নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আনোয়ার ভাইয়ের কথার কথা

আনোয়ার ভাই

কিছু একটা করি

আনোয়ার ভাই › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোট গল্প - লাল পুতুল

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৭

এই নাও চা । বারান্দায় রাখা ছোট টেবিলে ধপাস শব্দ হল। টেবিলটা কাঠের না হয়ে কাঁচের হলে ভেঙ্গে যেত। চা রাখার এই বিকট শব্দ বলে দিচ্ছে পারুলের রাগ এখনো কমেনি। তাই প্রতিদিন স্বামীর সাথে হাটতে বেরোলেও আজ যায়নি সে। আর কখনো নাকি সে হাটতে বেরোবে না। কর্কশ সুরে আপনের দিকে প্রশ্ন ছুড়েছে ‘ কার জন্য শরীর ঠিক রাখব ?’।

বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে বিশাল মাঠে হাটতে হাটতে ছােট এই প্রশ্নটি ঘুরপাক খেয়েছে আপনের মনে। তবে কি শরীর অন্যের জন্য। ইচ্ছে হচ্ছে মাঠে হাটা ও দেৌড়রত মানুষগুলোকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করতে। লােকে পাগল ভাববে তাই তা করল না। ফেরার সময় প্রতিবেশী সিনিয়র ভাই রতনের সঙ্গে নানা আলাপের মাঝে প্রশ্নটি করল।
না-না, তা কেন হবে। এই যে এত ভােরে ঘুম থেকে উঠে শরীরটাকে চাঙ্গা রাখতে বের হইতো নিজের জন্যই। কি মজিদ সাহেব কিছু বলছেন না কেন ?
হ্যা-হ্যা তাতো বটেই, তাতো বটেই। ব্যাংক থেকে সদ্য অবসর নেয়া মজিদ সাহেব রতন ভাইয়ের কথা সমর্থন করলেন। চাকুরী থেকে অবসর নেয়া সব মানুষের কথা প্রায় একই রকম। নিজ থেকে কিছু বলতে পারে না তারা। অন্যের কথায় সায় দেয়াই যেন কাজ। যেন চাকুরী যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায়। বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সে কথাই ভাবছিলেন আপন। তার মনে হল, পুরুষরা নিজের জন্য হাটে, নিজের জন্যই দৌড়ায়।
ওদিকে রান্নাঘর থেকে থালা-বাসন পরিস্কার করার শব্দ হচ্ছে। সব সময় এমন শব্দ হয় না। কােন কারনে রেগে গেলেই এরকম শব্দ করে কাজ করে পারুল। তবে এবার রাগের পরিমাণ একটু বেশী তাই সব কাজে শব্দও বেশী। এমনকি কথাও বলছে চেচিয়ে। রাগ ছাড়াও আরো একটি কারনে এমন আচরন করে সে। তা অবশ্য বছরে দুই একবার হয়। আপন দূরে কােথাও গিয়ে কয়েক রাত কাটালে সে রেগে বেলুন হয়ে যায়। দিনের বেলায় ধপাস ধপাস শব্দে ওর কাছেই যাওয়া যায় না। তবে রাতের বেলায় উল্টো। একটু আদর করে কাছে ডাকলেই নিজেকে গুটিয়ে আপনের বুকে মিশে যায়। কপালে চুমু দিয়ে লম্বা চুলে হাতের পরশ বুলিয়ে দেয়।
রাগ করেছ ?
হুম-বলে চােখের জলে আপনের টি-শার্ট ভিজিয়ে †দয়। এক সময় কান্না থামিয়ে অভিযোগের সুরে বলে ‘ আমাকে ছেড়ে এতদিন কেমন করে থেকেছ? কােন মেয়ের কাছে যাওনি তাে ?’
আমার এই লাল টুকটুকে বউ থাকতে কেন অন্য মেয়ে মানুষের কাছে যাব।
তা-তো আমি জানি। সেদিন পাশের বাড়ির ভাবী বলল, দেশের বাইরে গেলে না-কি পুরুষরা অন্যরকম হয়ে যায়। আর তােমার বন্ধুর বউতো রােজ এসে আমার কাছে তার স্বামীর নামে বদনাম করে।
তুমি তােমার স্বামীর বদনাম কর না ?
না। আমি কখনো সংসারের কথা বাইরে বলি না। সংসারের কথা নিজেদের মধ্যে রাখতে হয়। তাছাড়া আমি জানি তুমি ভাল মানুষ।

বারান্দায় বসে একটা ব্যাপার চােখে পড়ল আপনের। পাখিদের বসার জন্য সে নিজে গ্রীলের সাথে একটা ছােট কার্টুন বেধে দিয়েছে। ওখানে দু’টি চড়ুই বাসা বুনেছে। ওই বাসায় তিনটি বাচ্চাও ফুঁটেছে। সম্ভবত বাচ্চাগুলি নিতে দু’টি শালিক ঘুর ঘুর করছে। চড়ুই দু’টি পালা করে সারাক্ষন পাহাড়া দিচ্ছে। সব প্রাণীর মধ্যেই সন্তানের জন্য ভালবাসার কমতি েনই। তবে বড় হয়ে সন্তানরা তা বুঝতে পারে না।

