নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘বর্ষা’ যেন ‘বর্শা’ না হয়ে যায়

১৫ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ৮:২৬



জসীম উদ্দিন অসীম

‘বর্ষা’ কেমন আছে ? সে কি ভালো আছে ? আমরা কি তাকে ভালো রেখেছি ? একমাত্র উত্তর-না। অথচ যেখানে বর্ষা নেই, বৃষ্টি নেই, জল নেই , সেখানে সবুজ নেই, মানুষ নেই, নেই কোনো মরালগামিনীর প্রেম নিবেদন। নেই কোনো প্রেমিক পুরুষ। তাই কবি গেয়ে উঠেন ‘বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি তোমারি এ দ্বারে...।’

আমাদের এই অঞ্চল মানবজাতির বর্ষণমন্দ্রিত গৌরবময় ঐতিহ্যেরই অংশ। সেটা বিভিন্ন কারণে। এই যে আমরা ময়নামতির গৌরবগাঁথায় এত মুগ্ধ , তা প্রাচীনকালেই নান্দনিক এক নগরী ছিল। আজকের ময়নামতির বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসস্তুপ দেখে তা যথাযথভাবে নির্ধারণ করা যাবে না। শুধু কি তা-ই? ইতিহাসের আগেও যেমন ইতিহাস থাকে , তেমনি ময়নামতি নগরীর আগেই এখানে ছিল আরেক নগরী-‘জয়কর্মান্ত বসাক’। আমরা সেইসব ঐতিহ্যের উত্তরসূরিতা যথাযথভাবে বহন করতে পারিনি। এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। কারণ উত্তরসূরীতা বহন করতে চর্চা লাগে , যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। সেখানে আমাদের বর্তমান অবস্থান বড়ই ফাঁপা।

আমাদের এই অঞ্চলে সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাসের মতো অসম্ভব প্রতিভার জন্ম না হলেও এই অঞ্চল সাহিত্য-শিল্পেও অনুর্বর ছিল না। কিন্তু আজ বাণিজ্যমূল্যের নিরুপায় চাপে সাহিত্যমূল্য বড়বেশি সংখ্যালঘু। সাহিত্য সংখ্যালঘু, কবিতা সংখ্যালঘু, সংখ্যালঘু কবি। তাই কবি মীর্জা মোহাম্মদ রফিকে বাদশাহের সাথে বিবাদ করে রাজদরবার ছাড়তে হয়। উর্দুভাষার কবি মীর তকি মীরসহ উপমহাদেশের অনেক কবিকেই আত্মসম্মান রক্ষার্থে নবাবের দরবার ত্যাগ করে দারিদ্রে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

দারিদ্র আমাদের বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সর্বোচ্চ শিক্ষিত লোক হয়েও বারবার চাকুরি ছেড়েছেন তিনি। এই ক্ষেত্রে উর্দু ভাষার কবি মীর তকি মীর কিংবা সৈয়দ ইনশা আল্লাহ খাঁ-র নবাবের কোপদৃষ্টিতে পড়ে মৃত্যুবরণের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের চাকুরি ছেড়ে বেকার হয়ে নৈরাশ্যের কোনো এক সন্ধ্যালগ্নে কলকাতার রাস্তায় ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণের বিষয়টি ভীষণ সমান্তরাল।

আশ্চর্যের বিষয়, বাংলা কবিতার এই রাজা , জীবনানন্দ দাশ বর্ষাকে ভীষণভাবেই উপেক্ষা করে গেছেন, যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রেমের কবিতাকে। কিন্তু কেন? বর্ষা মানে কি শুধুই জল? জল মানে কি জলোচ্ছ্বাস? নৌকাডুবি? বন্যা? আর কিছু নয়?

