নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছায়া নয়, আলো ...

আরমান আরজু

সত্য ও অসীমের পথে

আরমান আরজু › বিস্তারিত পোস্টঃ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

২৬ শে জুন, ২০১৫ রাত ১১:০৫

পাণ্ডুলিপিটি হাতে পেয়ে আমার বড়চাচার কথা মনে পড়ে গেল। নজরুল বলতে পাগল ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার যখন কবি নজরুলকে সপরিবারে দেশে নিয়ে আসেন তখন তিনি কবিকে দেখতে ঢাকা চলে গিয়েছিলেন। শেষ যেবার তিনি নজরুলকে দেখেছিলেন তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। কবির বাকশক্তিহীনতা তিনি মেনে নিতে পারেননি। কবি নজরুল সম্পর্কে আমি যা জানি তার সম্পূর্ণ অবদান আমার বড়চাচার। তাঁর সান্নিধ্য না পেলে নজরুল সম্বন্ধীয় আমার জ্ঞান পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ থাকত।
পাণ্ডুলিপিটি বেশ আগের বলে মনে হচ্ছে। পুরোনো বইয়ের তাক পরিষ্কার করতে গিয়ে এককোণে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকা পাণ্ডুলিপিটি আমার চোখে পড়ল। শিরোনাম দেয়া হয়েছে ’জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার’। সাক্ষাৎকার গ্রহীতার কোন নাম চোখে পড়ল না। তবে হাতের লেখা বড়চাচার বলে ধারণা হচ্ছে। নিউজপ্রিন্ট কাগজে লেখা। অনেক স্থান ঝাপসা হয়ে গেছে। আমি অত্যন্ত আগ্রহভরে পড়তে শুরু করলাম।
প্রশ্নকর্তা: আপনাকে ধন্যবাদ জীবনের এ পড়ন্ত বেলায় এবং অসুস্থতা সত্ত্বেও আমাদের সাক্ষাৎ দেওয়ার জন্য।
কবি: একটু সংশোধন করি। ব্যক্তি নজরুলের পড়ন্ত বেলা থাকতে পারে কিন্তু কবি নজরুলের কোন পড়ন্ত বেলা নেই। কবিরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সৃজনশীল যদি ’কবি’ হয়ে থাকেন।
প্রশ্নকর্তা: আমরা দুঃখিত অসংলগ্ন প্রশ্নের জন্য। আপনাকে এখনো সক্রিয় আগ্নেয়গিরিরূপে পেয়ে আমরা আনন্দিত। আপনার মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি কবি শামসুর রাহমান কিন্তু জীবনের পড়ন্ত বেলায় খুব বেশি সৃজনশীল কোন পদ্য আমাদের দিয়ে যেতে পারেননি। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
কবি: চমৎকার প্রশ্ন। একজন কবির জন্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকা খুব জরুরী। দু’নৌকোয় পা দিলে আপনার পরিণতি কী হতে পারে তা আশা করি বুঝিয়ে বলতে হবে না। শামসুর রাহমান কিংবা আল মাহমুদ কিংবা যারা সাহিত্যের চাষ করেন, এঁদের পা দু’খানা এক নৌকোয় থাকলে ভাল হত।
প্রশ্নকর্তা: আপনি রাজনৈতিক প্রভাবের কথা বলছেন অথচ আমরা জানি রাজনীতি থেকে আপনিও দূরে ছিলেন না। আপনি রাজনৈতিক কবিতাও লিখেছেন। ’আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি আমাদের তাই বলে। কারাগারে আপনি বন্দী জীবনও কাটিয়েছেন। ’আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি থেকে আমি দু’টি চরণ উদ্ধৃত করছি-
”ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা, রক্ত দেখা।”
কবি: আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেটাকে আমি রাজনীতি বলতে পারি না, সময়ের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি মাত্র। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার নাম যদি রাজনীতি হয় তাহলে আমার বলার কিছু নেই।
