নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আনোয়ার

অনুফিল

অনুফিল › বিস্তারিত পোস্টঃ

গন্তব্য

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:৩৫

দিগন্ত জুড়ে রাত্রির ছড়িয়ে দেওয়া অন্ধকার। মাঠের ও ধারে বটগাছটা এখনও অদৃশ্য। নিথর গাছগুলোর আড়মোড়া এখনও ভাঙেনি। থেমে থেমে ডেকে উঠা শেয়ালগুলো পাশের ঝোপ ছেড়ে দূরের কোথাও আত্মগোপন করেছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের একটানা সুর সবে বন্ধ হয়েছে। নিশাচরগুলো ক্লান্ত হয়ে নিরবতা পালন করছে। আশেপাশে প্রাণের কোন চিহ্ন নেই। আছে ধুলোময় নিথর রাস্তা আর তার পাশে দন্ডায়মান শতবর্ষী বটগাছ।



আকাশটা অরুণোদয়ের আভাস দেওয়ার চেষ্টা করছে। দুই একটা কাক গোঙানোর স্বরে কি যেন বলে যাচ্ছে। হঠাৎ শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি শোনা যায়। -কে? নিঃশব্দ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। অবশ্য সব প্রশ্নের উত্তর থাকে না। তাই উত্তরের তুলনায় প্রশ্নের সংখ্যা বেশী।



কে, সে পথিক? অন্ধকারের বুক চিরে সে যাচ্ছে কোথায়? কী এমন কর্তব্য তার যে, নিস্তব্ধ অন্ধকারও তাকে পরাহত করতে পারে নি? সে কি জানে না, এখন ছুটে চলার সময় নয়? অথচ, সমস্ত পৃথিবী এখন থেমে আছে! প্রেম মদিরায় মত্ত যুবক-যুবতি কিংবা রাতজাগা আড্ডাবাজরাও হয়তো নেতিয়ে পড়েছে! ঘরে ঘরে জোড়া প্রাণের কোমল দেহ লেপ্টে আছে রঙিন মখমলে। একটু শীত শীত অনুভব করছে বলে হয়ত নিতান্ত অনিচ্ছায়ও কাঁথাটা আবার টেনে নেয়। তবুও অলসতা বশতঃ মশারির আলগা হয়ে থাকা অংশটা টেনে দেয়া হয় না। পাড়ায় পাড়ায় নাকডাকার অদ্ভুত আওয়াজ ছাড়া আর কোন সাড়া শব্দ নেই।



অদৃশ্য বটগাছ দৃশ্যমান হতে শুরু করে। পুকুরের জল তরঙ্গায়িত শব্দ ক্ষীণতর হয়ে আসে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে পথিক। দু’হাতে কান চেপে ধরে সর্বশক্তি দিয়ে কন্ঠ ছাড়ে। তার কন্ঠ হতে ঝংকৃত হয় বিচিত্র মধুর সুর। এ সুর প্রতিধ্বনিত হতে থাকে দিগ্বিদিক। সুরের মূর্ছনায় আলগা হয়ে পড়ে কোন কোন জোড়া প্রাণ। নরম গদি ছেড়ে কেউ কেউ সাড়া দেয় পথিকের আহবানে। আবার জল তরঙ্গধ্বনি শুনা যায়, ছলাৎ ছলাৎ। পথিকের সংখ্যা বাড়ে। পরবর্তী পথিকরা অগ্রবর্তী পথিকের অনুসরণ করে। এ দৃশ্য বড়ই মধুর। নিত্যকার এ দৃশ্য আবর্তিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে।



এই তো সেদিন, প্রবীণ পথিকটির বয়স যখন এতটুকু, সে আসত গুটি গুটি পায়ে, খানিকটা হেটে খানিকটা দৌড়ে, কিংবা এক পা খুঁড়ার মত করে। সেন্ডেল দুটি পরত কি পরত না, পানি ছুঁত কি ছুঁত না, এক দৌড়ে দাঁড়িয়ে পড়ত অগ্রজদের লাইনের পেছনে। তার জামার কোণাটা আঁটকে আছে পাজামার ভাজে, সেদিকে তার খেয়ালও নেই! তার কোন ভাবনা ছিল না মনে। ভাবনা থাকার কথাও নয়। সে বয়সে কেউ ভাবতে জানে না। তাই সে কখনও ভাবে নি, তাকেও হাল ধরতে হবে একটা জাতির। সমগ্র জাতি তার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবে। সে বলবে, দাঁড়াও। জাতি দাঁড়াবে! –ঝুঁকে পড়। জাতি ঝুঁকে পড়বে! –দাঁড়াও। জাতি আবার দাঁড়াবে। সে বসতে বললে জাতি বসবে। সে ঘুরতে বললে জাতি ঘুরবে। অতঃপর, সে একদিন নাই হয়ে যাবে। তার রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করবে তারই অনুজ কোন একজন।



