নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আন্‌ওয়ার এম হুসাইন। বাংলাদেশী লেখক। দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক বাংলা ও কিশোর বাংলায় গল্প লিখি।

আনু মোল্লাহ

আন্‌ওয়ার এম হুসাইন এর ব্লগ

আনু মোল্লাহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্পঃ মতিচোর

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:৫৪



- শোন্‌ আমি তো সেভেন এইটের বেশি পড়তে পারি নাই। আমার বাপেরে আমি দেখিই নাই। মায় চেরমান বাড়িতে কাজ কইত্ত। সেই সমে আমারে নিয়া চেরমানের কামে লাগাইদিল। ভালাই আছিলাম। চেরমানের গরু গোথান দেখি, ঘাস কাডি, গরু গুলানরে খাওন দেই। কম বেশ নিজেও খাওন পাই। ঈদে চাঁন্দে মাইনষের কাছে যা সাহায্য সহযোগিতা পাইত হেই গুলা জমাতে লাগল। মার ইচ্ছা অনে টেকা জমা হইলে। আমারে বিদেশ পাঠাইব। মা জানেও না, বিদেশ যাইতে কয় টাকা লাগে। তয় জানে অনেক টাকা লাগে। আর মাও এক টাকা দুই টাকা কইরা জমায়। আর ভাবে একদিন অনেক টাকা হইব। এর মাঝে একদিন গ্রামের চৌকিদার মারা গেল। আমিও একটু ডাঙর হইছি। মা গিয়া চেরমানেরে কইল মতি মিয়ারে বোড অফিসের এককান কাম দিয়া দ্যান না, হুজুর। আপনার লগে লগে থাইকব। আপনার হা খেজমত কইরব। যাক চেরমানের দয়া হইছে। আমাদের নিয়া চৌকিদারি পোস্টে ঢুকাই দিছে। পোশাক আশাক দিছে। জীবনে প্রথম পেন্ট পইচ্ছি। এর আগে কোনদিন পেন্টে ঢুকি নাই। নোতুন নোতুন গা চুলকাইত রে খালি। যা হোক সারাদিন লাডি একটা নিয়া চেরমানের পিছে পিছে ঘুরি। রাইতের বেলা বোড অফিসে ঘুমাই। মাসে পাঁচশ টেকা বেতন। শেষের দিকে অবশ্য একহাজার টাকা কইচ্ছিল। মায়ে সইন্ধ্যা অইলে চেরমান বাড়িততুন খাবার নিয়া দিয়া আসত। মাঝে মাঝে এদিক সেদিক চ্যাঁচড়া চোর, সিঁদেল চোর ধরা পরে। মাইষে ধইরা আইচ্ছা মত বানানির পরে আমি গিয়া মনের সুখে আরো দু চার ঘা দিয়া থানায় দিয়া আসি। হের পর কি হয় কে জানে। এরা আবার চুরি করে। আমার অত চিন্তার কাম কি! আমার কাম আমি করি। হেগো কাম হেরা করে। আমি বালাই আছিলাম রে। হুন্‌ ইশকুলে থাইকতে একবার স্যারেরা লিখত দিছিলো জীবনের লক্ষ্য কি। আমি শালার পড়া লেয়া কিছুই পাইত্তাম না। পারমু কোনতুন, মাস্টারের কেলাসে যা কইতো সব আমার মাথার উপরে দিয়া যাইত। এমন কোন দিন আছিল না আমি পিডা খাই নাই। তহন বুঝতাম না রে এহন বুঝি, চোর খালি আমি না। মাস্টারেরাও চোর। তারা যে পড়া চুরি করে হেইটা কিন্তু কেউ কয় না। আমি যেমুন চোর হেরা তেমন চোর। হেরা খালি কইত আমার মাথায় খালি গোবর। আইচ্ছা তুই ক, আমার মাথায় যুদি কিচ্ছু না থাকে আমি হুদা হুদাই এত বড় চোর অইছি। চোর অওয়া কি এত সোজা। তাই ত মাইসে জজ বেরিস্টার না অই চোর অইত।
-ওস্তাদ চোর অওন কি, জজ বেরিস্টারির তন কটিন। চোর মাথা কি হেগো চাই ভালা?
-তুই আসলেই বেআক্কইল্লা রে। তুই যুদি কোন জজ বেরিস্টার রে আনি কছ চুরি করবার, পাইর বো? পাইর বো না। মাইর খাই বুত হই যাইব। চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা, বুঝলি?
-হ ওস্তাদ।
-চুরি তে বহুত কিছিমে বেরেন খাটান লাগে। বহুত চিন্তা ভাবনার বিষয় আছে। কার বাড়ি চুরি করবি। কিভাবে চুরি করবি। কখন চুরি করবি। ধরা খাইলে কি করবি। বহুত বেপার আছে। যাই হোক আমি হেই দিন খাতায় লিখছিলাম, আমি পুলিশ হমু। পুলিশ হইয়া চোর পিডামু। সেই সমে চেরমান বাড়িতে চোর ধরা পড়ছিল। চোরেরে বাইন্ধা থুইছিল, পুলিশ আইসা পিডাইতে পিডাইতে থানায় নিয়া গেল। দেইখা মনে হইল বড় হইয়া আমিও চোর পিডামু। কষ্ট কইরা দৌরায়া ধরতে হয় না, বাঁনতে হয় না। আরেক জনে ধইরা বাইন্ধা রাখব তুমি আইসা পিডাবা। হেবি মজা। আমি মনে কই পুলিশ অই নাই তো কি অইছে চৌকিদার তো হইছি। চোর তো পিডাই।

