নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

দুই অনিতার গল্প

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৯



জসীম অসীম

অনিতা। কখনো পড়েনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প। তবু সে দক্ষিনারঞ্জন মিত্র মজুমদার কিংবা হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের রূপকথার দারুন ভক্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন একদিন সে গ্যালিক্সি আবিস্কারের মতো করেই আবিষ্কার করলো এ পৃথিবীর সমস্ত সুখ টাকায়। টাকা হলে স্বর্গ কিনতে-স্বর্গ গড়তে পারা যায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে দামী বস্তু-টাকা। কিন্তু আমার টাকা নেই। সারারাত আমি অনিতার মোলায়েম চুলে সুখ খুঁজে বেড়াই। কখনো চুষি তার লাল ঠোঁট। শারদীয় পূর্ণিমা দেখি। পাগল হয়ে যাই। একদিন এসবে অনিতাও খুব সাড়া দিতো। কিন্তু তারপর একদিন সেই অনিতা আমার বুখে এমনভাবেই পেতে দেয় এক অত্যাধুনিক মাইন-যা আমি উদ্ধার করতে পারিনি। মাইন ফাটলেই নিশ্চিত মৃত্যু...।

অথচ এক সময় কমিউনিস্ট বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতো অনিতা। তারপর মুখোশ উন্মোচন করছে। আমাকে বিয়ে করে নিশ্চিত হতে পারেনি। বেগে আমার রক্ত চুষে খাবে-তত রক্তও আমার শরীরে ছিলনা। ভালোবাসা-সে আর কতো চোষা যায়? ঠিক তখন থেকেই বেপরোয়াভাবে চলতে শুরু করে। আমি সব সহ্য করি দাঁতে দাঁত চেপে। ভাবি-অতি সাধারণ মানুষ হয়ে কেন দেখলাম বেপরোয়া নারীর স্বপ্ন? আমি তখন স্থানীয় একটি দৈনিকের রিপোর্টার কাম ফটোগ্রাফার। কাগজ নিয়েই সারাদিন মাথাব্যথা। আমার এক রিপোর্টার বন্ধু আমার চরমতম দুঃসময়ে আমাকে সেই পত্রিকায় কাজ পেতে বিশেষ সহায়তা করে। কিন্তু আমি সেই বন্ধুর কাছেও ঘরোয়া এ সমস্যা নিয়ে লজ্জায় কথা বলতে পরিনি। কিন্তু প্রায়ই সাংবাদিকতায় আমার দায়িত্বগত অবহেলা বাড়ে। সম্পাদক আমাকে চেনেন। আমার কাজের দক্ষতা-তিনি জানেন। কিন্তু যে দায়িত্বে অবহেলা বাড়ায়-তার দক্ষতা কি কাজে আসে?

দিনের পর দিন চলে যায়। নদীর মতো বাঁধ দিয়ে-জোর খাটিয়ে আবাদ করবো সংসার জীবনে সেই ইচ্ছেও আর নেই। বন্ধুর বাসায় পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বুকের দুঃখ তাড়াবার চেষ্টা করি। কিন্তু দুঃখ, সে তো নাছোড়বান্দা, টিমটিম করে জ্বলা চেরাগ। যখন আমাকে আমার প্রেম করে বিয়ে করেছে অনিতা, তখন অবস্থা অতটা খারাপ ছিলনা। স্থানীয় দু’টি সাপ্তাহিক ও একটি দৈনিকে এক সঙ্গে কাজ করতাম। ভালো একটি বাসায় থাকতাম। মন্দ চলছিল না দিনকাল। কিন্তু আমি পেশাগত জীবনে কখনো কারো হুকুমের দাস হতে পারিনি। টাকাও নেই-দাসও হবো না... এটা তো সম্ভব নয়। ফলাফল হিসেবে বেকার হয়ে গেলাম। জীবন সংগ্রামের দুনিয়ায়। ভালোবাসার চেয়ে টাকার দাম যে খুব বেশি-তা আমি দেরীতে বুঝেছি। আমার বাজারদর অবিশ্বাস্য রকম করে যাওয়ায় এ কথা তখন বুঝতে পেরেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম জীবন ভারতের হিন্দি কোনো রোমান্টিক ছবি নয়।