অন্ধকার আলোতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। বটের পাতার ফাঁক দিয়ে সোনালি আভা ঝরে পড়ছে। মৃদু সমীরণে পাতাগুলো ঈষৎ দুলে উঠছে। মাঠে শিরশির করছে সবুজ ঘাস। ঘাসের ডগায় শিশির কণা হতে ঠিকরে পড়ছে রঙ-বেরঙ এর আলো। উপরে নীলাভ আকাশে ডানা মেলছে পাখি। নিচে সবুজ ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে যায় বৃদ্ধ পথিক। শ্বেত-শুভ্র দেহটিকে অনুসরণ করে একটি কালো ছায়া।



পথিক চলছে শির উঁচিয়ে, হাত দুলিয়ে। দুই হাত দুই পা চীর প্রতিদ্বন্দী। একটি সামনে গেলে অপরটি পেছনে যায়। সে চলে অবচেতন মনে, মাথা দুলিয়ে, চুল উড়িয়ে। তার চোখে পাহাড়, ঝর্ণা, বৃক্ষ, সাগর, নদী, খাল, বিল, পুকুর, মাঠ, ঘাট। সে দেখে পরিষ্কার চোখে। সে চলতে থাকে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে, ধুলা উড়িয়ে, পা নাচিয়ে। তার উপরে নীল আকাশ। চারপাশে সবুজ গাছ। যেখানে পাখ-পাখালীর কলরব। কিচিরমিচির শব্দে সে চমকিত হয় না। কানও বন্ধ রাখে না। সে শুনে একমনে- একধ্যানে। কিন্তু সে জানে না, সে কী শুনে! তবুও সে থামে না। নগর-বন্দর, শহরতলী, অলি-গলি দিয়ে সে চলতে থাকে। ক্লান্ত পথিক, তবুও অবসর নেই। তার অনেক কাজ বাকি। তার গন্তব্য অন্তহীন। সে জানে তার বিশ্রামের সময় নেই।তার পাথেয় প্রয়োজন। একটু পাথেয়-এর অভাবে হয়ত সমস্ত আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তাই অজস্র পাথেয়- এর খুঁজে তার প্রচেষ্টার ইতি নেই। সে চলতে থাকে। সে বাধা আসলে বিচলিত হয় না। বাধার কাছে সে যেতে চায় না। কিন্তু বাধা তার কাছে আসে তাকে থামিয়ে দিতে, অচল করে দিতে। তবুও সে মাড়িয়ে যায় সকল বাধার প্রাচীর।



এক সময়, পথিকের শক্তি ফুরিয়ে যায়। তার সাহসে, শক্তিমত্তায়, বীরত্বে ভাটা পড়ে। সে বিকল যন্ত্রের ন্যায় অচল হয়ে পড়ে। নিজের শক্তিতে সে চলতে পারে না। মাথা দুলে না, চুল উড়ে না, ধুলাও উড়ে না। তার গতিও কেউ রোধ করে না।



দিন আসে, দিন যায়। প্রবীণের খালি আসনে নবীনের ছায়া পড়ে। বটের শাখা-প্রশাখা বাড়ে। নতুন পথিক ছায়া নেয়। সুখে গুনগুনিয়ে উঠে। ভাবুক মন ভাবে, এই বটগাছ শতবর্ষের ইতিহাস, প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরের হাহুতাশ। এখানে পড়েছে অগণিত পথিকের ক্লান্তিকর পদক্ষেপ আর অবহেলিত ছায়া। কিন্তু তারা আজ কোথায়? তারা কি শুধু যাওয়ার পথটাই চেনে, আসার পথ চেনে না? অবশ্য আসার পথ চিনে লাভ নেই। কারণ, এ পথ চূড়ান্ত গন্তব্যের পথ। যে গন্তব্য পানে শুধু যাওয়া যায়, ফিরে আসা যায় না।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.