-ওস্তাদ সবি তো বুইঝলাম। কিন্তুক তুমি চোর হইলা কেমনে। হেইডা তো কইতাছো না।
-আরে কইতে দে না। আমি সেইদিকেই তো যাইতেছি রে বাপ। আর শোন চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা। এতে ধৈর্য ধরন লাগে। তোর ধৈরয দেখতাছি একদমই নাই। চোর হবি কেমনে। চুরি বহুত সাধনার জিনিস। বুঝলি? চুরির মত একটা ভালা কামে আইসা, প্যানর প্যানর পশ্ন করবি না। পশ্ন করন মানা।
-হ ওস্তাদ বুঝচি।

প্রত্যেক গ্রামে একটা চোর থাকা নিয়ম আছে। আমাদের গ্রামে তেমনি আছে মতি চোর। ভদ্রলোকেরা বলে মইত্যা চোরা। মতির মা মতিরে বিয়ে করিয়েছিল। পাশের গ্রামে। তখনো মতি মইত্যা চোরা হয়নি। মতির বউ সুন্দরই ছিল। শ্বশুরের গ্রামের বাজারে একটা ছোটখাট চায়ের দোকান আছে। ছেলেপুলে বলতে দুইজন। মতির বউ আর তার একটা ভাই। ভাইটা বাপের সাথে দোকানে কাজ করে। মতির বউ চলে গেছে বাপের বাড়ি। চোর চ্যাঁচ্যড় জামাইয়ের ভাত খাবে না। অবশ্য মতিকে ফেরানোর চেষ্টা সে কম করে নাই। নরম কথা, গরম কথা, কান্না-কাটি কোন কিছুই বাদ রাখেনি। মতির কথা চুরি কি খারাপ নাকি! অন্য কাম যেমন কাম চুরিও তেমনি একটা কাজ। এই নিয়ে এত চিল্লা পাল্লার কি আছে। তবে মতির চোর হওয়ার পেছনে একটু ইতিহাস আছে। সে ইতিহাসও চোরের মত সাধারণ ইতিহাস। বিচিত্র নয়। গ্রামের চৌকিদারি পেয়ে মতির দিন ভালই যাচ্ছিল। শেষে মতির মা মতিরে বিয়ে দিল। মাসে মাসে বেতন পায়। চেয়ারম্যান টুকটাক সাহায্য করে। ইউনিয়ন পরিষদের রেশন রিলিফ এসব পেয়ে সে বলতে গেলে স্বাচ্ছন্দেই যাচ্ছিল।



সেবার ব্যাপক ঝড় উঠল। আপনাদের হয়ত মনে আছে ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখে। বিষম ঝড়, অসীম বিপদ। শুধু মতির নয়, গ্রামের সকলের ঘর-বাড়ি পড়ে গেল। গরু-ছাগল মরল। মানুষ মরল। চারিদিকে চিত্তিসান অবস্থা। শুধু চেয়ারম্যান সাবের মত যাদের দালান করা ঘরবাড়ি তাদের কিছু হয়নি। তাদের যা গিয়েছে গাছ-পালা, পশু-পাখি, গরু-ছাগলের উপর দিয়ে গিয়েছে। আর বাকিদের অবস্থা ঝড়ে পাওয়া বাসা ভাঙা দুমড়ে মুচড়ে কাবু হওয়া পাখিদের মত। সেদিন সকাল সকাল এসে চেয়ারম্যান সাহেব তড়িঘড়ি করে মতির ঘর উঠিয়ে দিলেন। শুধু উঠিয়ে দেয়া নয়, আগে ছিল খড়ের চালা, তাড়াতাড়ি টিনের চালা বসিয়ে দেন। মতির মা তো আনন্দে কেঁদে ফেলে। সিজদা করার নিয়ম থাকলে তারা মায়ে-পোয়ে দুজনে সিজদা করে নিত চেয়ারম্যান সাহেব কে। চেয়ারম্যান নিজে দাঁড়িয়ে তদারকি করে লোকজন-মিস্ত্রী-কামলা লাগিয় ঘর উঠিয়ে দিলেন।