আমি একসময় থিয়েটারও করতাম ঢাকায়। ওথেলা-আমার পাঠ্য নাটক ছিল। তারপর পেইন্টিং... রিপোর্টিং... ফটোগ্রাফি...সারাদিন ঘোরা। ছোট ভাইয়ের সাইকেল। মায়ের কথায় চোট ভাইকে বাবা কিনে দিয়েছিলেন। লাল মায়াবী সাইকেল। সেই আমি চাপে পড়লাম, জীবন থেকে পেইন্টিং-ফটোগ্রাফি-লেখালেখি সব বাদ দিতে হবে। বুঝলাম গোলাপের চেয়ে কাঁচা মরিচের দাম বেশি।

গ্রাম-বাংলার এক অতিসাধারণ ঘরে জন্ম হয়েছিল আমার। মা ছিলেন এক পল্লীবাসী মেয়ে। তবু তৃপ্তিতে কেটেছে জীবন। সেই জীবন লোভী এক মেয়ের খপ্পরে পড়ে এমন হবে ভাবিনি। অভাব যখন আসে তখন আপন মানুষও পর হয়ে যায়, শত্র“ হয়ে উঠে। ঠিক সেই সময়ে অনিতার মায়ের চোখ হয় ঠিক মহাজনের মতো। আমাকে অভাবী দেখে সে অনুকূল হাসি হাসে। দাঁত দেখিয়ে ভেংচি দেয়। মাথায় আমার বাজ পড়ে। এ শহরে থাকার আগ্রহ ক্রমাগত হারাতে থাকি। রাতের বেলা ঘুমোতে পারি না। দিনে অফিসে ক্লান্ত হয়ে টেবিলে মাথা রেঁখে হঠাৎ ঘুমিয়ে যাই। এরই মধ্যে ফোন আসে। ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। হয়তো কোনো থানা প্রতিনিধির ফোন। সংবাদ পাঠাতে চায়। হ্যাঁ সংবাদই বটে। টেলিফোনের ওপার থেকে বলে তোর সংসার গো-চারণভূমি এখন। দারুন মজা। ভাত খাওয়ার পয়সা ঠিকভাবে জুটে না-আবার সুন্দরী বউ দখলে রাখতে চাস। বলেই সে ফোন কেটে দেয়। প্রথম প্রথম অনিতাকে এসব ঘটনার কথা বলতাম আমি। তবে কারো কথা বলতামনা। অনিতা অনেক চেষ্টা করেছে-কে ফোন করে তার নাম বরে করতে। পরে হয়তো সে বুঝেছে ফোনগুলো ঠিক কার। তাই আর সে মাথা ঘামায়নি।

আমি যে পত্রিকায় কাজ করতাম সে পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে কি বিষয়টি নিয়ে আলাপ করবো? তাকে আমার বন্ধুর মতো মনে হয়। কিন্তু এত ঘরোয়া সমস্যা নিয়ে আলাপ ঠিক হবে না। নিজে নিজে ভাবি আমি। পাশে টেবিলের রিপোর্টার রিপোর্টের কাজে বাইরে। কমার্শিয়েল ম্যানেজারও অন্য জেলায়। একা একা অনিতার অপরূপ যাদুকরী সৌন্দর্য নিয়ে ভাবি আমি। মেঘের ভিড়ে হারিয়ে যাবে অনিতা? ভাবতেও পারিনা। এই অনিই তো একদিন আমাকে লিখেছে শত শত প্রেমের চিঠি। এখন সে খুব দূরে দাঁড়ানো মৌন এক পাহাড় হয়ে গেছে। অনিতাকে হারানোর কথা মনে হওয়াতে পাগল হয়ে উঠি আমি। খুব কাছ থেকে ঠোট দেখেছি তার। চোখ ঝলসে যায়। নিজের তোলা তার ছবিটা মানিব্যাগ থেকে খুলে দেখি। গভীর করে দেখি। যেন স্বর্গ রাজ্যের রূপসম্পদ মন্ত্রী। অনিতার ছবি আমার মাথার ভিতর আগুণ জ্বালিয়ে দেয়। বুকের ভিতরটা জ্বালিয়ে পুড়ে ছারখার করে দেয়। এই ছবি দেখলেই আমি আদর্শবাদ-জনগন সব ভুলে যাই। ব্যাক্তিস্বার্থ কুরে কুরে খায়। অনিতা যেন পুষ্পিত চেরী। চেরীর মহাপ্লাবন। এসব ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ অফিসের ফোন বেজে উঠে। রিং এলেই আৎকে উঠি আমি। ইদানীং। সংবাদ? নাকি উপদ্রব? রিসিভার হাতে হ্যালে বলতেই ফোনের ওপার থেকে অপরিচিত এক পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে।