এ কথা ঠিক যে জলে-জলোচ্ছ্বাসে প্রতিবছরই বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। ১৯৭০ সালের (১২ নভেম্বরে) জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারায় বাংলাদেশের ১০ লাখ লোক। এই প্রাণহানি অব্যাহত রয়েছেই। কিন্তু বর্ষাকে কতোভাবেই না বন্দনা করেছেন রবীন্দ্রনাথসহ ও অন্যান্য কবিগণ। সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও কবি কালিদাস খ্রীস্টিয় ২য় শতক থেকে চতুর্থ শতকের মানুষ। তার ‘মেঘদূত’ কাব্যগ্রন্থে বর্ষাকে যেভাবে পাওয়া যায়, রবীন্দ্রনাথ তার সর্বোচ্চ উপলব্ধি করেছেন। ‘কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে...যাসনে ঘরের বাহিরে।’

বাংলা সনের আষাঢ় ও শ্রাবণ-এই দুই মাস নিয়েই হলো বর্ষাকাল। মূলত এ ঋতু বৃষ্টির ঋতু। বৃষ্টিপাতে বৃষ্টিপাতে বাংলার আর কোনো ঋতু এমন সয়লাব হয় না। হরেকরকম ফুল ফোটে এই ঋতুতে। বিশেষ করে কদমের তো তুলনাই নেই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান, আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।...’ আদিকবি বাল্মীকির পরেই সংস্কৃত সাহিত্যে যেই কালিদাসের নাম, সেই মহাকবি কালিদাস লিখলেন,‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং

বপ্রক্রীড়া পরিণত গজপ্রেক্ষনীয়ং দদর্শ”

আষাঢ়ের প্রথম দিনে একদা সে নত দেহে বপ্রক্রীড়ারত গজের ন্যায় প্রেক্ষনীয় গিরিতট-সংলগ্ন একখন্ড মেঘ দেখতে পেল।

‘মেঘদূত’ কাব্যের পূর্বমেঘ খ›েডর প্রথম শ্লোকেই রামগিরি আশ্রমের তরু-ছায়াস্নিগ্ধ সেখানকার জল জনকতনয়া সীতার আনন্দ জলধারায় পবিত্র নবীন মেঘের পরিচয় পাওয়া যায়।

‘কশ্চিৎ কান্তা বিরহগুরুণা স্বাধিকার প্রমত্ত

শাপেনাস্তং গমিত মহিমা বর্ষ ভোগ্যে ণভর্তু।

যক্ষশ্চক্রে জনকতনয়া স্নান পূণ্যোদকেষু

স্নিগ্ধচ্ছায়া তরুষু বসতিং রামগির্যা শ্রমেষু’

অথবা

‘মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহ পন্যথাবৃত্তি চেত:

কণ্ঠাশ্লেষ প্রণয়িনি জনে কিং পুনর্দূর সংস্থে ’

নবীন মেঘ দেখে সুখীজনও যেখানে অন্যমনা হয়ে পড়ে, আর যার কণ্ঠালিঙ্গনকামী জনদূরে, তার তো কথাই নেই।

বাংলা কাব্যের মধ্যযুগের কবিরাও বর্ষার বিভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু ঐ যে মহাকবি কালিদাস, তাকে বাংলা কবিতার পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত করিয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথ। আর জীবনানন্দ দাশ, যার কবিতায় বর্ষা প্রায় অনুপস্থিত, তিনিও যেন মহাকবি কালিদাসের প্রভাব অস্বীকার করতে পারেন না। তিনি যখন তার বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতাসেন’-এ বলেন, ‘মুখ তার স্রাবস্তীর কারুকার্য, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’ তখন পরিষ্কার হয়ে যায় তার কাব্যেও ‘মেঘদূত’-এর প্রভাব কতো গভীর।

বর্ষার এই মেঘ দেখে কেবল কালিদাস নন, রবীন্দ্রনাথও রীতিমত অশ্র“পাতই করেন।

‘সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণধারা

অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশহারা

চেয়ে থাকি যে শূন্যে অন্যমনে

সেথায় বিরহিনীর অশ্র“ হরণ করেছে ওই তারা...’

