নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আসাদুজ্জামান জুয়েল

আসাদুজ্জামান জুয়েল

রওশনারা বেগম ও আবদুর রশীদ খানের কনিষ্ঠ পুত্র আমি আসাদুজ্জামান জুয়েল। ১৯৭৮ সালের ০৫ জুন শরীয়তপুর জেলার পালং থানা পালং গ্রামের এক সাধারণ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। শিক্ষা জীবন শুরু মায়ের হাতে। তুলাসার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এস.এস.সি; শরীয়তপুর সরকারী মহাবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচ.এস.সি; জাজিরা ডিগ্রী কলেজে থেকে বাণিজ্য বিভাগ হতে বি.কম পাস করার পর প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন অনুষদ হতে এলএল.বি ও এলএল.এম সম্পন্ন করি। প্রতিটি ক্যাম্পাসেই কেটেছে মধুর দিনগুলো। ২০০৯ সালের ০৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে আইনজীবী হিসাবে তালিকাভূক্ত হয়ে ২৩ ডিসেম্বর ২০০৯ ঢাকা বার এসোসিয়েশনে সদস্যভূক্ত হই। পরবর্তীতে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০ শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যভূক্ত হয়ে আইন পেশার সাথে যুক্ত আছি। ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতি, শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতি ও শরীয়তপুর জেলা ট্যাক্সেস বার এসোসিয়েশনের সদস্য হিসাবে আইন পেশায় নিয়োজিত আছি। সাংবাদিকতা ও লেখালিখি করি মনের টানে। একই সাথে আইন পেশা ও সাংবাদিকতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিরন্তন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কর্ম জীবন শুরু লেখালিখির মাধ্যমে। দৈনিক ভোরের কাগজ দিয়ে সাংবাদিকতার শুরু। এর পর দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক কালের কন্ঠ, দৈনিক গণমুক্তি সহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে কাজ করেছি। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬টি। প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ নিয়ে লেখা আমার প্রথম উপন্যাস ‘যেমন আছি লন্ডনে’ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের একুশে বই মেলায়। দীর্ঘ বিরতির পরে ২০১৯ এর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয় ভ্রমণ কাহিনী ‘কলকাতা ভ্রমণঃ জীবনে প্রথম কিছু’; প্রবন্ধ সংকলন ‘সমকালীন ভাবনা’ ও প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘হৃদয়ের শব্দক্ষরণ’। ২০২০ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সংকল ‘সমকালীন ভাবনা-২’ ও দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘তুই থাকিস পরাণের গহীনে’। এছাড়াও বেশ কিছু বই প্রকাশের অপেক্ষায় আছি। লেখালিখি করি বিভিন্ন ব্লগে। আমার ওয়েবসাইটঃ www.asadjewel.com, নিজস্ব ব্লগঃ www.asadjewel.blogspot.com এছাড়া www.somewhereinblog.net এ নিয়মিত লেখালিখি করি। শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসাবে তিনবার ও লাইব্রেরী সম্পাদক হিসাবে দু্ইবার দায়িত্ব পালন করেছি। বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, শরীয়তপুর জেলা ইউনিটের জীবন সদস্য। প্রগতি লেখক সংঘ, শরীয়তপুর জেলা শাখার সভাপতি হিসাবে দ্বায়িত্বে আছি, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি। সোনালী ব্যাংক লিমিটেড শরীয়তপুর, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক শরীয়তপুর এর আইন উপদেষ্টা হিসাবেও কর্মরত আছি। গরীব-দুঃখীদের মামলা পরিচালনার জন্য জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা শরীয়তপুর জেলা শাখার প্যানেল আইনজীবী হিসাবে দুস্থ্যদের আইনগত সহায়তা প্রদান কাজে নিষ্ঠার সাথে জড়িত আছি। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), শরীয়তপুর জেলা শাখার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষানিকেতন কর্ম কেন্দ্রীক পাঠাগার, শরীয়তপুরের কার্যনির্বাহী সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি দীর্ঘদিন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও অস্ট্রেলিয়ান বার এসোসিয়েশনের উদ্যোগে ইনটেনসিভ ট্রায়েল এডভোকেসী ওয়ার্কশপ, ২০১০ সালে এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টার এর উদ্যোগে হিউম্যান রাইটস এন্ড রুল অফ ‘ল’, ২০০২ ও ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট এর উদ্যোগে শিশু ও নারী বিষয়ক রিপোর্টিং কর্মশালা, ১৯৯৯ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর আয়োজিত কম্পিউটার ট্রেড প্রশিক্ষণ, ২০১০ সালে ইউএসএইড-প্রগতি-কালেরকন্ঠ আয়োজিত দুর্নীতি বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরী ও তথ্য অধিকার আইন বিষয়ক প্রশিক্ষণসহ পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। লেখালিখি ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে সমাজ সংস্কারে একজন কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। আমার অর্ধপ্রাণ কন্যা রওশন আসাদ প্রিয়ন্তী। সহধর্মীনি মুনমুন সুলতানা লুনা পেশায় শিক্ষিকা। দুই বোন রেহানা আক্তার রেখা এবং কহিনুর আক্তার শিখা এবং একমাত্র ভাই মোহাম্মদ রুহুল আমীন খান আজাদ একজন প্রবাসী। যোগাযোগের জন্য আমাকে মেইল করতে পারেনঃ [email protected]

আসাদুজ্জামান জুয়েল › বিস্তারিত পোস্টঃ

পথের পদ্যঃ কোলকাতা ভ্রমনঃ জীবনে প্রথম অনেক কিছু...

০৬ ই জুন, ২০১৭ রাত ৯:৫৫

কোলকাতা ভ্রমনঃ জীবনের প্রথম অনেক কিছু...
॥ ১ ॥
প্রথম পাসপোর্টঃ
৩৭ বছর পেরিয়ে গেছে অথচ পাসপোর্ট নেই আমার। আর এর আগে পাসপোর্টের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করিনি। ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাস করি। তৎকালীন সময়ের তুলনায় রেজাল্ট খুব ভাল না হলেও খুব যে খারাপ তাও বলবো না। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিষয় প্রতি সত্তর পার্সেন্টের উপরে মার্কস সহ প্রথম বিভাগেই উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। তারপরেও পরিবার এবং নিজে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমি কখনোই ভাল স্টুডেন্ট ছিলাম না। এভারেজ স্টুডেন্ট হিসাবে যা রেজাল্ট হয়েছে তাতে ভবিষ্যতে যে খুব ভাল কিছু করে কেটে খেতে পারবো সেই ভরসা আমার মধ্যে পরিবারের লোকজন দেখতে পাচ্ছিল না। তাই পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নিল বিদেশ পাঠিয়ে দেবে। আমার ছোট খালু বিল্লাল হোসেন খান তখন সৌদি প্রবাসী। ঐ সময় তার প্রবাস জীবনের ব্যাপ্তি বিশ-বাইশ বছরের অধিক। তাই খালুর ওখানে পাঠালে আমি ভাল থাকবো এবং আমার কোন সমস্যা হবে না এই ভেবে আমাকে প্রস্তাব দিলো যে,
-তুই সৌদি চলে যা।
আমার বিদেশের প্রতি কোন কালেই মোহ ছিল না। প্রবাসীদের আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। তারা নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, শরীরের তাজা রক্ত পানি করে টাকা রোজগার করে দেশে পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে এবং দেশের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ পাহাড়সম করে যা নিয়ে আমরা গর্ভ করি। যা হোক, আমি যেতে চাইলাম না কেন এর যুক্তি হিসাবে যা চিন্তা করেছিলাম তা আজও আমার মনে আছে এবং মনে থাকবে। প্রথমত আমি আমার মাকে ছেড়ে দূরে থাকতে পারতাম না। আমি যখনই বাড়ি যেতাম, স্কুল থেকে হোক, বা বাজার থেকে বা বেড়িয়ে এসে, যদি দেখতাম মা বাসায় নেই, তখনই বেড়িয়ে পড়তাম মা যেখানে গেছে সেখানটার উদ্দেশ্যে। মানুষের সামনে মা আমাকে পরিচয় দিতে ‘কোলের পোলা’ হিসাবে। আমি শিক্ষা জীবনের এক পর্যায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম। বছর দুয়ের মধ্যে যত ছুটিছাটা পেয়েছি বাড়ি চলে এসেছি। ছুটি না থাকলেও মাঝে মাঝেই বাড়ি চলে এসেছি। তাতে পড়ার বারোটা বেজেছে। অবশেষে আমি বুঝতে পেরেছি আমার দ্বারা অনার্স শেষ করা হবে না, বাড়িই চলে যাই। যেই সিদ্ধান্ত, সেই কাজ। ঢাকার তল্পি তল্পা গুটিয়ে বাড়ি চলে এলাম এবং বি,কম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। মূল বিষয় থেকে একটু দুরে চলে এসেছি, আমাকে যখন বিদেশ যেতে প্রস্তাব করা হলো আমি তখন বলেছিলাম
-বিদেশ যাব ঘুরতে কখনো কাজ করতে নয়।
এর কারন, যদি কাজ করতে যাই তবে ইচ্ছে হলেই ফিরে আসতে পারবো না। ঘুরতে গেলে ঘুরে চলে আসবো। এসেই মায়ের মুখ দেখবো। মা’ই আমার কাছে ছিল একটি পৃথিবীর সমান। শেষ পর্যন্ত বিদায় বেলায়ও আমি মায়ের পাশেই ছিলাম। এটাই আমার তৃপ্তি। প্রবাসে গেলে হয়তো অনেক অর্থ বিত্তের মালিক হতে পারতাম কিন্তু মায়ের শেষ নিঃস্বাস পর্যন্ত পাশে থাকতে পারতাম না। এ কারনে আমার আর পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়নি। পরবর্তীতে শরীয়তপুর আসার পর পড়াশুনার পাশাপাশি প্রথম আলোয় সাংবাদিকতা, ঔষধের ব্যবসা, শেয়ার ব্যাবসা, কালের কন্ঠে সাংবাদিকতাসহ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমার কর্মজীবনের তরী ভিড়লো আইন-আদালত-উকিল পাড়ায়। আমি আমার মায়ের একান্ত ইচ্ছায় ও দোয়ায় আইনজীবী হিসেবে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে সনদ লাভ করলাম। প্রথমে ঢাকা বারে যোগদান করলেও ঐ মায়ের টানেই শরীয়তপুর বারে সদস্যপদ গ্রহণ করে আইন পেশায় যুক্ত হলাম। পেশায় ব্যস্ততা ও আয় রোজগারের সাথে সমন্বয় রেখে এবার মনে হলো বিদেশ ঘোরার সময় এসেছে। তাই পাসপোর্ট করা দরকার। এরই মধ্যে বড় ভাই মোহাম্মদ রুহুল আমিন খান আজাদ ইটালী প্রবাসী হয়ে তার পরিবারের অপর দুই সদস্য ভাবি লাভলী আক্তার ও ভাতিজা নাজমুল আমিন খান পাপনকে নেয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকলে তাদের দুজনের জন্য পাসপোর্ট করার তাগিদ পড়লো। ভাবলাম দুজনের জন্য যেহেতু আমাকেই দৌড়ঝাপ করতে হবে তবে আমার পাসপোর্টও করে ফেলি। যেই ভাবা সেই কাজ। তিন জনের পাসপোর্ট করার জন্য শরীয়তপুরে স্থাপিত আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গেলাম এবং ফরম নিলাম। পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতির বিষয় সবাই জানে, শুধু জানে না সরকার! পাসপোর্ট প্রতি বার শত টাকা ঘুষ লাগে, আমি নিজে গিয়ে উপ-পরিচালককে আমার পরিচয় দিলাম, তাতে আমাদের পাসপোর্টে আর বার শত টাকা ঘুষ বা উৎকোচ লাগলো না, আমাদের কাজ করে দিলো নিয়মের মধ্যে থেকে। আমাদের ফরমের কোনে বিশেষ একটা মন্তব্য লিখে দিলো যাতে অন্য কোন টেবিলে কোন ঝামেলা না করে, কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ হলাম ঐ কর্মকর্তার নিকট। কিন্তু পুলিশ ভেরিভিকেশন বলে একটা ব্যাপার থাকে, সেখানে আর মাফ পেলাম না!! যথারীতি আমাদের পুলিশ ভাইরা (জনগনের বন্ধু) বন্ধুর কাছ থেকে ঠিকই চা খাওয়ার কথা বলে কিছু নিয়ে গেল। পুলিশ ভাইদের চায়ে যে চিনি এত বেশি লাগে আগে শুনেছি কিন্তু নিজে পাসপোর্ট করতে গিয়ে তা হারে হারে টের পেলাম!! অতঃপর ১০ মার্চ ২০১৫ ইস্যুকৃত জীবনের প্রথম পাসপোর্টটি হাতে পেয়ে গেলাম কিন্তু কোন দেশের ভিসা তো নেই!!! ভাবি লাভলী আক্তার ও ভাতিজা নাজমুল আমিন খান এর পাসপোর্ট পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ ইটালী ভিসা সেন্টারে জমা দেয়ার দীর্ঘদিন পর ভিসা সহ পাসপোর্ট ফেরত দিলো। এর কিছুদিন পর তাদের হযরত শাহ জালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে বিদায় দিতে গেলাম। ভাবি ভাতিজা চলে গেলো বিদেশ, আমি পরে রইলাম দেশেই!!

॥ ২ ॥
প্রথম আবেদনে প্রথম ভিসাঃ
আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি ও পরম মিত্র দেশ ভারত। ভ্রমনের উদ্দেশ্যেই যেহেতু পাসপোর্ট করেছি তাই প্রথম ভারতের ভিসা চাইবো মনস্থির করলাম। সবাই সতর্ক করে দিলো যে, ভারতের ভিসা পাওয়া আমেরিকার ভিসা পাওয়ার চাইতেও কঠিন!! যেমন বলা তেমনই ফল পেলাম! ই-টোকেন করতেই দীর্ঘ সময় চলে গেলে সাথে গেল টাকা। ভ্রমন ফি যা নিলো তার কয়েক গুন টাকা ই-টোকেন নামের যে কাটাতার তার কাটায় লেগে বেরিয়ে গেল। অবশেষে ই-টোকেন নিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ ভারতীয় ভিসা সেন্টার মতিঝিলের দিলকুশায় স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার অফিস সংলগ্ন সেন্টারে গেলাম। শীত চলে গেছে, হালকা গরমের দিন। সকাল সকাল কোট-টাই পড়ে একদম স্যুটেড-বুটেড বাবু সেজে লাইনে দাড়িয়ে আছি। দূর থেকে এক সুন্দরী রমনী দেখি আমার দিকে আঙ্গুল দিয়ে এক ভদ্রলোককে দেখাচ্ছে! তাকিয়ে দেখি আর কেউ নয়, আমার বন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান নয়নের বউ। ভাবী নয়নকে দেখাচ্ছে যে, জুয়েল ভাইর মত দেখা যাচ্ছে। দুঃখজনক বিষয়, ভাবী দীর্ঘদিন পরেও আমাকে দূর থেকে দেখে চিনলেও বন্ধু চিনতে পারেনি। কাছাকাছি আসলে বন্ধু বলে,
-তোরে তো আমি চিনতেই পারছিলাম না। টুসি দেখালো যে তুই দাড়ানো। তয়, এই গরমে কোট পড়ে এখানে কি করছিস?
আমি বন্ধুকে বললাম,
-প্রচন্ড গরমের মধ্যে যদি কখনো দেখস কোন লোক কোট পড়ে দাড়িয়ে আছে বা হেটে যাচ্ছে, ভাববি ঐ লোকটা হয় পাগল নয় উকিল। আর আমি যেহেতু উকিল তাই কোট পড়েই তো দাড়িয়ে থাকবো।
টুসি আমাদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে চলে গেলে তার কর্মস্থল ব্যাংকে। নয়নকে নিয়ে লাইনে ইট রাখার মত একজনকে বলে রাস্তার পাশের এক দোকানে গেলাম চা খেতে। চা খাওয়া শেষে বন্ধু নয়ন আমায় আরো কিছুক্ষণ সময় দিলো। আমার সিরিয়াল পেতে আরো সময় লাগবে আর ওর অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে দেখে আমিই ওকে বললাম,
-তুই অফিসে চলে যা।
ওর অফিস ভিসা সেন্টারের বিপরীত বিল্ডিং বিসিআইসি ভবনে। উচু তলায় বসে কাজ করে আমার বন্ধু নয়ন!! ওর হাতে আমার ব্যাগটা ধরিয়ে দিলাম। বললাম,
-তুই অফিসে যা, আমি পাসপোর্ট সহ কাগজপত্র জমা দিয়ে তোর অফিসে এক কাপ চা খেয়েই যাব।
ব্যাগ টানা আর দুটি বউ নিয়ে দুটি সংসারের ঘানি টানা একই রকম। নয়ন আমার হাত ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো ওর অফিসে। ব্যাগটা নেয়ায় মনে হলো মাথা থেকে একটা পাহাড়সম বোঝা নামলো। স্থুল শরীরটাই আমার কাছে একটা বোঝা, তার উপর যদি একটা ব্যাগ থাকে কাধে তবে অবস্থাটা কি বোঝেন! দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে ভিসা সেন্টারে ভিসা ফি ও কাগজপত্র সহ পাসপোর্ট জমা দিলাম। পুরা মাখনের মত নরম অমায়িক ব্যবহারের মাধ্যমে আমার কাগজপত্রগুলো গ্রহণ করে হাসিমুখে আমাকে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিলো। আমি নয়নের অফিসে গিয়ে আর চা পেলাম না! পেলাম স্পেশাল এক মগ ধুমায়িত কফি। বন্ধু বন্ধুর অফিসে এসেছে, চা কিরে, কফিই খা বলে বেয়ারাকে আদেশ দিলো,
-যা ভাল করে এক মগ কফি নিয়ে আয়!
অফিসের অন্য সহকর্মীদের কাছে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো এমন ভাবে যে শুনে আমিই একটু লজ্জা লজ্জা পাচ্ছিলাম। প্রশংসায় আমাকে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের ছাদ পেড়িয়ে হিমালয়ের চুড়ায় তুলে দিলো। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো,
-আমার বন্ধু বিশাল উকিল, বিশাল সাংবাদিক, প্রথম আলো, কালের কন্ঠের সাংবাদিক, দৈনিক ঝিরিঝিরি, আকাশ বাতাশ ঐ সব পত্রিকার সাংবাদিক না, আইনজীবী সমিতির নেতা, বার বার নির্বাচিত ইত্যাদি ইত্যাদি....।
চিন্তা করলাম, বেশিক্ষণ সময় হিমালয়ের চুড়ায় থাকা যাবে না, পশ্চাৎ দেশে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে!! তাই কফি শেষ করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আবার আসবো বলে। ভিসা সেন্টারের দেয়া স্লিপের নির্ধারিত তারিখে গিয়ে দেখি আমার জন্য ভারত সরকার এক বছরের ভিসা দিয়ে বসে আছে। যাওয়া মাত্রই পাসপোর্টটা ধরিয়ে দিলো। খুলে দেখি এক বছরের ভিসা, প্রতি ভিজিটে সর্বোচ্চ নব্বই দিন অবস্থান করা যাবে শর্ত জুরে দিয়েছে। চিন্তা করলাম, নব্বই দিন কিরে, নয় দিনই তো থাকা দুষ্কর হয়ে যাবে!! যাহোক ২০ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে হাতে পেয়ে গেলাম জীবনের প্রথম আবেদনে প্রথম বিদেশের ভিসা।