কে বলছেন?

আমাকে আপনি চিনবেন না। পরিচয় পরে দেয় যাবে। আপনার ভালো চাই।

কিভাবে?

তথ্য দিয়ে? আপনার স্ত্রী অনিতা বিষয়ে।

আমার স্ত্রী বিষয়ে আমি কারো কথা শুনি না।

এই তো শুনছেন। আপনার কৌতুহল রয়েছে। কারণ আপনার শাশুড়ীকে আপনি চেনেন। সে আজ শালবন বিহারে ঘুরতে গিয়েছে। সঙ্গে আরও কিছু ছেলে আসলে ছেলে না বলে খদ্দেরই বলতে পারেন। ইচ্ছে হলেই যাচাই করতে পারেন। আপনি রিপোর্টার মিথ্যে বললে ধরে ফেলবেন। এ কথা শেষ করেই ওপাশ থেকে ফোন রেখে দেয়া হয়। আমি ধীরে ধীরে নিজের চিয়ারে এসে বসি। তার ডিসেম্বরের শীতেও ফ্যান ছেড়ে দেই।

এক এক করে দু’দিন কেটে যায়। আর কোনো ফোন নেই। তৃতীয় দিন পত্রিকার অন্য রিপোর্টার শহরের বাইরে চলে যায়। কমার্শিয়াল ম্যানেজর যায় অন্য জেলা শহরে। সম্ভবত ফেনী। সম্পাদক ঢকায়। অফিসে একমাত্র আমি। সকাল বেলা। একটি ফিচারের ছবি প্রিন্ট করে এনে এডিটিং করছি। সহসা ফান বেজে উঠে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে কথা বলে তোমার বউ মানে কিন্দু দানুর সুন্দরী। এ শহরের কিংবদন্তী। দুর্ধর্ষ যৌনবতী। কিন্তু তুমি তো রাস্তার ফকির। ফকিরের কি সুন্দর বউ থাকা উচিৎ? এ মেয়ে যাবে-তাদের ঘরে-যাদের এ শহরের নামীদামী এলাকায় নিজস্ব বাড়ি ও সুনাম রয়েছে। রয়েছে কাঁচা টাকা।

অন্যরুমে রাখা টেলিফোনের রিসিভার রেখে দেই আমি। নিজের টেবিলে এসে বসি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে অফিসে আসে গল্পকার একজন। আমার বন্ধু। তার সঙ্গে কি এ বিষয়ে আলাপ তুলবো? না এ বিষয়টি খুব গোপনে চেপে যাই। তার সঙ্গে কথা হয় অন্য বিষয় নিয়ে। এর মধ্যে ফোন আসে আবার। সেই ফোন হ্যালো হ্যালো করে কেটে দেই। স্বেচ্ছায়। লাইনটা প্যারালাল। অন্য কেউ কান দিচ্ছে না তো? মনে কিছু সংশয়। গল্পকার চলে যায়। অফিসে আবার একাই আমি। পাশের দোকান থেকে চা আনিয়ে খাই। আবার ফোন বাজে। আমি ধরি। ওপাশের কন্ঠ বলে-

ঃ তুমি কি জানো তোমার বউ বিক্রি হয়ে গেছে? ক’দিন পরে বউ তোমার চুরি হয়ে যাবে। তুমি কি একজন সচেতন মানুষ হিসেবে অপমান বোধ করছো?