সরকারি বেসরকারি ত্রাণসামগ্রী আসতে লাগল। সব এসে জমা হচ্ছে বোর্ড অফিসে। ক্ষতিগ্রস্থদের লিস্ট করে তাদের মাঝে বিলি বন্টন হবে। মতির মার নামে একটা কার্ড করে দিলেন তিনি। চালের বস্তা, আটার বস্তা, ডালের বস্তা, বিস্কিটের টিন, জামা কাপড়, ঢেউ টিন, চায়ের প্যাকেট কি আসেনি। এমনকি দু একটা তাঁবু, টমেটোর সসও এসেছে। মতির ফুসরত নেই। দিন রাত পাহারা দিতে হয়। দিনের বেলা লোকজন আসে লাইন ধরে। তাদের কে এক সের আধ দের পোয়া ছটাক করে হিসেব করে দেয়। মেম্বাররা ঠিক করে দেয় কাকে কতটুকু দিতে হবে। এত দেয়ার পরেও স্টক শেষ হয় না। বোর্ড অফিসের স্টক বাড়তেই থাকে। কমে না। এক দিন রাতের বেলা বস্তায় বস্তায় জিনিস পত্র এসে জমা হতে লাগল মতির নতুন ঘরে। ঢেউ টিনও আসল আসল বানে বানে। চাল ডাল বিলি বন্টল হলেও টিন এখনো বিলি হয়নি। লিস্ট হচ্ছে। লিস্ট শেষ হলে বিলি হবে। মতি অবাক হয়ে যায়। চেয়ারম্যান বলেন আরও অনেক মাল আসবে। বিভিন্ন জায়গায় তিনি খবর পাঠিয়েছেন তাঁর ইউনিয়নে লোকজনের দুর্দশার কমতি নেই। এত জিনিস পত্র বোর্ড অফিসে রাখা ঠিক না। মতির বাড়িতে বরং হেফাজতে থাকবে। চারিদিকে চোর-ডাকাতের তো অভাব নেই। কার মনে কি আছে বলা যায় না। এত মাল পত্রের লোভে খুন খারাবিও হয়ে যেতে পারে। কিছু মাল বোর্ড অফিসে থাক। বেশির ভাগই থাকবে মতির ঘরের নিরাপত্তা বলয়ে। মতি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তবে জান দিয়ে পাহারা দিয়ে রাখে ঘরের মাল। বোর্ড অফিসের মাল। ঘরের একটা চাল ডালও ধরে না। কষ্ট করে বড় হয়েছে। কিন্তু পরের জিনিস হজম করে অভ্যস্ত না। অভ্যস্ত হলে সেও হয়ত একদিন মেম্বার চেয়ারম্যান হত। মারে বৌরেও ধরতে দেয় না। চেয়ারম্যান তাকে নিজের ছেলের মত বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিয়েছেন। তার খেলাফ সে করতে পারবে না। নিজের জান থাকতে না।

আস্তে আস্তে লোকজনের জানাজানি হয়ে যায়। মতির ঘরে রিলিফের মাল বোঝাই। চৌকিদারির নামে মতি যে এরকম কাম করতে পারে লোকের বিশ্বাস হয় না। চেয়ারম্যানের বিরোধী পক্ষও খবর পায়। চৌকিদার মাল পত্র সব সরিয়ে ফেলেছে। সাবেক চেয়ারম্যান আজরফ আলী বুঝতে পারেন বিষয় টা। থানায় গিয়ে মামলা করেন চেয়ারম্যান সব মালপত্র নিয়ে চৌকিদারের বাড়ি উঠিয়েছে। নিজের বাড়িতে না উঠিয়ে মতি চৌকিদারের ঘরে উঠিয়েছেন। চেয়ারম্যানের অগোচরে মতির পক্ষে এই কাম একলা সম্ভব না।

পরদিন সকাল বেলা মতির ডাক পড়ে চেয়ারম্যান বাড়ি। থানা থেকে পুলিশ আসবে। চেক হবে মতির বাড়ি। প্রথমে মতি বুঝতে পারে না। চেক হলে কি হবে! আর চেক হবে মানে টা কি? তারা তো আর চুরি করে নি। জিনিস পত্রের নিরাপত্তার জন্য ঘরে নিয়ে এসেছে। চেয়ারম্যান অত কিছু বুঝতে চান না। তাঁর কথা মতি কে স্বীকার করতে হবে সে চুরি করেছে। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে তিনি আঙুল বাঁকা করে ফেলেন-
- পুলিশ এসে যদি তোর ঘরে জিনিস পত্র পায় তোকে থানায় নিয়ে যাবে। তুই চুরি করিস নি বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। তার চেয়ে স্বীকার করে ফেললে ভাল।
- আপনেই তো মাল পত্তর সব আমার ঘরে আনছেন। আমি চুরি করি নাই। দিন রাইত পাহারা দিছি। এহন ক্যান কমু চুরি করছি--
- তুই কইলেও লোকে তোরেই চোর কইব। না কইলেও বলবে। আমার জিনিস আমি কিভাবে চুরি করব? তোর বাড়িতে মালপত্র সুতরাং তুইই চোর। তার চেয়ে তুই স্বীকার কর। পুলিশ তোরে থানায় নিয়া যাবে। আমি তো আছি। বাকিটা আমি দেখব। পুলিশ তোরে কি করব না।
চেয়ারম্যান সাহেব বেশি কথার মানুষ না। তিনি আর কথা বাড়ান না। মতি বলতে গেলে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “কোন কথা না। যেভাবে বলছি ওভাবে কর। না হলে বিপদে পড়বি। বিপদে পড়লে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। আমার কথা মত কাজ করলে আমি আছি। আমি দেখব। এখন বাড়ি যা। ঘুমা গিয়া। থানায় নিয়া গেলে ঘুমায়তে পারবি না”।