॥ ৩ ॥
প্রথম বিদেশ ভ্রমনে বেরিয়ে পড়াঃ
পাসপোর্ট হলো, ভিসাও পেলাম এবার বিদেশ ভ্রমন!! কিন্তু আজ যাই, কাল যাই করে বেরিয়ে পড়া হচ্ছে না। খালতো ভাই আমির হোসেন নয়ন ভিসা পেয়ে জানালো কোলকাতা যাবে, ওখানে কয়েকদিন থেকে পরে দিল্লি ঘুরে আবার কোলকাতা দিয়ে বাংলাদেশে ফিরবে। আমি বললাম যাব তোর সাথে। এক বৃহস্পতিবার যাব বলেও আর ওর যাওয়া হলো না। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মানুষ, বায়ারের সাথে সিডিউল এলোমেলো হওয়ায় সে এখন ঈদের পর যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আমি যে মনস্থির করে ফেলেছি! খালতোর সিডিউল বিপর্যয়ে আমার মানসিক বিপর্যয় আরো বেড়ে গেলো। যাব বলার সাথে সাথেই আমার মন কোলকাতার দিকে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। মন এখন কোলকাতার অলিতে গলিতে হেটে বেরাচ্ছে, দর্শনীয় স্থান দেখছে, মাটির পেয়ালায় বা মাটির ভারে চা খাচ্ছে, আরো কত কি!! আমাদের বারের আইনজীবী বন্ধু রুহুল আমীন ভাই জানালো কোলকাতা যাবে। দুই দিন থাকবে, জরুরী কাজ আছে। আমি বললাম,
-একা যাবেন তো আমি সাথে যাই, নতুন যেহেতু তাই আপনার সাথে গেলে একটু ভরসা পাব।
রুহুল ভাই বললো,
-ঠিক আছে, আমরা বৃহস্পতিবার বিকালের বাসে মোস্তফাপুর থেকে রওয়ানা দেব। কিন্তু রুহুল ভাইও তার সিডিউল পরিবর্তন করলো অজানা কারনে! দ্বিতীয় দফা পদক্ষেপ নিয়েও যেতে পারলাম না। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। আমার পাশের চেম্বারের বিজ্ঞ বন্ধু এডভোকেট জামাল ভূইয়া ইতিমধ্যে পাসপোর্টে ভারতীয় ভিসা লাগিয়ে এনেছে। খালতো যাওয়া বাতিল করায় আমি তার চেম্বারে চা খেতে খেতে প্রস্তাব দিলাম,
-চলেন দুদিনের ট্যুর দিয়ে আসি, যাব, ঘুরবো, চলে আসবো।
জামাল ভূইয়া অমনি রাজি হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত হলো, বড় কোন সমস্যা না হলে বা আর কেউ না গেলেও আমরা দুজনই যাব। এরই মধ্যে সাথে আরো একজন পেয়ে গেলাম। এডভোকেট মুরাদ মুন্সীরও ভিসা হয়েছে। আমরা যাব শুনে সেও বললো,
-চলেন আমিও যাব আপনাদের সাথে, একসাথে ঘুরে আসি।
জামাল ভূইয়া এর আগে দুবার কোলকাতা ঘুরে এসেছে। আমি আর মুরাদ মুন্সী এই প্রথম যাব তাই একসাথে তিন বন্ধু গেলে ভাল লাগবে। তাহলে আর বিলম্ব নয়। এবার তিনজনই একমত হলাম যে, বৃহস্পতিবার কোলকাতা ঢুকবো, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার রাত কাটিয়ে রবিবার সকালে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেব। যেই ভাবা সেই কাজ। বুধবার কনক পরিবহনের তিনটি টিকিট কেটে রাখলাম। বৃহস্পতিবার সকালে শরীয়তপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে আমাদের নিয়ে বাস ছেড়ে গেল বেনাপোলের উদ্দেশ্যে। শরীয়তপুর থেকে রওয়ানা দেওয়ার সময় ফেসবুকে পোষ্ট দিলামঃ
-কোলকাতা আসছি বন্ধুরা। কোলকাতার বন্ধুরা তৈরী থেকো, দেখা হয়ে চেতে পারে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কোলকাতার বন্ধু সুশান্ত কুমার কংশবণিক এর কমেন্টস,
-কোলকাতায় স্বাগতম! চলে আসো, দেখা হবে নিশ্চই।
আমাদের বহনকারী কনক পরিবহনের গাড়ি ছুটে চলেছে বেনাপোলের দিকে। যশোর রোডে গাড়ি ঢোকার পর রাস্তার দুপাশের বিশালাকায় গাছগুলো দেখে নয়ন জুড়িয়ে গেল। ১৮৪০ সালে জমিদার কালি পোদ্দার বাবু তার মায়ের গঙ্গাস্নানের জন্য যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত সড়কটি নির্মাণ করেন। আর মায়ের নির্দেশ অনুযায়ী পথচারীদের সুবিধার জন্য রাস্তার দুই পাশে রোপণ করেন অসংখ্য গাছ। যশোর-বেনাপোল সড়কের শতবর্ষী গাছগুলো মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। ১৯৭১ সালে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু শরণার্থী হয়েছিলেন এই সড়ক দিয়েই। মিত্রবাহিনীও এসেছিলেন এই পথ ধরেই।
শরীয়তপুর থেকে বেনাপোলের গাড়িতে পথি মধ্যে হালকা ঝিমুনি, বাইরের দৃশ্য দেখা, খুলনায় কবরি কলা ওরফে দুধ সাগর খেয়ে যাত্রা বিরতী করে আবার ছুটে চলা। শরীয়তপুর থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বেনাপোল পৌছতে পৌছতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল প্রায়। বেনাপোল পোর্টে নেমেই বাংলাদেশ অংশে একটি হোটেলে ঢুকে ভাত খেলাম পেট পূরে। ভেতো বাঙ্গালীর পেট ঠিক তো সব ঠিক। খাওয়া দাওয়া সেরে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনের সোনালী ব্যাংক কাউন্টারে ছয়শত টাকা ভ্রমন ট্যাক্স জমা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে ব্যাগ স্ক্যানে দিলাম। ভিতরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা একটা ফরম ধরিয়ে দিলো। ফরমটা ফিলাপ করে লাইনে দাড়ানোর পর ছবি তোলা, কিছু কথাবার্তা বলার পর বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন খুবই সাদামাটা ভাবে সম্মানের সাথে দ্রুত আমাদের ছেড়ে দিলো। নো-ম্যান্স ল্যান্ড পেরিয়ে ভারতীয় অংশে প্রবেশ করেই দেখি দীর্ঘ লাইন। লান্স ব্রেকের জন্য মনে হয় লোক ঢুকানো-আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ ছিল। তাই দীর্ঘ লাইন জমে গেছে। প্রচন্ড রোদের মধ্যে মানুষ বিক্ষিপ্ত ভাবে লাইনে দাড়িয়ে আছে। এক গ্রুপে একাধিক ভ্রমনকারী হলে একজন লাইনে আর বাকীরা ছায়ায় ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। আকা বাকা সাপের মত লাইন পেরিয়ে ভারতীয় ইমিগ্রেশনে প্রবেশ করার পর ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা অযাচিত প্রশ্ন করা শুরু করলো। তাদের কথার উত্তর দিয়ে বললাম,
-ভাই আইনজীবী আমি, আপনাদের দেশে ঘুরতে যাব!
একথা বলার পর ছেড়ে দিলো। আমার পিছনেই ছিল মুরাদ মুন্সী। ওর পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করা ছিল কিন্তু ডলার না নিয়ে ও বাংলাদেশী টাকা নিয়ে প্রবেশ করায় ঐ কর্মকর্তা ধরে বসলো, বললো,
-এনডোর্স করেছেন, ডলার কই?
নাই বলার পর লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বলে বসলো পাঁচশত টাকা দিন। অযথা ঝামেলা এড়ানোর জন্য ফহিন্নির পুতেরে মুরাদ মুন্সী পাঁচশত টাকাই ভিক্ষা দিয়ে দিলো। অমনি সব জায়েজ হয়ে গেল! ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে ভারত ভূমিতে পা রেখে খুজে বের করলাম দেশি মানুষ সমির ঘোষকে। সমির ঘোষ মিস্টির দোকান চালায়, তার বাড়ি আঙ্গারিয়া বাজারের কাছে। সমিরের এক স্বজনকে দীর্ঘ দিন আগে আঙ্গারিয়া বাজার থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় মাথায় বোমা মেরে মাথা গুড়িয়ে দেয়। ভয় পেয়ে বাড়ি, ব্যবসা ছেড়ে ভারত চলে যায়। আমরা দীর্ঘ লাইন ও ইমিগ্রেশনের ঝামেলা পার হয়ে ওপার যাওয়ার পর টের পেলাম বেশ খুধা পেয়ে গেছে। সমির’দা আমাদের চিরা ও দধি দিল বিট লবন ছিটিয়ে। অবশ্য মাগনা নয়, ভারতীয় রুপির বিনিময়ে! খেয়ে বের হলাম আরেক শরীয়তপুরের লোক বর্তমান ভারতের বাসিন্দা বলরাম ঘোষ এর দোকান মিতা র্স্টোরসে। সেখানে গিয়ে বাংলাদেশী টাকাকে ভারতীয় রুপিতে কনভার্ট করলাম। দেশি মানুষ হিসাবে দাম ভালই দিয়েছে! অন্য সব দোকান থেকে দশ পয়শা কমই দিল! ঠকলেও নিজের জেলার সাবেক দাদার কাছে ঠকেছি তাই মুখ বুজেই সহ্য করলাম। মুখে প্লাস্টিকের হাসি লাগিয়ে বিদায় নিলাম। বাংলাদেশের সিম কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তাই একটা সিম নেয়া দরকার পরিবারের সাথে যোগাযোগের জন্য। বলরামদার ছেলেই একটা ভোডা ফোনের সিম এনে দিলো, দাম নিলো আড়াইশো রুপি। সিমটা মোবাইলে ভরে দিলো। টাকা রুপান্তর করে, সিম নিয়ে উঠে পড়লাম গাড়িতে। বনগাঁ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। বেনাপোল থেকে বনগাঁ যাওয়ার পথটা খুব বেশি প্রসস্ত না হলেও রাস্তার দু’পাশের বিশালাকার কড়ই গাছ নয়ন জুড়িয়ে দিলো। রাস্তার কুল ঘেষে সুঠাম দেহী নারীরা বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে যা আমাদের দেশে যা দেখা যায় না। চোখ জুরানো দৃশ্যের তালিকায় প্রকৃতির সাথে পরিবেশটাও আমলে নেয়ার মত। শুধুযে নারীরা তা কিন্তু নয়, পুরুষের সাথে সমান তালে মধ্য বয়সী নারী, স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছাত্রীরাও বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে রাস্তার ধার ঘেষে। এভাবে দেখতে দেখতে বনগাঁ পৌছে জামাল ভূইয়া চলে গেল কাউন্টারে ট্রেনের টিকিটের জন্য। তিন জনের জন্য ৬০ রুপির বিনিময়ে শিয়ালদহ পর্যন্ত টিকিট কিনলো। এবার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। আমরা এখন ভারতের কোলকাতার মাটিতে অবস্থান করছি। ভিন দেশে দাড়িয়ে নিজেকে ইবনে বতুতার মত মনে হচ্ছে!
আমরা যেহেতু ভারতের কোলকাতা ভ্রমন করছি তাই কোলকাতা সম্পর্কে কিছু তথ্য বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতেই হয়। কোলকাতা পৌর সংস্থার ওয়েবসাইটে গিয়ে বেশ তথ্য পেলাম।
আজকের আধুনিক কোলকাতাঃ
আধুনিক কলকাতার ইতিহাস জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৬৯৮ সালে। যখন ব্রিটিশ সাবর্ণ রায় চৌধুরীর কাছ থেকে বার্ষিক ১৩০০ টাকায় তিনটি গ্রাম ইজারা নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে সেই সময়ে।
মুঘল স¤্রাট আকবরের প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজল সংকলিত আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। স¤্রাট জাহাঙ্গীর বরিষার সাবর্ণ রায় চৌধুরি পরিবারকে কলকাতা এবং লাগোয়া বরিষা থেকে হালিশহর পর্যন্ত জমির জমিদারির অধিকার অর্পণ করেন।
গঙ্গার তীর বরাবর বাগবাজার থেকে বড়বাজার, সেখান থেকে বর্তমান এসপ্ল্যানেড এবং তারপর থেকে বর্তমান হেস্টিংস পর্যন্ত তিনটি নগণ্য গ্রাম সুতানুটি, কলকাতা এবং গোবিন্দপুর আজকের কলকাতার ভিত্তিভূমি। তখন রয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, বর্তমান উত্তর কলকাতার হাটখোলাতে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্ট জব চার্ণক সুতানুটিতে পা রাখলেন। ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর স¤্রাট ঔরঙ্গজেবের পৌত্র আজিম-উস-শান সাবর্ণ রায় চৌধুরিকে পরামর্শ দিলেন ১৩০০ টাকায় জমিদারি স্বত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে হস্তান্তর করতে।
১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা কলকাতার ইংরাজ বসত আক্রমণের পর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভ তা পুনর্দখল করলেন। পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করার পর বাংলা প্রদেশে ব্রিটিশ দখল কায়েম হয়। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা পৃথক প্রেসিডেন্সি রূপে গণ্য হয়। একজন সভাপতি (প্রেসিডেন্ট) এর নেতৃত্বে চার সদস্যের এক কাউন্সিলের উপর প্রশাসনের দায়িত্ব অর্পিত হল। যদিও কর সংগ্রহ এবং বিতর্কের মীমাংসার জন্য সরাসরি দায়ী রইলেন একজন জমিদার (কালেক্টর অফ কলকাতা)। কলকাতার ক্রমবিকাশে ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি ৩৮ টি প্রতিবেশী গ্রামকে অন্তর্ভূক্ত করলেন।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্বে জব চার্ণক নামে একজন ইংরেজ তিনটি স্নিগ্ধ গ্রাম গোবিন্দপুর, সুতানুটি আর কলকাতার তীরে পৌঁছোলেন এবং নবাবের সৈন্যদল কর্তৃক লুণ্ঠিত তাঁর কর্মস্থল হুগলিতে আর ফিরে গেলেন না। তিনি চাইলেন এই গ্রামগুলিতেই শুরু হওয়া ব্যবসা-বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করবেন। এইভাবে শুরু হল এক ইতিহাস। প্রথমেই কাঁচা বাড়িগুলি ভেঙে পাকা বাড়ি উঠতে দেখা গেল, ব্রিটিশের ইজারা নেওয়া গ্রামগুলি ধীরে ধীরে গড়ে তুলল এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। দরবারি উত্থান-পতন আর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর থেকে কলকাতা বিকশিত হতে শুরু করল দ্রুত। কিন্তু সেই সময়কার দলিল বলছে, এটা আদপেই কোনো প্রামাণ্য শহর ছিল না। না ছিল রাস্তায় আলো, না ছিল পাকা রাস্তা, না ছিল পরিশ্রুত জল বা পাকা নর্দমা। অকালমৃত্যুর হার ছিল অত্যধিক বেশি। তবু এ শহর অনেককে কাছে টানল।
গোড়ার দিকে কোনো নাগরিক বা পৌর প্রতিষ্ঠান কলকাতায় ছিল না। শুধু বিচার বিভাগীয় কাজকর্মের জন্যে একটা ‘মেয়রস্ কোর্ট’ চালু হয়েছিল ১৭২৬-এ রয়্যাল চার্টারের মাধ্যমে। এই দপ্তরই সমস্ত পৌর কাজকর্ম দেখাশুনো করত, যাতে এই শহরের প্রতি নাগরিকেরা আকৃষ্ট হয়। ১২ আগস্ট ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পেল বাংলার দেওয়ানি সনদ। যাতে বিচার ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব বর্তালো কোম্পানির ওপর। এই দায়িত্ব থেকেই মানবিক দায় বর্তালো নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের। যখন ১৭৭৩ সালে কলকাতা হয়ে উঠল ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের রাজধানী, পৌর প্রতিষ্ঠানের জন্য দাবি হল জোরদার।
ঊনবিংশ শতকের প্রথম পর্বে ব্রিটিশ গর্ভনর জেনারেলরা শহরের উন্নতিকল্পে তহবিল গঠনের জন্য লটারির আয়োজন করেন। এই সমস্ত লটারি থেকে প্রাপ্ত তহবিলে শহরে নতুন রাস্তা নির্মাণ, পুরনো রাস্তার উন্নয়ন, দিঘি খনন প্রভৃতি করা হয় এবং একখানি টাউন হল নির্মাণ করা হয়।
ওই শতকের মধ্যপর্বে এসে একটি পৌর প্রতিষ্ঠান গঠনের চেষ্টা করা হয়। বোঝা গিয়েছিল যে, শহর বিস্তৃত হয়েছে এবং এর পরিচালনার জন্য সঠিক এবং নির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রয়োজন। তাছাড়া ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের এই ‘দ্বিতীয় শহর’টিতে উন্নততর পরিকাঠামো আর ব্যবস্থাপনা জরুরি হয়ে পড়েছিল, যাতে শহর তার নিজস্ব সমস্যা মেটাতে পারে।
এজন্য ১৮৪৭ সালে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে বিচারবিভাগীয় প্রশাসনের বদলে সাতজন বেতনভোগী সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করা হয়। এদের নির্বাচিত করেন কর প্রদানকারী বাসিন্দারা। এই বোর্ডকে শহরের উন্নতি এবং রাস্তা বা নর্দমার সংরক্ষণের জন্য সম্পত্তি ক্রয় এবং অধিকারে রাখার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ১৮৫২ সালে এই বোর্ডের বদলে নতুন চার সদস্যের বোর্ড তৈরি করা হয় যার দু’জন সরকার দ্বারা নিযুক্ত আর দু’জন নির্বাচিত। এই সময়ে বসবাস, আলো, ঘোড়া বা গাড়ি ব্যবহারের জন্য কর ধার্য করা হয়।
১৮৬৩ সালে ফের নতুন বোর্ড তৈরি হয় যারা নিজস্ব উপ-পৌর প্রধান নির্বাচন করেন। এছাড়া নিয়মিত স্বাস্থ্য আধিকারিক, স্থপতি, আমিন, কর-সংগ্রাহক বা নিয়ামক নিয়োগ করা হয়। এই সময়েই পয়ঃপ্রণালি এবং জলসরবরাহ সেবা উৎকর্ষতা লাভ করে। ১৮৬৬ সালে কসাইখানা এবং ১৮৭৪ সালে নিউ মার্কেট প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে বড় রাস্তাগুলির ধারে ধারে ফুটপাথ তৈরি হয়। এই সময়ে বসবাসের জন্য কর দশ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ১৮৭৬ সালে ৭২ জন কমিশনার (পৌর প্রতিনিধি) সমন্বিত নতুন পৌর প্রতিষ্ঠান (কর্পোরেশন) স্থাপিত হয়। এর মধ্যে ৪৮ জন নির্বাচিত এবং ২৪ জন সরকার কর্তৃক নিয়োজিত। এই সময়েই হাওড়া ও শিয়ালদায় দুটি প্রান্তিক রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে সংযোগকারী হ্যারিসন রোডটি নির্মিত হয়। নানান পরিবর্তন - পরিবর্ধন চলতে থাকে। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলার প্রথম স্থানীয় স্ব-শাসন মন্ত্রী করে ১৯২৩ সালে এ সম্পর্কে আইন প্রণয়ন করা এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
এই আইনের সাহায্যে প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক ধারা সংযোজিত করে স্ব-শাসন-ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় এবং সরকারি হস্তক্ষেপ লঘু করা হয়। মানিকতলা, কাশীপুর, চিৎপুর, গার্ডেনরিচ তথা নতুন বন্দর এলাকাকে সংযুক্ত করে বৃহত্তর কলকাতার রূপদান করা হয়। এই আইনের বলে এই প্রথম মহিলাদেরও অন্তর্ভূক্ত করা হয় শাসনপ্রণালিতে। তার প্রতি সম্মান জানাতে কলকাতা পৌরপ্রতিষ্ঠান তার প্রধান দপ্তরের লাগোয়া রাস্তার নামকরণ করে রাষ্ট্রগুরুর নামে।
১৮৯৬ সালে কর্পোরেশনের নিজস্ব মোহরচিহ্ন (এমব্লেম) তৈরি হয়। এতে দেখানো হয় একজোড়া হাড়গিলে পাখি তাদের পা দিয়ে একটি মুকুট বহন করছে। এরপরে নতুন করে মোহরচিহ্ন তৈরি হয় ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ যাতে শহরের নবতম আশা-আকাঙ্খা চিহ্নিত হয়।
কলকাতা পৌর প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৮০ লাগু হয় ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে। এর মাধ্যমে সাউথ সুবার্বান, গার্ডেনরিচ এবং যাদবপুরকে আওতার মধ্যে আনা হয়। এর ওয়ার্ড সংখ্যা ১০০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৪১-এ। বস্তি সংক্রান্ত আইনও পরিমার্জন করা হয়।
বাড়ি, জমি, বকেয়া-আদায় নিয়ে এবং করধার্যকরণ এবং মূল্যায়ন সংক্রান্ত সুবিধার্থে ব্যবস্থাবিধির ব্যাপক রদবদল হয় ১৯৮৪ সালে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, সরকারি ক্যবিনেটের মতন করে মেয়র-ইন-কাউন্সিল গঠন। ভারতে এ ধরনের পৌর প্রশাসক নিয়োগ ছিল অভূতপূর্ব ঘটনা।
এই নতুন আইনের লক্ষ্য ছিল পৌর পরিষেবাকে আরও দক্ষ এবং উপযোগী করে তোলা। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে পৌর প্রশাসনকে তিনটি স্তরে বিন্যস্ত করা হয়ঃ ১) কর্পোরেশন, ২) মেয়র-ইন-কাউন্সিল, এবং ৩) মেয়র। কর্পোরেশনের সদস্য সংখ্যা প্রত্যেকটি ওয়ার্ড থেকে একজন করে নির্বাচিত কাউন্সিলার নিয়ে মোট ১৪১ জন।

॥ ৪ ॥
প্রথম রেলে চড়াঃ
স্টেশনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বনগাঁ টু শিয়ালদহ লোকাল ট্রেন প্লাটফর্মে চলে এলো। জামাল ভূইয়া আগেও দুবার কোলকাতা ভ্রমন করেছে। তাই ভ্রমনে লিড দেয়ার দায়িত্বটা তার ঘারেই পড়লো। আমাদের আগেই সতর্ক করে দিলো যে,
-রেল আসা মাত্র হুরমুরিয়ে লোক নামবে ঠিক হুরমুরিয়েই উঠতে হবে। বেশি সময় ট্রেন স্টেশনে থাকবে না। তাই দেরি করা যাবে না। সবাই যেভাবে উঠে, আমাদেরও সেভাবেই উঠতে হবে।
পাঠক বন্ধুদের জন্য বনগাঁ রেলওয়ে স্টেশন এর কিছু তথ্যঃ বনগাঁ শহরের একমাত্র রেল স্টেশন। এটি একটি জংশন স্টেশন। স্টেশনটি বনগাঁ-রানাঘাট ও শিয়ালদহ-বনগাঁ লাইনের প্রান্তিক স্টেশন। এই স্টেশন থেকে একটি লাইন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশ-এ প্রবেশ করেছে। এই স্টেশন থেকে প্রতিদিন ৪০ জোড়ার বেশি ট্রেন চলাচল করে। শিয়ালদহ রেল স্টেশন থেকে স্টেশনটি ৭৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং রানাঘাট স্টেশন থেকে বনগাঁ স্টেশনের দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে স্টেশনটির দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। এই পথে বহু পণ্যবাহী রেল চলাচল করে বাংলাদেশে। এই স্টেশনের সঙ্গে এক সময় খুলনা ও যশোর শহরের সরাসরি রেল যোগাযোগ ছিল। বর্তমানে স্টেশনটি বনগাঁ শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার রেল পরিসেবা প্রদান করে থাকে। স্টেশনটি যশোর রোড থেকে ১.৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
ইতিহাসঃ এই স্টেশনটি প্রথম ১৮৮২-১৮৮৪ থেকে চালু হয়। প্রথমে এখানে কয়লা চালিত ট্রেন চলাচল করত। ১৮৮১ সালে সেন্টাল বেঙ্গল রেলওয়ে নামে এক রেল কম্পানি দমদম-খুলনা ও খুলনা-রানাঘাট রেল পথ তৈরি শুরু করে। ১৯০৩ সালে এই রেল পথ এর দায়িত্ব পায় ইস্টর্নার বেঙ্গল রেল।
বিদ্যুতায়নঃ এরপর ১৯৬৩-১৯৬৪ শিয়ালদহ-বারাসাত-অশকনগর-বনগাঁ বিভাগে বিদ্যুৎ চালিত ট্রেন চালিত হয়।
পরিকাঠামঃ এই স্টেশনটি রানাঘাট-বনগাঁ ও শিয়ালদহ-বনগাঁ লাইনের শেষ স্টেশন। স্টেশনটিতে ৩ টি রেল ট্রাক ও ৩ টি প্লাটফর্ম রয়েছে। এখানে সংরক্ষিত ও অসংরক্ষিত দুই প্রকার রেল টিকিট সংগ্রহের ব্যবস্থা রয়েছে। এই স্টেশনটি যাত্রী পরিসেবার পাশাপাশি পণ্য-দ্রব্য বহনকরী রেল গুলির পণ্য-দ্রব্য পরিবহনের পরিসেবা দিয়ে থাকে। এই স্টেশন থেকে বনগাঁ-শিয়াালদহ, বনগাঁ-রানাঘাট, বনগাঁ-বারাসাত, বনগাঁ-ক্যানিং, বনগাঁ-মাঝেরহাট প্রভৃতি লোকাল ট্রেন চলাচল করে।
জামাল ভূইয়ার কথা মত কাজ হলো। ট্রেন থামা মাত্রই জামাল ভূইয়ার কথা মতো উঠে পড়লাম। উঠতে বেশি কষ্ট হয়নি। দরজার কাছে দাড়াতেই উঠে গেলাম। আমার পিছনে যে পরিমান যাত্রী তাতে চলতে হয় না, দাড়ালেই পা চলে। বলেছিলো সিট পাওয়া যাবে না কিন্তু ভাগ্যগুনে সিট পেয়ে গেলাম, তাও আবার ফ্যানের নিচে, জানালার ধারে। আমাদের ভাগ্য ভাল বলতে হবে। প্রায় শত কিলোমিটার রেল পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধা নাগাদ পৌছে গেলাম শিয়ালদহ স্টেশনে। জীবনে প্রথম রেল ভ্রমন বেশ উপভোগ্য ছিল আমার জন্য। জানালার পাশে সিট নিয়ে বসে স্টেশন গুনতে গুনতে আর দেখতে দেখতে রেল ভ্রমন। রেল লাইনের পাশে স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর ছোট ছোট রান্নাঘরের মত থাকার ঘর। প্রচন্ড তাপদাহ চলছিল বাংলাদেশে। কোলকাতা প্রবেশ করে দেখি তাপমাত্রা আরো চেতা। ছোট ছোট ঘরগুলো থেকে গরম সহ্য করতে না পেরে মানুষগুলো রেল লাইনের ধারে হাত পাখা নিয়ে সামান্য বস্ত্রে দাড়িয়ে আছে। বয়স্ক মানুষগুলো রেল লাইনের পাশে বসে তাস খেলা নিয়ে ব্যস্ত। মহিলারাও দাড়িয়ে-বসে গল্পে মগ্ন। একটার পর একটা স্টেশনে থামছে রেল। অল্প সময়ের মধ্যে আবার ছেড়েও দিচ্ছে। মাঝে মাঝে শো শো করে আমাদের রেলের ডান পাশ-বাম পাশ দিয়ে রেল ছুটে যাছে। প্রথম প্রথম একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, এই বুঝি লেগে গেল। কিন্তু সারাজীবন শুনেছি, হাজাম বেটা তার মাপ মতই কাটে। প্রকৌশলীরা তাদের মাপ মতই লাইন বসিয়েছে। একটু ব্যাত্যয় ঘটার সুযোগ নেই, হাজার হাজার মানুষের জীবন সমান্তরাল দুটি লাইনের উপর। স্টেশনগুলিতে থামার সাথে সাথে যেমন যাত্রী উঠছে তেমনি উঠছে হকার। এখানকার হকারদের ভাষা একটু অন্য রকম। কেউ কাচা আমার জুস, কেউ আইসক্রীম, কেই খোসা ছাড়ানো বাদাম, কেউ আম, আবার কেউ গ্লুকোন-ডি এর পানি নিয়ে উঠেই এক ভিন্ন সুরে ডাকাডাকি করছে। আবার যাত্রী নামার সাথে সাথে হকারদের কেউ কেউ নেমে যাচ্ছে। রেলে ভিক্ষার ধরনও আলাদা। আমাদের দেশে ভিক্ষা করে শুধু মুখে বলে বলে। আর কোলকাতার ভিক্ষুকদের প্রযুক্তি জ্ঞান বেশ ভাল। তারা একটা সাউন্ড বক্স বুখে ঝুলিয়ে মুখে মাইক্রো ফোন দিয়ে গান গায়। গলায় ঝুলানো সাউন্ডবক্সে জনপ্রিয় গান বাজতে থাকে, ভিক্ষুক শুধু গানের সাথে মুখ মিলায়। গানগুলো আবার যেন তেন গান নয়, কিশোর কুমারের গান অথবা ভক্তিমূলক গান বাজায় আর ভিক্ষা করে। এটাও আমার কাছে নুতন দেখা কিছু। এত কিছু দেখার ফাকে ফাকে ক্লান্ত শরীর ঝিমুনি দিচ্ছে। জানালার পাশে রাখা হাত ঝিমুনিতে পড়ে যাচ্ছে! আবার জেগে উঠে রেল ভ্রমন উপভোগ করছি। কু-ঝিক ঝিক করতে করতে এক অন্য রকম রিদমে চলছিল রেলের যান্ত্রিক সঙ্গীত। অন্য রকম অনুভূতি পেলাম জীবনের প্রথম রেল ভ্রমনে। বনগাঁও থেকে পৌছে গেলাম শিয়ালদহ স্টেশনে।
শিয়ালদহ স্টেশনঃ শিয়ালদহ বা শিয়ালদা কলকাতা শহরের অন্যতম প্রধান রেলস্টেশন। শিয়ালদহ ভারতের ব্যস্ততম রেলস্টেশনগুলির একটি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরতলি রেল টার্মিনাল। কলকাতা মেট্রোর নির্মীয়মান দ্বিতীয় লাইনটি (ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো) শিয়ালদহ স্টেশনের পাশ দিয়ে যাবে। শুধুমাত্র শহরতলির ট্রেন ও যাত্রীসংখ্যা ধরলে এটি ভারতের ব্যাস্ততম।
ইতিহাসঃ শিয়ালদহ ষ্টেশন ১৮৬৯ খ্রীস্টাব্দে চালু হয়। এখান থেকে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গীয় রেল বিভাগ এর আওতায় ছিল। দেশভাগ এর আগে দার্জিলিং মেল শিয়ালদহ হতে রাণাঘাট, গেদে-দর্শনা পথ ধরে বর্তমান বাংলাদেশ এর মধ্যে দিয়ে শিলিগুড়ি যেত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এর সময় পূর্ব বঙ্গীয় রেল এর শিয়ালদহ বিভাগ ভারতের পূর্ব রেল এর আওতা ভূক্ত হয় এবং অবশিষ্ট অংশ তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান এর অন্তর্গত হয়।
শিয়ালদহ স্টেশনে পৌছে যার যার ব্যাগ নিয়ে রেল থেকে বেরিয়ে গেলাম, কোন টানা হেচরা নেই। সাথে করে আনা পানির বোতল শেষ! শিয়ালদহ স্টেশনের মধ্যে হাত মুখ ধোয়ার, সুপেয় পানি খাওয়ার অনন্য ব্যবস্থা। একে একে তিনজনই হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। এমন শীতল পানির সরবরাহ আমি কোথাও দেখিনি। সবাই হাত মুখ ধুয়ে বোতলে করে পানি নিয়ে যাচ্ছে। আমরা শুধু হাত মুখ ধুয়ে সতেজতা উপভোগ করে হাটা দিলাম স্টেশনের বাইরে। স্টেশনের বাইরে এসে ছোট একটি চায়ের দোকানে চা-কেক খেয়ে সামান্য বিশ্রাম সেই সাথে বাইরে থেকে স্টেশনের সৌন্দর্য উপভোগ করা। বাইরে থেকে স্টেশনটি খুবই সুন্দর। আলো ঝলমলে স্টেশন, কারুকাজ সবই মুগ্ধ করার মত। শুধু যে স্টেশনের সৌন্দর্য উপভোগ তা নয়, এখানকার মানুষগুলোর হাটা চলা, ব্যস্ততা, আড্ডাও উপভোগের বিষয়। যা দেখছি তাই ভাল লাগছে। চা চাইতেই আমাদের ওয়ান টাইম কাগুজে কাপে চা দিলো। চা সেবা শেষে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। একটু দরদাম করে উঠে পড়লাম। ছিমছাম গড়নের ড্রাইভার। খুব মিশুক প্রকৃতির। ড্রাইভারের সাথে চুক্তি হলো সে কয়েকটা হোটেল ঘুরিয়ে আমাদের একটা হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যাবে। কথা মত কাজ। কোলকাতা সিটিতে ঢুকে মারকুইজ স্ট্রিটে গেলাম। বাংলাদেশ থেকে যারাই কোলকাতা যায় সবাই মারকুইজ স্ট্রিটে বা এর আশে পাশে নিউমার্কেট এলাকার কাছাকাছি হোটেলে ওঠে। আমরাও গেলাম সেখানে। কিন্তু বাঙ্গালীদের এত ভির যে সেখানে কোন হোটেল খালি পেলাম না। কোলকাতায় আসলাম তাও হাটবার দিন!! ছয়-সাতটি হোটেল ঘুরে সিট না পেয়ে হতাশ হয়ে ড্রাইভার চলে এলো মউলালী এলাকায়। মউলালী এসে এ জে সি বোস রোডের সেন্ট তেরেসা চার্চের বিপরীতে প্লানেট ইন্টারন্যাশনাল গেষ্ট হাউজে একটা ডাবল সিটের এসি রুম পেলাম। আমরা সফর সঙ্গী যেহেতু তিনজন। আমাদের প্রয়োজন তিন বেডের রুম। তাই হোটেল রিসিপশনে দেন দরবার করে ঠিক করা হলো দুটা বেড এক করে দিবে আর একটা বালিশ বাড়িয়ে দিবে। আমাদের প্রস্তাবে হোটেল কর্তৃপক্ষ রাজি হলো। তিনজনের থাকার বন্দোবস্ত হলো। রিসিপশনে আমিই আমাদের নাম এনট্রি করলাম। তিনজনের পাসপোর্ট রেখে দিলো স্ক্যান করার জন্য। সাথে তিনজনের বিজনেস কার্ড দিলাম। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে হোটেলে উঠে শরীর ছেড়ে দিলো। একটু ফ্রেশ হয়ে অনুভব করলাম পেটের কৃমি বেশিক্ষণ আর বাঁচবে না। কিন্তু ওদের এভাবে মরতে দেয়া যায় না। এখনই কিছু একটা খেতে হবে। হোটেল রিসিপশন থেকে পাসপোর্ট তিনটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম খাবারের সন্ধানে। হোটেলের পাশেই একটা মাজার। মাজারের পাশে একটা বিরিয়ানির দোকান দেখে আর অন্য খাবার হোটেল খোজার ধৈর্য রইল না। দোকানের নাম লাজিজ বিরিয়ানি হাউস। বসে পড়লাম বিরিয়ানি খেতে। খাসির মাংসের বিরিয়ানি শসার স্লাইসের মত মোটা পিয়াচের সালাদ, কাচা লংকা দিয়ে খেয়ে পুলিশ বক্সের ধারে ছোট টং দোকানে মাটির পেয়ালায় যাকে এখানে ভার বলে সেই ভারে করে চা খেলাম। প্রতিটি চুমুকেই নতুনত্বের স্বাদ। মাটির ভারে চা পান এটাও জীবনে প্রথম। অনেক শুনেছি, কোলকাতায় মানুষ একটা কাপ দুবার ব্যবহার করে না। চা খেয়ে কাপ ফেলে দেয়, মাটির ভারে চা খায় ইত্যাদি ইত্যাদি। বাস্তবে তাই তাই ঘটছে। মাটির ভারে চা খেয়ে আমরাও নির্দিষ্ট স্থানে টুংটাং শব্দে কাপ ফেলে দিয়ে হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলাম। বৃহস্পতিবার রাতে ঘুমানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই। এমনিতেই ক্লান্ত শরীর, তার উপর কোথায় যাব ধারনা নেই। তাই হোটেলে ঢুকে কিছু ফোন কল করে সবার পরিবারকে জানিয়ে দেয়া হলো আমরা ভাল ভাবে পৌচেছি এবং হোটেলে উঠেছি।

