নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আন্‌ওয়ার এম হুসাইন। বাংলাদেশী লেখক। দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক বাংলা ও কিশোর বাংলায় গল্প লিখি।

আনু মোল্লাহ

আন্‌ওয়ার এম হুসাইন এর ব্লগ

আনু মোল্লাহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

হারু মাঝির ছেলে

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৩

‘আমারে আপনার চাদইর টা দিবেন? আমার জইন্য না। আমার মার জন্য। আমার মার খোব শীত।’

আমি লোকটার দিকে তাকালাম। রোগা পটকা টিংটিংয়ে শরীর। মুখভর্তি এলোমেলো দাড়ি গোঁফ। ঠোঁট ভর্তি লালা। দু এক ফোটা বেয়ে বেয়ে পড়ছে। হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে হাত বাড়ানো যেন সে জানে আমি চাদর টা তাকে দিয়ে দিব। গায়ে শরীরের চেয়ে বড় একটা টি শার্ট তার উপর একটা শার্ট। পরনে একটা প্যান্ট। এটাও তার সাইজের চেয়ে বড়। বুঝা যায় এগুলো তার নিজের না। কেউ হয়ত হয়ত দিয়েছে। গ্রামের কেউ অথবা কোন শৌখিন শী বস্ত্র বিতরণকারী ।

‘যা পাগলা!’ বলে সোলেমান মাতব্বর কড়া একটা ধমক দিলেন। ‘আমারে চাইদর টা দিবেন’ – ভেংচি কেটে টেনে টেনে মাতব্বর আবার বলেন। উনার বাপে উনার জন্য চাদর রেখে গেছেন। লোকটি আবার স্বাভাবিক ভাবেই চলে গেল।
‘হারু মাঝির ছেলে। পাগল। এর কথায় আবার কান দিও না’। আমাকে সাবধান করেন মাতব্বর।
শীতের সকালে গ্রামের চা দোকানের সামনে লম্বা টুল পেতে বসে বসে গল্প করছিলাম। অন্যরা সায় দেয় মাতব্ববের কথায়।

বাড়িতে ফেরার পথে লোকটি দেখি রাস্তার পাশে বসে আছে মন মরা হয়ে। আমার বেশ মায়া লাগল। আমি নতুন কেনা শাল টা খুলে তাকে দিয়ে দিলাম। লোকটা কিছু না বলে শাল টা নিয়ে দৌড় দিল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।

আপনারা হয়ত ভাবছেন আমি হাতেম তাঈ গোছের কেউ। আমি হাতেম তাঈ না। কলেজের মাস্টার। রংপুরের একটা নামকরা সরকারি কলেজে পড়াই। বাংলার মাস্টার। সুতরাং ছেলেমেয়েদের সাথে রঙ্গরসিকতা করে নজরুল-রবীন্দ্র-জীবনানন্দ মগজে বগলে টেনে টেনে বেশ ভালই দিন যায়। মাস্টারির সাথে সাথে পড়াশুনা লেখালেখি করি। ঢাকার বেশ কয়েকটা কাগজে শুক্রবারের সাহিত্যপাতায় আমার নাম ছাপা হয়। কয়েকটা বইও বেরিইয়েছে। কোথাও দাঁড়ালে উৎসাহি বালক বালিকারা অটোগ্রাফ খোঁজে। এই মফস্বলের বইয়ের দোকানেও আমার দু একটা বই দেখা। দেখে বেশ ভাল লাগে। শীতের সময় লম্বা বন্ধ। বাচ্চা কাচ্চাদেরও পরীক্ষা শেষ। আমি বউ বাচ্চা নিয়ে গাঁটরি বোঁচকা বেঁধে মাস খানেকের জন্য গ্রামে গিয়ে হাজির হই। প্রতি বছর হই। আমাদের বাড়ী বেশ বড় সড়। আমার চাচাত জেঠাত ভাই বোনেরা মিলে বিরাট হই চই কান্ড। সারা বছর বাড়ি থাকিনা বলে বড় ভাই এই সময় বেশ হাঁক ডাক শুরু করে দেয়। জাল ফেলা মাছ ধরা এই সেই নানা কাজ কারবার। মিলি বেশ উপভোগ করে। বাচ্চারা ও ঘুরাঘুরি করে মোটামুটি কালো হয়ে আসে। বান্ধা পাখি ছেড়ে দিলে যে অবস্থা তাদের সে অবস্থা।