আমার কোনো অপমানবোধ নেই। আপনি কথা বলতে পারেন-যতক্ষণ আপনার ইচ্ছে।

দেখ-তোমার জন্য আমার মায় হয়। খুব। কিন্তু তোমার হাতে তো টাকা পয়সা নেই। কাঁদে একটি ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে সারাদিন শহরে রোদে পুড়ে হেঁটে বেড়াও।

পাখিপ্রেমী এই আমি নিজের অতীতে আবার ফিরে যাই। মনে পড়ে- আকাশভরা কতো পাখি ছিল একসময়। এখন ওদের দেখতে পাওয়া যায় না। হয়তো ওরা হারিয়ে গেছে। সেসব পাখির মতোই কি একদিন সব সুন্দর বিশ্বাস দূরে হারিয়ে যাবে?

এ রকমভাবে নানা রকম ফোনের উপদ্রবে যখন আমি বিপর্যন্ত, ঠিক তখনও অন্যদিকে পেশাগত কাজের ফাঁকে ফাঁকে লিখে যাচ্ছিলাম এক রাখাইন যুবতীর গল্প।

যদিও আমি কুয়াকাটার সাগর সৈকতের রাখাইন পল্লীতে যাইনি কোনোদিন। তবু লিখে যাচ্ছিলাম কোনো এক রাখাইন যুবতী অনিতা তালুকদারের এক গল্প।

অনিতা তালুকদার পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার লতাচাপলী গ্রামের মেয়ে। তার পিতা মংচো তালুকদারের ছিল সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেত। অনিতারা তিন বোনই যুবতী এবং অনিতাই বড়। কোনো ভাই নেই তাদের। অনিতার মা মেয়েদের নিয়ে তার স্বামীর সংসারে শান্তিতেই ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর আগে অনিতার বাবা মংচো তালুকদারের অধিকাংশ জমির পাকা সোনালি ধান কেটে নিয়ে গেল স্থানীয় জোতদার বাবুল। এই নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাবুলের লাঠিয়ালদের হাতে খুব মার খায় মংচো। সেদিন এলাকার অন্য রাখাইন পরিবারও তেমন একটা প্রতিবাদে এগিয়ে আসেনি। কারণটা মংচোর কাছে বেশ রহস্যময়। অনেতার মা মংচোকে বাবার বুঝিয়ে বলেছে ধান যাক-জমি যাক কিন্তু প্রাণ যেন না যায়। প্রয়োজনে তিন মেয়েকে নিয়ে বেদমভাবে কাপড় বুনতে থাকবে এবং দিনরাত মাকুর শব্দে ভরিয়ে দেবে বাড়ি। কিন্তু এ কথায় শান্ত হয় না মংচোর মন। কোনো কোনো রাখাইন গৃহকর্তা রাতে এসে মংচোকে শান্তনা দেয় বাবুলের সঙ্গে লড়াই করে এ এলাকার কেউ পেরেছে? সরকারী অফিসের লোকের সঙ্গে তার কী রকম দোস্তী। এখন বলছে, তার কাছে দলিল আছে। দলিলের কথা শুনেই মংচোর মাথায় রক্ত উঠে। বলে, চৌদ্দপুরুষ এখানে বসবাস করলাম। সে বলে তার কাছে দলিল আছে। আরে আমার জমি কিনে নিল, আমি জানি না- বিক্রি করলো কে? আমি কাল থানায় যাবো, পুলিশ আনবো-মামলা করবো... বলেই মংচো চিৎকার করে কাঁদতে থাকে... আমার সোনার ধান... আমার বাপদাদার জমি। উঠানে মংচোর কান্না শুনে অনিতা তালুকদাররা তিন যুবতী বোন ঘরের ভিতর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। কিন্তু পাথর হয়ে বসে থাকে মংচোর বউ।