॥ ৫ ॥
প্রথম ভিক্টরিয়া দর্শনঃ
ঘুম থেকে উঠেই শুক্রবারের সকাল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম নাস্তার খোজে। হোটেল থেকে বেড়িয়ে মাজারের বিপরীতে রাস্তা পাড় হয়ে মোড়ের কাছে ফুটপাতে দেখি বিশাল সাইজের পরোটা ভাজছে। খুদার রাজ্যে পৃথিবী আর পৃথিবীর জায়গায় নাই। ফুটপাতে বসেই নাস্তা দিতে বলায় বিক্রেতা জিজ্ঞেস করলো,
-দাদা একছো না দেড়ছো দেব?
আমরা বুঝতে পারিনি বুঝে আবার বললো
-পনের টাকার দিবো?
আমরা বললাম দেন। বিশাল সাইজের পরোটা। আধা কেজি ওজনের এক একটা ময়দার গোলা টেবিলে রেখে বেলছে। বিশাল তাওয়ায় এক মহিলা ভাজছে উল্টেপাল্টে। ভাজা হলেই ধরিয়ে দিচ্ছে পাশের আরেকজনকে। তিনজন লোক ছোট এই হোটেলটিতে কাজ করছে, সবাই এ্যাপ্রোন পড়ে কাজ করছে। ফুটপাতে দোকান হলেও বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলছে। মহিলা রুটি ভেজে দিলে তৃতীয় সেই ছেলে রুটিটাকে কিছুক্ষণ থাপড়াথাপড়ি করে ঢেকে রাখছে একটা সিলভারের পাতিলে। এবার পাতিল থেকে ছিড়ে ছিড়ে একটা নিক্তিতে তুলে ওজন করে করে প্লেটে রাখছে। প্লেটগুলো আলাদা আলাদা চেম্বার বিশিষ্ট। আমাদের একশ গ্রাম ভাজা পরোটা দিলো প্লেটের এক চেম্বারে, প্লেটের অপর চেম্বারে মটরসুটির ঝোল ঝোল ডাল, এক চেম্বারে কিছুটা সালাদ, পিয়াচ কুচি। দেখতে প্রথমে খুব একটা ভাল মনে না হলেও একটু মুখে দিয়ে বুঝলাম মন্দ নয়। একশ গ্রাম পরোটা পুরোটাই খেয়ে ফেললাম দাদা। পাশের দোকান থেকে পানির বোতল কিনে খেয়ে আবার মাটির পেয়ালায় যা স্থানীয় ভাষায় মাটির ভার হিসাবে পরিচিত তাতে চা দিল। নাস্তা চা সেরে এবার একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিলাম ভিক্টরিয়ার উদ্দেশ্যে। ভিক্টরিয়ার গেটে পৌছে চোখ জুড়িয়ে গেল নয়নাভীরাম দৃশ্য দেখে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গাছ গাছালি আর পাখ পাখালির কলরব ঘিরে এক অপূর্ব স্থাপনা। জামাল ভূইয়া টিকিট কিনে আনলো তিনজনের জন্য। আমি আর মুরাদ মুন্সী ব্যাস্ত বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তোলা নিয়ে। ভারতীয়দের জন্য বিশ টাকা হলেও বিদেশীদের জন্য টিকিট মূল্য দুইশ টাকা। আমাদের দেখে যদিও বোঝার উপায় নাই আমরা ভারতীয় নয়। কোলতাতার লোকজনের চেহারা, ভাষা, সাইজের সাথে আমাদের কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু আমরা প্রতারক নই, বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আমাদের পাসপোর্ট লেগেছে, ভিসা লেগেছে, আমরা বিদেশী তাই দুইশ টাকা দিয়েই টিকিট নিলাম। ভিক্টরিয়ার মূল ফকট দিয়ে প্রবেশ করে ভিতরে চলতে থাকলো ফটোসেসন। নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলে গেলাম ভিক্টরিয়া হাউসের দোড় গোড়ায়। ভিতরে প্রবেশ দার এখনও খোলেনি। দশটায় খুলবে ভেবে আমরা চিকন বাতাসে ঢেউ খেলায় রত লেকের পারে গিয়ে বসলাম। পার বাধানো ঘাটে একটা বকুল গাছের নিচে বসে অপেক্ষা কখন দশটা বাজে। বিশাল লেকের পাশে ভিক্টরিয়ার বাগান বাড়িতে অন্য দশটা পার্কের মতই কিছু বদ লোক মাইনর বান্ধবী নিয়ে এসে বেহায়াপনা করছে। অপরুপ দৃশ্য থেকে আমাদের নজর অবশ্য ওদিকে যায় না, আমরা লেকের বাতাশ, মাছের খেলা, গাছের ঝির ঝির শব্দ উপভোগ করছি, দুষ্ট লোকের বেহায়াপনা নয়। দশটা বাজার সাথে সাথে ভিক্টরিয়া হাউসে প্রবেশ করেই প্রথমে ভিক্টরিয়ার কিছু পুরাতন স্মৃতি দেখলাম। সেখানে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে ভিক্টরিয়ার নক্সা, নির্মান পর্যায়ের কিছু ছবি, স্থপতিদের ছবি ও কর্মযজ্ঞ, নির্মান কাজ তদারকি কাজের ছবি। দেখতে দেখতে ঢুকে পড়লাম বাম পাশের বিশাল হল রুমে। সেখানে দেয়ালে রয়েছে বিশালাকায় বিভিন্ন চিত্রকর্ম। দীর্ঘকাল আগের হলেও এখনও যেন জীবন্ত কর্মগুলো। দেশি বিদেশী বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক ছবি। নবাবদের, ব্রিটিশদের, কোলকাতার কালজয়ী বাঙ্গালির জীবনচিত্র সহ নানা বিষয় ফুটিয়ে তুলেছে ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল এর বর্তমান মিউজিয়ামটি। পাঠক বন্ধুদের সুবিধার জন্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলোঃ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জওহরলাল নেহেরু রাস্তার নিকটে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল। ভারতে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের সাফল্যকে চিহ্নিতকরণ এবং রানী ভিক্টোরিয়ার একটি স্মারক-এই দ্বৈত উদ্দেশ্যের পরিবেশন হিসেবে এই স্মৃতি সৌধটি নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল একটি মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে যা ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয়। এই মিউজিয়ামে নকশা, অনুচিত্রকলা, চিত্রাঙ্কন, বই, মূর্তি ইত্যাদি তুলে ধরা হয়, পাশাপাশি তৎকালীন ভারতীয় ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ের অস্ত্রাদির উপরও দৃষ্টি প্রদান করা হয়। রাণী ভিক্টোরিয়া সম্পর্কেঃ ভারতের স¤্রাজ্ঞী, রাণী ভিক্টোরিয়া ৬৩ বছরেরও অধিক সময়ের জন্য রাজকীয়ভাবে গ্রেট ব্রিটেনের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাঁর কাকা চতুর্থ উইলিয়াম এর মৃত্যুর পর ১৮৩৭ সালে যুক্তরাজ্যের রাণী হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯০১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড শাসনভার গ্রহণ করেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল রাণী ভিক্টোরিয়ার সম্মানে ১৯০৬ এবং ১৯২১ সালের মধ্যে নির্মিত হয়। ১৯০১ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন রাণী ভিক্টোরিয়ার সম্মানে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণের প্রস্তাব করেন। এই স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর ১৯০৬ সালের ৪ জানুয়ারি ওয়েলস্-এর রাজকুমার (রাজা পঞ্চম জর্জ) স্থাপন করেন। ১৫ বছর ধরে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধ ১৯২১ সালে জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। এই স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজটি মেসার্স মার্টিন অ্যান্ড কোং, কলকাতাকে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে এই স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছিল, যা ভারতীয় দেশীয় রাজ্যগুলির দ্বারা প্রদেয়। এই স্মৃতিসৌধ ইন্দো-স্যারাসেনিক পুনর্জাগরণ স্থাপত্য শৈলীকে অনুসরণ করে সাদা মাকরানা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরী হয়েছিল। মুঘল, ডেক্কানি, ব্রিটিশ, মিশরীয়, ভেনিশীয় এবং পাশাপাশি ইসলামী পরিকল্পনার সমন্বয়ে এই সাদা স্মৃতিসৌধ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট এর স্থপতি উইলিয়াম এমারসনের তত্ত্বাবধানে তৈরী হয়েছিল। উত্তরের সেতু এবং বাগানের দরজা দুটিই উইলিয়াম এমারসন এর সহকারী ভিনসেন্ট জে এস দ্বারা পরিকল্পিত। কেন্দ্রিয় গম্বুজের শীর্ষে ৪.৯ মিটার লম্বা ও পাঁচ টন ওজনের “এঞ্জেল অফ ভিক্টরি”র একটি মূর্তি রয়েছে। রয়্যাল গ্যালারিঃ গ্যালারিতে জ্যানসেন এবং উইন্টারহলটার এর অসংখ্য চিত্রকর্ম রয়েছে যেগুলিতে রাণী ভিক্টোরিয়ার এবং রাজকুমার আলবার্ট এর জীবনের দৃশ্য চিত্রিত রয়েছে। এই গ্যালারির অর্šÍভূক্ত নিদর্শন ভান্ডারগুলি হলঃ একটি পিয়ানো যা রাণী ভিক্টোরিয়া ১৮২৯ সালে তার ১০ বছর বয়সে উপহার পেয়েছিলেন। এই পিয়ানো একটি চমৎকার পিয়ানো হিসাবে বিখ্যাত। সম্প্রতি পিয়ানোটি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল এর কেন্দ্রীয় গ্যালারিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। উইন্ডসর দুর্গে অবস্থিত একটি লেখার টেবিল রয়েছে যেটি রাণী ভিক্টোরিয়া দ্বারা ব্যবহৃত হত। জয়পুর মিছিল এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তৈল চিত্র। এটি রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড এর ১৮৭৬ সালে রাজ্য পরিদর্শন বিষয়ে রচিত। কিছু চিত্রকলার বর্ণনাঃ ১৮৩৮ সালের জুন মাসে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান, ১৮৪০ সালে সেন্ট জেমস প্যালেসে আলবার্টের সাথে ভিক্টোরিয়ার বিবাহ, ১৮৪২ সালে উইন্ডসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে ওয়েলসের রাজকুমার (সপ্তম এডওয়ার্ড) এর নামকরণ, ১৮৬৩ সালে রাজকুমারী আলেকজান্দ্রার সাথে ওয়েলসের রাজকুমারের বিবাহ, ১৮৮৭ সালে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে প্রথম জয়ন্তী সেবা, ১৮৯৭ সালে সেন্ট পল এর গির্জায় দ্বিতীয় জয়ন্তী সেবা এর মনোরম চিত্রকর্ম। কলকাতা গ্যালারিঃ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল এর ক্যালকাটা গ্যালারি ভারতের সর্বপ্রথম শহুরে গ্যালারি। বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের এই স্মৃতিসৌধের প্রতি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে এই গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন ভারতের তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী অধ্যাপক এস নুরুল হাসান। এই গ্যালারির চিত্রাঙ্কনগুলি হলঃ আর. বি. দত্তর দ্বারা বিপিন বিহারী দত্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রামমোহন রায়, কলকাতা ও হাওড়ার মধ্যে পন্টুন সেতু (হাওড়া ব্রিজ হিসেবে সুপরিচিত), ভবানীচরণ লাহা দ্বারা কার্ড খেলেয়ার, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মিসেস বেলনোস দ্বারা ফেরিওয়ালা, বেনি মাধব ভট্টাচার্য দ্বারা দেবী কালী। এই স্মৃতিসৌধের অন্যান্য কিছু গ্যালারী যেমনঃ জাতীয় নেতাদের গ্যালারি, পোর্ট্রেট গ্যালারি, সেন্ট্রাল হল, ভাস্কর্য গ্যালারি, অস্ত্র ও অস্ত্রাগার গ্যালারি। বাগানঃ ৬৪ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই স্মৃতিসৌধের পার্শ্ববর্তী বাগান ডেভিড প্রেন এবং রেডেসডেল দ্বারা পরিকল্পিত। ২১ জন সদস্যবিশিষ্ট মালিরা এই বাগানটির দেখাশোনা করেন। বাগানের বিশালাকার গাছগুলোর কোটরে কাঠবিড়ালির আনাগোনা দেখার মত দৃশ্য। এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে চঞ্চল কাঠবিড়ালিগুলো। এছাড়া ভিক্টোরিয়ার উত্তর দ্বারের দিকে রাণী ভিক্টোরিয়ার একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি আছে যা স্যার জর্জ ফ্র্যামটনের সৃষ্টি এবং এটি সিংহাসনে উপবিষ্ট রাণীকে নিয়ে বর্ণিত। ভবনের দক্ষিণ অংশে এডওয়ার্ড লনে স্মৃতিসৌধ খিলানের নীচে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড এর একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি দর্শকরা দেখতে পাবেন। এটি স্যার বারট্রাম ম্যাকেনাল দ্বারা পরিকল্পিত। ফ্রেডরিক উইলিয়াম পোমেরয় দ্বারা নির্মিত কার্জন স্থাপত্যের ধাঁচে কার্জন লন নামে অন্য আরেকটি আঙ্গন রয়েছে। এই বাগানে আরও বহু মূর্তি রয়েছে, সেগুলি হলঃ কর্নওয়ালিস, হেস্টিংস, ক্লাইভ, ডালহৌসি, বেন্টিঙ্ক, ওয়েলেসলি, রিপন, অ্যান্ড্রু.এইচ.এল ফ্রেজার ও রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জী।
ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল দেখা শেষে পিছন গেইট দিয়ে বেরিয়ে মিউজিয়াম পরিচালনা অফিসের কাছে গেলাম। সেখানে সতেজতার বেশ বন্দোবস্ত করে রেখেছে। পরিস্কার পরিচ্ছন ঠান্ডা পানিতে হাম মুখ ধুয়ে পাশেই পানি শীতলীকরণ যন্ত্রের মাধ্যমে শীতল পানি সরবরাহ হচ্ছে। আমরাও বোতল ভরে ঠান্ডা পানি পান করলাম। পানি পান শেষে পিছন গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাব। বেরিয়ে যাওয়ার আগে খালাতো ভাই আমির হোসেন নয়নকে ইমোতে ভিডিও কল দিয়ে ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল দেখালাম বিনা পয়সায়। যাব বলে না আসায় ভিক্টরিয়া দেখিয়ে প্রতিশোধ নিলাম। লেকের পার ঘেষে বিশালাকার দেবদারু গাছ, তার নিচে সেই পুরানো আমলের লোহার ফ্রেমে কাঠের তৈরী আমার করার জন্য বেঞ্চ পাতা। আমরা বসলাম কিছুক্ষণ। পুরাতন দেবদারু গাছ থেকে কাঠ বিড়ালি নেমে ছোটাছুটি করছে। আমরা ছবি তুলতে অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু এত দুষ্টু যে ফ্রেম বন্ধি করতে পারলাম না, দুচোখ দিয়ে হৃদয়ে বন্ধি করে রাখলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে গেলাম মূল রাস্তায়। রাস্তার পাশেই দুহাতের তালুতে উড়ন্ত ধবল কবুতর। যার নাম দিয়েছে পিস পার্ক। পিস পার্কের পাদদেশে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ ফটোসেসন করে ফুটপাতে বসে খুধার্থ অবস্থায় চা, বিস্কিট, কেক, পানি খেয়ে সামান্য বিশ্রাম।
এর পরে চলে গেলাম নিউ মার্কেটে। এই ফাকে মুরাদ মুন্সী ভিক্টরিয়ার সামনে দাড়িয়ে তোলা একটি ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীয়তপুরের এক সাংবাদিক মন্তব্য লিখে জানতে চাইলো, মুন্সী এই মসজিদটা কোথায়? ভিক্টরিয়াকেও মানুষ মসজিদ ভাবে, কোন দুনিয়ায় আছি আমরা!! তথ্যের ভান্ডার হলো সাংবাদিগণ, তারাই যদি ভিক্টরিয়া মেমোরিয়ালকে মসজদি ভাবে তবে উচু স্থান দেখলে অনেকেই কবর ভেবে জিয়ারত শুরু করে দিবে!!
নিউ মার্কেটের সামনে নেমে ভিতর দিকে প্রবেশ করলাম। মজার ব্যাপার নিউ মার্কেট যে কোনটা ঠিক করতে পারলাম না। সব মার্কেটই নিউ আর সব মার্কেটই পুরাতন। অনেক ঘুরাঘুরির পর আমি কিনলাম একটা বেল্ট। মুরাদ মুন্সী আর জামাল ভূইয়া কিনবে বাঘের খাচা! অনেক দোকান ঘুরাঘুরির পর বেশ প্রকট রংয়ের বাঘের খাচা দেখাচ্ছে দোকানদার। অবশেষে কালো রংয়ের বাঘের খাচা (আন্ডার ওয়ার) কিনলো দুজনেই। মুরাদ মুন্সী শর্ট প্যান্ট, কালো গেঞ্জি নিলো। প্রচন্ড রোদ। তাপমাত্র এতটা বেড়েছে মনে হচ্ছে সূর্য মামা মাথার হাতখানে উপরে এসে পড়েছে। হাটতে হাটতে ক্লান্ত, আবার প্রচন্ড খুধার্থও। বাঙ্গালী মানুষ, বাংলা খাবার ছাড়া মুখে কিছু রোচে না। খাবার হোটেল খুজতে খুজতে আরেক দফা ক্লান্তি! অবশেষে গলির ভিতরে একটা হোটেল পেলাম বেশ সাদামাটা। ভিতরে গিয়ে দেখি এটা পাঞ্চাবী শীখদের। দোকানের নাম কি যেন শেষে লেখা ধাবা কথাটা মনে আছে। ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞাস করলাম
-খাবার কি আছে?
আমাদের বললো,
-ভাত, মাছ, ডাল, সবজি, থালি।
আমরা একটা থালি অর্ডার দিলাম দেখার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে নিয়ে এলো এক বিশাল ট্রের মত সাজানো থালি। থালিতে এক চেম্বারে আছে ভাত, আরেক চেম্বারে দুটি রুটি, এক চেম্বারে আলুর দম, সবজি, ডাল, রুটি কড়কড়া ভাজা দিলে যেমন তেমনি একটা দোসা জাতীয় কিছু, এক চেম্বারে দুধের তৈরী দেখতে মিষ্টান্ন বা পায়েসের মত হলেও জামাল ভূইয়া খেয়ে বললো টক টক লাগে। থালি থেকে সবাই একটু একটু করে খেয়ে বললাম ভাত, ডাল, মাছ, সবজি আনেন। আমরা বুঝতে পারলাম না, দুপুরের খাবারে থালিতে একই সাথে ভাত ও রুটি কি কারনে দিলো? রুটি হলে শুধু রুটিই খাব, ভাত দিলে শুধু ভাতই, কিন্তু ভাত আর রুটি কি একসাথে খাওয়ার জিনিস? আমরা বুঝে গেলাম, এটা আমাদের খাবার না, আমাদের খাবার হলো ডাল-ভাত। অর্ডার করতেই মাথা আবৃত পাগরিতে এমন এক ব্যক্তি আমাদের মাছ ভাত এনে দিলো। মাছ কাটার কথা আর কি বলবো। আরেকটু পাতলা করে কাটতে পারলে আশি গ্রামের অফসেট পেপার বলে চালিয়ে দেয়া যেত। খুধার্থ অবস্থায় যা পেলাম তাতেই তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম। হাত মোছার অবস্থা দেখে মনে হলো একদম কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছি আরকি!! ধাবা থেকে বেরিয়ে রাস্তার কোল ঘেষে হাটছি ট্যাক্সি ক্যাবের আশায়। প্রধান সড়ক পর্যন্ত হেটে যাওয়ার পর ক্যাব পেলাম অনায়াসে। সরাসরি হোটেলে চলে এলাম ক্যাবে চরে। কোলকাতা প্রবেশের পর থেকেই বন্ধু সুশান্ত কুমার কংসবণিক বার বার ফোন করে আমাদের অবস্থান জানছে এবং টুকি টাকি বিষয়গুলো সতর্ক করে দিচ্ছে। কোথা থেকে কোথায় যেতে হবে, সেখানে কোন কোন বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, টাকা পয়সা লেনদেনে কি কি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শুক্রবার সকালে সুশান্ত আমাকে ফোন করে জানালো সে দুপুরের দিকে আসছে দেখা করতে। আমরা নিউ মার্কেট এলাকায় থাকাবস্থায় একাধিক বার ফোন করে জানলো কি করছি এবং জানালো সে রওয়ানা দিয়েছে, দুপুরে হোটেলে এসে দেখা করবে। আমরা নিউ মার্কেট থেকে হোটেলে এসে দেখি রিসিপশনে বসে আছে বন্ধু সুশান্ত। দেখেই দাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো, কত দিন পরে দেখা বন্ধু.....। এর পর আমরা সুশান্তকে নিয়ে চলে গেলাম আমাদের রুমে। খাটের উপর গা এলিয়ে দিয়ে চললো কুশলাদী বিনিময়। পরিবারের সবাই কেমন আছে, ওর ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলছে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের জানালো। আমরা এসেছি শুনে দত্তপুকুর থেকে কোলকাতা এসেছে দেখা করতে। কোলকাতার ব্যস্ত জীবনে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দেখা করতে আসাটা একটু বিরল ঘটনাই। আর আসবেই না কেন। ওতো বাংলাদেশের ছেলে। বাংলাদেশের মাটি পানিতে বেড়ে উঠা সুশান্ত মনে প্রাণে বাঙ্গালী। আতিথেয়তা, আপ্যায়নে বাঙ্গালীর তুলনা মিলা ভার। হোটেলে কিছুটা সময় দিয়ে সুশান্ত চলে গেল। ওর কিছু কাজও আছে, সেগুলো সেরে বাড়ি ফিরবে। আমরা আর ওকে আটকালাম না। বিদায় দিয়ে হোটেলে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ার পরিকল্পনা চলতে থাকলো।

