নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

https://www.facebook.com/asadali.ht

মোহাম্মদ আসাদ আলী

সাংবাদিক

মোহাম্মদ আসাদ আলী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আরব বসন্ত কোথায় এসে দাঁড়াল?

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০৪

বৈশ্বিক রাজনীতিতে আরবভূমি এক বিরাট লীলাক্ষেত্রে রূপ লাভ করেছে। যখন-তখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে সেখানে। সভ্যতার অন্যতম এই লীলাভূমির ধূসর বালুরাশি হচ্ছে রক্তে রঞ্জিত। শত্র“তা ও প্রতিশোধের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীময়। এরই অংশ হিসেবে আরবের ভূমিতে আজ থেকে চার বছর আগে ঠিক এই মাসটিতেই শুরু হওয়া সরকারবিরোধী আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছিল আরব বসন্ত। নামটি পশ্চিমাদের দেওয়া। তৎকালীন বিশ্বে আরবদের ওই জাগরণ ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। একের পর এক স্বৈরশাসকদের পতন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশের কোটি কোটি জনগণকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। কিন্তু আজ কয়েক বছর পেরিয়ে এসে বিশ্ববাসীর সামনে যে পরিষ্কার সমীকরণ দাঁড়িয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, কোটি কোটি মুক্তিপ্রেমী মানুষের ওই জাগরণ কার্যত বিফল হয়েছে। বসন্তকাল তো আসেই নি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তারা মুখোমুখি হয়েছে ঘোর শৈত্যপ্রবাহের।
আজ থেকে চার বছর আগে। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাস। উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়ার একজন বেকার যুবক মোহাম্মদ বুয়াজিজির নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে। অভিযোগ- ‘তিউনিশিয়ার একজন পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহার’। তার দেখা দেখি আত্মহুতি দেয় মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু দেশের যুবক। শুরু হয় আলজেরিয়া, জর্ডান, মিশর, ইয়েমেনে ব্যাপক সরকার বিরোধী আন্দোলন। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, মিছিল-মানববন্ধন চলতে থাকে সমান তালে। এদিকে পশ্চিমা মিডিয়ার ক্যামেরার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় আরবের ওই রাষ্ট্রগুলো। আন্দোলনকারীদের পক্ষে বৈশ্বিক জনমত তৈরি করতে এসব মিডিয়া প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য মোড়ল রাষ্ট্রগুলোও শর্তহীন সমর্থন দিতে থাকে আন্দোলনকারীদের। চলে সাহায্য-সহযোগিতাও।
প্রথম ধাক্কাতেই তিউনিশিয়ায় ফোটে বসন্তের ফুল। তারিখ ১৪ জানুয়ারি। শাসক বেন আলী জনবসন্তের ধকল সইতে না পেরে পালিয়ে যান সৌদি আরবে। ২৫ জানুয়ারি থেকে মিশরে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ১৮ দিনব্যাপী বিদ্রোহের পরে ৩০ বছর ধরে শাসন করা প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ১১ ফেব্র“য়ারি পদত্যাগ করেন। কিছুদিন পর পতন হয় জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহর। এদিকে ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি আব্দুল্লাহ সালেহ ঘোষণা দেন যে, তিনি ২০১৩ সালের পর আর রাষ্ট্রপতি থাকবেন না। একমাত্র সমস্যা বাঁধল লিবিয়ায়। গাদ্দাফী সরকার কোনোভাবেই ছাড় দিতে রাজি ছিল না। কিন্তু তারপর যা হলো তা সকলেরই জানা। পশ্চিমা সামরিক হামলার সামনে টিকতে পারল না স্বৈরশাসক মুয়াম্মর গাদ্দাফি। তার পতনের পেছনে মার্কিন স্বার্থই প্রধান নিয়মক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বলে অনেকের বিশ্বাস।
এরপর দ্বিতীয় ও সর্বাধিক বাধাটি আসে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পক্ষ থেকে, যে বাধা আজ অবধি ডিঙ্গাতে পারে নি পশ্চিমা জোট। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে বিদ্রোহীদের সমস্ত প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়। এমতাবস্থায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদও মুখোশ খুলে সরূপে আবির্ভূত হয়। এর যথেষ্ট কারণও বিদ্যমান। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আরও পোক্ত হবে। কারণ সিরিয়া-ই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ যা কিনা সরাসরি ইরান ও রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা করে চলছে। যাই হোক, মার্কিন সমর্থন, অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা পাবার পরও ফ্রি সিরিয়ান আর্মি এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন ঘটাতে পারে নি। বরং আইএস নামক জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানের মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যেই পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে।