সকাল নয়টার দিকে পুলিশ আসে। গ্রামের লোকজনও আসে দলে দলে। পুলিশ কে সার্চ করতে হয় না। ঘরে ঢুকেই দেখে মাটি হতে ছাদ পর্যন্ত বোঝাই করা রিলিফের মাল। মালামালের একটা তালিকা করেন তারা। এরকম করা নিয়ম। এসব চোরাই মাল উদ্ধার করে বোর্ড অফিসে চেয়ারম্যানের হেফাজতে দেয়া হবে। মতি কিছুই বলতে পারে না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে শুধু। কিছুই বলতে পারে না। চোখে মুখে দিশেহারা ভাব। তাতে সহানুভূতি আসে না কারো। গ্রামবাসীর হকের জিনিস চুরি করার জন্য লোকজনের মনে ঘৃণাই আসে শুধু। ওসি সাবের ধমক খেয়ে ‘হ আমি করছি’ কোন মতে বলে মতি। মতি যে একটা মিচকা শয়তান সন্দেহ থাকে না কারো। দু-এক জন নিরেট মাথা গণ্ডমূর্খ অবশ্য বুঝতে পারে না চেয়ারম্যানের নাকের ডগার উপর দিয়ে নিরীহ চৌকিদার কিভাবে টনকে টন রিলিফের মাল ডাকাতি করতে পারে! মনের সন্দেহ মনেই থাকে। কেউ মুখ খোলে না। মতি নিজেই বলেছে সে চুরি করেছে। আর কার কি বলার আছে! কোমরে দড়ি হাতে হাতকড়া দিয়ে থানায় নেয়া হয় তাকে। পুলিশ চেয়েছিল মতির মাকে বোউকেও ধরে নিয়ে যেতে। অবলা নিরীহ মেয়ে মানুষ। তাদের কোন দোষ নাই। ছেলের জন্য মাকে বৌকে না নিতে অনুরোধ করেন চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের কথা ফেলা যায় না। না হলে সকলের কোমরে দড়ি পড়ত। দলে দলে উৎসুক লোকজন পেছনে পেছনে বাজার পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে যায়। পেছনে মতির মা আর বৌয়ের কান্নার রোল পড়ে যায়। আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসে তাদের কান্নায়।

চেয়ারম্যান সাহেবের দয়ার শরীর। পুলিশের হাতে কিছু ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘গরীব মানুষের ছেলে। অভাবে পড়ে কাজটা করছে। বেশি মার-ধর করার দরকার নাই’। পুলিশ কর্মকর্তা পকেটে হাত ঢুকাতে ঢুকাতে বললেন, ‘ আসলে চোর পিটাতে মজা আছে। কিন্তু জানেন কি, আসল চোর কে আমরা কোন দিনই পিটাতে পারি না’। নিজে বাড়িতে গিয়ে মতির বাড়িতে দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দিলেন। বউ শ্বাশুড়ি কান্না কাটি করতে করতে দুপুরের খাবার রান্না করার সময় পাবে না। এটা তিনি জানতেন।

ধাক্কা মেরে হাজতে ফেলে দিয়ে তালা বন্ধ করে দেয় ডিউটি পুলিশ। পড়ে গিয়ে ওভাবেই শুয়ে থাকে মতি। ওঠার কোন ইচ্ছা নেই তার। কোন কিছু করারই ইচ্ছা নেই। স্যাঁতসেঁতে হাজত ঘর। প্রস্রাবের গন্ধ। দিনের বেলায়ই মশাদের যন্ত্রণা। এক কোন অন্য হাজতিরা একজন কে ঘিরে গোল হয়ে আছে। কেউ কেউ তার পা টিপছে মনে হয়। সেই লোকটি তার সাঙ্গদের বলল দেখত মালটা কোত্থেকে এল। মতি কিছুই বুঝার আগে টেনে হেঁচড়ে কয়েকজন গুন্ডামত লোকটির সামনে নিয়ে যায় তাকে।
- কিরে, কি করছিলি?
- মাডার?
- ডাকাতি?
মতি কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে থাকে। হাজতে যত বড় অপরাধি তত সম্মান। খুনির মান ইজ্জত সব থেকে বেশি। আস্তে আস্তে অপরাধের মাত্রা বুঝে গ্রেড নিচে নামতে থাকে। চোরের মান ইজ্জত বাইরেও নাই হাজতেও নাই। ভাল মানুষ সেখানে অচ্চ্যুৎ। তার অবস্থান থাকে সর্ব নিম্ন স্তরে। মতির কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে লোকটি আবার জিজ্ঞেস করে কি করছিলি? কোন উত্তর না পেয়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় মতির গালে। এটাই নিয়ম।
- মাডার করছিলি?
মতি মাথা নাড়ে?
- ডাকাতি করছিলি?
মতি মাথা নাড়ে।
- তো করছিলি টা কি হারামজাদা, বদমাইশ। কথা কস না ক্যা?
- কিছু করি নাই।
হো হো করে হেসে উঠে সবাই। ভাল একটা শিকার পাওয়া গেছে। খেলানো যাবো। এক চামচা বলে কিছুই যহন করস নাই আপাতত বসের হাত-পা টেপ। হত বিহ্বল মতি যন্ত্রের মত লোকটার পা টিপতে থাকে।