॥ ৬ ॥
হাওড়া ব্রিজ ভ্রমনঃ
বিকালের ভ্রমন পরিকল্পনার প্রথমেই চিন্তা এলো হাওড়া ব্রিজ দেখতে যাব। হাওড়া ব্রিজ দুইটা। হুগলী নদীর উপর দুটি একই মডেলের ব্রিজ হয়েছে। ক্যাব ড্রাইভারকে বলে নিলাম যে, আমাদের হাওড়া ব্রিজ ঘুরিয়ে ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামে নামিয়ে দিবেন। ড্রাইভার চলতে শুরু করলো। ফ্লাইওভার দিয়ে যেতে যেতে প্রথমেই হুগলী নদীর উপর নতুন তৈরী হাওড়া ব্রিজ। এই ব্রিজটি নতুন। এর নামকরন করা হয়েছে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এর নামে। ট্রাফিক সিগনালে দাড়ালে মাঝে মাঝেই ড্রাইভার হাতের তালুতে কি যেন নিয়ে তার সাথে একটু চুন মিসিয়ে গাজা তৈরীর মত করে ঘষে ঘষে মুখে নেয়। প্রতিটি ড্রাইভারকেই দেখলাম এমনটি করে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাস করতেই বললো,
-এটাকে খইনি বলে, দাদা আপনাদের দেশে এটা ব্যবহার করে না?
আমরা বললাম না। আমাদের দেশে কেউ কেউ গুল ব্যবহার করে, এটা ব্যবহার করে না। ড্রাইভার বললো, আমাদের দেশে এটা বেশ চলে দাদা। নতুন হাওড়া ব্রিজ অর্থাৎ বিদ্যাসাগর ব্রিজ ঘুরে হুগলী নদীর তীর ঘেষে একটা ছোট টং দোকানের কাছে ট্যাক্সি থামালো। ব্রিজে উঠতেই ড্রাইভার আমাদের সতর্ক করে দিলো,
-দাদা ছবি তুলবেন না কিন্তু। পুলিশ দেখলে অহেতুক ঝামেলায় পড়বেন। আর সিসি টিভি ক্যামেরাও আছে। তাই দেখুন, ছবি তোলার দরকার নাই।
বিদ্যাসাগর সেতু পার হয়ে আমরা হুগলী নদীর তীর ঘেষে চলছি। নদীর তীরে বড় বড় মিল কারখানা। নদীর তীর এতটা সুন্দর করে শাসন করেছে যে ভাঙ্গার উপায় নাই। পুরো তীরটা যেন সান বাধানো ঘাটের মত। পায়ে হাটা পথ, বসার সুবন্দোবস্ত, তীরে বিশালাকায় বটগাছ নিঃস্বর্থ ভাবে ছাড়া ও অক্সিজেন দিয়ে যাচ্ছে। তীর ঘেষে যেতে যেতে হঠাৎ ড্রাইভার গাড়ি থামেয়ে আমাদের গাড়িতে বসতে বলে বেরিয়ে গেল। আমরা এক জায়গায় বেশি সময় বসে থাকার লোক না, তাই নেমে পড়লাম। নেমে দেখি ড্রাইভার ছোট একটা দোকান থেকে কিছু কিনছে। আমরাও এগিয়ে গেলাম। অনেক ক্ষণ যাবৎ চা খাওয়া হয় না, তাই ভাবলাম চা খেয়ে নেই। দোকানে গিয়ে দেখি ড্রাইভার কিছু ভাজা-পোড়া কিনছে। আমরা দোকানিকে বললাম আমাদেরও কিছু দেন। দোকানী আমাদের একটা পাতার তৈরী বাটিতে করে কিছু পাকুড়া দিল। ছোট ছোট করে তৈরী পাকুড়া বেশ সুস্বাদু। তার চেয়ে অবাক করা বিষয় পাতার তৈরী বাটিটা দেখে প্রথমে আচ করতে পারিনি যে এটা পাতা দিয়ে তৈরী। পাতা দিয়ে এত সুন্দর করে বাটি তৈরী করা যায় এই প্রথম দেখলাম। দুতিনটা পাতা সলাকা দিয়ে শেলাই করে তার পরে সাচে ফেলে প্রচন্ড প্রেসার দিয়ে বাটিটা তৈরী করা হয়েছে। দেখতে খুবই সুন্দর। পাকুড়া খাওয়ার পর শুরু হলো পাতার বাটির ময়না তদন্ত। বাটিটা পড়তে পড়তে খুলে দেখলাম কিভাবে তৈরী করেছে। পাকুড়া খেয়ে চা নিলাম। সেই মাটির ভাড়ে চা। মুরাদ মুন্সীর জন্য একটু স্পেশাল! চিনি ছাড়া চা। এখানে চা তৈরী করার সময়ই চিনি দেয়। চা পাতা, চিনি, দুধ, এলাচি ভেঙ্গে একসাথে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ফুটায়। হাতল ওয়ালা সিলভারের পাত্রে চা উননে রেখে বার বার নাড়তে থাকে। মজার ব্যাপার হলো সব দোকানের চাই আমার কাছে এক রকম মনে হলো। অনেকটা পায়েসের নিগরানো ঝোলের মত স্বাদ!! একটা লক্ষ্যনিয় বিষয় হলো ছোট দোকানগুলো কয়লার আগুনে সব করে। কয়লার আগুন বেশ টাটকা। দেখে মনে হয় আগুনের এক একটা খন্ড। চা খেয়ে এর পর উঠে গেলাম ক্যাবে। ড্রাইভার আমাদের পুরাতন হাওড়া ব্রিজ অর্থাৎ রবীন্দ্র সেতু ঘুরিয়ে ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামের পাশে নেতাজি সুবাস চন্দ্র বসুর নামে তৈরী নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। প্রথম হাওড়া ব্রিজ অর্থাৎ বিদ্যাসাগর ব্রিজের চাইতে শতগুন সুন্দর মূল হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্র সেতুটি। ১৯৪৩ সালে কাজ সম্পন্ন হওয়া ব্রিজটা এখনও নতুনের মত লাগছে। পাঠক বন্ধুদের জন্য হাওড়া ব্রিজ সম্পর্কে কিছু তথ্যঃ হাওড়া ব্রিজ পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্র সেতু নামেও সুপরিচিত। কোলকাতায় হাওড়া ব্রিজ হুগলী নদীর উপর প্রসারিত এবং ব্রিটিশদের একটি বিস্ময়কর প্রযুক্তি কর্ম বলে মনে করা হয়। বিশ্বের ব্যস্ততম প্রসারিত খিলান সেতুর মধ্যে হাওড়া ব্রিজ অন্যতম। হাওড়া ব্রিজ প্রত্যহ প্রায় ৬০,০০০ যানবাহন ও অসংখ্য পথচারীর চলাচলের ভার বহন করে। হাওড়া ব্রিজ কোলকাতা মহানগরী ও হাওড়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে অর্থাৎ কোলকাতার অন্যতম হাওড়া রেল স্টেশন থেকে মহত্মা গান্ধী রোড বা এমজি রোড এর সাথে সংযোগ স্থাপন করে অত্র অঞ্চলের মানুষের লাইফ লাইন হিসাবে সমাদৃত। তাই হাওড়া ব্রিজ এই মহানগরীর জীবনরেখা স্বরূপ। হাওড়া ব্রিজ কোলকাতার হুগলী নদীর উপর অবস্থিত তিনটি ব্রিজের মধ্যে একটি। বস্তুত এটি ঔপনিবেশিক শহরের সবচেয়ে ভাবপ্রণ বৈশিষ্ট্য এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হিসেবে খ্যাত। হাওড়া সেতু নির্মাণ করতে দীর্ঘ ৭ বছর সময় লেগেছে। হাওড়ার এই প্রসারিত খিলান সেতুর কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৪৩ সালে। কোলকাতায় হাওড়া ব্রিজ এই একই বছরের মধ্যে যানবাহন চলাচল এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়। এই সেতুর নির্মাণে খরচ হয়েছিল প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা। হাওড়া ব্রিজ এর পুরো কাঠামোটি রিভেট দ্বারা নির্মিত যেখানে আপনি কোথাও নাট ও বোল্ট এর ব্যবহার দেখতে পাবেন না। বর্তমানে হাওড়া ব্রিজ কোলকাতার প্রবেশদ্বার স্বরূপ, যেটি এই শহরকে হাওড়া স্টেশনের সাথে সংযুক্ত করে, যা হল কোলকাতার মূল রেলওয়ে স্টেশন ও ভারতের সবথেকে ব্যস্ততম স্টেশন। হাওড়া ব্রিজ ৭০৫ মিটার দীর্ঘ এবং ৯৭ ফুট চওড়া। হাওড়া ব্রিজের পরিকাঠামো ২৬,৫০০ টন প্রসারন সাধ্য ইস্পাত দ্বারা নির্মিত, যা দুটি স্তম্ভ দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত। প্রতিটি স্তম্ভ রাস্তার ঊর্ধ্বভাগে ৯০ মিটার জুড়ে অবস্থিত।

॥ ৭ ॥
নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামঃ
আমরা হুগলী নদী হাওড়া ব্রিজ দিয়ে পার হয়ে ক্যাব থেকে নেমে নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ দ্বার থেকে একটু অদুরে নেতাজীর দাড়ানো বিশাল ভাস্কর্য। এমন একটি ভাস্কর্য সামনে পেয়ে ছবি না তুলে পারা যায়? আমরা নেতাজীর ভাস্কর্যের সামনে দাড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। ছবি তোলা শেষে এদিক ওদিকটা একটু ঘুরে দেখতে দেখতে স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে গানের আওয়াজ কানে ভেষে আসলো। নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামটি বার হাজার আসন বিশিষ্ট সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। গেটের নিরাপত্তা কর্মীকে জিজ্ঞেস করতেই বললো,
-হ্যা গান হচ্ছে। জি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য সা-রে-গা-মা-পা অনুষ্ঠানের সুটিং। গ্র্যান্ড ফিনালের চিত্রায়ন চলছে।
-প্রবেশাধিকার কি টিকিটের বিনিময়ে? জানতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা বললো,
-না, টিকিট সিস্টেম নয়, আমন্ত্রীতরাই কেবল ঢুকতে পারে।
আমরা দেখতে যেত চাইলে সাফ জানিয়ে দিলো,
-ভিতরে যাওয়া যাবে না।
আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললাম,
-আমরা সবাই আইনজীবী, এডভোকেট, বাংলাদেশ থেকে এসেছি আপনাদের দেশে ঘুরতে।
বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং আইনজীবী কথাটা শুনে নিরাপত্তা কর্মীদের একজনের মন গলে গেল। সে বললো
-এত দূর থেকে এসেছে যখন, যান ভিতরে যান।
অপর নিরাপত্তা কর্মী বললো,
-না না যেতে দেয়া যাবে না, কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে।
তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশী হিসাবে আমাদের সম্মান করলো এবং ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিলো। আমরা তিনজন ভিতরে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ অনুষ্ঠানের রেকর্ডীং পর্ব দেখলাম। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র ইনডোর স্টেডিয়ামটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। বাইরে প্রচন্ড গরমে শরীর সিদ্ধ প্রায়! ভিতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে মনে হলো সাইবেরিয়ায় ঢুকে গেছি। তিনজনে দ্বিতীয় সারিতে গিয়ে চেয়ারে বসলাম। গান চলছে। আমরা ভিতরে বসে গানের অনুষ্ঠানের ছবি তুললাম। জামাল ভূইয়া গানটা ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দিলো বিশাল স্টাটাস দিয়ে। একটা গান শেষ হওয়ার পর পরিচালকের গলা, আমরা আবার যাব, আবার যাব, রেডি হও, এক দুই এক দুই তিন... শুরু হয়ে গেল গান। মন মাঝি রে.... আয় ফিরে আয়.... গানটি গাইলো। দরদ দিয়ে গাওয়া গানটি শুনে অন্যরকম শীতলতা অনুভব করলাম। সারেগামাপা অনুষ্ঠানটি টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করার সময় অল্প বিস্তর দেখেছি। রেকর্ডীং করা অনুষ্ঠানটা ভালই লাগতো। আজ লাইভ দেখলাম। সত্যিই ওদের গানের গলা বেশ। দর্শকদের আগ্রহ আছে অনুষ্ঠানটিতে আর শিল্পীরা গায়ও চমৎকার, তাইতো ওরা এমন একটি প্রতিযোগীতায় গ্রান্ড ফিনালে পর্যন্ত আসতে পেরেছে। গানটি শেষ হওয়ার পর পরিচালক প্রতিযোগীদের একে একে ডাকলো মঞ্চে। প্রতিযোগীরা কিভাবে আসবে, এসে কি বলবে, কিভাবে সম্ভাষন জানাবে ইত্যাদি দেখিয়ে দিচ্ছে। স্টেডিয়ামের গ্যালারীতেও প্রচুর দর্শনার্থীদের ভির। ছোট ছোট অনেক ছেলে মেয়ে একই রকম সাজে। মনে হলো, আগে গ্রুপ নৃত্য হয়েছে বা হবে। আমরা কিছুক্ষণ ওখানে থেকে বেরিয়ে গেলাম। একজায়গা থেকে বেরোবার আগেই পরিকল্পনা চলতে থাকে, এখান থেকে কোথায় যাওয়া যায়! এবারও আমরা পরিকল্পনা করলাম, এবার গন্তব্য কফি হাউসে।