এক সময় সবার কান্না থেমে যায়। শেষ হয় উঠানের শোকাবহ আড্ডা। কিন্তু অনিতা তালুকদার তার কান্না থামাতে পারে না। সরব কান্না শব্দ হলেও নীরব কান্না তার বয়ে বয়ে নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের নোনা জলেই মিশে যায়। ততক্ষনে সবাই ঘুমে অচেতন। কিন্তু অনিতার চোখে ঘুমই আসে না। কেউ জানে না তার পেটে যে বাচ্চা চলে এসেছে। কারণ তার তো বিয়েই হয়নি। অথচ বাবুলের ছেলের সঙ্গে প্রেমে পড়ে তার এখন কী সর্বনাশই না হয়েছে। পেটের বাচ্চার উপস্থিতি অনুভব করে অনিতার মাথাটা আরও বেশি খারাপ হয়। মংচো তাহলে কার বিরুদ্ধে থানা-পুলিশ-মামলা করবে? নিজের মেয়ে অনিতা তালুকদারের বিরুদ্ধে? জিলিপির প্যাঁচের মতো, বাংলাদেশের নদীর মতো প্যাঁচে প্যাঁচে অনিতার মাথার মগজ মাছ ধরার জাল হয়ে যায়।

উত্তপ্তচিন্তার বাষ্পে রাত শেষ হয়ে যায়। ম্লানকরে আরও তিন-চার জনকে সঙ্গে করে থানায় যাবে মংচো। মংচোর বউ চুলা জ্বালায়। কী এক কাজের খোঁজে অনিতার খোঁজ পড়ে। কিন্তু কোথায় অনিতা? কোনো খোঁজ নেই। মংচোর বুক ধরফড় করে। নদীর দিকে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু বেশিক্ষণ দৌড়াতে হয় না তাকে। হঠাৎ একজনের কথা কানে আসে তার। মংচো মউগ্যার মাইয়া-অনিতা রানী বাবুলের পোলার লগে...।

মংচো যতটা জোরে নদীর দিকে দৌড়াচ্ছিল তারচেয়েও ধীরে ধীরে পা চালিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিল। কিন্তু তারপরও পারেনি স্থির থাকতে। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায় চরের বালুতে। এই ঘটনার পর মচোর বাড়িতে দিনের বেলা আর মাকুর শব্দ কেউ কখনো শুনেনি।

অনিতার পেটের বাচ্চা ক্রমাগত বড় হয়। সমান্তরালে বাবুলের স্বপ্নও বাড়তে থাকে। মংচো মউগ্যার মাইয়ারে বউ যখন করতেই হলো, সুতরাং মংচোকে তো আরও কিছু মূল্যশোধ করতেই হবে। ওদিকে অনিতাও অপেক্ষায় থাকে, তার নিরীহ পিতার এত বড় ক্ষতির কারণ যে বাবুল... তার শোধ সে কোন পন্থায় নেবে। তবে এইসব চিন্তার কথা সে নিজেকে ছাড়া কাউকেই বলে না। নীরবে শুধু মধ্যরাতে পিতা মংচো-র জন্য চোখের জল ফেলে আর ক্ষমা চায়। মনে মনে বলে, শুনেছি আমাদের পূর্ব-পুরুষে অনেক ডাকাতও ছিল। সুন্দরবন কেটে এখানে আবাদ করেছে তারা। জমি বানিয়েছে। বাঘের সঙ্গে-সাপের সঙ্গে সারাদিন লড়াই করেছে। আর তারই উত্তর পুরুষ মংচো-র মাইয়া অনিতা তোমারে ছাইড়া দিবো বাবুল? এতো সহজ না। জমি দখল করছো ঠিক, হজম করতে দিমু না। আমি মংচো-র মাইয়া।