বিকেলে বাড়ির উঠানে ভাইয়ার সাথে গল্প করছি এমন সময় দেখি সেই লোকটা। সকালের একই বেশ, একই রকম হাসি হাসি মুখে এসে আমার পায়ে সালাম করা শুরু করল। আমি বেশ অবাক হলেও ভাইয়া মিটিমিটি হাসছে। সালাম শেষ হলে ভাইয়া বললেন আজ আমারে সালাম করবি না? ভাইয়ার কথা থেকে বুঝলাম লোকটার এরকম সালাম করার বাতিক আছে। সালাম শেষে ভাইয়া তাকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে বলল যা তোর মার জন্য ওষুদ কিনিস। সকালের মতই লোকটা এক দৌড়ে চলে গেল।

‘হারু মাঝির নাম শুনিস নি? হারুন মাঝি।‘

হারু মাঝির নাম আমি শুনেছি। হারুন মাঝি। খেয়া নৌকার মাঝি ছিল সে। তিরিশ বত্রিশ বছরের যুবক। মনে বেশ দুঃখ ছিল। ছেলে পুলে ছিল না। সেই সময় যুদ্ধের বছর তার বউ পোয়াতি আনন্দ আর ধরে না মাঝির। একদিন একদল খান সেনা নাও পার করে দিতে বলেছিল মাঝি। সে বেশ ভাল মানুষের মতি নৌকায় তুলেছিল পনের বিশ জন খান সেনা কে। মাঝ দরিয়াতে গিয়ে নৌকা ঢুবিয়ে দেয়। স্রোতের টানে ঢুবে মরে সৈন্যরা। সাঁতরিয়ে কূলে পৌছে মাঝি। উঠে এক দৌড়ে বাড়ি গিয়ে পোয়াতি বউকে রেখে আসে বাপের বাড়ি। মুরুব্বিরা সবাই কইল তুমি আসলা ক্যান মাঝি। থাইকা যাইতা। মিলিটারি আবার আসতে পারে। হারুন মাঝি যাবে। তবে শ্বশুর বাড়ী নয়। যুদ্ধে যাবে। যুদ্ধে যাওয়া আর হয়নি মাঝির। বিকেলেই মিলিটারি এসে ধরে নিয়ে যায়। সেই নদীর ঘাটে বট গাছের নিছে ঝাঁঝরা করে ফেলে তাকে। পরে ঝুলিয়ে রাখে বট গাছে। তিন রাত দুই দিন ঝুলে ছিল। কেউ সাহস করে এগিয়ে আসে নি। তৃতীয় রাতে মুক্তি এলে পালিয়ে যায় মিলিটারি। পরে মুক্তি সেনারা জানাজা দিয়ে দাফন করে। বট গাছের নিচে আজো পুরনো ভাঙা কবর আছে মাঝির। কোন নাম ফলক নাই। একটা বাঁশের বেড়াও না। কেউ ভুলেও কোন দিন একটা ফুল নিয়ে যায় না। সেই হারুন মাঝির গল্প অনেক শুনেছি লোকমুখে। হারুন মাঝিকে কোনদিন আমি দেখিনি। দেখার কথা না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল তিন বছর।
সেই হারুন মাঝির ছেলে আক্কাস!
লোকে পাগলা ডাকে। আক্কাস নামে কেউ চেনে কিনা সন্দেহ। তার মাই শুধু ডাকে আক্কাস। আর ভাইয়া কে দেখলাম এই নামে ডাকতে। আক্কাস কে আমার পাগল মনে হয় না। তবে অটিস্টিক।

সকালে উঠানের রোদে বসে খেজুরের কাঁচা রসের পায়েস খাচ্ছি। এসময় কলেজের এক দঙ্গল ছেলে এসে হাজির। তাদের কলেজে বিজয় দিবসের প্রোগ্রাম। আমাকে যেতে হবে। তারা আমাকে সভাপতি করতে চায়। টি, এন, ও, চেয়ারম্যান আরো রাজনৈতিক দলের হোমরা চোমরা সবাই আসবে। আমি সাধারনত এই সব প্রগ্রামে যাই না। কি মনে করে রাজি হলাম। বললাম আমার সাথে একজন বিশেষ গেস্ট আসবে। তাকে আমার সাথেই বসতে দিতে হবে। তারা বলল কোন সমস্যা হবে না।



পরদিন বিকেলে হারু মাঝির বাড়িতে যাই। খড়ের চালা দাঁড়িয়ে আছে কোন মতে। ভিতরে শুয়ে আছে হারু মাঝির বউ মানে আক্কাসের মা। ধুঁকে ধুঁকে মায়ে পোয়ের জীবন চলে। আমারে ধরে বেশ কান্নাকাটিও করল। বাড়িতে শুধু ঘর খানাই আছে। বাকি সব চেয়ারম্যান সাব দখল করে নিয়েছেন। ঘরটিও তাঁর। দয়া করে এদের থাকতে দিচ্ছেন। তবে যে কোন সময় উঠিয়ে দিতে পারেন। হারু মাঝি মরার আগে সব নাকি তার কাছে বন্ধক রেখে গেছে। রোগা অবুঝ একটা ছেলেকে নিয়ে তিনি বৃদ্ধা মানুষ কি করবেন ভেবে পান না।