॥ ৮ ॥
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজও আছেঃ
স্টেডিয়ামের বাইরে এসে ক্যাবের জন্য অপেক্ষা। কয়েকটা ক্যাব পেলাম যারা কফি হাউস চেনে না। আর আমরাও চিনি না কোথায় বা কোন স্ট্রিটে কফি হাউস। রাস্তায় দাড়িয়ে ক্যাব ডাকার সময় দেখি স্মার্ট এক লোক দাড়িয়ে আছে ক্যাবের অপেক্ষায়। তার নাম অভিরুপ দেওয়ান। অভিরুপ দেওয়ান ক্যামলিয়া স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজির ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক। তিনি আমাদের একটি ক্যাব ধরিয়ে দিতে সহযোগীতা করলো। ওখানে ড্রাইভাররা কলস্ট্রিট বললে বেশ ভাল চেনে। কলস্ট্রিট প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সামনে বলে এক ড্রাইভারকে ধরিয়ে দিলো। এবার ড্রাইভার আমাদের নিয়ে ছুটে চললো কলস্ট্রিট ওরফে কলেজ স্ট্রিট এর দিকে। আকা বাকা রাস্তা ধরে পৌছে গেলাম সেই ঐতিহাসিক কফি হাউসের রাস্তায়। ক্যাব থেকে নেমেই চোখ কপালে উঠে গেল। এত বড় বইয়ের বাজার আমি আগে দেখিনি। রাস্তার দুধার ঘেষে সবই বইয়ের দোকান। বইয়ের জন্য এক সমৃদ্ধ জায়গা বলেই মনে হলো। নতুন বই, পুরাতন বইয়ের গন্ধে এক অপূর্ব মাদকতা। আধুনিক সুন্দরী এক রমনীকে জিজ্ঞেস করতেই আঙ্গুল উচিয়ে দেখিয়ে দিলো কফি হাউস।
কফি হাউস, ইন্ডিয়ান কফি হাউস বা এ্যালবার্ট হল সম্পর্কে কিছু তথ্য না দিলেই নয়। উত্তর কলকাতার বইপাড়া, কলেজ স্ট্রিট চত্বরে এটি অবস্থিত ও বাঙালির-আড্ডাস্থল, কলকাতার কফি হাউস গুলির মধ্যে সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউ এবং কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস-দুটিই প্রাচীনতম। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায় রাধাপ্রসাদ গুপ্তের দেওয়া স্মৃতিনির্ভর তথ্য অনুযায় ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের উদ্যোগে বাঙালি কফি সেবীদের জন্য সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউর কফি হাউস খোলা হয় ১৯৪১-১৯৪২ সাল নাগাদ আর তার কিছুদিন পরেই খোলা হয় কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসটি। পরে, ১৯৫৭ সাল নাগাদ অ্যালবার্ট হল কফি হাউস ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের আওতা থেকে বেরিয়ে এসে শ্রমিক সমব্যয়ের আওতায় আসে। এই দুই কফি হাউসই ছিল এক কালের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রধান আড্ডাস্থল। নিকটতম বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলির ছাত্রছাত্রীদের ভিড় করা ছাড়াও নামিদামী বুদ্ধিজীবী লেখক, সাহিত্যিক, গায়ক, রাজনীতিবিদ, পেশাদার, ব্যবসায়ী ও বিদেশি পর্যটকদের আড্ডা দেওয়ার অবারিত জায়গা হিসাবে এটি খ্যাত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুরানো বইয়ের বাজার ও নতুন বইয়ের বাজার সামনে আছে বলে হাউসটিতে সব সময়ই ভিড় থাকে। চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, বাঙালি অভিনেতা রূদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর মত প্রমুখ ব্যক্তিরাও কোননা কোন সময়ে এই কফি হাউসটিতে আড্ডা দিয়ে গেছেন। সংক্ষেপে এই কফি হাউসটি কলেজ স্ট্রিটের মর্মস্থলে অবস্থিত যেখানে প্রখ্যাত সব বুদ্ধিজীবিরা ঘন্টার পর ঘন্টা এক কাপ কফি নিয়ে আড্ডা জমান। পূর্বে অ্যালবার্ট হল নামে পরিচিত এই হলঘর বহু ঐতিহাসিক সভা বা জমায়েতের সাক্ষী।
আর্ন্তজাল ঘেটে পাওয়া যায় কফি হাউসের সেই আড্ডাটা... গানের সৃষ্টি ইতিহাস। ইতিহাস সমতুল্য গানের সৃষ্টির ইতিহাস জানলে পাঠক বন্ধুদেরও ভাল লাগবে।
প্রয়াত কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে’র কথা উঠলেই সবার মাথায় যে গানের সুর গুনগুন করে ওঠে সেটি নিঃসন্দেহে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আর আর নেই। কফি হাউস গানটি নিয়ে মান্না দে সব সময় নিজের চেয়েও বেশি কৃতিত্ব দেন গীতিকার সুরকারকে। বিনয়ী মান্ন দে’র মতে... তিনি শুধু গানটা গেয়েছিলেন মাত্র। হেমন্ত গাইলে গানটা সুপারহিট হতো আর শ্যামল মিত্র গাইলে তো হিট। তবে মান্নার কণ্ঠে যে গানটি চিরকালীন পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন গানটির সুরকার সুপর্ণকান্তি।
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা গানটির গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথায় সুর দিয়েছিলেন নচিকেতা ঘোষের পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ। মান্না দের মতে, গৌরীবাবু লিখেছিলেন দুর্দান্ত। সুরকার সুপর্ণকান্তি অসাধারণ কাজ করেছিলেন। এই গানটির সৃষ্টিও হয়েছিলো বেশ নাটকীয় ভাবে।
১৯৮৩ সালের কথা, গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার তখন আশা ভোঁসলেকে নিয়ে প্রচুর হিট প্রেমের গান লিখে চলেছেন। কিন্তু পূজার গান মান্না দের জন্য তিনি লিখতে পারছেন না। সবই লিখছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল গৌরী প্রসন্নের মনে। এ সময় একদিন নচিকেতা ঘোষের নিউ আলিপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন গৌরী প্রসন্ন। উদ্দেশ্য ছিল শক্তি ঠাকুরকে দিয়ে একটি গান তোলা। সেই সময় সেরা জুটি ছিলেন নচিকেতা ও গৌরী প্রসন্ন। সেই সূত্রে নচিকেতা ঘোষের ছেলে সুপর্ণকান্তির সঙ্গেও বেশ ভাল সম্পর্ক। তবে বাড়িতে আসার অনেকক্ষণ পরে সুপর্ণকান্তিকে দেখতে পেয়ে গৌরী প্রসন্ন মজা করেই বলেন, “কী, বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ?” এর উত্তরে সুপর্ণকান্তি তার গৌরী কাকাকে বলেন, “কী সব গদগদে প্রেমের গান লিখছো। একটা অন্যরকম গান লিখে দেখাও না। এই আড্ডা নিয়েও তো গান লিখতে পারো।”
এবার গৌরী প্রসন্ন বলেন, “তুমি তো অক্সফোর্ডের এমএ হয়ে গিয়েছো। আড্ডা নিয়ে বাংলা গান গাইবে?” সুপর্ণ তখন বলেন, “কেন নয়। কফি হাউসের আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পারো।” এই তর্কের মাঝেই গৌরী প্রসন্ন মনে মনে দুই লাইন গান সৃষ্টি করে ফেলেন।
এরপরেই সুপর্ণকান্তিকে বললেন, লিখে নাও- ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই।” সুপর্ণও সঙ্গে সঙ্গে দুটো লাইনেই সুর দিয়ে শুনিয়ে দেন। উপস্থিত শক্তি ঠাকুর সেবার পূজায় গানটা গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও সুপর্ণ রাজি হননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলেন মান্না দের কথা।
পরদিন সকালেই গৌরী প্রসন্নের স্ত্রী সুপর্ণকান্তিকে ফোন দিলেন। সারা রাত জেগে বহুদিন পরে গান লিখেছেন অসুস্থ গৌরী প্রসন্ন। তখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। দু’দিন পরে গানটা নিয়ে হাজির। কিন্তু শেষ স্তবক যোগ করার পক্ষপাতী ছিলেন না গৌরী প্রসন্ন। সুপর্ণকান্তি চান যোগ করুন একটি স্তবক। শেষ পর্যন্ত রাজি হন। লেখেন দুর্দান্ত সেই লাইন- ‘সেই সাতজন নেই, তবুও টেবিলটা আজও আছে।’ কিন্তু শেষ তিনটি লাইন তিনি লিখেছিলেন চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে। এক চেনা লোকের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেন সুপর্ণকান্তির কাছে। তারপর সুপর্ণকান্তির সুরে মুম্বাইয়ে গানটি রেকর্ড করেন মান্না দে। তৈরি হয়ে যায় একটা ইতিহাস।
“সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই,
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু সেই সেদিনের মালী নেই,
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউসে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়,
কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে, কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়।”
হাল জামানায় এই কফি হাউসটিকে আরো হৃদয়ের কাছা কাছি নিয়ে আসে প্রখ্যাত সঙ্গিত শিল্পী মান্না দে। তার গাওয়া গান-‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই... আজ আর নেই..............কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই...’ যখন থেকে গান ভাল লাগে তখন থেকেই শুনছি গানটা। গানের সুরে মাদকতাতো আছেই, সেই সাথে আছে ইতিহাস, গল্প। গানের চরিত্র বন্ধু নিখিলেশ সন্যাল, সুজাতা, মইদুল, গোয়ানিস ডি সুজা, অমল, রমা রায় নামের কিংবদন্তিরা আজ আর নেই। মান্না দে’ও চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবরে। গানের অপর এক কিংবদন্তী মইদুল মারা ৭৮ বছর বয়সে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। ইতিহাসের ঐতিহাসিক ব্যক্তিগণ মারা গেলেও ইতিহাস তো মরে না। এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই স্বগৌরবে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে মান্না দে’র বিখ্যাত সেই কফি হাউজ। দোতলায় উঠতে প্রথমে চোখে পড়লো সামনে টানানো ‘কফি হাউজ’ সাইনবোর্ডটা। আর দশটা বাঙালি ধাঁচের হোটেল রেস্টুরেন্টের মতোই কলকাতা কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজটি। বিশাল পুরাতন এক হল রুম। পঞ্চাশ-ষাটটার মতো টেবিল সারি সারি সাজানো। বিশেসত্ব হলো টেবিল গুলো খুবই ছোট। ছড়ানো ছিটানো চেয়ার। দেয়ালে সারি সারি সাজানো ভারত বর্ষের বিখ্যাত সব শিল্পীর চিত্রকর্ম তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্মটিই মনে হলো সবচেয়ে বড়। ভিতরে ঢুকে এদিক ওদিক দেখে নিলাম। সব টেবিলই পরিপূর্ণ। ডান কোনের দিকে একটি টেবিল খালি পড়ে আছে। আমাদের দেশে এ ধরনের হোটেলে সাধারণত কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়ই থাকে বেশি। সেখানে নবীন-প্রবীণদের মিশ্রণে জমজমাট আড্ডা দেখে বেশ ভালোই লাগলো।
ইন্টারনেট ঘাটনে কফি হাউস সম্পর্কে আরো যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলো, বাঙালির প্রাণের এ আড্ডাস্থলটির নাম এক সময় কফি হাউজ ছিল না। অ্যালবার্ট হল ছিল এর পূর্বনাম। ১৮৭৮ সালের এপ্রিলে তৎকালীন ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্টের নামকরণে এটির নাম করণ করা হয়। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১৪০ বছর। উপমহাদেশে বৃটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক ইতিহাসে জড়িয়ে আছে কফি হাউজটির কোনায় কোনায়। ব্রিটিশ-ভারত বর্ষে এ অঞ্চলের রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল এ কফি হাউজ। নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের সূত্রপাতও হয়েছিল এ কফি হাউজ থেকেই। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ বসু, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বাঙালি অভিনেতা রূদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো কত বিখ্যাত ব্যক্তিরা আড্ডা দিয়েছেন এই কফি হাউজে! সেই বিখ্যাতদের কাতারে ক্ষণিকের জন্য নিজেদেরকে ভেবে কিঞ্চিত পুলকিতও বোধ করলাম। আমিও আজ সেই কফি হাউজে! চোখের সামনেই যেন এক এক করে ভেসে উঠছিল বিখ্যাত মুখগুলো। হাউজটির চারদিকে সাজানো রয়েছে সেই বিখ্যাত মানুষগুলোর চিত্র। চারদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম। বিখ্যাত ব্যক্তি সহ সেই সাত জন নেই আজ টেবিলটা পড়ে আছে সাতটি পেয়ালা আজো খালি নেই। একি সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুড়ি শুধু সেই সেদিনের মালি নেই!!
আমরা তিন বন্ধু ভিতরে ডান দিকের কোনে একটা টেবিলে বসে পড়লাম। হুগলী নদীর তীরে সেই কবে পাকুড়া খেয়েছি তা কি এখনও আছে? চিন্তা করলাম খালি কফিতে হবে না। টেবিলে মাথায় পাগরী পড়া কোন এক নতুন মালি এসে জানতে চাইলো
-কি নেব।
তালিকার উপরের দিকে পড়ে দেখলাম মাটন হাক্কা চাওমিন, চিকেন হাক্কা চাওমিন সহ আরো অনেক কিছু। ভারী খাবার খাব সিদ্ধান্ত নেয়ায় মাটন হাক্কা চাওমিন অর্ডার দিলাম দুই প্লেট সাথে একটি খালি প্লেট। ওয়েটার ঘুরে এসে জানালো
-শেষ, চাউমিন পাওয়া যাবে না।
এবার পাকুরা বা অন্য কিছু আনতে বলায় ওয়েটার কাউন্টার থেকে ফিরে এসে বলছে,
-স্যার মাটন হাক্কা চাউমিন হবে, করে দিতে পারবে।
আমরা আর অন্য কোন আইটেম না চিন্তা করে অর্ডার ফাইনাল করলাম। কিছুক্ষণ বসে গল্প আর ছবি তোলার ফাকে চার দিকে চোখ বুলাচ্ছিলাম। যাকে দেখি তাকেই মনে হয় কবি কবি চেহারা। কে যে কবি লেখক আর কে যে পাঠক বা আমাদের মত আগন্তুক দর্শক বোঝা বড় দায়। আমাদের টেবিলের সামনে একটা টেবিল পরে তিন জন মেয়ে ও একজন ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মেয়ে তিনজন দেদারছে সিগারেট টানছে খুব ভাব নিয়ে। ডান পাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল ছবিটার কাছে বসা মেয়েগুলো সিগারেট টানছে তাতেও কোন দোষ নেই, কিন্তু নাক দিয়ে ধুয়াও ছাড়ছে। মুরাদ মুন্সী দেখে বলে বসলো,
-দেখেন ভাই, সিগারেট টানছিস টান, রং চো----- দরকার কি!!
বেশিরভাগ টেবিলেই এক বা একাধিক মেয়ে মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছে আর সিগারেটের ধোয়া ছাড়ছে। কফি হাউসের পুরো রুমটা ধুয়ায় ঘোলাটে হয়ে গেছে। চোখ জালা করছে। ওয়েটার আমাদের জন্য মাটন হাক্কা চাওমিন আর খালি প্লেট নিয়ে এসে হাজির। জামাল ভূইয়া খালি প্লেটটা টেনে নিয়ে প্রথমে মুরাদ মুন্সীর সামনে দেওয়া প্লেট থেকে কিছুটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো। আমি আমার প্লেট থেকে কিছুটা তুলে দিলাম। সাথে অর্ডার দিলাম কফি। ওয়েটার ঠান্ডা কফি নিয়ে এলো। খাবারের ফাকে ফাকে কফি খাচ্ছি। ঠান্ডা কফিতো, আমার বন্ধুরা জুসের মত স্ট্র দিয়ে এক টানেই মনে হয় শেষ করে দিয়েছে। আমি বললাম,
-অল্প কফি খেতে হয় আর বেশি সময় কাটাতে হয়!! তোমরা তো এক টানেই শেষ করে দিলে।
আমি ঠান্ডা কফি শেষ করে বললাম,
-আমি ধুমায়িত কফি খাব।
ঠান্ডা কফিতে কফি হাউসের আড্ডা জমার কথা নয়। আমার ধুমায়িত কফি চাই। ওয়েটারকে ধুমায়িত কফির জন্য বলা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই টেবিলে চলে এলো এক কাপ ধুমায়িত কফি। বেশ কিছুটা সময় কফি হাউসে কাটিয়ে বিল পরিশোধ করে ওয়েটারকে কিছু টিপস দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেরোতে বেরোতে চিন্তা করলাম ‘কফি হাউসের আড্ডাটা আজও আছে, শুধু মানুষ গুলো বদলে গেছে। হাউসটা ঠিকই আছে বদলায়নি, বদলায় মানুষ, আড্ডায়, চরিত্রে, স্বভাবে, রুচিতে, বয়সে.......

॥ ৯ ॥
তুমি হারিয়ে যাওয়ার সময় আমার সঙ্গে নিও....মামার হারিয়ে যাওয়া
কফি হাউস থেকে বেরোলেই রাস্তার অপর পাশে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির গেইট। গেইটের সামনে দাড়িয়ে ক্যাব ডাকছি কিন্তু খালি ক্যাবগুলি যেতে রাজি হচ্ছে না আবার যাওয়ার মত কোন খালি ক্যাবও পাচ্ছি না। আমরা এখন যাব নিউ মার্কেটে। শরীয়তপুর থেকে বৃহস্পতিবার সকালে রওয়ানা দিয়ে আমি, মুরাদ মুন্সী ও জামাল ভূইয়া আসছি কোলকাতা ভ্রমনে। বৃহস্পতিবার রাতের বাসে বেনাপোল এসেছে শরীয়তপুর বারের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট আসাদ খান মিলন ও এডভোকেট রুহুল আমিন ভাই। সারা রাত বাস জার্নি শেষে সকালে ইমিগ্রেশন পার হয়ে কোলকাতায় প্রবেশ করেছে। আসাদ খান মিলন মামা ও রুহুল ভাই শুক্রবার সকালে এসে উঠেছে হোটেল প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল গেষ্ট হাউসে। প্যারাডাইস ইন গেষ্ট হাউস নিউ মার্কেট এলাকার মারকুইজ স্ট্রিটে। তারা শরীয়তপুর বসেই রুম বুক করে এসেছিল। ফলে তাদের আর হোটেল খোজার ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। রুহুল ভাই বিদেশ ভ্রমনে বেশ অভিজ্ঞ, তাই অভিজ্ঞতার একটা দাম আছে না!! কফি হাউসে আসার পথে মিলন মামার ফোন।
-মামা, তোমাদের সাথে কি রুহুল আছে?
আমি বললাম, নাতো মামা, কোন সমস্যা? মামা জানালো,
-আরে রুহুল আমায় নিউমার্কেটের রাস্তায় রেখে কোথায় যেন গেছে, এখন আমি হোটেলের নাম ভুলে গেছি, রাস্তাও ভুলে গেছি। রুহুলকে বার বার ফোন করছি ও ফোনও ধরছে না। তুমি একটা ফোন দিয়ে রুহুলকে বলো আমাকে ফোন করতে।
আমি সাথে সাথে রুহুল ভাইকে ফোন দিলাম কিন্তু রুহুল ভাই আমার ফোনও ধরছে না। রুহুল ভাই হোটেলে ওঠার পর আমার ফেসবুকে একটা ছবিতে কমেন্টসে গিয়ে লিখেছিলো যে তারা মারকুইজ স্ট্রিটের প্যারাডাইস ইন হোটেলে উঠেছে। যেহেতু মামা হোটেলের নাম ও রাস্তার নাম ভুলে গেছে তাই আমি তাকে ফোন করে বললাম,
-মামা আপনার হোটেলের নাম প্যারাডাইস ইন, এটা মারকুইজ স্ট্রিটে।
নাম বলায় এবার মামার সব মনে পড়ছে। আমাদের জানালো,
-ওকে, ওকে! আমি এবার যেতে পারবো।
আমি মামাকে বললাম, আমরা কফি হাউসে যাচ্ছি। কফি হাউসের কাছাকাছি চলে এসেছি। আপনি যদি সমস্যা মনে করেন তবে একটা ক্যাব নিয়ে ড্রাইভারকে কলেজ স্ট্রিটের কথা বলে কফি হাউসে চলে আসেন। আমরা পরে আপনাকে পৌছে দেব। মামা আমাদের জানালো,
-কোন সমস্যা নাই। আমি যেতে পারবো।
অভিজ্ঞ রুহুল ভাইয়ের এহেন আচরনে মামা ভীষণ ক্ষুব্ধ! মামা রেগে গিয়ে পরদিনের বাস ধরে বাড়ি চলে যাবে সিদ্ধান্ত নিল!! পরে অবশ্য ঠান্ডা হয়েছে! ভ্রমন শেষেই কোলকাতা ছেড়েছে।
কফি হাউসের আড্ডার ফাকে আবার মামাকে ফোন দিলাম,
-মামা কোন সমস্যা?, হোটেল খুজে পেয়েছেন? মামা উত্তরে জানালো,
-কোন সমস্যা নেই, আমি হোটেল খুজে পেয়েছি, এখন হোটেলে এসে বিশ্রাম নিচ্ছি, কোন চিন্তা করো না।
কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আমরা চিন্তা করলাম, অপরিচিত জায়গায় এসে মামা হয়তো বিপদেই পড়েছে। হয়তো একাকিত্ব বোধ করছে। আমরা বরং মামার হোটেলে যাই, আমরা গেলে তার হয়তো ভাল লাগবে। কিন্তু প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সামনের রাস্তায় কোন ক্যাব পাচ্ছি না। আমরা একটু হেটে এগিয়ে মোড়ের দিকে গেলাম। মোড়ে শ্রী নিকেতনের বিশাল দুটি শোরুম। সেই মোড় থেকে একটা ক্যাব নিয়ে রওয়ানা দিলাম নিউমার্কেল এলাকায় মারকুইজ স্ট্রিটের প্যারাডাইস হোটেলে। হোটেলে গিয়ে রিসিপশনে গিয়ে খোজ নেব এডভোকেট আসাদ খান মিলন সাহেব কত নাম্বার রুমে আছে। এমন সময় হোটেলের দরজায় এসে দাড়ালো বিশাল কার্টন হাতে রুহুল ভাই। আমাদের দেখে বললো,
-আসো, আমাদের রুমতো দোতলায়!
আমরা তার সাথে দোতলায় গিয়ে দরজা নক করলাম। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে আটকানো অথচ নক করার পরেও খুলছে না। ভাবলাম মামা কি আবার নিচে গেল? অনেক ক্ষণ দরজায় নক করে অবশেষে ফোন দিলাম আমি। ভিতর থেকে ফোন রিসিভ করে মামা বলছে,
-হোটেলের দোতলায় আসো।
আমরা তার কথা দরজার এপাশ থেকে শুনতে পাচ্ছি কিন্তু মামা বলেই যাচ্ছে,
-আমি রুমে আছি, তোমরা দোতলায় চলে আস।
আবার দরজা নক করে বললাম আমরা আপনার রুমের সামনে দাড়িয়ে। মামা এবার বললো,
-ওহ! দাড়াও খুলছি।
আমরা ভিতরে প্রবেশ করে বুঝলাম, ক্লান্ত শরীরে মামার হালকা নিদ্রা ভাব চলে এসেছিল। তাই সে দরজা নকের শব্দ শুনতে পায়নি। মামা আমাদের পাকা আম দিয়ে আপ্যায়ন করলো। আম খেয়ে পাঁচ জনই বেরিয়ে পড়লাম রাতের খাবার খেতে। মারকুইজ স্ট্রিটের রাস্তায় হাটতে হাটতে রাস্তার শেষের দিকে একটা হোটেলে ঢুকে দোতলায় গিয়ে কোনের সিটে সবাই বসলাম। বেয়ারাকে আমাদের জন্য ভাত, ভর্তা, ভাজি, মাছ অর্ডার দিয়ে মামা নিলো দুটি রুটি ও সবজি। রাতের খাবারটা আমাদের সিনিয়রই খাওয়ালো। খাওয়া শেষে বেরিয়ে আমরা একটি ক্যাব ধরে আবার ফিরে এলাম মউলালী স্ট্রিটে আমাদের হোটেলে। হোটেলের সামনে নেমে ভিতরে না ঢুকে চলে গেলাম পুলিশ বক্সের কাছে। একবার হোটেলে উঠলে আর বের হওয়া হবে না তাই চা খেয়ে উপরে উঠবো। যেই ভাবা সেই কাজ, আগের সেই দোকানটায় গিয়ে আমি আর জামাল ভূইয়া চা সেবা করে হোটেলে চলে এলাম। মুরাদ অবশ্য খেলনা, একে তো চিনি ছাড়া চা দিতে পারবে না তার উপরে চা খায়ও কম। আমাদের আবার অক্সিজেন গ্রহণের মত কিছুক্ষণ পর পর চা না হলে হয় না। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সবাই লেগে গেলাম ফেসবুকে দিনের কর্মসূচী বর্ণনায়, আগের কর্মসূচীর প্রতিক্রিয়া দেখতে নোটিফিকেশন চেক করায়। আমাদের হোটেলে ছিল ফ্রি ওয়াইফাই সার্ভিস। হোটেলে ঢুকেই আমার নজরে পরেছে বিষয়টা। হোটেলের ম্যানেজারকে বলার সাথে সাথে আমাদের পাসওয়ার্ড বলে দিলো। আমরা যার যার মোবাইলে ওয়াইফাই কানেক্ট করে নিয়েছি। কিছুক্ষণ এক রুমে তিন জন তিনজনের কাজে লেগে গেলাম। এক রুমে থেকেও মনে হলো ভিন্ন ভিন্ন রুমে আমরা! কেউ কারো সাথে কোন কথা নেই!! ভ্রমনের আনন্দ, ত্রুটি বিচ্যুতি, সুবিধা, অসুবিধা নানা বিষয় থাকলেও কারো সাথে কোন বিষয় নিয়ে কোন আলোচনা নাই। কিছুক্ষণ ফেসবুক নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পর আগামী সকাল শনিবার নিয়ে আলোচনায় বসলাম। আমার আর মুরাদ মুন্সীর আগ্রহ শান্তি নিকেতনে যাওয়ার। কিন্তু জামাল ভূইয়া বাধ সাধলো। দুরত্ব বিবেচনায় জামাল ভূইয়া বললো, সকালে গিয়ে আমরা বিকালে আসতে পারবো না, তার পর কেনাকাটা আছে, তাই আমি শান্তি নিকেতনে যাওয়ার পক্ষে নাই। জামাল ভূইয়া ভাবির জন্য কেনাকাটা করবে, ছেলে মেয়ের জন্য কেনাকাটা করবেন। গৃহে শান্তি বজায় রাখাটা তার কাছে বেশি গুরুত্ব পেল, শান্তি নিকেতন নয়। শান্তি নিকেতন শিল্প সাহিত্য প্রেমি বাঙ্গালীর জন্য এক তীর্থ স্থান। কিন্তু জামাল ভূইয়ার কাছে শিল্পর চাইতে শিল্পীই বেশি আগ্রহের মনে হল!! তিন জন এক সাথে এসেছি, একজন যাবে না দুজন যাবে সেটা হতে পারে না। তাতে ভ্রমনের আনন্দে ব্যাত্যয় ঘটবে। অবশেষে শান্তি নিকেতন যাওয়ার পরিকল্পনা বিরস বদনে বাতিল করা হলো। সবকিছু বাদ দিয়ে ঘুমের মধ্যে শান্তি খোজার চেষ্টায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম।