কত চোর ধরে এনে এখানে দিয়ে গেছে মতি। আজ তাদের সকলের জন্য খারাপ লাগে মতির। মনে হয় কে জানে তাদের মাঝে কেউ কেউ না কেউ হয়ত তার মত বিনা দোষেই হাজতে এসছিল। একবার একবার এক চোররে বিষম মাইর দিয়েছিল লোকজন। মতি গিয়েও দু চার ঘা দেয়ার লোভ সামলাতে পারে নি। লোকটার কি হইছিল জানি না। মতি রে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে লোকটা কয় পোলা পাই না খাইয়া ছিলরে ভাই। নইলে কি আর আমি চুরি করি! চোরের মায়ের বড় গলা। লোক জন আরো তেড়ে আসে। কি জানি মতির হয়ত মায়াই লাগছিল চোরটার জন্য। সে ঠেকায় লোকজনকে। থানায় দিয়ে আসে লোকটাকে। পরদিন খুঁজে খুঁজে চোরটার বাড়ি গিয়েছিল সে। ছয় সাত বছরের একটা বাচ্চা আছে লোকটির। ছেলেটাকে ডেকে দশ টাকা দিয়ে এসেছিল সে। এর বেশি তার কাছে ছিল না। থাকলে হয়ত আরো বেশি দিত। ছেলে টা না খেয়ে না দেয় বাপের জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিল। ভালই হয়েছে তার কোন ছেলে পুলে নাই। থাকলে তার জন্য কেঁদে কেটে এরকম চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলত। কাঁদা কাটার কথা মনে পড়তেই মার কথা মনে পরে। সেই ছোট্ট ছেলেটার মত মাও তো কাঁদতে কাঁদতে শেষ। আর বউ, যে তার ছেলের মা হবে একদিন। আহারে! কাঁদতে কাঁদতে হয়ত খাওয়াই হবে না তাদের। খাওয়ার কথা মনে হলে ক্ষিদা পায় মতির। দুপুর হয়ে গেছে। সকালেই কিছু খায়নি সে। হাজতে কি খাওয়া দাওয়া কিছু দেয়! নাকি, না খাইয়ে রাখা নিয়ম। মতি বুঝতে পারে না।


চেয়ারম্যানের বদান্যতায় কোর্টে চালান হয়না মতি। কয়েকদিন হাজতবাসের পরেই ছাড়া পায়। এ কয়দিন চেয়ারম্যানের লোকজন এসে খাবার দিয়ে গেছে। যদিও তার কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। ছাড়া পেয়ে দাড়িয়াকান্দা থানা সদরে সারা সকাল বেলাটা এলোমেলো হেঁটে দুপুরের দিকে কারো দিকে না তাকিয়ে মা ও বৌয়ের অশ্রুভাঙা কান্নায় ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা এসে নিজের ঘরে ধুকে ঝিম মেরে রইল। বৌ খাবার এনে দিলে খাবারের জায়গায় খাবার পড়ে রইল। তাকিয়ে দেখল না। দিনাশ গুন্ডার মত বটির এক কোপে চেয়ারম্যানের মাথাটা যদি নামিয়ে দেয়া যেত তবে সে শান্তি পেত। রাতের অন্ধকারে গিয়ে চেয়ারম্যানের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিবে কিনা সে চিন্তাও উঁকি দিল। বোর্ড অফিস টাকে কোন এক মুহুর্তেই যদি উড়িয়ে দেয়া যেত তবে সে কিছুটা শান্তি হয়ত পেত। দিনাশের মত সাহসী সে না। মানুষ মারা তো দূরে থাক পিঁপড়াও মনে হয় মারতে পারে না। সাহস থাকলে সে হয়ত দিনে দূপুরে শত লোকের সামনে চেয়ারম্যানের মাথা ফাটিয়ে আবার জেলে যেত। আর খুনি হয়ে অন্য কয়েদিদের দিয়ে হাত পা টেপাত।




বিকেলে চেয়ারম্যান সাহেব ডেকে পাঠিয়ে বললেন তুই আগের মতই চৌকিদারি করতে থাক। কোর্টে মামলা ঠেকিয়ে দিয়েছি। এই নিয়ে চিন্তা করার কিছু নাই, সব কিছুই আগের মতই থাকবে। তুই আমার লোক তোরে কেঊ কিছু বলার সাহস পাবে না। মানুষের জীবনে এই রকম দূর্ঘটনা হয়েই থাকে। মতি মনে মনে চেয়ারম্যানের লোকের নিকুচি করল। মুখে হাঁ না কিছুই বলল না। চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বের হয়ে সেই বিকেলেই কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেল মতি। দুই মাস কোন খোঁজ খবর পাওয়া গেল না। দুই পর একদিন রাতের অন্ধকারে আবার নিজের ঘরে এসে ঢুকল। সাথে বেশ জামা কাপড়। জিনিস পত্র। ঘরের লোকজন মনে করল কোথায় বুঝি নতুন চাকরি বাকরিতে ঢুকেছে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই আসল ব্যাপার টা আস্তে আস্তে পরিস্কার হতে লাগল। কোন এক দোকার সামনে কি কোন বাজারের গলিতে কেউ হয়ত সাইকেল রেখে কোথাও গেছে। চাবি লাগাতে ভুলে গেছে কিংবা আসে পাশেই আছে তাই চাবি লাগায় নি। সাইকেল টা নিয়ে মতি পগার পার। আশে পাশের গ্রামের লোকজনের গাছের নারিকেল সুপারি সমানে সাবাড় হতে লাগল। নতুন বিদেশিওলা এসেছে। অনেক রাত জেগে গল্প সল্প করে ঘুমিয়েছে। এই ফাঁকে স্যুটকেসটা নিয়ে কোন ফাঁকে মতি পালিয়েছে। ধরাও খেয়েছে। মারও কম যায়নি। থানায় গেছে। মামলাও হয়েছে। জেল জরিমানা হয়েছে। ফিরে এসে মতি আবার আগের কামে। প্রথম প্রথম মা আর বৌ অনেক কান্না কাটি করেছে। কিছুতেই কিছু হয়নি। শেষে দু জনেই গেছে। একজন কবরে। আরেকজন বাপের বাড়ি। বাপের বাড়ি গিয়ে বসে থাকে নি। বাপ তাকে আরেক বিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা দিন মজুর। চোরের ঘরে ভাত খাওয়ার চেয়ে মজুরের ভাত খাওয়া অনেক ভাল।

