ব ও সুবিধাভোগীদের উল্লাস

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৫০

মানব সমাজে বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস আজকের নয়। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ইছামতী নদীর নামে রচিত আঞ্চলিক জনজীবন নির্ভর উপন্যাসটি পড়লাম। এ উপন্যাসে ব্রিটিশ আমলের মধ্যভাগের একটি গ্রামীণ জনসমাজ ও পারিপার্শ্বিক ঘটনা প্রবাহকে তুলে ধরা হয়েছে, এর সঙ্গে আংশিক ইতিহাসকে করা হয়েছে অনুষঙ্গ। সে ইতিহাস কিছুটা তিতুমীরের, কিছুটা ইংরেজ নীল কুঠিয়ালদের। নানা ঘটনাবলির ভেতর দিয়ে সেকালের জনজীবনকে, জনমানসকে এবং ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতিকে রূপায়ণ করা হয়েছে।উপন্যাসের পুরো অবয়বটি পরিচ্ছন্ন, জটিলতা-কুটিলতার উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ে না।গ্রামীণ মানুষ ও সমাজের সরলতা, প্রকৃতির কোলে লালিত ও পরিশীলিত মনন আর সুন্দর রুচির সাথে স্বার্থপরদের দ্বন্ধের মানবিক আবেদন হৃদয় ছুঁয়ে যায়।



ইছামতী নদীর যে অংশটি যশোর-নদীয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সে অংশের গ্রাম পাঁচপোতা, মোল্লাহাটি নীলকুঠি ও সংলগ্ন এলাকার পটভূমিতে 'ইছামতী'র কাহিনী গড়ে উঠেছে । ১৮৬৩ সালের শরৎকাল থেকে কাহিনীর শুরু। বন্যার পানি এ সময়েই নেমে যায়। ভারতবর্ষে তখন আধুনিকতার শুরু হয়েছে। তবে তখনো তা নগর-শহরের বাইরে বৃহত্তর জনজীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি। পুরনো বৃত্তের মধ্যেই আটকা পড়ে আছে তৎকালীন অখন্ড বাংলার গ্রামীণ জীবন। কলের গাড়ি দু-একটা আসতে শুরু করেছে, রেল চালু হচ্ছে, নদী দিয়ে চলছে কলের জাহাজ অর্থাৎ স্টিমার। লেখকের ভাষায়-'এ সময় পল্লীগ্রামে দোতলা প্রদীপ বা সেজ ব্যবহার হত-তলায় জল থাকত, উপরের তলায় তেল।' উল্লেখ্য, সে তেল ছিল রেড়ির তেল। গ্রামজীবনের রূপকার বিভূতিভূষণ যে গ্রামীণ সমাজের চিত্র এঁকেছেন সেখানে দুটি দিক আছে। এক. গ্রামের নিজস্ব জীবনচিত্র ও ঘটনাপ্রবাহ, যার মধ্যে আছে পরিবার বা মানুষকেন্দ্রিক চালচিত্র, দুই. নীলকুঠিকেন্দ্রিক জীবনচিত্র ও ঘটনাপ্রবাহ, যেখানে আছে ইংরেজ সাহেব বা কুঠিয়ালরা।



অন্য সব উপন্যাসের মতো 'ইছামতী'-তে কোনো নায়ক বা নায়িকা নেই। এখানে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মোল্লাহাটি নীলকুঠির নায়েব রাজারাম রায়। প্রচন্ড ক্ষমতাশালী যিনি ফসলি জমিতে নীলের মার্কা মারে, প্রজাদের জব্দ করে রাখে। সবাই তাকে ভয় করে। বিবাহিত ও নিঃসন্তান রাজারামের হৃদয়ের অতলে রয়েছে বাড়িতে অবিবাহিত অবস্থায় থাকা যথাক্রমে তিরিশ, সাতাশ ও পঁচিশ বছরের তিন সহোদরার প্রতি গভীর স্নেহ ও মমতা। অবশেষে পঞ্চাশ বছর বয়স্ক ভালো স্বভাব-চরিত্রের সুপুরুষ ও সুদর্শন পাত্র ভবানী বাঁড়ুজ্যেকে পাওয়ামাত্র তিন বোনকেই তার হাতে নির্দ্বিধায় তুলে দেন তিনি। অনেক অন্যায়-অবিচার ও কু-কীর্তির হোতা মানুষটি আদর্শ ভাইয়ের দায়িত্ব সুচারুভাবেই সম্পন্ন করেছেন। এই রাজারাম শেষাবধি ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ প্রজাদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নিহত হন। পরে যারা তাকে হত্যা করেছিল তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় তার মনিব ইংরেজ কুঠিয়াল বড় সাহেব শিপটন। চরিত্রটির মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক অত্যাচারীর নির্মম পরিণতিকে তুলে ধরা হয়েছে।



এ উপন্যাসে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র তিলু। মাঝবয়সে এসে আরো দুজনের সঙ্গে যে স্বামীকে সে পেয়েছে তার সেবা ও যত্নে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে। অন্য দুই বোনকে স্বামীর ভাগ দেয়ার ব্যাপারে তার কোনো ঈর্ষা বা মনোকষ্ট নেই। বড় হিসেবে যৌথ স্বামীর প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য বোনদের সব সময় উদ্বুদ্ধ করতে দেখা যায় তাকে। সৌভাগ্য তাকে ঋদ্ধ করে সন্তান দিয়ে যে হয়ে ওঠে তিন বোনের নয়নমণি। দরিদ্রের প্রতি যেমন প্রসারিত হয় তার মমতার হাত তেমনি গাঁয়ের এক খঞ্জ স্বামীর সুন্দরী স্ত্রী মুখরা, সাহসিনী নিস্তারিণীকে পরকীয়ার টানে ভেসে যাওয়া থেকে দৃঢ় হাতে রক্ষা করে। নিস্তারিণী চরিত্রটি স্বল্পপরিসরে আকর্ষণীয়া, উজ্জ্বল।