॥ ১০ ॥
কোলকাতা হাইকোর্ট, কোলকাতা সিটি বার ভ্রমন ও নিউ মার্কেটে কেনাকাটাঃ
শনিবার সকাল। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে পরিকল্পনা শুরু কোথায় যাওয়া যায়। সিদ্ধান্ত হলো আজ প্রথমেই যাব ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গে, তারপর ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে, তারপর কোলকাতা হইকোর্ট ঘুরে নিউ মার্কেটে কেনাকাটা সারা। কারন, রবিবার সকালে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেব। তাই কোন কাজ বাকি রাখা যাবে না। আজকের দিনটাই শুধু আমাদের হাতে। সকাল থেকে রাত অবধি যা কিছু করার করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ, রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। নিচে নেমে হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম
-ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গে যাব কিভাবে?
ম্যানেজার জানালো, ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গে যেতে পারবেন না। ওটা আর্মি এড়িয়া। সাধারণ কাউকে যেতে দেয়া হয় না। আপনারা যদি আর্মি পারসন হন বা কেউ পরিচিত থাকে তবে ঢুকতে পারবেন। যেহেতু ফোর্ট ইউলিয়াম দূর্গে যাওয়া হবে না তাই জানতে চাইলাম আর কি কি দর্শনীয় স্থান আছে। আমাদের জানালো কোলকাতা মিউজিয়াম দেখতে পারেন। আমাদের পরিকল্পনায় কোলকাতা মিউজিয়াম ছিল না। আমরা যেহেতু উকিল মানুষ তাই আমাদের অপর তীর্থস্থান কোলকাতা হাইকোর্ট, বার এসোসিয়েশন ঘুরবো। তাই সিদ্ধান্ত হলো আগে নাস্তা করবো। গতকাল সকালের মতই আমরা সেই ফুটপাতের দোকানে গেলা। আজ আর বলতে হলো না দাদা একছো না দেড়ছো দেব? আজ দোকানী বেশ সমাদর করে বসতে দিলো এবং বললো,
-দাদা দেড়ছো করে দেই।
আমরা দেড়ছোর সাথে ডিম চাইলাম। আমাদের ডিম অমলেট করে দিলো। অর্ধেকটা নয় পুরোটা ডিমের পুরোটাই খেয়ে আগের দিনের মত পাশের দোকন থেকে পানি কিনে চায়ের দোকানে গেলাম। আমাদের জিজ্ঞেস করলো
-দাদা ছোট না বড়।
আমরা বড় বলায় মাটির তিন পেয়ালা চা দিলো। খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ট্যাক্সির খোজে রাস্তার মোড়ে এসে দাড়ালাম। একটু দাড়াতেই একাধিক ক্যাব পেয়ে গেলাম। দরদাম করে রিক্সা ভাড়ার পরিমান টাকার বিনিময়ে ক্যাব নিলাম যাদুঘরে যাওয়ার জন্য। গল্প করতে করতে ক্যাব পৌছে গেল যাদুঘরের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে ভারতীয় গংগ্রাহালয়ের সামনে আমরা কিছু ফটো সেসন করে জামাল ভূইয়া গেল প্রবেশের টিকিট কিনতে। গিয়ে দেখে ভারতীয়দের জন্য টিকিট মাত্র পঞ্চাশ টাকা আর ফরেইনারদের জন্য পাঁচশত টাকা। বিষয়টা আমাদের কাছে একটু বৈষম্য মনে হলো। এতটা গলাকাটা দাম দিতে হবে? আমরা পর্যটক, ভারতীয়দের জন্য যদি টিকিট হয় পঞ্চাশ টাকা তবে আমাদের জন্য হওয়া উচিত ত্রিশ টাকা। আমরা অতিথি, অতিথির সাথে এতটা বৈষম্য দেখে অবাক হলাম। চিন্তা করলাম, একটা মিউজিয়াম প্রদর্শন করতে সারা দিন লেগে যাবে যদি ভাল ভাবে দেখতে চাই। আমাদের যেহেতু অনেক কাজ, আর আজকের দিনটাই হাতে আছে, সেক্ষেত্রে এতটা সময় সংগ্রাহালয়ে দেয়া যাবে না। তাই পনেরশ টাকা খরচ করে মিউজিয়ামে সময় কাটানো ঠিক হবে না। তিনজনই সিদ্ধান্ত নিলাম সংগ্রহালয় পরিদর্শন বাতিল। তাহলে এবার পরের প্রজেক্ট! আবার ক্যাব নিলাম কোলকাতা হাইকোর্ট যাওয়ার জন্য। কোলকাতা হাইকোর্ট যাওয়ার পথে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গের গেটের সামনে সিগনালে আমাদের ক্যাব থামলো। আমরা দূরথেকে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ অনুভব করে ছুটতে থাকলাম কোলকাতা হইকোর্টের দিকে। পথিমধ্যে অনেক কিছুর দেখলাম যার ভিতর হৃদয়ে দাগ কাটলো গান্ধীজীর স্বল্প বসনা ভাস্কর্য। গান্ধীজী লাঠি হাতে হাটার ভঙ্গিমায় ভাস্কর্য হয়ে দাড়িয়ে আছে। লক্ষনীয় বিষয় কোন ভাস্কর্যের পাদদেশ বা স্থাপনার দেয়ালে কোন পোষ্টার লাগানো নেই। আমাদের দেশে হলে প্রতিটা ভাস্কর্যের বা শিল্প কর্মের পাদদেশে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পোষ্টার, নেতাকে তেলিয়ে পাতি নেতার পোষ্টার বা কোন হারবাল চিকিৎসালয়ের রগরগে পোষ্টারে মোড়ানো থাকতো এখানে সেটা চোখে পড়লো না। সরা শহরে কোথাও ব্যানার বা ফেস্টুন দেখলাম না। আমাদের দেশে নেতার ছোট একটি ছবি দিয়ে চামচার বিশাল ছবিওয়ালা ব্যানার ফেস্টুন থাকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। ব্যানারে নেতাকে গুরুত্ব কম দিলেও নেতার তা বোঝার মত জ্ঞান খুব কমই আছে। তাছাড়া গাছে উঠতে না পারলে আমাদের দেশে কেউ নেতা হতে পারে না। পাতি নেতারা গাছের সাথে নিজেকে পেরেক মেরে দেখায় তারা কত বড় যিশু। এখানে হাতে গোনা দু’একটা ব্যানার দেখলাম তাও শুধু মমতা ব্যানার্জীর ছবিওয়ালা। শহরটা গাছে ভরা, কিন্তু কোন গাছে কোন পেরেক মারা নাই, সুতলি দিয়ে কোন ব্যানার টানানো নাই। গাছগুলো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অক্সিজেন ছাড়ছে মানুষের জন্য। দেখতে দেখতে আমরা পৌছে গেলাম কোলকাতা হাইকোর্টে।
কোলকাতা হাইকোর্টঃ কোলকাতা উচ্চাদালত বা কলকাতা হাইকোর্ট ভারতের প্রাচীনতম হাইকোর্ট। ১৮৬১ সালের হাইকোর্ট আইন বলে ১৮৬২ সালের ১ জুলাই কলকাতা হাইকোর্ট স্থাপিত হয়। সেই সময় এই হাইকোর্টের নাম ছিল হাই কোর্ট অফ জুডিকেচার অ্যাট ফোর্ট উইলিয়াম। বর্তমানে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ কলকাতা হাইকোর্টের অধিক্ষেত্রের অন্তর্গত। আন্দামান ও নিকোবরের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে কলকাতা হাইকোর্টের একটি সার্কিট বেঞ্চ আছে। কলকাতা শহরের সাম্মানিক নাগরিক শেরিফের ঐতিহ্যশালী দপ্তরটি এই আদালতের ভেতরে অবস্থিত।
স্থাপত্য শৈলীঃ হাইকোর্ট ভবনটি ইউরোপীয় গঠন শৈলীর গথিক স্থাপত্যবিশিষ্ট বেলজিয়ামের ইপ্রেস ক্লথ হলের আদলে নির্মিত। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ক্লথ হল ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেটি পুনর্নিমাণের জন্য ওই শহরের মেয়র কলকাতা থেকে এক সেট প্ল্যান চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। ১৮৬৪ সালের মার্চ মাসে ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। নির্মাণকার্য শেষ হতে সময় লেগেছিল আট বছর। এই ভবনে একটি ১৮০ ফুট উঁচু টাওয়ার আছে। হাইকোর্ট ভবনের নকশাটি বেশ জটিল। এই প্রসঙ্গে রথীন মিত্র লিখেছেন, ‘একটা চতুষ্কোণীর চারধারে অবস্থিত একটি আয়তাকার স্থাপত্য। ভেতরে অনেকগুলি বিচার কক্ষ, অন্যান্য ঘর। ছাদের সঙ্গে লোহার একটি সুন্দর গম্বুজ আছে, যা ভেতরের গরম হাওয়া টেনে বের করে নিয়ে বাহিরে পাঠিয়ে দিতে পারে। বাড়ির ভেতরের বাতাস হয়ে যায় নির্মল ঠান্ডা। চারিদিকে সুন্দর বাগান, ফোয়ারা।
পরবর্তী পর্যায়ে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর দিকে নতুন করে এর সংলগ্ন আরও একটি ভবন নির্মাণ করা হয় এবং পরবর্তী ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ দিকে হাইকোর্ট ভবনের বর্তমান স্থাপত্যের সঙ্গে সমতা রেখে আর একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। চতুর্ভুজাকার এই হাইকোর্ট ভবন দৈর্ঘ্যে ৪২০ ফুট এবং প্রস্থে ৩০০ ফুট।
বিচারপতিগণঃ ১৮৭২ সালে স্যার বার্নেস পিকক কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। হাইকোর্টের প্রথম ভারতীয় বিচারক ছিলেন শম্ভুনাথ পন্ডিত। হাইকোর্টের প্রথম ভারতীয় প্রধান বিচারপতি ছিলেন রমেশচন্দ্র মিত্র এবং প্রথম পূর্ণ মেয়াদের ভারতীয় প্রধান বিচারপতি ছিলেন ফণীভূষণ চক্রবর্তী। হাইকোর্টের দীর্ঘতম মেয়াদের প্রধান বিচারপতি ছিলেন শংকরপ্রসাদ মিত্র।
হাইকোর্টের বাম দিকের সড়কে গাড়ি থামিয়ে দিলে আমরা নেমে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম। শনিবার বন্ধ ছিল কোর্ট। ফলে কোন মক্কেলের আনাগোনা তেমন চোখে পড়লো না। আর আইনজীবীদের চেম্বারও তেমন একটা দেখলাম না। রাস্তার পাশের বিল্ডিংয়ে নোটারী পাবলিকের দু’একটা অফিস চোখে পড়লো। আমরা বার এসোসিয়েশন কোথায় জানতে চাইলে সিটি বার দেখিয়ে দিলো একজন। হাটতে হাটতে কোলকাতা সিটি বার এসোসিয়েশন এর সামনে গেলাম। একটা ভবনের নিচতলায় এক রুমের বার এসোসিয়েশন রুম। ভিতরে প্রবেশ করে দেখা এক শুকনা ভদ্রলোকের সাথে। জামাল ভূইয়া পরিচয় দিলো, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আমরা সবাই এডভোকেট। আমাদের পরিচয় পেয়েও তার মধ্যে তেমন কোন ভাবলেশ নেই। ভিতরে রুমের পিছন দিকে আরো কয়েকজন আইনজীবী বসে গল্প করছে। আমাদের সাথে দায়সারা কিছু কথা বলার পর মনে হচ্ছে এই লোক সামাজিকতা বুঝে না। আমরা বার থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক একটু ঘুরে কোলকাতা হাইকোর্টের সামনের দিকে চলে এলাম। সিনেমায় হাইকোর্টের যে চিত্র দেখায় সেই সামনের অংশের বর্ণনা আমার ভাষায় আসে না। হাইকোর্টের সামনে আসার আগে আমরা রাস্তার ধারে মাটির ভারে চা খেলাম। রাস্তার ধারে ধারে আমাদের দেশে যেমন লাল সালু কাপড় মোড়ানো তামারি থাকে, মাঝারের নামে টাকা তোলার জন্য, এখানেও ছোট ছোট মন্দির আছে। এক লোক কালো লেংটি পড়ে ফুটপাতের পানির কল থেকে একটা বালতি ভরে গোসল সারলো। তারপর একবালতি পানি নিয়ে ছোট একটা বটগাছের নিচে স্থাপিত ছোট মন্দিরে পানি ছিটিয়ে প্রনাম করলো। লোকটি যে লেংটি পড়েছে আমার মনে হলো ওটা পড়া আর না পড়া একই কথা। তারপরও তার ভক্তি দেখে আমার দেশের সাথে কিছু মিল পেলাম। ঢাকা হইকোর্টের মাজারে এমন ভক্ত অনেক দেখা যায়, সারা সপ্তাহ গোসল করে না, সারাদিন গাজা টানে তারপরও তাদের মধ্যে পীরের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা অঢেল। আমরা ফুটপাত ধরে একটু এগিয়ে গেলেই কোলকাতা হাইকোর্টের সামনের অংশ। হাইকোর্টের সামনে বিশাল বিশাল বটবৃক্ষ। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত এলাকাটা। বটগাছগুলোর মধ্যে কয়েকটার গোড়ায় পাকা করে বসার স্থান করে দিয়েছে সরকার। আমরা বসতে চাইলেও উপরের পাখিগুলোর আচরন ভাল মনে হলো না। টুপ টাপ ঝড়াচ্ছে। নিচের ফুটপাত সাদা করে ফেলেছে, কোলকাতা হাইকোর্ট এলাকার পাখিরা কি চুন খায়!! আমরা হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত বিপ্লবী সূর্য্য সেন (মাষ্টারদা) এর বিশাল এক ভাস্কর্য। আমাদের দেশ হলে এই মূর্তি এতদিন দাড়িয়ে থাকতো না। হেফাজত সরকারের সাথে আলাপ আলোচনা করে মূর্তির হেফাজত করে ফেলতো। কিন্তু কোলকাতায় সমহিমায় দাড়িয়ে আছে সূর্য্য সেনের ভাস্কর্য। আমরা মাষ্টরদার সূর্য্য সেনের সাথে বেশ কিছু ছবি তুললাম। কোলকাতা হাইকোর্টকে পিছনে রেখে ফটো সেসনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমি তুলি মুরাদ মুন্সীর ছবি আবার মুরাদ মুন্সী তোলে আমার ছবি। বলে রাখা ভাল, মুরাদ মুন্সী আবার ফটোগ্রাফির উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। তাই মুরাদ মুন্সীকে দিয়ে ছবি তোলার আগ্রহটা আমার একটু বেশি। জামাল ভূইয়া একাই সেল্ফি তুলে যাচ্ছে। সেখানে আরোক বিদেশী এসে কিছু ছবি তুললো। সে যে বিদেশী তা বোঝার জন্য তার পাসপোর্ট দেখতে হয়নি! সাদা চামরার লোক। আমাদের দেখে সে একটু মুচকি হেসে হাই হ্যালো করলো। আমরাও সভাব সুলভ ভাবে তার সাথে হাই হ্যালো বিনিময় করলাম। জামাল ভূইয়া যেহেতু আমাদের কোলকাতা ভ্রমনের টিম লিডার তাই এরই মধ্যে সে একটা ট্যাক্সী ক্যাব ঠিক করে ফেলেছে। আমরা ক্যাবে উঠে নিউ মার্কেটের দিকে রওয়ানা দিলাম। কোলকাতা ভ্রমনে একমাত্র মুসলিম ক্যাব ড্রাইভার পেলাম। ড্রাইভার বুঝতে পারলো আমরা বাঙ্গালী এবং মুসলমান। সে আমাদের সাথে গল্প জমিয়ে দিলো। কিভাবে ভারতে ইসলাম প্রচার শুরু হয়, কত কন্টকময় পথ ছিল এখানে ইসলাম প্রচার করা এবং প্রসার ঘটানো। বহু মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ভারত বর্ষে ইসলাম টিকে আছে। ড্রাইভার সাহেব আবার পীর মুরশিদের ভক্ত। আমাদের সাথেও এক ভক্ত আছে। এডভোকেট জামাল ভূইয় মাইজ ভান্ডারীর মুরিদ। পীরের আরেক ভক্ত পেয়ে জামাল ভূইয়া তো বেশ পুলকিত! জমিয়ে দিলো দুজনে। আমি আর মুরাদ মুন্সী তাদের দুজনের কথার ফাকে ফাকে সুর মিলিয়ে আবার নজর ফিরিয়ে নিচ্ছি বাইরের দিকে। আমাদের আগ্রহ সৌন্দর্যের দিকে। দুজনেই কোলকাতা শহরের ফুটপাতে সৌন্দর্য খুজে বেরাই। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ফুটপাত, গাছপালা, ভাস্কর্য, ফুটপাতে, পশু-পাখি, দাড়ানো নর-নারী কিছুই বাদ যাচ্ছে না। যা দেখছি তাতেই মুগ্ধ হচ্ছি। চলতে চলতে জামাল ভূইয়া ড্রাইভারকে একটা গানও শুনিয়ে দিলো। ‘একদিন আমার বড় পীরে ডাকিয়া কয় খাজারে---আমার পিছে নামাজ পরবে যেইজনা ॥ ফজরেরও নামাজ যেইজন, আদায় করিবে সেইজন, বিনা হিসাবে বেহেশত বাসি বলছে রব্বানা।’ সাথে যেহেতু আছি, আমরাও বাদ পড়লাম না, শুনে ফেললাম গানটা। জামাল ভূইয়ার গানের গলা প্রশংসা পাবার মত না হলেও বেশ ভালই গাইলো। গান শেষ হতে না হতেই আমরা পৌছে গেলাম নিউ মার্কেটের সামনে। আবারও সেই একই অবস্থা, নিউ মার্কেট যে কোনটা বোঝা বড় দায়, সবগুলোই কি নিউ মার্কেট!!
একটা মার্কেটের সামেনে নেমে ড্রাইভারকে বকসিস সহ ভাড়া মিটিয়ে ঢুকলাম মার্কেটের ভিতরে। অনেকক্ষণ হাটাহাটি করলাম মার্কেটের ভিতরে। কোলকাতা এসেছি, কিছু কিনে নিয়ে যাব না এটা কি হয়। যদিও আমি ভ্রমনে বের হলে কেনাকাটার পক্ষে নাই। ভ্রমন করতে এসেছি শপিং করতে নয়। কেনাকাটা করে যদি সময় ও পয়সা নষ্ট করি তবে ভ্রমনের আনন্দ থাকে না। তার উপর আমার স্থুলকায় দেহ। নিজের শরীর নিয়েই নিজে চলতে পারি না, তার উপর যদি কেনাকাটা করি তবে ব্যাগের ওজন বাড়বে। ব্যাগের ওজন বাড়া মানে শরীরের ওজন বাড়া। আমি ব্যাগ টানাটানির পক্ষে নাই। তবুও সবাই দেখি কেনাকাটা নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে গেল। আমিও ওদের সাথে কয়েকটা জয়পুরি থ্রিপিছ কিনলাম। বাড়িতে নিজের বউ আছে, ভাইয়ের বউ, দুটি বোন। তাদের জন্যই শুধু কিনলাম। নিজের কন্যার জন্য ও বাবার জন্য কিনলাম শুধু চকলেট আর পঙ্গু বা প্রতিবন্ধী আম মানে ল্যাংড়া আম। জামাল ভূইয়া ঈদের কেনাকাটা সেরে ফেললো। বউয়ের জন্য, পুত্র-কন্যার জন্য নিজের জন্য, মা-শাশুরির জন্য। কারো জন্য বাদ রাখলো না। মুরাদ মুন্সীও বউয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করলো। তবে নিজেদের জন্য সবাই কিনলাম। আমি শ্রী লেদার থেকে নিজের জন্য জুতা, স্যান্ডেল, ভ্রমনের সময় পাসপোর্ট, মোবাইল, টাকা পয়সা রাখার মত লেদারের সাইট ব্যাগ কিনলাম। মেয়ের জন্য একটা সুন্দর জামা পছন্দ হলেও সাইজের জন্য কিনতে পারলাম না। আমার মেয়ের বয়স মাত্র আড়াই বছর, কিন্তু যা পছন্দ হয়েছে তা চার থেকে পাঁচ বছরের মেয়েদের জন্য। মনটা একটু খারাপই হল। আমার আর মুরাদ মুন্সীর কেনাকাটা সহজেই শেষ হলো কিন্তু জামাল ভূইয়ার কেনাকাটা তো আর শেষ হয় না। আমরা দুজন জামাল ভূইয়াকে মার্কেটের ভেতরে রেখে বাইরে চলে এলাম। কেনাকাটার চাইতে মার্কেট ও মার্কেটে আগতদের দেখাটাই বেশ উপভোগ্য মনে হলো। তাই আমি আর মুরাদ মুন্সী মার্কেটের বাইরে এসে দাড়িয়ে মানুষ দেখছি!
জামাল ভূইয়ারও কেনাকাটা শেষ হলো। বেরিয়ে এলে এবার পেটের কামড়ানি অনুভব করলাম। অনেকক্ষণ হাটাহাটির পর ক্লান্ত ও খুধার্ত বোধ করছিলাম। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম বাংলা খাবারের হোটেল কোথায় আছে। সবাই গলি দেখিয়ে দিলো। আমরা গলি দিয়ে হাটতে হাটতে কোনের দিকে একটা হোটেল দেখতে পেলাম। শো-কেসে খাবার সাজিয়ে রেখেছে। বেন্ডি ভাজা, কড়লা ভাজা, বিভিন্ন ভর্তা, মোড়গের মাংস, মাছ দেখে খিদেটা ঝিলিক মেরে উঠলো। ভর্তা-ভাজি দেখে আমরা ঢুকে গেলাম হোটেলে। মুসলিম হোটেল। ছোট পরিসরে হোটেলটি। ঢোকার দরজার কাছেই বেসিন দেয়া। আমরা ব্যাগগুলো চেয়ারে রেখে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। এরপর খাবার অর্ডার দিলাম। আমাদের সাদা ভাত আর বিভিন্ন ভর্তা, মাছ, মোড়গের মাংস দিল। খাওয়া শেষে হাত মুখ ধুয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম। এখানকার ভাতগুলো বেশ ভাল। বাশমতি চালের ভাত। দেখতে মনে হয় নুডুলস ছোট ছোট করে ভেঙ্গে শিদ্ধ করা। ভাতের ঘ্রানটাও বেশ মম করে। খাওয়া দাওয়া শেষে বেরিয়ে দেখি রাস্তার ধারে চকোলেটসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে। আমরা দোকনটা থেকে চকলেট নিলাম। জামাল ভূইয়া জিরা কিনলো এক কেজি। এখানে জিরার কেজি মাত্র দুইশ টাকা। তাকে দেখে আমিও নিলাম। আমাদের দেশে জিরার দাম আকাশ ছোয়া। এখানে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে। কেনাকাটা শেষে রাস্তায় দাড়াতেই একটা ক্যাব পেলাম। বেশি দরদাম করতে হলো না। এখানে একটা কথা না বললেই নয়, কোলকাতায় কিছু ক্যাবের গায়ে লেখা রয়েছে নো রিফিউজাল। কিন্তু বেশিরভাগ ক্যাবই আপনাকে রিফিউজ করবে। আবার মিটারে যেতেও অনিহা দেখায়। একটু বাড়িয়ে দিলেই যেতে রাজি হয়। তবে বাড়িয়ে দেয়ার পরিমানটা খুব একটা বেশি নয়। গা সওয়া বলে আমরা বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করিনি কখনো। ক্যাব নিয়ে ছুটে চললাম মউলালী এজেসি বোস রোড হোটেল প্লানেট ইন্টারন্যাশনাল গেষ্ট হাউস। হোটেলে উঠেই ফ্রেশ হওয়ার পালা। পালাক্রমে তিনজন বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম। সেই ফাকে চলতে থাকে সারাদিনের ছবি আদান প্রদান। শেয়ারইট নামে একটা এ্যাপস আছে যা যাদুকরী কাজ করে। ছবি শেয়ারের পর চলতে থাকে ফেসবুকে পোষ্ট দেয়া। কিছুক্ষণ এভাবে চলতে থাকলো। এর পর একে একে রেডি হয়ে গেলাম বেরিয়ে পড়ার জন্য। আজ শনিবার। আজকের দিনটিই আছে হাতে। যা করার, যা ঘুরার আজকেই সারতে হবে।