প্রশ্নকর্তা: আমরা এবার আপনার কবিতা নিয়ে কথা বলতে চাই। আপনার বিখ্যাত এবং অতিপরিচিত একটি কবিতার নাম ’সংকল্প’।
কবি: ’সংকল্প’ কবিতাটি আসলে আমাদের যে বন্দী আত্মা তাকে কেন্দ্র করেই লেখা। প্রথম চরণটি খেয়াল করুন- ”থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,-”। জগৎটাকে বলতে আমি আসলে মহাজগতের কথাই বলেছি। যে সময়ে বসে আমি পদ্যটি লিখেছি সে সময় এত সহজে পুরো জগৎ ঘুরে দেখতে পাওয়া যেত না এখন আপনারা যেভাবে এ আধুনিক যুগে খুব সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারছেন। এটা হচ্ছে বস্তু বা বাস্তব জগৎ। ঠিক আত্মারও একটা জগৎ আছে। ইসলাম ধর্মে আধ্যাত্মিকতা বলে যে অধ্যায়টি আছে সেখানে আত্মার বিষয়টি অনেক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। ছোটকাল থেকেই আমি ইসলাম ধর্মের আবহে বড় হয়েছি। আমার সাহিত্যের বিশাল অংশ জুড়ে এর ছাপ আপনারা দেখতে পাবেন। বাংলা সাহিত্যে ইসলামি চেতনার চর্চা আমার হাত দিয়েই শুরু বলা যায়। কিন্তু আমার সাহিত্য সেভাবে মূল্যায়িত হয়নি। মোল্লারা আমাকে দিয়েছে শুধু গালি আর বাংলার অধ্যাপকেরা আমার মুখে মেখেছে চুনকালি।
প্রশ্নকর্তা: বিষয়টি বিতর্কিত। আমাদের মনে হয় সেদিকে না গেলে ...
কবি: কেন যাবেন না? আমার পুরো জীবনটাই তো গেল বিতর্কের ভেতর দিয়ে। আমি কবিতা লিখেছি আবার যুদ্ধও করেছি, পেটের দায়ে মসজিদের মুয়াজ্জিন হয়ে আযানও দিয়েছি আবার চা-রুটির দোকানে রুটিও বেলেছি। কিন্তু আমার সামগ্রিক পরিচয় আমি কবি। আর কবিরা সবসময় মানবতার পক্ষে। কবিদের রক্ত-মাংসের শরীর থাকে ইহজগতে আর আত্মা বিচরণ করে মহাজগতে। যাদের এ যোগ্যতা নেই তাদেরকে আমি কবি বলে মনে করি না। কবি জীবনানন্দ এজন্যই বলেছেন সবাই আসলে কবি নয়, কেউ কেউ কবি। আমি আত্মার কথা বলেছি। পৃথিবীর প্রত্যেক বস্তুই মূলের দিকে ধাবিত হয়। ঠিক আত্মাও ধাবিত হতে চায় ঊর্ধ্বলোকে কিন্তু পারে না কারণ সে মানব পিঞ্জরে বন্দী। তাই সে বারবার আবৃত্তি করে ’থাকব না কো বদ্ধ ঘরে’। এবার আসুন কবিতাটির সর্বশেষ চরণে- ”বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।” এখন মোবাইলের যুগ, ইন্টারনেটের যুগ, মানুষের হাতের মুঠোয় পুরো বিশ্ব। কিন্তু আমি ১৯৪১ সালে বসে যখন লিখছি ’বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’, তখন না ছিল মোবাইল না ইন্টারনেট। কিন্তু ছিল ইসলামের আধ্যাত্মিকতা যেখানে আত্মার বলে বলীয়ান হলে পুরো বিশ্ব হাতের মুঠোয় এসে যায়। বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এ আত্মার শক্তিতে শক্তিমান হয়ে বলেছিলেন,
”খোদায়ী নূরের পরশে যখন দৃষ্টি পড়ে বিশ্বপানে,
সরিষা সম দেখি তারে অনন্তর আমার জ্ঞানে”।
একই ভাব কিন্তু প্রকাশ ভঙ্গি ভিন্ন। এখন তো আধ্যাত্মিকতার চর্চা উঠে যাচ্ছে। কারণ সাধকরা নেই। তাদের জায়গা দখল করে নিয়েছে গ্রন্থের পণ্ডিতরা। এদেরকে ব্যঙ্গ করে আমি ’মানুষ’ কবিতায় লিখেছিলাম,
”পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!”