এই গানের সুর যিনি শ্রবণ করেছেন, তিনিই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন।

এই যে বর্ষা, এই যে আষাঢ়-শ্রাবণ, এ নিয়ে আমাদের সব কবি তো সব যুগে মশগুল ছিলেনই, কিন্তু এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-নজরুল যেন কয়েকধাপ এগিয়েই। রবীন্দ্রনাথের লেখায় শ্রাবণ এসেছে বিভিন্নভাবে। যেমন-শ্রাবণের ধারার মতো পড়–ক ঝরে/ পড়–ক ঝরে, তোমারি সুরটি আমার মুখের’ পরে, বুকের পরে। (কেতকী)

অথবা

শ্রাবণের পবনে আকূল বিষন্ন সন্ধ্যায়

সাথীহারা ঘরে মন আমার

প্রবাসী পাখি ফিরে যেতে চায়

দূরকালের অরণ্য ছায়াতলে (স্বরবিতান-৫৩)

অথবা

শ্রাবণ বরিষণ পার হয়ে/ কী বীণা আসে ওই রয়ে রয়ে। (গীতমালিকা-১)

অথবা

শ্রাবণ মেঘের আধেক দূয়ার ওই খোলা

আড়াল থেকে দেয় দেখা কোন পথ-ভোলা (নবগীতিকা-২)

অথবা

আষাঢ় শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে,

মেঘ আঁচলে নিলে ঘিরে”

সূর্য হারায়, হারায় তারা আঁধারে পথ হয় যে হারা,

ঢেউ দিয়েছে নদীর নীরে (কেতকী)

অথবা

শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়,

ক্ষণে ক্ষণে শর্বরী শিহরিয়া উঠে, হায়” (স্ববিতান-৫৩)

অথবা

শ্রাবণের বারিধারা ঝরিছে বিরামহারা

বিজন শূন্য-পানে চেয়ে থাকি একাকী।

দূর দিবসের তটে মনের আঁধার পটে

অতীতের অলিখিত লিপিখানি লেখা কি।

কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় শ্রাবণ এসেছে আরেক মাত্রায়।

যেমন-

শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে

বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে

অথবা

রিমঝিম রিমঝিম ঝরে শাওনধারা

গৃহকোনে একা আমি ঘুমহারা

অথবা

শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলনা

বরষা ফুরায়ে গেল, আশা তবু গেল না।

জীবনানন্দের লেখায়ও রয়েছে শ্রাবণ বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন রঙে।

যেমন-

‘শ্রাবণের গভীর অন্ধকার রাতে

ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙ্গে যায়

কোথায় দূরে বঙ্গোপসাগরের শব্দ শুনে” (শ্রাবণরাত-মহাপৃথিবী)

স্বপ্নের বাংলার এ শ্রাবণের বৃষ্টি ধারায় কেবল শিল্পীরাই নয়, বাংলাপাগল রাশি রাশি মানুষও মুগ্ধ হয়। বাংলর মন ভুলানো শ্রাবণ-মন ভুলানো নদী দেখে পাগল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ নদীমাতৃক বাংলায় জন্ম নিয়ে কৈশোরে কেউ জানালা খুলে নদী দেখে না কিংবা আষাঢ়ের শ্রাবণের অবিরাম বৃষ্টিধারা দেখে না, এমনটি প্রায় অসম্ভব। আষাঢ়ের শ্রাবণের শহরে গ্রামে বৃষ্টির তালে তালে জমে ওঠে আড্ডা, কোথাও হয় সংগীতের আয়োজন। তবে বর্ষা এখন আর তেমন আনন্দের নয়। বর্ষায় আগুনের আতঙ্ক না থাকলেও আতঙ্ক রয়েছে অনেক। বর্ষায় বৃষ্টির জন্য খেলা বন্ধ থাকে। বন্যায় ফসল প্লাবিত হয়, শুষ্ক মৌসুমের শীর্ণ যমুনা হিংস্র রূপ ধারণ করে। বেকার যুবক-যুবতী ও শ্রমিকের সময় কাটতে চায় না। গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ জায়গায় যাতায়াতে দুর্ভোগ বাড়ে। যমুনার ভাঙ্গন বাড়ে, বাড়ে লঞ্চডুবিসহ অন্যান্য নৌ-দুর্ঘটনা। আষাঢ়ে-শ্রাবণে দেশের অধিকাংশ শহরে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। বিশেষ করে বর্ষার বৃষ্টিঘন দিনের জলাবদ্ধ ঢাকায় দেশের যে কোন স্থান থেকে কেউ এসে যদি রাজপথের মরণফাঁদ ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলে পড়ে যান, তবে তার দ্বারা আর “ঢাকা শহর আইস্যা আমার পরান জুড়াইছে” গান গাওয়া সম্ভব নয়। কারণ ‘বর্ষা’ এখন ক্ষেত্র বিশেষে ‘বর্শা’তেও রূপ নিয়েছে। বৃষ্টির পানির নীচের খোলা ম্যানহোলে যে একবার ডুবেছে, সেই বুঝেছে বিষয়টি। আমরা বর্ষাকে খুন করছি, বর্ষাও তাই বর্শা হাতে নিয়ে রীতিমত যেন প্রস্তুত। তাই আজকাল বর্ষাকালে এত অনাসৃষ্টি। প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

