নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি ইংরেজি সাহিত্যের একজন ছাত্র। আমি শিখতে ভালবাসি।

কৃষ্ণ কমল দাস

ছাত্র,ইংরেজি বিভাগ

কৃষ্ণ কমল দাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

সরকারি বাঙলা কলেজ

১৩ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৮:২৪

সরকারি বাঙলা কলেজ
(লেখক ঃ কৃষ্ণ কমল দাস, ইংরেজি বিভাগ , সরকারি বাঙলা কলেজ)
( আমার এই লেখা শুধু নিজের শিখড় অনুসন্ধানের জন্য)
বাঙলা কলেজ আমার কলেজ। যখন এই কলেজে ভর্তি হই তখন আমার অনেক কাছের মানুষরা আমাকে নিয়ে মজা করত। তখন কষ্ট লাগত । মনে মনে প্রশ্ন জাগত , বাঙলা কলেজ কি সত্যিই খুব খারাপ কলেজ?
আমার আজ এত দিন পর মনে হলো যে আমার গর্ব করা উচিত সরকারি বাঙলা কলেজ নিয়ে । গর্ব করার মত কারন গুলো নিচে দিলামঃ
সরকারি বাঙলা কলেজ জন্ম্ একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে । ১৯৫২ সালের ভাষা অন্দোলনের পর বাঙ্গালি নিজেকে নতুন ভাবে চিনতে শুরু করে । সেই মহান ভাষা অন্দোলনের এক মহান ভাষা সৈনিকের নাম প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম । তার উদ্দেগে মূলত সরকারি বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
বলে রাখা ভালো সরকারি বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে এদেশে শিক্ষার মাধ্যম ছিলো ইংরেজি। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার পর এদশের বুদ্ধিজীবি ওমুক্ত চিন্তার মানুষ গুলো বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার জন্য একতা বদ্ধ হন। তাদরে মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, ডক্টর ইন্নাস আলীসহ তমদ্দুন মজলিসের কয়েকজন কর্মী । বাংলাক শিক্ষার মাধ্যম করার জন্য তারা একটি বাঙলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনা করে। যার ফলস্বরূপ ১৯৬১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ঢাকায় একটি বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে একটি বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে খান বাহাদুর আব্দুর রহমান খান-এর সভাপতিত্বে। বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে এই সভায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হয় তা হলো ৫১ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক পরিষদ গঠন।
এ পরিষদে ছিলেন তৎকালীন গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ আজম খান (সম্মতি সাপেক্ষে), পৃষ্ঠপোষক রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহা ও গুল মোহাম্মদ আদমজী, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল দেওয়ান মোঃ আজরফ ও খান বাহাদুর আবদুর রহমান খান সহ-সভাপতি, প্রাক্তন ডিপিআই আবদুল হাকিম কোষাধ্যক্ষ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ সেক্রেটারি, অধ্যাপক আবুল কাসেম ও অধ্যাপক হাসান জামান জয়েন্ট সেক্রেটারি শাহ মুস্তাফিজুর রহমান ও অধ্যাপক মতিউর রহমান অ্যাসিট্যান্ট সেক্রেটারি। পরিষদের সদস্য ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবদুস সালাম, সুনীল কুমার বসু, সাহিত্যিক মুহাম্মদ বরকত উল্লাহ, অধ্যাপক আবদুল হাই, কবি ফররুখ আহমদ, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, ব্যারিস্টর আবদুল হক, অধ্যাপক মোফাখখারুল ইসলাম।
এরপর বাঙলা কলেজের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে। ১৯৬১ সালের ১৮ জুন বাংলা একাডেমী সভাকক্ষে বাঙলা কলেজ সাংগঠনিক পরিষদের সভায় ঐ বছর জুলাই থেকে বাংলা কলেজের কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম কতৃক প্রনীত ডিগ্রি কলেজের পরিকল্পনা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
যেহেতু বাংলায় শিক্ষাদান করার জন্য বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠত হয় সেহেতু কোন বই বাংলায় না থাকায় শিক্ষকগন নিজ নিজ বিষয়ে তাদের ভাষণ বাংলায় লিখে আনেন। কলেজ থেকে সেগুলি সাইক্লোস্টাইল করে ক্লাসে ছাত্রদের মাঝে বিলি করা হয়। এর মধ্যে সবচেযে যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিলো বছর শেষে ভাষণ একত্রিত করে সম্পাদনার পর পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হয়। । পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, জ্যামিতি, বীজগণিত, পরিসংখ্যান ইত্যাদি বিষয়ে বাংলা কলেজের প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মতো বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচিত ও প্রকাশিত হয়।
যার ফল হয় সুদূরপ্রসারী , বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষার পুস্তকের মাধ্যমে বাংলা শিক্ষা চালু হয়।