দিনে দিনে আমাদের মতি এই চুরি বিদ্যার প্রকাশ্য নিয়ম নীতি সব শিখে গেল। থানায় তার নামের পাশে একটা নম্বরও জুটল। কোথাও কোন চুরি গেল কি খোয়া গেল মতি চোরের ডাক পড়ে থানায়। মাঝে মাঝে ধরা খেয়ে সে মার ধোরও খায়। সে থেকে বাঁচার নানা টেকনিকও সে আয়ত্ত করেছে। শেষে বাঁচতে না পারলে সে নিজেই বলে আমাকে থানায় দেন। মারেন ক্যান? চোরের শেষ আশ্রয়স্থল থানা!

আরো দুই গ্রামের দুটা চোরকে সাথে নিয়েছে সে। ওরা জাত চোর। জাত চোর হলেও কিভাবে জানি না তারা মতির বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। দিনে দিনে চোরদের ছোট¬ খাট একটা সর্দার বনে যায়। সারারাত এদিক সে দিক চুরি চামারি করে সকাল বেলা ঘুমায়। দুপুরের পর সারা বিকেল মোড়ের চা দোকানে গিয়ে বসে থাকে। চা খায়, বিড়ি ফুকে, আড্ডা বাজি করে। অন্য অনেক চোরের মত মতিও নিজের এলাকায় চুরি করে না। তবে সারারাত ঘুরে ফিরে যদি চুরি করার মত তেমন কিছু খুঁজে না পায় তবে বাড়ি ফেরার সময় হয়ত আশে পাশের কারো বাড়ির উঠোন দিয়ে আসার সময় থেকে কারো বালতি টা বদনা টা হাতে নিয়ে চলে আসে। দাড়িয়াকান্দা বাজারে ভাঙারি দোকান, সাপ্লাইয়ের দোকান, আড়তদার মহাজন, ব্যাপারি, ফাড়িয়া অনেকের সাথে খাতির হয়ে গেছে মতির। এদের সাপ্লাইয়ার সে। চোরাই মালে অনেক সুবিধা। অর্ধেক কি সিকি দামে এমন কি তার চেয়ে কম দামে কেনা যায়। চোরদের দিলে জোর কম বলে বেশি দর হাঁকাতে পারে না। অনেক সময় অনেক দামী জিনিসের মুল্য ঠাহর করতে পারে না। অনেক দামি জিনিস নামমূল্যে দিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে তার কাস্টমাররা আগেই ফরমায়েশ দিয়ে রাখে বিশেষ কোন জিনিসের জন্য। ফরমাশ মত জিনিস কালেকশন করে পরে সাপ্লাই। কোন বাড়ি তে কে বিদেশিওলা এসেছে, কে নতুন টিভি কিনেছে এসব খোঁজ খবর করতে হয়। কোন এক সাগরেদ কে পাঠিয়ে খবর আনতে হয় তারপর চুরি করতে যেতে হয়। যে খোঁজ খবর করতে যায় সে মূল অপারেশনে থাকে না। নানা রকমের ফন্দি ফিকিরের ব্যাপার আছে পুরো বিষয়টাতে।

প্রথম প্রথম লোকজন দেখলে কেমন করে তাকাত, দূরে সরে যেত। চায়ের দোকানে বসলে অন্যরা অস্বস্তি দেখাত। চারিকিকে কেমন এক অব্যক্ত ছিঃ ছিঃ। বুঝতে পারে সে। বলে, ‘আমার গায়ে কি গু লাগি রইছে? এমন কর কেন মিয়া। চুরি করি? সে তুমি আমি সবাই করে’। নজিমুদ্দীন কামলা সে দিন সরাসরি বলে ফেলেছিল, ‘চোরার মা’র ব’ গলা’।
-চোরার মা’র না ক’ চোরার ব’ গলা। আমার মাই নাই। ব’ গলা ত পরের কথা। আর চুরির কথা যদি কও আমার চেয়ে তুমিও কম যাও না মিয়া। আমি চোর বেবাকেই জানে। আমিও স্বীকার করি আমি চোর। তুমি কর না। কে ভালা?
গালি দিয়ে তেড়ে আসে নজিম। এত্ত বড় কথা।
মতি বলে, ‘ঠান্ডা হও মিয়া। মাথা অত গরম অইলে অয় না। আজিম বেপারির ক্ষেতে কাম করতে গেলে ধানের গোছা হাতায় ক গা দেও। তিন ডা না দুই ডা? এক বার চাঁ’র জিরানি, বিরি’ র জিরানি। কাম বেশি না জিরানি বেশি? টেকা কি আধা নেও না পুরা’।

বেশ কিছুক্ষণ বাত চিত চলে এই ভাবে। নজিম চিৎকার করে, গালি দেয়, তেড়ে আসে। আশ্চর্য! মতি গরম হয় না। ঠান্ডা মাথায় পাকা পাকা কথা বলে। মতি কে আজকাল আর কেউ গাঁটায় না মাস্টার, না মুন্সি, না বেপারি কেউ না।