॥ ১১ ॥
বেগম রোকেয়া স্মৃতি স্তম্ভ, সাইন্স সিটি, হলে গিয়ে সিনেমা দেখা
বিকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে ক্যাবের জন্য অপেক্ষা। কোন ক্যাব আসছে না দেখে হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে কিছুটা হেটে গেলাম ক্যাবের আশায়। সামনে কিছু ক্যাব দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবলাম দাড়িয়ে না থেকে এগিয়ে গিয়ে ক্যাব নেই। কিছুদূর হাটতে হাটতে পা থমকে গেল। কারন আর কিছুই না, একটা স্মৃতি স্তম্ভ দেখে আমরা দাড়িয়ে গেলাম। একটা ভবনের পাশে ফুটপাতে বিশাল এক মিনার। রোকেয়া মিনার। মিনারে লেখা আছে
‘নারীমুক্তি আন্দোলনের দিশারী সাহিত্যিক শিক্ষাব্রতী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ১৬২/১ আচার্য জগদীশ চন্দ্র রোড (সাবেক ১৬২ লোয়ার সারকুলার রোড) স্থিত বাসভবনে প্রয়াত হন ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২ সনে।
তিনি বাঙ্গ বাসীকে ডাক দিয়েছিলেন
‘জাগো বঙ্গবাসী, দেখ কে দুয়ারে, অতি ধীরে ধীরে করো করাঘাত।’
আমরা দাড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম বেগম রোকেয়ার স্মৃতি স্তম্ভ-‘রোকেয়া মিনার’। বাঙ্গালী নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত এই বাড়িতে শেষ নিঃস্বস্বাস ত্যাগ করেছেন, তাঁর সম্মানে এখানে স্মৃতি স্তম্ভ করা হয়েছে অথচ তা চোখে পড়লো বিদায় বেলায়। আমরা কয়েকটা ছবি তুললাম মিনার নিয়ে। কোলকাতায় বাঙ্গালী নারীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে, শ্রদ্ধা দেখিয়ে স্মৃতি স্তম্ভ করেছে, বাংলাদেশ থেকে এসে, দেখার পর দু’দন্ড দাড়াবো না তা কি হয়! এর পর আমরা একটা ক্যাব নিলাম সাইন্স সিটি যাওয়ার জন্য। কোলকাতায় দর্শনীয় স্থান লিখে গুগলে সার্চ দিলে যে কয়টা স্থানের নাম আসে তার মধ্যে সাইন্স সিটি অন্যতম। আমাদের নিয়ে ক্যাব ছুটে চলছে। অবাক করার বিষয় একটার পর একটা ফ্লাই ওভার পার হচ্ছি কিন্তু কোন পয়সা নিচ্ছে না। টোল ফ্রি ফ্লাই ওভার, এটা ভাবা যায়? অথচ বাংলাদেশে একটা ফ্লাই ওভার পার হলে ইজারাদার পারলে দুইবার টোল নিতে চায় আর এখানে কোন টোল লাগলো না। আমরা কিছুক্ষণ পর পৌছে গেলাম সাইন্স সিটিতে। সাইন্স সিটির গেটে নেমে ভাবলাম কতক্ষণ লাগে সাইন্স সিটি ঘুরতে তাই একটু চা খেয়ে নেই। গেটের পাশে অল্প কয়েকটা খাবারের ভ্রাম্যমান দোকান। কিন্তু কোন দোকানেই চা পেলাম না। অবশেষে আমরা লেবু স্তুপ করা একটা দোকানের সামনে গিয়ে লেবুর সরবত দিতে বললাম দোকানিকে। এখানে লেবুর সরবত নিয়েও কিছু বলার মত আছে। সরবত বানাচ্ছে সেটাও যেন একটা শিল্প। লেবু কেটে হাত মেশিনে চেপে রস বের করে রাখলো গ্লাসে। এর পর কিছু বিট লবন, অল্প চিনি, কিছু মসলা, ঠান্ডা সোডা ওয়াটার মিশিয়ে দিলো। চুমুক দিয়েই অন্য এক জগতে প্রবেশ করলাম। ঠান্ডা শীতলতায় হৃদয় জুরিয়ে গেল। কোলকাতায় প্রচন্ড গরম অনুভব করছিলাম। এক গ্লাস লেবু সরবত এতটা প্রশান্তি এনে দিলো যা ভাবার নয়। সরবত শেষ হতে না হতে মুরাদ মুন্সীর নজরে পড়লো কাচা ছোলা। কাচা ছোলা অর্ডার দিতেই দোকানদার বানানো শুরু করলো। কিছু কাচা ছোলা, পিয়াচ কুচি, কাচা লঙ্কা, সিদ্ধ আলু, কিছু মসলা আর তেতুলের টক মিশিয়ে কাগজে দিলো। তিনজনেই বেশ আয়েশ করে ছোলা খেয়ে সাইন্স সিটির প্রবেশ দ্বার পার হলাম। মনোরম পরিবেশে সুন্দর সাজানো গুছানো। ছোট ছোট বাহারি গাছ এমন ভাবে ছেটে রেখেছে মনে হচ্ছে সবুজ কার্পেটের নিপুন কারুকাজ। পায়ে হাটা রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ থাকলেও রাস্তায় একটা পাতা পাওয়া যাবে না। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পায়ে হাটা রাস্তা দিয়ে মূল গেটের কাছে গেলাম। দেশিয় প্রযুক্তির মাধ্যমে সুন্দর ফোয়ারা করেছে দেখার মত। জামাল ভূইয়া তিনটি টিকিট কিনলো। আমরা ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা হয়ে গেল কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থ্রিডি ভাস্কর্যের সাথে। বিভিন্ন এঙ্গেলে দেখলে ভিন্ন ভিন্ন কবি গুরুকে দেখা যায়। এক অনবদ্য কারুকাজ। এরপর পায়ে হাটা রাস্তার ধার ঘেষে সুসজ্জিত বাগানের ভিতর ইতিহাস হয়ে দাড়িয়ে আছে ভারত বর্ষের বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের ভাস্কর্য। এর মধ্যে একজন বিজ্ঞানীর ভাস্কর্য দেখে বেশ আপন মনে হলো। সত্যেন্দ্র নাথ বোস। যে বোসের থিওরি নিয়ে গবেষনা করে আজ বিজ্ঞানীরা নোবেল পাচ্ছে। ভাস্কর্যটির সামনে দাড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। ভাস্কর্যের নিচের দিকে সত্যেন্দ্র নাথ বোস এর জীবন কর্ম নিয়ে লেখা আছে ‘জন্মঃ ১৮৯৪, মৃত্যুঃ ১৯৭৪, শিক্ষাঃ এম,এসসি, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ১৯১৫, প্রোফেশনাল প্রোফাইঃ লেকচারার, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি, রিডার, ঢাক্কা ইউনিভার্সিটি, প্রোফেসর, ঢাক্কা ইউনিভার্সিটি, ভাইস চ্যান্সেলর, বিশ্ব ভারতী ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল প্রফেসর অফ ফিজিক্স, প্রেসিডেন্ট, ইন্ডিয়া সাইন্স কংগ্রেস, ফেলো, রয়েল সোসাইটি, লন্ডন, সম্মাননাঃ মেম্বার অফ পার্লামেন্ট, রাজ্য সভা, পদ্ম বিভূষণ, অনারারী ডীন ফ্রম সেভারেল ইউনিভার্সিটি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সত্যেন্দ্র নাথ বোস এর ভাস্কর্য দেখে একটু এগিয়ে গেলেই ছোট লেক। লেকের ভিতর প্লাস্টিকের বালতি দিয়ে সুন্দর একটি বৈজ্ঞানিক শিল্পকর্ম। লেকে বিভিন্ন প্রকার মাছ সাতার কাটছে। বিশেষ করে তেলাপিয়া মাছ, বড় সাইজের পাঙ্গাস মাছ চোখে পড়ার মত। আমরা লেকের পার ধরে এগিয়ে যাওয়ার পর বিশাল এক ডাইনোসর হা করে আছে। আসলে ওটা একটা গুহা বা টানেল তৈরী করা হয়েছে। এ প্রান্তে হা করা মাথা, আর পিছন দিকে বিশাল লেজ। ডাইনোসরের সামনে অনেক গুলো বেঞ্চ পাতা আছে। বসতে গিয়ে হাত দিয়ে সিটে একটু টান দিয়ে দেখে নিলাম, ময়লা আছে কিনা। হাত উঠিয়ে দেখি যেমন হাত তেমনই আছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বেঞ্চ, একটুও ধুলা ময়লা নেই। আমাদের দেশে হলে পা উঠিয়ে টোকাইরা-ভবঘুরে-বখাটেরা শুয়ে থাকতো। অথচ মনে হয় কিছুক্ষণ আগে মোছা দেয়া। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা হেটে হেটে পাতা কুড়িয়ে পরিস্কার করছে। লেকের পানিতে, ফোয়ারার পানিতে পাতা পড়ছে আর কিছুক্ষণ পর পর পরিচ্ছন্ন কর্মীরা নেট দিয়ে তুলে নিচ্ছে। অন্য কিছু দেখার চাইতে এগুলোই বেশি নজরে আসছে। সাইন্স সিটির ভিতর দিয়ে রাস্তায় সিটির নিজস্ব যন্ত চালিত গাড়িতে চলে ঘোরা যায়। আস্তে আস্তে চলছে গাড়িটি, একাধিক বগি নিয়ে তৈরী গাড়িটি হর্ণ বাজিয়ে বাজিয়ে চলছে। আমরা সিটির ভিতরের বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিতে নিতে পরিকল্পনা করছি এবার কি করা যায়? সিটির ভিতরে ক্যাবল কার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে, জীবন রহস্য নিয়ে চলচ্ছিত্র প্রদর্শন আরো নানা ইভেন্ট আছে।
সায়েন্স সিটিঃ কোলকাতার একটি বিজ্ঞান সংগ্রহালয় ও বিজ্ঞান কেন্দ্রিক বিনোদন উদ্যান। এটি ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনস্থ জাতীয় বিজ্ঞান সংগ্রহালয় পরিষদের অধিভূক্ত একটি বিজ্ঞানকেন্দ্র। পূর্ব কলকাতার ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস ও জে বি এস হ্যালডেন অ্যাভেনিউ-এর সংযোগস্থলে ৫০ একর জমির উপর সায়েন্স সিটি অবস্থিত। ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই সায়েন্স সিটি উদ্বোধন হয়। সায়েন্স সিটি স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কলকাতাবাসীর কাছে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলা।
সায়েন্স সিটির বিভিন্ন ইভেন্ট দেখতে এক বিকাল লেগে যাবে। তাই সাইন্স সিটি এখানেই দেখা শেষ করলে কেমন হয়? আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কোলকাতায় এলাম আর সিনেমা হলে এক শো সিনেমা দেখবো না এটা কি হয়! সাথে সাথে শরীয়তপুর বাসীর জন্য কোলকাতায় পরম মিত্র অতনু ঘটক চৌধুরীকে ফোন দিলাম। এখানে অতনু ঘটক চৌধুরী সম্পর্কে একটু না বললেই নয়। শরীয়তপুর জেলার পালং ইউনিয়নের দীর্ঘ কালের চেয়ারম্যান শরীয়তপুর জেলা গঠনের অন্যতম সংগঠক কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র কবি রথীন্দ্র কান্ত ঘটক চৌধুরী। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এক চিঠিতে লিখেছিলেন আমার রথীন বাংলা জানে। সেই রথীন্দ্র কান্ত ঘটক চৌধুরীর নাতি অতনু ঘটক চৌধুরী। অতনু কোলকাতায়ই থাকে। শরীয়তপুর থেকে যত লোকই কোলকাতা আসে সে চিকিৎসার জন্য হাক আর ভ্রমনের জন্যই হোক তাদের অতনু সহযোগীতা করেনি এমনটি হয়নি। আমরা যাওয়ার পর শত ব্যস্ততায়ও সে বার বার ফোন করে আমাদের খোজ খবর নিয়েছে এবং পরামর্শ দিয়েছে। যেহেতু সিনেমা দেখবো তাই প্রথম পছন্দের ছবি হলো সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া বহুল আলোচিত বিগ বাজেটের ছবি বাহুবলী টু। অতনুকে ফোন দিলাম বাহুবলী টু কোথায় চলে, কয়টায় শো, কিভাবে যাব আমাদের একটু জানানোর জন্য। অতনু আমাকে একটু পরে যানাচ্ছি বলে ফোন রাখলো। কিছুক্ষণ পরেই ফোন বেজে উঠলো। ধরতেই আমাদের জানালো প্যারাডাইস হলে বাহুবলি টু চলে, সিনেমা হলটি বড় বাজারে। পরবর্তী শো সন্ধা ছয়টায়। আপনারা সাইন্স সিটি থেকে একটা ক্যাব নিয়ে সোজা চলে যান সিনেমা হলে। আমরা একটা ক্যাব নিলাম। যেতে যেতে দেখা হলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে করা সড়কের সাইন বোর্ড। বঙ্গবন্ধু সড়ক দিয়ে যেতে যেতে নিজেদের মধ্যে বেশ উচ্ছসিত ভাব দেখা গেল। আমরা যে দেশ থেকে এসেছি সেই দেশের স্থপতির নামে ভিন্ন কোন দেশে সড়ক এটা একটা গর্বের বিষয়। বঙ্গবন্ধু সড়ক দিয়ে যেতে যেতে আবার ফ্লাই ওভার। সাইন্স সিটি থেকে বড় বাজার দীর্ঘ পথ সামান্য সময়ে চলে আসলাম। কোন ট্রাফিক জ্যাম নেই। শুধু আছে ট্রাফিক সিগনাল। সামনে রাস্তা ফাকা, রাস্তার ধারে কোন ট্রাফিক পুলিশও দাড়িয়ে নেই, কোন সিসি ক্যামেরাও নেই। তারপরও ড্রাইভাররা এখানে এক ইঞ্চি আগায় না। নিয়ম মানে বলেই কোন জ্যাম নেই। কোলকাতার রাস্তাগুলো ওয়ান ওয়ে। প্যারাডাইস হলের সামনে নামালে ড্রাইভারের অনেক দূর ঘুরতে হবে তাই আমাদের নামিয়ে দিলো কেসি দাসের মিষ্টির দোকানের কাছে। কেসি দাসের মিষ্টির দোকানের বিপরীতেই টিপু সুলতান মসজিদ। অনেক গুলো গম্ভুজ দিয়ে তৈরী টিপু সুলতান মসজিদটি দেখতে অনেক সুন্দর। রাস্তার এপার থেকেই আমরা মসজিদটি দেখতে দেখতে প্যারাডাইস হলের সামনে চলে গেলাম। হাতে বেশ সময় আছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম একটু চা খেয়ে নেই। জামাল ভূইয়া তিনটা টিকিট কেটে নিয়ে এলো। হলের সামনে কিছু দোকান আছে। মুরাদ মুন্সীর খিদে পেয়েছে। বললো, আগে কিছু খেয়ে নেই তারপর চা খাব। হলের সামনে ভাপা পিঠার মত দেখতে গোল গোল কিছু পিঠা নিয়ে বসে আছে একজন। আমরা জানতে চাইলে জানালো,
-এগুলোকে ইটলি বলে।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম কেমন খেতে,
-কিভাবে খায়। দোকানী বললো,
-এগুলো টমেটো সস, চাটনি, টক দিয়ে খেতে হয়। এগুলো সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার। তিন পিস বিশ টাকা।
আমরা লোকও আছি তিনজন। বললাম এক প্লেট দেন। দোকানী আমাদের একটি প্লেটে তিনটি ইটলি দিল। ইটলির উপরে কিছু টমেটো সস, শরিষা বাটা, তেতুলের টক, লবন দিয়ে দিলো। তিনজনে তিনটি ইটলি পুরোটাই খেলাম। বিল মিটিয়ে রাস্তার ওপারে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ অব কোলকাতা বিল্ডিং এর পাশে ফুটপাতের দোকানে চায়ের অর্ডার দিলাম। মাটির ভাড়ে তিনটা চা দিলো। টগবগে গরম চা হাতে নিয়ে বেশিক্ষণ রাখতে পারলাম না। বিস্কিটের বয়ামের উপর রেখে হাম কচলাতে শুরু করলাম। চা খেয়ে চলে গেলাম হলের গেটে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গেট খুলে দিলো। আমরা সুশৃঙ্খল ভাবে হলের ভেতরে প্রবেশ করলাম। একটা শো শেষ হয়েছে। প্রবেশ দ্বার দিয়ে কোন লোক বের হলো না। সিনেমা শেষে হল থেকে বাহিরের রাস্তা আলাদা। আমরা ভতরে প্রবেশ করে ওয়াশ রুমে গিয়ে একটু হালকা হয়ে নিলাম। দীর্ঘক্ষণ ছবি দেখবো, তাই কেউ রিক্স না নিয়ে ফ্রেশ হয়ে দোতলায় ডিসি রুমে চলে গেলাম। টিকিট চেকার আমাদের সিট দেখিয়ে দিলো। আমরা হলের বাম কোনের দিকে তিনটা সিট পেলাম। বসে পড়লাম তিনজন। কোন সময় ক্ষেপণ না করে যথাসময়ে শুরু হয়ে গেল বাহুবলি টু। বাহুবলীর পরিচালক এস এস রাজামৌলীর নির্মান শৈলীর প্রশংসা না করে পারা যায়না। ইতিহাস নির্ভর চলচ্ছিত্রটিতে প্রতিটি পদে পদে রয়েছে রোমাঞ্চ। ভালবাসা ও যুদ্ধ বিগ্রহের সংবিশ্রণে তৈরী ছবিটি দেখে বেশ তৃপ্তি পেলা। ছবিটিতে মানবিকতার পাশাপাশি আছে মিরজাফরি। পুত্র মায়ের সাথে যে প্রতারণার দৃশ্য দেখলাম তা যুগে যুগে ঘটেছে। বাংলার শেষ নবাব সিরাজ দৌলার সাথেওতো প্রতারনা হয়েছিল, মনে পরে গেল সেই সব ইতিহাসের কথা। ছবি দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও হল থেকে বেরিয়ে আরেক বিপদ। জামাল ভূইয়ার ভিতরে প্রচন্ড নি¤œচাপ আন্দোলিত হচ্ছে। আমরা যেহেতু হল থেকে বেরিয়ে গেছি তাই আর ভিতরে প্রবেশ করতে পারছি না। আমরা বের হওয়ার সাথে সাথে পরবর্তী শো চালু হবে তাই লোক প্রবেশ করছে। হলে থাকাবস্থায় চাপ এলে সারতে পারতো। কিন্তু এখন কি করা যায়। সিদ্ধান্ত হলো হোটেলে চলে যাই, ভূইয়ার নি¤œ চাপ কমিয়ে তার পরে নিচে নেমে খাওয়া দাওয়া সারবো। কিন্তু জামাল ভূইয়া জানালো, চাপ কিছুটা কমেছে। হোটেলে যাওয়া অতটা জরুরী নয়। বর্তমানে সহনশীল অবস্থায় আছে। আমরা এবার একটু স্বস্তির নিঃস্বাশ ছাড়লাম। এর পর শুরু হলো ক্যাব ডাকা। মোড়টায় ক্যাব পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা ক্যাব পেলাম। দরদাম করে উঠে বসলাম। ড্রাইভার আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলো। সময় ঘনিয়ে আসছে। রাত পোহালেই চলে যাব দেশে। আনন্দ ও বেদনার এক সংমিশ্রণে মিশেল অনুভূমি। থাকতেও মন চাইছে না, আবার যেতেও ইচ্ছে করছে না। যাহোক, আমরা হোটেলের সামনে নেমে আর উপরে উঠলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম একবারে খেয়ে হোটেলে উঠবো। কোলকাতা এসে প্রথম যে হোটেলটায় রাতের খাবার খেয়েছিলাম, সেই লাজিজ বিরিয়ানিতে শেষবারের মত রাতের খাবার খেলে কেমন হয়? সবাই একমত হলাম আজও বিরিয়ানিই খাব। লাজিজ হোটেলে যাওয়ার পর হোটেল মালিক আমাদের চিনতে পারলো। দেখেই বেশ সমাদর করে বসিয়ে হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে বললো, কি দেব দাদা। আমরা বিরিয়ানি দিতে বললাম। ওদের এখানে চায়ে ছোট বড়, সিগারেটে ছোট বড়, বিরিয়ানিতে ছোট বড়, সব কিছুতেই ছোট বড় আছে। আমরা বাঙ্গালী, বাংলাদেশী। আমাদের সব কিছু বড়, হৃদয় বড়, হাত বড়, আত্মা বড়, পেট বড়, খাওয়ার চাহিদাও বড়। আমরা বড় দিতে বললাম। মুরাদ মুন্সী আলু দিতে বললো দুই টুকরা। খাসির বিরিয়ানি, সাথে আলু, পিয়াচের সালাদ, কাচা লঙ্কা, লেবু। বেশ আয়েশ করে রাতের খাবার খেয়ে প্রথম দিনের সেই পুলিশ বক্সের পিছনের চা। মুরাদ মুন্সী আর চা নিলো না, আমি আর জামাল ভূইয়া মাটির ভারে চা খেলাম। এরপর হোটেলে গিয়ে প্রতিদিনের মত ফ্রেশ হয়ে ফেসবুকিং, ছবি আদান প্রদান। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ব্যাগ গুলো গুছিয়ে ছোট করে ফেললাম কিন্তু সেই বড়ই হয়ে গেল, বাঙ্গালি যে। সকালে পড়ার কাপড় চোপর রেখে বাকি সব গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্তির ঘুম এসে চুমু দিলো দুচোখে।

॥ ১২ ॥
কোলকাতার জীবন যাত্রাঃ
রিক্সা বিহীন সড়ক, ওয়ান ওয়ে, যত্র তত্র ট্যাক্সি ক্যাব, পোশাক পরিচ্ছদ, ওড়না বিহীন চলাচল, সুপেয় পানির সু ব্যবস্থা, কর্পোরেট দায়িত্ববোধঃ
স্বল্প সময় কোলকাতা ভ্রমনে কিছু বিষয় হৃদয়ে দাগ কেটেছে। কিছু বিষয় ভাল লেগেছে, কিছু বিষয় খারাপ লেগেছে। সব বিষয় ভাল লাগবে এমন কোন কথা নেই। এত দেশের গালি আরেক দেশে বুলি। আমাদের দেশের চুল এখানে এসে দেখি বাল। ভিন্ন দেশ ভিন্ন পরিবেশ। ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ কিছু মেলে কিছু মেলে না। তারই কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই এখানে।

রিক্সা বিহীন সড়ক
রাস্তায় নামলে মনে হবে একদম ফাকা রাস্তা। চলতি পথে ট্রাফিক সিগনাল ছাড়া গাড়ির কোন জ্যাম নেই, সিগনাল গুলোতেও যে জ্যাম আছে তা কিন্তু নয়। এর অন্যতম কারন হলো রিক্সা বিহীন সড়ক। মূল সড়কগুলোতে কোন রিক্সা চোখে পড়বে না। রিক্সা যে নেই তাও না। কিছু রিক্সা আছে প্যাডেল চালিত, কিছু রিক্সা মানব চালিত। মানব চালিত রিক্সা গুলো আমার কাছে অমানবিক লেগেছে। মানুষ বসে আছে আর একজন লোক তার বুক দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দিতে এমন কষ্টকর কাজ আর হতে পারে না। অনেকটা ঠেলাগাড়ির মত করে চালাচ্ছে। বাবুদের মত করে আরোহী বসে আছে আর একজন ভৃত্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তবে রিক্সা আর আদম টানা রিক্সা যাই হোক না কেন সবই চলে গলির ভিতর দিয়ে। তারা কখনো ব্যস্ত সড়কে ওঠে না। আর এ কারনেই রাস্তায় কোন জ্যাম নেই। মানবিকতার দোহাই দিয়ে আমাদের দেশে রিক্সা চলাচল বাতিল করা যায় না। এতে আমাদের ক্ষতিই হচ্ছে। আমাদের দেশের রাস্তায় নিয়ম নীতিহীন ভাবে নেমেছে রিক্সার পাশাপাশি নতুন জঞ্জাল অটোবাইক। বিদ্যুতের বারোটা বাজিয়ে রাস্তায় অযথা জঞ্জাল তৈরী করেছে। রিক্সা, অটোবাইক উঠিয়ে দিয়ে অধিক পরিমানে গণ পরিবহন নামিয়ে দেয়া উচিত। রিক্সা আর অটো চালকরা কি করবে সেটা তারাই ঠিক করে নেবে। যার যার যোগ্যতা অনুযায় কাজ খুজে নেবে। অযোগ্য লোক রাস্তায় বেরিয়ে জীবণের চাকা স্লত করে দেবে এটা কোন মানবিকতা হতে পারে না। রাষ্ট্র বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে অযোগ্য লোকগুলোকে দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তর করলেই সমাধান হতে পারে। মানবিকতার দোহাই দিয়ে অর্থনীতির চাকা মন্থর করার কোন যক্তি নেই।

ওয়ান ওয়ে রোড, যত্র তত্র ট্যাক্সি ক্যাব
রাস্তায় দাড়িয়ে আপনাকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। আপনি যদি হাত উচু করে বগল চুলকান তবেও দুচারটা ক্যাব দাড়িয়ে যাবে, বলবে দাদা কোথায় যাবেন। আছে আধুনিক ব্যবস্থাও। উবার বা ওলে অ্যাপস মোবাইলে ডাউনলোড করে নিলে আপনি যেখানে যাবেন, কোথায় আছেন লিখে সার্চ দিলেই বিভিন্ন ক্যাটাগরির ক্যাব চলে আসবে। এত আধুনিক ব্যবস্থা যা মানুষকে আরো স্বস্তি দিয়েছে। কোলকাতার রাস্তাগুলো সবই ওয়ান ওয়ে। সকালে যে রাস্তা দিয়ে যাবেন বিকালে সে রাস্তা দিয়ে যেতে পারবেন না। ওয়ান ওয়ে হওয়ার কারনে কোন জ্যাম থাকে না রাস্তায়। আর ট্রাফিক আইন সহ আইন মানার প্রবনতা গড়ে উঠেছে কোলকাতা বাসির মধ্যে। রাস্তা ফাকা পেলেও কেউ আইন ভাঙ্গছে না। একারনে কোলকাতার ড্রাইভারদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধটাও বেড়ে গেছে। আমাদের দেশে ক্যাব কালচারটা সিন্ডিকেটের হাতে না রেখে সেটা সার্বজনীন করা উচিত। ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী একজন দক্ষ ড্রাইভার যদি ক্যাব নামাতে চায় তবে তাকে সহযোগীতা করা উচিত বলে আমার কাছে মনে হয়। যোগ্য লোক ক্যাব চালালে রাস্তায় কাউকে দাড়িয়ে থাকতে হবে না। আমাদের দেশে পঞ্চাশ টাকায় রিক্সাও যেতে চায় না আর কোলকাতায় ত্রিশ-চল্লিশ টাকার বিনিময়ে ক্যাবে চড়ে রাজকীয় হালে ঘুরতে পারবেন। কোন গন্তব্যই ছোট করে দেখে না এখানকার ড্রাইভাররা। আমাদের দেশে দূরপাল্লায় যাওয়ার আশায় মোড়ে মোড়ে রিক্সা, অটো, ক্যাব সবাই দাড়িয়ে থাকে। অল্প দূরত্ব যেতে চাইলে তাদের গাল ওঠে না। প্রয়োজনে দাড়িয়ে থাকবে, রিক্সার সিটে বসে বসে বিশ্রাম নেবে, আর ফুটপাত নিজের বাপের জায়গা মনে করে জ্যাম তৈরী করবে। নীতি নির্ধারকদের এসব ক্ষুদ্র বিষয়ে বৃহৎ চিন্তা করা উচিত।

পোশাক পরিচ্ছদ, ওড়না বিহীন চলাচল
এখানকার মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। বৃদ্ধ বয়সের মানুষজন একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর একটা শর্ট প্যান্ট পড়ে বাড়ির সামনে বসে আছে বা দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করছে। তবে মেয়েরা এখানে বেশ আধুনিক। মেয়েরা এখানে ওড়না খুব একটা পড়ে না বললেই চলে। আধুনিকতার শ্রোতে গা ভাষিয়ে দিয়েছে সবাই। জিন্স প্যান্ট সাথে টিশার্ট জাতীয় পোশাকই বেশি ব্যবহার করে। কামিজের ক্ষেত্রে শর্ট কামিজ কিন্তু কেউই ওড়না ব্যবহার করে না। কালে ভদ্রে ওড়না দেখা যায়, তা গণায় ধরার মত নয়। একশত তাল গাছের বাগানে একটা চন্দন গাছ থাকলে তাকে যেমন কেউ চন্দন বাগান বলবে না তেমনি আরকি। এখানকার মেয়েরা বেশ সাহসি। ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করছে, পড়াশুনা করছে, ঘুরছে ফিরছে, কোন জড়তা দেখলাম না। মার্কেটগুলোতে গেলে মনে হবে স্ফীত বক্ষ প্রদর্শনী চলছে। পাঠক হয়তো ভাববেন আমার নজর খারাপ। আসলে আমার নজর খারাপ না, আমি যা দেখেছি, তই উপস্থাপন করলাম মাত্র। ভাল-খারাপের সংমিশ্রনে এক অনন্য অনুভূতি।

সুপেয় পানির সু ব্যবস্থা, কর্পোরেট দায়িত্ববোধঃ
রাস্তার মোড়ে মোড়ে সুপেয় পানির সু ব্যবস্থা করা আছে। তাও ঠান্ডা পানিয় জলের সু ব্যবস্থা। সরকার নয়, বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানি তাদের দায়িত্ববোধ থেকে পানিয় জলের ব্যবস্থা করেছে, সরকার তাদের সহায়তা করেছে মাত্র। যেমন আমাদের হোটেলের পাশেই সেন্ডো গেঞ্জি-আন্ডার ওয়ার কোম্পানি রুপা একটা প্লান্ট করেছে। ঠান্ডা ও শোধন করার মেশিন বসিয়ে দিয়েছে। মানুষ পানি নিয়ে যাচ্ছে। তবে কেউ পানি নেয়ার পর কল খুলে রাখে না বা সুযোগ পেলে কল চুরিও করে না। আমাদের দেশে যেভাবে পানি বিক্রি হয় সেখানে এতটা হয় না। আমরা পানির বোতল কিনে খেয়ে যত্রতত্র খালি বোতল ফেলে আবর্জনার স্তুপ তৈরী করছি। তাদের কর্পোরেট দায়িত্ববোধ দেখে বেশ ভাল লাগলো, আফসোস হলো, আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোর মধ্যে এ দায়িত্ববোধটা কি জাগ্রত হলে খুব বেশি ক্ষতি হতো?