‘আবার এসেছে আষাঢ়, আকাশ ছেয়ে

আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে...’

কিন্তু আকাশ ছেয়ে যদি আষাঢ় না এসে উল্কাবৃষ্টি হতে থাকে, তাহলে উপায় কী? ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে, জানি নে জানি নে, কিছু তে কেন যে মন লাগে না...’ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। কিন্তু যে বুঝেনা ‘মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা’-তার কাছে বৃষ্টি হলো মানুষকে খুন করার উপযুক্ত লগ্ন।

বর্ষার আছে সুখ, বর্ষার আছে দু:খ। বর্ষা যেমন মুগ্ধ করে, কখনো বিরক্তিও আনে। বর্ষার সবুজ প্রকৃতি অপরূপা বাংলাকে আরও মুগ্ধকর রূপে উপস্থাপন করে। দিনের সূর্য-রাতের চাঁদ কিংবা তারা একবার মেঘে ঢাকে, আবার ওরা মেঘের ঘোমটা থেকে নিজেদের বের করে আনে। বর্ষার বাংলা মন ভুলানো এক বাংলা। যাদের সবুজের প্রতি ভালোবাসা আছে, তাদের কাছে বর্ষাকাল প্রেমিক-প্রেমিকার মতো। কারণ বর্ষা বাংলা প্রাণের ঋতু। এজন্য যে, এই বর্ষাকালেই চৈত্র গ্রীষ্মের প্রচন্ড উত্তাপের পর বাংলার মাটি বৃষ্টির পানি স্পর্শ করে। পানির অপর নাম জীবন। বর্ষার বৃষ্টির পানির স্পর্শে বাংলার প্রকৃতিকে প্রাণের জোয়ার আসে। বদলে যায় বাংলার রূপ-রস। বর্ষা নিয়ে বাংলার কবি সাহিত্যিকগণ অনেক সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। এ সৃষ্টির বয়স হাজার বছরেরও বেশী। সেই চর্যাপদ থেকে শুরু করে নদীমাতৃক বর্ষা মধ্যযুগ অতিক্রম করে এসে লেগেছে রবীন্দ্র-নজরুল হয়ে বর্তমানের কবি-সাহিত্যিকদের মনেও। রবীন্দ্রনাথ বর্ষা দেখে যেমন আনন্দিত হয়েছেন, তেমনি বর্ষার বিদায় দেখেও লিখেছেন ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’ এবং ‘ধৈর্য্য মানো ওগো, ধৈর্য মানো’র মতো আবেগপ্রবণ লেখা।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনাতেও বর্ষা এসেছে নানা মাত্রায়। নজরুলের প্রেম-বিরহের রচনাতে সংস্কৃত কবি কালিদাসের বর্ষামন্দ্রিত ‘মেঘদূতে’র প্রভাব পড়েছে। কালিদাসের কাব্যের নায়কের মতো যেন একই সুরে তিনিও বলেছেন ‘শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না’।

বাংলার বর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ পাগল হয়েছিলেন নানাভাবে। রবীন্দ্রনাথের বর্ষায় বাংলাদেশের বর্ষা সংস্কৃতির একটি মুগ্ধকর রূপ ফুটে উঠেছে। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে ‘বর্ষণমন্দ্রিত’ নানা পংক্তি, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ুরের মতো নাচেরে’ এবং ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।’

