নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছায়া নয়, আলো ...

আরমান আরজু

সত্য ও অসীমের পথে

আরমান আরজু › বিস্তারিত পোস্টঃ

অর্থ কখনো অনর্থের মূল নয়

১৩ ই জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৩:০২

বিদ্যালয় জীবনে আমরা একটি ভাবসম্প্রসারণ পড়েছিলাম। ”অর্থ অনর্থের মূল”। চিন্তার বিহগ তখনো আকাশে ডানা মেলেনি আর তাই সম্মানিত শিক্ষকদের দেয়া পাঠ মাথা পেতে নিয়েছি। পরীক্ষার খাতায় গরগর করে লিখে এসেছি ’অর্থই অনর্থের মূল’। আসলেই কি অর্থ অনর্থের মূল? একই ছুরি একজন চিকিৎসকের হাতে থাকলে তা হয় জীবন রক্ষার প্রতীক আর একজন অসৎ ব্যক্তির হাতে থাকলে তা হয় জীবন সংহারের প্রতীক। তাই বলে আমরা কি বলতে পারি ছুরি অনর্থের মূল? অনর্থের মূল তাহলে কে?
বিনিময় প্রথার অসুবিধার জন্যই মুদ্রা বা অর্থ ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। মুদ্রা বা অর্থের উদ্ভব না হলে ব্যাংকগুলোর সিন্দুক ভরে যেত চাল-ডাল-গরু-মুরগী ইত্যাদিতে। চাল-ডাল-গরু-মুরগীর লেনদেন করতে করতে ব্যাংক কর্মকর্তার নাভিশ্বাস উঠত! আবার অন্যপিঠে বলতে হয় মুদ্রা বা অর্থ ব্যবস্থার অসুবিধাও আছে বটে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য! এখন জাল অর্থ নির্ণয়ের জন্য ব্যাংক কর্মকর্তারা কোরবানির গরু বেচাকেনার হাটে গরুর মল-মূত্রের বিকট গন্ধও সহ্য করেন! সবকিছুই অর্থের প্রয়োজনে। অর্থ এখন বিনিময় প্রথার একটি অপরিহার্য উপাদান। সে ’অর্থ’ তবে কেন অনর্থের মূল হবে?
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে মা খাদীজা (রা.)-এর বিয়ের পর নবী (সা.) অনেক ধন-সম্পত্তির মালিক হন বটে কিন্তু এ ধন-সম্পত্তির কিছুই তিনি ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসে ব্যয় করলেন না। বিলিয়ে দিয়েছিলেন অভাবীদের মধ্যে। এমনকি ইন্তেকালের কিছু পূর্বে তাঁর (সা.) কাছে যে পাঁচ/ছয়টি দিনার ছিল সেগুলোও তিনি দান করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। [সূত্র: ইসলামের ইতিহাস-১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৮ ও ২২৪, মূল: মাওলানা আকবর শাহ খান নজিবাবাদী, অনুবাদ ও সংকলন বিভাগ-ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা]। দেখা যাচ্ছে জীবনের এক পর্যায়ে মহানবী (সা.) অগাধ অর্থের মালিক হলেও তা কখনো অনর্থের কারণ হয়নি। যাবার বেলায়ও কিছু রেখে যাননি। আর আমরা হলে স্ত্রী-পুত্র-পরিজনদের জন্য রেখে যেতাম কাড়ি কাড়ি ব্যাংক জমা, স্বর্ণ, সম্পত্তি ইত্যাদি। দোষ কার? অর্থের না যে এর ব্যবহার করছে তার?
হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রহ.) প্রথম জীবনে ছিলেন বলখ নামক একটি অঞ্চলের বাদশাহ, পরে বাদশাহী ছেড়ে নির্জনে কঠোর সাধনা করে আল্লাহর প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। মহান আল্লাহর প্রিয়পাত্র তখনই হওয়া যাবে যখন মন থেকে সব রকমের মোহ বা মায়া দূর হয়ে যাবে। সব রকমের মোহ বা মায়া ত্যাগ করা এত সহজ বিষয় নয়। মোহের মধ্যে আছে ক্ষমতা, অর্থ, নারী ইত্যাদি। ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রহ.)-এর ক্ষমতা, অর্থ, নারী এ তিনটি ছাড়াও আরো অনেক প্রকার মোহ ছিল কিন্তু তিনি সব ত্যাগ করলেন একমাত্র মহান আল্লাহকে পাবার আশায়। এবং তিনি পেয়েছিলেনও। ফলাফল তিনি আর বাদশাহগিরিতে ফিরে যাননি কারণ তিনি আরেকটি শক্তিশালী বাদশাহী পেয়েছিলেন। সে শক্তিশালী বাদশাহীটি কী? বর্ণিত আছে, একদিন ইবরাহীম ইবনে আদহাম টাইগ্রীস নদীর পাড়ে বসে নিজের ছেঁড়া কাপড় সেলাই করছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বলল, ’আচ্ছা বলুন তো, বলখ অঞ্চলের বাদশাহী ছেড়ে আপনি কী লাভ করেছেন?’ ইবরাহীম ইবনে আদহাম লোকটির মনের ভাব বুঝতে পেরে হাতের সুচটি নদীতে ফেলে দিয়ে লোকটিকে বললেন সুচটি নদী থেকে তুলে দিতে। লোকটি অক্ষমতা প্রকাশ করলে ইবরাহীম ইবনে আদহাম নদীর দিকে ইশারা করলেন। ইশারা মাত্রই অসংখ্য মাছ এক একটি সোনার সুচ মুখে নিয়ে পানির উপর ভেসে উঠল। এ দৃশ্য দেখে লোকটি বিস্মিত হয়ে গেল। ইবরাহীম ইবনে আদহাম মাছদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ’আমি সোনার সুচ চাই নি, আমার সুচটিই আমি ফেরত চেয়েছি।’ অমনি একটি মাছ তাঁর সুচটি তাঁর সম্মুখে ফেলে দিল। তারপর তিনি লোকটিকে লক্ষ্য করে বললেন, ’বলখের বাদশাহী ছেড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বস্তুই আমি লাভ করেছি’ [সূত্র: মুসলিম সাধকগণ এবং অধ্যাত্মবাদ (Muslim Saints & Mystics), মূল: হযরত শেখ ফরিদউদ্দীন আত্তার (রহ.) এর তাযকিরাতুল আউলিয়া গ্রন্থ থেকে, অনুবাদ: এ. জে. আরবারি, প্রকাশনায়: ওমফালোসকেপসিস, আমেস, আইওয়া, যুক্তরাষ্ট্র]। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন অথচ এত এত সোনার সুচ সম্মুখে পেয়েও যিনি নেন নি বুঝা যাচ্ছে তিনি মোহ থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন।
এভাবে আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। এসব উদাহরণ থেকে একটি ধ্বনিই শুধু প্রতিধ্বনিত হবে আর তা হল অর্থ এঁদের কোন একজনকেও বশীভূত করতে পারেনি।