চেয়ারম্যানের বেয়াই বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি চুরি হয় বেশি। নালিশ আসে তাঁর বরাবর। চেয়ারম্যান হয়ে তাঁর নিজের আত্মীয়-স্বজনের জান মাল হেফাজতে না থাকলে মান ইজ্জত থাকে না। মতি কে ডেকে শাসান। মাল পত্র ফেরত দিতে বলেন। প্রথম প্রথম শালিশ বিচারে গিয়েছে। এখন আর যায় না। ‘থানায় মামলা করতে বলেন। যা কওয়ার থানায় গিয়া কমু। এহানে কিসের কথা’ - মুখের উপর বলে আসে সে। চুড়ান্ত বেয়াদবির জন্য হাত পা ভেঙে দিবেন কিনা বুঝতে পারেন না চেয়ারম্যান। দিতে হবে। নিশ্চয় দিতে হবে। জন্মের মত শিক্ষা দেয়া দরকার। থানা পুলিশ কি চোরের জন্য না মানুষের জন্য!



‘শোন আর ক দিন এই রম পরের জিনিস হজম করবি। চুরি চ্যাঁচড়ামি আর কত?’ বদি আর কলু। যদিও দুই জনেই এসে মতির ছায়ার নিচে দাঁড়িয়েছে চুরি তাদের জাত ব্যবসা। জাত ব্যবসা মানে দুজনেই চোরের ঘরের চোর। সুতরাং চুরি ছাড়া কি আর করবে তারা! মতির ঘরের দাওয়ায় ছেঁড়া ফাঁড়া পুরান একটা বিছনার উপর বসে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে দুজন।
‘শোন আমি কই কি একটা শেষ দান মারি। এর পর চুরি চ্যাঁচড়ামি চাড়ান দিই’। মতি আবার বলে।
‘কিন্তু সেই দান পামু কই ওস্তাদ’। দুজনেরই জিজ্ঞাসা।
ব্যবস্থা আছে। মতি করে রেখেছে। দিনের পর দিন আমাবস্যার রাতে চুরি করে ঘরে ফিরতে ফিরতে ঝোপ জঙ্গল বন বাঁদাড়ের ঘুটঘুটে অন্ধকারে এই পরিকল্পনা সাজিয়েছে মনে মনে। মতির চাচাত বোন রুপি কাজ করে চেয়ারম্যান বাড়ি। ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে নানা ফন্দি ফিকির করে শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে পেরেছে।
‘অই বইদ্যা বিয়া করবি না’?
‘ব্যবসা পাতির ঝা অবস্থা – নিজেই খাইবার পাই না, আবার বিয়া’।
‘হুন আমি অ ত হেইডাই কই। চুরি অ ছারান দিবি, বিয়া অ অইব’।
ফুসুর ফুসুর গুজুর গুজুর করে অনেকক্ষণ শলা পরামর্শ করে তারা। এমন নিবিড় পরামর্শ হাতের বিড়ি জ্বলে শেষ হয়ে যায় টেয় পায় না।
রাত গভীর হয়।
উঠানের পরে একটা শিমুল গাছ হতে পাখা ঝাপটিয়ে চলে অজানা পাখি।
আরামে বিড়ি টানে তিন জন। এখন অপেক্ষা শুধু রুপি যে দিন সংকেত দিবে।

রাত দুই প্রহর শেষ। চেয়ারম্যানের পুরনো দাদার আমলের বাড়ির পিছনে খিড়কির পুকুর ঘিরে যে বিশাল বাগিছা তাতে চাঁদের রাতেও ঘুটঘুটে অন্ধকার। উঁচু পাঁচিল ডিঙিয়ে বাগানে নামে মতি, বদি আর কলু। চেয়ারম্যান বাড়ী নেই আজ। ঘরে চেয়ারম্যানের বৃদ্ধা মা। উনি নড়তে চড়তে পারেন না। আর আছে চেয়ারম্যানের ছেলে রবিন আর তার বউ। রবিন জংলী মাতাল। রাতে হুশ থাকে না। সারারাত মাতলামি চেঁচামেচি হই চই। বউ টারও শান্তি নাই।
রুপির সাথে পাকা কথা হয়েছে। দারিয়াকান্দা বাজার থেকে চেয়ারম্যানের ঘরের আর আল-মারির চাবির নকল বানানো হয়েছে। গত দুই বছর লেগেছে এই চাবি কায়দা করতে। নকল বানানো হলে চাবি আবার আগের জায়গায়। রুপি নিশ্চয় দরজা খুলে রেখেছে। এরা তিনজন যাবে আর আলমারি খুলে গহনা গাটি অলংকার সব নিয়ে আসবে। তারপর রুপি সহ চার জনেই পালিয়ে যাবে আজ রাতে।