’সাম্যবাদী’ কবিতায় লিখেছিলাম,
”তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখো নিজ প্রাণ!”
প্রশ্নকর্তা: আপনি ইসলামের আধ্যাত্মিকতা নিয়ে বারবার বলছেন। এর কারণ কিংবা আপনার সাহিত্যে আদৌ কি আপনি এর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন কিনা আমাদের কি একটু বলবেন?
কবি: অবশ্যই। ইসলামের আধ্যাত্মিকতা আমার সাহিত্যে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। কোথাও রাখ-ঢাক ছাড়া আবার কোথাও রূপকার্থে। যেমন ’বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথমেই আছে,
”বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া,
খোদার আসন ’আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!”
অধ্যাত্মজ্ঞান ছাড়া খোদার আরশে পৌঁছানো কস্মিনকালেও সম্ভবপর নয়। ’খেয়া- পারের তরণী’ কবিতায় আছে,
”পুণ্য-পথের এ যে যাত্রীরা নিষ্পাপ,
ধর্মেরি বর্মে সু-রক্ষিত দিল্ সাফ্!
নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতেও
কাণ্ডারী আহমদ তরী ভরা পাথেয়।”
’দিল্ সাফ্’ অর্থাৎ হৃদয় পরিষ্কারের কথা একমাত্র ইসলামের অধ্যাত্মতত্ত্বেই বলে। ’কবি-রানি’-তে লিখেছি রূপকার্থে,
”তুমি আমায় ভালোবাস তাই-তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।।
... আমার আমি লুকিয়েছিল তোমার ভালোবাসায়,
আমার আশা বাইরে এল তোমার হঠাৎ আসায়।”
এ অধ্যাত্মপথ অত্যন্ত কণ্টকাকীর্ণ, অমসৃণ। যারা এ পথের পথিক তাদের সহ্য করতে হয় অনেক ঝড়-ঝাপটা, ভর্ৎসনা, সমাজের রক্তচক্ষু, এবং সর্বোপরি জ্ঞানপাপীদের সমালোচনা যা আমি ’সত্য-মন্ত্র’ গানে লিখেছি-
”(তোর) ঘরের প্রদীপ নিবেই যদি,
নিবুক না রে, কিসের ভয়?
আঁধারকে তোর কিসের ভয়?
(ঐ) ভুবন জুড়ে জ্বলছে আলো,
ভবনটাই সে সত্য নয়।
ঘরটাই তোর সত্য নয়।
বিধির বিধান মানতে গিয়ে
নিষেধ যদি দেয় আগল
বিশ্ব যদি কয় পাগল,
আছেন সত্য মাথার ’পর,-
বে-পরোয়া তুই সত্য বল।
বুক ঠুকে তুই সত্য বল!
(তখন) তোর পথেরই মশাল হয়ে
জ্বলবে বিধির রুদ্র-চোখ!
বিধির বিধান সত্য হোক!