মংচো-র বাকি দুই মেয়ের বিয়ে আর সহজে হচ্ছে না। এতো বড় করঙ্কের পর আর কে আসবে তাদের বিয়ে করতে? বাবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মংচো গিয়েছিল মাতবরের কাছে। মাতবর বলেন, এমনিতেই আমরা সংখ্যালঘু। ন্যায্য বিচার পাই না। তার ওপর তোমার মাইয়া অনিতা তো জাত-ধর্ম বিসর্জন দিলো। এখনতো তোমারই বিচার করা দরকার। তামাক খাবার পাইপ হাতে বসে বসে এসব কথাই ভাবছিল মংচো। এ কেমন বিয়ে হলো তার বড় মেয়ে অনিতার? ফসল ঘরে এলো না; পাড়ার মাতবর খেলো না, পুরোহিত পঞ্জিকা ঘেঁটে ঠিক করলো না বিয়ের শুভ দিনক্ষণ পাড়ার প্রবেশ মুখ থেকে বাড়ি পর্যন্ত সাজানো হলো না রঙিন কাগজের ফুলে, হলো না কোনো গেট, বাজরো না কোনো বাদ্য তবক দেয়া পানের ঘ্রাণে ভেসে তাছাড়া ধর্ম বিসর্জনের চেয়েও বড় কথা শুধু যদি ধর্ম বিসর্জন দেয়া হতো তাহলে কথা ছিল, বিধর্মী শত্র“র ঘরের বউ হলো অনিতা? চোখের জল ফেলতে ফেলতেই বাড়ির ভিতরের পুকুরপাড়ে বসে এই ভোরেই এসব কথা ভাবছিল এই মংচো। হঠাৎ ও-পাড়ার কিশোর এমং এসে খবর দিলো, ও কাকু তোমার অনি গলায় দড়ি দিয়া মরছে। কেউ কেউ কয় বাবুইল্যা তারে মাইরা ফালাইছে। মংচো বাড়ির ভিতর থেকে লম্বা একটি দা হাতে নিয়ে ‘মা অনি-অনি মা আমারা..., বলে চিৎকার করতে করতে বাবুলের বাড়ির দিকে ছুটে। কিন্তু একটু এগিয়ে যেতেই পাড়ার ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে মংচো-কে আটকায়। দুপুর নাগাদ পুলিশ এসে অনিতার মৃতদেহ থানায় নিয়ে যায়, সঙ্গে বাবুলের ছেলেকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। মংচো জানে শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না। ন্যায্য বিচার তাই আশাও করে না মংচো। শুধু ভুলে আর ভুলে ভরপুর ছিল মংচোর এই জীবন। তা না হলে কেন এমন হবে? এমনই ভাবে মংচো।

অনিতার মৃত্যুর পর মংচো-র পরিবারে আর যেন কোনো আশাই ছিল না। এরই মধ্যে একদিন থানার পুলিশ এসে মংচো ও তার স্ত্রী-র সঙ্গে কথা বলে গেছে। আত্মহত্যা না খুন- কী মনে হয় আপনার? পুলিশ কর্মকর্তার এমন প্রশ্নের জবাবে মংচো শুধু একবার বলে, গলায় দড়ি দেওয়ার জন্য আমার মাইয়াতো এই বাড়িতে কোনো গাছ খুইজ্জা পায় নাই। তাই বাবুলের বাড়ির গাছে ঝুলছে। অনিতার মৃত্যুর পর মংচো-র বাড়ির কাপড় বোনাও থেমে যায়। আর একবারের জন্যও মাকুর শব্দ এ বাড়ি থেকে কেউ শুনতে পায়নি। একদিন ভোরে পাড়া-প্রতিবেশি হঠাৎ আবিস্কার করে মংচো-র পুরো পরিবারটিই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। পাড়ার কিশোর এমং বলে, কাকু সেদিন কইছিল বার্মা চইল্যা যাইবো। তবে কি বার্মাই চইল্যা গেল?

আমার লেখা রাখাইন যুবতী অনিতা তালুকদারের গল্প একানে আসতেই আমার পত্রিকা অফিসে এসে হাজির হয় আমার স্ত্রী অনিতা রহমান ও তার মা রাশিদা রহমান। শ্বাশুড়ী রাশিদা রহমান বলেন, দেখো পার্লার থেকে তোমার স্ত্রীর চুল কেটে কেমন সোনালীরঙা করে এনেছি। দেখতে দারুন দেখাচ্ছে না?

আমি বললাম, হ্যাঁ-দারুন। আপনারা আছেন বলেই তো এমন মফস্বল শহরেও পার্লালগুলো চুল সোনালী করার উপাদান পারঅক্সাইড বিক্রি হতে পারে। স্ত্রী অনিতা রহমান বললো, তুমি কি খুব রাগ করছো?