তবে গয়া মেম চরিত্রটি বুঝি সুন্দরী, সহৃদয়া, বুদ্ধিমতি তিলুকেও ছাপিয়ে গেছে। সমাজে নিম্ন বাগদী জাতের সুন্দরী মেয়ে গয়াকে তার মা মোল্লাহাটি কুঠির বড় সাহেবের হাতে তুলে দিয়েছিল। সাহেব তাকে নিজের করেই রেখে দেয় কুঠিতে। বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে সে। নাম গয়া থেকে হয়ে যায় গয়া মেম। কিন্তু গয়া চরিত্র হারালেও মানবতা ও বিবেকবোধ হারায়নি। অনেক লোকই তাকে ধরে বড় সাহেবের কাছ থেকে উপকার লাভ করে। রামকানাই কবিরাজকেও মমত্ববশেই বড় সাহেবকে বলে বিপদ থেকে উদ্ধার করে দেয়। বড় সাহেবের খুবই প্রিয় ছিল গয়া মেম, কিন্তু তা বলে কখনো নিজেকে ছোট করে তার কাছ থেকে কিছু চেয়ে নিয়ে নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা করেনি সে।



কুঠিয়ালের মৃত্যুর পর গয়া ঠাঁই নেয় পৈতৃক কুঁড়েঘরে। তার স্বভাবটা নষ্ট মেয়ে মানুষের ছিল না। তাই সৎভাবে বেঁচে থাকার জন্য সে অন্যের বাড়ি ঢেঁকিতে ধান ভানার মতো অতি কষ্টের কাজও করে, কিন্তু কোনোক্রমেই শরীরের ব্যবসায় নামেনি যা তার জন্য স্বাভাবিক ছিল। দৈন্য তাকে নিঃস্ব করে দিলেও অনৈতিকতার কাছে সে আত্মসমর্পণ করেনি। যে প্রসন্ন চক্কত্তি তার শরীরটাকে পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তার কাছে মাছির মতো ভনভন করেছে, প্রলোভন দেখিয়েছে_ গয়া মেম কখনই তার সে নোংরা ফাঁদে পা দেয়নি। উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে জরুরি কাজে আসা বৃদ্ধ প্রসন্নর সঙ্গে মোল্লাহাটি কুঠির পরিত্যক্ত কবরস্থানে জোছনা রাতে গাছের ছায়ায় সৃষ্ট আলো-আঁধারিতে গয়া মেমের দেখা হয়ে যায়। বিস্ময়তাড়িত, অতীত স্মৃতি ভারাতুর প্রসন্নকে সে জীবনের শেষ কটা দিন তার কাছে এসে থাকার সরল ও আন্তরিক আহ্বান জানায়। তবে অন্তত সেই মুহূর্তে প্রসন্ন তাতে সাড়া না দিয়ে তার কর্মস্থলে ফেরার পথ ধরে। গয়া তার হৃদয়ের উদারতায়, অন্তরের সৌন্দর্যে মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।



নালু পাল এ উপন্যাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। উপন্যাসের প্রায় শুরুতেই তার দেখা পাই আমরা। সাহেবের ভয়ে পথ থেকে সরে গিয়ে নিচের ধান খেতে লুকোনো অতি গরিব নালু পাল নিচু জাতের মানুষ। একদিন সেই নালু পালই ব্যবসা করে বিপুল অর্থের মালিক হয়। কিন্তু অধিকাংশ নব্য ধনী যেমনটি হয় সে তা হয়নি। তার ভেতরে সব সময় বাস করেছে পুরনো দিনের সম্বলহীন নালু পাল। তাই সে দুটি কাজ করে। এক. মোল্লাহাটি নীলকুঠি সে নিলামে কিনে নেয়। দুই. গাঁয়ের অহঙ্কারী, জাতপাতসর্বস্ব বিত্তহীন ব্রাহ্মণদের সে তার বাড়িতে একবেলা আহারে আপ্যায়িত করে নিজের অবস্থানকে উঁচুকে উন্নীত করার প্রয়াস চালায়।



রামকানাই কবিরাজ মানবকল্যাণে নিবেদিত। এ অকৃতদার, হতদরিদ্র, চালচুলোহীন মানুষটি সমাজের সবার সঙ্গে নিজের খাপ-খাওয়াতে পারেননি। রোগী দেখে পয়সাও পান না। নিরিবিলি এ মানুষটি গ্রামের রামু বাগদী খুন হওয়ার ঘটনায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় রাজারামের নির্যাতনের শিকার হন। তাকে নীলকুঠিতে আটক রাখা হয়। তবুও আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি হননি। পরে হত্যার আগমুহূর্তে সতর্ক করে দিয়ে সেই রাজারামকেই বাঁচানোর চেষ্টা করেন তিনি, পারেন না। স্বজনহীন এ মানুষটির দুরবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গয়া মেম তার সেবায় এগিয়ে আসে। আরো পরে তিলুর ভক্তি-শ্রদ্ধা পেয়ে শান্তি পান তিনি। এই নিরীহ, নির্বিরোধ মানুষটির মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষের বৈচিত্র্য প্রকাশ পেয়েছে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.