জাতের চেয়ে মানুষ সত্য,
অধিক সত্য প্রাণের টান,
প্রাণ-ঘরে সব এক সমান।
বিশ্ব-পিতার সিংহ-আসন
প্রাণ-বেদীতেই অধিষ্ঠান,
আত্মার আসন তাই তো প্রাণ।”
মনে করবেন না আমি শুধু গান-কবিতাই লিখেছি। এসবের সমর্থনে পরতে পরতে কোরআন-হাদীসের কথা বলে গিয়েছি। যেমন, এক হাদীসে আছে, ”তোমরা এমন ভাবে আল্লাহর জিকির কর যেন লোকে তোমাদের পাগল বলে।”১ আমি লিখেছি, ”বিধির বিধান মানতে গিয়ে/ বিশ্ব যদি কয় পাগল,/ বে-পরোয়া তুই সত্য বল।” আরেক হাদীসে আছে, ”মু’মিনের ক্বলব বা হৃদয় হলো আল্লাহর আরশ।”২ আমি লিখেছি, বিশ্ব-পিতার সিংহ-আসন/ প্রাণ-বেদীতেই অধিষ্ঠান,/ আত্মার আসন তাই তো প্রাণ।” কোরআনে মহান আল্লাহ বলছেন,
”হে ঈমানদারেরা, তোমরা নিজেরা বাঁচো এবং পরিবার-পরিজনদের বাঁচাও আগুন থেকে।”৩
আমি ’শহীদী-ঈদ’ কবিতায় লিখেছি,
”শুধু আপনারে বাঁচায় যে,
মুসলিম নহে, ভণ্ড সে!
ইসলাম বলে- বাঁচো সবাই!
দাও কোরবানি জান ও মাল,
বেহেশত তোমার করো হালাল।
স্বার্থপরের বেহেশত নাই।”
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ”আমি তো তোমার মাঝেই বিরাজমান, কেন তুমি আমায় দেখতে পাও না?”৪
আমি ’ঈশ্বর’ কবিতায় লিখেছি,
”সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছো চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজো- আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে!
ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেখো দর্পণে নিজ-কায়া,
দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে পড়েছে তাঁহার ছায়া।”
এভাবে অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। এ বিষয়ে আমি অনেক গানও লিখেছি। যেমন:
”খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে
বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে।
ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ
এল যে এই পথ ধরে।”
”আমার মনের মসজিদে দেয়
আজান হাজার মোয়াজ্জিন,
প্রাণের ’লওহে’ কোরান লেখা
রুহ পড়ে তা রাত্রিদিন।”
প্রশ্নকর্তা: ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী (সা.) কে নিয়েও আপনার অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা, গান ও গজল আছে। এই যেমন-
”মোহাম্মদ নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে।
তাই কি রে তোর কন্ঠের গান এমন মধুর লাগে।।
ওরে গোলাব নিরিবিলি
বুঝি নবির কদম ছুঁয়েছিলি,
তাই তাঁর কদমের খোশবু আজও তোর আতরে জাগে।”
কিংবা
”আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়
আমার নবী মোহাম্মদ, যাহার তারিফ জগৎময়।”
কিংবা
”ছিলে মিশে আহাদে, আসিলে আহমদ হয়ে,
বাঁচাতে সৃষ্টি খোদার এলে খোদার সনদ লয়ে;”
আমার প্রশ্ন হল এ পংক্তি গুলো লেখার অনুপ্রেরণা আপনি কোথায় পেলেন?
কবি: আমি আগেই বলেছি যে ছোটকাল থেকেই আমি ইসলামিক পরিমণ্ডলে বড় হয়েছি। তবে এখানে একটি বড় ধরনের পার্থক্যের বিষয়ে না বলে পারছি না। ছোটকালে আমরা যেসব মাওলানা-মৌলভীদের কাছে আল্লাহ, তাঁর রসূল (সা.) এবং ইসলাম সম্পর্কে যেসব ভক্তি ভরা কথা, হামদ-না’ত শুনতাম, এখনকার বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদদের কাছে এসব আর শোনা যায় না। রসূল প্রেমের অনুপ্রেরণা আমার ওই সব ভক্তি ভরা কথা আর হামদ-না’ত থেকেই। যাক, ওদিকে আমি আর যাবো না। পুরো জীবনটাই আমার বিতর্কের ভেতর দিয়ে গেছে, নতুন করে আর ওপথে যেতে চাই না।
প্রশ্নকর্তা: ছোটদেরকেও আপনি বঞ্চিত করেননি। তাদের জন্যও রয়েছে আপনার বিশাল কর্মযজ্ঞ। আমরা অবাক হয়ে যাই যখন পড়ি-
”কাঠবেরালি! কাঠবেরালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
বেরাল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?-”
আপনি কাঠবিড়ালী কে বলছেন ’কাঠবেরালি’ ...