প্রথম বছরে প্রিন্সিপালসহ ১০ জন অধ্যাপক ও ১১ জন অফিস স্টাফ নিয়োগের প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কলা অনুষদে বাংলা, ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও তমদ্দুন, অর্থনীতি ও প্রাথমিক বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান অনুষদে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, ইংরেজি ও সমাজবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।
কলেজের জন্য স্থান নির্বাচন করার জন্য ১৯৬২ সালের ৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড অফিসে বাঙলা কলেজ সাংগঠনিক পরিষদের ৪র্থ অধিবেশন বসে। কিন্তু কলেজ চালু করার জন্য সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হলেও এক বছরেও একটি বাড়ি পাওয়া যায় নি। অবশেষে ১৯৬২ সালের ১ অক্টোবর বকশিবাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউটে নাইট কলেজ হিসেবে বাঙলা কলেজ কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৬২-৬৩ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে কলা বিভাগ ও বিএ প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।
১৯৬৩ সালে খোলা হয় একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগ। ৩০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় এ কলেজের তবে ১৯৬৪ সালের মধ্যেই কলেজের ছাত্র সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে চার শ’। ১৯৬৩ সালেই মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, গণিত ও জীব বিজ্ঞান পড়ানোর অনুমতি দেয়। ১৯৬৫ সালে বাণিজ্য শাখা খোলা হয়। ১৯৬৯ সালে বি.কম ও বি.এসসি শ্রেণি খোলার অনুমতি মেলে। (সূত্রঃ বাংলা পিডিয়া)
প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ৮ বছর বিনা বেতনে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ৪০টি উচ্চ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক বাংলায় রচনা করেন। যা বাঙলায় শিক্ষাদান কে ত্বরান্বিত করে।
৭-৮ বছর নবকুমার ইনস্টিটিউট ভবনে নৈশ কলেজ রূপে চালু ছিল বাঙলা কলেজ। পরে সরকার ঢাকার মধ্যে জমি না দিতে পেরে বর্তমান মিরপুরে জঙ্গলাকীর্ণ ও খাদযুক্ত জমি হুকুম দখলের মাধ্যমে ১৯৬৪ সালে বাঙলা কলেজের জন্য প্রায় ১২ একর জমি বরাদ্দ করে।
বাঙলা কলেজের কথা বললে আর এক জন ব্যক্তির নাম না নিলে অন্যয় হবে। তিনি হলেন তৎকালীন ডিপিআই ফেরদাউস খান । যার চেষ্ঠায় বাঙলা কলেজ সরকারের উন্নয়ন স্কিমভুক্ত হয়। কলেজের নামে মঞ্জুর হয় অর্থ। যা কলেজের উন্নয় কাজে গতি বাড়ায়।
অবশেষে কলেজের ভবন তৈরির কাজ আংশিকভাবে শেষ হলে ১৯৬৯ সালের ৪ অক্টোবর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গবেষণা ও শিক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ শামসুল হক বাঙলা কলেজের বি.এসসি ও বি.কম ক্লাশ উদ্বোধন করেন।
বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা হবার পর শিক্ষিত বাঙালি বিদ্বান ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিরোধিতায় নেমেছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করলে ছাত্র-ছাত্রীরা চাকরি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে। এমনকি ‘বাঙলা মৌলবি’ জন্ম হবে বলেও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঙলা মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ দ্রুতই জনপ্রিয়তা লাভ করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর অবাঙালি বিহারীরা বাঙলা কলেজ দখল করে নেয় ১৯৭১ সালে তখন তারা এর নাম পরির্বতন করে উর্দু কলেজ’ সাইনবোর্ড লাগায়।
যদিও বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ কিন্তু মিরপুর মুক্ত হয় ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২। এর কারন ছিলো তৎকালীন মিরপুর ছিল বিহারীদের একক অধিপত্য। তারা পাকিস্তানি বাহিনীদের সাথে হাত মিলিয়ে মিরপুর ও আশেপাশের এলাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা বাঙলা কলেজকে তাদের ক্যাম্প বানায় । বর্তমান বাঙলা কলেজের বাঙলা বিভাগ ছিলো মূল ক্যাম্প। কলেজের বর্তমান শহীদ মিনার এবং মূল ফটকের মাঝে পুকুর ছিলো , যেখানে পাকিস্তানী বাহিনী , বিহারী ও এদেশের রাজাকার রা মিলে অগনিত মানুষ হত্যা করে ঔই পুকুরে ফেলে দেয়। দুঃখের বিষয় আজ ও বাঙলা কলেজে কোন গনহত্যার স্মৃতিস্মম্ভ তৈরি হয় নি।
শুনলে হয়ত বুঝতে পারবেন বাঙলা কলেজে কি পরিমান অমানবিক কাজ হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময়। আনোয়ারা বেগম নামে তখন বাঙলা কলেজের এক কর্মী ছিলো তার মতে : পাকিস্তানীদের হত্যার জন্য পছন্দের জায়গা ছিলো কলেজের আম বাগান। তারা বাঙ্গালীদের ধরে এনে আম গাছের শিখড়ের ওপর মাথা রেখে বাঙ্গালীদের জবাই করে দিতো। তারপর কিছু লাশ পুকুরে ফেলে দিতো আর কিছু আম বাগানের আশেপাশে পড়ে থাকত। আনোয়ারা বেগম ২০১১ সালে মারা যান।