পারুল------------। পারুল, বারান্দায় এস।
কোন সাড়া নেই। আপনের ডাকে পারুল বারান্দায় আসবে কি- না বুঝা যাচ্ছে না। সে আবার পাখির বাসার দিকে নজর দিল। ইতিমধ্যে বারান্দায় অনেক চড়ুই এসে জমায়েত হয়েছে। গ্রীলের উপর সারিবদ্ধভাবে বসে ওরা চিচিমিচি করছে। সম্ভবত ওরা মিটিং করছে। মানুষ মিটিং করে, পাখিও মিটিং করে। তবে পার্থক্য রয়েছে। মানুষের মিটিংয়ে টাকা খরচ করে লােক †জাগাড় করা হয়। পাখির মিটিংয়ে খরচ করতে হয় না। মানুষের মিটিংয়ে শৃঙ্খলা থাকে না। ওদেরটায় আছে। মানুষের বেলায় বােম, ককটেল, গ্রেনেড, পেট্রোল বােম মারা হয়। পাখির বেলায় তা দেখা যায় না। চড়ুইদের মিটিং শেষ। একটু পর সব চড়ুই মিলে শালিক দু’টিকে দৌড়ে এ পাড়া পার করে দিয়ে এল। বিষয়টা দারুন উপভোগ করল আপন। হঠাৎ জােরে েহঁসে উঠল সে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একতাই বাংলাদেশের মানুষকে জয় এনে দিয়েছিল।

পারুল বারান্দায় এসেছে। আপন বুঝতে পারছে না সেকি তার ডাকে এল। নাকি অট্রহাসির কারন আবিস্কারে। হঠাৎ হাঁসি দেওয়ায় পাগল ভেবে বসল কি-না কে জানে।
পারুল বস। কথা শুনল। পাশের খালি চেয়ারটায় বসে পাখির বাসার দিকে তাকিয়ে থাকল।
পারুল আমি জানি তুমি রেগে আছ। অবশ্য রাগ হওয়ার কথাই। কােন নারীই তার স্বামীকে অন্য নারীর সাথে কল্পনা করতে পারে না। তুমি যে পুতুলটার কারনে আমার উপর রাগ করেছ সেই পুতুলটা আমাকে একজন নারী দিয়েছে সত্যিই। তবে খুব ছােট বেলায়। তিনি পাশের বাড়ির ঝর্ণা আপু। আমাকে ছােট ভাইয়ের মত আদর করত। - এতক্ষন পর মুখ তুলে আপনের দিকে নজর দিল পারুল। শুনবে তার কথা। আপনের এ কথায় মাথা ঝাকাল সে।

আমার থেকে চার পাঁচ বছরের বড় ছিল ঝর্না আপু। উচ্ছল ঝর্নার মতই খিলখিল করে হাঁসত সে। ছােট বেলায় আমার খেলার সাথী বলতে সেই। আমাকে নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরত। অগ্রহায়ণ মাসে বুড়া বুড়ির মেলায় নিয়ে চড়কায় চড়াত। বর্ষায় কাইলানী বিলে ডুবিয়ে শাপলা তুলত। বাড়ির ঢালে হিজল গাছ তলায় বসে সিদ্ধ শালুক খাওয়া নিয়ে কাড়াকাড়ি। পুকুর পাড়ে তেতুল গাছে উঠতাম লবনের পােটলা নিয়ে। গাছেই এক দুপুর পাড় করে দিতাম। আর আমের দিনে মনে মনে ঝড় চাইতাম। ঝড় তুফান হলেই পাশের মুন্সি বাড়ির আম গাছ থেকে সব আম পড়ে যেত। ঝড়ের মধ্যেই আম কুঁড়াতে ছুটতাম দুইজনে। এভাবেই দিন কাটছিল।

একদিন বিকেলে ঝর্না আপুকে না পেয়ে তার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাইরে থেকে দেখলাম বাড়িতে মেহমান এসেছে। আপুর বাবা তাদের সাথে কথা বলছে। তবে লােকগুলোকে কথা শােনার চেয়ে পিঠা, লাড্ডু খেতেই মনযোগী মনে হল। একটু পর দেখলাম মায়ের সাথে ঝর্না আপু এল। অবাক হলাম। ঝর্না আপু সব সময় সালোয়ার কামিজ পড়ে অথচ আজকে শাড়ি পড়েছে। লাল শাড়ি সঙ্গে লাল টিপ এমনকি চুলে ফিতাও েবঁধেছে লাল। ঝর্না আপুকে দেখার সাথে সাথে লােকগুলো খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সবাই মিলে তাকে দেখছে। তাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ আবার নানা প্রশ্ন করছে। এরপর দেখলাম ঝর্না আপু লােকগুলোর সামনে দিয়ে এদিক সেদিক হাটল। মেহমানদের মধ্য থেকে এক নারী উঠে তার চুল ছাড়িয়ে দিল। কি লম্বা চুল। আমি অবশ্য আগেই জানি। প্রায়ই চুল ছেড়ে আমার সাথে খেলতে যেত ঝর্না আপু। আমি তখন তাকে বলতাম- কত্ত বড় চুল। ঝর্না আপু হাসত।