॥ ১৩ ॥
ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনে ভোগান্তি
রবিবার সকাল। ঘুম থেকে চোখ মেলেই দেখি জামাল ভূইয়া ফ্লোরে দাড়িয়ে জামা কাপড় পড়ছে। মাঝে মাঝে তাগিদ দিচ্ছে ওঠার জন্য। বুঝলাম বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে। বেড়িয়ে পড়তে হবে মাটির টানে, আপন ঘরে। আস্তে আস্তে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে কাপড় চোপর পড়ে নিলাম। রুমে কিছু ফেলে গেলাম কিনা চেক করে বেরিয়ে পড়লাম। নিচে নেমে কাউন্টারে চাবি জমা দেয়ার পর ম্যানেজার লোক পাঠালো রুম চেকের জন্য। সবকিছু ঠিকঠাক আছে। হোটেলের ম্যানেজার আমাদের তিনজনকে হোটেলের লোগো লাগানো তিনটা চাবির রিং উপহার দিয়ে আবার আসার জন্য আমন্ত্রন জানালো। বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। বেরোবার আগে হোটেল বয়দের ও দাড়োয়ানকে বকসিস দিতে ভুল হলো না। আমরা বাঙ্গালি। আমাদের শরীরের চাইতে কলিজা বড় দেখিয়ে দিলাম আরকি। রাস্তায় বেরিয়ে একটা প্রাইভেট কার চালক আমাদের ডাকলো। দরদাম করে উঠে গেলাম শিয়ালদহ স্টেশনে যাওয়ার জন্য। বারতি ইনকামের জন্য সকালে গাড়ি চালায় লোকটা। হয়তো নিজের গাড়ি অথবা বসের গাড়ি ফুয়েল লোড করতে এসে একটু নাস্তার পয়সা জোগার করছে। আমরা অল্প সময়ের মধ্যে চলে এলাম শিয়ালদহ স্টেশনে। যথারীতি কোন টানা হ্যাচরা ছাড়া নিজেদের ব্যাগ নিজেরা নিয়ে স্টেশনের বারান্দায় দাড়ালাম। জামাল ভূইয়া টিকিট কিনে নিয়ে এলো। সকালে যেহেতু আগে আগে ঘুম থেকে উঠেছি তাই খুধাও আগে আগেই লেগে গেছে তা পেটের মোচরামুচরিতে টের পেলাম। স্টেশনের একটি দোকান থেকে কেক, পানি কিনে নিয়ে বনগাঁও স্টেশনমুখী প্লাটফর্মের দিকে রওয়ানা দিলাম। প্লাটফর্ম খুজে নিয়ে কিছুটা অপেক্ষা করতেই চলে এলো ট্রেন। আমরা আবারও জানালার পাশে সিট নিয়ে বসে পড়লাম। আমাদের যাওয়া আসায় বসা নিয়ে কোন ঝক্কি পোহাতে হলো না। সঠিক সময়ে সঠিক গন্তব্যর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিলো ট্রেন। আস্তে আস্তে বারছে গতি, একে একে পিছনে ফেলছে একেকটা স্টেশন, আর দুরত্ব বারাচ্ছে কোলকাতার সাথে আমাদের। একসময় কোলকাতার প্রাণকেন্দ্রে ছিলাম। এখন একটা দুটা করে স্টেশন পার হচ্ছি। হৃদয়ে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো নাড়া দিচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে কোলকাতার জন্য। বাংলাদেশে যাচ্ছি, নিজের মাতৃভূমিতে। নিজের স্বজনদের কাছে পাবো, সেই আনন্দে বুকটা ভরে উঠছে। এ যেন মুদ্রার দুটি পিঠ। আমি তাকিয়ে আছি কখন আসবে দত্তপুকুর স্টেশন। যেখানে থাকে আমার বন্ধু সুশান্ত কুমার কংসবণিক, দীপক কুমার কংসবণিক। দত্তপুকুর স্টেশনটার কথা হৃদয়ে গেথে আছে সেই সুদীর্ঘ কাল থেকে। বন্ধু তো অনেক থাকে। কিন্তু হৃদয়ের কাছাকাছি অবস্থান করে আর কয়জন! সুশান্ত হৃদয়ের খুব কাছে থাকা বন্ধু। তাইতো হৃদয়ের টানে ছুটে গেছে কোলকাতা। যখন শুনেছে আমি কোলকাতা আসছি। বাড়িতে কেন গেলাম না, হোটেলে কেন উঠেছি নানান অনুযোগ, অভিযোগ। ‘দাদা খেয়ে এসেছেন না যেয়ে খাবেন, পরের বার আসলে খেয়ে যাবেন কিন্তু’ কোলকাতা নিয়ে এমন নানান গাল গল্প শুনেছি অনেক। কিন্তু সুশান্তর ভালবাসা, আতিথেয়তা, আগ্রহ ও আবেগের মধ্যে তেমনটা পাইনি। বন্ধু যেখানেই থাকে বন্ধুকে ভুলতে পারে না। আমরা দেখতে দেখতে দত্তপুকুর স্টেশনে এসে থামলাম। পৌছামাত্রই মনে হলো আপন জায়গা, যেখানে আমার বন্ধু থাকে। সামান্য সময় থেমে কিছু লোক নামিয়ে কিছু লোক উঠিয়ে আবার ছুটে চললো ট্রেন তার গন্তব্যের দিকে। দত্তপুকুর থেকে যতই দূরে যাচ্ছে হৃদয়ে বন্ধুর জন্য কষ্টটা ততই বারছে। একসময় ছোখের আড়ালে চলে গেল স্টেশনটি। আমরা চলে এলাম বনগাঁও স্টেশন। যার যার ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের মূল গেইট দিয়ে না বের হয়ে বের হলাম পাশের রাস্তা দিয়ে। বড় একটা তেতুল গাছের কাছে বেবি স্টেশন। লোক হবে দুইশ আর বেবি নাই একটাও! একটা আসে তো দীর্ঘ লাইন থেকে পাঁচজন তুলে দেয় সিরিয়াল ম্যান এক দাদা। প্রচন্ড রোদে কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকা যায়! আমরা লাইন ছেড়ে দিয়ে চলে আসলাম সামনের প্রধান সড়কে বেবি রিজার্ভ করে নেব সেই চিন্তা করে। কিন্তু কোন বেবি রিজার্ভ যাবে না লাইন ছেড়ে, কারন পরে এসে আর লাইনে ঢুকতে পারবে না। আবার লাইনে এসে দেখি লাইন আরো দীর্ঘ হয়েছে। আমাদের পিছনে দাড়াতে হবে। সকালে একটুকরা কেক আর পানি খেয়ে কি আর পেট ভরে? আমরা পাশের একটা দোকানে গেলাম নাস্তা করতে। ছোট দোকান যাকে বলে কমদামি হোটেল। আমাদের দেশের হোটেল ছালাদিয়া এর চেয়ে অনেক ভাল। তবে দোকানের বিশেষত্ব হলো এর পরিচালকরা সবাই মধ্য বয়সি মহিলা। আমরা ভাত চাইলাম। আমাদের ভাত, আলু ভর্তা, আলুর ফ্রেঞ্চফ্রাই এর মত দেখতে আলু ভাজি, কাচা লঙ্কা, পিয়াচ দিল সাথে পাতলা ডাল। আমরা তিনজনের জন্য তিনটা ডিম দিতে বললাম। সকাল বেলার ভাত ভাজি ডাল ডিম ভাজা দিয়ে খেতে যে কত মধুর লাগে তা টের পেলাম। মোটা মোটা কাচা মরিচ আমার মত সাস্থ্য। কচকচিয়ে খেয়ে আবার চাইলাম। মরিচ নামেই কামে না। একটুও ঝাল নেই। তবুও তৃপ্তি সহ খেয়ে পেট ঠান্ডা করে নিলাম। কারন মাথা তো ঠান্ডা হবে না। উপরে প্রচন্ড গরম, তার উপরে গাড়ি পাচ্ছি না। তাই মাথা প্রচন্ড গরম। হোটেলের মহিলারা ভিতর থেকে বোতলজাত বিয়ার বিক্রি করছে মজুর টাইপের লোকদের কাছে। একটু গোপনে গোপনে বের করে দিচ্ছে আর মজুর শ্রেণীর লোকগুলো গামছা দিয়ে ঢেকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। গোপনে বিক্রি করলেও আমাদের চোখ এড়াতে পারলো না। খাবার বিক্রির সাথে মহিলারা বিয়ারও বিক্রি করে!! খাওয়া শেষে হোটেল থেকে বেরিয়ে লাইন ম্যানকে ঝারি দিলাম, দাদা আমরা নাস্তা খেতে গিয়েছিলাম, আমাদের সিরিয়ালটা দিয়ে দিন, আমাদের একটা বেবি রিজার্ভ দিন। লোকটা আমাদের ছায়ায় দাড়াতে বললে আমরা একটু আস্বস্ত হলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা বেবি আসার সাথে সাথে আমরা তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে আমরা অনেক ক্ষণ যাবৎ দাড়িয়ে আছি। লোকটি আমাদের বেবিটি দিয়ে দিলো। উঠে পড়লাম তিনজন। বেবি চলতে থাকলো বেনাপোলের দিকে। কিছুক্ষণ পর বেনাপোল বর্ডারে নেমে আমরা লাইনে না দাড়িয়ে ভিতরে ঢোকার ফন্দি আটতে থাকলাম। কিন্তু কাউকে পেলাম না। এরই মধ্যে অনেক লোককে ভিতরে প্রবেশ করতে দিলো। আমরা ভাবলাম এই বুঝি ইমিগ্রেশন ফেস করবো। কিন্তু আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল একটি সেডের নিচে। যেখানে লোক দাড়িয়ে আছে কম হলেও তিন হাজার। একবার যেহেতু ফাইলে ঢুকে পড়েছি আর বেরোবার উপায় নেই। আমি যেহেতু একটু বেশি ভারি তাই আমার দায়িত্ব হলো ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে থাকা। আর জামাল ভূইয়া ও মুরাদ মুন্সী লাইনে দাড়িয়ে সাপের মত পেচিয়ে পেচিয়ে মূল সিরিয়ালে আসার জন্য দড়িয়ে থাকলো। আমি ব্যাগগুলো একজায়গায় রেখে বসে পড়লাম। দাড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা করছে। দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের সিরিয়াল আসে না। মাঝে মধ্যে লাইনে কে আগে ছিল কে পিছে ছিল তা নিয়ে মারামারি করছে যাত্রীরা। ইন্ডিয়ান পুলিশ এসে চর থাপ্পর দিয়ে আবার সোজা করছে। তিনজন বিএসএফ জওয়ান ভারি অস্ত্র নিয়ে দাড়িয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে শরনার্থীরা যেন দাঙ্গা না বাধায় তার জন্য রেডি তারা!! লাইনের শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা ইমিগ্রেশন অফিসার মাঝে মাঝে কিছু লোক যেতে দিচ্ছে। লাল জামা গায়ে জড়ানো কুলিরা যখনই সুন্দর বেটে করে অফিসারটার সাথে কানে কানে কথা বলে তার কিছুক্ষণ পরই এমন দলছুট লোক যেতে পারছে। বুঝলাম সুন্দর লোকটার মাঝে লুকিয়ে আছে এক অসুন্দর দুর্নিতিবাজ চরিত্র। দীর্ঘ তিন ঘন্টা দাড়িয়ে থেকে সবাই ক্লান্ত আর বিরক্ত। সিদ্ধান্ত নিলাম আর ইন্ডিয়া আসবো না, যদি আসি তবে বাই এয়ারে আসবো, ল্যান্ড পোর্ট দিয়ে নয়। এবার আমাদের সিরিয়াল আসবে দেখে আমি ব্যাগ নিয়ে লাইনের মাথার কাছে দাড়ালাম। সিরিয়াল ডাক পড়ার সাথে সাথে যার যার ব্যাগ নিয়ে ছুটে চললাম ইমিগ্রেশন বিল্ডিংয়ের দিকে। ইমিগ্রেশন বিল্ডিংয়ের ভিতর এসি চলছে। কিন্তু সবাই ঘামছে। সেডে দাড়িয়ে সবাই বেশ গরম হয়ে গেছে, এখানকার এসিও ঠান্ডা করতে পারছে না। ভিতরে গিয়ে সিরিয়ায়ে দাড়িয়ে পাসপোর্ট দিলাম। ছবি তুলে, নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে পাসপোর্টে সিল মেরে ছেড়ে দিলো কাস্টমসের হাতে। পরের রুমে যাওয়ার সাথে সাথে শুরু হলো ব্যাগ তল্লাশির ভান। এক পুলিশ বলেই ফেললো, তিনছ টাকা দিন। আমি আর মুরাদ মুন্সী একসাথেই আছি। জামাল ভূইয়া আমাদের পিছনে ফেলে আগে চলে গেছে। মুরাদ মুন্সী ও আমার কাছে টাকা চাওয়ার পর বললাম সব টাকাতো আপনাদের দেশে খরচ করে এসেছি, এখন বাড়ি যাওয়ার ভাড়াটাও নেই, আপনাকে দিব কোথা থেকে? নাছোর বান্দা ছোটলোক বুঝে গেলাম তাই মুরাদ মুন্সী একশত টাকা বের করে দিলো। অমনি আমাদের দুজনকে ছেড়ে দিলো। ওদের চাহিদাও ছোট তাই অল্প প্রাপ্তিতেই খুশি। আমরা দুজন এগিয়ে গেলাম ইন্ডিয়ার পবেশদ্বারে। গেট পার হতেই নো-ম্যান্স ল্যান্ড। ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনের ভোগান্তি শেষে শান্তির এক সুবাতাশ বইছে। প্রাণ ভরে নিঃস্বাস নিলাম। আহ! কি শান্তি। এবার ঢুকে গেলাম বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন এলাকায়।

॥ ১৪ ॥
বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে শান্তি
বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে তেমন একটা ভির নেই। বিশ পচিশ জনের সিরিয়াল। লাইনে দাড়াতেই আমাদের পাসপোর্টে সিল দিয়ে দিলো। ব্যাগ চেক করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কাস্টমস এরিয়া পার হয়ে বেরিয়ে গেলাম। আমাদের পরিচিত এক সহযাত্রী শরীয়তপুর গামী ফেম গাড়ীর কাউন্টারে পৌছে গেছে। সেখানে গিয়ে মুরাদ মুন্সীকে ফোন দিল, আপনারা কি ফেম গাড়িতে যাবেন? মুরাদ মুন্সী জানালো, আমাদের জন্য তিনটা সিট রাখেন। আমরা বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পার হয়ে বের হতেই এক যুবক এসে জানতে চাইলো আপনারা তিনজন কি ফেম গাড়িতে যাবেন বলেছেন? আমরা জানতে চাইলাম, আপনি কে? সে জানালো, আমি ফেম গাড়ির স্টাফ। আমার কাছে ব্যাগ দেন। প্রথমে আমরা একটু অবিশ্বাস করলেও পরে মনে হয়েছে, লোকটা কাউন্টারে জানানোর পর কাউন্টার থেকে যুবককে পাঠিয়েছে। যুবকটি জামাল ভূইয়ার ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে গেল। আমি আর মুরাদ মুন্সী আস্তে আস্তে কাউন্টারে গিয়ে দেখি এডভোকেট আসাদ খান মামা কাউন্টারের সামনে বসে আছে। আমরা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কাউন্টারের পাশে একটা হোটেলে দেশি মাছ দিয়ে ভাত খেলাম। ভাত খেয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ফেম গাড়ির তিনটি টিকিট নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। এবার প্রাণের টানে বাড়ি ছুটে চলা। দুপুরের সময় বেনাপোল থেকে ফেম গাড়ি ছেড়ে রাত নয়টার দিকে শরীয়তপুর এসে পৌচলাম। পালং বাজারে নেমে আমি আর আসাদ খান মামা দুটি রিক্সা নিয়ে চলে গেলাম নিজ ঠিকানায়। বাসায় গিয়ে দেখি আমার অর্ধপ্রাণ মা রওশন আসাদ প্রিয়ন্তী এখনও জেগে আছে। আমাকে দেখে ঝাপিয়ে পড়লো আমার কোলে। আমি আমার প্রাণ ফিরে পেলাম, মাকে পেলাম, মাটির পরশ পেলাম। এক অপূর্ব অনুভূতির সংমিশ্রণে দ্রভিভূত হয়ে রাতের খাবার সেরে শান্তির ঘুমে নিমজ্জিত হলাম। আসলেই, এমন দেশটি কোথাও খুজে পাবে নাকো তুমি........সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্ম ভূমি....... সে যে আমার জন্ম ভূমি...

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই জুন, ২০১৭ সকাল ১১:০১

ভুয়া মফিজ বলেছেন: ভাই, এত্তোবড় পোস্ট....টাইপ করলেন কিভাবে? রহস্যটা কি? লেখা ভালো লাগলো।

০৮ ই জুন, ২০১৭ রাত ৯:১৮

আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেছেন: প্রথমেই ধন্যবাদ আমার লেখাটা পড়ার জন্য। আপনার ভাল লেগেছে এতেই আমার লেখার ও টাইপ করার ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে নিমিশেই। ভাই, আমি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছি। দৈনিক প্রথম আলো, কালের কন্ঠ পত্রিকা সহ বিভিন্ন মিডিয়ায় সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলাম দীর্ঘ ১৫ বছর। আমি আমার সকল নিউজ নিজেই টাইপ করে পাঠাতাম। সেই থেকেই আমার লেখালেখি হয় সরাসরি ল্যাপটপের জমিনে। লিখি আবার কাটি আবার লিখি। আমার একটা উপন্যাস প্রকাশ হয়েছে ২০১২ সালের একুশে বইমেলায়। ভ্রমন নিয়ে এই লেখাটা লিখলাম। ভবিষ্যতে আরো কিছু ভ্রমন করে একটা বই প্রকাশের ইচ্ছাও আছে। ধন্যবাদ।

২| ০৭ ই জুন, ২০১৭ সকাল ১১:৩২

অরন্যে রোদন - ২ বলেছেন: এমন চমতকার একটি লেখা ৬৭ জন পড়েছে অথচ মন্তব্য নেই একটাও!!!!

০৮ ই জুন, ২০১৭ রাত ৯:২২

আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেছেন: এইতো আপনি মন্তব্য করেছেন এটাই কম কিসে? ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার জন্য। চমৎকার একটি লেখা-কথাটা লিখেছেন এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

৩| ০৭ ই জুন, ২০১৭ দুপুর ১২:০৬

রক বেনন বলেছেন: ভালো লাগলো লিখাটা! অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন।

০৮ ই জুন, ২০১৭ রাত ৯:২৬

আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেছেন: ধন্যবাদ। আপনার অনুপ্রেরণা আমার অনেক কাজে লাগবে। আমাকে ভবিষ্যতে আরো লিখতে সাহাজ্য করবে।

৪| ০৭ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:১৫

অসিত কর্মকার সুজন বলেছেন: অনেক বড় লিখা তাই ভালো লাগলো যে কোন পর্ব করে না লিখে এক বারেই পোস্ট দিলেন । আপনাদের সাথে আমিও ঘুরে এসেছি লিখা পড়ে তাই মুনে হলো । আপনারা যেখানে ঘুরলেন , থাকলন ও খেলান সেসব এতো বিস্তারিত ভাবে বলেছেন যে এই পোস্ট পড়ে অনায়সে যে কেও কলকাতা গিয়ে বিচলিত হবে না । একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুব সুন্দর ভাবে গল্প বলার মতো বলে গিয়েছে । আগামী মাস খানেরকের মধ্যে আমরা দুই বন্ধু কলকাতা ভ্রমণে যাবো আশা রাখি । আপনার এই পোস্টটি আমাদের বিশাল কাজে আসবে । ভ্রমণের পাশাপাশি ওদের ভালো-মন্দ দুই সুন্দর ভাবে আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন । এ


সবকিছু মিলিয়ে পুরো পোষ্টটির অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে । :) ভ্রমণ বর্ণনার মাঝেমাঝে কিছু মহার কথা বলেছেন সেগুলো ভালোলেগেছে খুব । B-)


০৮ ই জুন, ২০১৭ রাত ৯:৪০

আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেছেন: অসিত কর্মকার সুজন ভাই, আপনার মন্তব্য পড়ে বুঝতে পেরেছি যে আপনি লেখাটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছে এবং উপভোগ করেছেন। আপনার মন্তব্য আমাকে আরো উৎসাহিত করবে। আপনি কোলকাতা যাবেন শুনে ভাল লাগলো। আশা করি আপনিও ঘুরে এসে ভ্রমন বিত্তান্ত লিখে আমাদের আপনার সাথে ঘুরাবেন। আমি এতটা আশাও করিনি যতটা রেসপন্স পাচ্ছি। আমার চিন্তা ছিল লিখে রাখি কি দেখলাম, কেমন দেখলাম। কিছুদিন পরে আমিও আর মনে রাখতে পারবো না কি দেখেছি, কেমন দেখেছি। লিখে রাখলে নিজেই যখন আবার পড়বো তখন সবকিছু চোখের সামনে চলে আসবে। আর আমি অত্যন্ত সাধারণ মানুষ তাই আমার বর্ণনাও সাধারন ও সাবলিল রাখতে চেষ্টা করেছি। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছি, রিপোর্টিয়ের মত মনে হতে পারে। তবে লেখাটা শুরু করার পর আমার কাছেও লিখতে ভাল লেগেছে। লিখতে লিখতে প্রায় পনের হাজার শব্দ লিখে ফেলেছি অথচ টেরই পাইনি। প্রায় পঞ্চান্ন পৃষ্ঠার বই হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে আরো দুএকটা রাষ্ট্র ঘুরে বা ভারতের অন্য কোন দর্শনীয় স্থান ঘুরে এসে লিখলে আস্ত একটা বই হয়ে যাবে। প্রকাশ করার পর আপনাকে জানাবো এবং উপহার দিব আশা করি। মুর্শিদাবাদ গেলে দেখার মত অনেক কিছু আছে যা নিয়ে লিখলে বই হয়ে যাবে সবাই বললো। আপনাদের উপদেশ, আগ্রহ আমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। আবারও ধন্যবাদ আমার মত সাধারণ মানুষের লেখা পড়ার জন্য। আমি কৃতার্থ। ভাল থাকবেন।

৫| ০৭ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:১৮

অসিত কর্মকার সুজন বলেছেন: বলেছেন: অনেক বড় লিখা তাই ভালো লাগলো যে কোন পর্ব করে না লিখে এক বারেই পোস্ট দিলেন । আপনাদের সাথে আমিও ঘুরে এসেছি লিখা পড়ে তাই মুনে হলো । আপনারা যেখানে ঘুরলেন , থাকলন ও খেলান সেসব এতো বিস্তারিত ভাবে বলেছেন যে এই পোস্ট পড়ে অনায়সে যে কেও কলকাতা গিয়ে বিচলিত হবে না । একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুব সুন্দর ভাবে গল্প বলার মতো বলে গিয়েছে । আগামী মাস খানেরকের মধ্যে আমরা দুই বন্ধু কলকাতা ভ্রমণে যাবো আশা রাখি । আপনার এই পোস্টটি আমাদের বিশাল কাজে আসবে । ভ্রমণের পাশাপাশি ওদের ভালো-মন্দ দুই সুন্দর ভাবে আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন । পোষ্টটি প্রিয়তে রাখলাম :)


সবকিছু মিলিয়ে পুরো পোষ্টটির অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে । :) ভ্রমণ বর্ণনার মাঝেমাঝে কিছু মহার কথা বলেছেন সেগুলো ভালোলেগেছে খুব । B-)

০৮ ই জুন, ২০১৭ রাত ৯:৩৭

আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেছেন: অসিত কর্মকার সুজন ভাই, আপনার মন্তব্য পড়ে বুঝতে পেরেছি যে আপনি লেখাটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছে এবং উপভোগ করেছেন। আপনার মন্তব্য আমাকে আরো উৎসাহিত করবে। আপনি কোলকাতা যাবেন শুনে ভাল লাগলো। আশা করি আপনিও ঘুরে এসে ভ্রমন বিত্তান্ত লিখে আমাদের আপনার সাথে ঘুরাবেন। আমি এতটা আশাও করিনি যতটা রেসপন্স পাচ্ছি। আমার চিন্তা ছিল লিখে রাখি কি দেখলাম, কেমন দেখলাম। কিছুদিন পরে আমিও আর মনে রাখতে পারবো না কি দেখেছি, কেমন দেখেছি। লিখে রাখলে নিজেই যখন আবার পড়বো তখন সবকিছু চোখের সামনে চলে আসবে। আর আমি অত্যন্ত সাধারণ মানুষ তাই আমার বর্ণনাও সাধারন ও সাবলিল রাখতে চেষ্টা করেছি। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছি, রিপোর্টিয়ের মত মনে হতে পারে। তবে লেখাটা শুরু করার পর আমার কাছেও লিখতে ভাল লেগেছে। লিখতে লিখতে প্রায় পনের হাজার শব্দ লিখে ফেলেছি অথচ টেরই পাইনি। প্রায় পঞ্চান্ন পৃষ্ঠার বই হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে আরো দুএকটা রাষ্ট্র ঘুরে বা ভারতের অন্য কোন দর্শনীয় স্থান ঘুরে এসে লিখলে আস্ত একটা বই হয়ে যাবে। প্রকাশ করার পর আপনাকে জানাবো এবং উপহার দিব আশা করি। মুর্শিদাবাদ গেলে দেখার মত অনেক কিছু আছে যা নিয়ে লিখলে বই হয়ে যাবে সবাই বললো। আপনাদের উপদেশ, আগ্রহ আমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। আবারও ধন্যবাদ আমার মত সাধারণ মানুষের লেখা পড়ার জন্য। আমি কৃতার্থ। ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.