২০১৪ সালের বাঙলা কলেজের ম্যগাজিন “মায়ের বুলি” যা সম্পাদনা করে গবেষক মিজানুর রহমান, তাতে বলা হয় অসংখ্য মাথার খুলি পাওয়া যায় বর্তমান কলেজের আবাসিক হোস্টটেলের জায়গায় তখন সেখানে গাছ পালায় পূর্ণ জঙ্গলের মত ছিলো। বর্তমানে এখনো ১০০ বছর বয়সী দুটি গাছ সেখানে রয়েছে।
আরও বলা হয় , অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারন মানুষদের হত্যা করে বর্তমান সম্মান ভবন ৩ও৪ এর মাঝে পুকুর পাড়ে গনকবর দেওয়া হয়।
এই সকল কারনে বাঙলা কলেজ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক জলজ্যান্ত ইতিহাস যা অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে ৫৫ বছর।
বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরুতে ওই সময়ের প্রভাবশালী সংবাদপত্র দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ ও পাকিস্তান অবজারভার ব্যাপক সমর্থন জুগিয়েছে্ ।
১৯৮৫ সালে কলেজটি সরকারিকরণ করা হয় এবং ১৯৯৭ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়।

বাঙলা কলেজ জাতির জন্য এক পথ প্রদর্শক এবং মুক্তিযুদ্ধের গনহত্যার ইতিহাসের ধারক। এই কলেজই বাঙ্গালিকে বাংলায় শিক্ষা লাভের সুযোগ করে ।
বাঙলা কলেজের জন্ম দেওয়া হয়েছিলো বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য। কিন্তু দরকারি সুযোগ সুবিধার অভাবে বাংলা ভাষার শিক্ষা দানের অস্ত্র আজ মৃতপ্রায়। পায়নি তার যোগ্য সম্মানটুকুও । বাঙলা কলেজ প্রতিষ্টাতাদের ইচ্ছা ছিলো বাঙলা বিশ্ববিদ্যালয় করার। যা ৫৫ বছর ধরে অধরা স্বপ্ন হয়ে রয়ে গেছে।
………………………….ধন্যবাদ
(সহযোগিতায়ঃ বাংলা পিডিয়া, উইকিপিডিয়া, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সুমন স্যর, ২০১৪ সালের বাঙলা কলেজের ম্যগাজিন “মায়ের বুলি” যা সম্পাদনা করে গবেষক মিজানুর রহমান।)
উৎসর্গ ঃ ভাষা সৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.