পরের দিন ঝর্না আপু আসল। তবে তার মন খারাপ। জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল, আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে রে আপন।
আমি বললাম সে তাে ভাল কথা। বিয়ে হলে কত আনন্দ হয়, মজা হয়। তখন তুমি তােমার বরকে নিয়ে আসবে, আমরা তিনজনে মিলে খেলব।
দূর বােকা। আমার বিয়ে হলে আমি কি আর এখানে থাকব। চলে যাব শশুর বাড়ি।
ওহ। তাহলে তুমি বিয়ে করবে না বলে দাও।
আমার না শুনবে কে ? আমি যে নারী । বলেই হাউ মাউ করে েকঁদে উঠল আপু। তার কান্না দেখে আমিও কাঁদছি। আপু আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখল অনেক্ষন। এভাবে তিনি আরো একদিন আমাকে বুকে জড়িয়ে েকঁদেছিলেন। যেদিন তার বিয়ে হল। তার আগের দিন।

আপু সেদিন একটা হলুদ শাড়ি পড়ে এসেছে। ছাড়া চুলে গােজা ছিল একটা হলুদ গাধা ফুল। হিজলগাছের আড়ালে লুকিয়ে আমাকে কাছে ডেকে নিল সে। তারপর কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরল বুকে। আপু কাঁদছে। তবে ফুপিয়ে ফুপিয়ে। আমি মুখ গুজে দিয়েছি তার বুকের মাঝে। সে আমার মাথার চুলে বিলি কাটছে আর বলছে আজকেই তাের সাথে শেষ দেখা। কাল চলে যাব শশুর বাড়ি। তার কথায় আমার চােখেও জল এল। মুখ তুলে আমি আপুকে বললাম, তােমার শশুর বাড়িতে আমাকে নেবে না । আপু কিছু বলল না। যাবার আগে আমার হাতে একটা মাটির পুতুল তুলে দিল। বলল- এটা তাের জন্য লাল মাটি দিয়ে বানিয়েছি। সব সময় এই লাল পুতুলটা কাছে রাখবি।

বিয়ের পর আপুকে আমি আর কােনদিন দেখি নাই। দেখবই কিভাবে ?
কেন ? দেখনি কেন ? এতক্ষন পর এক সাথে দু’টি প্রশ্ন ছুড়ল পারুল।
আপুর গায়ের রঙ কাল ছিল। তাই বিয়ের সময় তা পুষিয়ে দিতে হয়েছে গহনা আর নগদ টাকা দিয়ে। কিন্তু এতে মন ভরেনি জামাই বাবুর। আরো দাবি ছিল তার। এ নিয়ে ঝর্না আপুকে মানসিক-শারিরীক যন্ত্রনায় রাখত। একদিন খবর এল ঝর্না আপু হাসপাতালে। আমাদের বাড়ির সবাই দেখতে গিয়েছিল। কি কারনে যেন আমাকে নেয়নি। বড় হয়ে পড়ে জেনেছি, আগুনে ঝর্না আপুর সারা শরীর ঝলছে গিয়েছিল। আর সুন্দর কাল চুলগুলো পুড়ে ছাই। হাসপাতালের বেডে কয়েকদিন ছিল। তারপর চলে গেছে---একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আপন।
কোথায় ? পারুলের প্রশ্ন।
যেখানে একদিন সবাইকে যেতে হয়।
আপন কাঁদছে। পারুল উঠে গিয়ে তার চুলে বিলি কাটে। মুখটাকে টেনে বুকের মাঝে রাখে।
কিছুক্ষন পর স্বাভাবিক হয় আপন। দূর আকাশে চােখ যায় তার। যেখানে অবিরাম চলছে মেঘের ভেলার লুকোচুরি।

আমি দু:খিত। তােমাকে না বুঝে কষ্ট দিয়েছি। পারুলের এ কথায় একবার তার দিকে তাকায় আপন। তারপর আবার আকাশের দিকে।
এখন থেকে লাল পুতুলটা আমি সাজিয়ে রাখব।
তা আর সম্ভব নয়।
কেন ?
কাল সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার সময় লাল পুতুলটা আমি বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়েছি।

একটা দমকা হাওয়া এসে স্পর্শ করে যায় পুরো বারান্দা।

আপনের দু’টি হাত তখন পারুলের হাতের মধ্যে বন্দি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৩১

প্রামানিক বলেছেন: এখন থেকে লাল পুতুলটা আমি সাজিয়ে রাখব।
তা আর সম্ভব নয়।
কেন ?
কালকে সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার সময় লাল পুতুলটা আমি বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়েছি।


চমৎকার গল্প। খুব ভাল লাগল। ধন্যবাদ

২| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৫৯

আনোয়ার ভাই বলেছেন: কাল সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার সময় লাল পুতুলটা আমি বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়েছি।-------------ধন্যবাদ প্রামানিক । গল্প পড়া ও মন্তব্যের জন্য ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.