আমি বললাম, রাগ করার কী আছে? প্রেম করার সময়তো ক্ষুধার্ত মানুষের ভাগ্য বদলে বিশ্বাসী ছিলে। আর বিয়ের পর এখন মিস ইউনিভার্স, মিস ওয়ার্ল্ড হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছো। আমার শ্বাশুড়ী বলেন, তোমার বউকে আমি একজন দামী মডেল বানাতে চাই। ওর মতো সুন্দরী বিজ্ঞাপনের মডেল হলে অনেক টাকা রোজগার করতে পারবে। তুমি দেখেছো ওর গালে কেমন একটা সুন্দর টোল পড়ে? এমন একটা টোল কৃত্রিমভাবে তৈরি করার জন্য বিদেশে হাজার হাজার ডলার প্লাস্টিক সার্জারির ক্লিনিকগুলোতে খরচ করে মেয়েরা। তুমি কি জানো ঢাকার এলিট পরিবারের কাজের মেয়েরাও আজকাল পার্লারে গিয়ে চুলে রঙ করে, ফেসিয়াল করে। এই দেখো আমার বয়স ষাট ছুঁই ছুই। মুখের চামড়া দেখো কেমন টান টান। এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে জানো? পারফেক্টর মেশিনের সাহায্যে কুঁচকানো চামড়া টান টান করা যায়। সৌন্দর্যকে এখন পাওয়া যা না, কিনতে হয়। যেসব মেয়েদের দেখে পুরুষদের মাথা ঘুরে যায়, সেই সৌন্দর্য এখন পার্লারগুলোর দান। তুমি দেখবে ভারতের অভিনেত্রী মনীষা কৈরালার মতো মেয়ে এখন এই শহরেও রয়েছে। এদের তৈরি করেছে কারা? পার্লার গুলো। সুতরাং কুসংস্কার ছাড়ো।

আমার স্ত্রী অনিতা রহমান ও তার মায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বললো, আমার বান্ধবীদের ড্রেসিং টেবিলে টেবিলে শুধু লিপস্টিক-আইলাইনারই থাকে না। থাকে ক্লিনজার, টোনার, ময়েশ্চারাইজার, বডি লোশন, ডিওডরেন্ট, নানা রকম পারফিউম, মাসকারা, ফাউন্ডেশন, ফেসিয়াল, কন্ডিশনার...কতো কিছু। কিন্তু আমার কি আছে? আমি বললাম, চাউল-তেল-লবন-আটা-ডিম না কিনে বডি লোশন কিংবা মাসকারা খেয়ে বাঁচলেই হয়।

আমার স্ত্রী অনিতা বলে, যারা আনকালচার্ড তারাই সৌন্দর্যচর্চা ও ফিটনেসের পেছনে ব্যয় করতে কৃপণতা করে।

আমি বললাম, আমি তো চুরি করে তোমার ফিটনেসের ব্যয় যোগাতে পারবো না।

অনিতা বললো, তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে করছো কেন? সন্তান জন্ম দিতে? আমি তোমার সন্তান এখন পেটে নিতে পারবো না। এখনই পেটে সন্তান নিলে পেটের চামড়া কুঁচকে যাবে। তুমি তো আবার বাচ্চা হওয়ার পর পেটের ত্বকের চিকিৎসাও করাতে পারবে না। তাছাড়া এখনও পর্যন্ত আমার কাছে মাতৃত্বের চেয়ে নারীত্বের মায়া বেশি।

শ্বাশুড়ী রাশিদা রহমান বলেন, দেখো আমি হোটেল শেরাটনে সুইমিং কস্টিউম করে সাঁতার কাটা এক মহিলা আমি দেখেছি আজকাল প্লাস্টিক সার্জারি করে মেয়েরা তাদের বুক কিভাবে পুষ্ট করে। সেই তুলনায় আমার মেয়ে তো যথেষ্ট নম্রভদ্র ও সহনশীল। তুমি বরং চিন্তা বদলাও তোমার।