মশার কামড় সহ্য করে অপেক্ষা করে তারা। চেয়ারম্যানের মতই তার বাড়ির মশাগুলো। তিন জনেরই বিড়ির টক উঠেছে চরম। কিন্তু আলো জ্বালাতে সাহস পায় না। মাতালের বকাবাজি শোনা যায় দূর থেকে। পুকুরে শান বাঁধানো পুরনো দিনের ঘাটলা। কে যেন আসে পুকুরের দিকে। হাতে কলসি। এত রাতে কলসি নিয়ে কে আসবে। পানির জন্য হলে রুপি ছাড়া আর কারো হওয়ার কথা না। পা টিপে এগিয়ে সাপের গায়ে পা দেয়া অবস্থা মতির। রবিনের বউ ঘাটে বসে চোখ মুছছে। কান্নার দমক আসছে বুঝা যায় মতির। বউটাকে চেনে সে। সুখে নাই। রুপির কাছে কাহিনী শুনে নানান কাহিনি। মার ধোর অত্যাচার নির্যাতন লেগেই আছে। বাপের বাড়ি থেকে টাকা চায় রবিন। বউ এর বাপের বাড়ি আরিয়াবান্দা গ্রামে। ভরা রূপ যৌবন। রবিনের হাতে বাপের টাকা কম দেয় নি। বাপে জায়গা বেছে জমি বেচে মেয়ের সুখের জন্য টাকা দিয়েছে। এটা সেটা নানান কথা বলে টাকা এনেছে। তাও শান্তি নাই। মাতালের হা বন্ধ হয় না। মার ধোর গালিগালাজ প্রতি রাতেই। মতির ধন্ধ লাগে। বউটা কি মরার জন্য এসেছে নাকি। হাতে কলসি নিয়ে এই সময় একা একা ঘরের বউ পুকুর ঘাটে কান্নাকাটি সুবিধার মনে হয় না মতির। বদি আর কলু কে ইশারা করে কাছে আসার। যা ভাবছে তাই। কান্নার দমকে দমকে গলায় কলসি বাঁধছে বউটি। বদি বলে ডাক দেও না ওস্তাস। মতি থামিয়ে বলে আগে ডুব দিক তার পর।

পানির আন্দোলন আর বুদবুদ ঠান্ডা হয়ে এলে তিন জনে মিলে পানির নিচ থেকে উঠিয়ে আনে বউটিকে। নিশ্বাস এখনো আছে। তবে হুশ নাই। পেট ফুলে গেছে। ঘাটলার উপর উপুড় করে শোয়ায়ে পেটের পানি বের করে যা পারে। তিন জনে মিলে ধরাধরি করে চোরাই মালের মত নিয়ে আসে মতির বাড়ি।
জ্ঞান ফিরতেই বউ বলে, ‘আমি এখানে কেন? তোমরা কারা?’
- আমি মতি। মইত্যা চোরা।
- তোমরা আমারে বাঁচাইলা ক্যান? ওখানে কেন গেছ?
- ওখানে ক্যান গেছি বুঝ না? তোমার শ্বশুরের সর্বনাশ করতে গেছিলাম। তুমিই আমাগো সর্বনাশ করলা। এখন বাড়ি যাও।
শেষের দিকে মতির কন্ঠে বিরক্তি ঝরে।
- না মতি ভাই। আমি বাড়ী যামু না। মরতে আসছিলাম। আর ফিরত যাব। ওখানে যাওয়ার চেয়ে মরা হাজার ভাল। ওটা জাহান্নাম।
- যে দিকে খুশি সে দিকে যাও। তবে মইর না। মরা চুরির চেয়ে হাজার খারাপ।
বউ কি যেন চিন্তা করে। সাত পাঁচ ভাবে। মরতে গিয়েছিল। পারল না। আবার সেই হাবিয়া দোজখে! গায়ে গতরে নানান জায়গায় দেয়া রবিনের সিগারেটের ছেঁকা গুলো এখনো শুকায় নি। এই মতির সাথে পালিয়ে গেলে কেমন হয়! চেয়ারম্যান বাড়ির বউ চোরের সাথে পালিয়ে গেছে। চুনকালি পড়বে চেয়ারম্যানের মুখে। মরতেই যখন এসেছিলাম না মরে মেরে যাই! ওরা তিন জন বিড়ি ধরায়। এতক্ষণ উত্তেজনায় বিড়ির কথা মনে ছিল না তাদের। হালার রাত টা পুরা কুফা গেছে। ও দিকে রুপির কি অবস্থা কে জানে? মতির সব জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছা করে। চেয়ারম্যানের দোতলা ঘরে আগুন লাগানোর কেরামতি মতির নাই। অন্ধকারে বিড়ির আগুন জ্বলে আর নিভে। একটার পর একটা বিড়ি জ্বালিয়ে মাথা ঠান্ডা করতে চায় তিনিজনেই। চার টি নিশ্বাসের শব্দ আর সব চুপচাপ। হটাৎ নিরবতা ভাঙে রবিনের বউ।
- আমারে তুমি রাখবা মতি ভাই? তোমার ত বউ নাই। আমারে রাখ।
- তোমার মাথা খারাপ হইছে? বাড়ী যাও।
বলেই মতির মনে হয় আসলেই যদি এমন হয়! গেছিলাম ঘর চুরি করতে, বউ চুরি ঘর চুরির চেয়ে অনেক ভাল! উত্তেজনায় মতির হাত পা কাঁপে।

বহু যত্নে রাখা মায়ের একটা পুরনো শাড়ী বের দেয় মতি। বলে তাড়াতাড়ি রেডি হও। এখনি মেলা করমু আমরা। বদি আর কলুর দিকে চেয়ে বলে এই রইল চেরমান বাড়ীর চাবি। আজ পারস আর দিন পারস তোরা কামডা সাইরা লইস। আমরা যাই।
বদি আর কলুর মুখে কোন কথা যোগায় না। ওদের বুঝতে সময় লাগে।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.