কিন্তু বর্তমানে বাংলার বর্ষার আর তেমন রূপ-রস নেই। বাংলার বর্ষা এখন আহত হয়েছে। বিবর্তিত হয়েছে বাংলার প্রকৃতি। বাংলায় এখন বৃষ্টি আর আগের মতো আসে না। বাংলার বর্ষা নিয়ে বর্তমানের কবি সাহিত্যকরাও রচনা করছেন ভিন্ন রকম রচনা। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বর্ষা হয়েছে দারুন উপেক্ষিত।

বাংলায় এখন বর্ষা আসে নান রঙে। কোনো কোনো বর্ষায় বৃষ্টি আসে কৃপণের বেশে। কখনো বা বৃষ্টি আসে অনাবৃষ্টি হয়ে। ফলে প্লাবিত হয় বাংলাদেশ। হাহাকার উঠে ঘরে ঘরে। কখনো বা কৃপণ বৃষ্টির কারণে খরা এসে প্রবেশ করে বর্ষার বুকে। এমন শুস্ক নির্জীব বর্ষাকে দেখেই হয়তো বাংলাভাষার আরেক কবি বলে উঠেন, ‘এক খন্ড মেঘ ধার দিতে পারো গোবি সাহারাকে?’ এ বাংলাদেশ বর্ষাকালেও গোবি কিংবা সাহারা হয়ে উঠে। তাই কখনো কখনো বর্ষাকালেও বাংলার মানুষ বৃষ্টি ভিক্ষা চায়-‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই আল্লাহ মেঘ দে’। বাংলার বর্ষা এমনই বিপর্যস্ত আজকাল।

বাংলার বর্ষাকে ফিরে পেতে হলে পরিবেশের দিকে আবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। একসময় আমাদের বনভূমি ছিল তিরিশ শতাংশ। তা বর্তমানে নয় শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এমন হলে তো বর্ষার চেহারা পরিবর্তিত হবেই-বর্ষার কী দোষ। দোষ আমাদের। আমরাই আমাদের পরিবেশকে নিরবে-নিভৃতে খুন করে চলেছি।নদীমাতৃক বাংলার অনেক নদীও এখন মরে যাচ্ছে। মাতৃরূপা নদী মরে গেলে সন্তানরূপী বাংলার কী হবে?

আমাদের সচেতন হতে হবে এখনই। এখনই বৃক্ষরোপণ করতে হবে। এখনই বাংলার বর্ষার কদমফুল-নদীমালাকে রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা ভাবতে হবে। তা না হলে বর্ষা আর বাংলার কবি সাহিত্যিকদের গৌরবের বিষয় থাকবে না। নদীমালা ডেকে আনবে বন্যা-বৃষ্টির স্থান দখল করবে উত্তাপের আগুন। যে বর্ষাকে আমরা বাংলার প্রাণ বলি, অবহেলায় অবহেলায় সেই বর্ষা, ‘বর্শা’ হয়ে ফিরে এসে বাংলাকেও বর্শাবিদ্ধ করতে পারে। এই সোনার বাংলাদেশ, যেখানে ফুটে নীল অপরাজিতা ফুল, যে দেশের পথে পথে আকন্দ গাছ এমনিতেই জন্মায়, কদম ফুলের সৌরভে যেই দেশ যুগে যুগেই গর্বিত, কলমিলতায় ভরপুর যেই দেশ, কামিনী ফুলের উন্মাদনায় যেই দেশটা ঋদ্ধ, কেতকী আর গন্ধরাজ, চন্দ্রমল্লিকায়, চালতাগাছে আচ্ছন্ন যেই দেশ, সেই পানকৌড়ির দেশটা যেন অযতেœ নষ্ট না হয়ে যায়। বর্ষাকে যেন প্রতিশোধ নিতে বাধ্য না করি। সে যেন তার হাতে বর্শা তুলে জুঁই ফুল গাছ, টগর, নাগকেশর ফুল কিংবা ডাহুক পাখিকে হত্যা না করে বসে।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.