এদিকে সিরিয়ায় সরকারি বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে যখন ইতিহাসের বর্বরতম লড়াই চলছিল তখন হঠাৎ করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরে গেল মিশরের দিকে। মিশরে আরব বসন্তের সুবাদে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিপুল জনসমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় বসা মুরসী সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে নেয় সে দেশের সেনাবাহিনী। মুক্তিপ্রেমী মানুষের কাছে এই ঘটনা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। কিন্তু এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাটি রহস্যের আবরণে ঢাকা পড়ে যখন সেনা অভ্যুথানের কোনোরূপ বিরোধিতা না করে আমেরিকা, সৌদি আরব এবং ইসরাইল মিশরের সেনাপ্রধানকে হাজার হাজার ডলার আর্থিক সাহায্য পাঠায়। এমনকি পশ্চিমারা সেনাবাহিনীর ক্ষমতাগ্রহণকে প্রাথমিকভাবে সেনা অভ্যুত্থান হিসেবে মানতেও ছিল নারাজ। কারণ সেনা অভ্যুত্থান হিসেবে মেনে নিলে আর্থিক সাহায্য পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী হতো। সব মিলিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, মিশরে সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে পশ্চিমা সমর্থন ছিল এবং আজ পর্যন্ত সে সমর্থন অব্যাহত আছে।
আসা যাক বর্তমান পরিস্থিতিতে। প্রথমেই লিবিয়া। কথিত আরব বসন্তের মরিচিকায় মুগ্ধ হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে লিবিয়া অন্যতম। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে গাদ্দাফী যুগের পরিসমাপ্তি ঘটার পর আজ দুই বছর পেরিয়ে গেলেও লিবিয়ায় বসন্তের কোনো ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না। শৃঙ্খলতা ভেঙ্গে স্বাধীনতার মুক্ত হাওয়ায় প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিল লিবিয়ার মানুষ, সেই স্বপ্ন আজও পূরণ হয় নি। বরং ঘটছে ঠিক উল্টোটা। সারাক্ষণ হত্যা, গুম, বোমা হামলা, অপহরণের আশংকায় তটস্থ থাকতে হচ্ছে তাদের। গাদ্দাফী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা অনেকেই এখনও তাদের অস্ত্র পরিত্যাগ করেনি। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তার জের আজও চলছে। বরং ক্ষেত্রবিশেষে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আজও দাঁড় করানো যায়নি। দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার বিরোধ দূর করে জাতীয় ইস্যুতে তাদের একাত্ম করতেও ব্যর্থ হয়েছে লিবিয়ার বর্তমান সরকার। দেশের অর্থনীতিতেও গতি সঞ্চার করা যায়নি। অর্থনীতি বলা যায় ‘ব্যাক ফুটে’ চলে গেছে। আজ তারা না গণতন্ত্র পেয়েছে, না শান্তি পেয়েছে, বরং তাদেরকে ইতিহাসের জঘন্যতম সময় অতিক্রম করতে হচ্ছে। পশ্চিমারাও তাদেরকে পরিত্যাগ করেছে। এক সময়ের সমৃদ্ধ-সম্পদশালী দেশ লিবিয়া এখন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার ক্ষমতাও হারিয়েছে।
এদিকে মিশরের অবস্থা আরও করুণ। জেনারেল সিসি আবির্ভূত হয়েছে নব্য হোসনে মোবারকের ভূমিকায়। দুর্নীতি ও হত্যার অভিযোগ তুলে যে স্বৈরশাসককে ক্ষমতা থেকে নামাতে গিয়ে শত শত মিশরীয় প্রাণ হারালো সেই হোসনে মোবারককে এখন নির্দোষ প্রমাণ করতে দেখা যাচ্ছে। গত শনিবার মিশরের একটি আদালত ২০১১ সালের গণজাগরণে সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রায় আট শতাধিক মানুষের প্রাণহানির অভিযোগ থেকে হোসনে মোবারককে অব্যাহতি প্রদান করে। রায়ে বলা হয়, জনতার উপর গুলি চালাবার নির্দেশ উচ্চ পর্যায় থেকে আসে নি। গণমাধ্যমসূত্রে জানা যাচ্ছে, এই রায় মিশরের মুক্তিকামী মানুষ মেনে নিতে পারে নি। এতদিনে হয়তো মিশরবাসী বুঝে উঠতে পারছে যে, মুক্তি তাদের ভাগ্যে জোটে নি, পশ্চিমা বিশ্ব তাদের সাথে এক প্রকার ছলনা করেছে মাত্র।
অন্যদিকে সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি কাউকে নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কথিত আরব বসন্তের শুরু থেকে এ বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সিরিয়ায় এক লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় দশ লক্ষেরও বেশি আদম সন্তান। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে দেশটিতে। কথিত বিদ্রোহীদের গাছে তুলে ইতোমধ্যেই মই নিয়ে গেছে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি। এখন সিরিয়ায় কোনোপক্ষই জয়ের কাছাকাছি নেই। ধারণা করা হচ্ছে- দেশটির মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে। আরব বসন্তের পটভূমি থেকে জন্মগ্রহণ করা ‘আইএস’ নামের মাত্র একটি গ্র“প সারা বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিরিয়া থেকে উদ্গত এই আগুনের ফুলকি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মিভূত করছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইরাককে।
এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠছে- আরব বসন্ত কী দিল আরবদের? কিছুই দেয় নি, অথচ নিয়ে গেছে সর্বস্ব। পশ্চিমা প্রচারিত কথিত আরব বসন্ত আজ মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি কেড়ে নিয়েছে, নিরাপত্তা কেড়ে নিয়েছে, বহু নিষ্পাপ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। পৃথিবীকে দিয়েছে অনিরাপত্তার নতুন মাত্রা। এর ধকল কাটাতে ভাবি পৃথিবীকে হয়তো আরও বহু সময় অতিক্রম করতে হবে। এই যে এতকিছু হলো এবং হচ্ছে- এর জন্য প্রধানত কে দায়ী? আমি বলব সাম্রাজ্যবাদ। এ সব কিছুর মূলে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ উদ্ধার। এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসনকে রুখে দিতে না পারলে এমন পরিস্থিতি ঘুরে ফিরেই অবতীর্ণ হবে। তাই শান্তিপূর্ণ ও মুক্ত পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.