কবি: একটা শিশু যেভাবে কাঠবিড়ালীর সাথে কথা বলবে আমি সেভাবেই ছড়াটি লিখেছি।
প্রশ্নকর্তা: আরো আছে। যেমন ’প্রভাতী’ ছড়ায় লিখেছেন-
”ভোর হোলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠো রে!
ঐ ডাকে
জুঁই-শাখে
ফুল-খুকি ছোটো রে!
খুকুমণি ওঠো রে!”
’লিচু-চোর’-এ লিখেছেন-
”বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম, একটু দাঁড়া!”
ছড়াটি পড়লে আমি এখনো হাসি।
কবি: যখন শিশুদের জন্য লিখি তখন আমি তাদের মতো হয়ে যাই। শিশুদের ভাষা কিন্তু আলাদা এটা আপনাকে বুঝতে হবে। তাদের মন জয় করতে হলে আপনাকে তাদের ভাষায় কথা বলতে হবে।
প্রশ্নকর্তা: আমরা আর আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবো না। তবে একটা ব্যাপারে একটু খটকা আছে। শুরুর দিকে আপনি বলেছেন, ’মোল্লারা আমাকে দিয়েছে শুধু গালি আর বাংলার অধ্যাপকেরা আমার মুখে মেখেছে চুনকালি।’ মোল্লাদের ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম, তারা তো আর আলেম বা জ্ঞানী নয় যে আপনাকে বুঝবে। কিন্তু বাংলার অধ্যাপকেরা আবার কী করলো?
কবি: কী যেন নাম .. কী আজাদ ...
প্রশ্নকর্তা: হুমায়ুন আজাদ?
কবি: হ্যাঁ হ্যাঁ, তার একটা বই আছে না ’আমার অবিশ্বাস’ সেখানে সে আমার ধর্ম বিষয়ক লেখাগুলোর ব্যাপারে লিখেছে আমি নাকি স্থুলভাবে আমার বিশ্বাস প্রকাশ করেছি।৫ আমরা নাকি অবিকশিত আর তারা প্রস্ফুটিত ফুল! আমরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন আর তারা আধুনিক! ভালো, বেশ ভালো। ইসলাম, আল্লাহ আর নবীকে নিয়ে লিখলে অবিকশিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আর এঁদের বিপরীত লিখলে আধুনিক। এসব তারাই বলে যাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা প্রকট যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রি তাদের করায়ত্তে। সর্বত্রই যার অবিশ্বাস সে আবার মানুষ নাকি? আমি অবাক হয়ে যাই একজন মানুষ কীভাবে অবিশ্বাসী হতে পারে! মানুষ যখন শিশু থাকে তখন শিশুটি শুধু তার মাকেই চিনে যদিও তার চারপাশে অনেক কিছু থাকে, থাকে আকাশ, মাটি, বাতাস, পাখি, নদী, পাহাড় এবং সর্বোপরি আমাদের সবার পালনকর্তা মহান আল্লাহ। শিশুটি কি এত কিছু বুঝে? সে শুধু বুঝে তার মাকে। ঠিক এ মহাজগতের কাছে আমরা মানবজাতিরা শিশুর মত। আমাদের চারপাশেও অনেক কিছু আছে কিন্তু আমরা কি সবকিছু বুঝি? যার কোন বিশ্বাসই নেই তার আবার কিসের অবিশ্বাস?