আমি বললাম- সার্জারির মাধ্যমে স্তন আরও পুষ্ট করতে গিয়ে অনেক মেয়ের স্তন শুকিয়ে সমতল হয়ে গিয়েছে-এমন উদাহরনও রয়েছে। আপনি আপনার মেয়েকে সেই গল্পও শোনান। পরে ওসব ক্ষতিগ্রস্ত মহিলা মামলায়ও গিয়েছে কিন্তু স্তন ফেরত পায়নি। কারণ আদালতের বিচারক কিংবা ডাক্তাররা তো আর স্তন বানাতে পারে না।

আমার এ কথা শুনে ক্ষেপে গেলেন রাশিদা রহমান। বললেন, তুমি একটা বর্বর। আমি বললাম-আপনার মেয়ের বর হয়েছিলাম। আবার যদি আমার কপালে বর হওয়ার লেখা থাকে তাহলে তো বরবর বা বর্বর হতেই হবে। মোতাহার হোসেন চৌধুরীও এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

উত্তেজিত অবস্থায় অফিস ছেড়ে চলে গেলেন রাশিদা রহমান। আমার স্ত্রী অনিতা রহমান আমাকে বললো, আমার মায়ের সঙ্গে বেয়াদবি করাটা তোমার ঠিক হয়নি। আমি তোমার সঙ্গে সংসার করতে পারবো না, যদি মাসে আমার হাতে ১৫/২০ হাজার টাকা দিতে না পারো।

আমি বললাম, তাহলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে কোনো শুকনো মরিচের আড়ৎদারকে বিয়ে করো। কোনো স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক বা লেখকের পক্ষের এত টাকা রোজগার করা সম্ভব নয়। অনিতা বললো, ছাড়ো তোমার বালের সাংবাদিকতা, হেডার লেখালেখি।

আমি বললাম, এই তো পার্থক্য। আমার মাথায় স্যুররিয়ালিজম, তোমার মাথায় স্যান্ডউইচ এবং তোমার মায়ের মাথায় স্যুইমিংপুলের স্মৃতি।

অনিতা বললো, মানে?

আম বললাম, বইপত্র পড়ে অর্থোপার্জন হয়নি ঠিক-মগজটা এক ধরনের রাডার হয়ে গিয়েছে। রাডার যেমন বিমানের দিকে নির্ধারণ করতে পারে, আমিও ঠিক তোমার দিক নির্ধারণ করতে পেরেছি। তোমার মায়ের যেমন তিন সংসারেও সংসার হয়নি, তোমার তেমন সংসার হবে না। তোমার শরীরে তো তোমার মায়েরই রক্ত দুগ্ধ প্রবাহিত। তাই একটু অভাব দেখলেই বোমারু বিমানের মতো ক্ষেপে যাও। আমি তোমার মাথার বল্টু আটকে দেই আর তোমার মা সেই বল্টু খুলে দেয়। এমন অবস্থায় কি সংসার হয়? তোমার বোধোদয় আর হবে না- এতদিন আমি বৃথাই চেষ্টা করেছি। বাঁশি দিয়ে কী করে মানুষ-বাজিয়ে সুর তোলে। কিন্তু এই মুহুর্তে আমার হাতে একটি বাঁশি থাকলেও তা দিয়ে তোমাকে বেতের মতো বেত্রাঘাত করতাম। কারণ তোমার মায়ের বেলেল্লাপনা এত বলার পরও চোখে পড়ে না তোমার।

এই কথা বলার পর অনিতা করমচার মতো চোখ লাল করে বের হয়ে যায়। পরনে তখন ছিল তার সেই পলাশ ফুল লাল জামা। শূন্য অফিসে একা বসে থাকলাম আমি। তার কিছুক্ষণ পর থেকেই আবার লেখা শুরু করলাম রাখাইন যুবতী অনিতা এবং মাকুর গল্প। সাগরমাতৃক অনিতা তালুকদারের সুডৌল দেহ এখন নকশী কাঁথার নকশা হয়ে গেছে।

রচনা: ফেব্র“য়ারি-২০০২

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.