আক্কাসকে বললাম কাল বিকেলে তোকে নিয়ে এক জায়গায় যাব। বিকেলে আমাদের বাড়ি আসিস। পরদিন আক্কাস সময় মতই হাজির। হাজির অবশ্য তাকে হতে হয় না। বলতে গেলে সে আমাদের বাড়িতেই থাকে। আমার ভাঙা গাড়িটা নিয়ে বের হলাম। ভাবলাম যাবার আগে আক্কাসকে কিছু জামা কাপড় কিনে দিই। না, দরকার নেই। সে কেমন আছে সেটাই সবার জানা দরকার।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বয়ান শুনতে শুনতে আক্কাসকে হাতে করে আমি মঞ্চে উঠলাম। আমার পাশে আক্কাসকে বসিয়ে এক হাতে তাকে ধরে রাখলাম। হটাৎ লক্ষ্য করলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেন খাবি খাচ্ছে। মঞ্চে এবং অডিয়েন্সে সমান গুঞ্জন। এতসব গুণীজনের মাঝে একজন পাগলের উপস্থিতি কেউ মেনে নিতে পারছেন না। আমার ছাত্রবন্ধুরা যারা অতদূর গিয়ে আমাকে দাওয়াত করে এসছেন তারাও মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন। চেয়ারম্যান সাহেব উঠে চলে গেলেন। কিছু না বলেই। টিএনও সাহেব উঠে চলে যাবেন কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তিনি আমার পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ব্যাচম্যাট ছিলেন। একই হলে থাকতাম। এইটুকু পরিচিতের জন্য বোধকরি দ্বিধা করছেন।

পরবর্তী ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। আমি দ্রুত মাইক হাতে উঠে দাঁড়াই। ডান হাতে আক্কাসের বাহু ধরে তাকে পরিচয় করানোর চেষ্টা করি। আক্কাস হা করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। কেউ আমার কথা শুনছে বলে মনে হল না। বাইরে বিষম হট্টগোল। চেয়ারম্যানের দলের লোকেরা শ্লোগান দিচ্ছে। বিজয়ের অনুষ্ঠানে একজন রাজাকার এসে অনুষ্ঠান অপবিত্র করে দিয়েছে। তারা কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বৃথা যেতে দেবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছাপিয়ে আমার আওয়াজ কারো কানে পৌঁছায় না। চেতনা সমুন্নত রাখতে আমার ভাঙা গাড়িটার দফা রফা করা হল এক দফা। লোকজন ছুটে বের হতে থাকে। বিজয়ের অনুষ্ঠানে নাচ গান দেখতে এসে উটকো ঝামেলার জন্য তারা প্রকাশ্যেই আমাকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। আমি আক্কাসকে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। হারুন মাঝির অটিস্টিক ছেলেটির মত আমার নিজেকেও অটিস্টিক মনে হতে থাকে।


মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪০

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: দারুন!

এই সত্য আজ বাংলার কোনে কোনে... মাঠে ময়দানে সর্বত্র!!!!!

কৈফিয়ত! বিজয়ের নিরবতা

....
সত্য যখন ক্ষমতার কোলে বসে নিত্য বদলায়
তখন কি লিখব?

বীরশ্রেষ্ঠর উত্তরাধিকার যখন অচেনা
বীর উত্তম, বীর বিক্রমরা যখন উপেক্ষিত
স্বাধীনতার অধিনায়েকরা যখন চেতনার জালে ফেসে

আমজনতা আইজুদ্দিনের লিখায় কি আসে যায়?
একটা ষ্ট্যটাস বা পোষ্টে?
কিংবা একদিনর জন্য কর্পোরেট চেতনায় রাঙালে!!!!

ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের
মানচিত্রে স্বাধীনতা কই? যখন আমজনতা উপেক্ষিত
মিনিমাম একটা ভোটের অধিকার থেকে?!

কি লিখব
যখন হাজার প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্নই জন্মায় শুধু
বিরোধের খগড়, ট্যাগবাজি আর সমাধানহীন কুতর্কে! ...

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:০১

আনু মোল্লাহ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ স্যার :)

সুন্দর মন্তব্য আনন্দ দিয়েছে অনেক।
আপনার দেয়া কবিতা ও পড়েছি। চমৎকার লিখেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.