প্রশ্নকর্তা: চমৎকার বলেছেন। শেষ একটা প্রশ্ন। আপনি ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসী আর হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসীদের এক কাতারে আনার চেষ্টা করেছেন। এর স্বপক্ষে আপনি প্রচুর লিখেছেন। একদিকে বলছেন,
”আল্লা নামের বীজ বুনেছি এবার মনের মাঠে।
ফলবে ফসল, বেচব তারে কিয়ামতের হাটে।।
পত্তনিদার যে এই জমির
খাজনা দিয়ে সেই নবিজির
বেহেশতেরই তালুক কিনে বসব সোনার খাটে।”
আবার অন্যদিকে ’শ্যামাসংগীতে’ বলছেন,
”যে কালীর চরণ পায় রে
কালীর চরণ পায়
সে মোক্ষ মুক্তি কিছুই নাহি চায়।।
সে চায় না স্বর্গ, চায় না ভগবান,
শ্রীকালীর চরণ আত্মা তাহার, দেহ-মন ও প্রাণ;”
এটা কীভাবে সম্ভব?
কবি: আচ্ছা, ভোর বেলা যখন সূর্য উঠে সে কি শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আলো দেয় না সবাইকে দেয়? সূর্য যেমন আল্লাহর সৃষ্টি তদ্রুপ আমিও। সূর্য যদি আল্লাহর একটা সৃষ্টি হয়ে সবাইকে আলো দিতে পারে তবে আমার সমস্যাটা কোথায়?
প্রশ্নকর্তা: কোরানে আল্লাহ বলছেন,
”নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম” এবং ”যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না”।৬
তেল আর জল কিন্তু কখনো মিশে না। দু’নৌকোয় পা দিলে পরিণতি কী হতে পারে তা আপনি নিজেই কিছুক্ষণ আগে বললেন। আপনিও কি দু’নৌকোয় পা দেননি?
কবি: (কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর) এটা আসলে তখনকার হিন্দু-মুসলিম উত্তাল পরিস্থিতি ও সঙ্গদোষে হয়েছে। কিছু সমাজতান্ত্রিক বন্ধুর সাথে মিশে আমিও তাতে প্রভাবিত হয়েছিলাম এবং এর ছাপ আমার তখনকার লেখায় পড়েছে। আমি আসলে চেয়েছি ...

কিসের যেন শব্দে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। একি! আমি বিছানায় পড়ে আছি কেন? কবি নজরুল কোথায়? পাণ্ডুলিপিটা কোথায়?
পুনশ্চঃ কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর লেখা পাঠোত্তর আমি এখনো অবাক হয়ে ভাবি এ লোক এত বিপুল ও বৈচিত্র্যময় সাহিত্য রচনার শক্তি কোথায় পেল। কবির প্রতি আমার শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্রঃ
১. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১১৬৫৩, মুসনাদে আব্দ বিন হুমাইদ, হাদীস নং-৯২৫, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৮১৭, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৫২৩, তাফসীর আল কুরতুবী-চতুর্দশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৭ এবং তাফসীর ইবনে কাসীর-ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮৪।
২. কোরআন- সুরা আল আহযাব, আয়াত: ৭২ ও সুরা আল আনফাল, আয়াত: ২৪ এবং মকতুবাত শরীফ, ১ম খণ্ড, ১ম ভাগ,পৃ.১৬৯; কিতাবুল যুহুদ, ১/৬৯ পৃষ্ঠা, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ:); দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন।
৩. কোরআন- সুরা আল তাহরীম, আয়াত: ৬।
৪. কোরআন- সুরা যারিয়াত, আয়াত: ২১।
৫. আমার অবিশ্বাস- হুমায়ুন আজাদ, পৃষ্ঠা ৪১, আগামী প্রকাশনী।
৬. কোরআন- সুরা আল ইমরান, আয়াত: ১৯ ও ৮৫।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.