এবার আমরা বিপরীত চিত্র উপস্থাপন করব। বোধশক্তি অর্জন করার পর থেকেই দেখে আসছি মধ্যপ্রাচ্য নামক অঞ্চলটিতে অশান্তি লেগেই আছে। কেউ যেন দেখার নেই। এর সম্ভাব্য কারণগুলো হল অপশক্তির আধিপত্য বিস্তার আর অঞ্চলটির তেল সম্পদ যাকে তরল স্বর্ণ নামেও অভিহিত করা হয়। ক্ষমতার লোভ কিছু মানুষকে পুরো অন্ধ করে দিয়েছে। আর ক্ষমতার অপর নামই হল অর্থ। এত এত নিরপরাধ মানুষ-নারী-শিশু মারা যাচ্ছে সেদিকে কারো কোন ভ্রক্ষেপ নেই! এ যেন রোম পুড়ছে নীরো বাঁশি বাজাচ্ছে! এরা নাকি আবার ইসলামিক! ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা.) বলেছিলেন, ’যদি ইউফ্রেটিস নদীর তীরে একটি কুকুর না খেয়ে মারা যায় তবে উমর সে জন্য দায়ী থাকবে’ [আল ফারুক-উমর (রা.)-এর জীবনী, মূল: শামসুল উলামা মাওলানা শিবলী নুমানী, অনুবাদ: মাওলানা জাফর আলী খান, প্রকাশনায়: মুহাম্মদ আশরাফ, লাহোর, পাকিস্তান]। কুকুর দেখা দূরে থাক হাজারে হাজারে মানুষ-নারী-শিশু মারা গেলেও এসব অত্যাচারী শাসকদের হৃদয় এতটুকু কাঁপে না। সবল অর্থনীতি একটি দেশের জন্য অপরিহার্য জানি কিন্তু কতটুকু সবল তাকে হতে হবে যে জন্য অন্য দেশে হানা দিতে হবে? কেন এ একবিংশ শতাব্দীতেও কোন রাষ্ট্র, কোন সমাজ, কোন পাড়া আক্রান্ত হবে অর্থলোলুপদের দ্বারা? যতই অর্থের সৌধ গড়া হোক না কেন, যতই রাজ্য জয় করা হোক না কেন, যতই প্রাণ হন্তারক মারণাস্ত্র তৈরী করা হোক না কেন, যতই গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে নিজের প্রভাব খাটানো হোক না কেন, মৃত্যুতে তো সবই শেষ। অর্থ, রাজ্য, অস্ত্র, গোয়েন্দাগিরি সবই থাকবে শুধু প্রাণটি থাকবে না, তাহলে কেন এসব ক্ষণস্থায়ী বস্তুর পেছনে ছোটা? এ কি পাগলামি নয়?
মানুষ এখন অধ্যবসায় ছেড়ে অর্থদাসে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকে গভীর রাত শুধু অর্থ আর অর্থের চিন্তা। ধর্মের নামে, খেলার নামে, শিক্ষার নামে, ব্যবসার নামে, ইত্যাদি হরেক নামে চলছে অর্থ কামানো। আমরা কি চতুষ্পাদ জন্তুর চেয়েও অধম হয়ে যাচ্ছি? অর্থ ছাড়া তারা তো দিব্যি চলে যাচ্ছে, না খেয়ে কোন জন্তুকে তো কখনো মরতে দেখিনি বরঞ্চ কোরবানির নামে, ত্যাগের অভিনয়ের নামে বছর বছর অসংখ্য অবলা পশুকে আমরা বধ করে চলেছি! আমি আবার অর্থ ছাড়া চলতে বলছি না বরং বলছি কতটুকু অর্থ আমার প্রয়োজন চলার জন্য। আমরা কি অর্থের জন্য না অর্থ আমাদের জন্য? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যেনতেন ভাবে অর্থ কামাই করার জন্যই আমরা পৃথিবীতে এসেছি! অর্থ তো তবে অনর্থ সৃষ্টি করবেই। অথচ অর্থের সৃষ্টি হয়েছে আমাদের সুবিধার্থে।
সুতরাং অর্থ কখনো অনর্থের মূল নয়। অনর্থের মূলে তারাই যারা অর্থের অপব্যবহার করে পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করে চলেছে। তারা ভিনগ্রহের কেউ নয়, তারা বেশিসংখ্যক মানুষ। যত বড় বড় সনদ বা ডিগ্রীই তাদের থাকুক না কেন তারা আসলে অর্থলোভী। তারা প্রার্থনালয়ে যেয়ে যতই ধর্মভীরু সাজুক না কেন তারা আসলে লোলুপ। তারা মহাকাশে যেয়ে ঘুড়ি ওড়ালেও তারা মানবতার শত্রু।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.